জুমাদাল উলা-১৪৩৩   ||   এপ্রিল-২০১২

সুন্নাহর রৌদ্রময় ভূখন্ডে ঐক্যের জীবন্ত আশাবাদ

মাওলানা উবায়দুর রহমান খান নদভী

২৩ রবিউস সানী ১৪৩৩ হিজরী, মোতাবেক ১৭ মার্চ ২০১২ শনিবার, দিনটি যেন ছিল সূর্যালোকে সমুজ্জ্বল সাধারণ দিনের চেয়েও বেশি একটু রৌদ্রময়। রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের মাল্টিপারপাস হলে সমবেত বসা ও দাঁড়ানো মিলিয়ে প্রায় ১ হাজার উলামা-মাশায়েখ-তালাবা, উচ্চ শিক্ষিত সুধী ও দ্বীনদার বিশিষ্ট নাগরিকদের সপ্রাণ উপস্থিতিই দিনটিকে দিয়েছিল বিশেষ মাহাত্ম। সাধু সজ্জন জ্ঞানী গুণী খোদাভীরু লোকদের এমন একটি নির্বাচিত সমাবেশ সচরাচর চোখে পড়ে না। সুবাসী, সুবেশী, সুহাসি, সুভাষীদের নূরানী মুখাবয়ব চারপাশ আলো করে রেখেছিল সেদিন। পোষাকে ছিল সাদার ব্যাপকতা। শ্বেত শুভ্র বসন বললে যে পবিত্রতার আবহ তৈরি হয় ঠিক তাই ছিল পূর্ণমাত্রায়। ঈমান আমল সততা সাত্ত্বিকতা সারল্য ও সাধুতার অনুশীলনে স্নিগ্ধ অন্তর আত্মা দেহ মন মনন ও মনোনিবেশ এ সত্য-সাধক উপস্থিতিকে করে তুলেছিল মহিমান্বিত।

এই অভাজন কিছুটা দেরিতে হলেও যোগ দিয়েছিল সেই দীপ্ত সভায়। রাজধানীতে কুরআন-সুন্নাহর প্রকৃত ধারক বাহক সাধক ও প্রচারকগণের এই উজ্জ্বল তারকাসভায় নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। আমি পোশাক আষাকে যেমন ছিলাম ঝাপসা। শরীর স্বাস্থ্যও পীড়াকাতর। হৃদয়মন দুর্বল হতমান। ইলম আমল আখলাকের দিক থেকেও হতাশাজনক ন্যুব্জ ও ম্রিয়মান। সেরা ও বিশিষ্টজনদের বদান্যতা ও ঔদার্য আমার মত নিষ্প্রভ অনুজ্জ্বলকেও স্থান করে দিল তাদের আদরের আসনে। তারা না হয়েও আমি ঠাঁই পেয়েছিলাম তারকাদের সে মিলনমেলায়। আমি নিজেকে চিনি, নিজের হীনতা, অযোগ্যতার বাস্তব অবস্থা জানি। আর তাই নেক ও যোগ্য ব্যক্তিরা আদর কদর করলে ভয় এবং লজ্জায় সিটিয়ে যাই। ধরা খাওয়ার ভয়ে নিজের মাঝেই নিজে মিইয়ে থাকি। আর একান্ত অভিনিবেশসহ রাহমান রাহীম ওয়াহহাব ও সাত্তার-এর নাম জপতে থাকি। বুঝি, আল্লাহ রহমান রাহীম সাত্তার ও করীম বলেই আমার মত মানুষেরা সকল অসভ্যতা সত্ত্বেও সভায় আসন পাই। আনপড় হয়েও পড়ার কিতাব পাই। বকলম হয়েও লেখার কলম পাই। অকাজের হয়ে কলম-কাগজ পাই। মানে মানে যখন মেলা শেষ হয় আমি দমে দমে তাঁর শোকর করি। ভাবি, কত রাঊফ রাহীম লাতীফ তিনি। কেমন দয়া করুণা ও ক্ষমায় ঢেকে রেখে মানে মানে পার করে দিলেন তিনি এক গুনাহগার সিয়াহকার ব্যক্তিকে। এভাবে যদি শেষ পর্যন্ত মূল ঘাঁটিটি পার হয়ে যেতে পারি তাইলেই বাঁচোয়া। হে আল্লাহ, আমাকে, আমার মা-বাবা এবং বিশ্বাসী নারী-পুরুষদের শেষ বিচারের দিন তুমি পার করে দিও।

মিলনায়তনের প্রবেশ পথে হাস্যোজ্জল তরুণ কর্মীবৃন্দ সালাম ও শুভেচ্ছার সাথে সভার পথ দেখান। হাতে তুলে দেন মূল প্রবন্ধের গ্রন্থবদ্ধ ছাপা কপি, মারকাযুদ দাওয়াহর সৌজন্যে একটি লেখার প্যাড আর স্মারকচিহ্ন মূদ্রিত একখানা কলম। উপহার পেতে কার না ভালো লাগে! দান দয়া অনুগ্রহ আর করুণায় গড়া মানুষ তো আজন্ম করুণারই কাতর। পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহে নিষিক্ত এই ভরা মিলনায়তনে মারকাযের মুরববীদের এই প্রীতি উপহার আমার মতো জাতবান্দাকে মাবুদ-মাওলার দিকে আরো বেশি করে ঝুঁকিয়ে দিল, যে কোনো হাতের পেছনে কেবল মালিকের হাতই কার্যকর দেখতে পায় । শোকর ও ইমতিনানের উচ্ছ্বাস আমার ধারণক্ষমতা ছাপিয়ে যাচ্ছিল। আমি আরো তন্ময়তার সাথে আল্লাহর পবিত্র নামের যিকরে মগ্ন হয়ে গেলাম।

চারপাশে অসংখ্য চেনামুখ। রাজধানীর বিশিষ্ট সব আলেম, পীর-বুযুর্গ, মুহতামিম, মুফতী, ফকীহ, শায়খুল হাদীস, মুহাদ্দিস, লেখক, সম্পাদক, চিন্তাবিদ, প্রতিশ্রুতিশীল নওজোয়ান বিদ্যার্থী, তালিবুল ইলম, দ্বীনদার শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী ও সুধীবৃন্দ। আমার ঘনিষ্ঠ আসনে আজকের মধ্যমণি মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক। তার পাশে তারই অগ্রজ আজকের সেমিনারের সভাপতি মারকাযের মুদীর (পরিচালক) মুফতী আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ সাহেব দা.বা.।

জাত বান্দা শব্দটি আমার তৈরি। এটি হাদীস শরীফের ভাব থেকে উদ্ভূত, কিন্তু মাওলানা আবদুল মালেক সাহেবের একটি লেখা থেকে এটি সিঞ্চিত। তিনি কিছুদিন আগে লিখেছিলেন, হে আল্লাহ! আমি তোমার বান্দা। তোমার এক বান্দার পুত্র। এক বাদীর গর্ভজাত সন্তান। এ কথাগুলো পড়ার সময় আমার মনে হল, এ অবস্থা ও বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরতে নিজেকে জাত-বান্দা বলাই হবে উত্তম।

পবিত্র আবহে তিলাওয়াত ও দ্বীনী তারানা পরিবেশনের মাধ্যমে শুরু হয় সেমিনারের প্রথম পর্ব। প্রবন্ধ পাঠ করেন মারকাযের উস্তাদ, লেখক ও সম্পাদক মাওলানা যাকারিয়া আবদুল্লাহ। অনুষ্ঠান পরিচালনায় মুগ্ধতার আবেশ ছড়াচ্ছিলেন লালিত্যপূর্ণ কথাশিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক মাওলানা শরীফ মুহাম্মদ। প্রবন্ধ পাঠের অবসরে আমি পূর্ণ প্রবন্ধটি উল্টে পাল্টে দেখছিলাম। এসি তেমন কাজ করছিল না বলে হলের ভেতর গরম কিছুটা জানান দিচ্ছিল। আমি ধীরে ধীরে দু বোতল পানি শেষ করে ফেললাম। আর অপেক্ষা করছিলাম বহুল কাঙ্খিত পানি বিরতির।

সেমিনারের দাওয়াতনামায় এঁরা লিখেছেন পানি বিরতি। এটাও জাত-বান্দার মত নতুন ব্যবহার। ভাষাবিজ্ঞানে কাদিরুল কালাম শায়ের ও সাহিবুল ইক্তেদার আদীব বলে দুটি কথা আছে। এরা নতুন শব্দ, পরিভাষা, ব্যবহার ও ধারার জন্ম দিতে পারেন। ভাবছি, মারকায কি নতুন পরিভাষার জন্ম দিচ্ছে? নতুন ধারার? নতুন যুগের? এরা কি দ্বীন, শরীয়া, ইলম, দাওয়াহ, সমাজ, সংসার, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাষ্ট্র, সভ্যতা ইত্যাদি অঙ্গনে নতুন যুগের উপযোগী তাজদীদী কোনো ধারার সূচনা করছে?

অবশেষে পেলাম সেই পানি বিরতি। আমি আবারো কেবল পানিই নিলাম। সিঙ্গাড়া, সমুচা, বালুসাই, কেক কিছুই অসুস্থ মানুষের রুগ্ন পেটে সয় না। এ সবই সুস্থ সুজন প্রাণময় সজীব অডিয়েন্সের। আমি যে সবদিক দিয়েই অযোগ্য আবারও তা প্রমাণ করলেন মাকতাবাতুল আশরাফের প্রধান মাওলানা হাবীবুর রহমান খান। বোতলের মুখ খুলতে আবারও তিনি এক স্বেচ্ছাসেবীর সাহায্য পাঠিয়ে আমাকে উদ্ধার করলেন। নতুন প্রবন্ধ-পুস্তক, সুন্দর প্যাড, নবীজীর নামায, তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন, ইসলাহী মাজালিসের জন্য তাকে প্যাকেজ জাযাকাল্লাহ জ্ঞাপন করলাম। সঙ্গে সঙ্গে নতুন প্রকাশিত সব বই গিফট দেওয়ার কথা বলে তাকে হাসালাম। হাসালাম বলার চেয়ে বরং তার প্রিয়দর্শী মুখের নয়নাভিরাম আলোকময় হাসি দেখে আনন্দ লাভ করলাম। মনে পড়ল, জাযাকাল্লাহ সংস্কৃতির মুখ্য প্রচারক পরম শ্রদ্ধাভাজন অগ্রজপ্রতিম মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ (আদীব হুজুর) দামাত বারাকাতুহুম-এর নূরানী চেহারা। যিনি তার যুগান্তকারী অনেক সংস্কার-কর্মসূচির মত কৃতজ্ঞতাবোধ, কৃতজ্ঞতাপ্রকাশ, বিশুদ্ধ ধন্যবাদজ্ঞাপক পদ্ধতি নিয়েও লিখছেন, বলছেন। এ সবের ফলে আজ থ্যাংয়্যুর বদলে জাযাকাল্লাহর সাথে আমাদের সমাজ পরিচিত হতে শুরু করেছে। সুন্নতই হতে চলেছে বাংলার মুসলমানের সংস্কৃতি।

অতএব হে আদীব সাহেব হুজুর! জাযাকাল্লাহ! নিভৃতচারী ব্রতসাধনা সামান্য হলেও যদি তিনি ভাঙ্গতেন। অন্তত আজকের সেমিনারের মত তবিয়তশেনাস ইলমবান্ধব কোনো কোনো মজলিসে।

শুরু হলো দ্বিতীয় পর্ব। প্রবন্ধের উপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা পেশ করলেন বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুল মতীন (তেজগাঁও জামিয়া ইসলামিয়া), প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন সাহিত্যিক বহুগ্রন্থপ্রণেতা ও সফল অনুবাদক মাওলানা আ ব ম সাইফুল ইসলাম। আলোচকগণের নির্দেশনার প্রতি প্রবন্ধকার মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব শ্রদ্ধাপ্রকাশ করে তাদের জন্য জাযায়ে খায়েরের দুআ করলেন। এ পর্যায়ে এই অভাজনের নাম ঘোষণা করা হলো আলোচকরূপে। মনের কথা, কথার কথা, কাজের কথা, দরকারি কথা সব মিলিয়ে আমি আধা ঘণ্টা কথা বললাম। কিন্তু মূল কথাটিই সময়াভাবে বলা হলো না। এরপর মুদীর সাহেব কর্তৃক সভাপতির ভাষণ। সবশেষে সাহেবজাদায়ে হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. মাওলানা শাহ আহমদুল্লাহ আশরাফ কর্তৃক সবাইকে নিয়ে দুআ ও মুনাজাত।

অনেক কথার ভেতর এ কথাটিও বলেছি যে, মাওলানা আবদুল মালেক সাহেব দামাত বারাকাতুহুম ওয়াহদাতুল উম্মাহ ওয়াত্তিবাউস সুন্নাহ নামে যে দীর্ঘ নিবন্ধটি তৈরি করেছেন বর্তমান সময়ের বাংলাদেশে এমন একটি সমৃদ্ধ প্রামাণ্য চিন্তাপূর্ণ ও আন্তরিক লেখা সত্যিই বিরল। আরো কেউ কেউ হয়তো লিখতে পারতেন কিন্তু এতটা সময় মনোযোগ গভীর অভিনিবেশ স্বচ্ছ ও লক্ষ্যভেদী স্পৃহা জাগ্রত হৃদয় সমৃদ্ধ গ্রন্থ সংগ্রহ উপযুক্ত সহযোগী প্রভৃতি তাদের নেই। প্রবন্ধটি আমি পড়েছি। মাওলানা আবদুল মালেক জানেন, কোত্থেকে কি কি এনে প্রবন্ধ সাজাতে হয়। তিনি কুরআন-সুন্নাহ ও ইলমী উত্তরাধিকারের ঠিকানা জানেন। দেড় হাজার বছরে গড়ে উঠা ইসলামী জ্ঞান দর্শন, সাহিত্য ও গবেষণার বিস্তৃত মহাগ্রন্থাগারের সূচিপত্র সম্পর্কে তাঁর ভালো ধারণা রয়েছে। তিনি এর ক্যাটালগ খুঁজে বের করার যোগ্যতা রাখেন। শুধু এ প্রবন্ধই নয়, অতীতেও তাঁর অন্তত পনেরটি লেখা আমি সপ্রশংস দৃষ্টিতে, মুগ্ধ নয়নে, আগ্রহের সাথে পাঠ করেছি। অকৃত্রিম শান্তি ও আনন্দ লাভ করেছি। এসবের দ্বারা আমার জ্ঞানও অনেকাংশে সমৃদ্ধ হয়েছে। আল্লাহ তাঁর হায়াত ও নেক কাজে বরকত দান করুন। তাঁর কাজের জন্য তাঁকে উত্তম বিনিময় ও পুরস্কার দানে ভূষিত করুন। 

প্রসঙ্গত আমি আজকের সভাপতি মারকাযুদ দাওয়াহর মুদীর হযরত মাওলানা আবুল হাসান মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ সম্পর্কে বলতে চাই। মাওলানা আমার খুব পছন্দের মানুষ তার সরলতা নীতি নিষ্ঠা ও রসবোধের জন্য। আলহামদুলিল্লাহ, তার বিষয়জ্ঞান ঈর্ষনীয়, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনার দক্ষতা তো মারকাযের ক্রম উন্নতি ও অর্থবহ বিকাশ থেকেই সুস্পষ্ট। এসব গুণ এবং তার পড়াশোনা তাকে একজন সেরা ফকীহ হিসেবে আবির্ভুত করেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্ব, দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, অর্থনীতি ও বর্তমান সময়ের মানুষ সম্পর্কে তার শরীয়তনির্ভর আলোচনা ও মূল্যায়নে আমি মুগ্ধ। মাসিক আলকাউসারের কল্যাণে আমরা তার পাঁচ-সাতটি মূল্যবান অসাধারণ লেখা পড়ার সুযোগ পেয়ে ধন্য হয়েছি। আল্লাহ তাকেও সব ধরনের খায়ের দান করুন, জাযা দান করুন। 

মূল শিরোনাম, প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য বা আমার বক্তব্য বিষয়ে, আগামীতে কোনো নিবন্ধ লিখার ইচ্ছা রইল। আজ কেবল সেমিনার সংক্রান্ত সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন, ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি ও কিছু প্রাসঙ্গিক কথা পর্যন্তই। ইনশাআল্লাহ আবার কথা হবে। আপনারা ভালো থাকুন। আল্লাহ হাফেয। 

 

 

advertisement