বরাহে করম! রাকাত-সংখ্যা নিয়ে বিবাদ ছাড়ুন, নিজ নিজ ত্রুটি সংশোধন করুন
রমযানুল মুবারক মুমিনের ঈমানী তারবিয়তের বিশেষ মাস। এ মাসেই একজন মুমিনকে সারা বছরের ঈমানী শক্তি ও তাকওয়ার পাথেয় সংগ্রহ করতে হয়। এজন্য এই মাসে একদিকে যেমন অতিরিক্ত ব্যস্ততা থেকে মুক্ত থাকা উচিত তেমনি সব ধরনের বিবাদ-বিসংবাদ থেকেও পুরাপুরি পবিত্র থাকা উচিত।
আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إذا كان صوم أحدكم فلا يَرْفُثْ، ولا يَصْخَبْ، فإن سابَّه أحد، أو قاتله، فليقل : إني امرؤ صائم.
তোমাদের কেউ রোযাদার হলে সে যেন কোনো মন্দ কথা না বলে এবং হট্টগোল না করে। আর কেউ তাকে কটূক্তি করলে বা তার সাথে ঝগড়া করতে চাইলে সে যেন বলে-আমি রোযাদার।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৫১
হট্টগোল ও ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকা রোযার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। রোযাহীন অবস্থায়ও তা নিষিদ্ধ, আর রোযা অবস্থায় আরো মারাত্মক। দুনিয়াবী বিষয়ে যেমন বিবাদ-বিসংবাদ নিষিদ্ধ তেমনি দ্বীনী বিষয়েও নিষিদ্ধ। দ্বীনী বিষয়ে উপদেশ-নসীহত, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজে নিষেধের বিধান রয়েছে, কিন্তু ঝগড়া-বিবাদের অনুমতি নেই। কেউ ভুল করলে, ভুল কথা বললে তাকে বোঝানো যেতে পারে, সত্য-সঠিক বিষয়টি উপস্থাপন করা যেতে পারে, কিন্তু তার মাথায় চড়ে বসা ইসলামের শিক্ষা নয়।
আজকাল বিষয়টি শুধু এই নয় যে, ভুল কথা বা ভুল কাজের প্রতিবাদ করা হয় না। প্রকাশ্য হারাম ও নিষিদ্ধ কর্মকান্ডের দ্বারা রমযানের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করা হলেও তার প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ আছে শুধু তারাবীহর নামায বিশ রাকাত পড়ার বিষয়ে। এর বিরুদ্ধে লিফলেট প্রচার করা হয়, চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া হয়। এগুলো প্রতি রমযানেই কিছু লোকের বিশেষ ব্যস্ততা হয়ে দাঁড়ায়। মনে হয় যেন, তাদের নিকট বিশ রাকাত তারাবীহ পড়া ফরয নামায ছেড়ে দেওয়া ও ফরয রোযা ত্যাগ করার চেয়েও বড় গুনাহ। কেননা, এসব ফরয ছেড়ে দেওয়ার কারণে তাদেরকে কখনো আফসোস করতে দেখা যায় না কিংবা এসবের সংশোধনের জন্য কোনো দাওয়াতী প্রচারপত্রও বিতরণ করতে দেখা যায় না।
এসব মানুষ যদি সঠিক ইলম অর্জন করত তাহলে বুঝত যে, বিশ রাকাত তারাবীহ খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত। মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের ঐকমত্য (ইজমা) ও খায়রুল কুরূন থেকে অদ্যাবধি উম্মতের অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এবং সর্বসম্মত পথ (সাবীলুল মুমিনীন)-এর মতো অকাট্য দলিল দ্বারা প্রমাণিত। এর বিপরীতে তারাবীহর নামাযকে আট রাকাতে সীমাবদ্ধ করার পক্ষে কোনো দলিল নেই। যদি জোর করে বিনা দলিলে তাহাজ্জুদ ও তারাবীহকে একই নামায দাবি করা হয় তবুও তা আট রাকাতে সীমাবদ্ধ হতে পারে না। কেননা তাহাজ্জুদের নামায আট রাকাতে সীমাবদ্ধ নয়। কওলী হাদীস অনুযায়ী দুই দুই রাকাত করে সুবহে সাদিক পর্যন্ত যত রাকাত ইচ্ছা পড়া যায়। আর ফে’লী হাদীস দ্বারাও আট রাকাতের বেশি প্রমাণিত। স্বয়ং আম্মাজান আয়েশা রা. থেকে (যার বর্ণনাকৃত বছরজুড়ে সালাতুল লায়লের আট রাকাত ও বিতরের ৩ রাকাত মোট এগার রাকাতের হাদীস দ্বারা এসব বন্ধু তারাবীহর দলিল পেশ করে থাকেন।) সহীহ সনদে দশ রাকাতের কথা প্রমাণিত। আর অন্য সাহাবী থেকে এর চেয়ে বেশিও প্রমাণিত।
এজন্য যারা তাহাজ্জুদের হাদীস দ্বারা তারাবীহর রাকাত-সংখ্যা প্রমাণের অপচেষ্টা করেন তাদের কোনো অধিকারই নেই বিশ রাকাত তারাবীহ আদায়কারীদের উপর আপত্তি করার। তাদের নিকট সাধারণ নফল নামাযেও জামাত জায়েয। আর তাহাজ্জুদে তা হল মুবাহ। সুতরাং তাদের কথা অনুযায়ী যদি ধরা হয়, বিশ রাকাত সুন্নতে মুয়াক্কাদা নয় তাহলে তো এই হবে যে, তা নফল। আর তাদের নিকট নফল নামায জামাতে আদায় করা জায়েয। এজন্য যারা বিশ রাকাত পড়ছে তারা তো তাদের নীতি অনুযায়ীও কোনো নাজায়েয কাজ করছে না। তাহলে কেন খামোখা বিশ রাকাত আদায়কারীদের বিভ্রান্ত করবেন? তাদের বিরুদ্ধে লিফলেট প্রচার করবেন? কটূক্তি করবেন? এবং তাদের প্রতি বিদআত ও সুন্নাহ বিরোধিতার অপবাদ দিবেন?!
আর যদি আপনি নিষ্ঠার সাথেই আট রাকাতের বেশি তারাবীহকে বিদআত মনে করেন তবে প্রশ্ন এই যে, আপনি কি নিজে হাদীস ও আছরসমূহের সনদ যাচাই করেছেন? উসূলে হাদীস, ইলমে আসমাউর রিজাল ও ইলমুল জারহি ওয়াত তাদীল সম্পর্কে কি আপনার বিশেষজ্ঞতা আছে? ইলমে উসূলুল ফিকহ বিষয়ে কি আপনি পান্ডিত্য অর্জন করেছেন? আপনার উত্তর যদি না বোধক হয় তবে নিঃসন্দেহে আপনার এই জ্ঞান অন্যের তাকলীদনির্ভর। আর এই তাকলীদনির্ভর ইলমের উপর ভিত্তি করে কীভাবে আপনি অন্যদের উপর আক্রমণ করছেন?
মনে রাখবেন, বিশ রাকাত আর আট রাকাতের মতভিন্নতা সুন্নাহর বিভিন্নতার মতভিন্নতা নয়; বরং তারাবীহকে আট রাকাতে সীমাবদ্ধ মনে করা এবং বিশ রাকাত পড়তে আপত্তি করা সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা ও ইজমা পরিপন্থী।
এরপরও আমি আরজ করব, যদি আপনি আমানতদারির সাথেই বিশ রাকাত তারাবীহ পড়াকে ভুল মনে করেন তাহলে আপনি নিজ ধারণা অনুযায়ী সঠিক আমল করছেন-এতটুকুই কি যথেষ্ট নয়? অন্যের সাথে ঝগড়ায় লিপ্ত হওয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন কি আছে?
আপনি এই হাদীসের উপর একটু আমল করুন-
من ترك الكذب وهو باطل بُنِي له في رَبَض الجنة، ومن ترك المراء وهو محق بني له في وسطها، ومن حَسَّن خُلُقَه بُنِي له في أعلاها.
যে ব্যক্তি ভ্রান্ত অবস্থানে থেকেও মিথ্যা ত্যাগ করে তার জন্য জান্নাতের কোণে গৃহ নির্মাণ করা হয়। আর যে সঠিক অবস্থানে থেকে ঝগড়া পরিহার করে তার জন্য মধ্য জান্নাতে গৃহ নির্মাণ করা হয়। আর যে নিজের ব্যবহারকে সুন্দর করে তার জন্য উচ্চ জান্নাতে গৃহ নির্মাণ করা হয়।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২১১১
শায়খ নাসির উদ্দীন আলবানী রাহ. এই বিচ্ছিন্ন মতের (তারাবীহর নামায আট রাকাতে সীমাবদ্ধ হওয়া এবং বিশ রাকাত তারাবীহ বিদআত হওয়ার) সমর্থনে একটি কিতাব রচনা করেছেন। এর বিপরীতে খোদ আরবের আলিমগণই কলম ধরেছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় বিষয় এই যে, শায়খ আলবানী রাহ. তার কিতাবের কয়েক জায়গায় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন যে, আমি নিজ ইজতিহাদ অনুযায়ী আট রাকাতের বেশি তারাবীহ পড়া জায়েয না হওয়াকেই সঠিক মনে করি। আমি তা বলেছিও। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, যেসব আহলে ইলম নিজেদের ইজতিহাদ অনুযায়ী কিংবা আকাবির আহলে ইলমের তাকলীদ করে বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েন তাদের সম্পর্কে আমি এ কথা বলছি যে, তারা বিদআতে লিপ্ত (নাউযুবিল্লাহ)। আমি তাদেরকে বিদআতের অপবাদ দিচ্ছি না, তাদেরকে গোমরাহও বলছি না (নাউযুবিল্লাহ)। তারা বরং নিজেদের ইজতিহাদ অনুযায়ী সওয়াবের অধিকারী হবেন।
আমার এসব ভাইয়েরা যদি শায়খ আলবানী রাহ.-এর এ কথা অনুযায়ী আমল করেন তবুও তো তাদের ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হওয়ার প্রয়োজন নেই।
এসব বিবাদের পরিবর্তে এ বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত যে, তারা দীর্ঘ কিরাতে আট রাকাত তারাবীহ পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলবেন এবং তারাবীহতে কুরআন মজীদ খতম করার চেষ্টা করবেন। তারাবীহতে কুরআন মজীদ খতম করার সুন্নত দলিলহীন নয়, এর দলিল আছে। খোদ ইমাম বুখারী রাহ.ও তারাবীহর প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত করে তিলাওয়াত করতেন এবং কুরআন মজীদ খতম করতেন।-তারীখে বাগদাদ ২/১২; মুকাদ্দামায়ে ফাতহুল বারী
মারফূ হাদীসে তাহাজ্জুদ ও কিয়ামে রমযান (তারাবীহ) উভয় নামাযে দীর্ঘ কিরাতের প্রতি উৎসাহ ও আমল বিদ্যমান রয়েছে। এ সুন্নত পুনরুজ্জীবিত করা উচিত।
পাশাপাশি ঐ সহীহ হাদীসটিও তাদের স্মরণে রাখা উচিত, যা কিয়ামে রমযান (তারাবীহ) সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে, যে হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إنه من قام مع الإمام حتى ينصرف كُتِبَ له قيامُ ليلة.
ইমামের নামায শেষ হওয়া পর্যন্ত যে ব্যক্তি ইমামের সাথে নামায আদায় করবে সে সারা রাত (নামাযে) দাঁড়িয়ে থাকার সওয়াব পাবে।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২১৪৪৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৩৭০; জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৮১৭; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ১৩৬৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ২৫৪৭
এ হাদীস অনুযায়ী এসব ভাইদের উচিত ৮ রাকাতের তারবীহার সময় তারা যেন ইমাম-মুসল্লিদেরকে রেখে মসজিদ থেকে বের না হন এবং নামাযের শেষ পর্যন্ত ইমামের সাথে নামায আদায় করতে থাকেন। তাহলে ইনশাআল্লাহ তারা সারা রাত ইবাদতের সওয়াব পাবেন।
আর যেসব ভাই বিশ রাকাত তারাবীহ পড়েন তাদের প্রতি রইল ৩টি অনুরোধ।
এক. আমরা আল্লাহ তাআলার শোকর আদায় করি। কারণ তিনি নিজ অনুগ্রহে আমাদেরকে সঠিক মাসআলা অনুধাবন করার তাওফীক দিয়েছেন। আর শোকর আদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, নেয়ামতের সঠিক ও যথার্থ ব্যবহার। এর অপব্যবহার কিংবা এ দ্বারা ভুল উদ্দেশ্য সাধন না করা। তাই আমাদের জন্য পূর্ণ খুশু-খুযুর সাথে নামায আদায় করা জরুরি। রুকু-কওমা (রুকু থেকে সোজা হয়ে দাঁড়ানো), সিজদা, বৈঠক সকল রুকন ধীরস্থিরতার সাথে আদায় করি। অন্যথায় আমাদের নামায মুরগির ঠোকরে পরিণত হবে, যা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আর নিকৃষ্ট চুরি হল, নামায এত দ্রুত আদায় করা যে, রুকু-সিজদা, কওমা-জলসা ইত্যাদি রুকন ধীরস্থিরভাবে আদায় হয় না।
দুই. তারতীলের সাথে কুরআন মজীদ তিলাওয়াত করা। কমপক্ষে হরফের মাখরাজ ও অপরিহার্য সিফতগুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখি এবং জরুরি ওয়াকফগুলো পালন করি। কোনো শব্দ বা হরফ উচ্চারিত হল না কিংবা পার্শ্বের মুসল্লি শুনতে পেল না-এভাবে অতি দ্রুত তিলাওয়াত কখনো জায়েয নয়।
তারাবীহতে কুরআন মজীদ খতম করা সুন্নত। তবে এই সুন্নত তারাই আদায় করবেন, যারা তারতীলের সাথে তিলাওয়াত করেন, তিলাওয়াতের আদবসমূহ লক্ষ্য রাখেন। অন্যথায় ছোট সূরা দিয়ে ধীর-স্থিরভাবে তারাবীহ পড়াই উত্তম হবে।
প্রকৃত তাজবীদ হল
تحقيق تحقيق الحروف وتصحيح الوقوف.
হরফগুলোর সঠিক উচ্চারণ ও ওয়াকফগুলোর সঠিক অনুসরণ।
বাস্তবিকপক্ষে তাজবীদের বিধানসমূহ প্রয়োগের প্রকৃত ক্ষেত্র হচ্ছে কুরআনুল কারীম, বিশেষ করে যখন তা আল্লাহ তাআলার সামনে নামাযে তিলাওয়াত করা হয়।
তিন. রাতের শেষ ভাগ অধিক উত্তম ও বরকতপূর্ণ। এজন্য শেষরাতে তাহাজ্জুদ ও দুআর প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেই। এ মাসে সাহরীর জন্য উঠার বরকতে তাহাজ্জুদ আদায় করতে করতে যেন তা অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়।
সবশেষে সবশ্রেণীর ভাইদের জন্য একটি অনুরোধ। তা এই যে, রোযার প্রাণ হল গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। বিশেষ করে মুখ, কান ও চোখের গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা। এজন্য আমরা সবাই এদিকে লক্ষ্য রাখি। গীবত থেকে বাঁচি, ঝগড়া-বিবাদ থেকে বিরত থাকি। ইলমী ও দ্বীনী মুযাকারা যদি নিষ্ঠার সাথে হয় তবুও এর জন্য বছরের অন্য সময় আছে। সব কাজ রমযান মাসেই করতে হবে-তা তো জরুরি নয়? খালেস ইবাদতের মৌসুমের সময়গুলো যতটা শুধু আল্লাহর সাথে কাটানো যায় ততই ভালো।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন।