শাআইর ও ইবাদত : কিছু প্রয়োজনীয় কথা
গত ১৮ যিলকদ ’৩০ হি. মোতাবেক ৭ নভেম্বর ’০৯ ঈসায়ী মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ায় অনুষ্ঠিত মাসিক দ্বীনী মাহফিলে মারকাযের আমীনুত তা’লীম মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব উপরোক্ত বিষয়ে সংক্ষিপ্ত ও সারগর্ভ আলোচনা করেছিলেন। ‘শাআইর’-এর পরিচয় ও মর্যাদা, দ্বীনী বিষয়ে ‘ইনকার’, ‘ইছতিহযা’ ও আমলী দুর্বলতার শরয়ী বিধান, ইবাদাতের হাকীকত বোঝার প্রয়োজনীয়তা এবং ইসলামের ইবাদত ও অন্যান্য ধর্মের উপাসনা-উৎসবের মাঝে পার্থক্য ইত্যাদি মৌলিক বিষয় ছাড়াও প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন বিষয়ও তাতে উঠে এসেছে। আলোচনাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে তা আলকাউসারের পাঠকদের সামনেও পেশ করা হল। ইনশাআল্লাহ এতে সবাই উপকৃত হবেন।-সম্পাদক
আমি সূরায়ে হজ্বের একটি আয়াত তেলাওয়াত করেছি। এরপর যে আরবী বাক্যগুলো বলা হয়েছে তা কুরআন মজীদের আয়াত নয়। কুরআনের কিছু অংশ তেলাওয়াত করার পর এ ধরনের বাক্য বলা হয়ে থাকে। এগুলো বলা জরুরি নয়, তবে বললে কোনো দোষও নেই।
আল্লাহর কালামের প্রতি স্বীকৃতি ও মনের ঈমানী অনুভূতি প্রকাশ করে এই বাক্যগুলো বলা হয়। প্রথম বাক্যটির অর্থ হচ্ছে-‘আল্লাহ তাআলা সত্য বলেছেন।’ একথা বলা বাহুল্য যে, আল্লাহ তাআলাই সবচেয়ে বড় সত্যবাদী। তাঁর চেয়ে সত্যবাদী আর কেউ হতে পারে না। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
‘আল্লাহর কথার চেয়ে অধিক সত্য আর কার কথা হতে পারে?
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘লা রায়বা ফীহি’ এটা ওই কিতাব যাতে কোনো সন্দেহ নয়। দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ হল, ‘এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সত্য বলেছেন।’ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর কালাম, আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ সম্পূর্ণ সত্যবাদিতা ও আমানতদারীর সঙ্গে পৌঁছে দিয়েছেন। তাঁর পৌঁছানোর মধ্যে কোনো ধরনের ত্রুটি নেই। তৃতীয় ও চতুর্থ বাক্যের অর্থ হচ্ছে-‘আমরা এ বিষয়ে সাক্ষ্যদানকারী ও শোকরগোযারকারীদের অন্তর্ভুক্ত।’ অর্থাৎ আমরা সাক্ষ্য দেই যে, আল্লাহর কালাম সত্য এবং আল্লাহর পক্ষ হতে যেভাবে তা অবতীর্ণ হয়েছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেভাবেই তা আমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছেন। এই মহা নেয়ামত লাভ করে আমরা কৃতজ্ঞ।
পঞ্চম বাক্যের অর্থ হচ্ছে-‘সকল প্রশংসা আল্লাহর।’কথাগুলোর ভাব ও মর্ম অত্যন্ত সুন্দর। কুরআন মজীদের কিছু অংশ তিলাওয়াতের পর এভাবে মনের অনুভূতি, আস্থা ও স্বীকৃতি প্রকাশ করতে দোষ নেই। তবে এটা কোনো নির্ধারিত বিধান নয় যে, তা বলতেই হবে। কখনো কখনো বলা যায়। না বললেও অসুবিধা নেই।
অনেককে দেখা যায়, যেভাবে কুরআন মজীদের আয়াত তেলাওয়াত করেন, ঠিক সেভাবেই, একই সুরে এই বাক্যগুলোও বলেন। যদিও সম্ভাবনা কম তবুও এতে কারো কারো ভুল ধারণা হতে পারে যে, বোধ হয় এই কথাগুলোও কুরআন মজীদের আয়াত। এই দেশে এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে কি না জানি না, কিন্তু পাকিস্তানে এমন ঘটেছে বলে জানি। পাকিস্তানের করাচি বা অন্য কোনো শহরের ঘটনা। এক মজলিসে বক্তা কুরআন মজীদের আয়াত তেলাওয়াতের পর বয়ান আরম্ভ করলেন। এই বাক্যগুলো বলেননি। এক শ্রোতা দাঁড়িয়ে বলতে লাগলেন, জনাব আপনার একটি আয়াত তো রয়ে গেছে। অর্থাৎ সে মনে করেছে, কুরআনের যেখান থেকেই পড়া হোক সেখানে একটি আয়াত আছে-‘সাদাকাল্লাহুল আযীম।’ তো পরে ওই বক্তা সাদাকাল্লাহ্ বলার বিরুদ্ধে একটি বই লিখে দিয়েছেন। এটা অবশ্য বাড়াবাড়ি। কেননা, ‘সাদাকাল্লাহ’ পড়াই যাবে না এমন বিধান দেওয়া ভুল। তবে ‘সাদাকাল্লাহ’ পড়াকে জরুরি মনে করা বা তাকে কুরআনের আয়াত মনে করাও ভুল।
যাক, সূরা হজ্বের এই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে ‘শাআইরুল্লাহ’র সম্মান করে এটা তার অন্তরের তাকওয়া ও খোদাভীতির পরিচায়ক।’ আল্লাহর শাআইরকে সম্মান করা দ্বারা বোঝা যায়, অন্তরে ঈমান আছে এবং আল্লাহর ভয় ও ভালবাসা আছে।
‘শাআইর’ কাকে বলে
‘শাআইর’ আরবী শব্দ। ‘শায়ীরাতুন’ এর বহুবচন। ‘শায়ীরাতুন’ অর্থ হচ্ছে, নিদর্শন, প্রতীক। তাহলে ‘শাআইরুল্লাহ’ অর্থ হচ্ছে আল্লাহর নিদর্শন। কুরআন-হাদীসে শাআইরের ব্যাখ্যা এসেছে, যার সারসংক্ষেপ এই যে, আল্লাহ তাআলা বিশেষ কিছু স্থান, কিছু কাজ এবং কিছু বস্তুকে সম্মানিত করেছেন এবং সেগুলোকে তাঁর কুদরত ও আযমতের চিহ্ন সাব্যস্ত করেছেন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের নিদর্শন ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ তাআলার আদেশের কারণে এগুলো বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। শীর্ষস্থানীয় শাআইরের মধ্যে রয়েছে, কালামুল্লাহ অর্থাৎ কুরআন মজীদ এবং কালিমাতুল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহর কালিমা। কালেমা তাইয়্যেবা, কালেমা শাহাদত ইত্যাদি। বিশেষ স্থানসমূহের মধ্যে রয়েছে বাইতুল্লাহ, মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী এবং ইহুদীদের কব্জায় থাকা মুসলমানদের প্রথম কেবলা মসজিদে আকসা। এরপর সকল মসজিদ। তদ্রূপ আরাফা, মিনা-মুযদালিফা ‘শাআইরুল্লাহ’র অন-র্ভুক্ত। কুরবানীর পশুও শাআইরুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত।কিছু যিকর অর্থাৎ মুখে উচ্চারণ করা হয় এমন কিছু বিষয় শাআইরুল্লাহর মধ্যে গণ্য। যেমন আযান। কোনো জনপদে আযান হলে যে কেউ বুঝবে যে, এখানে মুসলমানদের বসবাস আছে এবং তাদেরকে ইবাদতের দিকে আহ্বান করা হচ্ছে। আযান ইসলামের শীর্ষস্থানীয় শাআইরের অন-র্ভুক্ত। মুমিনের অন্তরে আযানের প্রতি মহব্বত ও ভালবাসা না থেকে পারে না। একজন সাধারণ দ্বীনদার মানুষ আমাকে বলেছেন যে, আমার কাছে আযান শুনতে খুব ভালো লাগে। যখন আযান হয় তখন ছেলেদের বলি যে, সব জানালা খুলে দাও। আমি আযান শুনব। আর অনেকে তো শুধু এ কারণে বাসা পরিবর্তন করে ফেলে যে, সেখানে আযানের আওয়াজ শোনা যায় না।
পক্ষান্তরে এই দেশে এমন লোকও আছে যারা বলে, আযানের কারণে শব্দ দুষণ হয়! আহারে বাংলাদেশ! যে দেশে চারদিকের অনাহূত শব্দে কান পাতা দায় সেই দেশে নাকি আযানের কারণে শব্দ দুষণ হয়! এমন কথা যে বলে সে কখনো মুমিন হতে পারে না। সে হয় মুনাফিক নয়তো বেদ্বীন। আর এই সব লোক তো এখন আমাদের জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটিরও হর্তাকর্তা! যাই হোক, মুমিনমাত্রই শাআইরুল্লাহর সম্মান করবে। শাআইরুল্লাহর প্রতি তার ভক্তি ও আস্থা থাকবে। কোনো মুমিন কখনো এটাকে কটাক্ষ করতে পারে না।
দাড়ি ও মিসওয়াক
ইসলামের ‘শাআইর’ অনেক এবং তাতে বিভিন্ন প্রকার ও পর্যায়ক্রমও রয়েছে।ক্রমান্বয়ে আসতে আসতে একপর্যায়ে আসবে দাড়ি-টুপি, মিসওয়াক ইত্যাদি। এগুলো সাধারণ বিষয় নয়। দাড়িকে অনেকে সাধারণ সুন্নত মনে করে এবং এ কারণে এর প্রতি উদাসীনতা প্রদর্শন করে। অথচ সাধারণ সুন্নতেরও গুরুত্ব কম নয়। আর দাড়ি তো ‘সুন্নতে ওয়াজিবা’ অর্থাৎ ওয়াজিব পর্যায়ের সুন্নত। এর গুরুত্ব অনেক বেশি। হযরত আদম আ. থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পর্যন্ত সকল নবীর দাড়ি ছিল। তাই দাড়ি কখনো সৌন্দর্য্য হানিকর হতে পারে না। বিকৃত পরিবেশের কারণে কারো কাছে দাড়ি কামানো সৌন্দর্যের বিষয় মনে হতে পারে। কিন্তু এটা হচ্ছে বিকৃতি। প্রকৃত সৌন্দর্য দাড়ি রাখার মধ্যেই রয়েছে।
এখানে আরেকটি বিষয়েও সাবধান হওয়া দরকার। তা হচ্ছে দাড়ি না রাখা গুনাহ, কিন্তু দাড়িকে অবজ্ঞা করা বেদ্বীনী। যেসব মুসলমান দাড়ি রাখে না তারা নিজেদেরকে অপরাধী মনে করতে হবে। তাদের এই অনুভূতি থাকতে হবে যে, একটি গুনাহের কাজে তারা লিপ্ত। এটা যদি না থাকে তাহলে গুনাহ আরো বেড়ে যাবে। আর যদি দাড়িকে অবজ্ঞা করা হয় তাহলে তো ঈমানই থাকবে না।
মিসওয়াকও সাধারণ সুন্নত নয়, শাআইর পর্যায়ের সুন্নত। এজন্য কেউ যদি কখনোই মিসওয়াক না করে তাহলে সে গোনাহগার হবে। মাঝে মাঝে করল না তাহলে মিসওয়াকের ফযীলত থেকে বঞ্চিত হবে।
দেখুন আবারো বলছি, ইসলামের কোনো একটি বিধান পালন করতে না-পারা অপরাধ, কিন্তু এর দ্বারা ঈমান নষ্ট হয় না। পক্ষান্তরে সেই বিধানকে অবজ্ঞা ও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে ঈমান চলে যায়। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে যা আকীদা পর্যায়ের। এটা ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। ইনকার, ইছতিহযা ও আমলী দুর্বলতা
এখানে তিনটি বিষয় আছে : ‘ইনকার’, ‘ইছতিহ্যা’ ও ‘আমলী দুর্বলতা’। ইনকার অর্থ অস্বীকার করা আর ইছতিহ্যা অর্থ বিদ্রূপ ও অবজ্ঞা করা। ইনকার দ্বারাও ঈমান নষ্ট হয় তবে সবক্ষেত্রে নয়। ইসলামের যে বিষয়গুলো অকাট্য এবং কুরআন-হাদীস দ্বারা সরাসরি ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত তা অস্বীকার করলে ঈমান থাকে না। যেমন নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত-এগুলো ইসলামের অকাট্য ইবাদত। এগুলো অস্বীকার করলে ঈমান চলে যাবে। এমন আরো বহু অকাট্য বিষয় আছে যা জেনে নেওয়া আমাদের কর্তব্য। আর যেসব বিধান ইজতিহাদী পর্যায়ের তা অস্বীকার করাও গুনাহ কিন্তু এর দ্বারা ঈমান নষ্ট হয় না। পক্ষান্তরে ইছতিহযা এত মারাত্মক যে, শরীয়তের সামান্য কোনো বিষয়কে ইছতিহ্যা বা বিদ্রূপ করলে ঈমান চলে যাবে। আপনি মিসওয়াক করেন না-এটা অপরাধ। কিন্তু যদি মিসওয়াককে বিদ্রূপ করে বলেন, ব্রাশ আছে পেস্ট আছে তা বাদ দিয়ে এই সব কী, ছাগলের খুটা পকেটে ভরে রেখেছে। তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ঈমান চলে যাবে।
দ্বীনের কোনো বিষয়কে উপহাস করার দ্বারা বোঝা যায়, দ্বীনের প্রতি তার ভক্তি নেই। আস্থা ও ভালবাসা নেই। কেননা, যার প্রতি আস্থা থাকে মানুষ কখনো তাকে উপহাস করে না।
ইছতিহযা মুমিনের স্বভাব নয়, মুনাফিকদের স্বভাব। কুরআন মজীদে মুনাফিকদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা মুসলমানের সঙ্গে ‘ইছতিহযা’ করে। আল্লাহ তাআলা বলেন,
তৃতীয় বিষয় হল আমলী দুর্বলতা। শরীয়তের বিধান লঙ্ঘন করা গুনাহ। আর গুনাহ মানুষের আখিরাতের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য অনুতপ্ত থাকা চাই এবং গুনাহ ছেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করা চাই। অনুতাপের বিপরীত হল অহঙ্কার। এটা মানুষকে ইনকার ও ইছতিহযাতে লিপ্ত করে দেয়।হজ্ব শাআইরে ইসলামের অন্তর্ভুক্ত
মূল কথায় ফিরে আসি। শাআইরুল্লাহর সম্মান হচ্ছে ঈমানের অংশ এবং তা তাকওয়া ও খোদাভীতির পরিচায়ক।ইতিপূর্বে বলা হয়েছে যে, শাআইরুল্লাহর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। তন্মধ্যে কিছু শাআইর আছে কর্মগত। অর্থাৎ এমন কিছু কাজ, যা আল্লাহ তাআলা তাঁর কুদরত ও আযমতের নিদর্শন এবং ইসলাম ও মুসলমানদের চিহ্ন হিসাবে ঘোষণা করেছেন। এইসব কাজের মধ্যে অন্যতম হল হজ্ব। মুসলমানগণ নির্ধারিত স্থানে একত্র হয়ে প্রকাশ্যে আল্লাহ তাআলার বন্দেগী করে। এটা ইসলাম ও মুসলমানদের চিহ্ন। হজ্বের কাজগুলো পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায় যে, এর মূল বিষয় হল আল্লাহ তাআলার ইবাদত। ইসলাম তাওহীদের দ্বীন এবং এর সকল ইবাদতের মূল বিষয় হচ্ছে তাওহীদ। এটা এতই পরিষ্কার যে, এ বিষয়ে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই।
অন্যান্য বাতিল ধর্মের সাথে ইসলামের কোনো মিল নেই এবং এখানে কোনো তুলনাও চলে না। তবে নাম ও বাহ্যিক কিছু বিষয়ে কিছু সাদৃশ্য মনে হতে পারে। যেমন হজ্বের সময় মুসলমানরা আরাফার ময়দানে, মিনায়, মুযদালিফায় জমায়েত হয়। অন্য ধর্মের লোকদেরও বিভিন্ন তীর্থস্থানে জমায়েত হওয়ার রেওয়াজ আছে। কিন্তু এটা তো শুধু বাহ্যিক সাদৃশ্য। স্বরূপ, তাৎপর্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে, এই সকল বিষয়ে ইসলামের ইবাদত অন্য সকল ধর্মের উপাসনা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। অথচ আমাদের সাংবাদিক-সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রবণতা হল তারা সব বিষয়কে সমান বলতে আগ্রহী। এজন্য তারা ইসলামের ইবাদত-বন্দেগী, হজ্ব-কুরবানী-ঈদ ইত্যাদিকে ঠিক সেভাবেই উপস্থাপন করে যেভাবে উপস্থাপন করে হিন্দুদের পূজা-অর্চনা ও ধর্মীয় আচার-উৎসবকে। মুসলিম সমাজে মুসলিম নাম পরিচয় বহন করেও তারা এইসব কাজ করে। অথচ ইসলামের ইবাদত ও অন্যান্য ধর্মের পূজা-অর্চনায় কোনো মিল নেই।
ইসলামের ইবাদত ও অন্যান্য ধর্মের উপাসনার মাঝে পার্থক্য
ইসলামের ইবাদতের মূল ভিত্তি হল তাওহীদ ও সুন্নাহ। পক্ষান্তরে অন্যান্য ধর্মের উপাসনার মূল বিষয় শিরক ও বিদআত। কোনো মুসলমান কীভাবে সকল ধর্মকে সমান মনে করতে পারে? দেখুন, প্রথম পার্থক্য তো এখানেই যে, ইসলাম হচ্ছে আল্লাহ তাআলার মনোনীত ও আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র দ্বীন। পক্ষান্তরে অন্য সকল ধর্ম তাঁর কাছে প্রত্যাখ্যাত। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে-
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য দ্বীন শুধু ইসলাম। আল্লাহ ইসলামকেই সবার জন্য পছন্দ করেছেন, কিন্ত যারা তা মানল না, অন্য ধর্মে গেল তারা আল্লাহর দ্বীনকে পরিত্যাগ করল। দ্বিতীয় পার্থক্য হল ইসলামের ইবাদত বন্দেগী আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে নির্দেশিত। এখানে কারো নিজস্ব মতের কোনো অবকাশ নেই। আল্লাহ তাআলা পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করেছেন। সুতরাং নামায পাঁচ ওয়াক্তই। পৃথিবীর কোনো মুসলমান নামাযকে ছয় ওয়াক্ত বানাতে পারবে না। ফজরের নামায দুই রাকাত, যোহর-আসর চার রাকাত, মাগরিব তিন রাকাত, ইশা চার রাকাত-এভাবে আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারিত এবং সারা মুসলিমজাহানে নামায এভাবেই। কেউ একথা বলতে পারবে না যে, আসরের নামায চার রাকাত পড়লাম, সামনে ইশাও চার রাকাত পড়ব, মাঝে মাগরিব তিন রাকাত কেন? এটাও চার রাকাত পড়ি। এখানে নিজের ইচ্ছার কোনো অবকাশ নেই। নামায শুরু হবে তাকবীর দ্বারা শেষ হবে সালাম দ্বারা। এটাই নামাযের নিয়ম। পৃথিবীর কোথাও এর ব্যতিক্রম নেই। নামাযের কিছু মাসাইলের ক্ষেত্রে সেসব পার্থক্য দেখা যায় এটাও এজন্য নয় যে, কেউ মনগড়াভাবে কোনো পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছে; বরং ওই একাধিক পদ্ধতি হাদীস শরীফেই আছে। এক মুজতাহিদ এক পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন, অন্য মুজতাহিদ অন্য পদ্ধতি। কিন্তু সবগুলো হাদীস শরীফ থেকেই নেওয়া হয়েছে।
এবার অন্যান্য ধর্মের উপাসনা ও তার পদ্ধতি সম্পর্কে খোঁজ নিন। দেখবেন যে, এগুলোর কোনো ভিত্তি নেই। জিজ্ঞাসা করলে তারা বলবে যে, আমরা বাপ-দাদাদের এভাবেই করতে দেখেছি কিংবা এমন কিছু গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিবে যেগুলো বিকৃত, পরিবর্তিত ও ভিত্তিহীন। বাইবেল সম্পর্কে খোঁজ নিন। তা প্রকৃত ইঞ্জিল নয়। ইঞ্জিল ছিল আসমানী কিতাব। কিন্তু তা সংরক্ষিত থাকেনি। লোকেরা তা বিকৃত ও পরিবর্তিত করে ফেলেছে। এখন বিভিন্ন ভাষায় যেসব অনুবাদ পাওয়া যায় সেগুলো তুলনা করে দেখুন, যত অনুবাদ তত পার্থক্য। শুধু শব্দের পার্থক্য নয়, তথ্যের পার্থক্য। মোটকথা, সেসব ধর্মের উপাসনা ও উপাসনা-পদ্ধতির কোনো ভিত্তি নেই। পক্ষান্তরে ইসলামের সকল ইবাদত আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে নির্দেশিত ও প্রমাণিত।
তৃতীয় বিষয় হল ইসলামের ইবাদতের মূল ভিত্তি হচ্ছে তাওহীদ ও সুন্নাহ। পক্ষান্তরে অন্য সকল ধর্মের উপাসনার মূল ভিত্তি হল শিরক ও বিদআত। এভাবে একেক দিক থেকে যদি বিচার-বিশ্লেষণ করেন তাহলে দেখবেন, ইসলামের ইবাদতের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মের উপাসনার কোনো মিল নেই।
হজ্বের মূল বিষয় আল্লাহর ইবাদত
আমাদের আলোচ্য বিষয় হজ্ব সম্পর্কেই চিন্তা করুন। হজ্বে আমরা বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করি। কিন্তু এটা বাইতুল্লাহর সম্মানের জন্য করা হয় না। করা হয় আল্লাহর ইবাদতের জন্য। আল্লাহ তাআলা বাইতুল্লাহর চারপাশে তাওয়াফ করতে বলেছেন তাই তাওয়াফ করা হয়। এটা ঠিক যে, আল্লাহ তাআলা বাইতুল্লাহকে সম্মানিত করেছেন, কিন্তু তাওয়াফ সে সম্মানের জন্য নয়; বরং তা আল্লাহর ইবাদত। দেখুন, তাওয়াফ শুরু হয় হজরে আসওয়াদ থেকে। বাইতুল্লাহকে বাম পাশে রেখে তাওয়াফ করতে হয়। তাওয়াফের হালতে বাইতুল্লাহর দিকে তাকানো নিষেধ। বাইতুল্লাহর দিকে সীনা ফেরানোও নিষেধ। কেউ যদি বাইতুল্লাহর দিকে সীনা ফেরায় তাহলে যতটুকু সময় সীনা বাইতুল্লাহর দিকে ছিল ওই পরিমাণ তাওয়াফ হয়নি। আবার পিছিয়ে এসে তাওয়াফ করতে হবে। কী প্রমাণ করে এই মাসআলাগুলো? এটাই প্রমাণ করে যে, বাইতুল্লাহর তাওয়াফ বাইতুল্লাহর জন্য নয়, আল্লাহর জন্য। এটা আল্লাহর ইবাদত। হজরে আসওয়াদে চুম্বন করার বিষয়টি দেখুন। নিয়ম হল, অন্যকে কষ্ট না দিয়ে যদি হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করা সম্ভব হয় তাহলে চুম্বন করবে। তবে সাধারণত হজ্বের মওসুমে এটা সম্ভব হয় না। একেবারে মওসুমের শুরুতে চলে গেলে কিংবা মওসুমের শেষে যদি কেউ থেকে যায় তা চুম্বনের সুযোগ পাওয়া যায়। অন্যথায় তা পাওয়া যায় না। দূর থেকে হাত উঁচিয়ে হাতে চুম্বন করবে।
হজরে আসওয়াদে চুম্বনের বিষয়টি বাহ্যত মনে হতে পারে পাথরের প্রতি ভক্তি প্রকাশ। অথচ মোটেই তা নয়। হজরে আসওয়াদ হচ্ছে বেহেশতী পাথর। আল্লাহ তাআলা বেহেশত থেকে তা পাঠিয়েছেন এবং এতে চুম্বন করলে তিনি বান্দার গুনাহ মাফ করবেন। লক্ষ করুন, গুনাহ মাফ করবেন আল্লাহ তাআলা। তাই আল্লাহর আদেশে হজরে আসওয়াদে চুম্বন করা হয়। হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করলে তা কিয়ামতের দিন সাক্ষ্য দিবে যে, এ ব্যক্তি তাওহীদের লোক ছিল। দেখুন, তাওহীদপন্থী ছিল বলে সাক্ষ্য দিবে। কেননা, তা আল্লাহর পক্ষ হতে নির্দেশিত।
হযরত ওমর ফারূক রা.-এর ঘটনা অনেকেরই জানা আছে। হজরে আসওয়াদকে চুম্বন করার সময় তিনি বললেন, ‘আমি জানি, তুমি একটি পাথরমাত্র। কল্যাণ বা অকল্যাণের কোনো ক্ষমতা তোমার নেই। আমি যদি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে চুম্বন করতে না দেখতাম তাহলে আমি কখনো তোমাকে চুম্বন করতাম না।’ তাহলে পরিষ্কার পার্থক্য হয়ে গেল হিন্দুদের পাথর-পূজা ও আমাদের হজরে আসওয়াদে চুম্বনের মাঝে। এভাবে হজ্বের সকল কাজকর্মের সম্পর্কে চিন্তা করুন। দেখা যাবে যে, এর হাকীকত হচ্ছে তাওহীদ ও ইবাদত। আর তা আদায়ের পদ্ধতি রয়েছে কুরআন ও সুন্নাহ্য়। তাই স্বরূপ, তাৎপর্য এবং সম্পাদনের পদ্ধতি কোনো বিষয়েই অন্যান্য ধর্মের পূজা-অর্চনার সঙ্গে এর মিল নেই। তাহলে ইসলামের ইবাদত-বন্দেগী এবং ঈদ ও কুরবানীকে অন্যান্য ধর্মের উৎসব ও উপাসনার সঙ্গে এক কাতারে কীভাবে নিয়ে আসা যায়? অথচ এ কাজটিই আমাদের দেশের সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী মহলের প্রধান প্রবণতা। এটি সত্যিই অত্যন্ত দুঃখজনক।
এজন্য ইবাদত-বন্দেগীর হাকীকত ও স্বরূপ পরিষ্কারভাবে বোঝা উচিত। হাকীকত না বোঝার কারণে ইবাদতের প্রসঙ্গটি আমাদের অনেকের কাছেই অনেক হালকা ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। তারা একে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার জন্য বিভিন্নভাবে এর তাৎপর্যগত বিকৃতি সাধন করে থাকে। বস্তুত এটা ইবাদতের হাকীকত সম্পর্কে অজ্ঞতার ফল।
হজ্বের তাৎপর্যগত অপব্যাখ্যা
অনেকে হজ্বকে মুসলমানদের বৈশ্বিক পর্যায়ের মহাসমাবেশ বলে ব্যাখ্যা করে থাকে। এটা বিকৃতি। হজ্বকে যেমন অন্য ধর্মের উপাসনার সঙ্গে মেলানো যাবে না তেমনি একে নিছক সম্মেলনও বলা যাবে না। মুসলমানরা অবশ্যই একত্র হবেন, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবেন। তবে তা ভিন্ন প্রসঙ্গ। হজ্বকে এর সঙ্গে মেলানো যাবে না। হজ্ব খালিছ ইবাদত। দেখুন, হজ্ব ফরয হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে সামর্থ্য। সামর্থ্যবান ব্যক্তি শিক্ষিত হোক কি অশিক্ষিত, তার উপর হজ্ব ফরয। হজ্ব যদি মুসলমানদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনই হত তাহলে শুধু বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল লোকদেরকেই সেখানে যেতে বলা হত।
বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিজীবী
প্রসঙ্গত বলি, আমি কিন্তু বুদ্ধিমান বলছি, বুদ্ধিজীবী বলছি না। আমি এ দুটো শব্দের মধ্যে পার্থক্য করি। বুদ্ধিমান হচ্ছে যারা বুদ্ধির দ্বারা খালিকের পরিচয় পেয়েছে, রাসূলের পরিচয় পেয়েছে এবং বুদ্ধিকে মানুষের সেবা ও কল্যাণের কাজে নিবেদিত করেছে। এরা হচ্ছে বুদ্ধিমান। কুরআনের ভাষায় ‘উলূল আলবাব’। পক্ষান্তরে বুদ্ধিজীবী হল যারা বুদ্ধি বিক্রি করে খায়। তাদের বুদ্ধি সমাজের কোনো ক্ষতি ছাড়া উপকার করে না। বর্তমানে বুদ্ধিজীবী নামে যে মহলটি প্রসিদ্ধ তাদের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করলে এটাই বলতে হয়। আমরা কখনো কখনো বুদ্ধিমান অর্থে বুদ্ধিজীবী শব্দ ব্যবহার করি তবে তা ঠিক নয়।
যাই হোক, হজ্ব যদি নিছক মুসলমানের আন্তর্জাতিক সম্মেলন হত তাহলে শুধু বুদ্ধিমান ও চিন্তাশীল মানুষকেই দাওয়াত দেওয়া হত। যেন তারা একত্র হয়ে মুসমিলম উম্মাহর সঙ্কট ও সম্ভাবনা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে পারেন। অথচ বিষয়টি এমন নয়।
তদ্রূপ হজ্বের কাজকর্মগুলো লক্ষ করুন, আজ মিনায়, পরদিন আরাফায়, এরপর মুযদালিফায়, আবার মিনায়, এরপর মক্কায়, এভাবে হাজীরা শুধু সফরের ওপর থাকেন। পক্ষান্তরে সম্মেলনের দাবি হচ্ছে, একস্থানে শান্ত হয়ে বসে চিন্তা-ভাবনা ও মতবিনিময় করা। এটা তো এ আমলের সম্পূর্ণ প্রকৃতিবিরুদ্ধ। এজন্য ইবাদত-বন্দেগীর হাকীকত সঠিকভাবে বোঝা উচিত। অন্যথায় এ ধরনের বিভিন্ন বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সঠিকভাবে ইবাদত-বন্দেগী করার তাওফীক দান করুন। আমীন।