বাবরি মসজিদ-৭
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আলেকজান্ডার কেনিংহামের রিপোর্ট প্রথম খন্ড ১৮৭১ ঈ.
১৮৫৭ সালের পর কোম্পানির রাজত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। নিজেদের কায়েমী স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য তারা অন্য অনেক কাজের মতো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠা করল এবং বই-পুস্তক লেখানো শুরু করল। এসময়ই প্রত্যেক জেলার গেজেটিয়ার প্রস্ত্তত করা হয়। আপাত দৃষ্টিতে উপকারী মনে হলেও যে বিষ এ সকল রচনার ছত্রে ছত্রে ভরে দেওয়া হল তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টির অন্তরালে রইল।
আলেকজান্ডার কেনিংহামকে মনে করা হয় ভারতবর্ষের প্রত্নতত্ত্বের অনেক বড় বিশেষজ্ঞ। ইতিহাস ও গবেষণাকর্মে এখনো তার রিপোর্টগুলো অপরিহার্য। তার রিপোর্টের প্রথম খন্ডে ১৮৭১ সালে ‘অযোধ্যা’ সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন আজ পর্যন্ত এই শহরের উপর এর চেয়ে উত্তম কোনো গবেষণা প্রকাশিত হয়নি। এখানে তার কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরছি।
‘এখানে বলে দিচ্ছি যে, আমি হিন্দুদের আরেকটি তীর্থ স্থান সম্পর্কে শুনেছি, যা গোমতীর তীরে অবস্থিত এবং ‘সিতবারা’ নামে পরিচিত। সুলতানপুর থেকে লাখনৌর দিকে পনেরো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এখানে বছরে দুটি মেলা হয়ে থাকে। প্রথমটি চৈত্রের নয় তারিখে যখন চাঁদ বাড়তে থাকে, দ্বিতীয়টি কার্তিকের পনেরো তারিখে, যখন চাঁদ পূর্ণ হয়ে যায়। বলা হয়, পঞ্চাশ হাজার লোক একত্র হয়ে এখানে স্নান করে। প্রথম মেলাকে বলে রাম নবমী তীর্থ। ‘সিতবারা’ নামের মূল আমি খুঁজে পাইনি।’
এক জায়গায় বলা হয়েছে, ‘বুদ্ধ অর্থাৎ গৌতম বুদ্ধ এখানে দুই জায়গায় অবস্থান করেছেন। সরস্বতী তিনি নয় বা উনিশ বছর ছিলেন।
চীনা পর্যটক হিউন সাং এর বিবরণে আছে, তিনি বিশাখাতে ছয় বছর ছিলেন। এটা সরস্বতীর দক্ষিণে কিছু দূরে অবস্থিত। আমার মতে, বিশাখা ও ছাকেত একই জায়গার নাম।’
এরপর কেনিংহাম ‘অযোধ্যা’র আলোচনা এভাবে করেন-‘বর্তমান অযোধ্যা প্রাচীন নগরীর উত্তর পূর্বে অবস্থিত। এটি দৈর্ঘ্যে দুই মাইল এবং প্রস্থে পৌনে এক মাইল। তবে অর্ধেক শহর বসতিশূন্য। গোটা শহরে জীর্ণতার ছাপ পরিস্ফুট। অন্যান্য বিরান নগরে যেমন দেখা যায়, ধ্বংসাবশেষের টিলা, ভগ্ন, অর্ধ ভগ্নমূর্তি, কারুকাজ করা খুঁটি-এগুলো এখানে পাওয়া যায় না। ময়লা-আবর্জনার স্ত্তপ আছে, যা থেকে ইট-পাথর বের করে পার্শ্ববর্তী শহর ফয়েজাবাদের ঘরবাড়ি নির্মিত হয়েছে। মুসলমানদের এই শহরটি আড়াই মাইল দীর্ঘ এবং এক মাইল চওড়া। এই শহরটি ঐসব ইট-পাথর দ্বারা নির্মিত, যা অযোধ্যায় খনন করে পাওয়া গেছে। শহর দুটি ছয় বর্গমাইল এলাকার মাঝে অবস্থিত। এটা সম্ভবত রামের প্রাচীন রাজধানী অযোধ্যার অর্ধেক। ফয়েজাবাদে শুধু ‘বউবেগমে’র মাকবারা পরিষ্কার দেখা যায়। ওয়ারেন হেস্টিংসের মোকদ্দমার প্রসঙ্গে এই বেগমের কথা এসেছে। ফয়েজাবাদ ছিল প্রথম দিকের নবাবদের রাজধানী। আসফউদ্দৌলার আমলে তা বিরান হয়ে যায়।’
কিছু দূর গিয়ে কেনিংহাম লেখেন, ‘রামায়নের বিবরণ অনুযায়ী, অযোধ্যা নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হলেন মনু। তাকে মানবজাতির আদিপিতা মনে করা হয়। এক সময় এখানে দুর্গবেষ্টিত নগরী ছিল। ফটক ছিল। চারপাশে পরিখা ছিল। কিন্তু এখন সেসবের নাম-নিশানাও দেখা যায় না। বলা হয়ে থাকে, রামের অযোধ্যা খৃষ্টপূর্ব ১৪২৬ সালেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বিক্রমাদিত্যের আমল পর্যন্ত তা ছিল বিরান নগরী। প্রসিদ্ধ বর্ণনা অনুযায়ী বিক্রমাদিত্য ছিল উজ্জয়িনীর একজন শিকারী রাজা। এ যুগের হিন্দুরা বিক্রমের সকল কার্যকলাপ তার সাথেই যুক্ত করে থাকে। তাদের এই ধারণা ভিত্তিহীন। হিউন সাংয়ের বিবরণ অনুযায়ী এ নামের একজন শক্তিশালী রাজা সরস্বতীর নিকটে কনিষ্কর একশ বছর পরে অতিবাহিত হয়েছেন। সম্ভবত সময়টি ছিল খৃষ্টপূর্ব ৭৮ সাল। ...
এই বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে বলা হয়, তিনি ছিলেন বৌদ্ধ-বিদ্বেষী একজন উদ্যমী ব্রাহ্মণ। আমার মতে তিনিই অযোধ্যা নগরী পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছেন। রামচন্দ্রের ইতিহাসে যে পবিত্র স্থান তার নামের সাথে যুক্ত তা সন্ধান করিয়েছেন। বর্ণিত আছে, তিনি যখন এখানে আসেন তখন অযোধ্যা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে বন-জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল।
তিনি রামচন্দ্রের প্রসিদ্ধ স্থানের খোঁজ বের করেন। সরযূ নদীর ঘাট থেকে মাপা আরম্ভ করেন। লোকে বলে, তিনি রামচন্দ্র, সীতা, লক্ষণ, শত্রুঘ্ন, হনুমান ও অন্যান্যের নামে তিনশ ষাটটি মন্দির নির্মাণ করেছিল। ...
কিছু আগে গিয়ে কেনিংহাম লেখেন-
অযোধ্যায় ব্রাহ্মণদের মন্দির আছে, তবে সেগুলো সাম্প্রতিক কালের এবং সেগুলোতে প্রত্নতাত্ত্বিক সৌন্দর্য নেই। নিঃসন্দেহে এ সকল মন্দিরের অধিকাংশই নির্মিত হয়েছে মুসলমানদের ধ্বংস করে দেওয়া প্রাচীন মন্দিরগুলোর স্থানে।
নগরীর পূর্ব দিকে রামকোটের হনুমানগাড়ি অবিস্থত। এটি একটি ছোট দূর্গ, যা দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। চৌহদ্দির ভিতর একটি নতুন মন্দির আছে, যা টিলার উপর অবস্থিত। রামকোট নিঃসন্দেহে অতি প্রাচীন স্থান। এর সম্পর্ক মুনি পর্বতের সাথে। হনুমান মন্দির বেশি পুরোনো নয়। এটা আওরঙ্গযেবের আমলের আগের নয়। নগরীর পূর্ব কোণে রামঘাট অবস্থিত। কথিত আছে, রামচন্দ্র এখানে স্নান করেছিলেন। স্বর্গদুয়ারী বা স্বর্গদুয়ার হচ্ছে স্বর্গের দ্বার। উত্তর পূর্বে ঐ স্থানটি নির্দেশ করা হয়, যেখানে রামচন্দ্রের দাহ হয়েছিল। কয়েক বছর আগে এখানে একটি বৃক্ষ ছিল, যাকে বলা হয় ‘অশোক বট’। অর্থাৎ এটি হচ্ছে ঐ বৃক্ষ, যার নিকটে দুঃখ-শোক হয় না। সম্ভবত স্বর্গের সাথে মিলিয়ে এ নাম রাখা হয়েছে।
লোকের বিশ্বাস, এখানে যারা মৃত্যুবরণ করে কিংবা এখানে যাদের দাহ হয় তারা পুনর্জন্ম থেকে মুক্তিলাভ করে। অদূরে লক্ষণ-ঘাট অবস্থিত, যেখানে রামচন্দ্রের ভাই লক্ষণ স্নান করেছিলেন। এখান থেকে পোয়া মাইল দূরে নগরীর কেন্দ্রে জন্মস্থানের মন্দির দাড়িয়ে আছে। এখানে রামচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পশ্চিমে পাঁচ মাইল দূরে গুপ্তের ঘাট। এখানে কয়েকটি শ্বেত মন্দির রয়েছে। লোকে বলে, এখান থেকেই লক্ষণ অন্তর্হিত হয়েছিলেন। এ কারণেই এর নাম গুপ্তের ঘাট। কেউ কেউ বলে, এখান থেকে লক্ষণ নয়, রাম অন্তর্হিত হয়েছিল। তবে স্বর্গদুয়ারে তার শবদাহের বর্ণনার সাথে এই মতকে মেলানো যায় না। ’’
কেনিংহাম আরো লেখেন-
‘প্রাচীন নগরে বিশটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল, যাতে তিনহাজার ভীক্ষু বসবাস করত। সাথেই ছিল ব্রাহ্মণদের পঞ্চাশটি মন্দির। ব্রাহ্মণদের বসতিও ছিল অনেক বড়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, সপ্তম শতকের প্রথম দিকে বিক্রমাদিত্যের প্রতিষ্ঠিত তিন শ মন্দির ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং অযোধ্যা বিরান হতে চলেছিল।’
আলোচনা : আলেকজান্ডার কেনিংহামের এই উদ্ধৃতিগুলো থেকে জানা যায়, অযোধ্যা খৃষ্টপূর্ব ১৪২৬ সালের পর সম্পূর্ণ বিরান হয়ে গিয়েছিল এবং বন-জঙ্গলে হারিয়ে গিয়েছিল। কোনো কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। সকল নিদর্শন বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রায় দেড় হাজার বছর পর নিছক অনুমানের ভিত্তিতে তা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেখানে তিনশ ষাটটি মন্দির নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে তিন শ মন্দির মুসলমানদের আগমনের আগেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কেনিংহাম যখন এ গ্রন্থ রচনা করেছেন, অর্থাৎ ১৮৭১ সালে, তখন তিনি অযোধ্যা সম্পর্কে লিখেছেন, এই শহরের অর্ধেক এলাকাও বসতি নেই, গোটা শহরে জীর্ণতার ছাপ পরিস্ফুট, অন্যান্য বিরান নগরীতে যেমন পাওয়া যায়-ধ্বংসাবশেষের উঁচু উঁচু টিলা, ভগ্ন, অর্ধভগ্ন মূর্তি, কারুকাজ করা খুঁটি-এগুলো এখানে পাওয়া যায় না।
তিনি দেখাতে চান, তার সময় পর্যন্ত পবিত্রভূমি হিসেবে অযোধ্যার কোনো গুরুত্ব ছিল না। এরপর এ কথা লিখে হিন্দুদের বিরুদ্ধে বৌদ্ধদের উত্তেজিত করছেন যে, এ নগরীর পুনর্প্রতিষ্ঠার পিছনে বিক্রমাদিত্যের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বৌদ্ধদেরকে উচ্ছেদ করা।
এরপর মুসলমানদের উপর অপবাদ আরোপ করলেন যে, অযোধ্যায় সাম্প্রতিক কালের যে মন্দিরগুলো আছে, সেগুলোর অধিকাংশই নির্মিত হয়েছে মুসলমানদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রাচীন মন্দিরসমূহের স্থানে!
এই তথ্যের সপক্ষে তিনি কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ উপস্থিত করেননি। তবে তিনিও দাবি করেননি যে, রাম জন্মভূমির মন্দির ধ্বংস করে বাবর একটি মসজিদ নির্মাণ করেছেন, যা বাবরী মসজিদ নামে পরিচিত। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তিনি লিখছেন, লক্ষণঘাট থেকে পোয়া মাইল দূরে শহরের কেন্দ্রে জন্মস্থানের মন্দির দাড়িয়ে আছে। যদি কেনিংহামের সময় পর্যন্ত এই মন্দির অক্ষত থাকে তাহলে কীভাবে বিশ্বাস করা যায়, বাবরি মসজদি ঐ মন্দির ভেঙ্গেই বানানো হয়েছে?! তবে কি হিন্দু-মুসলিমে যে দীর্ঘ মামলা-মোকদ্দমা তা সম্পূর্ণ পরিকল্পিতভাবে সৃষ্টি করা হয়েছিল? রামমন্দিরের প্রসঙ্গ ছিল বাহানামাত্র?
(চলবে ইনশাআল্লাহ)