ওয়ালিদ ছাহেবের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মাদরে ইলমীর উদ্দেশে কয়েক ঘন্টার সফর
আমার মাদরে ইলমী হচ্ছে, খেড়িহর গ্রামের ‘মাদরাসায়ে আরাবিয়া’ (শাহরাস্তি, চাঁদপুর)। নূরানী কায়দা থেকে মিশকাত জামাত পর্যন্ত (এটাই এ মাদরাসার সর্বোচ্চ জামাত) আমার পড়াশোনা সেখানেই হয়েছে। আমার ওয়ালিদ হযরত মাওলানা শামসুল হক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম সেখানে দীর্ঘ দিন পর্যন্ত তাদরীসের খিদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। মাদরাসার ইহতিমামের যিম্মাদারীও তাঁর উপর ছিল।
গত ২৩ জুমাদাল উলা ১৪৩০ হি. (১৯ মে ২০০৯) মঙ্গলবার আববাজানের ইয়াদত ও যিয়ারতের উদ্দেশ্যে বড় ভাইজানের সঙ্গে খেড়িহর মাদরাসায় কয়েক ঘন্টার একটি সংক্ষিপ্ত সফরের সুযোগ হয়েছিল।
হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ বলেন, মা যদি জীবিত থাকেন তাহলে কোথাও যাওয়ার সময় তাঁর অনুমতি নিয়ে এবং আফিয়াত ও সালামতের জন্য দুআ চেয়ে বের হওয়া উচিত।’
তাঁর কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, একদিকে তা আদব ও ইহতিরামের দাবি। অন্যদিকে (তাঁর অভিজ্ঞতা অনুযায়ী) এর ওসীলায় আল্লাহ তাআলা পথের বিভিন্ন বিপদাপদ থেকে নিরাপদ রাখেন।
তাঁর এই নির্দেশনা অনুযায়ী আম্মাজান (আল্লাহ তাআলা তাঁকে আফিয়াত দান করুন এবং তাঁর ছায়া আমাদের উপর আরো দীর্ঘ করুন।) এর কাছ থেকে ইজাযত নিলাম এবং দুআর দরখাস্ত করলাম। এরপর আল্লাহ তাআলার উপর ভরসা করে রওয়ানা হলাম। বিদায়ের সময় সাথীরা হাদীস শরীফের এই দুআগুলো পড়ে বিদায় জানাল :
استودع الله دينك وأمانتك وخواتم عملك.
(মুসনাদে আহমদ ২/৭; সুনানে তিরমিযী ২/১৮২)
অর্থ : আমি আপনার দ্বীন, আমানত ও সর্বশেষ আমলসমূহ আল্লাহর সোপর্দ করছি।
استودع الله الذي لا تضيع ودائعه.
(মুসনাদে আহমদ ২/৪০৩)
অর্থ : আমি আপনাকে আল্লাহর হেফাযতে সমর্পণ করছি, যার হেফাযত গ্রহণকারী কখনো ক্ষতিগ্রস্ত হয় না।
এজাতীয় দুআ যদি সফরের সম্বল না হয় তাহলে পুরো পথ অস্থিরতার মধ্যে কাটতে থাকে। এ দুআগুলো বিদায়ী ব্যক্তি এবং বিদায় দানকারী দু’জনই পড়তে পারে।
গাড়ি খেড়িহরের দিকে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি চলে গিয়েছিলাম আমার শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোতে। সেই সময়ের উদাসীনতা, অসর্তকতা ও দুর্বলতাগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। সেই সাথে আসাতিযায়ে কেরামের ধৈর্য্য ও সহনশীলতা এবং পিতৃসূলভ স্নেহের আচরণগুলোও স্মৃতির আয়নায় দৃশ্যমান হচ্ছিল। নিজের অবস্থার জন্য ইস্তিগফার পড়তে পড়তে এবং আসাতিযায়ে কেরামের শুকরিয়া আদায় করতে করতে কৃতার্থ চিত্তে মাদরাসায় উপস্থিত হলাম এবং ওয়ালিদ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম-এর খেদমতে হাযির হলাম। অনেকক্ষণ তাঁর নিকটে বসে পিতৃস্নেহের স্বাদ উপভোগ করলাম। পরে অন্য উস্তাদদের সঙ্গে মোলাকাত করলাম।
উত্তর পার্শ্বের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় পূর্বদিকের তিন নম্বর কামরায় আমাদের উস্তাদ হযরত মাওলানা হানীফ ছাহেব (যিনি খেড়িহরেরই বাসিন্দা ছিলেন) থাকতেন। তাঁর নিকট আমরা তা’লীমুল ইসলাম পড়েছি। আমার এখনো মনে আছে, যখন সেই কিতাবে আযানের আলোচনা এল তখন তিনি আমাদের সবাইকে আযান মশক করিয়েছিলেন। এখন তিনি আল্লাহর সান্নিধ্যে চলে গেছেন। বিগত সফরে তাঁর কবর যিয়ারতের সৌভাগ্য হয়েছিল।
এখন ঐ কামরায় হাফেয মাওলানা মুফাযযল ছাহেব (যীদা মাজদুহুম) থাকেন। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে দেখলাম, তাঁর খাটের পশ্চিম পার্শ্বে তাকের মধ্যে পুরানো ও পোকায় খাওয়া অনেকগুলো কিতাব। আমি কিতাবগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ‘বৃদ্ধদের কাছ থেকে এগুলো সংগ্রহ করেছি, যাতে কিতাবগুলো সংরক্ষিত থাকে এবং এর দ্বারা অন্যরাও উপকৃত হয়। কিন্তু বাস্তবে আমি কিছুই করতে পারিনি।’ তাঁর কাছে মিশকাত জামাতেরও দরস রয়েছে। এজন্য তালিবে ইলম ভাইদের কাছে আরয করলাম, হিদায়া ও মিশকাত জামাত পর্যন্ত পৌঁছার পরও যদি কিতাবের সঙ্গে মুহববত পয়দা না হয় তাহলে আর কবে হবে? আমাদের আকাবিরের তো শৈশবেই কিতাবের সঙ্গে মুহববত পয়দা হয়ে যেত। হযরত মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. তাঁর শৈশবে, যখন কান্নাই হয় বাচ্চাদের একমাত্র হাতিয়ার, কান্নাকাটি করে কাযী সুলাইমান মনসুরপুরী রাহ.-এর বিখ্যাত সীরাত-গ্রন্থ ‘রহমাতুল্লিল আলামীন’ (পূর্ণ ৩ খন্ড) আদায় করে নিয়েছিলেন।
আমি আরয করলাম, এই কিতাবগুলোর করুণচিত্র স্পষ্টভাবে বলছে যে, কিতাবের প্রতি আমাদের কোনো মুহববত নেই। ইজাযত নিয়ে আমি কিতাবগুলোর পাতা উল্টিয়ে দেখলাম। সংগ্রহে রাখার মতো বিশটিরও অধিক কিতাব পাওয়া গেল, যার মধ্যে কোনো কোনোটা ছিল একাধিক রিসালার সমষ্টি।
হযরতের অনুমতি নিয়ে কিতাবগুলো আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। যাতে এগুলো ফটোকপি করে সংরক্ষণ করা যায় এবং মূলকপি বাঁধাই করে মালিকের নিকট ফিরিয়ে দেওয়া যায়। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দান করুন। আমীন।
কিতাব যদি তালিবে ইলম ভাইদের সামনেই থাকে, তাদেরকে দেখতে ও পড়তে নিষেধও করা না হয়, এরপরও যদি তারা অধ্যয়ন না করে তাহলে তাদের ‘তালিবে ইলম’ নাম ধারণ করার অধিকার কীভাবে থাকে?
বিশেষ করে পুরোনো কিতাবের প্রতি তো এমনিতেই আকর্ষণ থাকার কথা। ধরুন, একশ বছর আগের কিছু কিতাব যদি আপনার হাতে আসে তাহলে এগুলো নাড়াচাড়া করার দ্বারা সেই সময়ের ইতিহাস ও পরিবেশ-পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। আর এটুকুইবা কম কী যে, অতীতের একটি নিদর্শন হাতে নিয়ে আপনিও ফিরে যাবেন অতীতের কোলে। একটি স্মৃতিচিহ্ন হাতে নিয়ে যদি এই ভাবনা অন্তরে পয়দা হয় যে, সেই সময়ের নির্দশন আমার সামনে আর তার মালিক কবরে শায়িত এবং এতে দিলের মধ্যে বিশেষ কোনো অবস্থা যদি সৃষ্টি হয় তাহলে তাও এক বিরাট নেয়ামত।
এই কিতাবগুলোর মধ্যে মাসিক আলফুরকানের দুটি সংখ্যা ছিল। তালিবে ইলম ভাইয়েরা যদি শুধু এই সংখ্যা দুটিতে চোখ বুলাত তাহলেও ইলমের এক খাযানা বিনা শ্রমে পেয়ে যেত। উদাহরণস্বরূপ রবীউল আউয়াল ১৩৫৯ হিজরীর সংখ্যা খুললে প্রথম পৃষ্ঠার শুরুতেই নযরে পড়ে মাসিক আলফুরকান, বেরেলী খন্ড-৭ নং-৪ আর শেষে ‘তত্ত্বাবধানে-মৌলভী মুহাম্মাদ মনযূর নু’মানী ...।’
শুধু এতটুকু দেখলেই অনুমান করা যায়, বিগত শতকের মাঝামাঝি সময়ে হযরত মাওলানা মনযূর নু’মানী রাহ. মাসিক আলফুরকানের মাধ্যমে দ্বীনের কী বিরাট খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন। আর যদিও পরবর্তীতে আলফুরকান লক্ষ্ণৌ থেকে বের হত, কিন্তু তখন বের হত বেরেলী থেকে। আলফুরকান প্রথম প্রকাশিত হয় ১৩৫৯ হিজরীতে। প্রথম পৃষ্ঠাতেই ওই সংখ্যার বিষয়বস্ত্তর সূচি রয়েছে। বিষয়বস্ত্তর বাইরে প্রবন্ধকার/নিবন্ধকারদের নামগুলোও নবীন তালিবে ইলমদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। একটি প্রবন্ধের শিরোনামের পরে হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর নাম লেখা। রুচিশীল তালিবে ইলম এটা দেখে সচকিত হবে না তা তো হতেই পারে না। সে ভাববে, সে সময়ে হযরত থানভী রাহ. জীবিত ছিলেন? তিনিও মাসিক পত্রিকায় লিখতেন? নাকি এখানে অন্য কোনো বিষয় আছে? তৃতীয় প্রবন্ধের লেখকের নাম ‘মাওলানা আবদুল মাজেদ দরিয়াবাদী, এডিটর, সিদ্ক, লক্ষ্ণৌ’। এতে দরিয়াবাদী রাহ.-এর নামের সাথে মাসিক ‘সিদক’-এর সাথেও পরিচয় হয়ে যায়। পঞ্চম শিরোনামের পর লেখা রয়েছে, মাওলানা সাঈদ আহমদ আকবরাবাদী, এম. এ., এডিটর, বুরহান দিল্লী’। এতে নদওয়াতুল মুসান্নিফীন, দিল্লীর মুখপত্র ‘মাসিক বুরহান’-এর পরিচয় পাওয়া যায়।
বিষয়বস্ত্তর সুচিপত্রের পরে বিভিন্ন কিতাবের বিজ্ঞাপন রয়েছে। অধিকাংশ কিতাবই এ যুগের তালিবে ইলমদের জন্য সম্পূর্ণ নতুন। ভেতরে প্রবন্ধগুলোতে যা রয়েছে তা থেকে কিছু হাসিল করা তো অতিরিক্ত ইলম। মোটকথা, আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শুধু ওলট-পালটের দ্বারাও অনেক তারীখী মা’লূমাত হাসিল হয়।
রজব ১৩৫৯ হিজরীর সংখ্যাটি দেখলে ঐ সময়ে হিন্দুস্তানের বড় বড় আলেমদের একটি জামাত, অগণিত প্রবন্ধের শিরোনাম, প্রায় অর্ধশত কিতাব ও সেগুলোর মুসান্নিফ সম্পর্কে অবগত হওয়া সম্ভব। এরপর যে সব তালিবে ইলমের ‘লিসানুন ছাউল’ ও ‘কলবুন আকূল’ রয়েছে তারা এই প্রাথমিক তথ্যের উপর ভিত্তি করেই ইলমের এক খাযানা হাসিল করে ফেলতে পারে।
কিন্তু আফসোসের বিষয় এই যে, আমাদের তালিবে ইলম ভাইদের মধ্যে ব্যাপক পশ্চাৎপদতা চলে এসেছে। মনে হয়, তারা যেন নিজেদের সোনালি অতীতের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী নয় এবং ইলমের প্রশস্ততা ও গভীরতা এবং দ্বীনের তাফাক্কুহ ও প্রজ্ঞা হাসিল করার আগ্রহ তাদের মধ্যে নেই!
আল্লাহ আমাদের মধ্যে আমাদের আসলাফের ন্যায় জযবা ও প্রেরণা পয়দা করে দিন। আমীন। #