প্র শি ক্ষ ণ : দুর্গা বাহিনীর হাতে রাইফেল : টার্গেট কারা?
একটি ছবি ও ছবির বর্ণনা। ছাপা হয়েছে গত ২৮ মে সোমবার। ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর ১১ পাতায়। পাতাটির নাম ‘সারাবিশ্ব’-মূলত আন্তর্জাতিক খবরাখবরের জন্যই পাতাটি বরাদ্দ-আন্তর্জাতিক সংবাদসংস্থা এএফপির বরাতে ছাপা হওয়া ওই ছবির সঙ্গে ছবিবর্ণনা বা ক্যাপশন থাকলেও কোনো খবর বা প্রতিবেদন নেই। না থাকলেও কোনো সমস্যা হয়নি। ওই ছবিটিই যেন তার ভেতরের সব খবর বলে দিয়েছে।
পাতার উপরে বাঁ-পাশে চার কলামজুড়ে ছবিটি ছাপা হয়েছে। ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে, সেলোয়ার-কামিজ পরা বেসামরিক চার তরুণীকে রাইফেলের গুলি চালানো শেখাচ্ছে আরও চারজন যুবতী। তারাও বেসামরিক। প্রশিক্ষণ গ্রহণকারী তরুণীরা শুয়ে রাইফেল তাক করে টার্গেট ভেদ করছে। প্রশিক্ষক যুবতীরা উপুড় হয়ে হাতে ধরে ধরে তাদের সাহায্য করছে। পেছনে দাঁড়িয়ে-বসে আছে আরও কয়েক ডজন তরুণী। সবারই বুকে ব্যাজ লাগানো। নারীদের একটি অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। না, ছবিটি পাকিস্তান, আফগানিস্তান, কাশ্মীর, সোমালিয়া কিংবা ইয়েমেনের নয়। ওই ছবিটি মহান গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র (?) ভারতের। এবং ভারতের একশ্রেণীর হিন্দুদের। তাই অস্ত্র প্রশিক্ষণের এই পুরো পর্বটিকে ‘জঙ্গিবাদ’ হিসেবে কোথাও চিহ্নিত করা হয়নি।
অস্ত্র ও আইন হাতে তুলে নেওয়ার এই ভয়ংকর মহড়াটিকে ‘নিরীহ’ ও ‘আত্মরক্ষামূলক’ একটি আবহে পরিবেশন করা হয়েছে। ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে-‘ভারতের গুজরাট রাজ্যের আহমেদাবাদে একটি প্রশিক্ষণ শিবিরে হিন্দু দুর্গা বাহিনীর সদস্যরা রাইফেল চালানোর ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। এই বাহিনী কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নারী শাখা। এ সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে বিপদের দিনে হিন্দু পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।’
কট্টর হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের অস্ত্র প্রশিক্ষণের ছবি। তাই এটা সন্ত্রাস নয়। তাই এতে কোনো জঙ্গিবাদ নেই। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এদের ব্যাপারে নীরব। নীরব বিশ্বমোড়লরাও। দেখা যাচ্ছে, সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ কেবল একটি ধর্মের অনুসারীদের বিরুদ্ধে। সে ধর্মের নাম ইসলাম। ভারতের হিন্দু নারীরা রাইফেল চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এর প্রয়োগ হলে তো হবে মুসলমানদের উপরেই। অতীতে তো তাই হয়েছে। গুজরাটে-আহমেদাবাদেই হয়েছে। আগুনে পুড়িয়ে, ধর্ষণ করে হাজার হাজার মুসলিম নারীকে সেখানে হত্যা করা হয়েছে। আবার সেখানেই হিন্দু নারীরা রাইফেল চালানো শিখছে। যদি গুজরাটের মুসলিম নারীরা ভবিষ্যতের বিপদ ঠেকাতে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিত তাহলে সেটাই হতো যুক্তিযুক্ত ও সমর্থনযোগ্য। কিন্তু সে উপায় নেই। কারণ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে মুসলিম নারীদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণের অনুমোদন নেই। তাদের অধিকার কেবল নিহত হওয়ার, ধর্ষিত হওয়ার, আগুনে পোড়ার। নিজেরা বাঁচার কিংবা প্রতিরোধের কোনো চেষ্টা করলেই সেটা জঙ্গিবাদ। সেটা সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসবাদ। দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক কোনো শক্তিই প্রতিরোধ-সামর্থ্যসম্পন্ন কোনো মুসলমান দেখতে চায় না। অপরদিকে ভিন্ন ধর্মীরা কেবল আত্মরক্ষা নয়, আক্রমণের জন্যও সশস্ত্র প্রস্ত্ততি নিলে তাতে কোনো দোষ থাকে না। সেটা সন্ত্রাসবাদের ধারেকাছেও যায় না। কারণ, তারা তো মুসলিম নয়। এতদিন জানতাম, বেসামরিক নাগরিকদের সশস্ত্র তৎপরতাকেই চিহ্নিত করা হয় উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ হিসেবে। কিন্তু এ ছবিটা দেখার পর মনে হলো, বেসামরিক নাগরিকরা মুসলিম হলেই তখন সেটা উগ্রবাদ বা জঙ্গিবাদ; হিন্দু, খ্রিস্টান বা ইহুদীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র চালানো শিখলেও তাতে আইন বা শৃঙ্খলার কোনো ব্যত্যয় ঘটে না। ছবির ক্যাপশনে লেখা একটি বাক্য হচ্ছে-‘বিপদের দিনে হিন্দু পরিবারগুলোকে সহায়তা দেওয়ার মাধ্যমে সংহতি প্রতিষ্ঠা করা।’ এরকম একটি বাক্যে ‘হিন্দু শব্দটির জায়গায় ‘মুসলিম’ বসিয়ে দেখুন। তাহলেই সেটি সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে অভিযুক্ত হবে। প্রপাগান্ডা, ধরপাকড় ও আক্রমণ করে আত্মরক্ষার সাধ মিটিয়ে দেওয়া হবে। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে কেউ কেউ বলেন, শান্তিত, উদারতা আর অসাম্প্রদায়িকতার নামে দেশে দেশে কেবল মুসলমানদের দেওয়া হচ্ছে ইসলামের সঙ্গে সম্পর্কহীনতার এক অদ্ভুৎ ‘উদারতার’ পাঠ। ইসলাম ও মুসলমানের ওপর চালানো কোনো আঘাতেই যেন কোনো মুসলিম তার হৃদয়ে স্পন্দন অনুভব না করে সেজন্য দিন দিন তাদের ‘শান্তিপ্রিয়’, ‘অহিংস’ ও ‘উদার’ হওয়ার মানসিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে একশ্রেণীর গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ আর সরকারী কর্তারা রাখছে বড় ভূমিকা। অপরদিকে অমুসলিম জাতি-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়গুলোর মাঝে গড়ে তোলা হচ্ছে প্রতিরোধ ও আক্রমণ-প্রস্ত্ততি। হিন্দু হোক আর খ্রিস্টান হোক, মুসলিমপ্রধান দেশ হোক, কিংবা অমুসলিমপ্রধান-মিশ্র জনগোষ্ঠীর মাঝে এ নীতিই কার্যকর করা হচ্ছে দেশে দেশে। এতে মুসলমানরা ব্যাপকভাবে কোণঠাসা হচ্ছে বর্তমানে। ভবিষ্যতের জন্য তারা হচ্ছে আরও মারাত্মক অসহায়। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ২৮ মে প্রকাশিত ছবিটি ওই প্রোগ্রামেরই একটি বাস্তব সাক্ষ্য কি না।
কথিত জঙ্গিবাদের পুরো প্রস্ত্ততিটাই চালানো হচ্ছে পিবরীত দিক থেকে। অভিযোগের তীর আর আক্রমণের গোলাবারুদ ছোঁড়া হচ্ছে মারখাওয়া মুসলমানদের দিকে। আর বন্দুক হাতে প্রশিক্ষণের জন্য দেশে দেশে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে অমুসলিমদের। ছবির ঘটনাটি ভারতের হলেও ভেতরের চিত্রটি সারাবিশ্বের। এ এক ভয়ংকর ও অসম সাম্প্রদায়িক বিষের চিত্র। বিষের এই নর্দমায় হাত-পা বেধে মুসলমানদের সাঁতার দিতে বলা হচ্ছে। মুসলমানরা করুণ দুঃখে সাঁতরে চলেছেন। ইনশাআল্লাহ বিষের এই নর্দমা তারা পার হবেন। কিংবা শুকিয়ে শেষ হয়ে যাবে এই নর্দমার সব কালো বিষ। আমরা সেই দিনের অপেক্ষায়।