থেকে যাওয়া অধ্যায়গুলোর প্রতি অধিক মনোযোগী হোন
মাদরাসাগুলোতে শিক্ষাবর্ষের তৃতীয় ও শেষ ছে-মাহী শুরু হয়েছে। দাওরা-মিশকাতের ছাত্রদেরকে এখন আগের তুলনায় অনেক বেশি সময় সবকের জন্য দিতে হবে। একদিকে আছে নেসাব সমাপ্তির বিষয়, অন্যদিকে বেফাক পরীক্ষার প্রস্ত্ততি। সাধারণত দেখা যায়, এ সময় হাদীসের কিতাবসমূহের যে অধ্যায়গুলো পড়ানো হয় তার প্রতি তলাবায়ে কেরাম বিশেষ মনোযোগ দিতে পারেন না। অথচ এইসব অধ্যায়ের হাদীসগুলোর শিক্ষা শুধু তালিবে ইলমের জন্যই নয়; প্রত্যেক মুসলমানের পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ও মুহূর্তে প্রয়োজন। এসব হাদীসের সঠিক উপলব্ধি ও অনুসরণের দ্বারাই একজন মুসলিমের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন জীবন সুন্দর হতে পারে। আর এর মাধ্যমেই সুন্নাহর অনুসারী আদর্শবান উম্মত হওয়া যেতে পারে। আজকের তালিবে ইলম আগামীকালের শিক্ষক। ‘হুজুর’ নামেই তারা অধিক পরিচিত। তারা যদি কিতাব-সুন্নাহ, আদব, যুহদ, রিকাক, ঈমান বিলআখিরাহ, ফাযায়েল-মানাকিব, দুআ-দরূদ, যিকর এবং শামায়েল ও সীরাতের এই হাদীসগুলোর শিক্ষা আয়ত্ত করতে না পারেন এবং সে অনুযায়ী নিজের চিন্তা-চেতনা, মন-মানসিকতা, লেবাস-পোষাক, কথা ও কর্ম, যাহির-বাতিন ও আচার-আচরণ প্রস্ত্তত করতে না পারেন তাহলে তিনি ইসলাম ও নবীয়ে ইসলামের কেমন মুখপত্র হবেন? লোকজন হুজুরকে দ্বীনের মুখপত্র মনে করে এবং দাওরা সমাপনকারী মৌলবীদেরকে হুজুর ও আলেম মনে করে থাকে। মানুষের ধারণা পরিবর্তন করার সাধ্য আমাদের নেই। যতই বলা হোক, মাদরাসায় পড়ুয়া সব অক্ষরজ্ঞানীই মৌলবী নয়, সব মৌলবী আলেম নয়, আবার সকল আলেমই ঐ ফকীহ আলেম নয়, যার সম্পর্কে হাদীস শরীফে ঘোষণা হয়েছে- العلماء ورثة الأنبياء এতে সাধারণ মানুষের ধারণা পরিবর্তন হয় না। সাধারণ মানুষ সর্বাবস্থায় লেবাস ও নেসাবের হুজুরকেই হুজুর মনে করে। সব হুজুরকেই আলেম এবং সব আলেমকে নবীর ওয়ারিস ও ইসলামের মুখপত্র মনে করে। এজন্য আমরা যদি নিজেদেরকে চিন্তা-চেতনা, আচরণ-উচ্চারণ, লেনদেন-সামাজিকতা ইত্যাদি সকল বিষয়ে ইসলামী শিক্ষা ও নববী সুন্নাহর নমুনা বানাতে না পারি তাহলে আমরা শুধু নিজেদেরই ক্ষতি করব না; আমাদের পদবি ও সমাজেরও বদনাম করব, যা একটি আলাদা গুনাহ ও মারাত্মক অপরাধ। মন-মানসিকতা এবং জীবন ও কর্মে বিপ্লব আনয়নকারী এ হাদীসগুলো মনোযোগহীনতায় চলে যাওয়া উচিত নয়। এসব হাদীসের বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল অর্থ জানা, এর নির্দেশনা ও দাবি ভালোভাবে আত্মস্থ করা এবং নিজের জীবনকে তার আলোকে পর্যবেক্ষণ করা খুব জরুরি। হিফয ও তাকরারের সুবিধার্থে একটি সংক্ষিপ্ত মুযাক্কিরা (নোট খাতা) রাখা উচিত, যাতে কমপক্ষে বর্ণনাকারী সাহাবীর নাম, হাদীসের পূর্ণ পাঠ এবং কিতাবের নাম লেখা থাকবে। কোনো হাদীস সম্পর্কে উস্তাদ কোনো নুকতা বললে তা-ও সংক্ষেপে নোট করা উচিত। এটা ঠিক যে, এই অল্প সময়ে এ সকল কাজ সকল তালিবে ইলমের পক্ষে করা সম্ভব নয়। তবে এটুকু তো অবশ্যই করতে হবে যে, এসব অধ্যায়ের অধীনে যে সকল পরিচ্ছেদ ও অনুচ্ছেদ আছে কমপক্ষে তার শিরোনাম মনে রাখার চেষ্টা করি। আর অন্তত দু-একটি কিতাব যেমন-সহীহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ থেকে সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলো একটু মনোযোগসহ পড়ার চেষ্টা করি এবং ভবিষ্যতের জন্য এই নিয়ত করি যে, আমাদের দায়িত্বে হাদীসের দরস আসুক বা না আসুক নিজেকে আমি হাদীসের দরস দিতে থাকব এবং বিশেষ করে উপরোক্ত অধ্যায়ের হাদীসগুলো মনোযোগের সাথে বার বার পাঠ করব। পাশাপাশি এসব হাদীসের তাফাক্কুহ অর্জন এবং নিজের জীবনকে ঐ আলোয় আলোকিত করার জন্য আকাবির ও আসলাফের এ বিষয়ক কিতাব অধ্যয়ন করব। উদাহরণস্বরূপ নিম্নে বর্ণিত কিতাবগুলো বা তার কয়েকটি কিংবা এ ধরনের অন্য কোনো কিতাব অবশ্যই মুতালাআ করব। ১। ‘ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন’, আবু হামিদ গাযালী (মৃত্যু : ৫০৫ হিজরী)। এর মুখতাসার হল- المهذب من إحياء علوم الدين যা শায়খ সালেহ আহমদ শামীর লিখিত, ইনশাআল্লাহ এটি বেশি উপকারী হবে। إتحاف السادة المتقين بشرح أسرار إحياء علوم الدين মুরতাজা আযযাবীদি হানাফী (মৃত্যু : ১২০৫ হিজরী) فيض القدير شرح الجامع الصغير আবদুর রউফ আলমুনাভী الفتوحات الربانية شرح الأذكار النواوية ইবনে আল্লান ৫। ‘আদাবুদ দুনইয়া ওয়াদ দ্বীন’, আবুল হাসান আলমাওয়ারদী ৬। ‘আলআদাবুশ শারঈয়াহ’, ইবনে মুফলিহ। ৭। ‘আলআদাবুল মুফরাদ’, ইমাম বুখারী রাহ. ও এর শরহ ‘ফাযলুল্লাহিস সামাদ’। ৮। ‘মিন মায়ীনিশ শামাইল’, সালেহ আহমদ শামী। ৯। ‘মাআরিফুল হাদীস’, মাওলানা মুহাম্মাদ মনযূর নুমানী রাহ.। (হাদীস ও সীরাতের ইলম যিন্দা রাখার জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং সুন্নাহ-বিলমা’নাল আম-অনুসরণের প্রেরণা জাগ্রত রাখার ক্ষেত্রে অতুলনীয় কিতাব। ১০। হায়াতুস সাহাবা, মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ কান্ধলবী রাহ. ১১। খুতুবাতে হাকীমুল উম্মত ১২। মালফুযাতে হাকীমুল উম্মত ১৩। ইসলাহে ইনকিলাবে উম্মত, হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ. ১৪। ইসলাহী মাজালিস, মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী মুদ্দা যিল্লুহুল আলী ১৫। ইসলাহী খুতুবাত, মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী মুদ্দা যিল্লুহুল আলী ১৬। দস্ত্তরে হায়াত, হযরত মাওলানা সাইয়্যেদ আবুল হাসান আলী নদভী রাহ. ১৭। ইসলাম মেরা মাযহাব, মাওলানা আবদুশ শাকূর লাখনবী ১৮। ইসলাম ক্যায়া হ্যায়? মাওলানা মুহাম্মাদ মনযুর নুমানী রাহ. ১৯। দুনিয়া কী হাকীকত, মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ. ২০। আছরে হাযির হাদীসে নববী কে আয়নে মে, মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ লুধিয়ানভী রাহ. ২১। যিকর ও ফিকর, মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উছমানী মুদ্দা যিল্লুহুল আলী। তলাবায়ে কেরাম সাধারণত এসব অধ্যায়ের হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা খোঁজ করেন হাদীসের প্রচলিত ও সহজলভ্য শরহগ্রন্থগুলোতে। তাতে সন্তোষজনক তথ্য ও আলোচনা না পেলে পেরেশান হন। এই সমস্যার সমাধান এটাই যে, প্রচলিত ও সহজলভ্য শরহগুলোর পাশাপাশি উল্লেখিত কিতাবের শরণাপন্ন হওয়া। আর এগুলোর কোনো কোনোটিকে তো নিজের নিয়মিত মুতালাআর সূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। তিরমিযী দ্বিতীয় খন্ড অধ্যয়নকারীরা হয়তো লক্ষ্য করে থাকবেন, মাওলানা আবু সাবের আবদুল্লাহ ছাহেবের ‘আওনুত তিরমিযী’তে বিভিন্ন বাবের হাদীসগুলোর ব্যাখ্যার জন্য অধ্যায়ের বিষয়বস্ত্তর সাথে সংশ্লিষ্ট নমুনাস্বরূপ আকাবিরের আলাদা কিছু কিতাবের সহযোগিতা নিয়েছেন এবং তা থেকে প্রয়োজনীয় ও নির্বাচিত কিছু অংশ তুলে দিয়েছেন। এটি এমন একটি বৈশিষ্ট্য, যার কারণে এই শরহ তলাবাদের জন্য মাশাআল্লাহ বেশ উপকারী হয়েছে। সবশেষ আবেদন এই যে, উপরোক্ত আদব, নির্দেশনা ও শিক্ষার আমলী অনুশীলনের জন্য অপরিহার্য হল আহলে ফিকহ ও আহলে দিল বুযুর্গদের সান্নিধ্য। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পরিপূর্ণ তাওফীক দান করুন। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন।