মেহরে নবুওয়ত
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক
স্বয়ং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমাকে এজন্য নবী বানিয়েছেন যেন আমি নেক আমল ও উত্তম আখলাককে পূর্ণতা দান করি।’
উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা.কে জিজ্ঞাসা করা হল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখলাক কেমন ছিল? তিনি উত্তরে বললেন, ‘তাঁর আখলাক তো ছিল কুরআন।’ উদ্দেশ্য হচ্ছে, বৃক্ষকে ফল দ্বারা এবং ব্যক্তিকে তার শিক্ষার দ্বারা চেনা যায়। তোমরা যদি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানতে চাও তবে কুরআন মজীদ পড়, তাঁকে জানতে পারবে। (আর, তিনি তো ছিলেন কুরআনেরই বাস্তব রূপ।)
কুরআন মজীদ তাঁকে রাহমাতুল্লিল আলামীন বলেছে। আর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, তাঁর অস্তিত্বই জগৎবাসীর জন্য আল্লাহর রহমত।
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পরিচয় এভাবে দেওয়া হয়েছে যে, তিনি সৃষ্টির জন্য আল্লাহর সাক্ষী। অনুগতদেরকে সুসংবাদ দান করেন এবং অবাধ্যদেরকে সাবধান করেন। পথিক-পরবাসীর তিনি আশ্রয়স্থল।
তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। সকল বিষয়ে আল্লাহর প্রতি সমর্পিত। তাঁর স্বভাব সকল কাঠিন্য থেকে মুক্ত। তাঁর কথাবার্তায় রুক্ষ্মতা নেই, চিৎকার করে কথা বলেন না। মন্দের বিনিময় মন্দ দ্বারা দেন না। জাতি ও ধর্মসমূহের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর করে এক আল্লাহর ‘ওয়াহদানিয়্যাত’ কায়েম করা তাঁর দায়িত্ব। তাঁর শিক্ষা অন্ধকে দান করে চোখের জ্যোতি, বধিরকে দান করে শ্রবণশক্তি, আর গাফিল অন্তরের উপর থেকে সরিয়ে দেয় গাফলতের পর্দা। তিনি সর্বগুণে গুণান্বিত। স্থিরতা তাঁর ভূষণ, পরোপকার তাঁর পরিচয় এবং তাকওয়া তাঁর অন্তকরণ। তার বাণী হিকমতের আঁধার, সত্যবাদিতা ও ওফাদারী তার স্বভাব, ক্ষমা ও অনুগ্রহ তার চরিত্র, ইনসাফ তাঁর জীবনাদর্শ, সততা তাঁর শরীয়ত এবং হিদায়েত তাঁর পথপ্রদর্শক।
তাঁর মিল্লতের নাম ইসলাম এবং আহমদ তাঁর নাম। তিনি গোমরাহীর যুগে হিদায়েতের মিনার, জাহালাতের যুগে ইলমের আলো।
যারা ছিল বিশ্বে অখ্যাত ছিল তিনি তাদের খ্যাতি দান করেছেন এবং স্বল্পতার পরিবর্তে প্রাচুর্য এবং অসচ্ছলতার পরিবর্তে সচ্ছলতা আনয়ন করেছেন।
আল্লাহ তাআলা তাঁর মাধ্যমে অনৈক্য দূর করেছেন এবং বিদ্বেষ-বিভক্তি-জর্জরিত অন্তরকে প্রেম ও ভালবাসায় পূর্ণ করে দিয়েছেন।
তিনি মানব মনের সকল কামনাকে আল্লাহমুখী করেছেন এবং শতধা বিভক্ত জাতিকে আখিরাতমুখী করেছেন। তাঁর উম্মত সর্বশ্রেষ্ঠ উম্মত। তাদের দায়িত্ব মানবজাতির পথ প্রদর্শন।
ধৈর্য্য ও সহনশীলতা
১. তায়েফবাসী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে পাথর মেরে এত যখমী করল যে, তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। ফেরেশতা এসে বললেন, আদেশ করুন এই বসতি ধ্বংস করে দেই! নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না, না। এরা যদিও ইসলাম গ্রহণ করেনি, কিন্তু হয়তো একদিন এদের সন্তানরা ইসলাম গ্রহণ করবে।
২. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এক ইয়াহুদীর কিছু পাওনা ছিল। পাওনা আদায়ের নির্ধারিত সময়ের তখনো কয়েক দিন বাকি। কিন্তু ইয়াহুদী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জামা ধরে বলল, ‘আমার পাওনা আদায় কর।’ হযরত উমর ফারুক রা. রাগান্বিত হয়ে বললেন, ‘এই বেআদবকে কতল করা উচিত।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না; বরং তুমি আমাকে উত্তমভাবে পাওনা আদায়ের আদেশ কর আর তাকে বল উত্তমভাবে তাগাদা দিতে।’ এরপর ওই ইয়াহুদীর দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, এখনো তো কয়েক দিন বাকী।
৩. এক বেদুইন এসে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর চাদর ধরে এত জোরে টান দিল যে, ঘাড়ে লাল দাগ হয়ে গেল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দিকে তাকালেন। বেদুইন বলল, ‘আমাকে সাহায্য কর, আমি একজন দরিদ্র ব্যক্তি।’ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামকে আদেশ করলেন তাকে যেন যব দ্বারা পূর্ণ একটি উট ও খেজুর দ্বারা পূর্ণ একটি উট দান করা হয়।।
বিনয় ও ভদ্রতা
১. লোকদের সামনে কখনো পা ছড়িয়ে বসতেন না।
২. তাঁর সম্মানার্থে দাড়াতে সাহাবীদেরকে নিষেধ করতেন।
৩. কেউ দস্ত মুবারক ধরলে তিনি তা ছাড়িয়ে নিতেন না।
৪. কারো কথা কর্তন করতেন না।
৫. নিজে সওয়ার অবস্থায় সঙ্গীকে পায়দল চলতে দিতেন না। হয় তাকেও নিজের সঙ্গে সওয়ার করে নিতেন কিংবা তাকে বিদায় দিতেন।
একদিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খচ্চরের উপর সওয়ার ছিলেন। তাতে কোনো রেকাব ছিল না। পথিমধ্যে আবু হুরায়রা রা.কে দেখে বললেন, ‘সওয়ার হও।’ তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ধরে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করলেন, কিন্তু সওয়ার হতে পারলেন না। উপরন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেও পড়ে গেলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উঠে সওয়ার হলেন এবং দ্বিতীয়বার হযরত আবু হুরায়রা রা.কে সওয়ার হতে বললেন। হযরত আবু হুরায়রা এবারও সওয়ার হতে পারলেন না, আর তার ধরার কারণে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়ে গেলেন। এরপরও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিরক্ত না হয়ে সওয়ারীতে উঠলেন এবং তৃতীয়বার হযরত আবু হুরায়রা রা.কে সওয়ার হতে বললেন। হযরত আবু হুরায়রা রা. লজ্জা পেয়ে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি তো উঠতে পারছি না। আপনাকে আর কয়বার কষ্ট দিব!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)