শাওয়াল ১৪৩০   ||   অক্টোবর ২০০৯

স্কুল-কলেজের ইসলামিয়াতের সিলেবাস : একটি পর্যালোচনা

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

১. পরিভাষা ও পরিচিতি ক. ইবাদতের অর্থ রজব ১৪৩০ হি. (জুলাই ’০৯ ইং) সংখ্যায় এই প্রবন্ধের দ্বিতীয় কিসি- প্রকাশিত হয়েছিল। ‘পরিভাষা ও পরিচিতি’ শিরোনামের অধীনে ‘ইবাদতে’র অর্থ সম্পর্কে আলোচনা হচ্ছিল। বলা হয়েছিল যে, ‘ইসলাম শিক্ষা’র বইগুলোতে ইবাদতের যে অর্থ করা হয়েছে তাতে ‘ইবাদত’ ‘ইতাআতে’র সমার্থক বলে প্রতীয়মান হয়। অথচ ‘ইবাদত’ ও ‘ইতাআত’ দু’টি ভিন্ন অর্থবোধক আলাদা পরিভাষা। ইবাদতের অর্থ উল্লেখ করার পর বলা হয়েছিল যে, যে সকল আমল আল্লাহ তাআলা নিজের জন্য নির্ধারিত করেছেন এবং যা গায়রুল্লাহর জন্য করা হলে শিরক হয় সেসব কর্মগত ও বিশ্বাসগত আমল সম্পর্কে আগামী সংখ্যায় লিখতে চেষ্টা করব।’ বর্তমান সংখ্যায় এই ওয়াদা পূরণের ইচ্ছা করেছি। আল্লাহ তাআলা সঠিক কথা সঠিক পন'ায় ও সহীহ নিয়তে লেখার তাওফীক দান করুন। আমীন। কর্মগত ইবাদত ১. সালাত (নামায) নামায সর্বোত্তম ইবাদত এবং শুধু আল্লাহরই জন্য তা হতে পারে। নামাযের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ রোকন সিজদা। এটিও একমাত্র আল্লাহরই জন্য। ইবাদতের সিজদা গায়রুল্লাহকে করা শিরকে জলী বা প্রকাশ্য শিরক। তদ্রূপ আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে প্রয়োজন পূরণকারী, বিপদাপদ থেকে মুক্তি দানকারী অর্থাৎ সাধারণ উপায়-উপকরণের উর্ধ্বে সাহায্যদানের ক্ষমতাশালী মনে করে সিজদা করলে তা-ও শিরকে জলী বা প্রকাশ্য শিরক। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে- তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও নয়; সিজদা কর আল্লাহকে, যিনি এগুলো সৃষ্টি করেছেন। যদি তোমরা প্রকৃতই তাঁর ইবাদত কর।-সূরা হা-মীম আসসাজদা : ৩৭ অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে তারা কেন সেজদা করে না আল্লাহকে যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর লুকায়িত বস'কে প্রকাশ করেন, যিনি জানেন, যা তোমরা গোপন কর এবং যা তোমরা ব্যক্ত কর।-সূরা নামল : ২৫ নিছক অভিবাদন হিসাবে সিজদা করাও হারাম। শরীয়তে অভিবাদনের পন'া সুনির্ধারিত। তা হচ্ছে সালাম, যা হযরত আদম আ. থেকে শুরু করে প্রত্যেক নবীর শরীয়তে ছিল। কিন' পূর্বের উম্মত এই পন'া ছেড়ে শির নত করে বা ভূমিতে নত হয়ে প্রণাম জানানোর পন'া আবিষ্কার করেছে। খাতামুন্নাবিয়ীন সাইয়েদুল মুরসালীন হযরত রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই বিকৃতি সম্পর্কে তাঁর উম্মতকে সাবধান করেছেন এবং ঘোষণা করেছেন যে, অভিবাদনের পদ্ধতি হচ্ছে সালাম ও মুছাফাহা এবং আল্লাহর হামদ ও ছানার সঙ্গে পরস্পর কুশল জিজ্ঞাসা। রুকুও নামাযের গুরুত্বপূর্ণ রোকন। বাতিল উপাস্যের সামনে রুকু করা শিরক। তদ্রূপ ইবাদতের উদ্দেশ্যে গায়রুল্লাহর সামনে রুকু করাও শিরক। নিছক অভিবাদনের উদ্দেশ্যে কারো সামনে নতশীর হওয়া নিষিদ্ধ ও অবৈধ। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞাসা করেছিলেন, কারো সঙ্গে সাক্ষাত হলে তার সম্মানে মাথা ঝুকানো যাবে কি? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, না। নামাযের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রোকন হচ্ছে কিয়াম। মুশরিকরা তাদের মনগড়া উপাস্যদের সামনে জোড়হাতে দণ্ডায়মান হয়ে ভক্তি প্রদর্শন করে। এজন্য কোনো বাতিল উপাস্য কিংবা কোনো শিরক ও কুফরের নিদর্শনের সামনে জোড় হাতে দণ্ডায়মান হওয়া শিরক। নিছক সম্মানার্থে কারো সামনে দাঁড়ানোও নিষিদ্ধ, যা প্রাচীন আজমী রীতি। কেননা এতেও শিরকের কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। ইবাদত হিসাবে কিয়াম একমাত্র আল্লাহর জন্য। বান্দা নামাযে হাত বেঁধে আল্লাহর সামনে দণ্ডায়মান হয়, হামদ ও ছানা করে এবং তাঁর কালাম তেলাওয়াতের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের মর্যাদা লাভ করে। এই কিয়াম সম্পর্কে কুরআন মজীদে বলা হয়েছে এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যে তোমরা বিনীতভাবে দাঁড়াবে।-সূরা বাকারা : ২৩৮ আরো বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি রাত্রের বিভিন্ন যামে সিজদাবনত হয়ে ও দাঁড়িয়ে বিনয়াবনত হয়, ...।-সূরা যুমার : ৯ মোটকথা, নামায ও নামাযের বিভিন্ন অবস'া হচ্ছে সর্বোত্তম কর্মগত ইবাদত। এর বিভিন্ন রোকনও এমন, যা ভিন্নভাবেও গায়রুল্লাহর জন্য করা যায় না। ইরশাদ হয়েছে, এবং সিজদার স'ানসমূহ (অঙ্গসমূহ) আল্লাহরই জন্য। সুতরাং আল্লাহর সঙ্গে তোমরা অন্য কাউকে ডেকো না। আর যখন আল্লাহর বান্দা আল্লাহর ইবাদত করতে দাঁড়ায় তখন তারা ভিড় জমায়।-সূরা জিন্ন : ১৮-১৯ ২. যাকাত যাকাত আর্থিক ইবাদতের মধ্যে সর্বোত্তম। মানুষের দেহ ও প্রাণ যেমন আল্লাহর তেমনি তার অর্থ ও সম্পদও আল্লাহর। এজন্য দৈহিক ইবাদতের মতো আর্থিক ইবাদতও একমাত্র আল্লাহরই জন্য। আল্লাহর দেওয়া সম্পদ মানুষ যে কোনো বৈধ পথে খরচ করতে পারে। কিন' কারো প্রতি ভক্তি প্রকাশ ও তার নৈকট্য অর্জনের জন্য নিজের পবিত্রতা ও আত্মশুদ্ধির জন্য কিংবা বালা-মুসীবত দূর হওয়ার জন্য কারো (বাকি অংশ ৩০ পৃষ্ঠায়) স্কুল-কলেজের ইসলামিয়াত ... (১৩ পৃষ্ঠার পর) দরবারে ধন-সম্পদের নযরানা পেশ করা বা তার নামে সম্পদ উৎসর্গ করা হচ্ছে ইবাদত। এটা একমাত্র আল্লাহরই জন্য। যাকাত ও সদকার গূঢ় অর্থ এটাই। আর এজন্যই তা ইবাদত। যাকাত ও সদকা যদিও দেওয়া হয় ফকীর-মিসকীন ও অন্যান্য উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে, কিন' এর উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য ও সন'ষ্টি অর্জন করা এবং তার নিকট থেকে নিজের দ্বীনী ও দুনিয়াবী হাজতসমূহ পূরণ করা। হাদীস শরীফে আছে, (ইখলাসের সঙ্গে) যে সদকা করা হয় তা ফকীরের হাতে যাওয়ার আগে আল্লাহ তাআলার হাতে পৌঁছে যায়। কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, তারা কি জানে না যে, আল্লাহ তো বান্দাদের তাওবা কবুল করেন এবং ‘সদকা’ গ্রহণ করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ ‘ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা তাওবা : ১০৪ ভালো কাজে সম্পদ ব্যয়ের অনেক পথ রয়েছে। আল্লাহ তাআলার বিধান মোতাবেক হলে তা ‘আমলে ছালিহ’ বা ছওয়াবের কাজ। কিন' সকল ব্যয় পারিভাষিক অর্থে ‘ইবাদতে’র মধ্যে শামিল হয় না। শুধু যাকাত, সদকা, মান্নত পূরণ ইত্যাদি এতে শামিল হয়। ৩. সিয়াম (রোযা) নিছক অভুক্ত থাকার নাম রোযা নয়। কেউ যদি রোগবশত পানাহার ত্যাগ করে কিংবা আল্লাহ মাফ করুন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য অনশন করে তাহলে তা কখনো ইসলামী রোযা নয়। ইসলামী রোযার ফারাইয ও আরকান এবং এর কর্মগত, বিশ্বাসগত ও অনুভূতিগত বিভিন্ন আদব-কায়েদা সম্পর্কে যে কোনো জ্ঞানী মুসলিমই অবগত। অতএব তারা জানেন যে, রোযা খাঁটি ইবাদত এবং শুধু আল্লাহরই জন্য। হাদীস শরীফে আছে- সওম আমারই জন্য এবং আমিই তার প্রতিদান দিব। গায়রুল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য কিংবা কোনো গায়বী শক্তির সন'ষ্টির দ্বারা মকসূদ হাসিলের উদ্দেশ্যে অনাহার করা হলে তা হবে শিরক। অনশন পালন হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয়, যা বেদ্বীনদের রীতি এবং সম্পূর্ণ হারাম। আর স্বাস'্যগত কারণে পানাহার ত্যাগ করার বিষয়টি হচ্ছে দৈহিক ও চিকিৎসানৈতিক বিষয়। সেটাও রোযা নয়। ষ (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement