একান্ত সাক্ষাৎকার : ‘আমরা পরাজিত হলেও প্রতারিত যেন না হই’
মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ
[মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ। দেশের প্রথিতযশা প্রবীণ আলেম সাহিত্যিক, আরবী সাহিত্যের নিবেদিত সাধক এবং তা’লীম-তরবিয়তের অঙ্গনে একজন নীবর সংস্কারক। প্রতিভা, পান্ডিত্য ও আকাবিরের আদর্শ অনুশীলনের অপূর্ব সমন্বয়ে উজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্ব। শিক্ষা ও সাহিত্যের সুনির্ধারিত কাজের মানচিত্র অতিক্রম করা তাঁর দেশ ও বিশ্বভাবনার জগতটাও ব্যাপক আলোকিত। সদ্য নির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামার আলোচিত কায়রো ভাষণের ওপর তাঁর ভাবনা ও প্রতিক্রিয়া জানতে মাসিক আলকাউসার গত ২১ জুন সন্ধ্যায় তাঁর একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। আলোচিত এই ভাষণ ও ভাষণ ইস্যুর ভেতর-বাহির নিয়ে একটি খোলামেলা, বাস্তবানুগ ও চতুর্কোণস্পর্শী আলোকপাত বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে এই সাক্ষাৎকারটিতে তিনি তুলে ধরেছেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন : শরীফ মুহাম্মদ ও মুহম্মাদ যাকারিয়া আবদুল্লাহ।]
শরীফঃ নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হোসেন ওবামা গত জুনের শুরুতে কায়রোতে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিয়েছেন তার পক্ষে ও বিপক্ষে অনেক কথা হয়েছে। এসম্পর্ক সাধারণভাবে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাচ্ছি।
মিছবাহঃ যারা পক্ষে বলছেন তাদের কথা হলো ওবামা মুসলিম বিশ্বের প্রতি আন্তরিক। এই প্রথম আমেরিকার পক্ষ হতে ইসরাইলের সমালোচনা করা হয়েছে এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতি বিভিন্ন অবিচারের কথা স্বীকার করা হয়েছে। সর্বোপরি মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে নতুন সম্পর্কে সূচনার অঙ্গিকার করা হয়েছে, ইত্যাদি।
যারা বিপক্ষে বলছেন তাদের কথা হলো তার ভাষণে কিছু শব্দের ফুলঝুরি ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি ওবামার ভাষণের পক্ষেও নই, বিপক্ষেও নই। আমি ইতিহাসের পক্ষে এবং মুসলিম উম্মাহর, বিশেষত নেতৃবর্গের বর্তমান মানসিকতার বিপক্ষে। আমরা বারবার আমেরিকার কাছে সমাধান চেয়েছি, আশ্বাস পেয়েছি এবং প্রতারিত হয়েছি। মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের মানসিকতা হলো, আমেরিকা আমাদের সমাধান দেবে। উম্মাহর চৌদ্দশ বছরের ইতিহাসে এটা কখনো হয়নি, কখনো হবে না। আমাদের সমস্যার আমরাই সমাধান করেছি, আমাদেরই করতে হবে। আমি অবাক হয়েছি, ঠিক একথাই বলেছেন একজন বৃটিশ সাংবাদিক। আলজাযিরার সাথে সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, সমস্যা এই যে, আরবরা কখনো মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়ায়নি। সমাধানের জন্য ওরা অন্যের মুখের দিকে চেয়ে থাকে।
ওবামার ভাষণ সম্পর্কে আমি শুধু বলতে পারি, আমাদের প্রতি তাদের নীতিতে কোন পরিবর্তন আসেনি, পরিবর্তন এসেছে শুধু কৌশলে।
শরীফঃ বিষয়টি একটু খোলাসা করবেন? সউদী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলছেন, আমেরিকা তার নীতি বদলাচ্ছে, এই আমেরিকাকে আগের আমেরিকা মনে হয় না?
মিছবাহঃ বেচারা আরবদের কথা যত কম বলা যায় তত ভালো। সউদী মন্ত্রী বলেছেন, ‘ওবামা কথা বলেছেন বিনয়ের সাথে, তাতে ক্ষমতার দম্ভ ছিলো না।’ তাতেই তিনি বুঝে নিলেন, এ আমেরিকা আগের আমেরিকা নয়! সরলতা আর কাকে বলে! আসল কথা, বুশের মত ওবামাও চান মুসলিম বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে মার্কিন ও ইহুদি স্বার্থ উদ্ধার করতে। বুশ ভাবতেন, মুসলিম শাসকদের ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি দিয়ে; হয় তুমি আমার পক্ষে, না হয় আমার বিপক্ষে, এভাবে তাদেরকে কাবু করলেই মুসলিম বিশ্ব কাবু হয়ে যাবে। তখন যারা ইহুদি-মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে আওয়ায তোলবে তাদের সন্ত্রাসী বলে সহজেই শায়েস্তা করা যাবে। কিন্তু বুশ বুঝতে পারেননি যে, এতে মুসলিম বিশ্বের জনগণ ফুঁসে ওঠবে এবং তারা ‘সন্ত্রাসীদের’ পাশে দাঁড়াবে। সেটাই হয়েছে, বুশ হুমকি-ধমকি দ্বারা মুসলিম বিশ্বের নেতাদের তো পক্ষে টেনেছেন, কিন্তু জনগণের ঘৃণা কুড়িয়েছেন। জনগণ চলে গেছে সশস্ত্র সংগ্রামের পক্ষে। ফলে ইরাকে ও আফগানিস্তানে মুজাহিদদের সমর্থনে বিপুল অর্থসম্পদ যেমন আসছে তেমনি আসছে ‘মানবসম্পদ’। ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমূদ আববাস তো আমেরিকার নিয়ন্ত্রণে, কিন্তু জনগণ হামাসের সঙ্গে।
ওবামা এখন মুসলিম বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন যে, তোমরা তো মহান জাতি, সন্ত্রাসের সঙ্গে তোমাদের কোন সম্পর্ক নেই। গুটিকতেক সন্ত্রাসীর কারণে পুরো জাতির বদনাম হতে পারে না। আসো, আমরা একত্রে সন্ত্রাস নির্মূল করি এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে মুসলিম বিশ্বের সমস্যার সমাধান করি। এভাবে বিভাজন সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। এককথায় বুশ ‘তারহীবের’ (হুমকির) পথ ধরে ভুল করেছিলেন, ওবামা ‘তারগীবের’ (তোষণের) পথ গ্রহণ করে সেটা সংশোধনের চেষ্টা করছেন।
যাকারিয়াঃ ওবামা তো তার ভাষণে মুসলমানদের অবদানের প্রশংসা করেছেন এবং অতীতে মুসলমানদের উপর অবিচার হয়েছে তাও স্বীকার করেছেন, এটা কি তার ভাষণের ইতিবাচক দিক নয়?
মিছবাহঃ আসলে ‘তারগীব ও তারহীব’ শব্দদু’টি মনে রাখলেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। গ্রামের প্রবাদ হলো, ‘শাশুড়ি বউয়ের গুণ গায়, তবে ভাত মেপে দেয়।’ উনিও স্বার্থ আদায়ের জন্য প্রশংসা করেছেন, কিন্তু ভাত দিয়েছেন মেপে মেপে। ইহুদিদের তিনি প্রশংসা করেননি, বরং মৃদু তিরস্কার করেছেন। কিন্তু দেয়ার সময় বলেছেন, ‘ইসরাইলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, এ সম্পর্ক ভাঙ্গা সম্ভব নয়।’ কিন্তু আরববিশ্ব বা মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক? সউদি আরব, মিশর, পাকিস্তান? স্বার্থের ব্যাঘাত হলে সম্পর্ক চ্ছিন্ন হতে পারে। অর্থাৎ এখানে ‘মাপা ভাত’। ইসরাইলের দিকে পুরো থালাটা, আর মুসলিম বিশ্বের জন্য একমুঠ।
আচ্ছা বলুন তো, তাদের সর্বোচ্চ ভবন আমরা বানিয়েছি, এ প্রশংসায় আমেরিকার কী ক্ষতি, আর আমাদের কী লাভ?
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবদান কী কারো স্বীকৃতির মুহতাজ? এটা তো ওবামার করুণা নয়! কিন্তু সম্পর্ক? সেটা তো তিনি পরিষ্কার বলে দিয়েছেন যে, ইহুদীদের সাথে সম্পর্ক ঠিক রেখে তোমাদের যতটুকু দেয়া যায় আমি দেয়ার চেষ্টা করবো। তবু যদি মুসলিম বিশ্বের নেতারা তার কথার তাৎপর্য না বোঝেন তো দোষ ওবামার নয়, দোষ আমাদের সরলতার।
তিনি মুসলিম বিশ্বের উপর অবিচারের কথা স্বীকার করেছেন! তিনি কি একবারও বলেছেন, ইরাকে মুসলিম গণহত্যার জন্য আমি দুঃখিত? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য জাপানের সম্রাট এখনো ক্ষমা প্রার্থনা করেন। ওবামা তো ‘দুঃখিত’ বলতেও রাজী নন। শুধু বলেছেন, ‘আমরা ইরাক যুদ্ধে নিজেদের ইচ্ছায় গিয়েছি, যা বিশ্বে চরম মতপার্থক্য সৃষ্টি করেছে।’ প্রতিটি শব্দ লক্ষ্য করুন। তার পর তিনি বলেছেন, ‘তদুপরি ইরাকী জনগণ সাদ্দামের অত্যাচারী শাসনের চেয়ে অনেক ভালো আছে।’ দশলাখ নিরপরাধ ইরাকী মুসলমানকে হত্যা করে তিনি বলছেন, ‘ভালো আছে!
শরীফঃ তিনি তো বলেছেন, ইরাক বা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করবেন।
মিছবাহঃ সময় কিন্তু বলেননি! নির্বাচনের সময় বলেছিলেন, এখন তা থেকে পিছিয়ে এসেছেন। এখন বলছেন, ‘আমরা প্রতিটি সৈন্যকে আনন্দের সাথে ফিরিয়ে নিতাম যদি নিশ্চিত হতাম যে, আফগানিস্তানে এবং এখনকার পাকিস্তানে কোন সহিংস উগ্রবাদী নেই যারা যত বেশী সম্ভব মার্কিনীকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু সেই পরিস্থিতি আসেনি।’
উগ্রবাদী কারা? তিনি কাদেরকে বোঝাতে চাচ্ছেন। অতীতেও প্রতিবাদী মুসলিম শক্তিকে সন্ত্রাসী বলা হয়েছে। সবখানেই তো মুসলমানরা মার খেয়ে চলেছে। মার খেয়ে রুখে দাঁড়ানোটা কি সন্ত্রাস এবং উগ্রবাদ? নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা অবশ্যই ঘৃণ্য কাজ, এটা সন্ত্রাস এবং আমরা তা সমর্থন করি না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইহুদিরা মারছে, ফিলিস্তিনীরা মারছে, মার্কিনীরা মারছে, ইরাকীরা মারছে। কে নির্ধারণ করবে কোনটি সন্ত্রাস, কোনটি সন্ত্রাস নয়?
যাকারিয়াঃ ওবামা বলেছেন, নাইন ইলাভেনের কারণে আমেরিকা আফগানিস্তানে হামলা চালাতে বাধ্য হয়েছে। এসম্পর্কে আপনি কী বলেন?
মিছবাহঃ যে কোনভাবে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা আমরা শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করি, সেটা আবুগরীব কারাগারে হলেও। কিন্তু প্রথম কথা হলো এটা কীভাবে হয়েছে, কারা করেছে, এসম্পর্কে তারা যদি এতটাই নিশ্চিত হয়ে থাকে তাহলে তদন্তের ফলাফল প্রকাশ করা হচ্ছে না কেন? তিনি বলেছেন, ‘আফগানিস্তানে আমরা বাধ্য হয়ে গিয়েছি।’ কীভাবে বাধ্য হলেন? আফগানিস্তানে একটি বৈধ সরকার ছিলো। সে দেশের আদালত বলেছিলো, অভিযোগের প্রমাণ দাখিল করো, প্রমাণ পেলে তোমাদের দাবী মেনে নেবো। এর চেয়ে উত্তম আইনের ভাষা আর কী হতে পারে? কিন্তু আমেরিকার এক কথা, জীবিত বা মৃত ওসামা বিন লাদেনকে আমাদের চাই। যদি বাঁচতে চাও, বিনা শর্তে তাকে আমাদের হাতে তুলে দাও। একটি দেশ, যত শক্তিশালী হোক, আরেকটি দেশকে এভাবে বলতে পারে? আমেরিকা যদি আইন ও যুক্তির ভাষায় অগ্রসর হতো তাহলে কল্পনা করুন আজ পরিস্থিতি কত ভিন্ন হতো! ওবামার ভাষায় ‘আমেরিকা তালেবানকে তাড়া করেছে’। ভালো কথা, তো তালেবানের করণীয় কী ছিলো? শুধু তাড়া খেয়ে যাওয়া?
দ্বিতীয় কথা, সন্ত্রাসের সূত্রপাত তো টুইন টাওয়ার থেকে নয়, সেটা তো সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতা মাত্র!
আমেরিকা দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর ফিলিস্তিনে ইহুদিদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পৃষ্টপোষকতা করে এসেছে, তার দায় আমেরিকা কীভাবে এড়াবে?
শরীফঃ ওবামা বলেছেন, ‘যত তাড়াতাড়ি উগ্রবাদীদের বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব হবে, মুসলমান সম্প্রদায়ে তারা তত বেশী গ্রহণযোগ্যতা হারাবে এবং তত তাড়াতাড়ি আমরা নিরাপদ হতে পারবো, আমেরিকার সেনাবাহিনীও তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে আসবে।’ এসম্পর্কে আপনার মন্তব্য?
মিছবাহঃ আমার আগাগোড়া মনে হয়েছে ওবামা সাহেব শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বকে তিনি ছাত্র ভেবে উপদেশ দিয়েছেন, করণীয় নির্দেশ করেছেন। তারই বা দোষ কী, আমরাও তো তাকে দু’ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্চ তৈরী করে দিয়েছি! আমার কথা হলো, তিনি যত সরলীকরণ করেছেন বাস্তবতা তা নয়। সন্ত্রাসের মূল উৎস যত দিন বন্ধ না হবে আমরা না চাইলেও তত দিন সন্ত্রাস চলতেই থাকবে। ফিলিস্তিন সমস্যার ইনছাফপূর্ণ সমাধান করুন। মুসলিম বিশ্ব থেকে সৈন্য সরিয়ে নিন। নিশ্চয়তার সাথে বলা যায়, মুসলিম বিশ্বের কোথাও আমেরিকার বিরুদ্ধে কোন ঘৃণা ও সন্ত্রাস থাকবে না।
শরীফঃ তাহলে কি আমরা ইরাকে, আফগানিস্তানে এবং এখন পাকিস্তানে যে সহিংসতা চলছে তা সমর্থন করবো?
মিছবাহঃ অবাক করা প্রশ্ন! কোন সহিংসতার কথা বলছ? তোমার কাছে কি পরিসংখ্যান আছে, ঐ তিনটি দেশে মার্কিনীদের নির্বিচার বোমাবর্ষণ ও গুলিবর্ষণে কত নিরপরাধ মুসলমান নিহত হয়েছে?
তোমার কি মনে হয়, প্রতিরোধ যদি না হতো তাহলে ওবামা এখন এত কষ্ট করে কায়রোতে এসে মুসলিম বিশ্বের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করতেন?
বুশ যখন নাটকীয়তা করে জঙ্গি বিমানে উড়ে যুদ্ধ জাহাজে নামলেন এবং ঘোষণা দিলেন, আমরা জয়ী হয়েছি, ইরাক-যুদ্ধ শেষ। মুসলিম বিশ্বকে অপদস্থ করার আর কত তরীকা বাকি ছিলো! সত্যি যদি যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতো তাহলে কী হতো এখন? সিরিয়া শেষ হয়ে যেতো, ইরান শেষ হয়ে যেতো, তারপর ধরা হতো পাকিস্তানকে।
শরীফঃ এখন তো আমেরিকার ভাষায় ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের’ দায় চেপেছে পাকিস্তানের উপর?
মিছবাহঃ পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে এটা হয়েছে। পাকিস্তানে তো কোন সহিংসতা ছিলো না! আফগানসমস্যা পাকিস্তানে এলো কেন, এর জবাব আমেরিকারই দেয়ার কথা। পাকিস্তান কী করেছে? তোমার দাসত্ব করেছে। তোমার আদেশে মুজাহিদীন তৈরী করেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারিও তা স্বীকার করে বলেছেন, ‘মুজাহেদীন-তালেবান আমাদেরই তৈরী। আমরা তার দায় এড়াতে পারবো না।’ তো তারা খারাপ হলো কবে থেকে? যখন তারা আমেরিকার তাবেদারি করবে না বললো। আসলে আফগানিস্তানের যুদ্ধ পাকিস্তানে টেনে আনা হয়েছে পাকিস্তানকে টুকরো করার জন্য। অপরাধ, পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তির অধিকারী একমাত্র মুসলিম দেশ।
তো যা বলছিলাম, প্রতিরোধ না হলে এত দিন মুসলিম বিশ্ব তছনছ হয়ে যেতো। তো যাদের জান, মাল ও ইয্যতের কোরবানির কারণে দৈত্যটা এখনো ইরাকে-আফগানিস্তানে আটকা পড়ে আছে এবং ওবামা সাহেব মুসলিম বিশ্বকে এতটা গুরুত্ব দিচ্ছেন তাদের প্রতি কি কৃতজ্ঞতা থাকা উচিত নয়!
যাকারিয়াঃ ওবামা বলেছেন, হামাসকে সন্ত্রাসের পথ থেকে সরে আসতে হবে।
মিছবাহঃ এটাই তো ট্রাজেডি! ফিলিস্তিনে সন্ত্রাস শুরু হলো কত সনে? সে তো ৪৭-৪৮ এর আগে, যখন ইহুদি সন্ত্রাসীরা ফিলিস্তিনী মুসলমানদের কচুকাটা করে হাজার বছরের বাস্ত্তভিটা থেকে তাদের উৎখাত করেছিলো, আর মার্কিন-বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলো। সন্ত্রাস যারা শুরু করলো ওবামা তাদেরকে তো সন্ত্রাসী বলছেন না। যারা দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পর রুখে দাঁড়িয়েছে তাদের তিনি সন্ত্রাসী বলছেন, এটা কীভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে!
শরীফঃ ওবামা তার ভাষণে ইহুদি নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে ইহুদিদের স্থায়ী নিবাসের বৈধ অধিকারের কথা বলেছেন, এসম্পর্কে আপনি কী বলেন?
মিছবাহঃ এ তো বহু পুরোনো কথা; ওবামা আমাদের চেয়ে ভালো জানেন। প্রশ্ন হলো, আধুনিক যুগেও কি ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রের ধারণা গ্রহণযোগ্য? ইহুদিরা কি ফিলিস্তিনের ভূমিপুত্র? ওরা তো ভিন্ন দেশের নাগরিক। ওদেরকে কেন ফিলিস্তিনে জড়ো করা হলো? তিনি ষাট লাখ ইহুদি নিহত হওয়ার কথা বলছেন; মুসলিম বিশ্ব বা ফিলিস্তিনীরা তার মাশুল দেবে কেন? ওবামার সৌভাগ্য যে, মুসলিম বিশ্বে এমন একটি কণ্ঠস্বর নেই যে তাকে এ প্রশ্নটা করতে পারে যে, ঐ হত্যাযজ্ঞের জন্য তো ইউরোপ দায়ী। সুতরাং যদি ইহুদিরাষ্ট্র বানাতেই হয় তো ইউরোপের ভূমি নির্বাচন করুন!
ইহুদিদের উপর নির্যাতনের কথা স্বীকার বা অস্বীকার করার বিষয় তো আমাদের নয়। বরং ইউরোপের নেতৃস্থানীয় গবেষকরা বলছেন, হলোকাস্টের ঘটনা অনেক অতিরঞ্জিত। অথচ ওবামা বলছেন, এ সত্য অস্বীকার করা জ্ঞানহীন এবং হিংসাত্মক। এটা কোন ধরনের বাকস্বাধীনতা ও মুক্তবুদ্ধি যে, প্রশ্নই তোলা যাবে না? প্রশ্নের জবাবে আপনি তথ্যপ্রমাণ পেশ করুন। যাক এটা তাদের বিষয়।
ওবামা আয়াত তেলাওয়াত করেছেন, ভালো কথা। ‘অন্যায়ভাবে একটি মানুষকে হত্যা করা গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার সমান।’ কিন্তু আয়াতের শুরুটা তিনি বলেননি। এটা বলা হয়েছে বনী ইসরাঈলকে উদ্দেশ্য করে। মানে খুনখারাবিটা ছিলো ইহুদিদের জাতীয় চরিত্র। একারণেই তাওরাতে উপরোক্ত বিধান দিতে হয়েছে। তো এ অংশ বাদ দিয়ে তিনি তরজমা করলেন কেন? কোন জবাব নেই। তিনি ইতিহাসব্যাপী ইহুদি-নির্যাতনের কথা উল্লেখ করেছেন, কিন্তু ওরা যে নবীদের হত্যাকারী এটা কি শুধু কোরআনের বক্তব্য? প্রশ্ন হলো, পৃথিবীতে এমন একটি জাতির উদ্ভব হলো কীভাবে ইতিহাসের শুরু থেকেই যাদের উপর এরকম দুরবস্থা গিয়েছে? আপনি কোরআন পড়েছেন, কোরআন কেন ইহুদিজাতিকে ‘অভিশপ্ত’ আখ্যায়িত করেছে? শেক্সপিয়রের সাহিত্যে ইহুদিদেরকে বলা হয়েছে রক্তচোষা সুদখোর, কেন? জার্মানিতে পুরো অর্থনীতিকে ওরা কীভাবে তছনছ করেছিলো তা তো ইতিহাসে আছে। সে যাক, কিন্তু ফিলিস্তিনের মানুষগুলো কী অন্যায় করলো যে, ইহুদিদের বাড়িঘর নেই বলে ফিলিস্তিনে গৃহস্থের বাড়ি দখল করতে হবে?
যাকারিয়াঃ কিন্তু এখন তো ইসরাইল একটি বাস্তবতা। সুতরাং ওবামা যে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের কথা বলছেন সে সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন?
মিছবাহঃ এটা তো ওবামার উদ্ভাবন নয়। সউদী বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল আযীয যুবরাজ থাকা অবস্থায় এটা বলেছেন। ইসরাইল তখনো সেটা মানেনি, এখনো না। আমার ধারণা কিছু শর্ত চাপিয়ে দিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে অবশেষে ইসরাইল তা মেনে নেবে। আর এ জন্য যতটা সময় ও সুযোগ দরকার ইসরাইলকে আমেরিকা তা দেবে। শেষে আমাদের পিঠে হাত দিয়ে তিনি বলবেন, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি তোমাদের স্বার্থ রক্ষা করার। এতটুকু পারা গেছে। সুতরাং এতটুকুই মেনে নাও। এটা পরিষ্কার, এর বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না।
কিন্তু এর পরিণতি যে কত ভয়ঙ্কর হবে তা হয়ত আমেরিকা কল্পনাও করতে পারছে না।
যাকারিয়াঃ অনেক বিশ্লেষক কিন্তু মনে করছেন বারাক হোসেন ওবামা আসলেই ইহুদি লবি থেকে বের হয়ে আসতে চাইছেন।
মিছবাহঃ দেখুন ব্যক্তি ওবামার মনের খবর বলতে পারি না। আমরা মুসলিম উম্মাহ সুধারণা করেই ইতিহাসের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছি। এখনো আমরা সুধারণার উপরই আছি। ‘হাল্লা শাকাকতা কালবাহু’ বলে আমাদের ধর্মই আমাদের বেঁধে রেখেছে। সুতরাং ব্যক্তি ওবামা সম্পর্কে আমি সুধারণাই করবো। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে কী তার করণীয় তা বুঝে শুনেই তিনি মঞ্চে এসেছেন। প্রেসারগ্রুপও তাদের কাজ করে যাবে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওবামার ভাষণে মুসলিম বিশ্ব এত যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে, এর বিপরীতে ইহুদীদের মাঝে কিন্তু তেমন কোন ক্ষোভ বা ক্রোধ নেই। অথচ এখানে উচ্ছ্বাস হলে ওখানে ক্রোধ হওয়ার কথা! আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছে, আমার বাপ মুসলমান, দাদা মুসলমান, আমি তোমাদেরই লোক, অথচ ওখানে কোন প্রতিক্রিয়া নেই! আমেরিকার যারা ‘নীতিচিন্তক’, যারা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় ওবামাকে সামনে এনেছে তাদের তো আর এ তথ্য অজানা ছিলো না!
শরীফঃ ওবামা তার ভাষণে বেশ জোর দিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাস ও সহিংসা কোন সফলতা বয়ে আনে না।
মিছবাহঃ মুসলিম বিশ্বকে এ উপদেশ দেয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ আমরা সন্ত্রাস সমর্থন করি না। কিন্তু কথা হলো, আপনি ইহুদিদের সন্ত্রাস কেন দেখতে পাচ্ছেন না। গাজায় বিশ্বের চোখের সামনে যে পাশবিকতা ঘটে গেলো সে সম্পর্কে কেন কিছু বলছেন না! আত্মরক্ষার অধিকার আর গণহত্যা কি এক হতে পারে? আপনি যখন শুধু একচোখ দিয়ে দেখবেন তখন আপনার ভালো ভালো কথায় কীভাবে তারা বিশ্বাস করবে, যাদের রয়েছে আমেরিকার আশ্বাসের কাছে বারবার প্রতারিত হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা!
সন্ত্রাস কোন সুফল বয়ে আনে না, ঠিক। কিন্তু আমি তো নিরাপদ দূরত্বে বসে আছি বলে বুঝতে পারছি নছীহতটা, যাদের উপর দিয়ে স্টিম রোলারটা যাচ্ছে তারা এর মর্ম বোঝবে কীভাবে। তাদেরকে বোঝানোর উপায় কী?
শরীফঃ একচোখ দিয়ে দেখার বিষয়টি একটু খোলাসা করবেন?
মিছবাহঃ একটি বইয়ে ওবামা লিখেছেন, ইসরাইলে আমি ঐসব লোককে দেখেছি যারা হলোকাস্টে পিতা-মাতাকে হারিয়েছেন, ভাইকে হারিয়েছেন আত্মঘাতী বোমায়। আর আমি ফিলিস্তিনীদের মনে কথাও বুঝতে চেষ্টা করেছি চেকপয়েন্টে প্রতিনিয়ত যাদের অসম্মানের শিকার হতে হয় ...।
দেখুন, ফিলিস্তীনে তিনি এমন কোন মানুষের দেখা পাননি যার বাবা ইহুদিদের হাতে মারা গেছে, যার শিশু সন্তান বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়েছে, যার মা-বোনের ইজ্জত আবরু তার চোখের সামনে লুণ্ঠিত হয়েছে। তিনি শুধু জানতে পেরেছেন, ওরা চেকপয়েন্টে ‘অসম্মানের’ শিকার হয়। ব্যস, এটুকুই! এটা কী! বোঝার জন্য সবকিছু পরিষ্কার। এখন কেউ বুঝতে না চাইলে আমাদের করার কিছু নেই।
যাকারিয়াঃ পারমাণবিক বোমা ও ইরান সম্পর্কে বলতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বলেছেন, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি যে, পৃথিবীর কোন দেশেই পারমাণবিক বোমা থাকবে না, এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন।
মিছবাহঃ যদি অনুমতি দেন তাহলে বলবো, মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দকে তিনি সত্যি বোকা ভেবেছেন। অন্য কারো উদ্দেশ্যে এমন কথার বলার সাহস তার হতো না। এটা কি তেল বিক্রির কয়েকশ কোটি ডলারের বিষয় যে, আপনি নিশ্চয়তা দিলেন, আমরা মেনে নিলাম! এটা তো আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্ন। আপনি পাঁচ বছর আছেন, ষষ্ঠ বছরে আপনার নিশ্চয়তার কী মূল্য? ইরান তো নিশ্চয়তা দিচ্ছে, সে বোমা বানাবে না, শুধু শান্তিপূর্ণ কাজে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করবে। আপনি তো তা মানছেন না! আপনারই দলের সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট কার্টার স্বীকার করেছেন, ইসরাইলের অস্ত্রাগারে পারমাণবিক বোমা রয়েছে। এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কোথায়? উল্টো আরববিশ্বকে ইরানী বোমার ভয় দেখানো হচ্ছে।
ইরান তো প্রশ্ন করতে পারে, ইরানের পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন নেই কেন? এখন বেচারা শান্তিপূর্ণ কাজের কথা বলেই পার পাচ্ছে না, বোমার কথা বললে কি আর উত্তর কোরিয়ার মত পার পাবে?
আমার কথা হলো, আহমদিনেজাদ না বলুন, তার দেশের জনগণ তো প্রশ্ন করতে পারে, আমাদের বোঝাও, কেন আমাদের পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন নেই। কী জবাব আছে ওবামার কাছে? আমেরিকার কথা না হয় বাদ, মুরুববী দেশ! কিন্তু একসময় যাকে মধ্যপ্রাচ্যের ‘জারজ’ বলা হতো, কোরআন যাদের বলেছে অভিশপ্ত জাতি, তাদের হাতে বোমা থাকবে, আর ইরান বা আরবজাহান ঘুমিয়ে থাকবে শুধু ওবামার আশ্বাসবাণীর উপর ভরসা করে!
ওবামা তো দেখছি কোরআনের বেশ ভক্ত; কোরআন আমাদের বলছে, ‘না ইহুদিদের, না নাছারাদের, কাউকে তোমরা বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আসলে ওরা পরস্পরের বন্ধু। তো আমরা কি কোরআনের আহবানে সাড়া দেবো, না মুসলমান বাবার নাছারা পুত্রের একঘন্টার ভাষণে?
তবে আবারো বলি, ব্যক্তি ওবামাকে আমি শ্রদ্ধা করি, প্রেসিডেন্ট ওবামাও তার দেশের জন্য আদর্শ। তার কাছ থেকে মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের শেখার আছে। শেখার আছে আহমদি নেজাদের কাছ থেকেও। আমি শিয়া মাযহাব শিখতে বলছি না। আজ আমেরিকা ইরানের সাথে নিঃশর্ত আলোচনায় বসতে চায়, কিন্তু নেজাদ যদি বিশ্বশক্তিগুলোর চাপের কাছে নতি স্বীকার করতেন? গাদ্দাফির মত গাদ্দারি করে বসতেন? এটুকুই শিখতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের শায়খদের। খাদেমুল হারামাইন হিসাবে মুসলিম উম্মাহর অন্তরে সউদী বাদশাহর যে মর্যাদা সেটাকে তিনি কাজে লাগাতে চেষ্টা করুন। তাকে উপেক্ষা করা সহজ হবে না এমনকি আমেরিকার পক্ষেও।
শরীফঃ মুসলিম বিশ্বের পারমাণবিক শক্তি অর্জন সম্পর্কে ইসলামের নির্দেশনা কী?
মিছবাহঃ কেন, তোমার জানা নেই কোরআনের বাণী, ‘যত দূর পুরো তাদের জন্য শক্তি অর্জন করো ... তা দ্বারা সন্ত্রস্ত করার জন্য আল্লাহর শত্রুকে এবং তোমাদের শত্রুকে এবং তাদের ছাড়া আরো কিছু লোককে, যাদের তোমরা জানো না, আল্লাহ তাদের জানেন।’
তোমার মনে আছে কি না জানি না; ভারত যখন দ্বিতীয়বার বিস্ফোরণ ঘটালো, তো বিস্ফোরণ ঘটিয়েই ওদের মন্ত্রী আদভানি বলেছিলো, পাকিস্তানকে এখন থেকে ভারতের কথায় চলতে হবে। বিজ্ঞানী ডক্টর খান তখন বললেন, ‘নাউ, অর নেভার’, হয় এখন নয়ত কখনোই নয়। তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়ায শরীফ সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে বিস্ফোরণ ঘটালেন, আর ভারতের মুখটা চুপসে গেলো, সুর পাল্টে গেলো। আধুনিক পরিভাষায় এটাকেই বলে শক্তির ভারসাম্য, কোরআন বলেছে ‘ইরহাব’ বা সন্ত্রস্তকরণ। এখন পারমাণবিক শক্তি অর্জনের যে চেষ্টা চলছে, আমি মনে করি, বিলম্বে হলেও কোরআনের এই ইরহাবওয়ালা আয়াতের উপরই আমল হচ্ছে। আমার তো বিশ্বাস, যেসব মুসলিম বিজ্ঞানী দিন-রাত এক করে শক্তি অর্জনের সাধনায় নিয়োজিত তারা মাদরাসা- ওয়ালাদের চেয়ে কম ইবাদতগুজার নন, যদি তারা মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে নিবেদিত থাকেন।
যাকারিয়াঃ মুসলিম মেধাগুলো তো আমাদের থাকছে না। ভারতের কথাই ধরুন ...
মিছবাহঃ কে জানে তাদের মজবূরির খবর! দেশ ভাগ করে চলে আসার সময় আমরা তো ওদের খবর রাখিনি। এমনও হয় যে, একজন বিজ্ঞানীর মেয়েকে, সন্তানকে অপহরণ করে জিম্মি বানিয়ে রাখে। বিজ্ঞানীও তো একজন পিতা! তার সামনে যখন সন্তানের উপর নির্যাতন চালানো হয় তখন ...। এটা হলো একটা দিক। তবে যেসব মেধা শুধু অর্থ ও প্রতিষ্ঠার লোভে ইউরোপে আমেরিকায় পাচার হয়ে যাচ্ছে, যাদের অবদানের প্রশংসা ওবামা তার ভাষণে করেছেন তাদেরকে আল্লাহ হেদায়াত করুন।
যাকারিয়্যঃ মুসলিম মেধাগুলো যাতে উম্মাহর কাজে লাগে সেজন্য আমাদের কী করণীয়?
মিছবাহঃ অবশ্যই আমাদের করণীয় আছে। ঈমানী চেতনা, দ্বীনী গায়রত, জিহাদি জাযবা, এগুলো তাদের মাঝে যেন সৃষ্টি হয় সেজন্য আমাদের মুখে, কলমে, ছোহবতে, সান্নিধ্যে যার যতটুকু তাওফীক আছে চেষ্টা করতে হবে। হযরত আলী নদবী (রহ) এটাই বলেছেন। হাদীছে পাকিস্তান পড়ে দেখুন, তিনি বলেছেন, ‘এগিয়ে যাও, আমি মাদরাসায় ভর্তি হতে বলছি না, এগিয়ে যাও বিজ্ঞানের সকল অঙ্গনে।’ আসলে শিক্ষার এই যে বিভাজন, এটা তো শত্রুদের চক্রান্তের ফল। সকল শিক্ষাই ধর্ম শিক্ষা, যদি দ্বীন ও উম্মাহকে সামনে রেখে করা হয়। এটা আমার কথা নয়, বড়দের কথা।
শরীফঃ আপনার ধারণায় পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমার ভবিষ্যত কী?
মিছবাহঃ পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা তো পরিষ্কার। কায়রোর ভাষণের পর ওবামা বড় তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন, ‘পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা দখল করার ইচ্ছে আমাদের নেই।’ ওদিকে তালেবানভীতি ছড়ানো হচ্ছে যে, বোমাটা ওদের হাতে চলে যেতে পারে। আসলে পাকিস্তানের দুর্গতি শুরু হয়েছে মোশাররফকে দিয়ে। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর দেখ কীভাবে তাকে ছুঁড়ে ফেলা হলো, আর বেনযিরকে সরিয়ে আনা হলো জারদারিকে। পাকিস্তানের জঘন্যতম ব্যক্তিটি হলো সে দেশের কর্ণধার। তখনই মনে মনে বলেছিলাম, পাকিস্তানের খোদা হাফেয। এতকিছুর পরো আমি নিরাশ নই। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ হেফাযত করবেন। এমন কিছু হয়ত ঘটবে, যা আমাদের স্বপ্নে এবং শত্রুর কল্পনায় নেই। এছাড়া আর কী বলতে পারি!
শরীফঃ ওবামা তার ভাষণে ইরানের পারমাণবিক শক্তি অর্জনের অধিকার স্বীকার করেছেন, সে আলোকে আপনি ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের ভবিষ্যত কী বলে মনে করেন?
মিছবাহঃ সেটা আমাদের খুঁজতে হবে ওবামার ভাষণে নয়, আমেরিকার আচরণে। মার্কিন সূত্রেই প্রকাশ, ইরানে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য শত শত কোটি ডলার ব্যয় করা হচ্ছে। কীভাবে কিছু লোককে উসকানি দেয়া হচ্ছে। ওবামার ভাষণের ভালো ভালো কথাগুলো ইরানের নির্বাচনের পর যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তিনি তার কালো নাকটা দিব্যি ইরানের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে গলিয়ে দিচ্ছেন। আমাদের দেশের নির্বাচনের কথা বাদ, আমরা তো গরীব বাংলাদেশ। কিন্তু ইরানের নির্বাচনেও আমেরিকার সনদ নিতে হবে? মুসাভিকে পুতুল বানিয়ে নাচানো হচ্ছে। তিনি কারচুপির অভিযোগ এনেছেন, কিন্তু কোন প্রমাণ নেই। বিপুল সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি কী প্রমাণ করে? কোটির উপর ভোট কারচুপি হলো, অথচ কোন প্রমাণ নেই? সে দেশের সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব বলছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, সেকথারও মূল্য নেই? তাহলে কার কথা মানা হবে। ওবামা তো বলেছেন, তিনি তার পছন্দের গণতন্ত্র কারো উপর চাপিয়ে দিতে চান না। ইরানের সংবিধান অনুযায়ী সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের কথাই তো শেষ কথা। এখানেই তো মাসআলা খতম। কিন্তু দেখুন, কীভাবে সহিংসতার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে! প্রমাণ পেশ করার পরিবর্তে মুসাভি সহিংস প্রতিবাদে নেমেছেন, তাতে পশ্চিমারা খুশী। সরকার সহিংসা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে, তাতে ওবামা ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছেন। আসলে মুসাভির পরাজয় এবং আহমেদি নেজাদের বিজয়ে তাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। অথচ খোদ মার্কিন জরিপেও জানা গিয়েছিলো, তিনি বিপুল ব্যবধানে জয়ী হতে চলেছেন। আমার বিশ্বাস, ইরানী জনগণকে বোকা বানানো এত সহজ হবে না। ইরান শেষ পর্যন্ত এগিয়ে যাবেই।
যাকারিয়াঃ ওবামার ভাষণের আরেকটি প্রসঙ্গ ধর্মীয় স্বাধীনতা। তিনি পরধর্মের প্রতি ইসলামের সহনশীলতার প্রশংসা করেছেন। এসম্পর্কে কিছু বলবেন?
মিছবাহঃ কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, কিছু মুসলমান আছে যারা নিজের ধর্মবিশ্বাসকে পরিমাপ করতে গিয়ে অন্যের ধর্মবিশ্বাসকে বাতিল করে দেয়। আসলে কিছু মুসলমান নয়, ইসলাম নিজেই বলে, ইসলাম ছাড়া অন্যসকল ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ বাতিল; আল্লাহর নিকট ইসলামই একমাত্র গ্রহণযোগ্য ধর্ম। তবে লা-ইকরাহা ফিদ্দীন। যার যার ধর্মবিশ্বস পালনের অধিকার ইসলাম স্বীকার করে। কিছু মুসলমান বলতে আসলে তিনি তাদেরই টার্গেট করতে চান যারা ইসলামকে জীবনবিধানরূপে প্রতিষ্ঠিত করতে বদ্ধপরিকর। মুসলিম উম্মাহর এ অংশটাকেই পশ্চিমা বিশ্বের যত ভয়।
তিনি ধর্মীয় স্বাধীনতার কথা বলেছেন। তাকে এ সত্যও স্বীকার করতে হবে, মুসলিম বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন শুরু হয়েছে খৃস্টান মিশনারির মাধ্যমে। তিনি লেবাননের কথা বলেছেন, কিন্তু লেবাননের ইতিহাস বলেননি, কীভাবে খৃস্টানরা সেখানে একটি শক্তিরূপে দাঁড়িয়েছে। পূর্ব তিমুর এবং দাফুরের কথাও তিনি বলেননি, বলেননি আফ্রিকার মুসলিম দেশগুলোর কথা। এই মিশনারি তৎপরতা প্রতিহত করার অধিকার মুসলিম বিশ্বের আছে কি না সেটা তাকে পরিষ্কার করে বলতে হবে। আমেরিকায় মুসলমানদের অবস্থা তিনি তুলে ধরেছেন। তার বাবাও ছিলেন মুসলিম, কিন্তু ফল?
নারী অধিকার সম্পর্কেও তিনি ভালো কথা বলেছেন। তিনি মুসলিম বিশ্বের নারী নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন, কিন্তু আমেরিকায় এখনো নযির সৃষ্টি হলো না কেন? অদূর ভবিষ্যতেও কি হবে? অবশ্য তিনি একটি মূল্যবান কথা বলেছেন যে, পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য নারীকেও পুরুষের মত একই কাজ বেছে নিতে হবে তা ঠিক নয়। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা কথাটা মনে রাখলে ভালো করবেন।
তিনি মুসলিম বিশ্বকে শিক্ষা-দীক্ষায় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেতে সাহায্য করার কথা বলেছেন এবং বৃত্তিবৃদ্ধির কথা বলেছেন, যে বৃত্তিতে তার বাবা আমেরিকায় গিয়েছিলেন। কিন্তু ওবামাকেই জিজ্ঞাসা করি, সেই বৃত্তি গ্রহণ করে তার বাবা কী পেয়েছেন, আর কী হারিয়েছেন? তাতে মুসলিম বিশ্বের কতটা লাভ হয়েছে, আর আমেরিকা কতটা লাভবান হয়েছে? আমার বক্তব্য হলো, আমরা পিছিয়ে পড়েছি সত্য, তবে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে নিজেদেরই শক্তিতে। আমেরিকার দয়া ও সাহায্যে নয়। সারা দুনিয়া জানে, আমেরিকা আসলে কখনো সাহায্য দেয় না, শুধু সাহায্য নেয়। আমার এ কথাটা গভীরভাবে ভেবে দেখার মত।
শরীফঃ আপনার দৃষ্টিতে ওবামার ভাষণের মূল উদ্দেশ্যটা কী এবং আমাদের করণীয় কী?
মিছবাহঃ ওবামা কিন্তু শুধু ভাষণটা দিতেই আসেননি। তার আগে তিনি সউদি আরব গিয়েছেন। তেলের মূল্য নিয়ে আলোচনা করেছেন। ঐ তেলটাই তার মূল উদ্দেশ্য। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হচ্ছে আরবদের মধ্যে ইরানী বোমার ভীতি সৃষ্টি করা, যাতে ইরানের উপর যে কোন আগ্রাসনে আরববিশ্বের সমর্থন পাওয়া যায়। এটা আমেরিকার পুরোনো কৌশল। আফগানিস্তানে, ইরাকে তাই করেছে। এখন ইরানের ক্ষেত্রেও তাই করতে চাচ্ছে। ভাষণ দেয়াটা হলো তার তৃতীয় কাজ এবং এর উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর প্রতিবাদী অংশকে বিচ্ছিন্ন করা এবং মুসলিম সরকারগুলোকে মুসলিম জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া। পাকিস্তান হলো তার আদর্শ উদাহরণ। ফিলিস্তিনেও ফাতাহকে দিয়ে তাই করা হচ্ছে। লেবাননেও হিযবুল্লাহর বিরুদ্ধে লেবানন সরকারকে উসকে দেয়া হচ্ছে। তার ভাষণের মূল বার্তা হলো, মুসলিম বিশ্বের ‘বিপথগামী’ অংশটিকে নির্মূল করার জন্য মুসলিম বিশ্বের বাকি অংশকে আমেরিকার সঙ্গে কাজ করতে হবে, তবেই আমেরিকার সঙ্গে মুসলিম বিশ্বের নতুন সম্পর্ক হবে। বিনিময়ে মুসলিম বিশ্ব কী পাবে? এককথায় ‘সুন্দর একটি গৃহযুদ্ধ’!
আমাদের করণীয়? তা তো কোরআনই বলে দিয়েছে। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হওয়া, আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধরা এবং বিচ্ছিন্ন না হওয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আয়ত্ত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করা। সন্ত্রাস ও সহিংসা পরিহার করা এবং জিহাদের পথে অবিচল থাকা। শত্রুর প্রধান লক্ষ্যই হচ্ছে গৃহযুদ্ধ বাঁধানো। পাকিস্তানে যারাই এবং যে অজুহাতেই শত্রুর পাতা ফাঁদে পা দিয়ে মুসলমানে মুসলমানে হানাহানিতে লিপ্ত হয়েছে তারা ভয়ঙ্কর ভুল করেছে। যে কোন মূল্যে যুদ্ধটা আফগানিস্তানে রাখা উচিত ছিলো এবং সেখানেও লড়াইটা হওয়া উচিত বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে। অবশ্য ঘটনার প্রবাহ সবসময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না। আফগানিস্তানে মার্কিন আগ্রাসন এড়িয়ে যাওয়ার কোন উপায় কি ছিলো তখনকার বৈধ সরকারের?
যাকারিয়াঃ সন্ত্রাস, সহিংসতা ও জিহাদ-এর সংজ্ঞা কী?
মিছবাহঃ এখনকার পৃথিবীতে সংজ্ঞা নির্ধারণটাই তো সবচে’ কঠিন। দেখুন না, ওবামা বলছেন, বন্দুকের নলের মুখে যে নির্বাচন হয়েছে ইরাকে ও আফগানিস্তানে সেটা গণতন্ত্র এবং ঐ সরকার গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার! যদিও ভোটার নেই। আবার তিনিই বলছেন, শুধু নির্বাচন হলেই হবে না, জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন থাকতে হবে তাতে। তার মতে হামাস বিপুলভাবে নির্বাচিত হলেও গ্রহণযোগ্য নয়, মাহমূদ আববাসই গণতান্ত্রিক সরকার! ইরাকের গণহত্যাও ইরাকীদেরকে গণতন্ত্র উপহার দেয়ার জন্য। এখন কীভাবে নির্ধারণ করবেন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা?
যাক, রাষ্ট্র যখন কোন জনগোষ্ঠীর উপর নিপীড়ন, নির্যাতন চালায়, হত্যা, গণহত্যা চালায়, বিশেষত আপন দেশের সীমানার বাইরে তখন সেটা হয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। আশা করি এ সংজ্ঞা ওবামাও মেনে নেবেন। পক্ষান্তরে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যখন বৈধ সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে,নিরপরাধ মানুষের জানমল ও ইজ্জত আবরুর নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে তখন সেটাও হয় সন্ত্রাস এবং সহিংসা। ইসলাম কোনভাবে তা সমর্থন করে না। তবে ইসলাম এমন নিরীহ ধর্মও নয় যেমন ওবামা বলতে চান। ওবামার কাছে কোরআন আছে, খুলে দেখুন কোরআন বলছে, ‘তোমাদের হলো কী যে তোমরা আল্লাহর পথে অস্ত্রধারণ করছো না, অথচ দুর্বল নর-নারী ও শিশুরা ফরয়াদ করে বলছে, হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে গ্রাম থেকে উদ্ধার করুন, যার অধিবাসীরা যুলুম করছে।’ এটা কোরআনের নির্দেশিত জিহাদ, এটা অস্বীকার করলে ঈমান থাকবে না। শরিয়াতে জিহাদের এবং লড়াইয়ের সুনির্ধারিত বিধিবিধান রয়েছে, যা আলোচনা করার উপযুক্ত ক্ষেত্র এখানে নয়। এখানে আমি শুধু বলতে চাই, কোন জনপদ থেকে যদি এধরনের আহাযারি ও ফরয়াদ আসে তখন যা করণীয় সেটাই হলো জিহাদ! যেমন রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে মুজাহিদরা করেছিলো এবং তাতে আমেরিকার সমর্থন ছিলো। একই পরিস্থিতিতে অন্য যে কোন শক্তির বিরুদ্ধেও এটা জিহাদ হবে। অমুকের বিরুদ্ধে হলে জিহাদ, তমুকের বিরুদ্ধে হলে সন্ত্রাস, এটা আধুনিক কূটনীতি হতে পারে, ইসলাম হতে পারে না।
আমার এ বক্তব্যে যদি কোন ভুল থাকে এবং কেউ তা ধরিয়ে দেয় তাহলে আমি আমার মতামত সংশোধন করে নিতে রাজী আছি।
শরীফঃ ধন্যবাদ, আপনার বক্তব্যে নতুন চিন্তার খোরাক পেলাম। এবার বলুন, ওবামার ভাষণ কেমন হলে আপনি খুশী হতেন?
মিছবাহঃ এই যে মুসলিম বিশ্বজুড়ে ওবামা নামের তাছবীহ শুরু হয়েছে এটা আমার কাছে অসহনীয়। ইরানকে দেখো, ইরান কিন্তু এর ব্যতিক্রম। সে শক্তি অর্জন করতে চাচ্ছে। এটা কি সত্যি নয় যে, শক্তিই ওবামাকে এই অবস্থানে এনেছে যে, তিনি শিক্ষকরূপে বলছেন, আমরা ছাত্ররূপে কোন প্রশ্ন না করে শুনতে বাধ্য হচ্ছি? আমার কথা হলো, ওবামা, আমেরিকা, এ চিন্তাটাই আমাদের বাদ দিতে হবে। কেউ আমাদের সমস্যার সমাধান করে দেবে না, খুব বেশী হলে সমাধান চাপিয়ে দেবে, আর আমরা মেনে নিতে বাধ্য হবো। আমাদের তো নিজস্ব ফোরাম আছে। আমরা এক হই এবং আমাদের সমাধান অন্যের উপর চাপিয়ে দেই। এটা খুবই সম্ভব যদি শুধু এক হতে পারি। আমার একটি কথা জানতে ইচ্ছা করে, এতগুলো স্টেট এক হয়ে আমেরিকা হলো কীভাবে, অথচ তাদের সবকিছুতেই কত ভিন্নতা! আর বিশাল আরব জাহান এতটুকরো হলো কীভাবে, অথচ তাদের সবকিছু অভিন্ন! আজই এই মুহূর্তে আরবজাহান একটি পতাকার অধীনে আসুক, কালকে আমি যে কোন অনাহুত ব্যক্তিকে বলবো, ‘গেটআউট’!
ওবামার ভাষণ কেমন হলে খুশি হতাম? সবচে’ বেশী খুশী হতাম। কোন মুসলিম দেশ, বিশেষত কোন বিদ্যাঙ্গন যদি ওবামার ভাষণের মঞ্চ না হতো। তিনি তার দেশ থেকেই যা বলার বলতেন। আমাদের এখানে এসে যখন তিনি আমাদের সম্বোধন করেছেন, খুশী হতাম যদি তিনি আমাদেরও বক্তব্য শুনতেন,অন্তত আমাদের কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ দিতেন। খুবই ভালো হতো যদি ভাষণের পর একটি ‘উন্মুক্ত’ প্রশ্নোত্তর হতো।
আমি আরো খুশী হতাম যদি তিনি মুসলিম বিশ্বকে সম্বোধন না করে মুসলিম উম্মাহকে সম্বোধন করতেন। বিষয়টি হয়ত অনেকেরই দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ওবামা কিন্তু মুসলিম বিশ্বকে সম্বোধন করেছেন, মুসলিম উম্মাহকে নয়। সুতরাং প্রথম ধাক্কাতেই কাশ্মীর বাদ এবং ইন্ডিয়া খোশ! এই সেদিন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, কাশ্মীর প্রসঙ্গে তিনি কিছু বলবেন না। মুসলিম বিশ্ব বলতেও তিনি বোঝেন শুধু মধ্যপ্রাচ্য। যেখানে তেল এবং স্বার্থ সেখানে আমেরিকা। সুতরাং কাশ্মীর বাদ, চেচেনিয়া বাদ।
ওবামার ভাষণে কী থাকলে খুশী হতাম? তিনি যদি মুসলিম বিশ্বের প্রতি আমেরিকার অতীত আচরণের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতেন, ইরাকে, আফগানিস্তানে লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করার জন্য ক্ষমা চাইতেন...
যাকারিয়াঃ তিনি তো বলেছেন, গুয়ান্তানামো বন্দীশিবির একবছরের মধ্যে বন্ধ করে দেবেন?
মিছবাহঃ ব্যস এতটুকুতেই পাপস্খালন হয়ে গেলো? ইরাক ও আফগানিস্তানের কারাগারে এবং গোয়ান্তানামো বন্দীশিবিরে বিনাবিচারে হাজার হাজার মুসলিম যুবককে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আমেরিকা মানবতার বিরুদ্ধে যে জঘন্য অপরাধ করেছে সে জন্য কি তিনি ক্ষমা চেয়েছেন? সন্ত্রাস ও সহিংসতার আওতায় কি এগুলো পড়ে না? সিআইএ সব প্রমাণ ধ্বংস করে ফেললো কেন? এখনো যে ছবিগুলো আছে ওবামা সাহস করছেন না সেগুলো প্রকাশ করতে, আমেরিকার প্রতি মুসলিম বিশ্বের ঘৃণা বেড়ে যাবে বলে। চমৎকার যুক্তি! তারপরো কোন্ মুখে তিনি মানবতার কথা বলেন? মানুষ হত্যার মন্দত্বের সবক দান করেন? অথচ তালেবানদের হাতে বন্দী কোন সাংবাদিক বা মানবাধিকার কর্মী কি নির্যাতনের শিকার হয়েছে? যারা ছাড়া পেয়ে এসেছে, এমনকি নারী সাংবাদিক, সবাই একবাক্যে বলেছে, আমাদের সাথে ভালো ব্যবহার করা হয়েছে।
যাক, আমি খুশি হতাম তিনি যদি ফিলিস্তিনে হামাসের ‘সহিংসতার’ পাশাপাশি ইহুদি সন্ত্রাস সম্পর্কেও অন্তত একটি কথা বলতেন। তিনি যদি বলতেন, সমস্ত বেআইনি ইহুদি বসতি উচ্ছেদ করতে হবে। তিনি যদি বলতেন, ইরানকে পারমাণবিক প্রকল্প থেকে সরে আসতে হবে, সেই সঙ্গে ইসরাইলকে তার পারমাণবিক বোমা ধ্বংস করতে হবে। তিনি যদি বলতেন, ইহুদীদের নিঃশর্তভাবে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র মেনে নিতে হবে, বিনিময়ে আরবরা ইসরাইলের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেবে। (ইসরাইলের অস্তিত্ব অবৈধ হলেও বাস্তবতার কারণে মুসলিম উম্মাহ তা বরশাদত করতে প্রস্ত্তত আছে।)
শরীফঃ আমার তো মনে হয়, মুসলিম উম্মাহর সামনে বড় অন্ধকার ভবিষ্যত ...
মিছবাহঃ তারপরো সবকিছু এগিয়ে চলেছে, খুব ধীরে ধীরে। আমি মনে করি, এখন ইতিহাস তার শেষ কথাটা বলার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে। আমরা নিরাপদে আছি, স্টিমরোলারটা আমাদের ভাইদের উপর দিয়ে যাচ্ছে; তাই বলতে সাহস পাচ্ছি না, না হয় বলতাম, দিন এগিয়ে আসছে। মুসলিম উম্মাহর শত্রুরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে। এখন যা কিছু হচ্ছে তা হলো সৃষ্টির প্রসব বেদনা। মুসলিম উম্মাহর গর্ভ থেকে ইমাম মেহদি যে জন্মলাভ করবেন, সেই প্রসব বেদনা! সুতরাং সহ্য তো করতেই হবে।
শরীফঃ আমেরিকার সামনে পতনের কোন ঘনঘটা আছে বলে কি আপনি মনে করেন?
মিছবাহঃ একটা কথা আমি বলে থাকি, আফগানিস্তানে রাশিয়াকে আমরা চৌদ্দ বছর সময় দিয়েছি। আমেরিকাকে বিশবছর সময় তো দিতে হবে! আমেরিকার পতন অবশ্য ভিতর থেকেই শুরু হয়ে গেছে। এখন মুসলিম উম্মাহ যত তাড়াতাড়ি জেগে ওঠবে আমেরিকার শত্রু তত দ্রুত হবে। কারণ মুসলিম উম্মাহকেই বিশ্বের আগামী নেতৃত্বের শূন্যতা পূর্ণ করতে হবে। জীবন ও জগতে শূন্যতার তো কোন সুযোগ নেই।
যাকারিয়াঃ সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে আমেরিকার অনেক ক্ষয়ক্ষতির কথা ওবামা তার ভাষণে স্বীকার করেছেন।
মিছবাহঃ এটা ঠিক, তাদের অর্থনীতির কোমর ভেঙ্গে আসছে। ওদিকে চীন অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রাযুক্তিক সর্বদিক থেকেই এগিয়ে আসছে। আর কত দিন ওরা এভাবে চালিয়ে যেতে পারবে! এখন যদি সউদী আরব ইরানের সাথে মিলে তেলের পাইপলাইনটা একটু চেপে ধরতো তাহলেই দৃশ্যটা দেখার মতো হতো। কিন্তু রাজা সাহেব তো রীতিমত সোনার হার পরিয়ে দিলেন!
যকারিয়াঃ তাদের অর্থনৈতিক ধ্বসের পেছনে নিশ্চয় ইরাক ও আফগানিস্তানে আগ্রাসনের ব্যয় বিরাট ভূমিকা পালন করছে!
মিছবাহঃ তাদের জন্য সবচে’ বিপর্যয়ের ব্যাপার হলো এখনো তারা ইরাকের তেলসম্পদে হাত দিতে পারেনি। আমেরিকার আফসোস তো এখানেই। এখনো যুদ্ধের খরচ চলছে স্রোতের মত। ঠিকাদারি মুনাফা কিছু হলেও তেলের রাষ্ট্রীয় লুণ্ঠন যাকে বলে সেটা শুরু করতে পারেনি। ইরাকে, আফগানিস্তানে ‘বিচ্ছুরা’ এমনভাবে কামড়াচ্ছে যে, মার্কিনসৈন্যদের হতাহতের সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ওরা আত্মহত্যা করছে, আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। পুরো মিডিয়া তাদের হাতে, তাই সঠিক চিত্র আসছে না। ওদের ভাষায় প্রতিদিন শত শত সন্ত্রাসী মারা পড়ছে, কিন্তু তাদের সংখ্যা তো কমছে না। পঁয়ষট্টির পাক-ভারত যুদ্ধের সময় একটি কার্টুন ছাপা হয়েছিলো, ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকায়, একজন ভারতীয় জেনারেল ঘোষণা করছেন , পাকিস্তানের কাছে সাড়ে তিনশ যুদ্ধবিমান ছিলো, তার মধ্যে ইন্ডিয়ান এয়ারফোর্স সাড়ে চারশ ভূপাতিত করেছে!’
পশ্চিমা মিডিয়া এখন এভাবেই সন্ত্রাসী নিধন করছে। বেসামরিক যত মানুষ মারা যাচ্ছে ওদের হাতে সব সন্ত্রাসী।
শরীফঃ ওবামার ভাষণের উপর এই যে আলোচনা হলো আপনার দৃষ্টিতে এর সুফল কী?
মিছবাহঃ যদি আমাদের মাঝে কিছু চেতনা জাগ্রত হয়! নচেৎ এটাও হবে অর্থহীন আলাপ। এখানেই আমার আফসোস। আমাদের চেহারায় না আছে বিষাদের চিহ্ন, না আছে ক্রোধের চিহ্ন, এমনকি না আছে হতাশার চিহ্ন! আজ যদি শায়খুল হিন্দ (রহ) থাকতেন, মাদানী (রহ), কিংবা এদেশে ছদর ছাহেব (রহ) থাকতেন! তাহলে তো এখান থেকেই একটা হুঙ্কার দিতেন। তাতে একটা জাগরণ সৃষ্টি হতো। এ আলোচনা মূলত সেই চেতনারই আমাদের মত করে প্রকাশ। আমার কথা হলো, এতটুকু চেতনা যেন আমাদের থাকে যে, আমরা পরাজিত হলেও প্রতারিত যেন না হই। বাইবেল হাতে কেউ যেন আমাদেরকে কোরআনের সবক দেয়ার সাহস না করে। আমাদেরকে এতটা বোকা ভাবার সুযোগ যেন না পায় যে, আমার বাবা মুসলমান! প্রস্তাবিত ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রে সামরিক বাহিনীর প্রয়োজন নেই। তোমাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি।
শরীফ, যাকারিয়াঃ জাযাকুমুল্লাহ!
মিছবাহঃ ওয়া ইয়্যাকুম! #