বছর ঘুরে আবারো এল ঈদুল আযহা। মুসলিম জীবনে ঈদুল ফিতরের মতো আরেকটি আনন্দোৎসব। এদিন ধনী-গরীব, রাজা-প্রজা সকলেই ঈদগাহে সমবেত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দু’রাকাত নামায আদায় করবে। আর সামর্থ্যবান মুমিন বান্দারা আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের জন্য শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় তাদের কুরবানীর পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করবে। এরপর তাঁর আম মেহমানদারী গ্রহণের সৌভাগ্য অর্জন করবে।
ঐতিহাসিক, তবে ...
ঈদুল আযহা মুসলমানদের অন্যতম উৎসবের দিন। যার মূল বিষয় হল কুরবানী। এটি কুরআন-সুন্নাহয় অকাট্যভাবে প্রমাণিত বিধান এবং আল্লাহ ও রাসূলের পক্ষ হতে নির্দেশিত অন্যতম প্রধান ইবাদত। এই দিনের আনন্দ হল, দশই যিলহজ্ব আল্লাহর ব্যাপক মাগফিরাত লাভের আনন্দ এবং ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জল আনুগত্য-কুরবানী পেশ করার আনন্দ। আর যে মাহবুব মাওলার ভালবাসা ও নৈকট্য অর্জনের জন্য এত সাধনা তিনি যদি দয়া করে কবুল হওয়া কুরবানীর মাধ্যমে ‘আম যিয়াফত’ বা ব্যাপক মেহমানদারী করেন, তাহলে তো মুমিন-হৃদয়ে আনন্দের জোয়ার আসবেই। তাৎপর্যগত দিক থেকে ইসলামী ঈদ আর অন্যান্য ধর্মের পর্ব উৎসবের মাঝে এই পার্থক্য রয়েছে যে, অন্যান্য ধর্মে যেখানে শত বছরের পুরনো কোনো ঘটনা কিংবা বিশেষ কোনো ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে বছর বছর উৎসব উদযাপিত হয় সেখানে ইসলাম নিজেরই সদ্য করা ইবাদতের সৌভাগ্য-আনন্দে উজ্জীবিত হতে বলে। তাই এক মাস সিয়াম সাধনার সৌভাগ্যের আনন্দ উৎসব হল ঈদুল ফিতর। আর হজ্ব, কুরবানী ও মাওলার মেহমানদারী লাভের খুশির উৎসব হচ্ছে ঈদুল আযহা। মনে রাখতে হবে যে, এই কুরবানীর মূল সূত্র যদিও মিল্লতে ইবরাহীমিতে বিদ্যমান ছিল কিন্তু মিল্লাতে ইবরাহীমির ‘সেই’ ঘটনাই আমাদের আনন্দের মৌলিক উৎসব নয়; বরং আমাদের আনন্দের অন্তর্নিহীত কারণ তাই যা উপরোল্লেখিত হয়েছে। কারণ কুরবানী ইসলামেরই একটি স্বতন্ত্র বিধান এবং শরীয়তে মুহাম্মাদীর শিআর।
যুগে যুগে কুরবানী
কুরবানী বা প্রিয় বস্তুটি মাহবুব মাওলার দরবারে উৎসর্গ করার ইতিহাস সুদীর্ঘ। হযরত আদম আ.-এর দুই সন্তানের কুরবানীর কথা বিবৃত হয়েছে সূরা মায়েদায়। এই কুরবানীর প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে উত্তম সূত্রে বর্ণিত হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.-এর একটি রেওয়ায়েতে। হযরত আদম আ.-এর দুজন ছেলে ছিল। হাবিল আর কাবিল। হযরত হাওয়া আ. প্রত্যেকবার এক জোড়া সন্তান প্রসব করতেন। একটি ছেলে অপরটি মেয়ে। এই জমজ ভাইবোনদের বিয়ে ছিল হারাম। তাই তখন এক গর্ভে জন্মলাভ করা ছেলের সাথে ভিন্ন গর্ভে জন্মলাভ করা মেয়ের বিয়ের নিয়মই প্রচলিত ছিল। কাবিলের জমজ বোনটি ছিল সুশ্রী। জমজ হওয়ার কারণে তাকে কাবিল বিয়ে করার নিয়ম না থাকলেও তার জেদ ও হঠকারিতা ছিল যে, সে তাকে বিয়ে করবেই। অন্যদিকে হকদার হওয়ার দাবি ছিল হাবিলের। এই দ্বন্দের ফয়সালা হল এভাবে-প্রত্যেকে আল্লাহর সান্নিধ্যে কিছু কুরবানী করবে। যার কুরবানী কবুল হবে তার দাবিই গ্রহণযোগ্য হবে। হাবিল একটি দুম্বা ও কাবিল কিছু ফলফলাদির কুরবানী পেশ করল। তখনকার দিনে কুরবানী কবুল হওয়ার আলামত ছিল, আকাশ থেকে আগুন নেমে কবুলকৃত কুরবানী খেয়ে ফেলত। যথারীতি আগুন এসে হাবিলের দুম্বাটি খেল, কাবিলের কুরবানী রয়ে গেল তথৈবচ। কিন্তু তা মেনে নিতে পারেনি কাবিল। প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে সে হত্যা করে ফেলল তার ভাইকে। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ২/৪৮)
সূরা মায়েদার ২৭ থেকে ৩১ আয়াত পর্যন্ত এই ঘটনাটি সংক্ষিপ্তভাবে বিবৃত হয়েছে। যার প্রথম আয়াতটি হল, (তরজমা) আর (হে নবী) আপনি তাদের সামনে আদম আ.-এর দুই ছেলের ঘটনা সঠিকভাবে পাঠ করে শুনিয়ে দিন। যখন উভয়েই এক একটি কুরবানী পেশ করেছিলেন। তাদের মধ্য থেকে একজনের কুরবানী কবুল হল আর অপরজনেরটি কবুল হল না। সেই (অপরজন) বলতে লাগল, আমি নিশ্চয়ই তোমাকে হত্যা করে ফেলব। সেই (প্রথম জন) বলল, আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের আমলই কবুল করেন।
হযরত আদম আ.-এর পর প্রত্যেক উম্মত বা জাতির মধ্যেই এই মুবারক আমল বিদ্যমান ছিল।
আল্লাহ তাআলা বলেন, (তরজমা) আর প্রত্যেক উম্মতের জন্য আমি কুরবানী নির্ধারণ করেছি। যেন তারা আল্লাহর দেওয়া চতুষ্পদ পশুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের ইলাহ তো এক ইলাহ। অতএব তোমরা তারই অনুগত থাক এবং (হে নবী) আপনি সুসংবাদ দিন বিনীতদের।-সূরা হজ্ব : ৩৪
উল্লেখ্য যে, সকল উম্মতের কুরবানীর নিয়ম এক ছিল না। ইসলামী শরীয়তে যে পদ্ধতিতে কুরবানী করা হয় তাও আল্লাহ তাআলার পক্ষ হতে নির্দেশিত এবং তা মিল্লাতে ইবরাহীমির অংশ। হযরত ইবরাহীম আ. আল্লাহ তাআলার আদেশে তাঁর প্রিয় পুত্র ইসমাঈলকে কুরবানী দিতে উদ্যত হওয়ার ঘটনা খুবই প্রসিদ্ধ। মূল ঘটনাটি কুরআন মজীদে আছে। তবে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক কিচ্ছা-কাহিনী রচিত হয়েছে, যা ইসরাঈলী রেওয়ায়েতনির্ভর।
কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা এই ঘটনা যতটুকু বর্ণনা করেছেন তাই মুমিনের জন্য যথেষ্ট।’
আল্লামা ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, অতঃপর এ ব্যাপারে যে সমস্ত আছার বর্ণিত তার অধিকাংশই হচ্ছে ইসরাঈলী। এই সুন্দর ঘটনা, মহান পরীক্ষা ও আল্লাহর পক্ষ হতে বিশাল দুম্বা প্রেরণ সম্পর্কিত ঘটনার জন্য কুরআন মজীদের বর্ণনাই যথেষ্ট।
অতএব এই ব্যাপারে ইসরাঈলী রেওয়ায়েত বা অলীক কল্প-কাহিনীতে না গিয়ে কুরআন মজীদে বর্ণিত ঘটনার উপরই সন্তুষ্ট হওয়া উচিত। তাই এখানে কুরআন মজীদের সূরা সাফফাতের আয়াত ৯৯ হতে ১০৭ পর্যন্ত বর্ণিত ঘটনার সরল মর্মার্থ তুলে ধরছি।
আর তিনি ইবরাহীম আ. বললেন, আমি আমার রবের দিকে চললাম। তিনি অবশ্যই আমাকে সৎপথে পরিচালিত করবেন। হে আমার রব, আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান করুন। অতঃপর আমি তাকে এক ধৈর্য্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। অতঃপর সে যখন পিতার সাথে কাজ করার মতো বয়সে উপনীত হল তখন তিনি (ইবরাহীম) বললেন, প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবাই করছি। এখন তোমার অভিমত কী বল? সে বলল, হে আমার পিতা! আপনি যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন তা-ই করুন। ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। তারা উভয়ে যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং পিতা পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিলেন তখন আমি (আল্লাহ) তাকে আহ্বান করলাম, হে ইবরাহীম! তুমি স্বপ্নাদেশকে সত্যে পরিণত করেছ। আমি এভাবেই সৎকর্ম পরায়ণদের পুরষকৃত করে থাকি। নিশ্চয়ই এটি ছিল একটি স্পষ্ট পরীক্ষা। এবং আমি তাকে মুক্ত করলাম একটি বড় যবাইয়ের পশুর বিনিময়ে।
এর চার আয়াত পর হযরত ইবরাহীম আ.কে ইসহাক নামে আরেকটি পুত্র-সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। ইহুদী-খৃষ্টানরা যদিও বলে যে, কুরবানীর ঘটনা হযরত ইসহাক আ.-এর সঙ্গে ঘটেছিল কিন্তু বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যে, হযরত ইসমাঈল আ.-এর সঙ্গেই কুরবানীর ঘটনা ঘটেছিল। এটিই সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে অধিকাংশ মুফাসসিনের রায়। হাফেয ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, এটিই কুরআন দ্বারা সুস্পষ্ট; বরং যবীহ ইসমাঈল আ. হওয়ার তো আরো বড় দলীল হল কুরআন প্রথমে যবাইয়ের ঘটনার উল্লেখ করেছে। এরপর ইসহাকের জন্মের সুসংবাদ দান করেছে। যারা যবীহ ইসহাক আ. বলে থাকে তাদের দলীলের সূত্র হল বিভিন্ন ইসরাঈলী রেওয়ায়েত। তাদের কিতাবে রয়েছে তাহরীফ। (বিদায়া ১/৩৬৬)
এছাড়া এটা যে আহলে কিতাবদের তাহরীফ তার আরো সুস্পষ্ট দলীল বর্তমান বাইবেলেও বিদ্যমান রয়েছে। কারণ বাইবেলের (বাংলা সংস্করণে) আদি পুস-কের ১৬-১৭ পৃষ্ঠায় বর্ণনা দ্বারা বোঝা যায় যে, ইবরাহীমের স্ত্রী সারার তখনও কোনো ছেলে মেয়ে হয়নি। তখন আদেশ এল তিনি তাকে আরও বললেন, দেখ, তুমি গর্ভবতী। তোমার একটি ছেলে হবে। আর সেই ছেলেটির নাম তুমি ইশ্মায়েল রাখবে।’ (আদি পুস-ক পৃ. ১৭) বাইবেলের বর্ণনা মতেই তখন ইবরাহীম আ.-এর বয়স ছিয়াশি বছর। আর তাঁর একশ বছর বয়সে জন্ম নেন ইসহাক। (দেখুন : আদি পুস-ক পৃ. ২৩)
এরপর আদি পুস্তকের ২৪-২৫ পৃষ্ঠায় কুরবানীর ঘটনা উল্লেখিত। এখানে আছে, ‘ঈশ্বর বললেন, তোমার ছেলেকে, ‘অদ্বিতীয়’ ছেলে ইসহাককে, যাকে তুমি এত ভালবাস তাকে নিয়ে তুমি মোরিয়া এলাকায় যাও। সেখানে যে পাহাড়টার কথা আমি বলব তার উপর তুমি তাকে পোড়ানো-উৎসর্গ হিসাবে উৎসর্গ কর।’ পরে বলা হয়েছে, ‘তুমি তোমার ছেলেকে, অদ্বিতীয় ছেলেকে উৎসর্গ করতে পিছপা হওনি। এখানে বাইবেলে বারবার আসা ‘অদ্বিতীয়’ শব্দটি মনোযোগের দাবিদার। বাইবেলের বর্ণনামতেই ইসমাঈলের জন্ম আগে তাই ইসহাক আ.-এর জন্মের আগ পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ইবরাহীম আ.-এর এক মাত্র পুত্র।
এই জন্যে ইবনে কাসীর রাহ. বলেন, এখানে ইসহাক শব্দটি প্রক্ষিপ্ত। কেননা, ইসহাক তো একক ও অদ্বিতীয় সন্তান নন। একক ও অদ্বিতীয় সন্তান তো ইসমাঈল। প্রকৃতপক্ষে আরবদের প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে তারা এমন মিথ্যা তাহরীফে লিপ্ত হয়েছে। কারণ ইসমাঈল আ. হলেন ইয়াকুব আ.-এর পিতা, ইয়াকুব আ. মানে যার দিকে তারা নিজেদের সম্পৃক্ত করে থাকে। তারা ইসমাঈল আ.-এর মর্যাদা নিজেদের দিকে টেনে নেওয়ার জন্য তাদের ধর্মগ্রন্থে তাহরীফ করেছে। তাদের জানা নেই যে, ইযযত ও সম্মান আল্লাহরই হাতে। তিনি যাকে ইচ্ছা তা দান করে থাকেন। (বিদায়া ১/৩৬৬-৩৬৭)
পরিশেষে একটি ঘটনা উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানতে চাই। হযরত ওমর ইবনে আবদুল আযীযের খেলাফতকালে সিরিয়ার এক ইহুদী আলেম মুসলমান হলেন। তখন খলীফা তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইবরাহীমের কোন সন্তানকে যবাই করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল? তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! সে তো ইসমাঈলই হে আমীরুল মুমিনীন। ইহুদীরাও এ কথা জানে। কিন্তু হে আরবজাতি! তোমাদের সাথে হিংসার বশবর্তী হয়ে তারা এই কাজ করেছে।(বিদায়া ১/৩৬৯-৩৭০)
সে যাই হোক, মিল্লাতে ইবরাহীমের সে মহান কুরবানীর সূত্র ধরেই আমাদের জন্য আল্লাহ ও রাসূল প্রবর্তন করেছেন এই মহান ইবাদতের। ত্যাগ ও বিসর্জনের এই নিঃশর্ত আনুগত্যের।
কুরবানীর মূল প্রাণ
কুরবানীর প্রাণ কথা হল তাকওয়া-খোদাভীতি, আল্লাহর প্রতি নিখুঁত মহব্বত ও ইখলাস। তাকওয়া, মহব্বত ও ইখলাস প্রত্যেকটি কলবের সাথে সম্পৃক্ত। কারণ আল্লাহর গোস্তের প্রয়োজন নেই, রক্তের প্রয়োজন নেই। তিনি তো শুধু মুমিনের তাকওয়ার পরীক্ষা নিতে চান। লোক দেখানো, মানুষের বাহবা কুড়ানো, পার্থিব বড়ত্বের প্রতিযোগিতা, বড় লোকের কাতারে শামিল হওয়া এবং ‘আমার ছেলেরা কার দুয়ারে গোশতের জন্য ধর্ণা দেবে’-এ ধরনের ছোট এ পার্থিব মানসিকতার কুরবানী হয়তো সেই সব সামান্য উদ্দেশ্যকে পূরণ করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টির জন্য উৎসর্গিত নজরানা হতে পারে না। আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা মুত্তাকীদের কুরবানীই কবুল করেন।-সূরা মায়িদা : ২৭
তিনি আরো বলেন, আল্লাহর কাছে না এসব পশুর গোশত পৌঁছে, না তার রক্ত; বরং তার নিকট তোমাদের তাকওয়া পৌঁছে থাকে।-সূরা হজ্ব : ৬৭
এই কারণেই পূর্ণ ইখলাস ও মহাব্বতের সাথে শুধুই আল্লাহর রেযামন্দীর জন্য কেউ কুরবানী করলে তা আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়। এমনকি পশুর রক্ত মাটিতে পড়ার আগেই আল্লাহর কাছে তা কবুল হওয়ার কথা হাদীস শরীফে এসেছে।-জামে তিরমিযী হাদীস : ১৪৯৩
ফ্রিজ সমাচার
কুরবানীর গোশতের এক ভাগ গরীব-মিসকীনদের আরেক ভাগ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের এবং বাকি এক অংশ কুরবানীদাতাদের খেতে বলা হয়। এটি মুস্তাহাব। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, এসব পশুর গোশত থেকে তোমরা খাও এবং বিপন্ন অভাবগ্রস্তদের খাওয়াও। -সূরা হজ্ব : ২৮
আরো বলেছেন, তখন তা হতে তোমরা খাও এবং ধৈর্য্যশীল ও যাচনা উভয় ধরনের অভাবগ্রস্তকে খাওয়াও।-প্রাগুক্ত ৩৬
ইসলামের প্রথম যুগে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক বছর কুরবানীর গোস্ত তিন দিনের চেয়ে বেশি খেতে নিষেধ করেছিলেন। এ সম্পর্কে উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, নবীজীর যুগে কুরবানীর সময় কিছু গ্রাম্য দরিদ্র মানুষ নবীজীর দরবারে এসেছিলেন। তাদের ক্ষুধা ও দারিদ্র্য লক্ষ্য করে তিনি এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলেন। আর বাকি গোস্তগুলো অভাবীদের দান করতে বলেছিলেন। পরের বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নিষেধ তুলে নেন এবং অনুমতি দিলেন, (যতদিন ইচ্ছা) খাও, সদকা কর এবং জমা রাখ।-সহীহ বুখারী হাদীস : ৫৪২৩; সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস : ৫৯২৭
উপরোক্ত হাদীসে ক্ষুধার্ত লোকদের অবস্থার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়ার একটি শিক্ষা নিহিত রয়েছে। আমাদের দেশে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নিচে অবস্থান করে, কিন্তু এ দারিদ্র্য পীড়িত দেশে কুরবানী উপলক্ষে ফ্রিজের বাজার যেভাবে সরগরম হয়ে উঠে তাতে সহজেই অনুমান করা যায়, ধনীর কুরবানীর গোশতের কয়টি টুকরো দরিদ্রের ঝুপড়িতে পৌঁছে। এ দেশে এমন বিচিত্র মানুষও আছেন যারা কুরবানীর পর আস্ত পশুটিই ফ্রিজে ঢুকিয়ে রাখেন আর সারা বছরের গোস্তের প্রয়োজন পুষিয়ে নেন। আইনের দৃষ্টিতে তা জায়েয হতে পারে কিন্তু মানবিকতা বলেও তো একটা কথা আছে। আর উপরে যে হাদীসটি বলা হল, তাতেও বলা হয়েছে যে, কুরবানীর গোস্ত ঈদ ও পরবর্তী দিনগুলোতে নিজেরাও খাও এবং গরীব-মিসকীনদের মাঝে বণ্টন কর। এই হাদীসের হিদায়েত মোতাবেক আমাদের আমল করা উচিত।
পরিচ্ছন্নতা কাম্য
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে ইসলাম বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। একটি ইবাদত আদায় করতে গিয়ে পশুর বর্জ্য ও ময়লা-আবর্জনা দ্বারা ঘরের আঙ্গিনা ও পথ-ঘাটকে দূষিত করে তোলা মোটেই উচিত নয়। এতে মানুষকে কষ্ট দেওয়া হয় যা একটি ভিন্ন গুনাহ। এসব উদাসীনতার কারণে ইবাদতের মর্যাদা ম্লান হয়ে যায়। এদিকে সবার সতর্কতা ও সচেতনতা একান্ত জরুরি।
পরিশেষে আসুন হৃদয় মনের সবটুকু মহব্বত নিয়ে সামর্থ্যের মধ্যে সবচেয়ে ভালো পশুটি ক্রয় করি আর একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য তার দরবারে তা উৎসর্গ করি। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে রিয়া থেকে বেঁচে ইখলাসের সাথে কুরবানী করার মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন।