বাইতুল্লাহর ছায়ায়
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কলম যখন চলতে শুরু করে, কোত্থেকে কোথায় চলে যায়! ফিরে আসি আগের স্থানে, সুড়ঙ- পথের প্রবেশমুখে।
পায়ের জখমে ব্যথাটা যেন একটু বেড়েছে। হাঁটতে হচ্ছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। তবে আল্লাহর শোকর, একসময় সুড়ঙয়ের শেষ মাথায় আলোর রেখা দেখতে পেলাম। সুড়ঙপথ থেকে বের হয়েই চোখের সামনে দেখা যায় পবিত্র হারামের ভাবগম্ভীর ইমারত। তাতে হৃদয়ের গভীরে এমন এক শান্তি ও শীতলতা অনুভূত হলো, যা শৈশবে মানুষ মায়ের অাঁচলের ছায়ায় অনুভব করে।
ডান দিকে খুব কাছে মাওলিদুন্-নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। এখন সেখানে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্র দ্বিতল একটি ভবন, যা সমৃদ্ধ ইসলামী পাঠাগার -রূপে পরিচিত। তখন কেমন ছিলো মা আমেনার সেই ছোট্ট ঘরখানি! কল্পনায় যেমন দেখতে পাই হয়ত তেমন, কিংবা আমাদের কল্পনা যত দূর যায়, তার চেয়েও সাধারণ, তার চেয়েও সুন্দর! আলো নেই, তবু আলোকিত! সাজ নেই, তবু সুসজ্জিত! বাগিচা নেই, তবু কেমন সুবাসিত! সেই আলো, সেই সাজ, সেই সুবাস; এখনো কি নেই তার কিছু আভা, কিছু আভাস!
মনে পড়ে পঁচিশবছর আগে কেমন করে যেন সাহস হয়েছিলো, পেয়ারা নবীর জন্মস্থান এই পবিত্র গৃহে প্রবেশ করার। ভাবলে এখনো কেমন পুলক শিহরণ জাগে অন্তরে! সেই জান্নাতি সুবাস এখনো যেন সুরভিত করে হৃদয় ও আত্মাকে।
কিন্তু আশ্চর্য! পরে আর কখনো সাহস হয়নি এ পবিত্র স্থানে প্রবেশ করার! দূর থেকে দেখেছি, আর অপূর্ব এক তন্ময়তায় আচ্ছন্ন হয়েছি! এবারও অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে প্রাণভরে দেখলাম আমার পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মস্থান! দ্বার উন্মুক্ত। পাঠাগার আছে, মানুষ যাচ্ছে, আসছে! আমি শুধু দূর থেকে তাকিয়ে আছি, আর দূর অতীতের ধূসর ছবি অবলোকন করছি! এখানেই অতিবাহিত হয়েছে বিধবা আমেনার এতীম দুলালের পবিত্র শৈশব। যখন মা আমেনার মমতার অাঁচলখানি তাঁর মাথার উপর ছিলো না তখনো তিনি এ ঘরেই বাস করেছেন! দাদা আব্দুল মুত্তালিব কি এখান থেকেই তাকে কোলে করে নিয়ে যেতেন কা‘বা প্রাঙ্গণে, বাইতুল্লাহর ছায়ায়। কখনো কি তাঁর শিশুহৃদয় বিষণ্ণ হতো বাবার কথা ভেবে, মায়ের কথা মনে করে? এ ঘর কি কখনো তাঁর হাসির শব্দ শুনেছে, কিংবা তাঁর কান্নার আওয়ায?
***
মক্কা শরীফে সুড়ঙটি এসে শেষ হয়েছে ছাফা পাহাড়ের কাছে, জাবালে আবু কোবায়সের পাশে। জাবালে আবু কোবায়স সেই পাহাড়, যেখানে দাঁড়িয়ে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব তাঁর পবিত্র আঙুল দ্বারা ইশারা করেছিলেন, আর চাঁদ দু’টুকরো হয়েছিলো। কোরায়শের সমবেত জনতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলো আমাদের পেয়ারা নবীর সেই আশ্চর্য মু‘জেযা। কিন্তু ঈমান! না, তারপরো ঈমান নছীব হয়নি, দুর্ভাগা কোরায়শের! এমনই হয়! কাছের মানুষ করে অবহেলা, দূরের মানুষ করে সমাদর!
দেখো না, মক্কার মানুষ হিজরতের অাঁধার রাতে যার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলো নাঙ্গা তলোয়ার হাতে, সুদূর ইয়াছরিবের মানুষ তাঁকেই বরণ করে নিয়েছিলো ‘তালা‘আল বাদরু আলাইনা’ বলে!
***
জাবালে আবু কোবায়সের কোল ঘেঁষে হারামের চত্বর পার হয়ে মিছফালায় আসতে সময় লাগলো আধ ঘণ্টারও বেশী, এমনই ছিলো সমাগমের চাপ। এখন প্রথম কাজ হলো মাথা মুড়িয়ে ইহরাম থেকে মুক্ত হওয়া। অবশ্য ইহরাম থেকে পূর্ণ মুক্তি হবে তাওয়াফে যিয়ারত করার পর।
হারাম থেকে মিছফালার দিকে যাওয়ার পথে ডান দিকের গলিপথে একটু উঁচুতে ঢাকা হোটেল। তার ডান পাশ দিয়ে আরো উঁচুতে আমাদের থাকার ঘর। তার কাছে একটি সেলুন। দীর্ঘ লাইন। এখনো সবার গায়ে ইহরামের লেবাস। সবার পিছনে দাঁড়ালাম। দেখতে দেখতে আমার পিছনেও দীর্ঘ লাইন হয়ে গেলো। অধিকাংশ বাংলাদেশী, পাকিস্তানী ও হিন্দুস্তানীও আছে কিছু। এখানে দু’রকমের অভিজ্ঞতা পেলাম। কয়েকজন অবলীলায় আমাকে ডিঙ্গিয়ে আগে চলে গেলেন। কিছু বললাম না। নিজেকে প্রবোধ দিলাম, হয়ত তাদের অনিবার্য কোন তাড়া আছে। কয়েকবারই বচসা হয়ে গেলো এই ডিঙ্গিয়ে যাওয়া লোকদের সঙ্গে, লাইনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তাদের। দেখলাম, যুবক বয়সের যারা বেশীর ভাগ তারাই এ অন্যায়টা করছে। খুব পীড়াদায়ক মনে হলো। হজ্বের সফরে তো আসা হয় যিন্দেগীর সবকিছুতে পরিবর্তন আনার জন্য। সবকিছুই যদি আগের মত থেকে গেলো তাহলে কী লাভ হলো জান-মালের এত কষ্টের সফরে! এত মেহনতের ইবাদতে! খাবারের দোকানগুলোতেও দেখেছি এ দুঃখজনক চিত্র এবং আরো লজ্জাজনকরূপে। একবার তো এমন হলো, ইমাম ছাহেব আমাকে পাঠালেন রাতের খাবার আনতে রুটির দোকানে। একঘণ্টা পর খালি হাতে ফিরে এলাম। ইমাম ছাহেব অবাক, আমি বললাম, কী করবো, সবাই নাকি আমার আগে এসেছে! ইমাম ছাহেব গিয়ে দশমিনিটের মধ্যে গরম রুটি নিয়ে এলেন, আর বললেন, তোমার মত দরবেশ হলে না খেয়েই থাকতে হবে। চেষ্টা করবা যাতে অন্যের উপর যুলুম না হয়, কিন্তু ভালো মানুষের মত দাঁড়িয়ে থাকলে তো চলবে না।
হঠাৎ দেখি দু’জনের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।
ঘটনা একই, একজন আরেকজনকে ডিঙ্গিয়ে যেতে চাচ্ছে, দুজনই বাংলাদেশী। কে একজন মন্তব্য করে বসলো, ‘ইয়ে বাঙ্গালী লোগ বড়ে ফাসাদী হ্যাঁয়।’
ঝগড়া ফাসাদে আসলে কেউ কম যায় না, দোষটা কেন জানি বেচারা বাঙ্গালীদের কাঁধেই চাপে বেশী।
যাই হোক, কয়েকজন আগে বেড়ে অনেক কষ্টে উভয়কে শান্ত করলেন। ইহরামের লেবাস যদি ভাষা জানতো তাহলে কী বলতো কে জানে! হয়ত বলতো, ‘দোহাই, আমাকে তাড়াতাড়ি খুলে ফেলো’।
আফসোস, উচিত তো ছিলো নিজের প্রয়োজন পিছিয়ে রেখে অন্যের প্রয়োজন পুরা করা, অথচ এখানে পরিষ্কার অন্যের হক নষ্ট করা হচ্ছে এবং কোন রকম দ্বিধা-সঙ্কোচ ছাড়া। তাহলে হজ্ব থেকে কী শিক্ষা গ্রহণ করা হলো?
একজন বুড়ো হাজী কিন্তু সে শিক্ষাটাই আমাকে দিলেন এবং আমি খুব লজ্জিত হলাম। লাইনে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে সেলুনের দরজার কাছাকাছি পৌঁছেছি; একজন, তিনিও বাংলাদেশী, কাঁধের ধাক্কায় আমাকে প্রায় ফেলে দিলেন। তা দিতেই পারেন! তিনি বলিষ্ঠ যুবক, আমি প্রায় বুড়ো। প্রায় কেন, বার্ধক্যে আমি তো আমার বয়স থেকে দশবছর এগিয়ে আছি, যেমন অনেকে কয়েকবছর পিছিয়ে থাকে।
তো তিনি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলেন, কিন্তু আমি পড়তে চাইলাম না। কেউ কি আর সহজে পড়ে যেতে চায়! যা অবলম্বন নয় সেটাকেই অবলম্বন করে মানুষ পতন থেকে রক্ষা পেতে চায়। এটা মানুষের সহজাত ধর্ম। আমি তাই করলাম। যিনি ধাক্কা দিলেন তার হাত ধরেই পতন রোধ করতে চেষ্টা করলাম। তিনি এমন ঝাড়া দিলেন যে, আরো বেশী করে পড়ে গেলাম। কোমরে, মাথায় আঘাত পেলাম এবং হজ্বের কথা ভুলে গেলাম। আল্লাহ মাফ করুন, কয়েকটা কঠিন শব্দ মুখ ফসকে বের হয়ে এলো। তবে সেই যুবকের ভদ্রতা যে, তিনি ফিরে এসে রুখে দাঁড়াননি। আমাদের চরিত্রগত দিক থেকে তো সেটাই ছিলো স্বাভাবিক।
একজন বয়স্ক হাজী। আশী বছরের কম হবে না, তিনিও বাংলাদেশী। মাথা মুড়োনোর জন্য সেলুনের ভিতরে চেয়ারে বসেছিলেন। তিনি ঘটনা দেখলেন এবং আমাকে ভেতরে নিয়ে জোর করে তার জায়গায় বসিয়ে দিলেন, আর বললেন, আপনি সেরে নিন; আমি আপনার জায়গায় দাঁড়াচ্ছি।
ঘটনার আকস্মিকতায় এমনই হতচকিত হয়ে পড়লাম যে, না বলারও সুযোগ হলো না। শুধু ভিতরে ভিতরে লজ্জায় মরে গেলাম। সেলুনের লোকটি ভারতের কেরালার অধিবাসী। তার কথায় আরো লজ্জা পেলাম। ভাঙ্গা ভাঙ্গা উর্দূতে বললেন, মিয়াঁজী, দেখো, এই বুড়োর কাছ থেকে শেখো। এত অধৈর্য হও কেন?
আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া যুবকটি পাশের চেয়ারে। তাকে কিছুই বলা হলো না, বলা হলো শুধু আমাকে! কারণ সম্ভবত এই যে, তিনি আমাকে মুখে কিছু বলেননি, আর আমি কটু কথা উচ্চারণ করেছি। মন্দ কথার এমনই মন্দ প্রভাব। ঘটনাটি মনে হলে এখনো লজ্জিত হই এবং মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, এমন ভুল যেন আর কখনো না করি, বরং যদি পারি, ঐ বুড়ো হাজী ছাহেবের দেয়া শিক্ষাটা যেন গ্রহণ করতে পারি, যেমন কেরালার অধিবাসী সেলুনওয়ালা উপদেশ দিয়েছেন।
সাধারণ সময়ে মাথা কামাতে নেয় পাঁচ রিয়াল; দশতারিখে পনেরো রিয়ালের কম কিছুতেই নয়। আমি পনেরো রিয়াল দিলাম। সেলুনওয়ালা বললেন, তুমি পাঁচ রিয়ালই দাও। আমি অপ্রস্ত্তত হয়ে জানতে চাইলাম, কেন, আমার জন্য কম কেন?! তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, বাত মাত বাড়হাও, আগে চলতা বনো। (কথা বড়িও না, সামনের পথ দেখো।)
হয়ত এটাও তিরস্কারের ভিন্ন সংস্করণ! তাই কথা না বাড়িয়ে আমি দরজার পথ দেখলাম। যথেষ্ট শিক্ষা হলো আজ। নাপিতের দোকানও কখনো কখনো এভাবে হয়ে যায় ‘মাদরাসা ও খানকাহ’!
হোটেলে এসে দেখি, লিফট বন্ধ অথবা নষ্ট। নতিজা একই; পাঁচতলায় যেতে হবে বড় বড় সিঁড়ি ভেঙ্গে। এমনিতেই খারাপ লাগছিলো, মনটা আরো দমে গেলো। শেষপর্যন্ত বারকয়েক জিরিয়ে উপরে উঠে এলাম। কামরায় শুধু শিকদার সাহেব। শুয়ে আছেন চোখ বন্ধ করে, তবে জাগ্রত। চোখ মেলে তাকালেন। উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আশা করেছিলাম, আজ প্রথমে আপনার দেখা পাবো, তাই হলো।
আমি বললাম, ইমাম ছাহেব আপনাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। তিনি আপনার রামী করবেন এবং এসে আপনাকে ‘হালাল’ করবেন।
শিকদার সাহেবকে আজ আর মনমরা মনে হলো না, বেশ হাসিখুশি। আসলে তিনি ভাবতেই পারেননি, এত সহজে তার হজ্ব হয়ে যাবে। আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বললেন, আমাদের মত মাযূরদের জন্য হজ্বের বিধান যে এত সহজ তা তো জানতাম না। আমাকে কোন কাফেলায় নিতেই রাজী হয়নি। ইমাম ছাহেব যদি মেহেরবানি না করতেন তাহলে তো এই জীবনে আর হজ্বই করা হতো না।
পুরো সফরে এই একটি কথা তিনি যে কত বার বললেন! অথচ আমরা মানুষের কত বড় বড় অনুগ্রহ অবদান কত সহজে ভুলে যাই!
শিকদার সাহেব এখন দুনিয়াতে নেই। বড় ভালো মানুষ ছিলেন। ধীর স্থির এবং বিচক্ষণ। যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করেছেন। সুস্থ অবস্থায় হজ্বের কথা চিন্তা করেননি; অসুস্থ হওয়ার পর তো প্রশ্নই আসে না। আল্লাহর ইচ্ছায় এবার তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন এবং হজ্ব করেছেন। বান্দা যদি খালিছ দিলে নিয়ত করে, আল্লাহ অবশ্যই তা পুরা করেন এবং এমনভাবে করেন যে, বান্দা নিজেই অবাক হয়ে যায়। শিকদার সাহেব সেদিন বলেছিলেন, ‘আচ্ছা হুযূর, এখন তো কামরায় কেউ নেই। সত্যি করে বলুন তো, আমার হজ্ব কি আপনাদের হজ্বের মত হবে? একই রকম ছাওয়াব হবে?
আমি হেসে বললাম, আল্লাহ সম্পর্কে আপনার কী ধারণা? আল্লাহ তো বলেছেন, বান্দা যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি বান্দার দিকে দৌড়ে যাবো। তো আপনি এত কষ্ট করে আল্লাহর ঘরে এলেন, এত কষ্ট করে আরাফায় হাজির হলেন; আমি তো মনে করি, আপনার হজ্ব সবার চেয়ে বেশী কবুল, বরং আপনার উছিলায় আমাদের হজ্বও ইনশাআল্লাহ কবুল হবে।
শিকদার সাহেব খুশিতে কেঁদে ফেললেন। তারপর তিনি যে কথাটি বললেন, তার অর্থ তখন বুঝতে পারিনি, পেরেছি তার মৃত্যুর খবর শোনার পর। তিনি বললেন, হুযূর, মনে হয় কি জানেন! এবার না হলে আমার আর হজ্ব করা হতো না।
আল্লাহ তাকে মাগফেরাত নছীব করুন; হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, তার আখেরাতের সফর ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের চৌদ্দজনের কাফেলায় তিনিই প্রথম দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণকারী ব্যক্তি।
ان شاء الله بكم لاحقون
(আল্লাহ চাহে তো আমরাও তোমাদের সঙ্গে যুক্ত হবো।)
গোসল করে স্বাভাবিক পোশাক লুঙ্গি-জামা পরলাম। সফরের শুরুতে বাড়ী থেকে ইহরাম গ্রহণ করে এসেছিলাম, আজ ইহরাম থেকে ফারেগ হলাম। নিজেকে খুব হালকা মনে হলো, বিরাট কোন দায়িত্ব সম্পন্ন হওয়ার পর যেমন মনে হয়। আর তখন আমাকে হতবাক করে দিয়ে শিকদার সাহেব বলে উঠলেন, হুযূর, আপনারা হলেন উম্মতের রাহবার, আম মানুষের ইহরাম শেষ হলেও আপনাদের ইহরাম শেষ হবে না কখনো। ইহরামের দায়দায়িত্ব জীবনভর আপনাদের বহন করে যেতেই হবে।
মিয়াঁ শিকদার, আল্লাহ তোমার কবরকে ঠান্ডা রাখুন, বড় কঠিন শিক্ষা তুমি আমাকে দিয়ে গেছো।
***
আজ যে ঈদুল আযহার দিন, ভুলেই গিয়েছিলাম। সারা দুনিয়ার মুসলমান ঈদের নামায পড়ে; এমনকি আল্লাহর ঘরে হারাম শরীফেও ঈদের জামাত হয়। ঈদের জামাত নেই শুধু মিনায় তাঁবুর শহরের বাসিন্দাদের জন্য।
আমাদের দেশে যেমন পথে পথে কোরবানীর ‘যাবীহা’ যবাই করা হয়, এখানে তা নয়। সবকিছু করা হয় নির্দিষ্ট স্থানে। তাই কোরবানির ঈদের কোন আলামত কোথাও দেখা যায় না।
বলা ঠিক হবে কি না বুঝতে পারছি না, কোরবানির গোশত খাওয়ার খুব ইচ্ছে জাগলো। পঁচিশ বছর আগে যখন হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ.)-এর ছোহবতে হজ্ব করেছি, আল্লাহ তা‘আলা কোরবানির গোশত খাইয়েছেন। সাতাশী সনেও মিনার তাঁবুতে আল্লাহ তা‘আলা কোরবানির গোশতের ব্যবস্থা করেছেন। আর কেন নয়! কোরবানি তো আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে বান্দার জন্য খাছ দাওয়াত! সুতরাং মনে একটা আশা ছিলো, যদিও এবার যাহেরি কোন ব্যবস্থা নেই, তবু কোন না কোনভাবে বান্দাকে আল্লাহ তাঁর দাওয়াতি দস্তরখানে শরীক করবেন।
এবং কী আশ্চর্য! প্রায় সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ যেন গায়ব থেকেই ব্যবস্থা করলেন! বান্দার প্রতি আল্লাহর দয়া ও মায়ার কী কোন সীমা পরিসীমা আছে!
চতুর্থ তলায় ছিলো হিন্দুস্তানী হাজীদের কাফেলা। এ ভবনের লিফট সেখানেই থামে। পঞ্চম তলায় আমরা সিঁড়ি বেয়ে ওঠি, আবার নামার সময় চতুর্থ তলায় এসে লিফটে ওঠি। লিফটের পাশেই রান্নাঘর।
তো হারামে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চতুর্থ তলায় এসে দেখি লিফট সচল হয়েছে। উঠতে যাবো এমন সময় বলা নেই, কওয়া নেই, হিন্দুস্তানী মহিলা রান্নাঘর থেকে রেকাবিতে করে কোরবানির গোশত নিয়ে বের হলেন এবং আমাকে দেখে বলে উঠলেন, হাজী ছাহাব, আইয়ে কোরবানি কা গোশত লীজিয়ে।
ঘরে পুরুষ-মহিলা একসঙ্গে খেতে বসেছে। অনেক পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও দস্তরখানে শরীক হলাম না। ‘শুকরিয়া’ বলে আলতো করে রেকাবি থেকে একটুকরো গোশত তুলে নিলাম। আহা, সে কী স্বাদের গোশত! একটুকরোতেই তৃপ্তি হয়ে গেলো। এটাই হলো আল্লাহর মেহমানদারি! যেন চাওয়ামাত্র পাওয়া! তাই
অন্তরের গভীর থেকে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম।
প্রিয় পাঠক, আমার গোশত খাওয়ায় তোমার কোন লাভ নেই, ঠিক। কিন্তু সত্যি করে বলো তো, কোন স্বাদই কি তুমি পাওনি?! পেলে বোঝবো, তুমি কিছু বুঝেছো; না পেলে বোঝবো, এ স্বাদ বোঝার জন্য তোমাকে আরো অপেক্ষা করতে হবে।
***
নীচে এসে ঢাকা হোটেলে পেট পুরে দুপুরের খাবার খেলাম। তারপর হারাম শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। যোহরের সময় হয়ে এসেছে। নামাযের পরই তাওয়াফে যিয়ারাত করার ইচ্ছে।
গলি থেকে মিসফালার সড়কে এসে দাঁড়ালেই চোখের দৃষ্টি সিণগ্ধ হয় হারামের চত্বর ও প্রাচীর অবলোকন করে। এগিয়ে যেতে যেতে মনে হয় চুম্বক-আকর্ষণ যেন টেনে নিয়ে যাচ্ছে! একই রকম জনস্রোত! একই রকম অভিব্যক্তি! আরেকবার আল্লাহর ঘরের দীদার লাভ করার একই রকম আকুতি! পরিবর্তন শুধু এই যে, ইহরামের শুভ্রতা তেমন করে আর চোখে পড়ে না। এখন পোশাক থেকে বোঝা যায়, কে আরব, কে অনারব; কে
হিন্দুস্তানী, পাকিস্তানী, আর কে বাংলাদেশী।
মানুষের পোশাকই যেন বলে দেয়, হজ্ব এখন বিগতপ্রায়। সৌভাগ্যের দিনগুলো হায়, কিছুতেই ধরে রাখা যায় না!
হারাম শরীফে প্রবেশ করলাম। যোহরের আযান হলো এবং জামাত হলো। আল্লাহর ঘর তখনো দেখা হলো না। ভিতরে ভিতরে রোমাঞ্চিত হলাম, কেমন অনুভূতি হবে তিনদিন পরে আল্লাহর ঘরের দীদারে!
সমাগম কিছুটা হালকা হলো। ধীরে ধীরে দুরু দুরু বুকে এগিয়ে গেলাম উম্মে হানির দিকে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলাম। দৃষ্টি তখনো অবনত। আমি জানি, কোথায় দাঁড়ালে আল্লাহর ঘরের দীদার হবে। দাঁড়ালাম। অবনত দৃষ্টি ধীরে ধীরে উপরে উঠলো এবং .. এবং দীদার নছীব হলো! আমি জানি, আমার চোখের তারায় এখন আল্লাহর ঘরের ছবি! ধন্য আমি! ধন্য আমার চোখের তারা দু’টি!
তাকিয়ে আছি, নিষ্পলক দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে আছি। চারপাশে সবকিছু যেন থেমে গেছে! সবকিছু যেন মুছে গেছে! আমি আছি, আমার সামনে আছে আল্লাহর ঘর! মাত্র তো তিনটি দিন, কিন্তু মনে হলো, কত যুগ পরে যেন আল্লাহর ঘর দেখা হলো; যেন প্রথম অবলোকনের সেই শিহরণ! সেই কম্পন!! সেই স্পন্দন!!!
না, একটু যেন অন্যরকম! একটু যেন আছে হাতছানি! ‘এসেছো! এসো, এসো, আমাকে তাওয়াফ করে হজ্বের পূর্ণতা অর্জন করো!’
যেন সেই অদৃশ্য হাতছানির সিণগ্ধ আকর্ষণে ধীর কোমল পদক্ষেপে আমি এগিয়ে গেলাম মাতাফের দিকে!
বান্দার মিনতি শোনো হে আল্লাহ! আজ এই তাওয়াফে যিয়ারাতে তোমার ‘ইরফান’ দান করো হে আল্লাহ! এই তাওয়াফে হে আল্লাহ, আমি দিতে চাই আমাকে এবং পেতে চাই তোমাকে!!
সমগ্র মাতাফ এমন পরিপূর্ণ যেন তিল ধারণেরও স্থান নেই, কিন্তু স্থান হলো। স্থান নেই, তবু যে আসবে তারই স্থান হবে। এ যে আল্লাহর ঘর! পৃথিবীতে কোথাও যার ঠাঁই নাই, তারও ঠাঁই হবে এখানে, আল্লাহর ঘরের প্রাঙ্গণে।
শুরু হলো হজ্বের ফরয তাওয়াফে যিয়ারাত। যতবার তুমি তাওয়াফ করবে, তোমার সামনে উন্মোচিত হবে মা‘রিফাতের নতুন কোন রায ও রহস্য। প্রতিটি তাওয়াফ তোমাকে নিয়ে যাবে অনুভবের নতুন জগতে, সান্নিধ্যের নতুন দিগন্তে। এজন্য তোমাকে হতে হবে না অলী কামেল বুযুর্গান। শুধু আল্লাহর কাছে একটু চাইতে হবে। গোনাহগার হলেও তোমার চাওয়া বৃথা যাবে না। শুধু একটু কামনা করো, একটু প্রার্থনা করো, হৃদয়কে একটু একাগ্র করো, আর দৃষ্টিকে রাখো অবনত; তারপর তাওয়াফ শুরু করো, অবশ্যই তুমি অনুভব করবে নতুন কিছু।
কখনো যদি শেষ না হতো! তাওয়াফের এই নূরের জোয়ারে ভেসে যাওয়া, এই তরঙ্গদোলায় দোল খেতে থাকা কখনো যদি শেষ না হতো! চিরকাল যদি এভাবে চলতে থাকতো! কিন্তু না, যখন সময় হবে, তোমাকে থামতে হবে। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত - এবার তোমাকে থামতে হবে।
তওয়াফের জোয়ার আরো যেন জোরওয়ার হলো, প্রেমের তরঙ্গদোলা আরো যেন প্রবল হলো, এদিকে আমার তাওয়াফও শেষ হলো, আর মনের মধ্যে কেমন একটা কষ্ট যেন ক্ষত সৃষ্টি করতে লাগলো, হায়, শেষ হয়ে গেলো তাওয়াফ! এমন সময় হঠাৎ ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠলো, তুমি চাও, চিরকাল তোমার তাওয়াফ চলতে থাকুক! তাহলে দোয়া করো; যারা তাওয়াফ করছে তাদের জন্য এভাবে দু‘আ করো, হে আল্লাহ, কেয়ামত পর্যন্ত তোমার যত বান্দা এ ঘর তাওয়াফ করবে তাদের তুমি কবুল করো!
এভাবে দু‘আ করো, তাহলে তোমার আমলনামায় তাওয়াফের সিলসিলা চিরকাল চলতে থাকবে।
দু‘আ করলাম, আর তখন ...!
কাছে গিয়ে হজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, কিংবা মুলতাযামে বুক লাগানো আজ কল্পনা করাও সম্ভব নয়। তাই শুধু দূর থেকে দেখা হলো, আর তাতে আফসোসের একটা দহন অনুভূত হতে লাগলো। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো, আফসোসের কী আছে! কোন কিছুই তো না, দূরে নয়! সবকিছুই তো তোমার কাছে, তুমি যদি থাকো তাঁর কাছে! এখান থেকেই ডাকো না! এখান থেকেই হাত পেতে মাগো না!! ‘দূর’ হয়ে যাবে ‘দুয়ার’! চাওয়ার দেরী, দেরী নেই পাওয়ার!! এটা যদি হয় তোমার বিশ্বাস তাহলে তোমার জন্য রয়েছে আসমানের আশ্বাস!!!
তাওয়াফের দু’রাকাত আদায় করতে হলো মাকামে ইবরাহীমের অনেক পিছনে। কারণ পুরো মাতাফ তখন ‘প্লাবিত’ তাওয়াফের তরঙ্গজোয়ারে!
যামযাম পান করতে গিয়ে ঘটলো অভূতপূর্ব এক ঘটনা, যার ব্যাখ্যা না তখন বুঝতে পেরেছি, না এখন বুঝতে পারি। কী ছিলো এর হাকীকত ও রহস্য!
আল্লাহর ঘর বরাবর মাতাফের শেষ প্রান্তে, যেখানে যামযাম পানের ব্যবস্থা, সে পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব হলো কোনমতে। কিন্তু অবস্থা দেখে মনে হলো, যামযামের পিপাসা আজ পিপাসাই থেকে যাবে। ভাবছি ফিরে যাই; এমন সময় দেখি, কলের গোড়ায় ছিলেন নূরানী চেহারার দীর্ঘদেহী এক আরব আমার দিকে যামযামপূর্ণ গ্লাস এগিয়ে দিলেন। কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করলাম এবং পান করলাম। আবার তিনি গ্লাস পূর্ণ করে দিলেন, আবার পান করলাম। আবার, আবার; এভাবে সাত গ্লাস পান করার পর আমাকে বলতে হলো,
يا شيخ! قد شبعت وارتويت
(আমি তৃপ্ত ও পরিতৃপ্ত হয়েছি)
তিনি মৃদু হেসে বললেন,
لا تعجل حتى تبلغ عشرة كاملة
(পূর্ণ দশ-এ পৌঁছার আগে ক্ষান্ত হয়ো না।) নবম গ্লাসের পর মনে হলো, আমার দেহের কোষে কোষে যামযাম পৌঁছে গেছে! আর একটি ফোঁটা গ্রহণের সাধ্য বুঝি আমার নেই। অনেকটা অসহায়ের মত অপারগতা প্রকাশ করলাম, কিন্তু অজানা অচেনা আরব শায়খ নাছোড় বান্দা; দশম গ্লাস পান করতেই হবে! তিনি বললেন,
اشرب، والله يجزيك
ইয়া আল্লাহ, তোমার এ কোন লীলাখেলা! ‘পঁচিশ বছরের জীবনে’ এমন ঘটনা তো আর ঘটেনি! হঠাৎ মনে হলো, আমি যেন কোন অদৃশ্য শক্তি দ্বারা সম্মোহিত। শায়খ তার ঠোঁটের কোন মধুর হাসির ঝিলিক ধরে রেখে দশম গ্লাসটি এগিয়ে দিলেন। মনে হলো, আমি তা পান করলাম না, আমাকে পান করানো হলো। আর সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীর এমন হালকা হয়ে গেলো যেন মাত্র একদু’ গস্নাসই পান করেছি। খালি গস্নাসটি ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখি, সেই আরব শায়খ আমার সামনে নেই।
আমি যে বললাম, ‘অজানা, অচেনা’, আসলেও কি তাই! তিনি তো আমার ‘কালিমাগো’ মুসলিম ভাই! ভাই কি কখনো হতে পারে ভাইয়ের অজানা, অচেনা! পরিচয়ের বন্ধন ছাড়া কেউ এভাবে মেহমানদারি করে জগতের শ্রেষ্ঠ ‘পানীয়’ দ্বারা! পরিচয়ের বন্ধন ছাড়া এভাবে এতদিন পরো কি মনে পড়ে কারো নূরানি চেহারা! পরিচয়ের বন্ধন অবশ্যই ছিলো এবং আছে। শুধু জানি না, তিনি কে? শুধু জানি না, আবার কবে দেখা হবে তার সঙ্গে? যামযামের পারে! হাউযের কিনারে!! জান্নাতের বাজারে!!!
***
আছরের নামাযের পর বাসায় গেলাম। গিয়ে দেখি, ভাই কামরুল ইসলাম তাওয়াফে যিয়ারাত করে পূর্ণ ‘আলহাজ্ব’ হয়ে বসে আছেন! এটা তার ফরয হজ্ব। তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস তখন দেখবার মত! প্রতিটি কথায় ভিতরের আনন্দ যেন উপচে পড়ছে! বিভিন্ন সময় তিনি তার অনেক পেরেশানি ও সমস্যার কথা আমাকে বলেছেন। তখন মনে হতো, তিনি অনেক দুঃখী মানুষ। আমি সমবেদনার সঙ্গে তার কথা শুনতাম এবং যথাসাধ্য সান্ত্বনা দিতাম, কিন্তু আজ মনে হলো, তিনি জগতের সবচে’ সুখী ও পরিতৃপ্ত মানুষ। আল্লাহর ঘরের যিয়ারত এবং বাইতুল্লাহর হজ্ব যখন ভিতরের অনুভব থেকে সম্পন্ন হয় তখন হৃদয় ও আত্মার পুলক ও প্রশান্তি এমনই হয়। কলবের সুকূন ও সাকীনা তখন সত্যি অতুলনীয় হয়। কিন্তু মানুষকে তো ফিরে আসতেই হয় তার অতীতের জীবনে, জগৎ-সংসারের জটিল আবর্তে। ঊনপঞ্চাশটি কঙ্করের আঘাত খাওয়া শত্রুও আহত পশুর হিংস্রতা নিয়ে লেগে থাকে তার পিছনে। তখন বড় কঠিন হয়ে পড়ে হজ্ব ও বাইতুল্লাহ অর্জন রক্ষা করা, তবে আল্লাহ যাকে সাহায্য করেন। আমি আমার সামনের এই সুখী মানুষটির উদ্ভাসিত মুখমন্ডলের দিকে তাকিয়ে আন্তরিকভাবে কামনা করলাম, ‘আল্লাহ যেন সাহায্য করেন তোমাকে, আমাকে, আমাদের সকলকে। আজীবন আমরা যেন ধরে রাখতে পারি হজ্বের যাবতীয় অর্জন। বাইতুল্লাহর নূর ও নূরানিয়াতে আমাদের জীবনের চলার পথ যেন থাকে সদা আলোকিত, আমীন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)