তালীমী সালের শেষে তালিবে ইলম ভাইদের খেদমতে
জানি না আমার তালিবে ইলম ভাইয়েরা কখনো ভেবেছেন কি না যে, বছরের পড়া সম্পন্ন হোক না হোক, বছর শেষ হয়ে যায়। তাই বছর শেষ হওয়া আর বছরের পড়া শেষ হওয়া একটি অপরটির জন্য অনিবার্য। এ কারণে পুরা দরসে নেযামীর সময় শেষ হয়, কিন্তু নেসাব শেষ হয় না। কখনো নেসাব শেষ হয়, কিন্তু প্রত্যাশিত যোগ্যতা অর্জিত হয় না। আবার কখনো কিতাবী ইসতিদাদ পয়দা হয়, তবে তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও রুসূখ ফিল ইলম পয়দা হয় না এবং আদব-আখলাকও পয়দা হয় না।
ইলমের জন্য চাই আকল ও বুদ্ধি, হিলম ও সহিষ্ণুতা; চাই আদব ও তাওয়াযূ এবং তাকওয়া ও তহারাত। এই সকল গুণ আগেও কম ছিল, তবে ঐ সময় আলোচনা ছিল। আর এখন তো আলোচনাও কমে গেছে।
সমঝদার তালিবে ইলম নিজের মুহাসাবা করতে থাকে। সে কখনো বছর শেষ হওয়াকে বছরের প্রত্যাশিত উন্নতির-ইলম-আমল, প্রজ্ঞা ও সচেতনতা এবং বিনয় ও গাম্ভীর্য অর্জিত হওয়ার সমার্থক মনে করে না। সে তো বাস্তব অবস্থার বিচার করে যে, কী পরিমান হাসিল হল, আর কী পরিমাণ হাসিল হওয়ার প্রয়োজন ও সম্ভাবনা ছিল। সে না অহঙ্কারের শিকার হয়, কারণ ইলমের পরিধি সম্পর্কে তার ধারণা আছে, অজানার দিগন্তহীন বিস্তৃতির সামান্য আভাসই তার চিন্তাকে অহঙ্কার থেকে দূরে রাখে। আর না সে হীনম্মন্যতার শিকার হয়, কারণ সে জানে, তার নিসবত ও মানসিব, তার আসন ও সম্বন্ধ হচ্ছে সর্বোচ্চ আসন, সর্বোৎকৃষ্ট সম্বন্ধ। তার দৃঢ় বিশ্বাস আছে-مَنْ جَدَّ وَجَد যে চেষ্টা করে সে পায়-এই শাশ্বত ও স্বাভাবিক নিয়মের উপর। আর সে উপলব্ধি করে, যে জাতির সামনে আল্লাহ রাববুল আলামীন খোলা রেখেছেন আত্মোন্নতির রাজপথ, দান করেছেন পরম পথনির্দেশ, ঐ জাতির কোনো সদস্য শুধু তখনই হীনম্মন্যতার শিকার হতে পারে যখন সে হয় নিতান্ত নির্বোধ এবং চরম অকৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাআলা যাকে চিন্তাশক্তি দান করেছেন এবং শোকর গোযারির রাস্তা দেখিয়েছেন সে কখনো এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে না।
অকস্মাৎ মনে হল, বছর শেষের এই উপলক্ষ্যে তালিবে ইলম ভাইদের সাথে কেন কিছু কথা দিল খুলে বলছি না? আশা করি, তারাও কথাগুলো হৃদয় দিয়ে শুনবেন এবং গুরুত্বের সাথে নিজের জীবনে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেন।
১. আলহিলমু ওয়াল আনাত (স্থিরতা ও সহিষ্ণুতা)
এই দুটি বৈশিষ্ট্য জীবন চলার পথে খুবই প্রয়োজনীয়। ইলমের আমানত যারা বহন করেন তাদের জন্য তো তা আরো বেশি জরুরি। মূলে এ দুটি গুণ যেহেতু স্বভাবগত তাই কারো মনে হতে পারে, এগুলো গায়রে ইখতিরয়ারী, এখানে চেষ্টার কোনো ভূমিকা ও সার্থকতা নেই। এই ধারণা সঠিক নয়। প্রচেষ্টার দ্বারা এই দুই গুণেরও বিকাশ ও বর্ধন হতে পারে এবং হয়।
যেসব তালিবে ইলম মোটামুটি মেহনত করে, ইমতিহানে ভালে নম্বরও পায় তাদের অধিকাংশেরই যে কিতাবী ইসতিদাদ পয়দা হয় না বা নাকিস থাকে আমার ধারণায় এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে ‘উজলত’ ও চঞ্চলতা এবং ‘লা-উবালী’ ও দায়িত্বহীনতা। যার মাঝে স্থিরতা ও সহিষ্ণুতা আছে সে কখনো চিন্তাভাবনা ছাড়া হরকত ও ইরাব লাগাবে না। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া তারকীব বলবে না, তরজমা ও মতলব বয়ান করবে না। এটা খুবই কম হবে যে, না বুঝেও সে বুঝেছে বলে মনে করবে, কিংবা ভুল বা অসম্পূর্ণ বুঝেও সঠিক ও পুরাপুরি বুঝেছে মনে করবে।
আজকাল তালিবে ইলমদের মাঝে-আমার উদ্দেশ্য ঐসব তালিবে ইলম, যারা ‘ভালো ছাত্র’ হিসেবে পরিচিত-এই রোগের বিস্তার খুব বেশি। তারা অসম্পূর্ণ বুঝে এমনকি না-বুঝে বা ভুল বুঝেও আশ্বস্ত হয়ে যায় যে, বিষয়টি তারা বুঝেছে। চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তরজমা করে ফেলে অথচ এই অনুভূতিও নেই যে, ভুল বলা কেমন দায়িত্বহীনতা। যা মনে আসে, দ্বিতীয়বার চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই তা লিখে দেয় বা বলে দেয়!
চিন্তা করবে কীভাবে? চিন্তারও তো কিছু নিয়ম আছে, সূত্র আছে। তারা না এই সূত্রগুলো জানে, না জানার চেষ্টা করে।
এই তালিবে ইলমরা যদি চঞ্চলতা ত্যাগ করে নিজের বুঝকে বিচার করে এবং তাদের মাঝে এই অনুভূতি সৃষ্টি হয় যে, তারা ইলমের আমানতের বাহক তাহলে ইনশাআল্লাহ সঠিক বোঝার যোগ্যতা তাদের মাঝে পয়দা হবে। অশুদ্ধ বা অসম্পূর্ণ বুঝে সন্তুষ্ট হওয়ার রোগও ধীরে ধীরে দূর হবে।
স্থিরতা ও সহিষ্ণুতা প্রত্যেক পর্যায়ের তালিবে ইলমের জন্য প্রয়োজন। প্রত্যেকে নিজের ইলম অন্বেষণ এবং বহছ ও তাহকীকের ক্ষেত্রে এই গুণের সহযোগিতা নিতে পারে। যেসব তালিবে ইলম তালীম ও ইফাদার ময়দানে প্রবেশ করেছেন তাদের জন্য হিলম ও তাআন্নি তথা স্থিরতা ও সহিষ্ণুতার প্রয়োজন আরো বেশি।
তো আমার প্রথম দরখাস্ত এই যে, আগামীর জন্য দৃঢ় সংকল্প করুন, ইলম আহরণ এবং ইলম বিতরণের কোনো পর্যায়েই আমি চঞ্চলতার শিকার হব না এবং দায়িত্বহীনতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করব না; বরং আমি ধীর-স্থিরভাবে পথ চলব এবং সকল বিষয়ে সততা ও দায়িত্ব-জ্ঞানের পরিচয় দিব।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)