না রী : কন্যার পিতা কারাগারে
খবরের শিরোনাম-‘নাটোরে মেয়েকে বাল্যবিয়ে দেওয়ায় বাবার কারাদন্ড।’ ঘটনাটি ২৭ এপ্রিলের। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে পরের দিন। মূল খবরটি হচ্ছে, নাটোর সদরের বলিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষক জামালউদ্দিন তার কিশোরী মেয়ে জেসমিন আক্তার (১৪)-এর সঙ্গে শহরের বনবেলঘড়িয়া এলাকার মিলন হোসেনের বিয়ের কাবিননামার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার আয়োজন চূড়ান্ত করেছিলেন। দুপুরে বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। খবর পেয়ে পুলিশ মেয়ের বাবা জামালউদ্দিনকে নাটোর থানায় নিয়ে যায়। বিকালে ভ্রাম্যমান আদালত তাকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড দেয়। এদিকে মেয়ের বাবাকে থানায় নিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে ছেলেপক্ষ আর বিবাহ অনুষ্ঠানে যায়নি।
এরকম ঘটনার খবর পত্রিকায় নতুন নয়। গ্রামগঞ্জে প্রায়ই এজাতীয় ঘটনা ঘটে। সেগুলো ছাপাও হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ‘বাল্যাবিয়ে’ শিরোনামে ঘটনাগুলোর খবর প্রকাশ পায়। এ খবরের ক্ষেত্রেও তেমনটি হয়েছে। তবে কথিত বাল্যবিয়ে আয়োজনের কারণে মেয়ের বাবার কারাদন্ডের ঘটনা কমই ঘটে। এখানে ঘটে গেছে। এ জাতীয় খবর পত্রিকায় দেখার পর পাঠকদের বড় একটি অংশের প্রতিক্রিয়া চলে যায় ওই বিয়ের আয়োজন ও মেয়ের অভিাভাবকদের বিরুদ্ধে। তারা উড়ন্ত একটি দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই ঢালাওভাবে কথিত বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তারা মনে করেন, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ায় মেয়েটার জীবন নষ্ট হচ্ছিল এবং মেয়ের অভিভাবকরা মস্তবড় একটা অন্যায় করছিল। কিন্তু ব্যাপারটি কি আসলেই সেরকম কিনা-ভেবে দেখা দরকার। কায়েকটি বিষয়ের পাশাপাশি এ জাতীয় ঘটনাকে বিশ্লেষণ করে দেখলে বুঝতে একটু সুবিধা হতে পারে।
প্রথম বিষয় হচ্ছে, দেশের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে কাউকে প্রাপ্তবয়ষ্ক গণ্য করা হয় না। সে হিসেবে ১৮-এর নিচে যে কারো বিয়েকে বাল্যবিয়ে বা অপ্রাপ্ত বয়ষ্কের বিয়ে হিসেবে ধরে সেটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করা হয়। যদিও সবাই জানেন, প্রকৃত বিবেচনায় একটি ছেলে বা মেয়ে ১৩-১৪ বছর বয়স থেকেই প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়ে যায়। অবশ্য তখনও প্রাপ্তবয়ষ্কতার পরিপক্কতা এবং ওই বয়সেই তাদের বিবাহিত জীবনে প্রবেশের উপযুক্ততা বিষয়ে দ্বিধা-সংশয় থাকতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু নিরাপত্তার দিক থেকে দেশের ও সমাজের পরিস্থিতি বর্তমানে কেমন-এটাও তো এসঙ্গে ভেবে দেখা উচিত। ধর্ষণ, ইভটিজিং এবং দেশজুড়ে মেয়েদের জীবন ও সম্ভ্রমের অনিরাপত্তার বিষয়টি তো সবাই জানেন। প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় বহু মেয়ের জীবনে সর্বনাশ ঘটার খবর ছাপা হচ্ছে। ইভটিজিংয়ের কারণে এদেশে বহু কিশোরী মেয়ে গত দু’বছরে অত্মহত্যা করার পথ বেছে নিয়েছে। শহর-গ্রাম সব জায়গায় বখাটেদের উৎপাত পুরোদস্ত্তর চলছে। এ পরিস্থিতিতে কোনো কিশোরী মেয়েকে (প্রকৃত বিবেচনায় যে মেয়েটি প্রাপ্তবয়ষ্ক এবং নারী হিসেবে এ সমাজ যার নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব নেয় না) যদি তার দরিদ্র কৃষক পিতা উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিতে চান, তাহলে তার ‘নথিগত অপরাধ’ দেখা হবে না-কি দেখা উচিত তার ‘সমাজ বাস্তবগত অপারগতা’-এটা আইন প্রণেতা ও সমাজকর্তারা অরেকটু ভেবে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, ইসলামী শরীয়তে প্রাপ্তবয়ষ্কদের (১৮ বছর পূরণের শর্তে নয়-প্রকৃত ও শারীরিক গঠনের বিবেচনায়) স্বেচ্ছায় বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার অনুমতি দিয়েছে। সে ক্ষেত্রে পরিবারের অভিভাবকদের আয়োজনে সেটা হলে আরো সুন্দরভাবেই সেটা সম্পন্ন হচ্ছে বলে মনে করা যেতে পারে। তার পরও একথা মনে রাখা উচিত যে, প্রাপ্তবয়ষ্কতার শুরুতেই বিয়েতে যেতে বাধ্য করে না ইসলামী শরীয়ত। একই সঙ্গে এটাও সঠিক যে, শরীয়ত কেবল শারীরিক প্রাপ্তবয়ষ্কতা নয়-শারীরিক-মানসিক প্রাপ্তবয়ষ্কতা ও পরিপক্কতার পরই বিয়েতে যেতে উৎসাহিত করে। কিন্তু যে সমাজে নারীর জীবন ও সম্ভ্রমের নিরাপত্তার বিষয়টি প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে এবং সামাজিক নিরাপত্তার কোনো দৃঢ় আবহই যেখানে অবশিষ্ট নেই সেখানে ১৮ বছর বয়সের শর্ত পূরণ না হলে চতুর্দশী কন্যার পিতাকে জেলে পাঠানোর মতো ঘটনায় মন বিষন্ন হয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, এখানে কোন বিষয়টির প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত-নারীর জন্য পূর্ণ সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায়-নাকি কথিত বাল্যবিয়ে বিষয়ক আইনের কঠোর প্রয়োগে?
তৃতীয় বিষয়টি হচ্ছে, সন্তানের প্রতি এ দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি মমতাবান হচ্ছেন তার মা-বাবা। এটাই স্বাভাবিক চিত্র। সন্তানের নিরাপত্তা ও কল্যানের চিন্তা তারাই সবচেয়ে বেশি করে থাকেন। নাটোরের বালিয়াডাঙ্গার কৃষক জামালউদ্দিন তার চতুর্দশী কন্যার বিয়ের আয়োজন করে কারাদন্ড পেলেন। তার মেয়ে ১৮ বছরের কম বয়সী হওয়ায় দেশীয় আইনে তিনি ‘অপরাধ’ করেছেন। মাসখানেক হয়তো তিনি কারাগারে থাকবেন। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, তার চোখে এখন অশ্রু ঝরছে। আর সে অশ্রু তার কারাদন্ড প্রাপ্তির নয়, তার মেয়েটির বিয়ে ভেঙ্গে যাওয়ার কষ্টের।
তাই আমরা সমাজের নীতিনির্ধারক, আইনপ্রণেতা এবং আইন ও বিচার সংশ্লিষ্ট সব সুধীজনের কাছে অনুরোধ করব এ বিষয়ক আইনটি নিয়ে পুনবির্বেচনা করার। অন্তত এ আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সার্বিক দিক বিবেচনা করে পদক্ষেপ নেওয়ার। সর্বোপরি এ জাতীয় ঘটনার জন্য আদালতগুলোতে সুচিন্তা ও সহানুভূতিশীলতা ভিত্তিক একটি বিশেষ সেল গঠন করার অনুরোধ আমরা রাখতে পারি।
একটি সমাজে বিরাজমান পরিস্থিতি ও বাস্তবতার চারদিক সামনে না নিয়ে কেবল এক দিকে কঠোর হলে সমাজে প্রচন্ড ভারসাম্যহীনতা দেখা দিতে পারে। দুর্বল রশিতে শক্ত গিট্টু তো দেওয়া যায় না। আর সেটা কারো জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে না।