আরববিশ্বে জিহাদের প্রত্যাবর্তন!
জুমাদাল উলার দ্বিতীয় জুমআয় (২৩-০৩-২০১২ তারিখে) মসজিদে নববীতে খুতবা শুরু হল। বক্তৃতার ধরন ও বিষয়বস্ত্ত শুনে বিস্মিত না হয়ে পারা গেল না। এরচেয়ে আরো অবাক করা ব্যাপার ঘটল পরবর্তী জুমআয় মসজিদুল হারামে। শায়খ সুদাইস তার জ্বালাময়ী খুতবায় নিজে যেমন কাঁদলেন তেমনি লক্ষ চোখের পানিও ঝরালেন। বিষয়বস্ত্ত প্রায় একই। উপস্থাপন যার যার নিজস্ব আন্দাজে।
আজকের লেখার উদ্দেশ্য অবশ্য হারামাইনের খুতবার অনুবাদ বা ভাষ্য পেশ করা নয়। লেখার বিষয় সেটিই, যা শিরোনামে বলা হয়েছে-মধ্যপ্রাচ্যে জিহাদের প্রত্যাবর্তন। হ্যাঁ, পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়েই এখন জিহাদ শব্দটি প্রকাশ্যে উচ্চারিত হচ্ছে। পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টেলিভিশন, জুমআর খুতবা কোথাও এ শব্দ ব্যবহারে আগের অলিখিত নিষেধাজ্ঞা নেই। বরং মিডিয়াগুলোতে উলামায়ে কেরাম প্রতিনিয়ত জিহাদের ফযীলত, মুজাহিদদের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থনদান ইত্যাদি বিষয়ে সারগর্ভ বক্তব্য রাখছেন।
যে মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের কাছে জিহাদ একটি এলার্জি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, এ বিষয়ে বইপত্র লেখা, প্রকাশ বা বিক্রি করার উপর অলিখিত নিষেধাজ্ঞা আরোপিত ছিল, সম্ভবত যা এখনো আছে, যেখানে কোনো খতীব বা দাঈ জিহাদ নিয়ে আলোচনা করার চিন্তাও করতে পারতেন না সেখানে জিহাদের ব্যাপক আলোচনা বিস্ময়কর বৈ কি!
সিরিয়ার জালেম শাসক বাশার আলআসাদ কর্তৃক ব্যাপক মুসলিম নিধনের প্রতিবাদে এখন গোটা মধ্যপ্রাচ্য সোচ্চার। বিদ্রোহী যোদ্ধাদেরকে আর্থিক ও নৈতিক সমর্থন দেওয়ার পাশাপাশি তাদের পক্ষে জনমত গঠনের কাজ চলছে প্রকাশ্যেই। শুধু রাষ্ট্রীয় টিভিগুলোই নয়, আলজাজিরা-আলআরাবিয়ার মতো চ্যানেলগুলোও এখন তাদের অনুষ্ঠানমালার সিংহভাগ বরাদ্দ রাখছে সিরিয়ার জন্য। বাশারের বিরুদ্ধে লড়াইকে জিহাদ বলতে এখন আর কোনো সংকোচ নেই তাদের। বিদ্রোহীরা পাচ্ছেন মুজাহিদের মর্যাদা। মসজিদে মসজিদে তাদের জন্য ফজরে/মাগরিবে কুনূতে নাযেলাহ পড়া হচ্ছে নিয়মিত। মোটকথা, পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এখন প্রধান আলোচ্য বিষয় সিরিয়া-প্রসঙ্গ। কোন পথে কত তাড়াতাড়ি বাশার সরকারের পতন ঘটানো যাবে, বাশারবিরোধীদের আরো কী কী সহযোগিতা দেওয়া যায় তা নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা ও চিন্তা-ভাবনার যেন অন্ত নেই।
সৌদী আরব ও অন্যান্য আরব দেশের সরকারগুলোর জিহাদ বিষয়ে এ নমনীয়তা এবং বাশার বিরোধী সিরীয় যোদ্ধাদেরকে মুজাহিদের সম্মান দিয়ে ঐসব দেশের জনগণের আর্থিক ও নৈতিক সমর্থনকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখছেন ঈমানদার মুসলিমসমাজ।
বাশারের সম্ভাব্য পতনের পর সিরিয়ায় ইসলামী নেজাম চালু হবে কি না- সে প্রশ্নের জবাব মিলবে ভবিষ্যতে। কিন্তু এ মুহূর্তে মুসলমানদের খুশি হওয়ার মূল কারণ সম্ভবত জিহাদ নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা বলার সুযোগ এবং শরীয়তের এ গুরুত্বপূর্ণ বিধানটির পুনরায় সর্বস্তরে চর্চা।
তারা মনে করেন, বিশ্বের মুসলিম সরকারগুলোর তাড়াতাড়ি এ কথা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, তাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর প্রশিক্ষণ হওয়া দরকার জিহাদী মানসিকতা নিয়ে। তাদের পড়াশোনা ও প্রশিক্ষণে কুরআন-হাদীসের জিহাদ বিষয়ক শিক্ষা, ফযীলত ও বিধি-বিধানগুলোর উপস্থিতি দরকার ব্যাপকভাবে। আর মুসলিম দেশগুলোর জনগণ, বিশেষত যুবসমাজের অন্তরে জিহাদের গুরুত্ব যত বেশি স্থান পাবে ততই এ সকল দেশের নিরাপত্তার জন্য তা সহায়ক হবে। সরকারগুলোকে বিদেশী আগ্রাসনের মোকাবেলায়
স্ব-ঘোষিত সুপার পাওয়ার এবং তার জোটবদ্ধ রাষ্ট্রগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না। ব্যয় করতে হবে না তাদের পিছনে কোটি কোটি ডলার। আর নিজ দেশে তাদেরকে কলোনী করতে দিয়ে ভিতরে ভিতরে গণরোষের শিকার হতে হবে না; বরং এ যুবসমাজ ও মুসলিম জনতাই হয়ে উঠবে দেশের অতন্দ্র প্রহরী। তাদের ঈমানী শক্তিই হবে শত্রুর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র।
মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে এ কথাগুলো আরো বেশি প্রাসঙ্গিক। কারণ আরব জাহানের উপরই শত্রুর বদনজর সবচেয়ে বেশি। সেখানেই আগ্রাসন চালিয়ে বর্বরতার সকল রেকর্ড ভঙ্গ করছে অভিশপ্ত ইহুদী-খ্রিস্টান জাতি। সেখানেই অসংখ্য ঘাঁটি তৈরি করেছে পশ্চিমা জোট পরাশক্তি। তারা মধ্যপ্রাচ্যের রাজা-বাদশা ও ক্ষমতাবানদের জুজুর ভয় দেখিয়ে ঐসব দেশে আস্তানা গেড়ে লুটে নিচ্ছে তাদের আল্লাহপ্রদত্ত মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ। অথচ এ মধ্যপ্রাচ্যেই রয়েছে পৃথিবীর পবিত্রতম স্থান-মক্কা-মদীনা। এ আরব জাতিই একদিন ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বাহাদুর গোষ্ঠি। ইসলামের প্রথম ধারক, বাহক ও প্রচারকও তারাই। নিজেদের ঈমান, সাহস, সততা ও নিষ্ঠা দিয়ে তারাই প্রতিষ্ঠা করেছে পৃথিবীর দেশে দেশে ইনসাফের রাজত্ব। ভেঙ্গে চুরমার করেছে বড় বড় তাগুতি শক্তির প্রাসাদ-দুর্গ। আজ তাদের দেশ ও সরকারের জন্য কি না ভিনদেশী-ভিনজাতির সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন হয়ে পড়েছে! কেন হল তাদের এমন অবস্থা?
ইতিহাসবিদ ও ধর্মতত্ত্ব বিশ্লেষকদের মতে, এর পিছনে যে সকল কারণ সক্রিয় সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে আরব জাতি ও সরকারের জিহাদ-বিমুখতা। স্বৈরাচারী পন্থায় ক্ষমতাকে স্থায়ী করার মানসে এবং সম্পদের প্রাচুর্যে ডুবে গিয়ে তারা জিহাদকে অনেক দূরে ছুড়ে ফেলেছে। আর নাইন-ইলেভেনের পর তো জিহাদ বিষয়ক কিতাবাদির উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কারো সম্পর্কে জিহাদী মনোভাবের গন্ধ পেলেও তাকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করা হয়েছে কোনো কোনো আরব দেশে। শত শত নিরীহ লোক এ কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং হচ্ছে। কিন্তু জিহাদকে অনন্তকাল পর্যন্ত ভুলিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি। আর আদৌ কি তা সম্ভব! পবিত্র কুরআনেই তো অসংখ্য জায়গায় জিহাদের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব ও নিয়ম-নীতির আয়াত রয়েছে। সূরা আনফাল এবং সূরা বারাআহর মূল ভাষ্য তো জিহাদই। আর কুরআন ধ্বংস করা কি সম্ভব? লক্ষ লক্ষ হাফেযদেরকে নিঃশেষ করা সম্ভব? খোদ আল্লাহই যে কুরআনের হিফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন?
সুতরাং জিহাদ বিষয়ে ঐসব সরকারের কান্ড দেখে ব্যথিত-মর্মাহত হলেও একেবারে নিরাশ হয়ে যায়নি ঈমানদার জনগোষ্ঠী।
সিরিয়া পরিস্থিতিকে সামনে নিয়ে এখন আরববিশ্বে জিহাদ শব্দের স্বতঃস্ফূর্ত উচ্চারণ, খতীবদের ভাষণ, আলেম-উলামাদের সারগর্ভ আলোচনা এবং এসব কিছুতে সরকারগুলোর মৌন সমর্থনে কিছুটা হলেও আশার আলো দেখতে পাচ্ছে ঈমানদার আরব মুসলমানরা।
হাদীসের ভাষায় জিহাদ হচ্ছে, শির উঁচু রাখার অন্যতম উপায়।
অন্য হাদীসের ভাষ্য হল, জিহাদ চলবে কিয়ামত পর্যন্ত। যে জাতি জিহাদ ছেড়ে দিবে তারা অপদস্থ ও লাঞ্ছিত হবে।
এসব অমর বাণীকে স্মরণ করে যদি আরব রাষ্ট্রনায়কেরা, তাদের সেনাবাহিনী এবং তাদের জনগণ জিহাদী জযবায় অনুপ্রাণিত হয়ে কোনো দিন নেমে পড়ে খাঁটি জিহাদে তবে সেটিই হবে আলকুদস পুনঃবিজয়ের প্রথম উপলক্ষ। জাযিরাতুল আরব ও পুরা আরববিশ্ব আবার মুক্ত হবে ইহুদি-নাসারা থেকে। সেদিনের অপেক্ষাতেই হয়ত আশায় বুক বেঁধে আছে খাঁটি ঈমানদার আরবরা।