নবী-আদর্শের অনুসরণে মর্মান্তিক অবহেলা বড় বড় সুন্নত পরিত্যক্ত, বহু সুন্নত নিষ্প্রাণ এরপরও ঈমান ও মুহববতের দাবি!
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
৫. মদ ও জুয়া
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
يا ايها الذين آمنوا انما الخمر والميسر والانصاب والازلام رجس من عمل الشيطان، فاجتنبوه لعلكم تفلحون، انما يريد الشيطان ان يوقع بينكم العداوة والبغضاء فى الخمر والميسر ويصدكم عن ذكر الله وعن الصلوة، فهل انتم منتهون. واطيعوا الله واطيعوا الرسول واحذروا، فان توليتم فاعلموا انما على رسولنا البلغ المبين.
(তরজমা) হে মুমিনগণ! মদ, জুয়া, মূর্তিপূজার বেদী ও ভাগ্য নির্ণায়ক শর ঘৃণ্য বস্ত্ত, শয়তানের কাজ। সুতরাং তোমরা তা বর্জন কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।
শয়তান তো মদ ও জুয়া দ্বারা তোমাদের মাঝে শত্রুতা ও বিদ্বেষ ঘটাতে চায় এবং তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণে ও সালাতে বাধা দিতে চায়। তবে কি তোমরা নিবৃত্ত হবে না।
তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর এবং সতর্ক হও। যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও তবে জেনে রেখো, স্পষ্ট প্রচারই আমার রাসূলের কর্তব্য।-সূরা মায়েদা (৫) : ৯০-৯২
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
الخمر أم الخبائث.
অর্থ : মদ সকল অনাচারের মূল।-আলমুজামুল আওসাত, তবারানী, হাদীস : ৩৮১০
অন্য বর্ণনায় আছে-
أم الفواحش.
সকল অশ্লীলতার মূল।-প্রাগুক্ত, হাদীস : ১১৩৭২, ১১৪৯৮
অন্য হাদীসে আনাস ইবনে মালেক রা. বলেন-
لعن رسول الله صلى الله عليه وسلم في الخمر عشرة : عاصرها، ومعتصرها، وشاربها، وحاملها، والمحمول إليه، وساقيها، وبائعها، وآكل ثمنها، والمشتري لها، والمشترى له.
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদের সাথে সংশ্লিষ্ট দশ ব্যক্তিকে লানত করেছেন : যে মদ (বানানোর জন্য রস) নিংড়ায়, যে নিংড়াতে বলে, যে মদ পান করে, যে তা বহন করে, যার নিকট বহন করে নেওয়া হয়, যে তা পান করায়, যে তা বিক্রয় করে, যে মদ বিক্রিত অর্থ ভোগ করে, যে মদ ক্রয় করে ও যার জন্য মদ ক্রয় করা হয়।-জামে তিরমিযী, হাদীস : ১৩৪১; ইবনে মাজাহ, হাদীস : ৩৩৮১
আর জুয়া হল ‘আকল বিলবাতিল’ তথা অন্যায়ভাবে পরস্ব গ্রাসের একটি মারাত্মক পন্থা এবং ধন-দৌলত ও মান-মর্যাদা বিনষ্ট করার এক শয়তানি হাতিয়ার। রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো এ কথাও বলেছেন-
من قال لصاحبه : تعال أقامرك فليتصدق.
যে অন্যকে বলে, চল জুয়া খেলি, সে যেন সদকা করে।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৬৫০
অর্থাৎ শুধু জুয়ার ইচ্ছা করলেও সদকা করা আবশ্যক।
৬. ধোঁকা ও প্রতারণা
ধোঁকা ও প্রতারণা হল ঈমান পরিপন্থী স্বভাব এবং নিচুতা ও মোনাফেকী।
হযরত আবু হুরায়রা রা.-এর বর্ণনা-
إن رسول الله صلى الله عليه وسلم مر على صُبْرة طعام، فأدخل يده فيها، فنَالَتْ أصابعُه بَلَلا. فقال : ما هذا يا صاحب الطعام؟ قال : أصابته السماء يا رسول الله! قال : أفلا جعلته فوق الطعام كي يراه الناس؟ مَنْ غَشَّ فليس مني.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন স্ত্তপ করে রাখা শস্যের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি স্ত্তপের ভেতর হাত প্রবেশ করালে আঙ্গুলগুলো ভিজে গেল। স্ত্তপের মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন- ব্যাপার কী? মালিক বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! বৃষ্টির পানিতে তা ভিজে গিয়েছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তবে তা উপরে রাখলে না কেন, যেন মানুষ তা দেখতে পায়? যে ধোকা দেয় সে আমার দলভুক্ত নয়।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১০২
মাকিল ইবনে ইয়াসার আলমুযানী রা. বলেন-
إني سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول : ما من عبد يسترعيه الله رعية، يموت يوم يموت وهو غاش لرعيته إلا حرم الله عليه الجنة.
আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, যাকে আল্লাহ দায়িত্বশীল বানান আর সে তার অধীনদের সাথে প্রতারণাকারী হিসেবে মৃত্যুবরণ করে তাহলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৭১৫০, ৭১৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২২৭ (১৪২)
অন্য বর্ণনায় আছে-
ما من أمير يلي أمر المسلمين، ثم لا يجهَدُ لهم وينصَح إلا لم يدخل معهم الجنة.
যে আমীর মুসলমানদের দায়িত্বশীল হয় কিন্তু তাদের জন্য মেহনত করে না, তাদের কল্যাণকামীও হয় না, সে তাদের সাথে জান্নাতে যাবে না।-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ২২৯ (১৪২)
৭. আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানের পরিপন্থী রায় প্রদান করা
কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী রায় দেওয়া অর্থাৎ শরীয়তের অকাট্য ও সর্বসম্মত বিধানের বিপরীতে কারো আইন বা রায়কে প্রাধান্য দেওয়া স্পষ্ট কুফর। আর এটাকে অন্যায় জেনে এবং নিজেকে অপরাধী মনে করে কোনো চাপ কিংবা অপারগতার কারণে করলে তা হবে ফিসক। তবে কেউ বিনা দ্বিধায় এমনটি করলে কিংবা ভালো বা বৈধ মনে করে করলে তা হবে পরিষ্কার কুফরি। এই ব্যক্তি ঈমানের গন্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
উসওয়ায়ে হাসানাহ অবলম্বন এবং নববী সুন্নাহ অনুসরণের অর্থ আমাদেরকে কুরআন থেকেই শিখতে হবে। এ সম্পর্কে কুরআনের ঘোষণা-
فلا وربك لا يؤمنون حتى يُحَكِّمُوك فيما شجر بينهم، ثم لا يجدوا فى انفسهم حرجا مما قضيت ويسلموا تسليما.
(তরজমা) কিন্তু না, আপনার প্রতিপালকের শপথ! তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের বিবাদ-বিসংবাদের বিচারভার আপনার উপর অর্পণ না করে; অতপর আপনার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাদের মনে কোনো দ্বিধা না থাকে এবং সর্বান্তঃকরণে তা মেনে নেয়।-সূরা নিসা (৪) : ৬৫
আরো ইরশাদ করেছেন-
وان احكم بينهم بما انزل الله ولا تتبع اهواءهم واحذرهم ان يفتنوك عن بعض ما انزل الله اليك، فان تولوا فاعلم انما يريد الله ان يصيبهم ببعض ذنوبهم، وان كثيرا من الناس لقسقون. افحكم الجاهلية يبغون ومن احسن من الله حكما لقوم يوقنون.
(তরজমা) (কিতাব নাযিল করেছি,) যেন তুমি আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী তাদের বিচার নিষ্পত্তি কর, তাদের খেয়াল-খুশির অনুসরণ না কর এবং তাদের সম্পর্কে সতর্ক হও, যাতে আল্লাহ যা তোমার প্রতি নাযিল করেছেন তারা তার কিছু থেকে তোমাকে বিচ্যুত না করে। যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে জেনে রেখো যে, তাদের কোনো কোনো পাপের জন্য আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দিতে চান এবং মানুষের মধ্যে অনেকেই তো সত্যত্যাগী।
তবে কি তারা জাহেলী যুগের বিধিবিধান কামনা করে। নিশ্চিত বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্য বিধান দানে আল্লাহর চেয়ে কে শ্রেষ্ঠ?-সূরা মায়েদা (৫) : ৪৯-৫০
৮. জাহেলিয়াতের রীতি-নীতির অনুসরণ
বিদআতের মতো জাহেলি রীতিনীতিও নববী সুন্নাহর সম্পূর্ণ বিপরীত। অতীত ও বর্তমান জাহেলিয়াত, তার প্রতীক ও বৈশিষ্ট্য সবকিছুই নববী সুন্নাহর পরিপন্থী ও বিরোধী বিষয়। জাহেলি রীতিনীতি অনেক বিদআত থেকেও মারাত্মক।
হাদীস শরীফে আছে-
أبعض الناس إلى الله ثلاثة : ملحد في الحرم، ومبتغ في الإسلام سنة الجاهلية، ومطلب دم امرء بغير حق ليريق دمه.
তিন শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর নিকট সবচেয়ে বেশি ঘৃণিত : হারাম এলাকায় পাপাচারকারী, মুসলমান হয়েও জাহেলি রীতি অন্বেষণকারী এবং অন্যায় রক্তপাতে সচেষ্ট ব্যক্তি।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৮৮২
জাহেলিয়াতের অনুসরণের সবচেয়ে মারাত্মক দিক হল বিজাতির সাদৃশ্য গ্রহণ। অমুসলিমদের প্রতীক ধারণ করা, তাদের আইন ও সংস্কৃতির অনুকরণ করা এবং বেশভূষা ও চালচলনে তাদের সাদৃশ্য অবলম্বন করা-সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত।
হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من تشبه بقوم فهو منهم
কেউ কোনো জাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করলে সে তাদেরই দলভুক্ত।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪০২৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ১৯৭৪৭; মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ৫১১৪
আজকাল মুসলিম দেশগুলোতে সভ্যতা-সংস্কৃতি, শিক্ষা-দীক্ষা, আইন-বিচার, রাজনীতি এবং বেশভূষা ও জীবন যাপনের পদ্ধতিতে পশ্চিমাদের যে অনুসরণ-অনুকরণ চলছে তা সরাসরি জাহেলি আদর্শের অনুসরণ।
এই অন্ধকার থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আল্লাহ তাআলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর সূত্রে আমাদেরকে শরীয়ত, সুন্নত, উসওয়ায়ে হাসানাহ এবং মীযান ও হিকমত দান করেছেন।
হায়! আমাদের কালিমা পাঠকারী ভাইয়েরা যদি এই সত্য উপলব্ধি করতেন! তারা যদি বুঝতেন যে, আল্লাহর কুরআন ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর ঈমান আনার অর্থই হল, বিদআত, নফসানিয়াত ও জাহিলিয়াতের অনুসরণের পরিবর্তে আল্লাহ তাআলার নাযিলকৃত শরীয়ত মোতাবেক এবং তাঁর রাসূলের সুন্নাহ ও উসওয়ায়ে হাসানা অনুযায়ী জীবন যাপন করা, যাতে রয়েছে আকীদা-ইবাদত থেকে নিয়ে দুআ ও যিকির পর্যন্ত, লেনদেন ও সামাজিকতা থেকে নিয়ে আচার-আচরণ পর্যন্ত, জন্মের আগ থেকে নিয়ে কবরে সমাহিত হওয়া পর্যন্ত, ব্যক্তি থেকে নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত, জাহের থেকে বাতেন
পর্যন্ত, হালাল ও হারাম থেকে নিয়ে আদব ও শৃঙ্খলা পর্যন্ত-সকল বিষয়ের বিধান ও নির্দেশনা।
رضيت بالله ربا، وبالإسلام دينا، وبمحمد نبيا.
আমি আল্লাহ তাআলাকে রব হিসেবে, ইসলামকে ধর্ম হিসেবে এবং মুহাম্মাদকে (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) নবী হিসেবে পেয়ে সন্তুষ্ট ও পরিতুষ্ট।
৯. কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুতে আঘাত করা
বিদায় হজ্বের ভাষণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছিলেন-
إن دماءكم وأموالكم وأعراضكم حرام عليكم، كحرمة يومكم هذا، في شهركم هذا، في بلدكم هذا. ألا إن كل شيء من أمر الجاهلية تحت قدمي هاتين موضوع.
অর্থ : নিশ্চয়ই তোমাদের জান-মাল, ইজ্জত-আব্রু তোমাদের উপর এমনই হারাম যেমন এই মাসে, এই শহরে আজকের এই দিনটি হারাম। জেনে রেখো, জাহেলিয়াতের সকল কিছু আমার এই দুই পায়ের নিচে পদদলিত।-সহীহ বুখারী, হাদীস : ৬৭; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৬৭৯
অন্য হাদীসে সায়ীদ ইবনে যায়েদ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
من أربى الربا الاستطالة في عرض المسلم بغير حق.
অন্যতম জঘণ্য সুদ হচ্ছে অন্যায়ভাবে কোনো মুসলমানের ইজ্জত-আব্রুতে হস্তক্ষেপ করা।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ১৬৫১; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৮৭৬
গীবত-শেকায়েত, মিথ্যা অপবাদ, গালিগালাজ, অপমান ও তাচ্ছিল্য ইত্যাদি সব কিছুই অন্যের মান-সম্মানে আঘাত করার বিভিন্ন পন্থা। সবগুলোই কবীরা গুনাহ এবং বাইতুল্লার অমর্যাদা করার মতো মারাত্মক অপরাধ।
১০. ঝগড়া-বিবাদ
প্রীতি ও সম্প্রীতি মুমিনের বৈশিষ্ট্য। মুসলিমের অন্তরে অন্য মুসলিমের প্রতি ভালবাসা থাকবে। নিজের জন্য যা পছন্দ করে, ভাইয়ের জন্যও তা-ই পছন্দ করবে। নিজের অধিকার বিসর্জন দিতে রাজি থাকবে, কিন্তু অন্য ভাইয়ের সামান্য অধিকার বিনষ্ট হওয়া পছন্দ করবে না। এ কারণেই অন্যের সাথে তার ঝগড়া-বিবাদ, মনোমালিন্য হবে না। কেউ ঝগড়া করতে চাইলে সে পিছু হটবে। কারণ তার জানা আছে, ঝগড়া-বিবাদ হারাম। আর পারস্পরিক সম্পর্ক নষ্ট করা অত্যন্ত খারাপ কাজ।
আবুদ দারদা রা.-এর বর্ণনা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
ألا أخبركم بأفضل من درجة الصيام والصلاة والصدقة؟ قالوا : بلى يا رسول الله. قال : إصلاح ذات البين، وفساد ذات البين هي الحالقة.
‘আমি কি তোমাদেরকে সিয়াম, সালাত ও সদকার মর্তবা থেকেও শ্রেষ্ঠ বিষয় সম্পর্কে বলব না?’ সবাই আরজ করলেন, ‘আল্লাহর রাসূল! অবশ্যই বলুন।’ তিনি বললেন, ‘বিবাদরতদের মাঝে শান্তি স্থাপন করা। আর জেনে রেখো, পরস্পর কলহ-বিবাদই তো মানুষকে মুড়িয়ে দেয়।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৭৫০৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ৪৯১৯; জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৫০৯
পরস্পরের সম্পর্ক নষ্ট করে-এমন সকল কাজ ও আচরণকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছেন। পাশাপাশি এমন অনেক সুন্নাহ জারি করেছেন, যার দ্বারা পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটে। এসব বিধান ও নির্দেশনা অনুসরণের ফলে সাহাবায়ে কেরামের মাঝে সাধারণত বিবাদ হত না। এরপরও কখনো দুই ব্যক্তি বা দুই গোত্রের মাঝে বিবাদ দেখা দিলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তৎক্ষণাৎ উপস্থিত হয়ে মীমাংসা করে দিতেন। মীমাংসা করা ও করানো ছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরামের এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাহ, যা আজ প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
পরস্পর কলহ-বিবাদ করা তো দূরের কথা, অপর মুসলিমের প্রতি মনে মনে বিদ্বেষ ও শত্রুতা পোষণ করাও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সুন্নাহর পরিপন্থী।
হাদীস শরীফে আছে-
عن أنس بن مالك رضي الله عنه قال لي رسول الله صلى الله عليه و سلم : يا بني إن قدرت أن تصبح وتمسي وليس في قلبك غش لأحد فافعل ثم قال لي : يا بني وذلك من سنتي ومن أحيا سنتي فقد أحبني ومن أحبني كان معي في الجنة.
رواه الترمذي في كتاب العلم، وقال: هذا حديث حسن غريب من هذا الوجه.
আনাস রা.কে সম্বোধন করে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘বেটা! সকাল-সন্ধ্যায় যদি এমনভাবে থাকতে পার যে, তোমার মনে কারো প্রতি বিদ্বেষ নেই তাহলে এভাবেই থাক। বেটা! এটি আমার সুন্নত। যে আমার সুন্নতকে যিন্দা করে সে আমাকে ভালবাসে। আর যে আমাকে ভালবাসে সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।’-জামে তিরমিযী, হাদীস : ২৬৭
সুন্নাহ ও উসওয়ায়ে হাসানাহ জানার জন্য কী অধ্যয়ন করব
এতক্ষণ নবী-আদর্শ থেকে উপকৃত হওয়া এবং নবী-সুন্নাহর অনুসরণ সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে দশটি মৌলিক কথা বলা হয়েছে এবং সুন্নাহর দশটি আদেশ ও দশটি নিষেধ নমুনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এই সংক্ষিপ্ত আলোচনাও যদি মনোযোগ সহকারে পাঠ করা হয় তাহলে ইনশাআল্লাহ আমরা বুঝতে পারব, ইলম ও আমল এবং চিন্তা ও ফিকির-সব দিক থেকেই আমাদের মাঝে সুন্নাহর প্রতি কত মারাত্মক অবহেলা রয়েছে।
জেনে রাখা ভালো যে, নববী সুন্নাহ সম্পর্কে জানার জন্য যেমন ‘সুন্নত’ শিরোনামের কিতাব-রিসালা পাঠ করা জরুরি তেমনি ঐসব কিতাবপত্রও পাঠ করা জরুরি; বরং বেশি জরুরি, যাতে ইসলামের পূর্ণ পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে, এবং ঈমানের সকল শাখা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। তাওহীদ, রিসালত, ইসলামী আকীদা এবং জরুরিয়াতে দ্বীনের বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। শিরক ও বিদআত এবং জাহেলি রসম-রেওয়াজের পরিচয় ও তা থেকে বেঁচে থাকার উপায় বলা হয়েছে। কবীরা গুনাহ ও অশ্লীলতার তালিকা, এসবের কুফল এবং পার্থিব ও পরকালীন ক্ষতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে। উত্তম গুণাবলির পরিচয় ও তা অর্জনের উপায় বলা হয়েছে। মন্দ আচরণ ও প্রবণতার পরিচয় এবং তা থেকে অন্তরকে পরিষ্কার করার উপায় উল্লেখ করা হয়েছে। লেনদেনের স্বচ্ছতা ও সামাজিকতার নিয়ম-নীতি উল্লেখ করা হয়েছে। লেনদেন ও সামাজিকতার ত্রুটিগুলোর সংশোধন করা হয়েছে। দ্বীন ও দুনিয়ার সকল অঙ্গন এবং দিন-রাতের সকল কাজে ইসলামী আদব ও নববী শামাইল ও আদর্শের শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। সকল বিষয়ে প্রচলিত ভুল ও হঠকারীদের প্রান্তিকতা সংশোধন করে সঠিক ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা পেশ করা হয়েছে।
যতক্ষণ আমরা এসকল বিষয়ে সুন্নাহর স্বচ্ছ ও গভীর জ্ঞান অর্জন করে নিজেদের জীবনে প্রয়োগ না করব ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সুন্নাহর অনুসরণ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে; বরং তা সুন্নাহ মোতাবেক হবে না।
এখানে শুধু কয়েকটি কিতাবের নাম উল্লেখ করা হল। ভবিষ্যতে সুযোগ হলে বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করা যাবে ইনশাআল্লাহ।
১. তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন।
২. তাফসীরে মাআরিফুল কুরআন।
৩. মাআরিফুল হাদীস, মাওলানা মুহাম্মাদ মানযুর নুমানী রাহ.
৪. রিয়াযুস সালেহীন, ইমাম নববী রাহ.
৫. আলআদাবুল মুফরাদ, ইমাম বুখারী রাহ.
৬. আলআযকার, ইমাম নববী। অথবা আলহিসনুল হাসীন, ইবনুল জাযারী
৭. নবীয়ে রহমত, মাওলানা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.
৮. উসওয়ায়ে রাসূলে আকরাম, ড. আবদুল হাই আরেফী রাহ.
৯. ইসলাম ক্যায়া হ্যায়?, মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নুমানী রাহ.
১০. ইসলাম মেরা মাযহাব, মাওলানা আবদুশ শাকুর লখনবী রাহ.
১১. তাকবিয়াতুল ঈমান, শাহ ইসমাঈল শহীদ রাহ.
১২. দ্বীন ও শরীয়ত, মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নুমানী রাহ.
১৩. দস্ত্তরে হায়াত, মাওলানা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.
১৪. আরকানে আরবাআহ, মাওলানা সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.
১৫. ইসলাহী নেসাব, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.
(এটি মূলত দশটি পুস্তিকার সংকলন, যাতে শুআবুল ঈমান সম্পর্কিত একটি পুস্তিকা আছে, যার নাম ‘ফুরূয়ুল ঈমান’।
১৬. ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মত, হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ.
১৭. ইসলাহী খুতুবাত, মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম। অথবা তাঁর কিতাব-‘ইসলাম আওর হামারি যিন্দেগী’, যা দশ খন্ডে প্রকাশিত।
১৮. ইসলাহী মাজালিস, মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম
১৯. যিকর ও ফিকির, মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী দামাত বারাকাতুহুম।
সমাজের সংশোধন সম্পর্কে অতি গুরুত্বপূর্ণ ও অনন্য কিতাব। সকল আলেম, তালিবে ইলম, ইমাম-খতীব, সাধারণ শিক্ষিত পাঠক ভাই মোটকথা, সকল শ্রেণীর মুসলমানের তা অধ্যয়ন করা উচিত। আর যারা পড়তে পারেন না তাদেরকেও পড়ে শোনানো উচিত। সামাজিকতা বিষয়ে ইসলামের যে আহকাম ও নববী সুন্নাহ আজ সমাজ থেকে হারিয়ে গেছে সে সম্পর্কে একটি সারগর্ভ ও দরদভরা প্রামাণিক কিতাব।
২০. হালাল ওয়া হারাম, মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানী।