وحدة الأمة واتباع السنة উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা মতভিন্নতার মাঝেও সম্প্রীতি রক্ষা, সুন্নাহসম্মত পন্থায় সুন্নাহর প্রতি আহবান
গত ২৩ রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরী, মোতাবেক ১৭ মার্চ ২০১২ ঈ. শনিবার কাকরাইল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার উদ্যোগে ‘উম্মাহর ঐক্য : পথ ও পন্থা’ শিরোনামে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সেমিনারে আলকাউসারের তত্ত্বাবধায়কের পক্ষ থেকে যে প্রবন্ধটি উপস্থাপিত হয়েছিল তা হুবহু বা তার সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশের জন্য অনেক বন্ধু/পাঠক জোর আবেদন জানিয়েছেন। সেমিনারে উপস্থিত বন্ধুরা প্রবন্ধটি পুস্তক আকারে পেলেও আলকাউসারের অধিকাংশ পাঠকের কাছে তা পৌঁছেনি। এজন্য সামান্য পরিবর্তন-পরিমার্জনের পর প্রবন্ধটির সারসংক্ষেপ আলকাউসারে প্রকাশ করা হচ্ছে। এটি প্রবন্ধের চতুর্থ কিস্তি। যাদের কাছে মূল প্রবন্ধটি রয়েছে তাদের জন্যও তা উপকারী হবে বলে আশা রাখি।
বর্তমান সংখ্যা ও আগামী সংখ্যায় প্রকাশিত আলোচনা মূলত উক্ত প্রবন্ধের পরিবর্ধিত ও সম্পাদিত দ্বিতীয় সংস্করণ, যা গত ৪ রজব, ’৩৩ হি., মোতাবেক ২৬ মে ’১২ ঈ. একই স্থানে অনুষ্ঠিত সেমিনারের (দ্বিতীয় পর্ব) উপলক্ষে প্রস্ত্তত করা হয়েছিল। আল্লাহ তাআলা এটিকে উপকারী করুন। আমীন।-সম্পাদক
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ফুরূয়ী ইখতিলাফের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি ও বাড়াবাড়ির কারণ
সব যামানার আলিমগণ ফুরূয়ী বা শাখাগত মাসাইলের মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে যে ভারসাম্যপূর্ণ কর্মপন্থা নির্দেশ করেছেন বর্তমান মুসলিমসমাজে, বিশেষত এ উপমহাদেশে তা মর্মান্তিকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। সম্প্রীতি, উদারতা ও নম্রতার পরিবর্তে এ ধরনের মতভেদের ক্ষেত্রগুলোতে বাড়াবাড়ি ও কড়াকড়ি করা হচ্ছে। এর কারণ কী? এ বিষয়েও আলিমগণ লিখেছেন। বর্তমান প্রবন্ধে এ বিষয়েও কিছু আলোকপাত করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।
বাড়াবাড়ির কারণ অনেক। আমি এখানে কয়েকটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করব ইনশাআল্লাহ।
১. একমুখী অধ্যয়ন ও অসম্পূর্ণ অধ্যয়ন
ইখতিলাফী বিষয়ে যিনি মত প্রকাশ করতে চান, নিজের পথ ও পন্থার দিকে আহবান করতেই চান এবং অন্যের পথ ও পন্থার উপর আপত্তি করতেই চান, তার প্রথম কর্তব্য, বিষয়টি গভীরভাবে অধ্যয়ন করা । এ বিষয়ে পক্ষে বিপক্ষে যা কিছু লেখা হয়েছে তা গভীর মনযোগ ও পূর্ণ ন্যায়নিষ্ঠার সাথে অধ্যয়ন করা। কিন্তু দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে আমরা চরম উদাসীন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের অধ্যয়ন একমুখী। সেও অসম্পূর্ণ ও পরনির্ভর অধ্যয়ন। অথচ এ অধ্যয়নের ভিত্তিতে আমরা মত প্রকাশ করি সম্পূর্ণ মুহাক্কিক; বরং মুজতাহিদসুলভ ভঙ্গিতে!
কিছু উদাহরণ
১. অতি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে দেওয়া হয় যে, ‘বিতরের নামায তিন রাকাত পড়া ভিত্তিহীন। কিংবা তা কেবল জয়ীফ হাদীসে আছে!’
অথচ একাধিক সহীহ হাদীস, অনেকগুলো আছারে সাহাবা এবং মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের কর্মগত ইজমার দ্বারা তিন রাকাত বিতরের পদ্ধতি প্রমাণিত।
আরো বলা হয় যে, ‘তিন রাকাত যদি পড়তে হয় তাহলে দ্বিতীয় রাকাতে বসবে না। তিন রাকাত এক জলসায় পড়বে!’
যারা এ ধরনের কথা বলেন তারা যদি বিতরের প্রসঙ্গটি ‘শরহু মাআনিল আছার’ ও ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ থেকেও অধ্যয়ন করতেন এবং নসবুর রায়ার হাশিয়া ‘বুগয়াতুল আলমায়ী’ ও ‘কাশফুস সিত্র আন মাসআলাতিল বিত্র’ (মাওলানা মুহাম্মাদ আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি) পাঠ করতেন, অন্তত মাওলানা ইউসুফ লুধিয়ানবী রাহ.-এর কিতাব ‘‘ইখতিলাফে উম্মত আওর সিরাতে মুসতাকীম’’ থেকেই পাঠ করতেন তাহলেও তাদের এ ধরনের কথা বলতে দ্বিধা হত।
যেখানে সহীহ মুসলিমসহ অনেক হাদীসের কিতাবে সহীহ হাদীসে এই সাধারণ মূলনীতি বলা হয়েছে যে, ‘নামাযের প্রতি দুই রাকাতে আত্তাহিয়্যাতুর বৈঠক আছে’ সেখানে দলীল ছাড়া এই ফতোয়া দেওয়ার দুঃসাহস কীভাবে হয়, উপরন্তু হাদীস অনুসরণের নামে?!
‘বিতরের নামাযকে মাগরিবের মত বানিও না’-এই হাদীসের পূর্বাপর না দেখেই কেউ ব্যাখ্যা করেছে, ‘বিতরের নামাযে প্রথম বৈঠক করবে না, করলে সালাম ফেরাও।’ এরপর এ ব্যাখ্যারই তাকলীদ করা হচ্ছে। অথচ এ হাদীসের ব্যাখ্যাও হাদীসের মধ্যেই আছে। তা হচ্ছে বিতরের আগে দু’ চার রাকাত নফল নামায অবশ্যই পড়বে। মাগরিবের মত শুধু তিন রাকাত পড়বে না। দেখুন : শরহু মাআনিল আছার ও হাশিয়া নাসবুর রায়া।
দুই জলসা ও এক সালামে তিন রাকাত বিতর সম্পর্কে হাদীস ও আছারের দলিল জানার জন্য মাসিক আলকাউসারের জুমাদাল উলা ’৩১ হি. (মে ’১০ ঈ.) সংখ্যা থেকে যিলকদ-যিলহজ্ব ’৩১ হি. (নভেম্বর ’১০ ঈ.) পর্যন্ত সংখ্যাগুলো দেখা যায়।
২. বলা হয়ে থাকে, ‘কুনূতের বিভিন্ন দুআ আছে তবে اللهم إنا نستعينك الخ দুআটি নেই।’
অথচ তা মুসান্নাফে আব্দুর রাযযাক (খন্ড : ৩, পৃষ্ঠা : ১০৫-১২০); মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা (খন্ড : ৪, পৃষ্ঠা : ৫১৮, খন্ড : ১৫, পৃষ্ঠা : ৩৪০-৩৪৪); কিয়ামুল লায়ল, মুহাম্মাদ ইবনে নাসর আলমারওয়াযী (পৃষ্ঠা : ২৯৬-৩০২) এবং আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকীসহ (খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ২১০) একাধিক হাদীসের কিতাবে আছে। আদ্দুররুল মানসুরের পরিশিষ্টেও কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া আছে।
৩. বলা হয়ে থাকে, ‘দুআ কুনূতের আগে তাকবীরের দলীল হাদীসের কিতাবে নেই।’
অথচ ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ তাহাবীতে (খন্ড : ১১, পৃষ্ঠা : ৩৬৫-৩৭৮) দুইজন বড় সাহাবীর আমল বর্ণিত হয়েছে।
৪. বলা হয়ে থাকে, ‘মেয়েদের নামাযের পদ্ধতিও পুরুষের মতোই। উভয়ের নামাযের পদ্ধতি আলাদা হওয়ার কথা ভিত্তিহীন। এটা শুধু হানাফিদের মাযহাব।’
অথচ বাস্তবতা এই যে, নারী-পুরুষের নামায আদায়ের পদ্ধতি অভিন্ন হওয়ার বিষয়ে আমাদের জানামতে কোনো দ্ব্যর্থহীন সহীহ হাদীস বা আছার নেই। অথচ কিছু সাহাবী ও অনেক তাবেঈ থেকে বিভিন্ন বিষয়ে উভয়ের নামাযের পদ্ধতি আলাদা হওয়া প্রমাণিত। একটি মারফূ মুরসাল হাদীসও আছে, যাকে একাধিক আহলে হাদীস আলিম শাওয়াহিদ ও সমর্থক বর্ণনার কারণে নির্ভরযোগ্য বলেছেন। এ প্রসঙ্গে নবাব সিদ্দিক হাসান খানের ‘‘আউনুল বারী’’ও দেখা যেতে পারে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫২০, দারুর রশীদ হলব, সুরিয়া; খন্ড : ২, পৃষ্ঠা : ১৮৪-১৮৫, দারুন নাওয়াদির, বৈরুত, হাদীস : ২৫২)
এরপর তা শুধু হানাফী মাযহাবের সিদ্ধান্ত নয়, চার মাযহাবের ফকীহগণ এ বিষয়ে একমত। আহলে হাদীস আলেমদেরও অনেকে এই ফতোয়া দিয়েছেন। কেউ কেউ এ বিষয়ে আলাদা পুস্তিকাও লিখেছেন।
যেমন দেখুন, মাওলানা আবদুল হক হাশেমী মুহাজিরে মক্কী-এর পুস্তিকা-
نصب العمود في تحقيق مسألة تجافي المرأة في الركوع والسجود والقعود
এ বিষয়ে মাসিক আলকাউসারের রবিউস সানী ’২৬ হিজরী (জুন ’০৫ ঈ.) সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটি নবীজীর নামায (মাকতাবাতুল আশরাফ বাংলাবাজার ঢাকা থেকে প্রকাশিত)-এর পরিশিষ্টেও যুক্ত হয়েছে।
আমি শুধু ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্য উল্লেখ করছি। তিনি বলেছেন-
وقد أدب الله تعالى النساء بالاستتار وأدبهن بذلك رسوله صلى الله عليه وسلم، وأحب للمرأة أن تضم بعضا إلى بعض، وتلصق بطنها بفخذيها وتسجد كأسترما يكون لها، وهكذا أحب لها في الركوع والجلوس وجميع الصلاة أن تكون فيها كأستر ما يكون لها.
আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে পুরোপুরি আবৃত থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর রাসূলও (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুরূপ শিক্ষা দিয়েছেন। তাই আমার নিকট পছন্দনীয় হল, সিজদা অবস্থায় মহিলারা এক অঙ্গের সাথে অপর অঙ্গকে মিলিয়ে রাখবে, পেট উরুর সাথে মিলিয়ে রাখবে এবং সিজদা এমনভাবে করবে যাতে সতরের পূর্ণ হেফাযত হয়। অনুরূপ রুকু, বৈঠক ও গোটা নামাযে এমনভাবে থাকবে যাতে সতরের পুরাপুরি হেফাযত হয়।-কিতাবুল উম্ম, শাফেয়ী ১/১৩৮
ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর বক্তব্যটি যেন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা.-এর বাণীরই ব্যাখ্যা। নারীর নামায সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন- تجتمع وتحتفز খুব জড়সড় হয়ে অঙ্গের সাথে অঙ্গ মিলিয়ে নামায আদায় করবে।-মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ২৭৯৪
৫. বলা হয়ে থাকে, ‘বুকের উপর হাত বাঁধার কথাই সহীহ হাদীসে আছে আর তা বুখারীর হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত।’
অথচ সহীহ বুখারীর কোনো হাদীস দ্বারা তা প্রমাণ হয় না। ইবনে খুযায়মার যে হাদীসে বুকের উপর হাত বাঁধার কথা আছে তাতে মুআম্মাল ইবনে ইসমাইল নামক একজন রাবী আছেন, যাকে স্বয়ং ইমাম বুখারী রহ. ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন।
পাঠকবৃন্দকে মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহর দুটি প্রবন্ধ পাঠ করার আবেদন করব, যা তিনি এ বিষয়েই লিখেছেন। দুটো প্রবন্ধই মাসিক আলকাউসার যিলহজ্ব ’৩২ হি. (নভেম্বর ’১১ হি.) ও মুহাররম ’৩৩ হি. (ডিসেম্বর ’১১ ঈ.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।
৬. বলা হয়ে থাকে, ‘জোরে আমীন বলার হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে।’
অথচ সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী শিরোনাম দিয়েছেন জাহর বা জোরে আমীনের, কিন্তু তাতে এমন একটি হাদীসও নেই, যাতে জাহরের কথা আছে।
ওখানে যে হাদীসগুলো আছে তাতে আমীন বলার ফযীলত উল্লেখিত হয়েছে এবং এ কথা আছে যে, ইমাম-মুকতাদী উভয়েরই আমীন বলা উচিত। কিন্তু জোরে বলার কথা নেই।
৭. বলা হয়ে থাকে, ‘ইমামের পেছনে মুক্তাদির ফাতিহা পড়া ফরয-এই হাদীস সহীহ বুখারীতে আছে।’
অথচ সহীহ বুখারীতে ইমাম বুখারী এ ধরনের শিরোনাম যদিওবা লিখেছেন, কিন্তু তাতে এমন কোনো হাদীস নেই, যাতে মুক্তাদিকে ফাতিহা পড়ার আদেশ করা হয়েছে।
হাঁ, لا صلاة إلا بفاتحة الكتاب (ফাতিহা ছাড়া কোনো নামায নেই) হাদীসটি আছে, কিন্তু এতে তো মুক্তাদির কথা নেই। এই হাদীসের ব্যাপকতায় মুক্তাদি শামিল কি না-তা একটি ইজতিহাদী বিষয়। ইমাম বুখারী ও কোনো কোনো ইমামের ইজতিহাদ অনুসারে মুক্তাদিও শামিল। আবার অন্য অনেক ইমামের মতে অনেক দলিলের ভিত্তিতে মুক্তাদির বিধান আলাদা।
৮. বলা হয়ে থাকে যে, ‘তারাবী আট রাকাত হওয়ার দলীল সহীহ বুখারীতে আছে।’
অথচ সহীহ বুখারীতে আছে ‘সালাতুল লায়ল’ সংক্রান্ত হাদীস। এর ব্যাখ্যা তারাবীর দ্বারা করা ঐসকল বন্ধুর নিজস্ব ইজতিহাদ। তাদের যুক্তি, তারাবী ও তাহাজ্জুদ একই নামাযের দুই নাম। এগারো মাসের তাহাজ্জুদ রমযান মাসে তারাবী হয়ে যায়। এই দাবির পক্ষে তাদের কাছে কোনো আয়াত, হাদীস বা আছারে সাহাবা নেই। এটা তাদের একান্ত নিজস্ব ইজতিহাদ, যা ইমাম বুখারীর ইজতিহাদ থেকেও আলাদা।
ইমাম বুখারী রাহ. প্রথম রাতে তারাবী পড়তেন এবং শেষ রাতে তাহাজ্জুদ। তারাবীর প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত পড়তেন এবং পুরা কুরআন খতম করতেন। এবার হিসাব করে দেখুন তারাবী যদি আট রাকাত করে পড়া হয় তাহলে প্রতি রাকাতে বিশ আয়াত করে পড়ে পুরা রমযানে, তা ত্রিশ দিনের হলেও, খতম করা সম্ভব কি না।
৯. যে বিনা ওজরে সময়মত ফরয নামায পড়েনি তার উপর কাযা জরুরি হওয়া স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত। এ বিষয়ে জুমহুর উম্মতের ইজমাও রয়েছে। কিন্তু অনেক বন্ধুকে অতি জোড়ালোভাবে বলতে দেখা যায়, ‘ঐ ব্যক্তির কাযা আদায়ের বিধান নেই।’
আমি মনে করি, এটা হাদীস অনুসরণের নামে শায ও বিচ্ছিন্ন মত এবং দলিলবিহীন; বরং দলিলবিরোধী মতামত প্রচার করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাদের খেদমতে আরজ, তারা যেন এই মাসআলাটি অন্তত ইমাম ইবনে আব্দিল বার (৪৬৩ হি.)-এর আলইসতিযকার কিতাবে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৩০০-৩০১, باب النوم عن الصلاة) পাঠ করেন। আর আদবের সাথে আরজ করব যে, এ বিষয়ে কি শুধু এ হাদীসটি যথেষ্ট নয়-
اقضوا الله، فالله أحق بالوفاء
আল্লাহকে (তাঁর পাওনা) পরিশোধ কর। কারণ আল্লাহই সর্বাধিক হকদার (তাঁর) পাওনা পরিশোধের।
এবং فدين الله أحق أن يقضى
তাহলে আল্লাহর ঋণ তো পরিশোধের অধিক হকদার।
মাসিক আলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় (মুহাররম ১৪২৬ হি., ফেব্রুয়ারি ’০৫ ঈ.) এ বিষয়ে মাশাআল্লাহ একটি সারগর্ভ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
১০. কেউ তো চরম দুঃসাহস প্রদর্শন করে বলেছেন, ‘বিনা অযুতে কুরআন স্পর্শ করা সম্পূর্ণ জায়েয।’ তাদের দাবি, এটা নিষিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। অথচ
لا يمس القرآن إلا على طهر
(পবিত্র হওয়া ছাড়া কুরআন স্পর্শ করবে না)-এই হাদীস শুধু সহীহই নয়, অর্থের দিক থেকে মুতাওয়াতির। আর এ বিষয়ে জুমহুর উম্মতের ইজমা আছে। ইমাম ইবনে আবদুল বার রাহ. এ বিষয়েও সংক্ষেপে অতি সারগর্ভ আলোচনা করেছেন। আলইসতিযকারে (খন্ড ৮, পৃষ্ঠা : ৯-১৩, باب الأمر بالوضوء لمن مس القرآن) তাঁর আলোচনাটি দেখে নেওয়া যায়।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমর ইবনে হাযম রা.কে যে পত্র দিয়েছিলেন তাতে অন্য অনেক বিধানের সাথে এই বিধানও ছিল যে, অযুহীন কেউ কুরআন স্পর্শ করবে না। পত্রের এ অংশ মুয়াত্তা মালিকেও রয়েছে। ইবনে আবদিল বার রাহ. এই পত্রখানা সম্পর্কে লেখেন-
وكتاب عمرو بن حزم هذا قد تلقاه العلماء بالقبول والعمل، وهو عندهم أشهر وأظهر من الإسناد الواحد المتصل، وأجمع فقهاء الأمصار الذين تدور عليهم الفتوى وعلى أصحابهم بأن المصحف لا يمسه إلا الطاهر.
অর্থাৎ আলিমগণ আমর ইবনে হাযমের এই পত্র সাদরে বরণ করেছেন এবং এ অনুযায়ী আমল করেছেন। এটি তাঁদের কাছে একটি মুত্তাসিল সনদের চেয়ে বেশি প্রসিদ্ধ ও প্রকাশিত। ইসলামী জনপদসমূহের ফতোয়ার স্তম্ভ যেসব ফকীহ (মুজতাহিদ) ও তাঁদের শীষ্যগণ তাঁরা একমত যে, পবিত্র ব্যক্তি ছাড়া কেউ কুরআনকে স্পর্শ করবে না।-আলইসতিযকার ৮/১০
মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ এ বিষয়েও মাশাআল্লাহ অতি উত্তম ও প্রামাণিক প্রবন্ধ লিখেছে, যা আলকাউসারের সফর ’২৭ হি. (মার্চ ২০০৬ ঈ.) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকবৃন্দের কাছে অনুরোধ, তাঁরা যেন এই প্রবন্ধগুলো অবশ্যই পাঠ করেন।
১১. কেউ কেউ রুকুর সময় এবং রুকু থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইনের সুন্নতের উপর এত জোর দিয়েছেন যে, এই সুন্নতের সমর্থনে রাফয়ে ইয়াদাইন না করার (এইসব জায়গায় হাত না তোলার) সুন্নত বাতিল করাকে জরুরি মনে করেছেন। তারা নির্দ্বিধায় বলে দিয়েছেন যে, রাফয়ে ইয়াদাইন না করার বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই; কোনো সাহাবী থেকেও এর কোনো প্রমাণ নেই। অথচ খলীফায়ে রাশেদ ওমর ইবনুল খাত্তাব রা., খলীফায়ে রাশেদ আলী ইবনে আবী তালিব রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.সহ কয়েকজন সাহাবী থেকে হাত না তোলার সুন্নত প্রমাণিত। অনেক তাবেয়ীর আমলও এটি ছিল।
জনৈক ব্যক্তি ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর সামনে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর হাদীস পেশ করেছিল যে, তিনি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন। তখন ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেছিলেন, যদি ওয়াইল রা. (যিনি ছিলেন একজন আগন্তুক সাহাবী) একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেন তাহলে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. (যিনি ছিলেন সফরে-হযরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খাদিম এবং ফকীহ সাহাবী) পঞ্চাশ বার রফয়ে ইয়াদাইন না করতে দেখেছেন।
(দেখুন : আলমুয়াত্তা, মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান, পৃষ্ঠা : ৯২; কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনা ইমাম মুহাম্মাদ ১/৭৫; শরহু মাআনিল আছার তহাবী ১/১৬১; নসবুর রায়াহ লি আহাদীসিল হিদায়া, জামালুদ্দীন যায়লায়ী ১/৩৯৭)
খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত এবং আছারে সাহাবা শরীয়তের উল্লেখযোগ্য দলিল, বিশেষত নামাযের পদ্ধতির ক্ষেত্রে। উপরন্তু এ বিষয়ে সহীহ বা হাসান সনদে একাধিক মারফূ হাদীস রয়েছে।
মুসনাদে আহমদ ও জামে তিরমিযীতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর সূত্রে যে মারফূ হাদীসটি আছে তাকে খোদ ইমাম তিরমিযী রাহ. ‘হাসান’ বলেছেন। ইবনে হাযম জাহেরী রাহ. ‘সহীহ’ বলেছেন। নিকট অতীতের মশহূর মুহাদ্দিস আহমদ শাকির রাহ. জামে তিরমিযীর হাশিয়ায় লিখেছেন-
هذا الحديث صححه ابن حزم وغيره من الحفاظ وهو حديث صحيح، وما قالوا في تعليله ليس بلعة.
ইবনে হাযম এবং আরো কোনো কোনো হাফিযুল হাদীস এই হাদীসকে ‘সহীহ’ বলেছেন। আর একে ‘মা’লূল’ সাব্যস্ত করার জন্য আপত্তিকারীরা যা কিছু বলেছেন বাস্তবে সেগুলো ইল্লত নয়।-জামে তিরমিযী ২/৪১
১২. ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার নামাযে তাকবীর বিষয়ে এক মাসনূন তরীকা এই যে, অতিরিক্ত তাকবীর বারোটি । দ্বিতীয় মাসনূন তরীকা (যা আমাদের মতে অধিক শক্তিশালী), অতিরিক্ত তাকবীর ছয়টি। প্রথম রাকাতে তাকবীরে তাহরীমার পর তিন তাকবীর, অর্থাৎ তাকবীরে তাহরীমাসহ চার তাকবীর। আর দ্বিতীয় রাকাতে কিরাআতের পর তিন তাকবীর, এরপর রুকুর তাকবীর, অর্থাৎ রুকুর তাকবীরসহ চার তাকবীর।
কোনো কোনো বন্ধুকে বলতে শোনা যায়, হাদীসে শুধু বারো তাকবীরের আমল পাওয়া যায়। দ্বিতীয় তরীকা কোনো সহীহ হাদীসে পাওয়া যায় না। কেউ কেউ তো এমনও লিখেছেন যে, ঐ বিষয়ে কোনো হাদীসই নেই।
বুঝতে পারছি না, এ জাতীয় অবাস্তব দাবি সম্পর্কে কী বলা যায়। পাঠকবৃন্দকে শুধু এই অনুরোধ করব, তাঁরা যেন দ্বিতীয় মাসনূন তরীকার দলিল, হাদীস ও আছার জানার জন্য মাসিক আলকাউসার রমযান-শাওয়াল ’২৬ হি. সংখ্যায় (২০০৫-এর ভলিউমে) প্রকাশিত ঈদের নামাযের অতিরিক্ত তাকবীর বিষয়ক প্রবন্ধটি মনোযোগের সাথে পাঠ করেন। প্রবন্ধটি মাকতাবাতুল আশরাফ, বাংলাবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘নবীজীর নামাযে’র পরিশিষ্টেও যুক্ত আছে।
এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। নমুনা হিসাবে এগুলোই যথেষ্ট। এখানে দেখানো উদ্দেশ্য যে, অনেক বন্ধু এ সকল বিষয় এমনভাবে পেশ করে থাকেন যে, ফিকহে হানাফীর অনুসারীদের কাছে এসব বিষয়ে কোনো দলীল নেই। পক্ষান্তরে তাদের কাছে আছে প্রচুর সহীহ হাদীস!
তাছাড়া উপরে উল্লেখিত ৯, ১০ ও ৪ নম্বর মাসআলাটি তো শুধু ফিকহে হানাফীর নয়, জুমহূরে উম্মতের ইজমায়ী মাসআলা। অন্যান্য মাসআলাতেও হানাফী ফকীহগণের সাথে অন্য অনেক ফকীহ একমত। আর প্রত্যেক মাসআলায় ফকীহ সাহাবী ও তাবেয়ীগণের হাওয়ালা তো এখনই উল্লেখ করা হয়েছে। এ কারণেই আমি নিবেদন করে থাকি যে, আমার এই বন্ধুরা যদি তাদের অধ্যয়নের পরিধি বিস্তৃত ও গভীর করতেন তাহলে এই বাড়াবাড়ি তাদের মধ্যে থাকত না।
অন্তত এটুকু চিন্তা তো অবশ্যই হতো যে, ওদের কাছেও দলীল আছে; আর আমাদের দলীলগুলোর প্রধান্য ও অগ্রগণ্যতাও এত সুস্পষ্ট নয় যে, একদম মুতাওয়াতির ও অকাট্য বিষয়ের মত এতে ভিন্নমতের কোনো অবকাশই নেই।
২. আংশিক ও অস্বচ্ছ ধারণার উপর পূর্ণ প্রত্যয়
অনেক সময় এমন হয় যে, কোনো কোনো বন্ধুর উসূলে হাদীস ও উসূলে ফিকহের কিছু নীতি ও ধারা সম্পর্কে খুব অগভীর ধরনের জানাশোনা থাকে। নীতিটির স্বরূপ ও তাৎপর্য এবং ভাষ্য ও বিস্তারিত অনুষঙ্গের জ্ঞান থাকে না। উসূলের উপর মুতাকাদ্দিমীনের কিতাবসমূহ গভীর মনোযোগের সাথে পাঠ করার বিষয়ে সচেতনতা থাকে না। শুধু অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ ধারণার উপর ভিত্তি করে বিপরীত পথ ও পন্থা সম্পর্কে কটুক্তি ও সমালোচনার বিরাট সৌধ নির্মাণ করে ফেলা হয়। এরপর ইলমী আলোচনাতেও তাদের মুখে আম লোকের ভাষা ও যুক্তি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন তাদের এ সকল কথা :
ক. সহীহ বুখারী বা সহীহ মুসলিমে নেই
অনেকের মনে দৃঢ় প্রত্যয় আছে যে, ‘যেসকল হাদীস সহীহ বুখারী এবং সহীহ মুসলিমে নেই তা হয়তো সহীহ নয় কিংবা সহীহ হলেও এই দুই কিতাবের সহীহ হাদীসের সমপর্যায়ের নয়।’ এ কারণে কোনো বিষয়ে হাদীস পেশ করা হলে বলে, বুখারীতে দেখান, মুসলিমে দেখান। কিংবা বলে, বুখারী-মুসলিমে এর বিপরীত যে হাদীস আছে তা অধিক সহীহ। সুতরাং ঐ হাদীসের উপর আমল করা উচিত এবং এটা বাদ দেওয়া উচিত!
যাদের উসুলুল ফিকহ ও উসুলুল হাদীসের পোখতা ইলম আছে তারা বোঝেন এটা কেমন স্থূল কথা। কারণ :
ক. ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম দু’জনই পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন যে, তাঁরা তাঁদের ‘কিতাবুস সহীহ’তে যে হাদীসগুলো বর্ণনা করেছেন তা সব সহীহ। তবে সকল সহীহ হাদীস তাঁরা তাঁদের কিতাবে বর্ণনা করেননি এবং বর্ণনার ইচ্ছাও করেননি। এ কথাটি উভয় ইমাম থেকে সহীহ সনদে প্রমাণিত।
ইমাম বুখারী রহ. বলেছেন-
ما أدخلت في كتابي "الجامع" إلا ماصح، وتركت من الصحاح لحال الطول.
অর্থাৎ আমি আমার কিতাবুল জামি’তে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। তবে গ্রন্থের কলেবর বড় হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় (অনেক) সহীহ হাদীস ত্যাগ করেছি।-আলকামিল, ইবনে আদী ১/ ২২৬; তারীখে বাগদাদ ২/৮-৯
‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামছা’’য় (পৃ. ১৬০- ১৬৩) ইমাম ইসমাঈলীর সূত্রে ইমাম বুখারীর বক্তব্যের আরবী পাঠ এই-
لم أخرج في هذا الكتاب إلا صحيحا، وما تركت من الصحيح أكثر.
আমি এই কিতাবে শুধু সহীহ হাদীস এনেছি। আর যে সহীহ হাদীস আনিনি তার সংখ্যা বেশি।
খতীব বাগদাদী রাহ. ‘‘তারীখে বাগদাদে’’ (১২/২৭৩ তরজমা : আহমদ ইবনে ঈসা আততুসতরী) এবং হাযেমী ‘‘শুরূতুল আইম্মাতিল খামসা’’য় (পৃ. ১৮৫) বর্ণনা করেছেন যে, ইমাম আবু যুরআ রাযী রহ. (যিনি ইমাম মুসলিম রহ. এর উস্তাদ) একবার সহীহ মুসলিম সম্পর্কে বললেন, এর দ্বারা তো আহলে বিদআর জন্য পথ খুলে দেওয়া হল। তাদের সামনে যখন কোনো হাদীস দ্বারা দলীল দেওয়া হবে তখন তারা বলবে, এ তো কিতাবুস সহীহতে নেই!
তেমনি ইমাম ইবনে ওয়ারা রাহ.ও সরাসরি ইমাম মুসলিম রাহ.কে সম্বোধন করে এই আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তখন ইমাম মুসলিম রাহ. বলেছেন, আমি এই কিতাব সংকলন করেছি এবং বলেছি, এই হাদীসগুলো সহীহ। আমি তো বলিনি যে, এ কিতাবে যে হাদীস নেই তা জয়ীফ! ....
তখন ইবনে ওয়ারা তার ওজর গ্রহণ করেন এবং তাঁকে হাদীস শুনান।
এই ঘটনা থেকে যেমন বোঝা যায়, ইমাম মুসলিম রাহ. সকল সহীহ হাদীস সংকলনের ইচ্ছাও করেননি তেমনি এ কথাও বোঝা যায় যে, কোনো সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীস পেশ করা হলে ‘এ তো সহীহ মুসলিমে নেই’ বলে তা ত্যাগ করা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর তরিকা হতে পারে না। একই কথা সহীহ বুখারীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
২. ইমাম আবু বকর ইসমায়িলী রহ. (৩৭১ হি.) ‘আল মাদখাল ইলাল মুসতাখরাজ আলা সহীহিল বুখারী’তে হাম্মাদ ইবনে সালামা থেকে ইমাম বুখারীর রেওয়ায়েত না করার প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘বুখারী তো তাঁর মানদন্ডে উত্তীর্ণ অনেক সহীহ হাদীসও বর্ণনা করেননি। তবে তা এ জন্য নয় যে, তাঁর দৃষ্টিতে হাদীসগুলো জয়ীফ কিংবা সেগুলোকে তিনি বাতিল করতে চান। তো হাম্মাদ থেকে রেওয়ায়েত না করার বিষয়টিও এরকমই।’-আননুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ, বদরুদ্দীন যারকাশী ৩/৩৫৩
৩. ইমাম আবু নুয়াইম আসপাহানী রাহ. (৪৩০ হি.) ‘আলমুসতাখরাজ আলা সহীহি মুসলিম’’-এ একটি হাদীসের মান সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন-
"فإنهما رحمهما الله قد تركا كثيرا مما هو بشرطهما أولى و إلى طريقتهما أقرب"
অর্থাৎ বুখারী মুসলিম এমন অনেক হাদীস ত্যাগ করেছেন, যেগুলো তাদের সংকলিত হাদীস থেকেও তাঁদের নীতি ও মানদন্ডের অধিক নিকটবর্তী।-আলমুসতাখরাজ ১/৩৬
৪. এটি একটি সহজ ও বাস্তব কথা যে, বুখারী-মুসলিমে বর্ণিত হাদীসসমূহের সমপর্যায়ের হাদীস এবং ঐ দুই কিতাবের মানদন্ডে উত্তীর্ণ সহীহ হাদীসের সংখ্যা অনেক। শুধু মুসতাদরাকে হাকিমেই এ পর্যায়ের হাদীস, হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর বক্তব্য অনুযায়ী হাজারের কাছাকাছি।-আননুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ
মুসনাদে আহমদ এখন ৫২ খন্ডে বিস্তারিত তাখরীজসহ প্রকাশিত হয়েছে। টীকায় শায়েখ শুআইব আরনাউত ও তার সহযোগীরা সনদের মান সম্পর্কেও আলোচনা করেছেন। আমাদের প্রতিষ্ঠানের উচ্চতর হাদীস বিভাগের একজন তালিবে ইলম শুধু প্রথম চৌদ্দ খন্ডের রেওয়ায়েতের হিসাব করেছেন। দেখা গেছে, সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ-এই ছয় কিতাবে নেই এমন হাদীসগুলোর মধ্যে : বুখারী ও মুসলিম উভয়ের শর্ত অনুযায়ী ৪০১টি, শুধু বুখারীর শর্ত অনুযায়ী ৬৪টি, শুধু মুসলিমের শর্ত অনুযায়ী ২১৫টি হাদীস রয়েছে।
এছাড়া সহীহ লিযাতিহী বা সহীহ লিগায়রিহী হাদীসের সংখ্যা ১০০৮টি ও হাসান লিযাতিহী বা হাসান লিগায়রিহী হাদীস ৬১৫টি। এসব সংখ্যা স্বতন্ত্র-অতিরিক্ত হাদীসসমূহের, অর্থাৎ যেগুলোর কোনো মুতাবি বা শাহেদ তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী ছয় কিতাবে নেই।
ইমাম তহাবী রহ. এর ‘শরহু মুশকিলিল আছার’ও তাখরীজসহ ১৬ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে নমুনা হিসাবে শুধু দুই খন্ডের হাদীস ও আছার দেখা হয়েছে তো বুখারী-মুসলিম উভয়ের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীস পাওয়া গেছে ২২২টি, বুখারী-মুসলিম কোনো একজনের মানদন্ডে উত্তীর্ণ হাদীসসংখ্যা ১৪৬টি। এর মধ্যে ৪৬ টি এমন যে, তাখরীজের বিবরণ অনুযায়ী বুখারী-মুসলিমে তার কোনো মুতাবি-শাহিদ (সমর্থক বর্ণনাও) নেই। এ ছাড়া এই দুই খন্ডে সহীহ লিযাতিহী হাদীস ২৬৪ টি, সহীহ লিগায়রিহী ১২১টি, হাসান লিযাতিহী ৯৪টি ও হাসান লিগায়রিহী
রয়েছে ১৩টি।
শায়েখ নাসিরুদ্দীন আলবানী রহ. ‘সিফাতুস সালাহ’র (নবীজীর নামাযের পদ্ধতি) উপর যে কিতাব লিখেছেন তাতে ছয় কিতাবের বাইরে ৮৬ টি হাদীস রয়েছে এবং সহীহ বুখারী-সহীহ মুসলিমের বাইরে সুনানের কিতাবের হাদীস রয়েছে ১৫৬ টি।
৫. স্বয়ং ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রহ. তাদের অন্যান্য কিতাবে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন বা দলিল হিসেবে উল্লেখ করেছেন, যেগুলো তাঁদের এই দুই কিতাবে নেই। কারো সন্দেহ হলে ‘জুযউল কিরাআতি খালফাল ইমাম’ এবং ‘জুযউ রাফইল ইয়াদাইন’ ইত্যাদি খুলে দেখতে পারেন। জামে তিরমিযী খুললেও দেখতে পাবেন, ইমাম তিরমিযী রাহ. ইমাম বুখারীর উদ্ধৃতিতে এমন অনেক হাদীসকে সহীহ বলেছেন, যা সহীহ বুখারীতে নেই।
তো এই সকল নিশ্চিত ও চাক্ষুষ প্রমাণ থাকার পরও কোনো নির্ভরযোগ্য হাদীস গ্রহণ করতে শুধু এ কারণে দ্বিধাগ্রস্ত হওয়া যে, তা বুখারী, মুসলিমে নেই, অতি সত্হী ও অগভীর চিন্তা নয় কি?
৬. সপ্তম শতাব্দীতে তৈরিকৃত ‘তাকসীমে সাবয়ী’*-এর কারণে যদি কারো সন্দেহ হয় তাহলে তাদের জেনে রাখা উচিত, ঐ ‘তাকসীম’কারীগণই লিখেছেন-
أما لو رجح قسم على ما فوقه بأمور أخرى تقتضي الترجيح، فإنه يقدم على ما فوقه، إذ قد يعرض للمفوق ما يجعله فائقا
অর্থাৎ অগ্রগণ্যতার অন্যান্য কারণে কোনো প্রকার যদি তার উপরস্থ প্রকারের চেয়ে অগ্রগামী হয় তাহলে তাকে তার উপরের প্রকারের চেয়ে অগ্রগণ্য করা হবে। কারণ এই বিন্যাসে উল্লেখিত নীচের প্রকারের বর্ণনার সাথে কখনো কখনো এমন বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়, যা তাকে উপরের পর্যায়ের বর্ণনার সমকক্ষ বা অগ্রগণ্য করে।
এ কথাটি হাফেয ইবনে হাজার রাহ. (৭৫২ হি.) শরহু নুখবাতুল ফিকারে (পৃ. ৩২ ) পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন। তাঁর শাগরিদ মুহাদ্দিস শামসুদ্দীন সাখাভী রাহ.ও (৯০২ হি.) ‘‘ফাতহুল মুগীছে’’ তা আরো খুলে খুলে বয়ান করেছেন। মুহাদ্দিস বদরুদ্দীন যারকাশী রাহ. (৭৯৪ হি.) ‘‘আন নুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ’’ তে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ২৫৬-২৫৭) এবং জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. ‘‘তাদরীবুর রাবী’’তে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৮৮) পরিষ্কার লিখেছেন যে, সহীহ মুসলিমের তুলনায় সহীহ বুখারী অধিক সহীহ হওয়ার অর্থ সমষ্টিগত বিচারে অধিক সহীহ হওয়া; এই নয় যে, সহীহ বুখারীর প্রতিটি হাদীস সহীহ মুসলিমের প্রতিটি হাদীসের চেয়ে অধিক সহীহ। যারকাশী রাহ. আরো লিখেছেন, অগ্রগণ্যতার কারণ-বিচারে মুহাদ্দিসগণ কখনো কখনো মুসলিমের হাদীসকে বুখারীর হাদীসের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
সুতরাং তাঁদের কাছেও ‘তাকসীমে সাবয়ী’ সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য অটল নীতি নয়।
খ. অধিকতর সহীহ বর্ণনাই কি অগ্রগণ্য?
অনেকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, ‘যে হাদীস সনদের বিচারে বেশি সহীহ তা-ই শ্রেষ্ঠ ও অগ্রগণ্য, বিপরীত হাদীসটি সহীহ হলেও।’
অথচ এটা নিয়ম নয় যে, হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা দিলে অন্য কোনো বিবেচনা ছাড়াই অধিক সহীহ হাদীসটি গ্রহণ করা হবে এবং বিপরীতটি বর্জন করা হবে। বরং স্বীকৃত নিয়ম এই যে, এই বিরোধের ক্ষেত্রে জমা, তারজীহ ও নাসখ তথা সমন্বয় সাধন, অগ্রগণ্য বিচার ও নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়ের নিয়ম কার্যকর করতে হবে। তারজীহ বা অগ্রগণ্য বিচারের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে ‘উজূহুত তারজীহ’ বা অগ্রগণ্যতার কারণসমূহের ভিত্তিতে যে হাদীস রাজিহ বা অগ্রগণ্য হবে সে হাদীসের উপরই আমল হবে। অগ্রগণ্যতার অনেক কারণ আছে।** সনদের বিচারে অধিক সহীহ হওয়া একটিমাত্র কারণ। তো অগ্রগণ্যতার অন্য সকল কারণ ত্যাগ করে শুধু এক কারণের ভিত্তিতে সব জায়গায় সমাধান দিয়ে যাওয়া নিয়ম পরিপন্থী।
স্বয়ং ইমাম বুখারী রাহ. কিতাবুস সালাহ-এর দ্বাদশ অধ্যায়ে باب ما يذكر في الفخذ উরূ সতরের অন্তর্ভুক্ত কি না-এ সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।
সেখানে তিনি বলেছেন-
وحديث أنس أسند وحديث جرهد أحوط، حتى يخرج من اختلافهم
অর্থাৎ আনাস রা.-এর হাদীস, (যার দ্বারা উরূ সতর না হওয়া প্রমাণ হয়) সনদের বিচারে অধিক সহীহ হলেও জারহাদের হাদীস (যাতে উরূ সতর হওয়ার কথা আছে) সতর্কতার বিচারে অগ্রগণ্য। যাতে ইখতিলাফের মধ্যে থাকতে না হয়।
ফাতহুল বারীতে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা : ৫৭১) আছে, ইমাম বুখারী রাহ. ‘আততারীখুল কাবীরে’ জারহাদের হাদীসকে ইযতিরাবের কারণে জয়ীফ বলেছেন। তাহলে দেখুন, সহীহর বিপরীতে যয়ীফের উপর আমল করাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন। কারণ এটাই সতর্কতার দাবি। যে মাযহাবে উরূ সতর সেই মাযহাব অনুসারেও যেন গুনাহগার হওয়ার আশঙ্কা না থাকে।
এ কারণে অগ্রগণ্যতার একটিমাত্র কারণকে সর্বক্ষেত্রে প্রাধান্যের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করা এবং সনদের বিচারে যেটি শ্রেষ্ঠ সেটিকেই চূড়ান্তভাবে শ্রেষ্ঠ মনে করা আর তা-ও বিনা তাহকীকে, শুধু এ কারণে যে, বিপরীত হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে নেই-এই চিন্তা মোটেও সঠিক নয়। সুতরাং অগ্রগণ্যতার অন্যান্য দিক ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং বিবেচনায় রাখা জরুরি। যেমনটা আমরা স্বয়ং ইমাম বুখারীর কাছে দেখলাম।
আরো মনে রাখা উচিত, যে সহীহ হাদীস মোতাবেক সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে আমল হচ্ছে, যার উপর ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিমের উস্তাদের উস্তাদরা আমল করেছেন, ফিকহ ও হাদীসের ইমামগণ যার উপর মাসআলার ভিত্তি রেখেছেন তাকে শুধু এই ছুতায় দ্বিতীয় পর্যায়ে নিয়ে আমলের গন্ডি থেকে বের করে দেওয়া যে, হাদীসটি বুখারী-মুসলিমে কেন আসেনি-এ কি ন্যায় ও যুক্তির কথা হতে পারে? হাদীস-সুন্নাহর কোনো দলিল এমন করতে বলে কি না তা চিন্তা করা কি প্রয়োজন নয়?
গ. সহীহর মোকাবেলায় হাসান কি গ্রহণযোগ্য নয়?
উপরের উদাহরণ থেকে পরিষ্কার হয়েছে যে, এক বিষয়ে যদি দুইটি মুখতালিফ হাদীস বিদ্যমান থাকে, যার একটি সহীহ, অন্যটি হাসান, তাহলে সহীহ সর্বাবস্থায় হাসানের চেয়ে অগ্রগণ্য হবে তা অপরিহার্য নয়। কেউ কেউ মনে করে, সহীহ-হাসানে তাআরুয (বিরোধ) মনে হলে সর্বাবস্থায় সহীহকেই অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইনসাফের কথা এই যে, এখানেও ইখতিলাফুল হাদীসের মূলনীতি প্রয়োগ করতে হবে। অর্থাৎ দুই হাদীসের মধ্যে ইখতিলাফ (বাহ্যত বিরোধ) মনে হলে বিরোধ নিষ্পত্তির যে মূলনীতি আছে, অর্থাৎ জমা (সমন্বয়) তারজীহ (অগ্রগণ্যতা বিচার) নাসখ (নাসিখ-মানসূখ নির্ণয়) সে অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে হবে। যদি তারজীহ বা অগ্রগণ্যতার প্রসঙ্গ আসে তাহলে যে হাদীস অগ্রগণ্য সাব্যস্ত হবে তার উপর আমল করা হবে।
অগ্রগণ্য হাদীস ঐ হাদীসকে বলে, যাতে এক বা একাধিক অগ্রগণ্যতার কারণ বিদ্যমান রয়েছে। সুতরাং সহীহর বিপরীতে হাসান হাদীসে যদি এক বা একাধিক শক্তিশালী কারণ অগ্রগণ্যতার থাকে তাহলে তাকেই অগ্রগণ্য করতে হবে।
যারা বলেছেন, ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) সহীহর চেয়ে অগ্রগণ্য, সুতরাং এখানে সমন্বয় চেষ্টার প্রয়োজন নেই, তাদের মতকে হাফেয ইবনে হাজার রাহ. ‘‘ইনতিকাযুল ইতিরায’’ গ্রন্থে (খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৫৮) খন্ডন করেছেন।
তিনি লেখেন-
وأما دعوى أن الجمع لا يكون إلا في المتعارضين، وأن شرط المتعارضين أن يتساويا في القوة، فهو شرط لا مستند له، بل إذا صح الحديثان وكان ظاهرهما التعارض وأمكن الجمع فهو أولى من الترجيح.
অর্থাৎ এই দাবি করা যে, সমন্বয় শুধু দুই মুতাআরিযের (বাহ্যত বিরোধপূর্ণ) মাঝে হয়ে থাকে আর মুতাআরিয তখনই হয়, যখন দুটোই শক্তির দিক থেকে সমান হয়-এটি দলিলহীন শর্ত। বরং দুই হাদীস সহীহ হলে এদের মাঝে যদি বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হয় এবং সমন্বয় সাধন সম্ভব হয় তাহলে সেটিই তারজীহের চেয়ে উত্তম।
হাফেয ইবনে হাজার রাহ. এ কথা বলেছেন মুসতাদরাকে হাকিম ও সহীহ বুখারীর দুটো হাদীসের উপর আলোচনা করতে গিয়ে, যে দুই হাদীসের মাঝে বাহ্যত বিরোধ দেখা যাচ্ছিল। কেউ এখানে সহীহ বুখারীর হাদীস ‘আসাহ’ (অধিক সহীহ) হওয়ার যুক্তিতে মুসতাদরাকের হাদীস প্রত্যাখ্যানের প্রস্তাব করেছিলেন। এই প্রস্তাব ভুল সাব্যস্ত করে ইবনে হাজার উপরের কথা বলেন।
তদ্রূপ তিনি তার কিতাব ‘শরহু নুখবাতিল ফিকারে’র দরসে বলেছেন, সহীহ ও হাসানের মাঝেও তাআরুয (বিরোধ) দাঁড়াতে পারে। সুতরাং মানসূখ (রহিত) রেওয়ায়েত সহীহ পর্যায়ের আর নাসিখ (রহিতকারী) রেওয়ায়েত হাসান পর্যায়ের হওয়া খুবই সম্ভব।-আলইয়াওয়াকীতু ওয়াদ দুরার আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার, আবদুর রউফ আলমুনাভী খন্ড ১, পৃষ্ঠা : ৩০৬; হাশিয়া কাসিম ইবনে কুতলুবুগা পৃষ্ঠা : ১০৯; হাশিয়াতুল কামাল ইবনে আবী শারীফ আলা শরহি নুখবাতিল ফিকার পৃষ্ঠা : ৭৩
যদি সহীহর বিপরীতে হাসানের কোনো গুরুত্বই না থাকে তাহলে তা সহীহর জন্য নাসিখ কীভাবে হয়?
ঘ. সুন্নাহকে সনদভিত্তিক মৌখিক বর্ণনার মধ্যে সীমাবদ্ধ মনে করা
শরীয়তের সর্বপ্রথম এবং সবচেয়ে বড় দলীল হল কুরআন কারীম। এরপর সুন্নাহর স্থান। কিন্তু সুন্নাহের ব্যাপারে কতিপয় মানুষের এই ধারণা আছে যে, যেসব হাদীস সুস্পষ্টভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কথা বা কাজ হিসেবে সহীহ বর্ণনা-পরম্পরায় এসেছে শুধু তাই সুন্নাহ। এই ধারণা ঠিক নয়। সুন্নাহ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা ও নির্দেশনাবলির নাম। এই শিক্ষা ও নির্দেশনা আমাদের কাছে সাধারণত মৌখিক বর্ণনা সূত্রে পৌঁছে থাকে এবং সাধারণ পরিভাষায় এইসব মৌখিক বর্ণনাসূত্রে প্রাপ্ত রেওয়ায়েতগুলোকেই ‘হাদীস’ বলে। কিন্তু অনেক সময় এমন হয় যে, রাসূলে কারীম সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিশেষ কোনো শিক্ষা বা নির্দেশনা আমাদের কাছে মৌখিক বর্ণনার স্থলে কর্মের ধারাবাহিকতায় পৌঁছায়। অর্থাৎ সাহাবায়ে কেরাম নবীজী থেকে কর্মের মাধ্যমে তা গ্রহণ করেছেন; তাদের নিকট থেকে তাবেয়ীগণ গ্রহণ করেছেন। এভাবে প্রত্যেক উত্তরসূরি তার পূর্বসূরি থেকে কর্মের মধ্য দিয়ে নবীজীর সেই শিক্ষাকে গ্রহণ করেন। নবী-শিক্ষার এই প্রকারটিকে পরিভাষায় ‘আমলে মুতাওয়ারাস’ বা ‘সুন্নতে মুতাওয়ারাসা’ বলে।
নবী-শিক্ষা ও নবী-নির্দেশনার অনেক বিষয় এই পথেই পরবর্তীদের হাতে পৌঁছেছে। এইসব শিক্ষা-নির্দেশনা যদি মৌখিক বর্ণনাসমূহের মধ্যেও তালাশ করা হয় তাহলে অনেক সময় এমন হয় যে, হয়ত এ ব্যাপারে কোনো মৌখিক বর্ণনা পাওয়া যায় না অথবা পাওয়া গেলেও সনদের দিক থেকে তা হয় যয়ীফ। এখানে এসে স্বল্প-জ্ঞান কিংবা স্বল্প-বুঝের লোকেরা বিভ্রান্ত হয়। তারা যখন বিশুদ্ধ মৌখিক বর্ণনাসূত্রে বিষয়টি খুঁজে পায় না তো নবীজীর এই শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বসে। অথচ মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী সূত্র তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে বিষয়টি সংরক্ষিত।
তদ্রূপ নবী-শিক্ষার একটি অংশ হল যা আমাদের কাছে সাহাবায়ে কেরামের শিক্ষা-নির্দেশনার মধ্য দিয়ে সংরক্ষিত আছে। সাহাবায়ে কেরামের অনেক নির্দেশনা এমন আছে যার ভিত্তি শরীয়তসম্মত কিয়াস ও ইজতিহাদ। এগুলো শরীয়তের দলীল হিসেবে স্বীকৃত। আবার তাদের কিছু নির্দেশনা ও কিছু ফাতওয়া এমন আছে যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কথা বা কাজ থেকে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু অন্যকে শিখানোর সময় এর উদ্ধৃতি দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। কেননা প্রেক্ষাপট থেকে এ কথা স্পষ্ট ছিল যে, তাঁরা নবীজীর শিক্ষা ও নির্দেশনার ভিত্তিতেই তা শিক্ষা দিচ্ছেন। এজন্য দ্বীনের ইমামগণের সর্বসম্মত নীতি হল, সাহাবায়ে কেরামের যে ফাতাওয়া বা নির্দেশনার ব্যাপারে এটা সুনির্দিষ্ট যে, এটি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষা-নির্দেশনা থেকেই গৃহীত, এতে সাহাবীর ইজতিহাদ বা কিয়াসের কোনো প্রভাব নেই তা মারফূ হাদীসেরই অন্তর্ভুক্ত। কোনো মাসআলায় এর মাধ্যমে প্রমাণ দেওয়া মারফূ হাদীসের দ্বারা প্রমাণ দেওয়ার শামিল। পরিভাষায় একে মারফূ হুক্মী বলে। নিঃসন্দেহে এর ভিত্তি কোনো মারফূ হাকীকী বা স্পষ্ট মারফূ। তবে এটা জরুরি নয় যে, হাদীসের কিতাবসমূহে সেই স্পষ্ট মারফূ হাদীসটি সহীহ সনদে বিদ্যমান থাকবে। এখানেও স্বল্প-বুঝের লোকেরা পদস্খলনের শিকার হয় এবং নবীজীর শিক্ষাটিকেই অস্বীকার করে বলতে থাকে যে, এর কোনো ভিত্তি পাওয়া গেল না, অথচ মারফূ হুকমীর সূত্রে প্রমাণিত হওয়াও দলীল হিসাবে যথেষ্ট।
উদাহরণস্বরূপ ইমাম ইবনে রজব হাম্বলী রাহ.-এর হাওয়ালা উল্লেখ করা যায়। তিনি তাকবীরে তাশরীকের উপর আলোচনা করে লেখেন, তাকবীরে তাশরীক মশরূ হওয়ার বিষয়ে আলিমগণ একমত। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সহীহ মরফূ হাদীস নেই। শুধু সাহাবায়ে কেরাম ও তাঁদের পরবর্তী ব্যক্তিদের থেকে কিছু আছর বর্ণিত হয়েছে এবং এর উপর মুসলমানদের আমল রয়েছে। এরপর লেখেন-
وهذا مما يدل على أن بعض ما أجمعت الأمة عليه لم ينقل إلينا فيه نص صريح عن النبي صلى الله عليه وسلم، بل يكتفي بالعمل به.
অন্য কিছু হুকুমের সাথে এই হুকুমটিও প্রমাণ করে যে, যেসব বিষয়ে উম্মতের ইজমা হয়েছে তন্মধ্যে কিছু বিষয় এমনও আছে, যে সম্পর্কে আমাদের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্পষ্ট কোনো নস বর্ণিত হয়ে আসেনি; বরং এ বিষয়ে শুধু আমলে (মুতাওয়ারাছ-এর) উপরই নির্ভর করতে হয়।-ফাতহুল বারী ফী শরহি সহীহিল বুখারী, ইবনে রজব হাম্বলী (৭৩৬হি.-৭৯৫হি.) খ. ৬, পৃ. ১২৪
সহীহ হাদীসে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন সুন্নাতের পাশাপাশি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে অনুসরণ করার এবং তাকে মজবুতভাবে অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। ইরশাদ করেছেন-
انه من يعش منكم بعدي فسيرى اختلافا كثيرا، فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين، تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ ... وإياكم ومحدثات الأمور، فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة.
‘‘মনে রেখো! আমার পরে তোমাদের যারা জীবিত থাকবে তারা বহু মতানৈক্য দেখতে পাবে। তখন আমার সুন্নত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত খলীফাগণের সুন্নতকে আকড়ে রাখবে। একে অবলম্বন করবে এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে রাখবে ... এবং তোমরা (ধর্মীয় বিষয়ের) নবআবিস্কৃত বিষয়াদি থেকে খুব সতর্কতার সাথে বেuঁচ থাকবে। কেননা প্রতিটি নবআবিস্কৃত বিষয় বেদআত। আর প্রতিটি বিদআত গোমরাহী।’’-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৬০৭; জামে তিরমিযী ৫/৪৩, হাদীস : ২৬৭৬; মুসনাদে আহমদ ৪/১২৬, হাদীস : ১৬৬৯২; সুনানে ইবনে মাজা, হাদীস : ৪২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৫
জামে তিরমিযীর ২২২৬ হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওফাতের পরে খেলাফতের মেয়াদ ত্রিশ বছর হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী খোদ নবীজীই করে গেছেন। সে হিসেবে নবী-পরিভাষায় খুলাফায়ে রাশেদীন চারজন- ১. আবু বকর রা. ২. উমর রা. ৩. উসমান রা. ৪. আলী রা.। তাঁর শাহাদত ৪০ হিজরীর রমযানে হয়েছে।
যেহেতু খুলাফায়ে রাশেদীনের ব্যাপারে ওহীর মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জেনেছিলেন যে, তাঁদের জারিকৃত সুন্নতসমূহ নবী-শিক্ষার উপরই ভিত্তিশীল হবে, তাঁদের সুন্নতসমূহ নবী-সুন্নতেরই অনুগামী হবে এবং আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি মোতাবেক হবে এজন্য রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে ব্যাপক ঘোষণা দিয়ে বলে যান যে, তোমরা খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অাঁকড়ে রাখবে।
সুতরাং যখন উম্মতের সামনে কোনো বিষয়ে প্রমাণ হবে যে, এটি চার খলীফার কোনো একজনের সুন্নত তখন তার অনুসরণের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপরোক্ত আদেশই যথেষ্ট। আমাদের জন্য আরো অগ্রসর হয়ে এটা ভাবার প্রয়োজন নেই যে, তাঁদের এই সুন্নতের ভিত্তি কী ছিল এবং তাঁরা এই সুন্নত কোন নবী-শিক্ষা থেকে গ্রহণ করেছেন। এখানেও স্বল্প জ্ঞান ও স্বল্প বুঝের লোকদের অভ্যাস হল, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতের ভিত্তি হাদীসের কিতাবসমূহে খুঁজতে থাকা। এরপর সহীহ সনদে নবীজীর স্পষ্ট কোনো বাণী যদি বিশেষ এই ব্যাপারে তারা না পায় তখন তাকে অস্বীকার করে বসে এবং অত্যন্ত
মর্মান্তিকভাবে একে বিদআত আখ্যা দিয়ে দেয়। অথচ রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিন্দিত ইখতিলাফ থেকে বাঁচার এই পথই দেখিয়েছেন যে, আমার সুন্নত ও আমার খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নতকে মজবুতভাবে অবলম্বন কর। এরপর বলেছেন, বিদআত থেকে বেঁচে থাক। একটু চিন্তা করুন, যদি খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত বিদআতই হত তাহলে নবীজীর এই ইরশাদের কোনো অর্থ থাকে কী?
সুন্নাহর পরে শরীয়তের তৃতীয় বুনিয়াদী দলিল হল ইজমা। এর বিভিন্ন ধরন এবং অনেক পর্যায় আছে। এর মধ্যে সর্বপ্রধান ও সর্বশ্রেষ্ঠ হল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মুহাজির-আনসার এবং অন্যান্য সাহাবীগণের ইজমা। এই ইজমা যদি ব্যাপকভাবে এবং অবিচ্ছিন্ন ও সম্মিলিতরূপে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছায় তবে তা শরীয়তের অনেক বড় অকাট্য দলিল। এ দলিল থাকা অবস্থায় অন্য কোনো দলিলের প্রয়োজন নেই।
আর ইজমাকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করার জন্য এরও প্রয়োজন নেই যে, এই ইজমা কীসের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়েছে তার অনুসন্ধানে অবতীর্ণ হওয়া। কেননা শরীয়ত নিজেই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে এবং যাঁদের মাধ্যমে ইজমা সম্পন্ন হয় তাঁদের ব্যাপারে আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছে যে, এঁরা কখনো গোমরাহীর বিষয়ে একমত হতে পারে না। কুরআন মজীদে তো সুস্পষ্টভাবে মুহাজির ও আনসারী সাহাবীগণের অনুসরণের আদেশ করা হয়েছে এবং সাবীলুল মুমিনীন (মুমিনদের অনুসৃত পথ) থেকে বিমুখ হওয়াকে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার কারণ বলা হয়েছে।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মত, পথ ও রুচির সাথে একাত্মতা পোষণ করে না এমন ব্যক্তিদের অভ্যাস হল তারা কোনো মাসআলায় শুধু উম্মতের ফকীহবৃন্দ নয়, উম্মাহর শীর্ষ ব্যক্তিবর্গ-সাহাবায়ে কেরাম, বিশেষত মুহাজির ও আনসারের ঐকমত্য থাকা অবস্থায় ভিন্ন দলিল তালাশ করতে থাকে। অথচ শরীয়ত এই ইজমাকে দলিল সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু ওইসব বন্ধু যদি শরীয়তের এই দলিলের সমর্থনে অন্য কোনো সহীহ সনদওয়ালা স্পষ্ট হাদীস না পায় তাহলে এই মাসআলাটিকে অস্বীকার করে দেয়। কেউ তো আরো এক ধাপ বেড়ে অত্যন্ত দুঃসাহসিকতার সাথে শরীয়তের দলিল ইজমাকেই অস্বীকার করে বসে।
মনে রাখবেন, এসব হচ্ছে মূর্খতা ও শরীয়তের প্রতি অনাস্থা প্রকাশের সমার্থক। যদিও তা অসচেতনভাবেই হোক না কেন। অর্থাৎ শরীয়ত যে বিষয়টিকে দলিল সাব্যস্ত করেছে তারা তাকে মেনে নিতে পারছেন না।
এ বাস্তবতা সম্পর্কে যাঁদের চিন্তা ভাবনার সুযোগ হয় না তারা বিনা দ্বিধায় ঐ সকল সুন্নতকে ইনকার করে, যা তারা সনদ ভিত্তিক বা মৌখিক বর্ণনা সূত্রে সরাসরি قال رسول الله صلى الله عليه وسلم বা فعل رسول الله صلى الله عليه وسلم শব্দে কোনো সহীহ হাদীসে পান না। একারণে খুব সহজেই তারা খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং আমলে মুতাওয়ারাছকে ইনকার করেন। বিশ রাকাআত তারাবী, জুমার নামাযের প্রথম আযান, তারাবীতে কুরআন খতম, জুমার খোৎবা আরবীতে হওয়া, কালেমায়ে তাওহীদের উভয় অংশ একসাথে বলার বৈধতা لا إله إلا الله محمد رسول الله. ইত্যাদি অনেক বিষয়, যেগুলোর বড় দলীল বা প্রসিদ্ধ দলিল হচ্ছে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নত, মুসলিম উম্মাহর আমলে মুতাওয়ারাছ কিংবা আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন, এসব কিছুকে তারা এই বলে অস্বীকার করেন যে, এগুলো সহীহ হাদীসে নেই! তো উপরে উল্লেখিত বাস্তবতা সম্পর্কে চিন্তা করলে অনুমান করতে পারবেন, তাদের নীতি কতটা ভুল ও মারাত্মক নীতি! অথচ খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং আছারে সাহাবা ও তাবেয়ীন যে শুধু সুন্নতে নববীর সাথে যুক্ত তাই নয়, সনদ ভিত্তিক বর্ণনা সূত্রে বর্ণিত অনেক সহীহ হাদীসের (কওলী সুন্নতের) প্রকৃত অর্থ বোঝা ও তার প্রায়োগিক রূপ উপলব্ধি করাও এর উপর নির্ভরশীল। আলোচনা দীর্ঘ হওয়ার আশংকা না হলে এখানে কিছু উদাহরণও উল্লেখ করা যেত। আহলে ইলম যদি মুহাদ্দিস হায়দার হাসান খান টুংকী রাহ.-এর রিসালা ‘‘আততাআমুল’’ও অধ্যয়ন করেন তাহলেও ইনশাআল্লাহুল আযীয চিন্তার পথ খুলে যাবে। এই রিসালা ‘আলইমাম ইবনু মাযাহ ওয়া কিতাবুহুস সুনানে’র হাশিয়ায় রয়েছে।
ঙ. ‘সহীহ’ ও ‘সুন্নত’কে সমার্থক মনে করা
সহীহ বা হাসান পর্যায়ের প্রতিটি রেওয়ায়েত অবশ্যই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস। কারণ তা তাঁর থেকে প্রমাণিত। কেউ কেউ মনে করেন, হাদীসে যা কিছু প্রমাণিত তা অবশ্যই সুন্নত বা
মুস্তাহাব। অথচ সঠিক কথা হল, হাদীস দ্বারা যা প্রমাণিত তা শরীয়তের বিধান বটে, কিন্তু তা কোন প্রকারের এবং কোন পর্যায়ের বিধান; তা কি সুন্নত-মুস্তাহাব, না মোবাহ; সাধারণ বিধান না বিশেষ অবস্থার বিধান; সু্ন্নত হিসেবে করা হয়েছিল, না ওযরের কারণে বা শুধু বৈধতা বর্ণনার জন্য করা হয়েছিল অথবা শুধু অভ্যাসগতভাবে*** করা হয়েছিল-ইত্যাদি অনেক সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম দিক আছে যেগুলোর গভীরে পৌঁছা ও সমাধান দেওয়া মুজতাহিদ ও ফকীহগণের কাজ। এজন্য আমাদের কর্তব্য, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই হাদীস সব সময় মনে রাখা-
نضر الله امرء سمع منا حديثا فحفظه، حتى يبلغه غيره، فرب حامل فقه إلى من هو أفقه منه، ورب حامل فقه ليس بفقيه
অর্থাৎ আল্লাহ ঐ ব্যক্তিকে সজীব করুন, যে আমার নিকট থেকে কোনো হাদীস শুনেছে, অতপর তা মুখস্থ করেছে এবং অন্যের নিকট পৌঁছে দিয়েছে। কারণ ফিকহের অনেক বাহক তার চেয়ে অধিক ফকীহর নিকট তা পৌঁছে দিবে এবং ফিকহের অনেক বাহক নিজে ফকীহ নয়।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৮৪৭; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৩৬৫২; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস : ৬৭ ও ৬৮০
হাদীস বোঝার ক্ষেত্রে যারা শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে, না হাদীস বোঝা ও হাদীস-ব্যাখ্যার প্রাথমিক ও স্বীকৃত নিয়মনীতি জানা আছে, না জানার ইচ্ছা আছে আর না এ বিষয়ে আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণার সহায়তা নেওয়াকে বৈধ মনে করে, এরা তো বুঝতেই পারবে না যে, হাদীস অনুসরণের নামে অজান্তেই তারা সুন্নাহ বিরোধিতায় লিপ্ত হবে।
এদের কেউ মনে করবে, সব লোক আহাম্মক, এরা মসজিদের বাইরে বা জুতার বাক্সে জুতা রাখে অথচ সুন্নত হল, জুতা পায়ে দিয়ে নামায পড়া! তবে মাথায় না টুপি থাকবে, না পাগড়ি। খালি মাথায় জুতা পায়ে নামায পড়া সুন্নত!
কেউ মনে করবে, (নাউযুবিল্লাহ) পশ্চিমাদের রীতিই তো সঠিক। পেশাব তো দাঁড়িয়ে করাই সুন্নত!
কেউ বলবে, নামাযে নাতনিকে কাuঁধ তুলে নেওয়া সুন্নত!
কেউ ফরয নামাযের আগে পরের সুন্নতে রাতিবা (সুন্নতে মুয়াক্কাদা) এবং বিতরকে আম নফলের মতো মনে করে অবহেলা করবে, কিন্তু অতি উদ্যম প্রদর্শন করবে মাগরিবের আগের দুই রাকাত নফলের বিষয়ে!
কেউ জুমআর আগের চার রাকাআত সুন্নতকে অস্বীকার করবে, জুমার পরের সুন্নত ত্যাগ করার বিষয়েও কোনো আফসোস হবে না, অথচ খোৎবা চলা অবস্থায় তাহিয়্যাতুল মসজিদ পড়তে ভুল করবে না।
কেউ মিসওয়াকের সুন্নত সম্পর্কে উদাসীন থাকবে, কিন্তু পাগড়ি বাঁধার বিষয়ে ভুল করবে না!
কেউ শোয়ার সময় চোখে সুরমা দিতে ভুলবে না, কিন্তু শোয়ার সময় দুআ ও যিকিরের কথা চিন্তাও করবে না!
কেউ তো দস্তরখান বিছানোর ক্ষেত্রে সামান্য শিথিলতাও করবে না, কিন্তু খাবারের কোনো দানা, তরকারির টুকরা পড়ে গেলে তা উঠিয়ে খাওয়ার ধারে কাছেও যাবে না!
কেউ মৌলিক বিষয়াদিতে সালাফ ও আকাবিরের তরীকা থেকে সরে যাবে, কিন্তু ব্যবস্থাপনাগত ও পরিবর্তনশীল বিষয়াদি অবস্থা ও চাহিদার পরিবর্তনের পরও আকাবিরের তরীকা আখ্যা দিয়ে তাতে জমে থাকবে আর এই ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করবে যে, আকাবিরের তরীকায় আছি!
কেউ নিজের সংশোধনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে সমাজের সংশোধনকে!
কেউ নিজের সন্তানের চিন্তার চেয়ে বেশি জরুরি বলবে উম্মতের চিন্তাকে!
কেউ দ্বীনের উপর আমল করার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করবে দ্বীনের খেদমত ও দাওয়াতকে!
কেউ দ্বীনের বিধানের উপর আমল করার চেয়ে বেশি তৎপর থাকবে হুকুমতে ইসলামিয়া কায়েম করার ক্ষেত্রে।
মোটকথা, এই ধরনের এবং এর চেয়েও মারাত্মক ধরনের চিন্তাগত ও কর্মগত প্রান্তিকতার, যা আমাদের প্রায় সকল ঘরানায় কমবেশি বিস্তার লাভ করছে, এর কারণ এছাড়া আর কী যে, আমরা আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ও ফুকাহায়ে উম্মতের জ্ঞান-গবেষণা থেকে কুরআন বোঝা, হাদীস বোঝা এবং হাদীস মোতাবেক আমল করার বিষয়ে হয়তো সহায়তা নেই না কিংবা সঠিক পন্থায় নেই না।
আমার এই অনুযোগ শুধু ঐ বন্ধুদের সম্পর্কেই নয়, যারা-আল্লাহ মাফ করুন-ফিকহের মাযহাব ও মুজতাহিদ ইমামদের সম্পর্কে বিদ্বেষ বা অপ্রসন্নতা পোষণ করেন কিংবা তাদের প্রাপ্য মর্যাদা ও ভালোবাসা দিতে প্রস্ত্তত নন; আমার অনুযোগ ঐ ভাইদেরও প্রতি, যারা ফিকহের মাযহাব এবং আকাবির ও আসলাফের নাম নিয়েও الفقه العام للدين (দ্বীনের সাধারণ প্রজ্ঞা) এবং فقه الوسطية والاعتدال (মধ্যপন্থা ও ভারসাম্য সম্পর্কে প্রজ্ঞা) অর্জনের বিষয়ে উদাসীন। এই ফিকহ ও প্রজ্ঞা তো আহলে ফিক্হ ও আহলে দিলের সোহবত ছাড়া এবং এ দুই বিষয়ে লিখিত প্রতি যুগের আহলে ফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের নির্বাচিত কিতাবাদি পাঠ করা ছাড়া অর্জন করা সহজ নয়।
৩. দলিলের শুধু সনদ দেখা। দলিল দ্বারা বিষয়টি কীভাবে প্রমাণ হয় এবং মূল আলোচ্য বিষয়ে তা প্রযোজ্য কি না-এ সম্পর্কে চিন্তা না করা।
কোনো হাদীস বা আছার দ্বারা কোনো বিধান প্রমাণ করতে হলে অনেকগুলো বিষয় দেখা জরুরি। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দুটি :
১. ঐ হাদীস বা আছর নির্ভরযোগ্য কি না। তার সনদের মান এমন কি না, যা প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করা যায়।
২. বাস্তবিকই তা আলোচিত বিধানের উপর দালালত করে কি না (অর্থাৎ আলোচিত বিধানকে নির্দেশ করে কি না)। করলে সেটি কোন প্রকারের এবং কোন পর্যায়ের দালালত।
কোনো হাদীস বা আছর দ্বারা মাসআলা প্রমাণ করার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিষয়টির গুরুত্ব প্রথম বিষয় থেকে কোনো অবস্থাতেই কম নয়। উসূল ও মাবাদিয়াতের ইলম হাসিল করা ছাড়া শুধু অনুবাদের উপর নির্ভর করে যারা গবেষণার প্রাসাদ নির্মাণ করতে চান তারা দ্বিতীয় বিষয়ে থাকেন সম্পূর্ণ উদাসীন।
যেমন কারো দাবি যদি এই হয় যে, ‘রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রুকুর তাকবীরের সময়, রুকু থেকে উঠে এবং দুই রাকাত থেকে উঠে সর্বদা রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, কখনো এইসব জায়গায় রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়তেন না’ এরপর সহীহ বুখারীর এই হাদীস দ্বারা তা প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. যখন নামায শুরু করতেন তখন আল্লাহু আকবার বলতেন এবং দুই হাত উঠাতেন, যখন রুকু করতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন, যখন سمع الله لمن حمده বলতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন এবং যখন দুই রাকাতের পর দাঁড়াতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এই আমল আল্লাহর রাসূল সাললাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাওলায় বলতেন (মারফু হিসেবে বর্ণনা করতেন)।-সহীহ বুখারী খ. ১ পৃ : ১৮০
নামাযের তিন জায়গায় সর্বদা রাফয়ে ইয়াদাইনের দাবি করে শুধু এই হাদীস দেখে যদি মনে করা হয় যে, তার পুরো দাবি প্রমাণ হয়ে গেছে তাহলে ভুল হবে। কারণ এই হাদীসে তো শুধু এটুকু আছে যে, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। কিন্তু সব সময় করতেন তা তো এই হাদীসে বলা হয়নি। তেমনি একথাও বলা হয়নি যে, তিনি কখনো রাফয়ে ইয়াদাইন ছাড়া নামায পড়তেন না। উপরন্তু যখন অন্য হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন না করাও প্রমাণিত তখন তা অস্বীকার করার উপায় কী?
তেমনি কারো দাবি যদি এই হয় যে, রাফয়ে ইয়াদাইন সুন্নাতে মুআক্কাদা এবং রাফয়ে ইয়াদাইন না করা খেলাফে সুন্নত; এরপর দলিল হিসেবে ঐ হাদীসটি পেশ করেন তাহলে যদিও তিনি সহীহ হাদীসই পেশ করেছেন, কিন্ত হাদীসটি তার দাবি প্রমাণ করে না। এই হাদীসে রাফয়ে ইয়াদাইন করা প্রমাণিত হয়, কিন্তু তা মোবাহ, না বিভিন্ন সুন্নাহর একটি; সুন্নত হলে তা মুআক্কাদা, না মুস্তাহাব ও যীনাত-এসব বিষয়ে এই হাদীস নিশ্চুপ। এসবের জন্য অন্যান্য দলীল ও করীনার প্রয়োজন, যা ফকীহগণের দৃষ্টিতে থাকে, কিন্তু অদূরদর্শী লোকেরা দাবি ও দলিলের মাঝে সামান্য মিল দেখলেই মনে করে, আমাদের গোটা দাবি প্রমাণ হয়ে গেছে।
আরেকটি উদাহরণ : কেউ যদি দাবি করে যে, আযানের আগে আযানের মতো উঁচু আওয়াজে দরূদ পড়া সুন্নত; এরপর দলীল হিসেবে এই হাদীসটি পেশ করে-
من صلى علي واحدة، صلى الله عليه عشرا
যে আমার উপর একবার দরূদ পরে তার প্রতি আল্লাহ দশটি রহমত নাযিল করেন।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ৪০৮
তাহলে হাদীস তো সহীহ, কিন্তু এর দ্বারা তার দাবি প্রমাণ হয়নি। কিন্তু তিনি যদি জিদ করেন যে, এ হাদীসে তো সময় নির্ধারণ করা নেই, আস্তে পড়ারও শর্ত নেই, সুতরাং জোরে পড়লেও এই ছওয়াব পাওয়া যাবে। কাজেই আমি আযানের আগে তা জোরে জোরে পড়ব। এরকম জোরাজুরি করলে তাকে তো শুধু এটুকুই বলা যাবে যে, আপনি হাদীসের তরজমা পড়ার সাথে সাথে কিছুটা উসূলে ফিকহ এবং সুন্নত-বিদআত সংক্রান্ত শরীয়তের মূলনীতি সম্পর্কেও পড়াশোনা করুন তাহলে বুঝতে পারবেন, আপনি সহীহ হাদীস তিলাওয়াত করেছেন বটে, কিন্তু তা আপনার দাবির পক্ষে দলিল নয়। একে ঐ দাবির দলিল মনে করা ভুল।
আরেকটি উদাহরণ : কেউ যদি দাবি করেন যে, প্রত্যেক ফরয নামাযের পর ইমাম-মুকতাদী সবাই মিলে হাত তুলে জোরে জোরে দুআ করা দায়েমী সুন্নত; এরপর দলীল হিসেবে তিরমিযী শরীফের হাদীস পেশ করে যে, এক ব্যক্তি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন,
أي الدعاء أسمع
কোন দুআ বেশি কবুল হয়? বললেন
جوف الليل ودبر الصلوات المكتوبة
মধ্য রাতের দুআ এবং ফরয নামাযের পরের দুআ। -জামে তিরমিযী, হাদীস : ৩৪৯৯
তাহলে এটা হবে দাবি প্রমাণের অসম্পূর্ণ প্রয়াস। কারণ হাদীস থেকে শুধু এটুকু প্রমাণ হয় যে, ফরয নামাযের পর দুআ কবুল হয়। এতে এই সময় দুআ করার উৎসাহ তো পাওয়া যায়, কিন্তু হাত তুলে সম্মিলিতভাবে জোরে জোরে দুআ করা এবং একে দায়েমী সুন্নত সাব্যস্ত করার বিষয়টি এই হাদীস দ্বারা প্রমাণ হয় না।
মোটকথা, এটি একটি দীর্ঘ প্রসঙ্গ। দাবি ও দলীলের মাঝে দূরত্বের এই ত্রুটি এবং তদজনিত বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকার জন্যই শুধু হাদীসের অনুবাদ পড়ে দাবি-দলিলের ময়দানে নেমে পড়তে নিষেধ করা হয়।
৪. আলিমের পরিবর্তে বিভিন্ন মাধ্যমকেই যথেষ্ট মনে করা।
ইলম শেখার স্বাভাবিক পদ্ধতি হচ্ছে আহলে ইলম, আহলে ফিক্হ ও আহলে দিল ব্যক্তিদের সাহচর্য অবলম্বন করা। হাদীস শরীফে আছে-
تعلموا، إنما العلم بالتعلم، والفقه بالتفقه، ومن يرد الله به خيرا يفقهه في الدين.
তোমরা শেখো, ইলম তো শেখার দ্বারা আসে এবং ফিকহ আসে ফিকহের চর্চা ও শেখার দ্বারা। আর আল্লাহ যার সম্পর্কে কল্যাণের ইচ্ছা করেন তাকে দ্বীনের ফিকহ দান করেন।-ইবনে আবী আসিম, তবারানী-ফাতহুল বারী খ. ১ পৃ. ১৯৪
সাহবায়ে কেরাম ইলম ও ফিকহ অর্জন করেছেন সাহচর্যের দ্বারা। এরকম তাবেয়ীগণ সাহাবায়ে কেরামের সাহচর্যের দ্বারা, তাবে তাবেয়ীন তাবেয়ীনের সাহচর্য দ্বারা, এভাবেই এই ধারা চলে আসছে। যখনই আহলে ফিকহের সাহচর্য ত্যাগ করে শুধু কিছু উপায়-উপকরণকে ইলম হাসিলের পক্ষে যথেষ্ট মনে করা হয়েছে তখনই ইফরাত-তাফরীত (প্রান্তিকতা); বরং তাহরীফ-তাবদীলের (বিকৃতির) দরজা খুলেছে।
এ প্রসঙ্গে ড. নাসির আল-আকলের বক্তব্য ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। এর অনেক আগে ইমাম আবু ইসহাক শাতিবী রাহ. (৭০৯ হি.) তাঁর কিতাব ‘আলমুয়াফাকাত’ খ. ১ পৃ. ৯১-৯২ (বারো নাম্বার মুকাদ্দিমায়) এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং দলিলসহ পরিষ্কারভাবে বলেছেন যে, আদব, তাহকীক ও তাফাককুহ-এগুলো শুধু বই পড়ে হাসিল করা যায় না। এগুলোর জন্য সাহচর্য জরুরি।
গ্রন্থ পাঠ করে, আলোচনা শুনে কিংবা সিডি দেখে তথ্যভান্ডার সমৃদ্ধ করা যায়, কিন্তু ফাকাহাত ও বসীরত তথা প্রজ্ঞা ও অন্তর্দৃষ্টি, ইতিদাল ও ভারসাম্য, আদব ও নীতি এবং বিনয় ও তাওয়াজু হাসিল করতে হলে আহলে ফিকহ ও আহলে দিলের সোহবত জরুরি।
৫. উসূলুল ফিকহ, কাওয়াইদুল ফিকহ, মাকাসিদুশ শরীয়া, আসবাবুল ইখতিলাফ, আদাবুল ইখতিলাফ ও আলফিকহুল আম লিদ্দীন সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান ও প্রজ্ঞা না থাকা।
এই সকল ইলম ও ফন অতি গুরুত্বপূর্ণ। কুরআন-সুন্নাহর সঠিক ও মানসম্মত বুঝের জন্য এই শাস্ত্রগুলো অপরিহার্য। মনে করুন, একজন ব্যক্তির কাছে এ সকল ইলমের কোনো সঞ্চয় নেই, তিনি তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের সাহায্যে কুরআন বোঝার চেষ্টা করছেন এবং সাধ্যমত উপদেশ গ্রহণের চেষ্টা করছেন কিংবা মাআরিফুল হাদীস পাঠ করছেন এবং সামর্থ্য অনুযায়ী হেদায়েত ও নির্দেশনা গ্রহণের চেষ্টা করছেন তো এতে কোনো অসুবিধা নেই, কোনো আপত্তিও নেই (তবে তাফসীরে তাওযীহুল কুরআনের তৃতীয় খন্ডের ভূমিকায় যে কথাগুলো আরজ করা হয়েছে সেগুলোর দিকে খেয়াল রাখা জরুরি)
আপত্তি তখনই হবে যদি তিনি তাওযীহুল কুরআনের লেখক হতে চান, মাআরিফুল হাদীসের লেখক হতে চান, কিংবা এই কিতাগুলোর উপর পর্যালোচনা বা এই কিতাবের লেখকদের উপর আপত্তি করতে চান অথচ উপরোক্ত ইলম ও ফনের কোনো সঞ্চয় তার নেই। নস বোঝা ও তার ব্যাখ্যা-উপস্থাপনার প্রাথমিক বিষয়গুলোর সাথেও তার পরিচয় নেই, দ্বীন ইসলামের সাধারণ বুঝ ও প্রজ্ঞাও তার নেই, এরপরও তিনি তাহকীক ও গবেষণার ময়দানে প্রবেশ করেন এবং নির্দ্বিধায় নিজের মতামত প্রকাশ করতে থাকেন, এমনকি তা অন্যের উপর আরোপেরও চেষ্টা করতে থাকেন!!
এ পদ্ধতি কোথাও কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। উপরোক্ত ইলম ও ফনে পূর্ণ পারদর্শিতা বিপুল জ্ঞান ও প্রজ্ঞার অধিকারী আলিমদেরই হয়ে থাকে। যাদের এসব বিষয়ে প্রাথমিক বা মাধ্যমিক পর্যায়েরও জানাশোনা আছে তারাও তো নিজের পরিধির বাইরে পা রাখা এবং আইম্মায়ে মুজাতাহিদীন ও উলামায়ে উম্মতের বিরুদ্ধে মুখ খোলা থেকে বিরত থাকবেন।
৬. স্বীকৃত বিষয়কে সাধারণ প্রচলনের মতো মনে করে বিরোধিতা ও বিচ্ছিন্নতায় আগ্রহী হওয়া।
এক হচ্ছে الشائعات والمروجات যার অর্থ প্রচলিত। এতে দু ধরনের বিষয় আছে : এক. যা প্রচলিত এবং দলীল দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দুই. যা প্রচলিত তবে ভিত্তিহীন। আহলে ইলম, বিশেষত যাদেরকে আল্লাহ তাআলা তাজদীদী ও সংস্কারমূলক কাজের তাওফীক দিয়েছেন তারা ভিত্তিহীন বিষয়গুলোর সম্পর্কে সাবধান করেন। এগুলোই হচ্ছে বিদআতের খন্ডন এবং রসম-রেওয়াজের ইসলাহ সংক্রান্ত কিতাবাদির বিষয়বস্ত্ত। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.-এর কিতাব اصلاح الرسوم-এর বাংলা তরজমা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রিসালা أغلاط العوام-এরও বাংলা তরজমা হয়েছে। তাজুদ্দীন ফাযারী রাহ. فقه العوام وانكار امور اشتهرت بين الأنام নামে কিতাব লিখেছেন।
ইলমে হাদীস, ইলমে তাফসীর সহ অন্যান্য ইলমের লেখকেরাও এই-দায়িত্ব পালন করেছেন।
এ তো গেল প্রচলন সম্পর্কে কিছু কথা। আরেকটি বিষয় আছে, المسلمات والاجماعيات অর্থাৎ ঐসকল আকীদা, চিন্তা, মত, বিধান ও মাসআলা, যা ইলমের ধারক-বাহকদের কাছে মুসাল্লাম ও স্বীকৃত এবং তার উপর সকল আহলে ইলম বা জুমহুর ও সংখ্যাগরিষ্ঠ আহলে ইলমের ইজমা রয়েছে। কোনো কোনো মানুষ তাদের জ্ঞানের স্বল্পতা ও আত্মগরিমার কারণে এইসব স্বীকৃত ও সর্বসম্মত বিষয়কেও সাধারণ প্রচলনের মতো মনে করে এবং এগুলোর দলিল খুঁজতে থাকে। বলাবাহুল্য, সীমিত অধ্যয়ন ও সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে প্রত্যেক বিষয়ের দলিল কীভাবে পাওয়া যাবে? তো নিজের অনুসন্ধান অনুযায়ী যখন ঐসব স্বীকৃত কোনো বিষয়ের সুস্পষ্ট দলিল পায় না তখন তা পরিষ্কার ইনকার করে দেয়। তাদের জানা নেই যে, আহলে ইলমের মাঝে সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃত বিষয়াদির উপর আপত্তি করে ভিন্ন রাস্তা অবলম্বন করা হচ্ছে শুযূয। এটা ঐ শুযূযের অন্তর্ভুক্ত, যে সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে-
من شذ شذ في النار
যারা বলে অর্থ না বুঝে কুরআন তিলাওয়াতে কোনো ফায়েদা বা ছওয়াব নেই, অযু ছাড়া কুরআন স্পর্শ করা জায়েয, বিনা ওজরে ত্যাগ করা নামাযের কাযা নেই ... ইত্যাদি, তারা এই ভ্রান্তিরই শিকার। তারা স্বীকৃত বিষয়াদিকে সাধারণ প্রচলনের অন্তর্ভুক্ত করে নিজেরাও গোমরাহীর শিকার হয়, অন্যদেরও গোমরাহ করে।
৭. যে বিষয়ে পারদর্শিতা নেই তাতে অনুপ্রবেশ করা।
ডাক্তার হোক, ইঞ্জিনিয়ার হোক, কিছু কিতাবের তরজমা পাঠ করে সহীহ-জয়ীফের ফতোয়া এবং কোন নামায হাদীসের মোতাবেক আর কোন নামায হাদীসবিরোধী-এ জাতীয় কঠিন কঠিন ফতোয়া দিতে থাকা।
এ কাজ যেকোনো বিবেকবানের দৃষ্টিতেই অন্যায়, কিন্তু আজকাল এটারই সয়লাব চলছে। এখানে আমি শুধু শিরোনামটুকুই বললাম। মাসিক আলকাউসারের উদ্বোধনী সংখ্যায় প্রকাশিত ‘গবেষণা : অধিকার ও নীতিমালা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি পাঠ করার জন্য অবশ্য অনুরোধ করব।
৮. অন্যকে বিনা দলিলে অজ্ঞ মনে করা কিংবা সুন্নাহ বা সুন্নাহওয়ালার প্রতি অনুরাগী নয় মনে করা।
এটা সরাসরি কুধারণা, যা কুরআন হারাম করেছে। কারো সাথে মতভেদ হলে তার সম্পর্কে কুধারণা পোষণ করাও জায়েয-এই ধারণা ঠিক নয়। কারো সম্পর্কে না জেনে শুধু অনুমান করে কোনো কিছু বলা দুরস্ত নয়।
৯. আসাবিয়ত ও অন্যায় পক্ষপাত এবং তাকাববুর ও অহংকার।
হাদীস শরীফে তাকাববুরের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে-
بطر الحق وغمط الناس
সত্যকে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ মনে করা।
এই সংজ্ঞার আলোকে প্রত্যেকের কর্তব্য, নিজ নিজ অবস্থা বিচার করা। আসাবিয়ত ও অন্যায় পক্ষপাত শুধু ইমামের প্রতিই হয় না; নিজের চিন্তা ও পছন্দের প্রতিও হয়। আর এটাই বেশি খতরনাক।
১০. মুহাসাবার অভাব
অন্য পক্ষের দলিল সম্পর্কে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে এই মুহাসাবা ও আত্মজিজ্ঞাসা জরুরি যে, ঐ পক্ষের কোনো গবেষক আলিম আমার সামনে থাকলে আমি কি এরূপ পর্যালোচনা করতে পারতাম।
আর প্রকৃত মুহাসাবা এই যে, আখিরাতের আদালতে আহকামুল হাকিমীনের সামনে (যদি আমাকে প্রশ্ন করা হয়) আমি কি আমার এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করতে পারব?
এভাবে মুহাসাবা করা হলে বিনা গবেষণায় বা অসম্পূর্ণ গবেষণার ভিত্তিতে পর্যালোচনা বা না-ইনসাফীর সাথে পর্যালোচনা বন্ধ হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাকে ও আমাদের সকলকে নিজের মুহাসাবা করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
টীকা :
* তাকসীমে সাবয়ী অর্থ সাত প্রকারে বিভক্তকরণ। সম্ভবত মুহাদ্দিস ইবনুল সালাহ রাহ. (৬৪৬ হি.) সর্বপ্রথম এই ধারণা প্রকাশ করেন যে, সহীহ হাদীস সাত প্রকার এবং প্রত্যেক উপরের প্রকার নীচের প্রকারের চেয়ে তুলনামূলক বেশি সহীহ। প্রকারগুলো এই-
১. যে হাদীস সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম দুই কিতাবেই আছে।
২. যা শুধু সহীহ বুখারীতে আছে।
৩. যা শুধু সহীহ মুসলিমে আছে।
৪. যা এই দুই কিতাবে নেই তবে এই দুই কিতাবের মানদন্ডে সহীহ।
৫. শুধু বুখারীর মানদন্ডে সহীহ।
৬. শুধু মুসলিমের মানদন্ডে সহীহ।
৭. যা না এই দুই কিতাবে আছে, না এই দুই কিতাবের মানদন্ডে সহীহ। তবে অন্য কোনো ইমাম একে সহীহ বলেছেন।-মুকাদ্দিমাতু ইবনিস সালাহ পৃ. ১৭০
হিজরী সপ্তম শতকে সহীহ হাদীসের এই প্রকারভেদ অজুদে আসার পর অনেক লেখক নিজ নিজ কিতাবে তা উদ্ধৃত করেছেন। তবে অনেক মুহাক্কিক মুহাদ্দিস বাস্তবতা বিচার করে বলেছেন, এই প্রকারভেদ উসূলে হাদীসের আলোকে সহীহ নয়। সহীহ হাদীসের শ্রেণী ও পর্যায় নির্ধারিত হবে ছিহহতের শর্ত ও বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে, বিশেষ কোনো কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। যেমন অনেক হাদীস শুধু সহীহ বুখারীতে আছে, সহীহ মুসলিমে নেই, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা মুসলিমের মানদন্ডেও সহীহ। এ ধরনের হাদীসকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে নেওয়ার কী অর্থ? তেমনি কোনো হাদীস বুখারীতে নেই, শুধু মুসলিমে আছে, কিন্তু তার সনদ এমন যে, তা ইমাম বুখারীর নিকটেও সহীহ। এ হাদীসকে তৃতীয় শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা কি অর্থহীন নয়? তদ্রূপ যেসব হাদীস উভয় ইমামের মানদন্ডে সহীহ সেগুলো কি শুধু এই দুই কিতাবে সংকলিত না হওয়ার কারণে চতুর্থ শ্রেণীতে চলে যাবে?
মোটকথা, এই প্রকারভেদকে শাস্ত্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। অনেক আহলে ইলমের মতো নিকট অতীতের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস আহমদ শাকির রাহ.ও (মৃত্যু : ১৩৭৭ হি.) এই তাকসীমের কঠোর সমালোচনা করেছেন। দেখুন : মুসনাদে আহমদে সহীফায়ে হাম্মাম ইবনে মুনাবিবহের উপর তার ভূমিকা, খন্ড ৮ পৃষ্ঠা : ১৮২।
** ইমাম আবু বকর মুহাম্মাদ ইবনে মূসা আলহাযেমী রাহ. (৫৪৮ হি.-৫৮৪ হি.) ‘আলইতিবার ফিন নাসিখি ওয়াল মানসূখি মিনাল আছার’ কিতাবে (খন্ড : ১, পৃষ্ঠা ১৩২-১৬০) পঞ্চাশটি উজুহূত তারজীহ (অগ্রগণ্যতার কারণ) উল্লেখ করেছেন, যেগুলোর দ্বারা দুই মুখতালিফ (বাহ্যত পরস্পর বিরোধী) হাদীসের মধ্যে অগ্রগণ্য নির্ধারণে সহযোগিতা নেওয়া হয়।
এই পঞ্চাশ কারণের মধ্যে একটি কারণও এই বলেননি যে, দুই মুখতালিফ হাদীসের মধ্যে একটি বুখারী বা মুসলিমে আর অন্যটি অন্য কোনো হাদীসের কিতাবে থাকলে বুখারী-মুসলিমেরটি অগ্রগণ্য হবে!!
সাধারণত অগ্রগণ্যতা নির্ধারিত হয় অগ্রগণ্যতার কারণ ও বৈশিষ্ট্যের নিরিখে; কোনো বিশেষ কিতাবে থাকা বা না থাকার ভিত্তিতে নয়। মুজতাহিদ ইমামগণ কখনো কিতাবের ভিত্তিতে অগ্রগণ্যতার ফয়সালা করতেন না। হাদীস-সুন্নাহ এবং ফিকহে ইসলামী সংকলিত হওয়ার অনেক পরে এই নীতি সৃষ্টি হয়েছে যে, অমুক অমুক কিতাবকে হাদীস অনুসরণের ভিত্তি বানাও। অথচ এর দ্বারা অনেক সহীহ ও হাসান হাদীস বর্জিত হয়ে যায়।
*** নিঃসন্দেহে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি অভ্যাস জামাল ও কামালে পরিপূর্ণ। এসব বিষয়ে সাধ্যানুযায়ী তাঁর সাথে সামঞ্জস্য সৃষ্টি করা মহবতের দলীল এবং ছওয়াব ও বরকতের কারণ। কিন্তু মূল অনুসরণের ক্ষেত্র তো সুন্নতে হুদা। সুন্নতে হুদার বিষয়ে (যাতে আদাব অংশটিও শামিল) শিথিলতা করে নিছক অভ্যাসগত বিষয়াদিতে মুশাবাহাত-সামঞ্জস্য ইখতিয়ার করা এক ধরনের ধোকাও হতে পারে। উল্লেখ্য, দাড়ি লম্বা রাখা সুন্নতে হুদার গুরুত্বপূর্ণ বিধান এবং ওয়াজিব পর্যায়ের আমল।