জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৩   ||   মে-২০১২

পার্বত্য চট্টগ্রাম : ষড়যন্ত্রের অন্যরূপ

মাওলানা আবদুল মজীদ

অনেক ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতামত ও প্রবন্ধ পড়ে জেনে আসছি যে, বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান) নিয়ে দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং হচ্ছে। এবার তার খানিকটা যেন নিজের চোখেই দেখে এলাম।

৬ জুমাদাল উলা ১৪৩৩ হিজরী, মোতাবেক ৩০ মার্চ ২০১২ শুক্রবার, আমাদের সফর শুরু হল। জামাতে আমরা ১৮জন ছিলাম। কাকরাইল মসজিদে ইশার নামায ও হেদায়েতী কথার পর রাতের বাসে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা হলাম।

কাকরাইল মসজিদের জায়গাটির উপর আমার ঈর্ষা হয়। শত শত মানুষ এখানে এসে আল্লাহর ইবাদত করে। আবার এখান থেকেই ঈমানের দাওয়াত নিয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। কত মানুষ যে এখান থেকে দ্বীনের ফিকির পেয়েছেন, নতুন ঈমানী জীবন পেয়েছেন, দ্বীনের জন্য কুরবানীর চেতনা পেয়েছেন তার হিসাব তো একমাত্র আল্লাহ রাববুল আলামীনের কাছেই আছে। আমাদের প্রতিটি মসজিদকে আল্লাহ তাআলা আবাদ করে দিন এবং দাওয়াত ও হেদায়েতের কেন্দ্র বানিয়ে দিন। আমীন।

ফজরের নামায আদায় করলাম খাগড়াছড়ি জেলার এক সেনাক্যাম্পে। সকাল সাতটায় জেলা শহরের কেন্দ্রে নেমে নিকটবর্তী এক মসজিদে উঠলাম। অযু-ইস্তিঞ্জার পর নাশতা। ইশরাকের পর জিপযোগে দুর্গম পাহাড়ি রাস্তায় প্রায় ৩৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছলাম খাগড়াছড়ি জেলার সীমান্তের সাথে লাগোয়া রাঙ্গামাটি জেলার লংগদু থানার বাজারে। থানা মসজিদে দুই দিন থাকা হল। ভাইবোনছাড়া, ঝর্ণা-টিলা, ভাটেপড়া ও লংগদু বাজার-এই চারটি জায়গাকে সামনে রেখে সাথীরা গাশত করলেন। দ্বীনী শিক্ষা বা দুনিয়াবী শিক্ষার মূলধারার সাথে এলাকাগুলোর চোখে পড়ার মতো কোনো যোগাযোগ নজরে এল না। উপজাতি ও বাঙ্গালী আলাদা দুটি দলে বিভক্ত। ব্যবসা-বাণিজ্যে বাঙ্গালিদের প্রাধান্য আর কৃষি ও বনজ সম্পদে উপজাতিদের প্রাধান্য বেশ চোখে পড়ল। 

 যে কারণে পার্বত্য জেলাগুলো চক্রান্তকারীদের বিচরণকেন্দ্র

হাদীস শরীফ থেকে বোঝা যায়, যারা মুসলমানদের মূল ভূখন্ড বা মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। নিরাপত্তাহীনতা যেমন জানমালের হয় তেমনি ঈমান-আমলেরও হয়। পার্বত্য জেলাগুলোর বিস্তীর্ণ অঞ্চল বৃটিশ সরকার, পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশ সরকার কোনো আমলেই জাতীয় উন্নতি ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থার অধীনে আসেনি। আধুনিক নাগরিকসেবার স্পর্শ এই এলাকাগুলো পায়নি। তেমনি দ্বীনী শিক্ষা বিস্তারের তৎপরতাও খুব কম। বলাবাহুল্য, ইলমের নূর ও ঈমানী মেহনত থেকে বঞ্চিত জায়গাগুলোই হয়ে ওঠে চক্রান্তকারীদের মিশন বাস্তবায়নের নিরাপদ ক্ষেত্র।

ঈমানের মূল্য পাঁচশত টাকা!

শনি ও রবিবার দুদিন লংগদু থেকে সোমবার যোহরের পর আমরা আমাদের মূল গন্তব্যের দিকে রওনা হলাম। স্থানটি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি থানায় অবস্থিত আমতলী ইউনিয়নের কবিরপুর গ্রাম। ২০০৩ সালে কবির নামে এক লোক অর্থের লোভে কাদিয়ানী হয়েছিল। তার পর এই কুচক্রিদের হাতে একে একে ৪০টি পরিবার ঈমানহারা হয়। তাদের আস্তানায় গিয়ে এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। আমাদের পূর্বসূরী-ইসলামের প্রথম শহীদ হযরত সুমাইয়া রা., তাঁর স্বামী হযরত ইয়াসির রা. যে ঈমানের দৌলত জীবন দিয়ে রক্ষা করেছেন, খাববাব, খুবাইব, মুসআব ও বিলাল চরম নির্যাতন সহ্য করেও সে সম্পদ হাতছাড়া করেননি। কাদিয়ানিরা সেই দৌলত এখানে মাত্র ৫০০/- টাকায় ক্রয় করছে।

২০০৩ সালে কবির সাহেব কাদিয়ানী হলেও ২০০৭ সালে তওবা করে ফিরে আসেন। কিন্তু যে অশুভ ধারার সূচনা ঐ সময়ে হয়েছিল তা দিন দিন জোরদার হচ্ছে। গুরু তওবা করলেও শিষ্যরা ঐ মিশনে তৎপর রয়েছে। কবির সাহেব একজন প্রভাবশালী মানুষ। তার নামেই গ্রামের নাম। এখন তিনি চরম রোগাক্রান্ত। তার সাথে অনেক কথা হল। তিনি তার এই পাপের জন্য  অনুতপ্ত।

কাকরাইলের মুরববীদের আল্লাহ তাআলা জাযায়ে খায়র দান করুন

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে উম্মতের ঈমান-আমলের হালত নিয়ে ভাবার মতো মানুষ দিন দিন কমছে। কারণ এর জন্য যেমন দরকার উম্মতের প্রতি সীমাহীন দরদ তেমনি দরকার যশ-খ্যাতি ও পার্থিব স্বার্থবিমুখ এক মুখলিস হৃদয়। পাশেই মাইনিমুখ বাজারে দেখলাম, একটি ইসলামী দলের বড় সাইনবোর্ড। এ অঞ্চলে তাদের রাজনৈতিক তৎপরতা থাকলেও দ্বীনের এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের নিষ্ক্রিয়তায় হতবাক হয়েছি। এই ফিতনা মোকাবিলায় তাদের কোনো তৎপরতার কথা কারোর কাছেই শুনতে পাইনি। কেন এই নিষ্ক্রিয়তা? উম্মতের ঈমান রক্ষার চেয়েও বড় কোনো স্বার্থ কি হতে পারে ইসলামী আন্দোলনের কোনো কর্মীর? পক্ষান্তরে সুদূর ঢাকায় বসে দাওয়াতের মুরববীরা অস্থির হয়ে জামাতের পর জামাত তশকীল করে এ সংকট মোকাবিলার চেষ্টা করছেন। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে জাযায়ে খায়র দান করুন এবং আরো বেশি কাজ করার তাওফীক দান করুন।

৩ এপ্রিল ১২ মঙ্গলবার সকালে জামাতের সাথীরা নিয়মিত গাশতে বের হলেন। তাওহীদ, রিসালাত ও আখিরাতের মতো ইসলামের মৌলিক তিনটি বিষয়ের বাইরে সাধারণত জামাতের সাথীরা কথা বলেন না। এরপরও কাদিয়ানীদের সাথে তাদের বিতর্ক ঘটে গেল। কাদিয়ানীরা তাদের এক উস্তাদকে (নাম যিকরে ইলাহী) নিয়ে এল। কাদিয়ানীদের স্থানীয় সভাপতির দোকানে তিন বার বৈঠক হল। প্রতি বৈঠকে সে বিপর্যস্ত হল। প্রথমেই সে আমাদেরকে ৮ পৃষ্ঠার একটি প্রসপেক্টাস দিয়েছিল। তাতে হাদীসের মূল পাঠ ও তরজমায় অন্তত ১০টি ভুল পেলাম। এ ভুলগুলোর দিকে যখন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল তখন সে ঝিম মেরে রইল। তার অন্যান্য উস্তাদকে ফোন করতে থাকল। ঐ উস্তাদরা নাকি এসব জালিয়াতির জবাব দিতে সক্ষম। শুনেছি, বুধবার তাদের এক উস্তাদের আগমন হয়েছিল। কিন্তু সকল কাদিয়ানীর অনুরোধের পরও সে আস্তানা থেকে বের হয়নি। এতে অনেক কাদিয়ানীর  মনে সংশয় দেখা দিয়েছিল।

বুখারী শরীফের এক হাদীসের অনুবাদ তারা পরিচিতির কাগজে এভাবে লিখেছে-

تلزم جماعة المسلمين وإمامهم

তোমরা মুসলমানদের ঐশী জামাত ও এদের ইমামকে অাঁকড়ে ধর।

আমরা বললাম, ঐশী শব্দটি কোন শব্দের অনুবাদ? কোনো জবাব নেই। বললাম, আরবী না জানা এই সাধারণ মানুষগুলোর সাথে আর কত জালিয়াতি করবেন?

আরেকটি মারাত্মক জালিয়াতি দেখুন, তারা তাদের প্রসপেক্টাসের ৬ নং পৃষ্ঠায় লিখেছে, দেওবন্দি মাদরাসা ও মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা, উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম মাওলানা মুহাম্মাদ কাসিম নানুতুবী সাহেব খতমে নবুওয়তের যে বিশ্লেষণ প্রদান করেছেন  তার সাথে আমরা সম্পূর্ণ একমত। অথচ মাওলানা কাসিম নানুতুবী রাহ. তার তাহযীরুন নাস কিতাবে এই সম্প্রদায়কে কাফির সাব্যস্ত করেছেন। (দেখুন : মুহাযারায়ে ইলমিয়্যাহ ২/২৯)

আলিমের জন্য কিতাব হচ্ছে হাতিয়ার আর উস্তাদ হলেন সেনাপতি

সফরে বের হওয়ার আগেই চিন্তা করেছিলাম, দু চারটি কিতাব সাথে নিব। কিন্তু কোন কিতাব নিব? মাওলানা আবদুল মালিক ছাহেব হুজুরকে ফোন করলাম। তিনি কয়েকটি কিতাবের নাম বললেন, যার মধ্যে আল্লামা কাশ্মীরী রাহ.-এর লেখা আততাসরীফ বিমা তাওয়াতারা ফী নুযূলিল মাসীহ কিতাবটিও ছিল। কাদিয়ানীদের সাথে আলোচনায় এই কিতাবটি নাঙ্গা তলোয়ারের ভূমিকা পালন করল। মারকাযুদ দাওয়াহ যাত্রাবাড়ি থাকাকালে আমি সেখান থেকে কিতাবটি সংগ্রহ করেছিলাম। কখনও ভাবিনি, এটি আমার এত কাজে আসবে। যিকরে ইলাহী যখন দাবি করল, মির্যা কাদিয়ানী মসীহে মওউদ তখন আমি কিতাবটি থেকে হযরত ঈসা আ.-এর ব্যাপারে বর্ণিত হাদীসগুলো দেখাতে লাগলাম। আর মির্যা কাদিয়ানী আর হযরত ঈসার মধ্যে ক্রমেই পার্থক্য ফুটে উঠতে লাগল। যেমন ঈসা আ. সম্পর্কে বর্ণিত আছে, তিনি ৪০ বছর বাঁচবেন। অথচ মির্যা সাহেব (১৮৩৭-১৯০৮) বেঁচেছিলেন ৭১ বছর। এরকম কিছু স্পষ্ট পার্থক্য দেখিয়ে দেওয়ার পর তার অবস্থা ছিল দেখার মতো।

এ সফরে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, কিতাব সংগ্রহ করা একজন আলিমের জন্য খুব জরুরি।

যিকরে এলাহীর লা-জবাব অবস্থা দেখে অনেক কাদিয়ানীই সংশয়ে পড়ে গেল। ঐসব অঞ্চলে আহলে ইলমের আসা যাওয়া অব্যাহত থাকলে অনেক মানুষ আবার ঈমানের দিকে ফিরে আসবে ইনশাআল্লাহ।

কাদিয়ানীরা জন্ম থেকেই অভিশপ্ত। এদের বিরুদ্ধে একটু হরকতেই আল্লাহ তাআলা আসমানী মদদ পাঠান। আমাদের জামাতের আমীর জনাব শহীদুল ইসলাম সাহেব এবং মুসা ভাইয়ের পরামর্শ ছিল, বড় বড় কিছু জমায়েত করে সাধারণ মুসলমানদেরকে সচেতন করা হোক, যাতে নতুন কেউ এদের চক্রান্তের শিকার না হয়। পরামর্শ অনুযায়ী কয়েকটি জমায়েতে দীর্ঘ বয়ান হল। পার্শ্ববর্তী মাহিল্লা বাজার মসজিদের ইমাম জনাব হাফেয হারুন সাহেবের মাইকে ঘোষণা দেওয়ামাত্রই পুরা বাজার আমাদের সামনে হাজির হয়ে গেল। উপযুক্ত সময় মনে করে ঈমান, ইসলাম ও কাদিয়ানীয়াতের উপর সোয়া এক ঘণ্টা বয়ান হল। যে যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেখানেই সোজা দাঁড়িয়ে বয়ান শুনেছে। বার বার এ অনুভূতি হচ্ছিল যে, দ্বীনের কাজের জন্য এ জায়গা বড়ই উর্বর। যাদের দাওয়াত এদের কাছে আগে পৌঁছবে তাদের কথাই এরা গ্রহণ করবে। নগরজীবনের ব্যস্ততার শিকলে বন্দি মানুষের চেয়ে এদের মধ্যে দ্বীনের কাজ করা কত সহজ। আহ! আমরা যদি সেই দরদ নিয়ে এদের দুয়ারে আগেই হাজির হতাম।

বয়ান শেষ হলে উপস্থিত লোকজন বলল, হুজুর! আমাদের এখানে অনেকদিন বৃষ্টি হয় না। বৃষ্টির জন্য একটু দুআ করুন। আমরা দুআ করলাম-ইয়া আল্লাহ! এরা তোমার দ্বীনের কথা শোনার জন্য এত সময় দিয়েছে। তোমার জন্য ত্যাগ শিকার করেছে তুমিও তাদের প্রার্থনা মঞ্জুর কর। আল্লাহর মেহেরবানি, দুআর পর সেখানে বৃষ্টি হল। এই আসমানী মদদ আমাদের জন্য আরেকটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। সকলেই বলাবলি শুরু করেছে যে, এই হুজুররাই সত্যের উপর আছে নতুবা এদের কথায় আল্লাহ বৃষ্টি দিলেন কেন? মনে হল, এই কাদিয়ানী সম্প্রদায় এতটাই অভিপশপ্ত যে, এদের বিরুদ্ধে সামান্য হরকতেই আসমানী মদদ এসে যায়। আল্লাহ তাআলা এ ধারাকে অব্যাহত রাখুন।

আল্লাহ তাআলা বলেন, সাবধান! আমার দল নিশ্চয়ই বিজয়ী। সূরা সাফফাত (৩৭) : ১৭৩

আর ওদের সম্পর্কে বলেছেন, অর্থ : সাবধান! শয়তানের দলই

ক্ষতিগ্রস্ত।-সূরা মুজাদালা (৫৮) : ১৯

তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনের বিরুদ্ধে বিষোদগার

কবি বলেন, কোনো নির্বোধকে যদি দেখ আমার বদনাম করতে তাহলে মনে করবে এটাই আমার শ্রেষ্ঠত্বের দলিল।

উপমহাদেশে আল্লামা কাশ্মীরী রাহ. ও তার স্বনামধন্য শাগরিদ মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.। কথা ও কলম দ্বারা কাদিয়ানী ফিতনার মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন।

কাদিয়ানীদের দ্বারা কুরআনের অনেক আয়াতে যে সকল তাহরীফ হয়েছে মাআরিফুল কুরআনে সহজ সরল ভাষায় সেগুলোর মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া হয়েছে। যেহেতু এই তাফসীরগ্রন্থটি বাংলায় অনূদিত হয়েছে এবং সচরাচর পাওয়া যায় এজন্য কাদিয়ানীরা এর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, যার প্রমাণ আমি এখানে এসেও পেয়েছি। ওদের এসকল কুৎসার কথা শুনে আমার দিলে এ তাফসীরের প্রতি এবং মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ.-এর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনেক বেড়ে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ।

একবার পাঞ্জাবের এক গবেষক গবেষণা করে বললেন, আখেরাত বলতে কিছু নেই। আমাদের এক ভাইয়ের কাছে কথাটা শোনার পর বললাম, এতে কুরআন মজীদের প্রতি আমার ঈমান আরও মজবুত হয়েছে। কারণ কাফিররা এ জাতীয় কথা বলবে তাতো কুরআন মজীদ অনেক আগেই বলে দিয়েছে, কাফিররা মনে করে যে, তাদেরকে আর উঠানো হবে না।-সূরা তাগাবুন (৬৪) : ৭

কাদিয়ানী যিকরে ইলাহীর সাথে যখন কথা বলছিলাম তখন মনে হচ্ছিল, সে কোনো নতুন কুরআন নিয়ে কথা বলছে। কারণ কুরআনের এমন ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে শুনিনি এবং কোনো লেখকের লেখাতেও পড়িনি। তার বর্ণিত ব্যাখ্যার সাথে ১৪ শত বছর ধরে চলে আসা সঠিক ও সুস্পষ্ট ব্যাখ্যার কোনো সম্পর্ক নেই।

এ তো বলাই বাহুল্য যে, কুরআন মজীদের যে কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণযোগ্য নয়। কোনো ব্যাখ্যা গ্রহণ করার জন্য শর্ত হচ্ছে তা খাইরুল কুরূন তথা সাহাবা-তাবেয়ীনের যুগ থেকে চলে আসা ব্যাখ্যার সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। মুসাল্লাম উসূলে দ্বীনের সাথে সাংঘর্ষিক হতে পারবে না। কাওয়ায়েদে আরাবিয়্যাহ দ্বারা সমর্থিত হতে হবে ইত্যাদি। এ সকল শর্তে উত্তীর্ণ না হলে তা তাহরীফ বা অপব্যাখ্যা বলে গণ্য হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই অপব্যাখ্যা শুধু অপব্যাখ্যা থাকে না; ইনকার বা অস্বীকারে পর্যবসিত হয়। হযরত ঈসা আ. প্রথমবার দুনিয়াতে এসে মারা গেছেন বলে প্রচার করছে কাদিয়ানীরা, যা ইসলামের মুসাল্লাম আকীদায়ে মুতাওয়ারাসার পরিপন্থী। যেমন সূরা আলে ইমরানের ৫৫ নং আয়াত-

يعيسى انى متوفيك ورافعك الى

এই আয়াতের তরজমা সে করল, আমি তোমাকে মৃত্যু দিব এবং মর্যাদা দিব। এখানে সে এক চরম বিকৃতিকারীর পরিচয় দিল। দুররে মানছূরে ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, আমি আপনাকে নিজের কাছে উঠিয়ে নিব (এবং শেষ যমানায় স্বাভাবিক মৃত্যু দিব)।-মাআরিফুল কুরআন, সৌদী মুদ্রণ ১৭৭ পৃষ্ঠা

এই আয়াতের মুতাওয়ারাছ এবং মুসাল্লাম ব্যাখ্যা এটিই। অথচ কাদিয়ানীরা এর বিপরীতে এমন এক ব্যাখ্যা করে থাকে, যা সরাসরি কুরআন মজীদের তাহরীফ।

হাদীসের ক্ষেত্রেও এমন অসংখ্য তাহরীফ তারা করেছে। যেমন, যত হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ঈসা ইবনে মারইয়ম আ.-এর অবতরণের কথা বলেছেন সব জায়গায় তারা মারয়ম ও ঈসাকে দুইটি প্রতীকী নাম বলে ব্যাখ্যা করে। যেমন, হাতেম তায়ী বদান্যতার প্রতীক, ওমর বীরত্বের প্রতীক। তারা সরলমনা মুসলমানদেরকে ইসলামী আকীদা বলে শেখাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বনী ইসরাইলের সেই ঈসা আবার আসবে এটা কোথাও বলেননি; বরং মাতৃগর্ভ থেকে ঐ সব গুণের অধিকারী এক প্রতীকী ঈসা আসবে এ কথাই তিনি বুঝিয়েছেন। আর সে-ই হল মির্যা গোলাম আহমদ কাদিয়ানী। (নাউযুবিল্লাহ) আর বনি ইসরাইলের ঈসার তো মৃত্যু হয়েছে।

অথচ সহজ কথা সকলেই বুঝে যে, কারো পরিচয় দেওয়ার সময় প্রতীকী নাম ব্যবহার করা হয় না। যেমন আমি একজনের কাছে একটি চিঠি পাঠাচ্ছি। খামের উপর আমি কি তার প্রকৃত নাম লিখব না প্রতীকী নাম? তার প্রকৃত নাম যদি হয় আবদুল্লাহ, কিন্তু দানশীল হওয়ার কারণে আমি যদি লিখি হাতেম তাই তাহলে এটা যে নির্বুদ্ধিতা এ বিষয়ে কি কোনো বুদ্ধিমান দ্বিমত করবে?

এই সহজ কথাটা কাদিয়ানীরা কেন বোঝে না? সত্যিই কি বোঝে না?

তো আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস শরীফে হযরত ঈসা আ.-এর নাম, মাতার নাম, কিয়ামতের আগে অবতরণ, অবতরণের শহর, সময়, কাজ, অবদান, বিবাহ,

সন্তান, আসমান থেকে অবতরণের পর স্বাভাবিক মৃত্যু, দাফন সবকিছু পরিষ্কার করে বলে গেছেন। অথচ তারা এই সকল হাদীসের অপব্যাখ্যা করে প্রকারান্তরে মূল বিষয়টিকে অস্বীকার করে।

তাহরীফের আরেক উদাহরণ দেখুন

মুফতী মুহাম্মাদ শফী রাহ. আততাসরীহ বিমা তাওয়াতারা ফী

নুযুলিল মাসীহ গ্রন্থের ভূমিকায় (পৃষ্ঠা : ৭৪) এক হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, হযরত ঈসা আ. তাকে (দাজ্জালকে) লুদ শহরের দরজায় পাবেন। শায়খ আবদুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ রাহ. নিচে টীকাতে লিখেছেন, লূদ ফিলিস্তিনে বাইতুল মাকদিসের কাছে একটি শহরের নাম।

আমি যিকরে ইলাহীকে জিজ্ঞাসা করলাম, মির্যা সাহেব কি কখনও ফিলিস্তিন গেছেন? হাদীসে তো

ফিলিস্তিনের লুদ শহরের গেটে ঈসা আ. উপস্থিত হওয়ার কথা আছে। সে সাথে সথে বলল, বুঝলেন না, এটা হচ্ছে পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানা। আমি আসমান থেকে পড়লাম। এই লোক বলে কি! কোথায় লূদ আর কোথায় লুধিয়ানা। এ তো দেখছি, আগরতলা-উগারতলা এক বানিয়ে দিচ্ছে। আমাদের গ্রামদেশের নিরক্ষর লোকেরাও তো এই পন্ডিতের চেয়ে অনেক জ্ঞানী। তারা আর কিছু না হোক আগরতলা-উগারতলার পার্থক্য বোঝে!

আমি বললাম, লুদ শব্দের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসরা বলেছেন, এটি ফিলিস্তিনের একটি শহর আপনি একটু দেখান এই চৌদ্দশত বছরে কোন কোন মুহাদ্দিস এই স্থান সম্পর্কে বলেছেন, এটি পাঞ্জাব ও গুরুদাসপুর জেলার কাদিয়ান গ্রামে অবস্থিত? সে লা-জবাব হয়ে গেল।

প্রিয় মাতৃভূমির এই মানচিত্র কি অক্ষত থাকবে

রাঙ্গামাটির আমতলী ইউনিয়নের কবিরপুর গ্রাম ছাড়াও এই জেলাগুলোর জানা-অজানা অনেক জায়গায় কাদিয়ানীদের আস্তানা গড়ে উঠেছে। একই জেলার কালাপাকুজ্য ইউনিয়নের শিবিরবাজারেও এমন এক আস্তানার সন্ধান পাওয়া গেছে। এরা ইহুদীদের মতো একটি পৃথক সার্বভৌম ভূখন্ডের সন্ধানে মরিয়া হয়ে নীরব আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। যদি রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সর্বোপরি ওলামায়ে কেরাম এ ফিতনার মুকাবেলায় সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও কর্মসূচি হাতে নিয়ে অগ্রসর না হন তাহলে একদিন ইসরাইলের মতো একটি কাদিয়ানী রাষ্ট্রের ঘোষণা এসে গেলেও অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।

খ্রিস্টান ও কাদিয়ানীদের মধ্যে আছে পিতা-পুত্রের গভীর সম্বন্ধ। ইন্দোনেশিয়ার পূর্ব তিমুর এবং দক্ষিণ সুদানের ন্যায় প্ল্যান করে স্বাধীনতা আন্দোলনের ডাক দিয়ে তারপর পশ্চিমা দুনিয়ার মাধ্যমে গণভোট চাপিয়ে দুইটি পৃথক খ্রিস্টান রাষ্ট্র বানানোর ঘটনা তো আমাদের চোখের সামনেই ঘটল। আফসোস করা ছাড়া ঐসব অঞ্চলের জনগণ আর কী করতে পেরেছে? আমরাও কি এমন একটি অসাড় আফসোসের দিকে যাচ্ছি? আল্লাহ তাআলা হেফাযত করুন।

বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলোকে নিয়ে এমন একটি ষড়যন্ত্রের হুঁশিয়ারি কিছুদিন পূর্বে সেনাদপ্তর থেকে দেওয়া হয়েছিল। (সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, ১৫ এপ্রিল ২০১১)

গত বছরের আগস্ট মাসের বিভিন্ন তারিখে বেশ কয়েকটি দৈনি পত্রিকাতেও এ বিষয়ক প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

উপজাতিদের সাথে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী ছাড়া আর কেউ থাকে না। তাদের অভিজ্ঞতাই বাস্তব অভিজ্ঞতা। এরই সাথে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা খ্রিস্টানদেরকে পার্বত্য জেলাগুলোতে নিয়ে সংখ্যাগুরু বানানো হচ্ছে, যা পূর্ব তিমুরে হয়েছিল। এভাবে গণভোটে বিজয়ের ক্ষেত্রও তৈরি করা হচ্ছে। আমি এখানে তাদের ওয়েবসাইটের একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরছি-১৮৮১ সালে বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের অনুপাত ছিল প্রতি ৬০০০ জনে ১ জন। ২০০০ সালে তা দাঁড়ায় ১১ জনে ১ জন। ২০১৫ সাল নাগাদ এই অনুপাত ৩/১ নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে তারা কাজ করছে।

সময় খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। এরপর হয়তো সচেতন হওয়ারও সময় থাকবে না। 

 

 

advertisement