বাইতুল্লাহর মুসাফির-২৪
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
হোটেল কক্ষে আমি তখন একা। ফোন বেজে উঠলো। অভ্যর্থনা থেকে বলা হলো, কেউ দেখা করতে চায়। একটু অবাক হলাম। কে হতে পারে এখানে আমার পরিচিত! বললাম, নীচে আসছি। নীচে গিয়ে তো আরো অবাক! মুহম্মদ! বাংলাদেশে ইরাকী দূতাবাসের ‘ফার্স্ট সেক্রেটারী’ ছিলেন। যেমন অমায়িক তেমনি আন্তরিক। ঢাকায় আমাদের বাড়ীতেও এসেছিলেন। আমার সঙ্গে অন্তরের সম্পর্ক ছিলো। তাই বলে এখানে এ অবস্থায় দেখা হবে, কল্পনা করিনি। তাছাড়া আমার জানা ছিলো না, তিনি এখন কোথায়! উচ্ছ্বসিত হয়ে বললাম, আমাকে মনে আছে তোমার!
হাসিতে উদ্ভাসিত মুখে বললেন, তোমাকে কি ভুলতে পারি! ওখানে তুমিই তো ছিলে আমার একমাত্র অন্তরঙ্গ! বাংলাদেশের ‘বীতা’ খেয়েছিলাম না তোমার বাড়ীতে! তোমার মায়ের হাতের তৈরী ‘বীতা’ কত স্বাদের ছিলো! কেমন আছেন তোমার মা-বাবা?
‘বীতা’ মানে পিঠা! তিনি এবং তার বন্ধু আব্দুল মজীদ আমাদের বাড়ীতে খেয়েছিলেন পাটিসাপটা পিঠা এবং মুগডাল বেটে বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন নকশা করে তৈরী চিনির সিরায় ভেজানো ‘ফুলপিঠা’। সেই পিঠার কথা এমনভাবে বললেন, যেন স্বাদটা এখনো লেগে আছে তার জিভে; আমার বড় ভালো লাগলো।
মুহম্মদ বেশ আন্তরিকভাবে বললেন, ‘তুমি আমার দেশে এসেছো, আর আসা হবে কি না, হলেও আমার সঙ্গে দেখা হবে কি না, জানি না। তাই তোমার জন্য ছোট্ট একটি ‘প্রোগ্রাম’ তৈরী করতে চাই, যাতে বাগদাদে তোমাকে দেখার স্মৃতি জাগরূক থাকে।’
মানুষ মানুষকে এর চেয়ে সুন্দর কথা বলতে পারে এবং বলে, কিন্তু এর চেয়ে আন্তরিকভাবে, এমন হৃদয় ছুঁয়ে খুব কম মানুষই বলতে পারে।
হযরতের অনুমতি নিয়ে আমরা হোটেল থেকে বের হলাম। মুহম্মদকে জানালাম, বিকাল তিনটায় আমাকে ফিরতে হবে পরবর্তী কর্মসূচীতে শরীক হওয়ার জন্য।
মুহম্মদের বাড়ী বাগদাদের উপকণ্ঠে। অল্প সময়ের পথ,কিন্তু তিনি বাগদাদের বিপুল ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যে আমাকে মুগ্ধ করার জন্য বিভিন্ন পথ ঘুরে তারপর শহর থেকে বের হলেন।
মাঝশহরে আমাদের রমনার মত বিরাট উদ্যান, তবে সুবিন্যস্ত ও সুসজ্জিত। মাটিতে সবুজের চাদর, তাতে বিভিন্ন ফুলের কারুকাজ! উপরে সবুজের শামিয়ানা, ফাঁকে ফাঁকে নীল আকাশ। এককথায় মন স্নিগ্ধ করা পরিবেশ। সেখানে আমরা কিছুক্ষণ সময় কাটালাম। কফি ও খেজুরের বিস্কিট খেলাম। গাছের ছায়ায় জুটি বেঁধে বসে আছে বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়ে ও নারী-পুরুষ। পর্দাহীনতা আছে, নগ্নতা নেই। এদিক থেকে আমরা মনে হয় একধাপ এগিয়ে গেছি। পর্দাহীনতার সীমানা ছাড়িয়ে আমরা এখন নগ্নতার সীমানায় চলে এসেছি। পাশ্চাত্য সংস্কৃতির ‘বর্জ্য’রূপে প্রতিটি মুসলিম দেশেই এর অনুপ্রবেশ ঘটছে; পার্থক্য যা তা হলো গতি ও মাত্রায়।
উদ্যানে একটি সুন্দর লেক রয়েছে। খুব প্রশস্ত নয়, তবে এঁকে বেঁকে উদ্যানের এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত গিয়েছে। দু’পাশে বৃক্ষের পরিকল্পিত সারি। লেকের পানিতেও পড়েছে গাছের ছায়া। সত্যি মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! ছোট ছোট প্লাস্টিকের নৌকায় তরুণ-তরুণীরা ভেসে বেড়াচ্ছে। একদিকে তাদের কলহাস্য, অন্যদিকে পাখীদের কলরব। তাতে যেন মানুষে ও প্রকৃতিতে একটা মাখামাখি ভাব তৈরী হয়েছে!
এখানে যতক্ষণ ছিলাম, মনে হয়েছে কোথাও কোন যুদ্ধ নেই; হানাহানি ও রক্তপাত নেই; তেমনি নেই হিংসা ও বিদ্বেষ। আহা, সত্যি যদি এমন হতো! ইরান-ইরাক বুকে বুকে আলিঙ্গন করতো!
আখতার ফারূক সাহেবের কাছে শুনেছি, ইরানে দৃশ্য অন্যরকম। শোকের, ক্রোধের ও প্রতিশোধের ছাপ রয়েছে মানুষের চেহারায়। এতে আমার দু’টি ধারণা হয়েছে; লোকক্ষয় ইরানের বেশী হচ্ছে, আর ইরাকের জনগণ যুদ্ধে আগ্রহী নয়। যুদ্ধটা চলছে মূলত ইরাকের সুসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী এবং ইরানের বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ ও স্বল্প প্রশিক্ষিত তরুণদের মাঝে, যাদের বলা হয় পাসদারানে ইনকিলাব। যুদ্ধের আগেই ধরা পড়ে গিয়েছিলো যে, ইরানী জেনারেলদের অধিকাংশ হচ্ছে সিআইএ-র অনুগত এজেন্ট। ফলে বাধ্য হয়ে তাদের সরিয়ে দিতে হয়েছে, কিংবা দিতে হয়েছে মৃত্যুদন্ড । ফলে সেনাবাহিনী হয়ে পড়েছিলো প্রায় নেতৃত্বহীন ও দক্ষতাশূন্য। তাছাড়া সমরাস্ত্রের মার্কিন সরবরাহ ছিলো একেবারে বন্ধ, এমনকি যন্ত্রাংশের অভাবে ইরানের অধিকাংশ যুদ্ধবিমানই ছিলো অচল। সর্বোপরি যুদ্ধের সময় গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধে জড়িত প্রেসিডেন্ট বনী ছদরের দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনা তো পৃথিবীর ইতিহাসেই বিরল। এ অবস্থায় এত দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চলছে কীভাবে এবং ইরান টিকে আছে কীভাবে সেটাই হলো বিস্ময়ের বিষয়। এর একমাত্র ব্যাখ্যা হচ্ছে ইরানের তরুনসমাজের বিপ্লব-উন্মাদনা। তারা যুদ্ধ করতো শহীদ হওয়ার জন্য এবং আয়াতুল্লাহদের ভাষায় জান্নাতের টিকেট পাওয়ার জন্য। তাদের নীতিবোধও ছিলো অনেক উঁচু। যুদ্ধকালের একটি খবর পড়েছিলাম দৈনিক ইত্তেফাকে। একটি ইরানী বিমান পোল ধ্বংস করার জন্য ‘ডাইভ’ দিয়ে বোমা না ফেলেই উপরে উঠে এসেছিলো। কিছুক্ষণ পর পাইলট আবার ‘ডাইভ’ দিতে গেলে বিপক্ষ বিমান থেকে ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়, আর পাইলট অক্ষত অবস্থায় আটক হন।
তাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, তুমি তো বোমা বর্ষণ করে নিরাপদে চলে যেতে পারতে। তোমার এ আচরণের কারণ কী?!
পাইলট বললেন, প্রথমবার আমি যখন নীচে নেমে আসি তখন একটি গরুরগাড়ী পোল পার হচ্ছিলো!
যুদ্ধের অভিধানে এর নাম আত্মঘাতী ভাবাবেগ হলেও এ ঘটনা ঘটেছিলো এবং আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে তা ব্যাপক প্রচার পেয়েছিলো।
এককথায় ইরান নেমেছে ‘ধর্মযুদ্ধে’, পক্ষান্তরে ইরাকের যুদ্ধ হলো শাতিল আরবের উপর আধিপত্য বিস্তারের জন্য। ইরাক লড়ছে সমরশক্তির উপর, আর ইরান লড়ছে ‘ইসলামী’ বিপ্লবের শক্তির উপর। তাই ইরানকে এখনো কাবু করা সম্ভব হয়নি এবং হয়ত সম্ভব হবেও না। মাঝখানে শত্রুর হাতে পরাজিত হবে ইরাক, ইরান ও মুসলিম উম্মাহ।
আজ যখন এ সফরনামা লিখছি তখন ইরাক তো জ্বলে পুড়ে সারখার, ইরানেরও টুটি চেপে ধরার সব আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। তখন না আরব জাতীয়তাবাদের পূজারী সাদ্দাম তা বুঝতে পেরেছিলেন, না ইসলামী বিপ্লবের উন্মাদনায় আত্মহারা খোমেইনী। হযরত হাফেজ্জী হুযুর উভয় নেতার সামনে শুধু চোখের পানি ফেলে এসেছিলেন।
***
মুহম্মদের বাড়ীতে এসে আমি সত্যি বিস্ময়ে অভিভূত! বাড়ী তো নয় যেন সুন্দর একটি ছবি! বাড়ীর চারপাশে খেজুরগাছ তো আছেই, আরো আছে ফলের ও ফুলের বাগান। মধ্যখানে আকাশের শুভ্র মেঘের মত সুন্দর দ্বিতল বাড়ী। এখনো আমি এমন একটি সুন্দর বাড়ীর স্বপ্ন দেখি। কোন নদীর তীরে এমনই বাগান- ঘেরা একটি বাড়ী, যেখানে বসে আমি সাহিত্যের সাধনায় আত্মনিমগ্ন হবো। আমার লেখার কামরাটি হবে নদীর দিকে। জানালাপথে দেখা যাবে নদী এবং নদীর ঢেউ, আর দেখা যাবে পাল তোলা নাও। বাগানে পাখীর কোলাহল থাকবে, কিন্তু মানুষের শোরগোল থাকবে না। এ স্বপ্ন আমার পূর্ণ হয়নি, তবে সাহিত্যসাধনার আত্মিক আনন্দ আল্লাহ আমাকে দান করেছেন। সেজন্য আল্লাহর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
মুহম্মদের পরিবারের সবাই উষ্ণ আন্তরিকতার সঙ্গে আমাকে গ্রহণ করলো। মুহম্মদের বিধবা আম্মা বড় নেক খাতুন। পর্দার আড়াল থেকে সালাম ও কুশল বিনিময় করলেন এবং এ বাড়ীতে আমি আগন্তুক নই, পরিবারেরই একজন, একথা বললেন এবং স্নেহ ও মমতার সঙ্গেই বললেন। মুহম্মদের ছেলে-মেয়ে সবাই ছোট। নতুন মেহমান পেয়ে ওরা খুব হৈচৈ করলো।
আমার অন্তরে একটি সুপ্ত ইচ্ছে ছিলো, ইরাকের দু’একটি পরিবারকে নিকট থেকে দেখবো এবং ইরাকের পারিবারিক জীবন ও পরিবেশ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারণা লাভ করবো। এখানে সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো। আমার যদ্দুর মনে হয়েছে ইরাকী পরিবারে (এবং সম্ভবত অন্যান্য আরবদেশেও) ভাই-বেরাদরির সম্পর্ক এখনো যথেষ্ট মজবূত। চাচা ও চাচাতো ভাই এখনো তাদের কাছে অধিক আপন। পরিবারের বৃদ্ধ সদস্যরা খুব সম্মানিত। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও মতামতের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে পারিবারিক সিদ্ধান্ত-গুলোতে। দুপুরের খাবার ঘরে হবে না, বাড়ীর বাগানে, মুহম্মদের আধুনিকা স্ত্রী সে বিষয়ে মতামত নিলেন বিধবা শাশুড়ির এবং তার কথায় ছিলো শ্রদ্ধার অভিব্যক্তি।
অপরিসীম আনন্দের মাঝে কেটে গেলো সময়। ছায়াঘেরা বাগানে বড় চাদর বিছিয়ে দুপুরের খাবার একসঙ্গে খাওয়া হলো। বয়ামে খেজুরের সিরা সেই প্রথম দেখলাম; ভেবেছিলাম মধু। দস্তরখানে এটার যথেষ্ট কদর ছিলো। বেশ আনন্দ ও তৃপ্তির সঙ্গেই আহার-পর্ব সমাপ্ত হলো।
সামান্য সময়ের আতিথ্যের বন্ধনে আবদ্ধ এই আরব পরিবারটি থেকে বিদায় নিতে অন্তরে আমি ব্যথার টান অনুভব করলাম। আজ পঁচিশ বছর পর আমার জানা নেই বাগদাদের সেই সুখী পরিবারটির এখন কী অবস্থা? সে বাড়ীতেও কি আগুন লেগেছে? পশুদের হিংস্র থাবা কি সেই পরিবারটিকেও ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে? আমি জানি না; আমি শুধু শুভ কামনা করতে পারি।
ফেরার পথে মুহম্মদ আমাকে বাগদাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে গেলেন। প্রথমে দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার। বিশাল সংগ্রহ। আরবী, ইংরেজী, ফরাসী ও জার্মান ভাষার প্রচুর বই। বিষয়ভিত্তিকভাবে সাজানো। ক্যাটালগব্যবস্থা অত্যাধুনিক। জির্যাক্স মেশিন এর আগে আমি দেখিনি। কীভাবে পুরোনো বই জির্যাক্স করা হয় তা আমাকে দেখানো হলো। অত্যন্ত দুঃখের সাথে যে জিনিসটি অনুভব করলাম তা এই যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের এই কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে ইসলামী কুতুবখানার প্রতিনিধিত্ব ছিলো খুবই দুর্বল। পুস্তক সংগ্রহের ক্ষেত্রে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের গুরুত্বই সর্বাধিক। তাই জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখার সাম্প্রতিকতম প্রকাশনা যেখানে গ্রন্থতালিকায় সন্নিবেশিত হয়েছে সেখানে অনেক পুরোনো ইসলামী পুস্তকও দেখা গেলো অনুপস্থিত। দুপুরের ‘অসময়েও’ অধ্যয়নকারী ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতি ছিলো লক্ষণীয়। শিক্ষকদের অধ্যয়নের ব্যবস্থা আলাদা। মুহম্মদ আমাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। তার পরিচিত একজন বয়স্ক অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা হলো। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন একটি বিভাগের প্রধান। বেশ নিবিষ্ট চিত্তে অধ্যয়ন করছেন। তার অধ্যয়নে বিঘ্ন ঘটানো আমার ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু মুহম্মদ সেটাই করে বসলেন। যদিও একজন জ্ঞানবৃদ্ধের সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার আন্তরিক ইচ্ছা থেকেই তিনি এটা করেছেন, তবু কাজটা ঠিক হয়নি।
তিনি বই থেকে মুখ তুলে তাকালেন, যেন অনেক কষ্ট করে, মৃদু হেসে মুছাফাহা করলেন যেন আরো কষ্ট করে। আমার এখনো মনে হয়, তার দৃষ্টিতে ছিলো নীরব তিরস্কার। আমি খুব কুণ্ঠিত হলাম। অল্পক্ষণেই কুশল বিনিময় ও বিদায়পর্ব সমাপ্ত হয়ে গেলো। আমি তার অধ্যয়নে বিঘ্ন ঘটায় দুঃখ প্রকাশ করলাম। তিনি সৌজন্য প্রকাশ করে বললেন, ‘লা-হারাজ’! কিন্তু তার দৃষ্টির ভাষা পরিষ্কার বলছিলো, ‘বিরাট হারাজ’!
মনে পড়লে এখনো আমি খুব লজ্জা বোধ করি যে, যে বিষয়টি আমার নিজেরই অত্যন্ত অপছন্দ সেটারই উপলক্ষ হয়ে গেলাম আমি দূর বিদেশে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্ঞানবৃদ্ধের সামনে।
মুহম্মদ আগেই যোগাযোগ করেছিলেন ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের জনৈক অধ্যাপকের সঙ্গে। সেখানে কোন সমস্যা হয়নি। কারণ তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন এবং আমরা সময়মত পৌঁছতে পেরেছিলাম। বাংলাদেশে আমি আরবী ভাষার খেদমত করি শুনে তিনি খুশী হলেন। আধুনিক আরবী সাহিত্যে আমার পড়াশোনার পরিধি জানার জন্যই যেন তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গের অবতারণা করলেন। ডঃ তোয়াহা হোসাইন আমার পছন্দের লেখক নয়, কথাটা তার পছন্দ হলো না। আমি তাকে শুনালাম সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবীর সেই বিখ্যাত মন্তব্য, তোয়াহা হোসাইন সর্বঅর্থেই ‘আদব’ থেকে মুক্ত।
তিনি আমাকে তার নিজের রচিত ‘তাতাওউরুর-রিওয়ায়াতিল আরাবিয়্যাহ ফিল ইরাক’ নামে একটি মোটা সমালোচনা গ্রন্থ উপহার দিলেন, এবং যথারীতি সেটা এখন আমার কাছে নেই।
***
ঠিক সময়েই আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। যারা মাযার যিয়ারাতে গিয়েছিলেন তারাও ফিরে এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। হযরতের সঙ্গে আমরা কাযিমিয়্যা-এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। হযরত জা’ফর ছাদিক (রহ)-এর পুত্র হযরত মূসা আলকাযিম-এর মাযার এখানে অবস্থিত। এজন্যই পুরো এলাকার এ নাম। এটি দজলা নদীর পশ্চিম অংশ রাছাফায় অবস্থিত; তাই এবার আমাদের দজলা নদীর পোল পার হওয়ার সুযোগ হয়নি। আলাদা করে কথাটা বললাম এজন্য যে, দজলা নদীর পোল যতবার পার হয়েছি ততবারই প্রবাহমান নদীর দিকে নতুন পুলক, নতুন শিহরণ ও নতুন আবেগ অনুভব করেছি। আজও মুহম্মদের সঙ্গে দু’বার দজলা নদী পার হয়েছি এবং একবার গাড়ী থামিয়ে পোলের উপর দাঁড়িয়ে অনেক্ষণ বয়ে যাওয়া নদীর সৌন্দর্য এবং হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের বেদনা অনুভব করেছি। আজ এত বছর পর এত দূর থেকে দজলা নদীর বেদনা আবার আমাকে ভীষণভাবে দগ্ধ করছে। কারণ তাতারী বর্বরতার পর এই প্রথম আবার দজলার পানিতে ইরাকী মুসলমানদের লাশ ভেসে যাওয়ার খবর শুনতে পাচ্ছি।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা হযরত মূসা আলকাযিম (রহ)-এর মাযারে পৌঁছে গেলাম। মাযারের সৌধ অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ। সেটা না হয় মেনে নেয়া গেলো, কিন্তু আফসোস, সেখানে এমন সব প্রকাশ্য শিরক ও বিদ‘আত ছিলো যা এই মাযারের বাসিন্দার রূহকে নিঃসন্দেহে কষ্ট দেয়। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিলো না। শিরক ও বিদ‘আতের সর্বনাশা সায়লাবের মুখে আমরা তো নিজের দেশেও অসহায়।
তাকওয়া ও ধার্মিকতা, জ্ঞান ও প্রজ্ঞা এবং উন্নত নৈতিকতা ও চারিত্রিক পবিত্রতায় মহান নবীপরিবারের তিনি ছিলেন উজ্জ্বল তারকা এবং সমকালীন মুসলিম উম্মাহর ভক্তি-শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কেন্দ্র। ইলমে হাদীছের অঙ্গনেও ছিলো তাঁর অতি উচ্চ মর্যাদা। তাঁর কবরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ আমি বেদনায় স্তব্ধ হয়ে থাকলাম এবং অন্তরের গভীরে অনুভব করার চেষ্টা করলাম যে, তাঁকে যখন মদীনা ছেড়ে বাগদাদে আসতে বাধ্য করা হয়, তাঁর অন্তর তখন কেমন বেদনাদগ্ধ হয়েছিলো! মদীনায় নানাজানের রওযা শরীফ ছিলো তাঁর জন্য প্রাণ শীতল করা সান্ত্বনা; বাগদাদে তিনি ছিলেন একেবারে সান্ত্বনাবিহীন। বিদ্রোহের অমূলক আশংকায় খলীফা আলমাহদী তাঁকে বাগদাদে নিয়ে আসেন। পরে স্বপ্নযোগে হযরত আলী (রা)-এর তিরস্কারে ভীত হয়ে তাঁকে মুক্তি দেন এবং সসম্মানে মদীনায় পৌঁছে দেন। পরবর্তীতে একই অন্যায় করেন খলীফা হারূনুর-রাশীদ। দ্বিতীয়বার তাঁকে আনা হয় বন্দী করে। বাগদাদের বন্দীজীবনেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর অন্তরে তখন ব্যথা-বেদনার কেমন ঢেউ ছিলো তা কিছুটা হলেও বোঝা যায় মৃত্যুর পূর্বে খলীফা হারূন রাশীদের নামে লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত, অথচ সারগর্ভ সেই ঐতিহাসিক পত্র থেকে, যা আরবী সাহিত্যের অনন্য- সাধারণ সৃষ্টিরূপে স্বীকৃত, যাতে একদিকে রয়েছে গভীর মর্মবেদনার ‘শান্ত’ প্রকাশ, অন্যদিকে রয়েছে যালিমের প্রতি কঠিন সতর্কবাণী। তিনি বলেন-
‘আমার দুঃখের প্রতিটি দিন তোমার সুখের একটি করে দিন সঙ্গে করে বিদায় হচ্ছে। সুতরাং দুঃখেরও শেষ হবে এবং সুখেরও অবসান হবে। তারপর আমাদের সামনে আসবে এমন এক সময়, যা কখনো শেষ হবে না। সেদিন ধ্বংস তাদের জন্য যারা অন্যায়ের উপর রয়েছে।’
৫ই রজব ১৬৩ হিজরীতে তাঁর ইনতিকালে বাগদাদ যেভাবে শোক প্রকাশ করেছিলো, আকাশে বাতাসে কান্নার যে রোল উঠেছিলো তা প্রমাণ করে যে, মূসা আলকাযিম বন্দী ছিলেন না, বন্দী ছিলেন খলীফা হারূন রাশীদ নিজেরই হাতে নিজে।
যিয়ারাতের পর অন্তরের অন্তস্তল থেকে আল্লাহর দরবারে এই মুনাজাত করলাম, হে আল্লাহ! আমার কলবে তুমি তোমার পেয়ারা হাবীবের মুহাববাত দান করো; তোমার নবীর আহলে বাইতের প্রতিও মুহাববাত দান করো এবং সেই মুহাববাতের সঠিক প্রকাশ আমার জীবনে দান করো। নবী ও নবীপরিবারের মুহাববাত যেন হয় আখেরাতে আমার নাজাতের ওয়াছীলা।
হযর মূসা আলকাযিম (রহ)-এর কবর যিয়ারাত করার পর আমাদের হযরত আশ্চর্য এক মন্তব্য করলেন। তিনি বললেন, ‘আমার দিল বলছে, এটা যেন জান্নাতুল বাকীর একটি হিস্সা। জান্নাতুল বাকীর সঙ্গে যেন এই কবরের নিসবত রয়েছে।’
যিয়ারাতের পর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেদনাদায়ক সব দৃশ্য দেখতে লাগলাম। শিয়াসম্প্রদায় মূসা আলকাযিমকে মনে করে তাদের বারো ইমামের একজন। তাই মাযারে সবসময় তাদের হুজুম লেগেই আছে। উচ্চস্বরে ক্রন্দন তো স্বাভাবিক, কিন্তু কেউ জালি চুম্বন করছে, কেউ উপুড় হয়ে সিজদা করছে, আর মাযারের ভিতরে লাগাতার ‘মুদ্রাবর্ষণ’ করছে। যেন মাযার ওয়ালার রূহকে কষ্ট দিয়েই তারা রূহানি ফয়েয হাছিল করবে। হায়, এখানে শায়িত মহান ব্যক্তির যদি কথা বলার শক্তি থাকতো!
***
হযরত মূসা আলকাযিম (রহ)-এর মাযার-সীমানায় যে মসজিদ তার নাম জামে আবু ইউসুফ। মসজিদের একপার্শ্বে হযরত ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর মাযার। হযরতের পিছনে পিছনে আমরা সেখানে উপস্থিত হলাম। মানুষ যেভাবে ফুলের ঘ্রাণ নেয়, হযরত যেন ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর কবর থেকে সেভাবে ইলমের ঘ্রাণ নিলেন। তাঁর হালাত দেখে এ উপমাটাই আমার মনে হলো।
ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর পর ইসলামী উম্মাহ ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর জ্ঞান ও প্রজ্ঞার মহাঋণ থেকে কখনো মুক্ত হতে পারবে না। এই মহান ছাত্রের মাধ্যমেই ইমাম আ‘যম ছাহেবের ফিকহী মাযহাব সুসংহত রূপ লাভ করেছে এবং মুসলিমবিশ্বে তা এমন ব্যাপক প্রসার লাভ করেছে। সর্বোপরি সুদীর্ঘ কাল ইসলামী জাহানের প্রধান বিচারপতি- রূপে হানাফী ফিকাহকে তিনি তাত্ত্বিকতার স্তর থেকে বাস্তবতার মজবুত বুনিয়াদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। হবে নাই বা কেন! ইমাম আবু হানীফা (রহ) তো ভবিষ্যতের ইমামরূপে নিজ হাতে তাঁকে গড়ে তুলেছিলেন।
ইলমে ফিকাহর পর ইলমুল হাদীছেও তাঁর উচ্চ মরতবা ছিলো সর্বস্বীকৃত। এমনকি অজ্ঞতাবশতঃ যারা ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর হাদীছজ্ঞান সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছেন তারা পর্যন্ত হাদীছের ক্ষেত্রে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর অগাধ জ্ঞানের অকুণ্ঠ স্বীকৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়েছেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বল তো এত দূর বলেছেন যে, তাঁর হাদীছ-শিক্ষার বিসমিল্লাহই হয়েছে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ)-এর হাতে। আপ্লুত হৃদয়ে আমি যখন এই মহান ইমামের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আছি তখন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগলো তাঁর জীবনের স্মরণীয় বিভিন্ন ঘটনা। আমি যেন দেখতে পেলাম সেই এতিম বালককে যার হাতে দিরহাম ভর্তি থলিয়া দিয়ে স্নেহশীল উস্তায ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলছেন, নাও খরচ করো, শেষ হলে আবার চেয়ে নিয়ো। কিন্তু চাওয়ার প্রয়োজন হয়নি কখনো। কারণ শেষ হওয়ার আগেই উস্তায আবার তা পূর্ণ করে দিয়েছেন।
আমি যেন দেখতে পাচ্ছি সেই দৃশ্য যখন এতীম বালকের উৎকণ্ঠিতা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলছেন, ‘তোমার পুত্র তো একদিন পেস্তা ও ঘী দ্বারা তৈরী ফালুদা খাবে।’
ফালুদা ছিলো খলীফা হারূন রাশীদের দস্তরখানের দুর্লভ খাদ্য। ইমাম আবু ইউসুফ একদিন সেই ফালুদা দেখে খলীফাকে বললেন, আজ আল্লাহ আমার উস্তাযের কথা পূর্ণ করেছেন।
ঘটনা শুনে বিস্মিত খলীফা বললেন, ইমাম আবু হানীফাকে আল্লাহ রহম করুন। তিনি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দ্বারা যা দেখতেন মানুষ তাদের স্থূল চোখে কীভাবে তা দেখতে পাবে!
এখানে দাঁড়িয়ে আমি যেন সেই ঐতিহাসিক বিচার দরবার দেখতে পেলাম যেখানে খলীফাতুল মুসলিমীনের পুত্র মূসা ইবনুল মাহদীকে তলব করা হলো আসামীরূপে এবং সন্দেহবশতঃ রদ করা হলো খলীফার পক্ষে প্রদত্ত সাক্ষ্য। ফলে খলীফাকে মেনে নিতে হলো বাদীপক্ষের দাবী।
আমি যেন দেখতে পেলাম মৃত্যুশয্যায় শায়িত ইমাম আবু ইফসুফকে, যিনি তখনো একটি মাসআলা আলোচনা করছেন, আর বলছেন, ‘না জেনে কবরে যাওয়ার চেয়ে জেনে কবরে যাওয়া ভালো।’ যার সঙ্গে মাসআলা আলোচনা করছিলেন তিনি দরজা পর্যন্ত না যেতেই ইমাম শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।
ইসলামী জাহানের সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রধানবিচারপতির কবরের সামনে দাঁড়িয়ে আমি লজ্জিত মনে ভাবলাম, আজ যারা ইমাম আবু ইউসুফের উত্তরসূরী তাদের কি রয়েছে ইসলামী বিচারব্যবস্থা পরিচালনার ন্যূনতম যোগ্যতা! আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কি পেরেছে এমন যোগ্যতা অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে!
বড় স্থানে দাঁড়ালে ছোট মনেও বড় চিন্তা করার সাহস জাগে। আর আল্লাহর রহমত তো অনেক সময় বড়-ছোটর সীমারেখাও মুছে ফেলে। এই মহান ইমামের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তাই আমি সাহস পেলাম এই প্রতিজ্ঞা করার যে, সারা জীবন সাধনা করবো আমি আমার দেশে শিক্ষাব্যবস্থার এমন সংস্কারের যা উম্মাহকে উপহার দিতে পারে যুগের ইমাম আবু ইউসুফ! হে আল্লাহ! তুমি তাওফীক দাও, শক্তি দাও।
জামে আবু ইউসুফে আছর পড়ে হযরতের সঙ্গে আমরা হোটেলে ফিরে এলাম। মুহম্মদ আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য তখনো ছিলেন। তিনি বললেন, চলো তোমাকে দজলা নদীর সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য দেখাবো।
আমার মনের ইচ্ছেটাই যেন তার মুখে উচ্চারিত হলো। তাই স্বানন্দে তার কথায় রাজী হলাম। হযরতও খুশিমনে ইজাযত দিলেন।
দজলার উভয় তীরে বেশ কিছু বিনোদনকেন্দ্র রয়েছে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত এসকল স্থানে বিনোদন প্রেমিকদের সমাগম থাকে। দজলা-তীরের বিনোদন অবশ্য শুধু আধুনিক বাগদাদের নয়, প্রাচীন বাগদাদেরও বৈশিষ্ট্য ছিলো। আববাসী যুগের সাহিত্যে এবং বিশেষতঃ আবু নাওয়াসের কাব্যসমগ্রে এর প্রচুর উদাহরণ রয়েছে।
এখানে শিশুদের জন্য আছে শিশু-উদ্যান, তাতে খেলাধূলার এমন সব বিচিত্র উপকরণ, আমাদের দেশে যা কল্পনাও করা যায় না।
কিছু কিছু স্থান অপেক্ষাকৃত নির্জন। একটু দূরে হলেও নির্জনতা যাদের ভালো লাগে তারা সেখানে চলে যায়। নিরাপত্তা ও শান্তিশৃঙ্খলা এখানে, বাগদাদে এবং সমগ্র ইরাকে এত সুসংহত যে, সাধারণ অপরাধও শূন্যের কোঠায়। তাই গভীর রাত পর্যন্ত নারী-পুরুষ ও তরুণ-তরুণীরা এখানে নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়।
সবচে’ আনন্দের বিনোদন হলো ছোট ছোট স্পীডবোটে দজলার বুকে ছুটে বেড়ানো। প্রতিটি বিনোদন- কেন্দ্রেই রয়েছে স্পীডবোট ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা। যারা স্থায়ী সদস্য এবং স্পীডবোট চালনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তারা নিজেরাই চালাতে পারে, অন্যথায় সঙ্গে চালক নিতে হয়। মুহম্মদ দুই সিটের একটি বোট ভাড়া নিলেন এবং আমরা দজলার পানিতে ভাসলাম। দজলার বুকে তখন বিদায়ী সূর্যের সোনালী আলো পড়েছে। অসংখ্য স্পীডবোট ছোটাছুটি করছে। কোনটা ধীর গতিতে, কোনটা দ্রুত গতিতে, আর কোনটা তীরবেগে। দীর্ঘস্থায়ী এবং অনিশ্চয়তাপূর্ণ একটি যুদ্ধের দেশে এমন আনন্দমুখর পরিবেশ কল্পনাও করা যায় না। এটা ভালো না, মন্দ বলা সহজ নয়, তবে বিষয়টি কৌতুহলোদ্দীপক।
মুহম্মদ ধীরে ধীরে গতি বাড়াতে লাগলেন এবং একসময় গতি এমন তীব্র হলো যে, আমার রীতিমত ভয় ধরার অবস্থা। চালকের আসনে মুহাম্মদ কিন্তু বেশ হাসিমুখ। বোঝা গেলো, এ বিষয়ে তিনি অভ্যস্ত এবং সিদ্ধহস্ত। ইরাকে সরকারী কর্মকর্তাদের শুনেছি সামরিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। অন্যদিকে আমি বেচারা মাদরাসার নিরীহ এক ‘হুজুর’। আগে জানলে হয়ত পানিতেই নামতাম না, কিন্তু এক বিদেশীর সামনে এখন তো আর ভীরুতা প্রকাশ করা চলে না; তাই চেহারায় যথাসম্ভব ‘কুছ নেহী’ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলাম। তাতে ভয়টা কেটে গিয়ে একধরণের রোমাঞ্চের অনুভূতি সৃষ্টি হলো। এদিকে গতি আরো বাড়লো। লক্ষ্য করলাম, অনেকেই যেন অলিখিত এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। মুহম্মদ জানালেন, এভাবে মাঝে মধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটে। তবে তার ভাষায়, ঘটনা ও দুর্ঘটনাই তো জীবন। আমি মৃদু হেসে বললাম, বরং ঘটনা ও দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণই হলো জীবন।
নদীতে আমি নৌকা ভ্রমণ করেছি, লঞ্চে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দিয়েছি, বড় জাহাজেও চড়েছি। সে সবই ছিলো আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা। কিন্তু আজকের আনন্দ এবং অভিজ্ঞতা দু’টোই অন্যরকম। ভয়, শিহরণ, পুলক, উৎকণ্ঠা সবকিছুর অদ্ভুত একটা মিশেল। এটা শুধু অনুভব করা যায়, শব্দে প্রকাশ করা যায় না।
প্রাচীন বাগদাদে আমীর-ওমরারা নাকি দজলার বুকে শানদার বজরায় ঘুরে বেড়াতেন। চাঁদনি রাতে শাহী মহলের শাহযাদিরাও নাকি দজলার ঝিলমিল পানিতে নৌবিহার করতেন। কিন্তু এখনকার এই যে গতির আনন্দ, সেটা ছিলো তাদের কল্পনারও অতীত। আবার আগামী যুগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মানুষকে যে গতি দান করতে যাচ্ছে তার তুলনায় আজকের গতিকেও হয়ত মনে হবে শম্ভুক গতি। অথচ প্রত্যেক যুগের মানুষ নিজের গতি ও শক্তি নিয়ে কত না গর্বিত! এটা হয় শুধু আগামী দিন সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে। দজলার বুকে আজ এই যে গতির ঢেউ, নীলনদের ফিরআউন কি তা কল্পনাও করতে পেরেছিলো! কতটুকু উচ্চতায় সে খুঁজতে গিয়েছিলো মূসার ইলাহকে? এখন তো আমরা আরো অনেক উচ্চতা থেকে দেখতে পাই পৃথিবীকে! মানুষ তো এখন মহাশূন্যের অভিযাত্রী! অজ্ঞতা ছাড়া আর কী কারণ ছিলো ফির‘আউনের ‘আনা রাববুকুমুল আ‘লা’ দাবীর পিছনে, যার আস্পর্ধা এযুগের মহাশূন্যচারী মানুষ পর্যন্ত করতে পারে না! অজ্ঞতা, শুধু অজ্ঞতা!
একসময় খেয়াল হলো, আমরা অনেক দূর চলে এসেছি। নদীর উভয় তীরে এখন আর শহরের চিহ্ন নেই। সূর্য এখন একটি লাল থালা। দজলার পানিতেও সেই লালের আভা। স্পীডবোটের সংখ্যা এদিকে অনেক কম। প্রকৃতির এমন সুন্দর দৃশ্য জীবনে আমি খুব কম দেখেছি। অন্তত আজকের এ আনন্দঘন মুহূর্তটির জন্য দজলাকে আমার মনে পড়বে। মুহম্মদ ধীরে ধীরে গতি কমালেন; আমরা নদীর তীরে নামলাম। তিনি বললেন, এখান থেকে সূর্যাস্তের দৃশ্য খুব সুন্দর উপভোগ করা যায়। আসলেও তাই। নদী এখানে বাঁক নেয়ার কারণে মনে হয় সূর্যটা যেন নদীতে ডুবে যাচ্ছে। অপূর্ব! সত্যি অপূর্ব! এমন একটি সুন্দর দৃশ্যের জন্য সূর্যের স্রষ্টার উদ্দেশ্যে আমার সিজদায়ে শোকর।
সুবহানাল্লাহ! পরের দৃশ্য যে আরো সুন্দর! অর্ধেকটা সূর্য যেন পানিতে ডুবে আছে, বাকি অর্ধেকটা জেগে আছে পানির উপরে! একসময় পুরো সূর্যটাই ডুবে গেলো দজলার পানিতে। নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আমি উপভোগ করলাম সে দৃশ্য। যে সূর্যের অস্ত যাওয়ার দৃশ্য দেখে আমরা এত মুগ্ধ সে সূর্য নিজেও তো আল্লাহর তাসবীহ পড়ে! যে দজলার বুকে গতির ঢেউ তুলে আমাদের এত আনন্দ তার স্রোতে তরঙ্গেও তো শোনা যায় সুবহানাল্লাহর সুমধুর ধ্বনি! ‘ওয়ালাকিন লা তাফকাহূনা তাসবীহাহুম।’ তাহলে সৃষ্টির সৌন্দর্য অবলোকন করে কেন আমরা আল্লাহর শোকর আদায় করবো না! কেন আল্লাহর নামে তাসবীহ পাঠ করবো না!
বিশ পঁচিশজন মানুষ আমরা সেখানে মাগরিব আদায় করলাম। দজলা নদীর তীরে উন্মুক্ত আকাশের নীচে সবুজ ঘাসের জায়নামাযে সেটাই ছিলো আমার জীবনের একমাত্র সিজদা। নামাযের পর প্রায় নির্জন সেই নদীর তীরে মুক্ত নির্মল বাতাসে আমরা অনেক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম। মুহম্মদ তখন তার জীবনের অনেক কথা বলেছিলেন আমাকে। সেসব কথা এখন আর মনে নেই, সেই সব অনুভূতিও স্মরণে নেই। স্মৃতিতে রয়ে গেছে শুধু ঝাপসা কিছু ছবি। কিন্তু দজলার স্রোত যেন এখনো আমি দেখতে পাই; এখনো শুনতে পাই দজলার তরঙ্গ ধ্বনি। আর সুন্দর মনের সেই মানুষটির ভালোবাসার উষ্ণতা এখনো আমি অনুভব করি।
রাতের দজলা সম্পূর্ণ ভিন্ন এক রূপ ধারণ করেছে। চারদিকে শুধু আলোর ছোটাছুটি। মানুষ দেখা যায় না, শুধু যেন আলোরা মেতে উঠেছে আনন্দে! বড় সুন্দর দৃশ্য! দজলা কত দিন ধরে বয়ে চলেছে এভাবে; কত দিন ধরে বয়ে যাবে এভাবে! নদীও থেমে নেই, মানুষও থেমে নেই। নদীর গতি শুনেছি সাগরের অভিমুখে, কিন্তু মানুষের গতি! দজলা নদীর তীরে সমৃদ্ধ বাগদাদ নগরীতে যারা বাস করে কোন দিকে তাদের গতি? রক্তের স্রোতে কোথায় ভেসে চলেছে তারা? তেহরানের পাশেও কি আছে কোন নদী?
সন্ধ্যার বেশ কিছু পরে আমরা বিনোদনকেন্দ্রে ফিরে এলাম এবং একটি পরিচ্ছন্ন রেস্তোঁরায় খোলা চত্বরে গিয়ে বসলাম। মুহম্মদ বললেন, তোমাকে দজলা নদীর সুস্বাদু মাছ খাওয়াবো। এ মাছ শুধু দজলাতেই পাওয়া যায়। তোমাদের দেশের ‘ইলছা’ অবশ্য আরো সুস্বাদু, তবে দজলার স্বাদও তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।
তারপর তিনি বললেন, এক্ষেত্রে রান্নার বিষয়টি অবশ্য গুরুত্বপূর্ণ। ইলছা আমি অনেক খেয়েছি, কিন্তু তোমার আম্মার হাতের রান্না ছিলো অন্যরকম! যদি সুযোগ পাই, অন্তত ইলছার স্বাদ গ্রহণের জন্য আবার বাংলাদেশে যাবো এবং তোমার আম্মার হাতের রান্না খাবো।
পঁচিশ বছর পর আমার আববা এখন দুনিয়াতে নেই; আম্মা আছেন, কিন্তু তাঁর হাতের রান্না নেই। দজলার মুহম্মদকে আবার যদি পদ্মার ইলিশের স্বাদ চাখাতে পারতাম, ভালো লাগতো; কিন্তু এসব কল্পনাও এখন রীতিমত পরিহাস। এখন তো বাগদাদ জ্বলছে এবং সে আগুনের ধোঁয়া এখান থেকেও দেখতে পাচ্ছি। আল্লাহ রক্ষা করুন বাগদাদকে এবং মুসলিম জাহানকে যামানার হালাকু খানের ধ্বংসযজ্ঞ থেকে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই আগুনে সেঁকা সেই মাছ এসে গেলো। নামটা এখন মনে নেই। তবে মোটামুটি সুস্বাদুই ছিলো। খেলামও মজা করে। তারপর কিছু সুন্দর সময়ের কিছু সুন্দর স্মৃতি বুকে ধারণ করে ফিরে এলাম হোটেলে।
***
পরদিন সকালে হঠাৎ জানানো হলো, ধর্মমন্ত্রী জরুরী বৈঠকের জন্য অপেক্ষা করছেন। এখনই যেতে হবে। এই তাড়াহুড়া আমার কাছে অদ্ভুত মনে হলো। কারণ তাদের জানা ছিলো আমাদের হযরত বয়োবৃদ্ধ মানুষ। অন্তত শারীরিক দিক থেকেও প্রস্ত্ততির জন্য তাঁর কিছুটা সময়ের প্রয়োজন। যাই হোক, হযরত সঙ্গে সঙ্গে রওয়ানা হলেন। ধর্মমন্ত্রণালয়ে পৌঁছার পর মাননীয় মন্ত্রী হযরতকে স্বাগত জানালেন এবং কুশল বিনিময়ের পর ফলফলাদি দ্বারা আপ্যায়ন করলেন।
রাজনীতি বা কূটনীতি আমার বিষয় নয়, তবু মন্ত্রীর আচরণে আমি একটা ‘গন্ধ’ পেলাম। কেন জানি মনে হলো, কোন কারণে তিনি অস্বস্তিতে আছেন। এর মধ্যে তিনি আচমকা প্রশ্ন করে বসলেন, জনাব আব্দুল মান্নান সম্পর্কে আপনাদের কী মতামত? অদ্ভুত প্রশ্ন! তার চেয়ে যদি জানতে চাইতেন, হোটেল মেরিডিয়ান কত তলা, এতটা অবাক হতাম না। ভাবতাম, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার আগে খোশমেজাজের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর এ কেমন উদ্ভট প্রশ্ন! কিন্তু তার চেয়ে বেশী অবাক হলাম হযরতের পক্ষ হতে যিনি জওয়াব দিলেন তার কথায়! তিনি বললেন, ইরাকে থাকা অবস্থায় তার বিরুদ্ধে আমি কিছু বলতে চাই না। বাংলাদেশের জনগণ তার কীর্তিকর্ম সম্পর্কে অবগত।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কারণ এ জবাব ছিলো হযরতের উপস্থিতিতে এবং তাঁর পক্ষ হতে। স্বভাবতই পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে উঠলো। আশ্চর্য, এটাই কি ইরাকের মাননীয় ধর্মমন্ত্রীর জরুরী বৈঠকের নমুনা! আর এটাই কি হযরতের সফর- সঙ্গীদের প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতার নমুনা!
কিছুক্ষণ পর মন্ত্রীমহোদয় ঘড়ি দেখে বললেন, আমরা এখন কাছরে জামহুরিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো। মহামান্য প্রেসিডেন্ট শায়খের জন্য অপেক্ষা করছেন।
আবার অবাক হওয়ার পালা। এভাবে ঘোর পথের কী প্রয়োজন ছিলো? হযরতকে সরাসরি কেন বৈঠকে নেয়া হলো না এবং বৈঠকের কথা আগেভাগে কেন জানানো হলো না? বাংলাদেশে হযরতের অবস্থান ও মর্যাদা সম্পর্কে ইরাক সরকার কি অবগত নয়?
যাই হোক ঘটনা নিজস্ব গতিতেই এগিয়ে চললো। গাড়ীর বহর রওয়ানা হলো কাছরে জামহূরিয়ার উদ্দেশ্যে। সুরক্ষিত বিশাল প্রাসাদ। অনেকগুলো নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে আমরা পৌঁছলাম প্রাসাদের অভ্যন্তরে। সেখানেও অতিক্রম করতে হলো অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণ। তারপর হযরতকে নেয়া হলো অপেক্ষা-কক্ষে। সেখানে এক নতুন বিস্ময়! জনাব আব্দুল মান্নান একা বসে আছেন তাকিয়ায় হেলান দিয়ে। হযরতকে দেখে নড়লেন-চড়লেন না। হয়ত শারীরিক কষ্ট ছিলো। কিন্তু আমাদের বিস্ময়ের কারণ হলো, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে হযরতের বৈঠকের মুহূর্তে তিনি এখানে কেন? মাননীয় ধর্মমন্ত্রী কি আসলে তাঁর সীমাবদ্ধতার ভিতরে থেকে আমাদেরকে কোন বার্তা দিতে চেয়েছিলেন? কেন জানি মনে হলো, বড় কোন দুর্ঘটনা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, যা হযরতের জন্য সুখকর হবে না। পুরো সফরে হযরতের মুখপাত্ররূপে যিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব, তাঁকে আমার আশঙ্কার কথা জানালাম। তিনি বললেন, কিছু না। হয়ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাদের বৈঠক আমাদের আগে বা পরে হওয়ার কথা আছে। আমি বললাম, ‘তারা’ কোথায়? এখানে তো শুধু ‘তিনি’! মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাহেব আমাকে সমর্থন করে বললেন, ‘আগেই বিষয়টির ফায়ছালা হওয়া উচিত। মনে হয়, এটা বৈঠক বানচাল করার কোন ষড়যন্ত্র। কিন্তু আশ্চর্য, হযরতের সফরসঙ্গীদের কেউ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিলেন না।
সভাকক্ষে প্রবেশের জন্য নাম ঘোষণার সময় আবার আমাদের তাজ্জব হওয়ার পালা। প্রথমে জনাব আব্দুল মান্নান, তারপর হযরত হাফেজ্জী হুযূর। খান ছাহেব তখন আবার জোর দিয়ে বললেন, আমাদের উচিত এভাবে সভাকক্ষে প্রবেশ না করা। কিন্তু মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব বললেন, এখন এসব চিন্তা করার সময় না।
বুঝতে পারলাম না, চিন্তা করার সময়টা তাহলে কখন? আমরা চিন্তা না করেই প্রবেশ করলাম। বসার ব্যবস্থা হলো নাম ঘোষণা অনুযায়ী। অর্থাৎ প্রতিনিধিদলের অঘোষিত প্রধান হয়ে গেলেন জনাব আব্দুল মান্নান! ইরাকী কর্মকর্তারা যখন গ্রুপফটো তোলার আয়োজন করলেন তখন মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব এই বলে প্রতিবাদ করলেন, ‘ঐ লোক’ আমাদের ‘শান্তিমিশনের’ সদস্য নয়, সুতরাং তার সঙ্গে গ্রুপফটোতে আমরা রাজী নই।
বুঝলাম না যে, এটা কেমন বেমক্কা প্রতিবাদ! আমরা তো নাম ঘোষণা অনুযায়ী প্রবেশ করেছি এবং সেভাবেই আসন গ্রহণ করেছি। তাহলে সেভাবে ফটো তুলতে আপত্তি কেন? তাছাড়া এবং সেটা আরো গুরুত্বপূর্ণ। ছবি সম্পর্কে শরীয়াতের মাসআলা এবং উলামায়ে হিন্দের মাসলাক কী? থানবী (রহ)-এর সিদ্ধান্ত এবং আমাদের হযরতের আচরণ কী? আর আমরা কী করছি? এর জবাব সুখকর নয়, সুতরাং তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
পরিস্থিতি সম্পর্কে হযরত ছিলেন অনবগত। কিন্তু যখন দেখলেন ক্যামেরা প্রস্ত্তত তখন এখানেও তিনি সেই প্রিয় দৃশ্যটির অবতারণা করলেন যা সারা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। বরং বিশ্ব শুধু এই একটি দৃশ্য থেকে হাতে কলমে জানতে পেরেছে যে, ছবি সম্পর্কে শরীয়াতের বিধান কত কঠোর! হযরত রুমাল দিয়ে মুখ ঢেকে ফেললেন। কর্মকর্তারা তখন অবাক হয়ে তাদের যন্ত্রপাতি গুটিয়ে নিলেন।
প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসাইন সদলবলে সভাকক্ষে প্রবেশ করলেন। কিছুক্ষণের জন্য আমি সবকিছু ভুলে এই আশ্চর্য মানুষটির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচে’ আলোচিত ব্যক্তিদের একজন তিনি। সৈনিকসুলভ সুদৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে এলেন। প্রতিটি পদক্ষেপে যেন সাহসিকতা, নির্ভীকতা ও আভিজাত্যের বিচ্ছুরণ ঘটছিলো। তার সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় তার কিছুই দেখা গেলো না তার অভিব্যক্তিতে। দাম্ভিকতার লেশমাত্র নেই, না চলায়, না বলায়; না আচরণে, না উচ্চারণে। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ছিলেন ভাইস প্রেসিডেন্ট তোয়াহা ইয়াসীন রামাযান এবং তথ্যমন্ত্রী ও ধর্মমন্ত্রী। আমি আনন্দের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, যেভাবে আসন সাজানো হয়েছে সেভাবে নয়, বরং প্রেসিডেন্ট প্রথমে মোছাফাহা করলেন হযরত হাফেজ্জী হুযূরের সঙ্গে এবং বেশ কিছুক্ষণ তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করলেন। তার অভিব্যক্তিতে ভক্তি ও শ্রদ্ধার অভিপ্রকাশই আমি দেখতে পেলাম। তারপর তিনি সংক্ষিপ্ত কুশল বিনিময় করলেন মাওলানা আযীযুল হক, জনাব আব্দুল মান্নান ও অন্যান্যের সঙ্গে।
আলোচনার শুরুতেই প্রেসিডেন্ট যুদ্ধের প্রচন্ড ব্যস্ততার কারণে সাক্ষাতের জন্য সময় দিতে বিলম্ব ঘটায় দুঃখ প্রকাশ করলেন এবং জানতে চাইলেন, ইরাক সফরের দিনগুলো তাঁর কেমন কাটছে।
প্রেসিডেন্টের কথার সূত্র ধরে হযরত নিজের আলোচনা শুরু করলেন এভাবে, ‘আমার সফরের দিনগুলো সুন্দর কাটছে এবং আপনার আন্তরিক মেহমানদারির জন্য শুকরিয়া। তবে যেহেতু আমার এখানে আসার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো যুদ্ধ বন্ধের বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করা, সেহেতু আমি আজকের বৈঠকের জন্য বেচায়ন ছিলাম।
প্রেসিডেন্ট বললেন, দেখুন, আমি তো যুদ্ধ বন্ধ করতে চাই। সেজন্য প্রতিটি আন্তর্জাতিক ফোরামে নিঃশর্ত যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব দিয়ে আসছি। কিন্তু ইরান কোন প্রস্তাবেই সাড়া দিচ্ছে না। তাদের একই কথা, সাদ্দামের পতন ছাড়া যুদ্ধ বন্ধ হবে না। এ অবস্থায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমি কী করতে পারি?
হযরত বললেন, আমরা সবাই মুসলমান। আমাদের সবার শাসনব্যবস্থা হলো কোরআন ও সুন্নাহ। আপনি আপনার দেশে কোরআন ও সুন্নাহর শাসন ঘোষণা করুন; ইরান তার ক্ষতিপূরণের দাবীসহ সমস্ত শর্ত প্রত্যাহার করে নিঃশর্ত যুদ্ধ বন্ধে প্রস্ত্তত আছে।
এ পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট কিছুটা উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, দেখুন, ইরানের খোমেইনীর আদেশে আমি ইসলামী হুকুমত কায়েম করবো না। আমাদের শাসনব্যবস্থা আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়। তাতে হস্তক্ষেপের অধিকার
কারো নেই।
হযরত কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমি আপনার দ্বীনী ভাই এবং আমি শুধু সেই দৃষ্টিতেই কথা বলছি। আমি যা বলছি তা ইরানের বা খোমেইনীর শর্ত নয়। এটা আমার নিজের প্রস্তাব এবং খোমেইনী তা গ্রহণ করেছেন। এখন আপনি কবুল করলেই আমি আগে বাড়তে পারি। আমি উভয় দেশকে আল্লাহর রজ্জু ধরে এক হওয়ার দাওয়াত দিচ্ছি।
প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম বললেন, যুদ্ধ বন্ধের জন্য আমার প্রস্তাব হলো, ইরান এবং ইরাক পরস্পরের স্বার্বভৌমত্ব স্বীকার করবে। একে অপরের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবে না এবং কেউ কারো উপর নিজের শাসনব্যবস্থা চাপিয়ে দেবে না। ইরান এই তিন শর্ত মেনে নিলে যুদ্ধ বন্ধ করতে আমার কোন আপত্তি নেই। আপনি ইরানকে এই তিন শর্তে রাজী করাতে চেষ্টা করুন।
হযরত বললেন, দেখুন, আমি কারো শর্ত কাউকে মানাতে এই সফরে বের হইনি। আমার বয়স দেখুন। এটা এমন সফরের উপযোগী বয়স নয়। আমি উভয়কে ইসলামের হুকুমত কবুল করার দাওয়াত দিয়েছি এবং আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধারার আহবান জানিয়েছি। আমি আবারো আমার দরদভরা আবেদন পেশ করছি। আপনি এবিষয়ে কিছু বলুন।
প্রেসিডেন্ট বললেন, ইসলামী হুকুমত কায়েম করবো কীভাবে? শিয়ামতে, না সুন্নীমতে? হানাফীমতে, না হাম্বলী মতে?
সাদ্দামের মত একজন আরব রাষ্ট্রনায়কের এমন সরল চিন্তা আমাকে অবাক করলো। এগুলো তো সাধারণ মানুষের কথা। তাঁর তো আরো গভীর চিন্তার অধিকারী হওয়ার কথা। যাই হোক, হযরত জবাবে বললেন, আপনি তো ইসলামী হুকুমত করবেন কোরআন-সুন্নাহমতে। তাতে শিয়া-সুন্নী তো দূরের কথা, তাতে তো অমুসলিমরাও নিজ নিজ ধর্মীয় অধিকার ভোগ করবে।
প্রেসিডেন্ট এবার আরো লঘু কথা বললেন। তিনি বললেন, ইসলাম কায়েম করার চেষ্টা তো আমি করছি এবং এক্ষেত্রে বেশ সফলতাও অর্জিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ তিনি প্রথমে তার মাযারসংস্কার- বিষয়ক কর্মকান্ডের কথা বললেন, আর বললেন এতীম-বিধবাদের কল্যাণভাতা ও অন্যান্য জনকল্যাণ- মূলক কার্যক্রমের কথা।
হযরত একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, আপনি ভালো করেই জানেন, আমি কোরআন-সুন্নাহভিত্তিক দেশ শাসনের কথা বলছি। আর একমাত্র এপথেই আমাদের কামিয়াবি, দুনিয়াতে এবং আখেরাতে।
প্রেসিডেন্ট তখন মৃদু হেসে বললেন, শায়খে মুহতারাম, আপনার দেশে কি সেই ইসলামী হুকুমত কায়েম হয়ে গেছে যে, ইরাকে দাওয়াত নিয়ে এসেছেন?
মনে হলো হযরত ব্যথা পেলেন। তিনি বড় দরদের সাথে বললেন, আমার দ্বীনী ভাই! বাংলাদশে ইসলামী হুকুমত কায়েমের জন্য আমি সারা জীবন মেহনত চালিয়ে আসছি। আপনি এবং এরশাদ দু’জনই আমার ভাই। আমি দু’জনকেই দাওয়াত দিয়েছি। যে কবুল করবে সেই কামিয়াব হবে।
এতক্ষণ পর প্রেসিডেন্ট একটি ‘সানজীদা’ ও প্রাজ্ঞ কথা বললেন। তিনি বললেন, ইসলামী হুকুমত কায়েম করা তো একদিনের কাজ নয়; তাছাড়া আমার বাস্তব কিছু সমস্যাও রয়েছে। তবে আমি কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় বসতে সম্মত আছি।
হযরত বললেন, এটা যে একদিনের কাজ নয় তা আমি জানি এবং বাস্তব সমস্যা সম্পর্কেও আমার ধারণা রয়েছে। তাই আমি সে দাবীও জানাচ্ছি না। শুধু বলছি, আপনি কোরআন-সুন্নাহর শাসন জারির ঘোষণা দিন। তারপর পর্যায়ক্রমে আগে বাড়ুন এবং নিশ্চিন্ত থাকুন যে, আল্লাহ গায়ব থেকে মদদ করবেন। যেগুলোকে আপনি সমস্যার পাহাড় মনে করছেন, আল্লাহর ইচ্ছায় সেগুলো আপনার রাস্তা থেকে সরে যাবে। আপনি এককদম আগে বেড়ে তো দেখুন, আল্লাহ আপনার দিকে দৌড়ে আসবেন। এটা তো আল্লাহর ওয়াদা।
এপর্যন্ত সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই অগ্রসর হচ্ছিলো এবং আলোচনা চলছিলো হযরত ও প্রেসিডেন্ট, এ দু’জনের মাঝে। মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব শুধু তরজমার দায়িত্ব পালন করছিলেন। আমরা সবাই গভীর আগ্রহের সঙ্গে আলোচনার গতিবিধি অনুসরণ করছিলাম। এবার ছিলো প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পালা। এবং মনে হলো তিনি কিছু বলার জন্য প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছেন। আর তখনই ঘটলো সেই বিস্ফোরণ, যার আশঙ্কা ছিলো প্রতিমুহূর্তে। জনাব আব্দুল মান্নান প্রেসিডেন্টের ডান পাশের আসনটি দখল করে চুপচাপ বসে ছিলেন এবং বেশ নিরীহভাবেই ছিলেন। এবার তিনি স্বমূর্তি ধারণ করে প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘খোমেইনী কাফের, দজ্জাল, শয়তান। এরা সব খোমেইনীর দালাল। সুতরাং এসব বেহুদা আলোচনায় আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করা উচিত নয়। বাংলাদেশের জনগণ সবসময় ইরাকের পাশে ছিলো, থাকবে। আমিই বাংলাদেশের জনগণের আসল প্রতিনিধি, এরা নয়।’
এটা ছিলো ঘটনার শুরু, শেষ নয়। প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতায় আমরা যে কত দরিদ্র তা এবার বোঝা গেলো আমাদের আচরণে। মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব হলেন হযরত হাফেজ্জী হুযূরের মুখপাত্র। সুতরাং তার জন্য এটাই শোভনীয় ছিলো যে, তিনি শান্তভাবে প্রেসিডেন্টকে সম্বোধন করে বলবেন, তৃতীয় কোন ব্যক্তি যেন আলোচনায় বিঘ্ন না ঘটায়। কিন্তু উত্তেজিত হয়ে তিনি সম্বোধনপাত্র পরিবর্তন করে ফেললেন। তাছাড়া এতক্ষণ তিনি হযরত হাফেজ্জী হুযূরের বক্তব্য তরজমা করছিলেন, এবার তিনি সম্পূর্ণ নিজ দায়িত্বে নিজের পক্ষ হতে বলা শুরু করলেন। প্রেসিডেন্টের পরিবর্তে তিনি জনাব আব্দুল মান্নানকে সম্বোধন করে খাছ বাংলায় বলতে লাগলেন, আপনি কে? আপনি কোন অধিকারে কথা বলছেন। আপনি তো আমাদের দলের লোক নন। আমরা সবাই জানি, আপনি ...।
জনাব আব্দুল মান্নান যা চাচ্ছিলেন তাই হলো। তিনি আরো জোরে চিৎকার করে আরো ‘খাছ’ বাংলায় বলতে লাগলেন, যার যে কাজ সাজে তার সেটাই করা উচিত। আমি রাজনীতি করি আইয়ূবের আমল থেকে, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন? আপনারা তো ...।
এভাবে চলতে থাকলো। সে বড় লজ্জাজনক পরিস্থিতি। সম্ভবত আধুনিক কূটনীতির ইতিহাসে কোন রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে এমন ঘটনার নযির নেই। আর সেটা ঘটলো হযরতের উপস্থিতিতে, আমাদেরই বিচক্ষণতার অভাবে।
সভাকক্ষে প্রবেশের পরই মাওলানা আযীযুল হক ছাহেবকে আমি বলেছিলাম, যেহেতু অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির অনুপ্রবেশ ঘটেছে সেহেতু এটাই নিরাপদ যে, প্রেসিডেন্টকে হযরতের পক্ষ হতে প্রস্তাব দেয়া হবে, এ আলোচনা যেহেতু অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং এর উপর যুদ্ধরত দু’টি দেশের ভবিষ্যত নির্ভর করছে সেহেতু আমরা চাই এ আলোচনা রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত হোক এবং উভয় পক্ষে তিনজন করে সাহায্যকারী উপস্থিত থাকুক। কিন্তু তিনি বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমার বিশ্বাস, সবটা বিষয় প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের অগোচরে ঘটেছে। তাকে বেশ বিব্রতই মনে হলো, আর আমাদের হযরত তো একেবারে এতীমের মত বসে থাকলেন।
অনেক্ষণ পর মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব বাংলাভাষা ত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে সম্বোধন করে বললেন, আপনি এই লোককে থামতে বলুন। তার উপস্থিতিতে আমরা কোন আলোচনা করতে রাজী নই।
বাংলাদেশের বহু প্রাচীন প্রবচন, সময়ের এক কোপ, অসময়ের দশকোপ। এখন তিনি যা বললেন সেটাই যদি আলোচনার শুরুতে বলা হতো তাহলে কিছুতেই এমন ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বিব্রত প্রেসিডেন্ট বৈঠকের সমাপ্তি ঘোষণা করে উঠে গেলেন, আর আমাদের ‘এতীম’ হযরত অসহায়ভাবে তাঁর মাকছাদের জানাযা কাঁধে নিয়ে ফিরে এলেন।
আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইরাকের প্রেসিডেন্ট এবং সাদ্দাম হোসাইনের মত প্রেসিডেন্ট হযরত হাফেজ্জী হুযূরের সঙ্গে অযথা দীর্ঘ দেড়ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে বসেননি। একথা যেমন সত্য যে, যুদ্ধ ইরাক শুরু করেছে এবং আমেরিকার প্ররোচনায়, তেমনি একথাও সত্য যে, ইরাক যে কোন উপায়ে যুদ্ধ থেকে বের হয়ে আসার একটা সম্মানজনক পথ তালাশ করছিলো। কারণ সাদ্দামের মার্কিন ‘বন্ধুরা’ তাকে বুঝিয়েছিলো যে, যেহেতু ইরানের সেনাবাহিনী এখন ভঙ্গুর অবস্থায় সেহেতু এ যুদ্ধ মোটেই দীর্ঘস্থায়ী হবে না, বরং ইরাকী বাহিনীর প্রথম ঝড়ো হামলার মুখেই ইরানের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়বে। তখন শাতিল আরবের দাবী আদায় করে সাদ্দাম নিজের সুবিধা মত যুদ্ধ বন্ধ করার সুযোগ পাবেন। সাদ্দাম সাহসী হলেও নির্বোধ। তিনি মার্কিন বন্ধুদের টোপ গিলেছিলেন এবং নিজের সৃষ্ট অজুহাতের ভিত্তিতে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, আর শুরু করেই যা বোঝার বুঝে গিয়েছিলেন। আসলে তিনি ধারণাই করতে পারেননি যে, শাহের ইরানকে খোমেইনী কোথায় নিয়ে গিয়েছিলেন। গোটা জাতির অন্তরে মৃত্যুর এমন এক উন্মাদনা তিনি সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন যার নযির পৃথিবীর ইতিহাসে খুব বেশী নেই। ইরানে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি পাসদারানে ইনকিলাবও লড়াই করছিলো। আর প্রশিক্ষণে দুর্বল হলেও তারা ছিলো মৃত্যুভয়হীন। কারণ তাদের বিশ্বাসে মৃত্যু মানেই ছিলো জান্নাতের টিকেট। তাই ইরানের লোকক্ষয় এবং সম্পদক্ষয় অনেক বেশী হলেও যুদ্ধের পাল্লা শেষ পর্যন্ত ইরানের দিকেই ঝুঁকে পড়েছিলো। সুতরাং পরিস্থিতির বিচারে সাদ্দাম যুদ্ধবন্ধের বিষয়ে অবশ্যই আন্তরিক ছিলেন। পক্ষান্তরে ইরানের শিয়া নেতাদের বিশ্বাস ছিলো, সাদ্দামের শুরু করা যুদ্ধ তারা নিজেদের ইচ্ছা মত শেষ করতে পারবেন। তারাও ভুলে গিয়েছিলেন যে, এ যুদ্ধ ইরাকের নয়, বরং সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার এবং ইহুদিবাদী ইসরাইলের। প্রয়োজনে আমেরিকা ইরাককে মারণাস্ত্র সরবরাহ করবে এবং ইরানকে হাঁটু গেড়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করবে।
পরবর্তীতে তাই ঘটেছিলো। ইসরাইল যখন বিমান হামলা চালিয়ে ইরাকের পারমাণবিক কেন্দ্র ধ্বংস করে দিলো তখন আমেরিকা টু শব্দটি না করলেও ইরাককে রাসায়নিক অস্ত্র সরবরাহ করেছিলো যার মোকাবেলায় ইরানের কিছুই করার ছিলো না, নিঃশর্ত যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়া ছাড়া। তার পরেও কি মুসলিম বিশ্বের নেতৃবৃন্দের
বোধোদয় ঘটেছে?! না।
সাদ্দামের সঙ্গে হযরতের বৈঠক যদি স্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে যেতো তাহলে ফলাফল কী দাঁড়াতো তা আমি জানি না। এ বৈঠক ভন্ডুল করার পেছনে পর্দার আড়ালে কারা কাজ করেছে তা জানার উপায় নেই। আব্দুল মান্নান তো ক্রীড়নক মাত্র। তিনি সম্ভবত বহু দূর থেকে নিয়ন্ত্রিত ছিলেন, এমনকি হতে পারে যে তিনি তাদের চিনতেনও না।
সাদ্দাম হোসায়ন কোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে যুদ্ধ বন্ধের ফায়সালার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন তা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত ও গ্রহণযোগ্য ছিলো। এর ভিত্তিতে অনেক কিছুই হতে পারতো। হয়ত হাফেজ্জী হুযূর উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য মুসলিম বিশ্বের নির্বাচিত আলিমদের নিয়ে সালিস মজলিস গঠন করতেন। উভয় পক্ষ যদি মজলিসের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার পূর্বপ্রতিশ্রুতি প্রদান করতো, আর সালিস মজলিস যদি মক্কায় আল্লাহর ঘরের ছায়ায় বসে ইনছাফপূর্ণ কোন সিদ্ধন্তে উপনীত হতে পারতো এবং এভাবে দু’টি মুসলিম দেশের মাঝে যুদ্ধ বন্ধ হতে পারতো তাহলে মুসলিম জাহান, এমনকি সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসে তা হতো নযিরবিহীন এক ঘটনা। এতে ইরান-ইরাক উভয়ের মর্যাদা যেমন উঁচু হতো তেমনি বাংলাদেশসহ অন্যান্য মুসলিম দেশে ইসলামী খিলাফাত কায়েমের কাজও অনেক দূর এগিয়ে যেতো।
কিন্তু আল্লাহ জানেন খোমেইনীর মাথায় কী ভূত সওয়ার হয়েছিলো। যুদ্ধ বন্ধের জন্য ইসলামী হুকুমত কায়েমের শর্ত আরোপ করাকে ‘তামাশা’ ছাড়া আর কী বলা যায়? এটা কি ইসলামী হুকুমত কায়েমের তরীকা? এটা কি যুদ্ধ করে চাপিয়ে দেয়ার বিষয়?
আজ খোমেইনী পৃথিবীতে নেই, নেই হযরত হাফেজ্জী হুযূরও। এমনকি সাদ্দাম হোসায়নও অনেক ঘটনার নায়ক ও খলনায়ক হয়ে শেষ পর্যন্ত আল্লাহর ইচ্ছায় শাহাদাতের মর্যাদা লাভ করেছেন।
রূহের জগতে আজ যদি হযরত হাফেজ্জী হুযূর জিজ্ঞাসা করেন খোমেইনীকে, শেষ পর্যন্ত আপনি তো যুদ্ধবন্ধ মেনে নিয়েছিলেন আমেরিকার আদেশে; তাহলে আপনার এক দ্বীনী ভাইয়ের কথা মেনে নিতে দোষ কী ছিলো? আমি তো আপনাকে সতর্ক করেছিলাম! এ প্রশ্নের কী জবাব দেবেন খোমেইনী?
তদ্রূপ যদি তিনি সাদ্দামকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনি তো ইরাকের জাতীয় পতাকায় ‘আল্লাহু আকবার’ যুক্ত করে মৃতুর আগে কোরআন হাতে নিয়েছিলেন; তাহলে ইরাকের শাসক অবস্থায় কোরআন হাতে নিতে বাধা ছিলো কোথায়? আমি তো আপনাকে বলেছিলাম, আল্লাহর গায়বি মদদের কথা! কী জবাব দেবেন সাদ্দাম হোসাইন?
***
ফিরে আসি আগের জায়গায়। হযরত ক্লান্ত শ্রান্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় হোটেলে ফিরে এলেন। কেউ তাঁকে সামান্য একটু সান্ত্বনার কথাও বললো না। যে যার কামরায় চলে গেলো। যেন কিছুই ঘটেনি। কারো মাঝে কোন প্রতিক্রিয়াই দেখা দিলো না আব্দুল মান্নান সম্পর্কে দু’একটি কটুক্তি ছাড়া। তাদের ওঠা-বসা, কথা-বার্তা সবই ছিলো স্বাভাবিক। এমনকি দুপুরের খাবার গ্রহণের পর তারা পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী কাদেসিয়া যুদ্ধের প্যান্যারোমা দেখতে মাদায়েন রওয়ানা হয়ে গেলেন। হযরতের কাছে এসব বিষয় তখন ছিলো অর্থহীন। তাই তিনি গেলেন না। আমার একে তো ইচ্ছে ছিলো না, তদুপরি হযরত বললেন, তুমি আমার কাছে থাকো।
সবাই বের হয়ে যাওয়ার পর হযরত বললেন, আমি সাদ্দাম হোসাইনের কাছে একটি চিঠি লিখতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে কাগজ-কলম হাযির করলাম। তিনি বিষয়বস্ত্ত বলে গেলেন, আমি আরবীতে লিখে নিলাম। চিঠিটি মোটামুটি এরকম ছিলো-
আমার দ্বীনী ভাই সাদ্দাম হোসাইন! আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু
নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আদ্দীনু আন্নাছীহাতু’ -দ্বীন হচ্ছে হিতাকাঙ্ক্ষা। সুতরাং মুসলমানদের শাসকের প্রতি হিতাকাঙ্ক্ষা হলো দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ হুকুম। সেই হুকুম পালন করার নিয়তে আপনাকে আমি এই পত্র লিখছি। আল্লাহ আমাদের সবাইকে দ্বীনের উপর চলার এবং দ্বীন কায়েম করার তাওফীক দান করুন, আমীন। কারণ এটাই হলো দুনিয়াতে কামিয়াবি এবং আখেরাতে নাজাতের একমাত্র পথ।
আপনার সঙ্গে আমার একটি একান্ত বৈঠক হলে খুব ভালো হতো, কিন্তু সে সুযোগ পাবো কি না, জানি না। আমি আপনাকে ইহুদি-নাছারাদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করতে চাই। আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন, কোরআন শরীফে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে ঈমানদারগণ, ইহুদি ও নাছারাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। আসলে তারা পরস্পর বন্ধু।’
সুতরাং ইহুদি-নাছারাদের পরামর্শে কখনো কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন না। আপনি মুসলমান, সুতরাং তারা আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী হতে পারে না। তদ্রূপ তাদেরকে আপনি ভয় করবেন না, একমাত্র আল্লাহকে ভয় করবেন। কারণ সারা দুনিয়া যদি একত্র হয়ে আপনার কোন উপকার করতে চায়, আল্লাহর হুকুম ছাড়া আপনার কোন উপকার করতে পারবে না। তদ্রূপ সারা দুনিয়া যদি একত্র হয়ে আপনার কোন ক্ষতি করতে চায়, আল্লাহর হুকুম ছাড়া আপনার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। সুতরাং আপনি সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর ভরসা করে ইসলামী হুকুমত কায়েম করার ঘোষণা দিয়ে দিন এবং পর্যায়ক্রমে আগে বাড়তে থাকুন, আর প্রশাসনের বুনিয়াদি স্থানগুলো থেকে ইহুদি-নাছারাদের অবশ্যই দূরে রাখুন। আল্লাহ আপনার সহায় হবেন ইনশাআল্লাহ।
যুদ্ধ বন্ধের আলোচনায় আপনার কথাবার্তা আমার কাছে আন্তরিক মনে হয়েছে। এজন্য আমি আপনার শোকরগুজার। আমি আমার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবো, ইনশাআল্লাহ। আশা করি আমার প্রচেষ্টার প্রতি আপনার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। ইরাক, ইরান ও পুরা মুসলিম জাহানকে আল্লাহ হেফাযাত করুন, আমীন।
আপনার দ্বীনী ভাই
মহাম্মাদুল্লাহ
আরবী তরজমা শুনে হযরত খুশী হলেন, আমাকে অনেক দু‘আ দিলেন এবং চিঠিতে দস্তখত করে বললেন, ‘এই চিঠি সরাসরি সাদ্দাম হোসাইনের হাতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করো, অন্য কারো হাতে নয়।’
আমি বললাম, ইনশাআল্লাহ।
আমার চিন্তায় দু’টি মাধ্যম ছিলো, মুহসিন ও মুহম্মদ।
মুহম্মদ পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। কিন্তু অনেক চিন্তাভাবনার পর মুহসিনের সহযোগিতা গ্রহণ করাই ভালো মনে হলো। মুহসিনের গ্রামের বাড়ীতে যাওয়ার ওয়াদা ছিলো। হযরতের অনুমতি নিয়ে আমি তার সঙ্গে রওয়ানা হলাম। বাগদাদ থেকে পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটার দূরে তার গ্রাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম। সুন্দর গ্রাম। বাগদাদের সঙ্গে ঢাকার যেমন পার্থক্য, দু’দেশের গ্রামের মধ্যেও তেমনি পার্থক্য। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা প্রায় সবই বিদ্যমান। তবে মুহসিন জানালো, সব গ্রামের অবস্থা এমন নয়। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলো এখনো অনেক অনুন্নত। অবশ্য সরকার গ্রাম উন্নয়নে খুবই আন্তরিক, যদিও যুদ্ধের কারণে উন্নয়ন প্রচেষ্টা এখন অনেকটাই থেমে গেছে।
আমরা প্রথমেই গেলাম গ্রামের শেষ প্রান্তে কবরস্তানে। পাশাপাশি দু’টি নতুন কবর। একটি কবরের সামনে কালো চাদর-আবৃত একজন বয়স্কা মহিলা এবং তার বারো তেরো বছরের বালক পুত্র দাঁড়িয়ে ছিলো। আমরা কবর যিয়ারাত করলাম। আমার অন্তরে তখন ছিলো অন্তহীন বেদনার ঢেউ। এরা দু’জন মৃত্যুবরণ করেছে কোন কাফিরের গুলিতে নয়, তাদেরই মত কোন মুসলমান ভাইয়ের গুলিতে। একই ভাবে তাদের হাতে সীমান্তের ওপারে যারা নিহত হয়েছে তারাও মুসলমান। কে জানে পৃথিবীতে এপর্যন্ত যত মুসলমান নিহত হয়েছে তাদের কত ভাগ কাফির-মুশরিকের হাতে, আর কত ভাগ মুসলমানের হাতে! সঠিক একটা পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে ভালো হতো।
এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের বলি কিন্তু সাদ্দাম বা খোমেইনী নন; নন যুদ্ধের জেনারেলরাও। তারা তো নিরাপদ দূরত্বে বাগদাদের প্রাসাদে এবং কুমের আস্তানায় বসে যুদ্ধের নকশা তৈরী করেন, রক্ত ঝরে সাধারণ সৈনিকদের। বিধবা হয় ইরাকী মা, এতীম হয় ইরানী বালক। এ যুদ্ধ বন্ধের জন্য আমাদের হযরতের মত অস্থির হয়েছেন মুসলিম বিশ্বের আর ক’জন!
এদু’টি কবর যিয়ারাতের মাধ্যমে আমি যেন যিয়ারাত করলাম এ যুদ্ধে নিহত সকল মুসলমানের কবর। হোক সে ইরাকী বা ইরানী, শিয়া বা সুন্নী। আমি কল্যাণ ও নিরাপত্তা কামনা করলাম সকল এতীম ও বিধবার, হোক তারা ইরাকের বা ইরানের। কারণ সবার রক্ত অভিন্ন, সবার অশ্রু অভিন্ন; ইসলামের সূত্রে যেমন তেমনি মানবতারও সূত্রে।
নিহত সৈনিকের সেই এতীম পুত্রটির কথা আজ এত বছর পরও আমার মনে পড়ে। সে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে বলেছিলো, কাফের খোমেইনী আমার বাবাকে খুন করেছে, আমি এর বদলা নেবো।
তার কথা শুনে আমি হেসেছিলাম বড় বেদনার হাসি। ‘কাফের’ খোমেইনীর হাতে খুন হচ্ছে ইরাকের নিরীহ মুসলমান, আবার ‘কাফের’ সাদ্দামের হাতে খুন হচ্ছে ইরানের নিরীহ মুসলমান। মাঝখানে কাফির আমেরিকা হাসছে হায়েনার হাসি। মুসলিম জাহানের এ বড় করুণ ট্রাজেডি। মুসলমান ‘কাফেরদের’ পরিবর্তে আমাদের বন্দুকের নল কবে ঘোরবে আসল কাফেরদের দিকে! সবসময় আমাদের তলোয়ারের পিয়াস কি মিটবে শুধু নিজেদেরই খুনে! কবে বন্ধ হবে এই ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ?
কিন্তু তখন যদি জানতাম, আগামী দিনের গর্ভে কী ভয়াবহ ঘটনা লুকিয়ে আছে আমাদের জন্য তাহলে হয়ত কামনা করতাম, শুধু ইরাক-ইরান যুদ্ধ চলতে থাকুক, এর বেশী আর কিছু না হোক।
মুহসিনের আববার সঙ্গে দেখা হলো গ্রামের মসজিদে নামাযের সময়। তিনিই মসজিদের ইমাম ও মুআযযিন। নূরানী চেহারার বড় নেক ছুরত ইনসান। ছেলেকে নামায পড়তে দেখে খুব খুশী হলেন। যাকে বলে, একেবারে আবেগাপ্লুত হলেন। তার চোখে তখন আনন্দাশ্রু চিকচিক করছে। তিনি ভেবে পেলেন না কীভাবে তার পুত্রের এ অভাবনীয় পরিবর্তন! হযরতের কথা তিনি আগেই শুনেছেন; এখন আরো বিশদ শুনে বললেন, যার সামান্য সংস্পর্শে আমার ছেলের এমন পরিবর্তন তিনি নিশ্চয় অনেক উঁচু দরজার অলী, বুযুর্গ! তিনি অনুগ্রহ করে আমাদের দেশে এসেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ এবার আমাদের উপর অনুগ্রহ করবেন। এ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ এবার অবশ্যই বন্ধ হবে।
হায় বৃদ্ধ যদি জানতেন, তার এবং তার মত বহু নেক মানুষের নেক তামান্না একটু আগে কীভাবে খুন হয়ে গেছে! #
(চলবে ইনশাআল্লাহ)