শাবান-রমযান-১৪৩৩   ||   জুলাই-আগস্ট-২০১২

وحدة الأمة واتباع السنة উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা, সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 

গত ২৩ রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরী, মোতাবেক ১৭ মার্চ ২০১২ ঈ. শনিবার কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার উদ্যোগে উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ থেকে যে প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হয়েছিল তা হুবহু বা তার সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশের জন্য অনেক বন্ধু/পাঠক জোর আবেদন জানিয়েছেন। সেমিনারে উপস্থিত বন্ধুরা প্রবন্ধটি পুস্তক আকারে পেলেও আলকাউসারের অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা পৌঁছেনি। এজন্য সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জনের পর প্রবন্ধটির সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি প্রবন্ধের চতুর্থ কিস্তি। যাদের কাছে মূল প্রবন্ধটি রয়েছে তাদের জন্যও তা  উপকারী হবে বলে আশা রাখি।

বর্তমান সংখ্যা ও আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত আলোচনা মূলত উক্ত প্রবন্ধের পরিবর্ধিত ও সম্পাদিত দ্বিতীয় সংস্করণ, যা গত ৪ রজব, ৩৩ হি., মোতাবেক ২৬ মে ১২ ঈ. একই স্থানে অনুষ্ঠিত সেমিনারের (দ্বিতীয় পর্ব) উপলক্ষে প্রস্ত্তত করা হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এটিকে উপকারী করুন। আমীন।-সম্পাদক

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

এই পরিচ্ছেদে বিক্ষিপ্ত কিছু বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলাই তাওফীকদাতা। তাঁরই কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।

১. রুচির পার্থক্য ও কর্মক্ষেত্রের বিভিন্নতা বিভেদ নয়

তিনটি বিষয় বৈচিত্র ও বিভিন্নতার বড় প্রশস্ত ক্ষেত্র : ১. নফল ২. মোবাহ ৩. দ্বীনের খিদমতের বিভিন্ন শাখা।

ফরয ইবাদত ও ফরয দায়িত্ব পালনের পর অবশিষ্ট সময় নফল কাজে ব্যয় করা উচিত। নফল কাজ অনেক। একেক জনের আগ্রহ একেক কাজের দিকে থাকে। কেউ নফল নামায বেশি পড়েন, কেউ নফল রোযা বেশি রাখেন। কারো আগ্রহ যিকিরের দিকে, কারো আগ্রহ ইলম বাড়ানোর দিকে। কেউ নফল হজ্ব, নফল ওমরা বেশি করেন, কেউ দান-সদকা বেশি করেন। তো যার যে কাজে আগ্রহ হয় করুন। এ হচ্ছে বৈচিত্র ও বিভিন্নতা। একে ঝগড়া-বিবাদ তো দূরের কথা, প্রশ্ন ও আপত্তির কারণও বানানো যায় না।

এটা ঠিক যে, পারিপার্শ্বিকতার বিচারে একেক জনের জন্য একেক রকম আমল বেশি উপযোগী হয়। এজন্য উত্তম হল, কোনো আলিমকে নিজের অবস্থা জানিয়ে পরামর্শ নেওয়া, নিজের শায়খের (দ্বীনী পরামর্শদাতার) কাছে জিজ্ঞাসা করা।

এখানে ইমাম মালিক রাহ.-এর একটি ঘটনা আমাদের মনে রাখা উচিৎ। ঐ যামানার বুযুর্গ আব্দুল্লাহ আলউমারী রাহ. ইমাম মালিক রাহ.কে লিখলেন, আপনি নির্জনতায় আসুন এবং ইনফিরাদী আমলে মশগুল হোন (ইমাম মালিক রাহ.-এর মূল ব্যস্ততা ছিল ফিকহ ও হাদীসের শিক্ষাদান)। ইমাম তাঁকে লিখলেন, আল্লাহ তাআলা যেমন রিযক বন্টন করেছেন তেমনি কর্মও বণ্টন করেছেন। কারো জন্য নফল নামায সহজ করেছেন, কিন্তু রোযা রাখা সহজ করেননি। আবার কারো জন্য সদকা আসান করেছেন, কিন্তু রোযা রাখা আসান করেননি। কারো জন্য জিহাদের আমলকে সহজ করেছেন।

ইলমের প্রচার প্রসারও একটি নেক আমল। আল্লাহ তাআলা এটি আমার জন্য সহজ করেছেন। এরই উপর আমি সন্তুষ্ট। আপনি যে কাজে আছেন (অর্থাৎ নির্জন সাধনা), আমার ধারণা আমার পছন্দের আমলটি তার চেয়ে অনুত্তম নয়। আশা করি, দুজনই আমরা কল্যাণ ও পুরস্কারের পথে আছি।-সিয়ারু আলামিন নুবালা, যাহাবী ৭/৪২৪

একই কথা মোবাহ বিষয়াদির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একেক জনের একেক খাবার পছন্দ, একেক জনের একেক কাপড়; কারো গোল টুপি পছন্দ, কারো লম্বা টুপি; কারো এই জামা পছন্দ, কারো ঐ জামা। আল্লাহ তাআলা যে ক্ষেত্রকে মোবাহ রেখেছেন তাতে প্রত্যেকে নিজ নিজ রুচি ও স্বভাব অনুযায়ী যেকোনোটা অবলম্বন করতে পারে। এতে প্রশ্ন-আপত্তি ঠিক নয়। হ্যাঁ, কখনো পারিপার্শ্বিক কারণে একজনের জন্য একটি মোবাহ বিষয় বা পদ্ধতি উপযোগী হয়, তো অন্যজনের জন্য অন্যটি। এসব ক্ষেত্রেও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করা চাই। যার কোনো মুরবিব বা দায়িত্বশীল আছেন তার সাথেও অবশ্যই পরামর্শ করবে। তবে মনে রাখতে হবে, মোবাহ বিষয়ে নিজের রুচি, স্বভাব, পছন্দ বা নিজের শায়খ ও মুরবিবর রুচি ও পছন্দকে অন্য সবার উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না। কেউ এমন করলে তাকে হাদীসের ভাষায় বলা হবে-

      لقد لقد حجرت واسعا

  একটি প্রশস্ত ক্ষেত্রকে তুমি সংকুচিত করেছ।

আরো বলা হবে, মোবাহের অর্থই হচ্ছে এতে বাধ্যবাধকতা নেই। এরপরও কেন বাধ্যবাধকতা আরোপ করছেন?

ব্যবস্থাপনার বিষয়ও বৈচিত্রের এক বিস্তৃত ক্ষেত্র। ওখানেও অধিক উপযোগী নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য হতে পারে। একেও লোকেরা দ্বীনী ইখতিলাফ মনে করে। এটা ঠিক নয়। শরীয়ত ব্যবস্থাপনাগত বিষয়ে ঐক্য ও সম্প্রীতি সৃষ্টি ও তা রক্ষার জন্য মশোয়ারা, আমীরের আনুগত্য ও সবরের উৎসাহ দিয়েছে। শান্তি চাইলে আমাদেরকে এই পথই অনুসরণ করতে হবে। নিন্দা-কটূক্তি জায়েযও নয়, এর কোনো সুফলও নেই।

দ্বীনী খিদমতের বিভিন্ন শাখা

দ্বীনের প্রচার প্রসারের জন্য, দ্বীনের হেফাযত ও সংরক্ষণের জন্য, দ্বীনের নুসরত ও খিদমতের জন্য এবং সমাজের সর্ব­স্তরে ও জীবনের সকল অঙ্গনে দ্বীনের আহকাম বাস্তবায়নের জন্য অনেক কাজের প্রয়োজন। প্রতিটি কাজ দ্বীনের নুসরতের এক-একটি ক্ষেত্র। দাওয়াত-ওয়াজ, তাবলীগ-তালীম, তারগীব-তারহীব, আমর বিল মারূফ-নাহী আনিল মুনকার, জিহাদ-তাযকিয়া, রাষ্ট্রের কর্ণধারদের অন্যায় ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখার জন্য সাংগঠনিক তৎপরতা এবং এ ধরনের আরো যত বৈধ কাজ আছে সবগুলো দ্বীনের খিদমতের এক-একটি শাখা। প্রতিটি শাখার সাথে ছোট ছোট  অনেক প্রশাখা আছে। এখন দ্বীনের এই সকল বিভাগের কাজ একজন বা একশ্রেণীর  মানুষের পক্ষে সম্পন্ন করা কাম্যও নয়, সম্ভবও নয়। সুতরাং কর্মবণ্টনের নীতি অনুসরণ ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু আফসোস, কিছু মানুষ কর্মের বিভিন্নতাকেও ইখতিলাফ মনে করে এবং যে যেই শাখার সাথে যুক্ত তাকেই হক্ব এবং অন্য বিভাগকে অন্তত অপ্রয়োজনীয় মনে করে। অথচ প্রতি যুগের আকাবির কুরআন-সুন্নাহ ও সালাফের জীবন ও কর্মের আলোকে এ কথাই বলে এসেছেন যে, রফীক বনো, ফরীক না বনো। অর্থাৎ সতীর্থ হও, প্রতিপক্ষ হয়ো না। দ্বীনের প্রত্যেক খাদিম, যে বিভাগেই সে নিয়োজিত থাকুক, দ্বীনের খিদমত করছে। কোনো নাজায়েয কাজে লিপ্ত না হলে এবং ভুল আকীদা, ভ্রান্ত চিন্তার প্রচার না করলে তিনি আমাদের মোবারকবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। তিনিও তো আমাদেরই কাজ করছেন। তিনি আমাদের সঙ্গী ও সতীর্থ; শত্রু ও প্রতিপক্ষ নন। বন্ধুকে শত্রু মনে করা কত মারাত্মক ভুল!

হাদীসে আছে, একদিন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে এলেন। সেখানে দুটি হালকা ছিল : এক হালকায় দুআ ও তেলাওয়াত হচ্ছিল, অপর হালকায় তালীম ও তাআল্লুম (শেখা-শেখানো)। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উভয় হালকা নেক আমলে আছে। এরপর তিনি তালীম-তাআল্লুমের হালকায় বসলেন একথা বলে যে, আল্লাহ আমাকে শিক্ষক বানিয়ে পাঠিয়েছেন।-সুনানে ইবনে মাজাহ ১/৮৩; সুনানে দারিমী পৃ. ৫৪; আলফকীহ ওয়াল মুতাফাক্কিহ ১/১০-১১-আররাসূলুল মুআল্লিম ওয়া আসালীবুহু ফিত তালীম পৃ. ৯

যারা কর্মের বৈচিত্রকে বিধানের ইখতিলাফ সাব্যস্ত করেন কিংবা নিজের ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোনো ক্ষেত্রের দিকে প্রসন্ন দৃষ্টিতে তাকান না তাদের জন্য-যদি তারা চিন্তা করেন-এই একটি হাদীসই যথেষ্ট।

কিছু লোক আছে, যারা এক মসজিদে একাধিক দ্বীনী কাজ পছন্দ করেন না কিংবা একই সময়ে মসজিদের দুই কোণে দুইটি হালকা, একে অপরের অসুবিধা করা ছাড়া, দুটি আলাদা কাজে মশগুল থাকাকেও সহ্য করতে পারেন না তাদের জন্যও এই হাদীসে চিন্তার উপকরণ আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দ্বীনের বুঝ দান করুন এবং দ্বীনের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-ন্যায় ও ভারসাম্য রক্ষার তাওফীক নসীব করুন। আমীন।

২. সকল ইখতিলাফকে নিন্দিত মনে করা এবং ইখতিলাফের দায় আলিমদের উপর চাপানো

সম্পূর্ণ প্রবন্ধটি মনোযোগের সাথে পড়া হয়ে থাকলে সম্ভবত পরিষ্কার হয়েছে যে, সকল ইখতিলাফ নিন্দিত নয়। একশ্রেণীর মানুষ সকল ইখতিলাফকে নিন্দিত মনে করে। অথচ তাদের নিজেদের মাঝেও আছে হাজারো ইখতিলাফ। এরপর কোথাও কোনো ইখতিলাফ দেখলে অতি সহজে এর দায়-দায়িত্ব আলিমদের উপর চাপিয়ে দেয় এবং আলিমদেরকে অভিযুক্ত করে।

কেউ কোনো বাতিল আকীদা প্রচার করল, কেউ শরীয়তের কোনো হুকুমের তাহরীফ করল, কেউ আল্লাহর বিধানের জায়গায় মাখলুকের আইনকে প্রধান্য দিল, কেউ জরুরিয়াতে দ্বীনের কোনো কিছুকে ইনকার করল এখন আহলে হক আলিমগণ যদি এর প্রতিবাদ করেন তাহলে এটাও ইখতিলাফ হয়ে যায় এবং এক্ষেত্রেও মতভেদের জন্য আলিমদেরকে অভিযুক্ত করা হয়!

এদের ভালো করে বোঝা উচিত, সকল ইখতিলাফ নিন্দিত নয়। যে ইখতিলাফ নিন্দিত তাতেও ইখতিলাফের দায় তার উপরই বর্তাবে, যে হক পথ ছেড়ে ভুল পথে গেল। তাওহীদ হক, শিরক বাতিল। সকলের কর্তব্য, তাওহীদের আকীদা গ্রহণ করে তাওহীদপন্থী হওয়া। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তাওহীদের দ্বীন ইসলাম থেকে বিমুখ হয়ে বিভিন্ন ধরনের শিরকে লিপ্ত, এমনকি কোনো কোনো কালিমা পাঠকারীও এই বিষয়ে অজ্ঞ এবং অজ্ঞতা বা হঠধর্মিতার কারণে শিরকে জলীতে লিপ্ত। তাহলে তাওহীদের ক্ষেত্রেও ইখতিলাফ হয়ে গেল, কিন্তু এই ইখতিলাফের জন্য দায়ী কে? যে তাওহীদের উপর আছে সে, না যে তাওহীদের বিরোধিতা করে শিরকে লিপ্ত হয়েছে সে?

সুতরাং মনে রাখতে হবে, ইখতিলাফের জন্য ঐ ব্যক্তিই দায়ী, যে হক্ব ত্যাগ করে বাতিল পথে যায় কিংবা শরীয়তসম্মত ইখতিলাফের ক্ষেত্রে সঠিক পদ্ধতি ত্যাগ করে ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করে। যারা হক্বের উপর আছে, সঠিক নিয়মের উপর আছে তাদেরকে ইখতিলাফের জন্য অভিযুক্ত করা জায়েয নয়; বরং এমন করাটাই হচ্ছে নিন্দিত ইখতিলাফ।

এ বিষয়ে হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর রিসালা ইহকামুল ইতিলাফ ফী আহকামিল ইখতিলাফ পাঠ করা উচিত। আল্লাহ তাআলা তাওফীক দিলে এ
পুস্তিকার সারসংক্ষেপ সহজ ভাষায় আলকাউসারে প্রকাশ করার ইচ্ছা আছে।

৩. আলিমদের মাঝে মতভেদ হলে আম মানুষ কী করবে?

এই প্রশ্ন এখন মানুষের মুখে মুখে। আমল থেকে গা বাঁচানোর জন্য এবং ভুল থেকে ফিরে আসার সংকল্প না থাকলে অতি নিরীহভাবে এই অজুহাত দাঁড় করানো হয় যে, আমাদের কী করার আছে? আলিমদের মাঝে এত মতভেদ, আমরা কোন দিকে যাব? কার কথা ধরব, কার কথা ছাড়ব?

আমার আবেদন এই যে, আমরা যেন এই অজুহাত দ্বারা প্রতারিত না হই। এটি একটি নফসানী বাহানা এবং শয়তানের ওয়াসওয়াসা। নিচের কথাগুলো চিন্তা করলে এটা যে শয়তানের একটি ধোঁকামাত্র তা পরিষ্কার বুঝে আসবে।

১. জরুরিয়াতে দ্বীন, অর্থাৎ দ্বীনের ঐ সকল বুনিয়াদী আকীদা ও আহকাম এবং বিধান ও শিক্ষা, যা দ্বীনের অংশ হওয়া স্বতঃসিদ্ধ ও সর্বজনবিদিত, যেগুলো মুসলিম উম্মাহর মাঝে সকল যুগে সকল অঞ্চলে ব্যাপকভাবে অনুসৃত, যেমন আল্লাহর উপর ঈমান, তাওহীদে বিশ্বাস, আখিরাতের উপর ঈমান, কুরআনের উপর ঈমান, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং তাঁর হাদীস ও সুন্নাহর উপর ঈমান, মুহাম্মাদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর আখেরী নবী ও রাসূল হওয়ার উপর ঈমান; পাঁচ ওয়াক্ত ফরয নামায, জুমার নামায, যাকাত, রোযা, হজ্ব ও পর্দা ফরয হওয়া, শিরক, কুফর, নিফাক, কাফির-মুশরিকদের প্রতীক ও নিদর্শন বর্জনীয় হওয়া, সুদ, ঘুষ, মদ, শূকর, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মিথ্যাচার ইত্যাদি হারাম হওয়া এবং এ ধরনের অসংখ্য আকীদা ও বিধান, যা জরুরিয়াতে দ্বীনের মধ্যে শামিল তাতে আলিমদের মাঝে তো দূরের কথা, আম মুসলমানদের মাঝেও কোনো মতভেদ নেই। যারা দ্বীনের এই সকল স্বতঃসিদ্ধ বিষয়কেও বিশ্বাস ও কর্মে অনুসরণ করে না তারাও বলে; বরং অন্যদের চেয়ে বেশিই বলে যে, আলিমদের মাঝেই এত মতভেদ তো আমরা কী করব!

২. অসংখ্য আমল, আহকাম ও মাসাইল এমন আছে, যেগুলোতে আলিমদের মাঝে কোনো মতভেদ নেই। এগুলোকে ইজমায়ী আহকাম বা সর্বসম্মত বিধান হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু মানুষ এসব বিষয়েও নতুন মত ও পথ আবিষ্কার করে, এরপর আলিমদের অভিযুক্ত করে যে, তারা এখানে দ্বিমত করছেন!

৩. আল্লাহ তাআলা যাকে বিচার-বিবেচনার সামান্য শক্তিও দিয়েছেন তিনি যদি আল্লাহকে হাজির-নাজির জেনে সত্য অন্বেষণের নিয়তে জরুরিয়াতে দ্বীন (স্বতঃসিদ্ধ বিষয়াদি) এবং মুজমা আলাইহ (সর্বসম্মত বিষয়সমূহ) সামনে নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন যে, বাতিলের পক্ষাবলম্বনকারীরা আলিম (জ্ঞানী) নন; বরং হাদীসের ভাষায় عليم اللسان اللسان বাকপটু। এই শ্রেণীর লোকদের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকলে আহলে হক্ব আলিমদেরকে, যারা আসসুন্নাহআলজামাআর নীতি-আদর্শের উপর আছেন, চিনে নিতে দেরি হবে না। এরপর তাঁদের সাহচর্য অবলম্বন করলে তিনি তো নিন্দিত মতভেদ থেকে বেঁচেই গেলেন। আর বৈধ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে তিনি যদি তার দৃষ্টিতে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য আলিমদের নির্দেশনা অনুসরণ করেন তাহলে কোনো অসুবিধা নেই। ইনশাআল্লাহ আখিরাতে তিনি দায়মুক্ত থাকবেন।

৪. কুরআন-হাদীসের বাণী ও ভাষ্য থেকে প্রাপ্ত কিছু চিহ্ন ও আলামত আছে, যেগুলোর সাহায্যে ঈমানদারির সাথে চিন্তা-ভাবনা করে কেউ কোনো আলিমকে নির্বাচন করতে পারেন, যার সাহচর্য তিনি গ্রহণ করবেন এবং যার সাথে দ্বীনী বিষয়ে পরামর্শ করবেন।

সময় করে আলিমদের মজলিসে যান, তাঁদের কাছে বসুন এবং লক্ষ করুন, যেসব আমল সর্বসম্মত, যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে সুন্নত এমন বিষয়ের অনুসরণ আর যে বিষয়গুলো সর্বসম্মতভাবে নাজায়েয ও বিদআত তা বর্জনের বিষয়ে কে বেশি ইহতিমাম করেন, কার সাহচর্যের দ্বারা আখিরাতের ফিকির পয়দা হয়, ইবাদতের আগ্রহ বাড়ে, আল্লাহ তাআলার নাফরমানী সম্পর্কে অন্তরে ভয় ও ঘৃণা সৃষ্টি হয় এবং কার সঙ্গীদের অধিকাংশের অবস্থা এসব ক্ষেত্রে ভালো; কে পূর্ণ সতর্কতার সাথে গীবত থেকে বেঁচে থাকেন এবং প্রতিপক্ষের সাথেও ভালো ব্যবহারের আদেশ দেন; কার কথা থেকে বোঝা যায় কুরআন-হাদীসের ইলম তার বেশি, কার কথায় নূর ও নূরানিয়াত বেশি; তেমনি যে আলিমগণ সর্বসম্মতভাবে হক্বের উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁরা কাকে সমর্থন করেন। এ ধরনের নিদর্শনগুলোর আলোকে বিচার করার পর কেউ যদি সালাতুল হাজত পড়েন, আল্লাহর দরবারে দুআ করেন, ইসতিখারা করেন, এরপর নেক নিয়তের সাথে কোনো আলিমকে নির্বাচন করেন তাহলে ইনশাআল্লাহু তিনি দায়মুক্ত হবেন।

তবে এক্ষেত্রেও জরুরি মনে করা যাবে না যে, সবাইকে ঐ আলিমের কাছেই মাসআলা জিজ্ঞাসা করা উচিত এবং তাঁরই কাছে পরামর্শ নেওয়া উচিত। তদ্রূপ মতভেদপূর্ণ বিষয়াদিতে ঐসব লোকদের সাথে তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হওয়া যাবে না, যারা অন্য আলিমের ফতোয়া ও নির্দেশনা অনুযায়ী আমল করেন। অন্য কেউ যদি আল্লাহর রেযামন্দির জন্য চিন্তা-ভাবনা করে অন্য কোনো আলিমকে তার দ্বীনী রাহনুমা বানান তাহলে আপনার আপত্তি না থাকা উচিত, না তার সাথে আপনার তর্ক-বিতর্ক করা সমীচীন আর না আপনার সাথে তার।

যে আলিমদেরকে আপনি নির্বাচন করেননি তাদের সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করা কিংবা তাঁদের সম্পর্কে কটূক্তি করা কোনোটাই জায়েয নয় এবং বিনা দলীলে তাদের কাউকে বাতিল মনে করাও বৈধ নয়। আপাতত এ কয়েকটি কথাই নিবেদন করলাম। আল্লাহ তাআলা যদি তাওফীক দান করেন আগামীতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছা আছে।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

গত মজলিসে (সেমিনারে) ও পরে এমন কিছু প্রশ্ন এসেছে, যা সরাসরি প্রবন্ধের বিষয়বস্ত্তর সাথে সংশ্লিষ্ট। প্রবন্ধটির বর্তমান সংস্করণে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়ে দেওয়া মুনাসিব মনে হচ্ছে। অবশিষ্ট প্রশ্নগুলোর উত্তর আলকাউসারের প্রশ্নোত্তর বিভাগে লেখার চেষ্টা করা হবে ইনশাআল্লাহ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

 

 

advertisement