রবিউল আখির ১৪৩৩   ||   মার্চ-২০১২

বাইতুল্লাহর ছায়ায়-২১

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

কান্নার রোল, আর অশ্রুর ঢল ধীরে ধীরে শান্ত  হলো এবং হৃদয়ের গভীরে পরম আশ্বাস ও প্রশান্তি সৃষ্টিকারী মুনাজাত শেষ হলো। অশ্রুভেজা মুখগুলো তখন বড় পবিত্র মনে হলো, আর মনে হলো, আসমানে ফিরেশতাদের নূরানি চেহারা হয়ত এমনই উজ্জ্বল, এমনই উদ্ভাসিত!

হে আল্লাহ! সামনে কত দীর্ঘ পথ আছে জানি না। পথের বাঁকে বাঁকে পাপের কত কলঙ্ক-কালিমা আছে তাও জানি না। মোহের কত জাল এবং প্রবৃত্তির কত ফাঁদ আছে, কিছুই জানি না। মাটির মানুষ হয়ত আবার মাটি-কাদায় মাখামাখি হবে; পাঁকে পঙ্কে হয়ত জীবন আবার ক্লেদাক্ত হবে, কিন্তু হে আল্লাহ, আরাফার চোখের পানি কখনো যেন শুকিয়ে না যায়! অনুতাপের এ অশ্রুধারা জীবনকে চিরকাল যেন শুভ্র-সুন্দর রাখে এবং জীবনের সমাপ্তিকে পবিত্রতা দান করে।

এখানে যুগে যুগে যত অশ্রু ঝরেছে, আমার দুফোঁটা চোখের পানিও তাতে শামিল করো; আমাকে তুমি হে আল্লাহ, কবুল করো। আমীন! আমীন!! আমীন!!!

***

এত কান্নার পরো কান্না থামে না! এত চাওয়ার পরো চাহিদা ফুরায় না! এতক্ষণ কেঁদেছে একসঙ্গে, এখন কাঁদছে একা একা! এতক্ষণ চেয়েছে সমস্বরে, এখন চাইতে বসেছে নীরবে, নিভৃতে। কেউ তাঁবুর ভিতরে, কেউ বাইরে গাছের ছায়ায়, কিংবা পাহাড়ে পাথরের আড়ালে।

কারো কান্না শোনা যায়, কারো কান্না শুধু দেখা যায়। কারো আকুতি ভিক্ষুকের, কারো মিনতি প্রেমিকের। আরাফার বিস্তৃত সবুজ উদ্যানজুড়ে সে বড় অভূতপূর্ব দৃশ্য! দেখে দেখে আবারও মনে হলো সেই কথা, চৌদ্দশ বছর পরে উম্মতের কাছে হয়ত আর কোন পুঁজি নেই, তবে আছে সেই দৃশ্যের সঙ্গে এই সাদৃশ্য!

কান্নায় এত শান্তি! চাওয়ার মধ্যে এত তৃপ্তি! আমি তাহলে একটু আড়ালে যাই না কেন? চোখদুটি ভিজিয়ে আবার একটু চাই না কেন? কেউ দেখবে না, কেউ শোনবে না তিনি ছাড়া! আমি কাঁদবো, তিনি দেখবেন! আমি চাইবো, তিনি শোনবেন! আমি আচল বিছাবো, তিনি আচল ভরে দেবেন!

অপূর্ব এক ভাবতন্ময়তায় দেহমন আচ্ছন্ন হলো। তাঁবু থেকে বের হলাম। কিছুক্ষণ নিমগাছের ছায়ায় বসলাম। নাহ, মন যেমন নির্জনতা চায়, এখানে যেন তা নেই। ঐ যে পাহাড়টা, খুব দূরে তো নয়, ওখানে যাই!

এখানেও মানুষ, তবে অল্প এবং নিমগ্ন। এখানেও কান্না, তবে শান্ত এবং সিণগ্ধ।

আরাফায় শুধু কান্না, আর কান্না! এখানে জাবালে সমতলে অশ্রু যেন বান ডাকে!

তবে নীচে সমতলের কান্নায়, আর উপরে পাহাড়ের কান্নায় কিছু যেন পার্থক্য আছে! নীচের কান্না ভয়ের, অনুতাপের! এখানের কান্না আনন্দের, কৃতজ্ঞতার। এখানে যারা কাঁদছে, যেন পাওয়ার আনন্দে কাঁদছে! যেন কৃতজ্ঞতা নিবেদনের জন্য কাঁদছে! এখানে কান্নায় যেন সঙ্গীতের মধুর সুর! যেন রিমঝিম বৃষ্টি! ভিজতে বড় ইচ্ছে জাগে!

তুমি ভাবছো, এ নিছক আবেগের কথা? কিন্তু মনের আবেগ আসে কোত্থেকে, কোন সুদূরের ইঙ্গিতে?! কেন আসে?! কীভাবে আসে?!

***

কিছুক্ষণ বসলাম, যারা কাঁদছে তাদের রিমঝিম কান্নায় ভিজলাম এবং আপ্লুত হলাম। হৃদয় যেন একটু একটু গলতে শুরু করেছে! চোখের জলে একটি যেন জোয়ার দেখা দিয়েছে!

আচ্ছা, আরেকটু উপরে উঠি না কেন! কষ্ট হবে, তবু উঠি। যত উঠলাম নির্জনতা তত গভীর হলো। একসময় দেখি, আমি একা; আমার চারপাশে কেউ নেই, কিছু নেই; আছে শুধু নির্জনতা! মন কেমন করা অখন্ড এক নির্জনতা!

পাহাড় সম্ভবত প্রকৃতির সবচে ভাবগম্ভীর অংশ। মরুভূমির নির্জনতায় গভীরতা আছে, গম্ভীরতা নেই। পাহাড়ের নির্জনতায় গভীরতা আছে, গম্ভীরতাও আছে। আরাফার ময়দানে পাহাড়ের নির্জনতায় দাঁড়িয়ে সেই আশ্চর্য ভাবগম্ভীরতা আমি হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম এবং অভিভূত হলাম। পাহাড়ের নির্জনতা, পাহাড়ের ভাবগম্ভীরতা আমাকে যেন একান্ত আপন করে নিলো। আমার হৃদয় ও আত্মা এবং সমগ্র সত্তা তখন আল্লাহতে সমর্পিত হওয়ার জন্য উন্মুখ হলো। আল্লাহকে খুব কাছে মনে হলো। এত কাছে যে, আমি ডাকবো, আর তিনি সাড়া দেবেন।

আমি আল্লাহকে ডাকলাম প্রাণভরে, হৃদয়ের সবটুকু আকুতি ও মিনতি একত্র করে। এমন করে ডাকার সৌভাগ্য সবসময় হয় না এবং সবখানে হয় না। যখন হয়, যেখানে হয়, আল্লাহর দেয়া তাওফীকেই হয়। তাওফীক ছাড়া কিছু হয় না, কখনো হয় না।

***

মুনাজাত শেষে উঠে দাঁড়ালাম। আরাফার বিশাল বিস্তৃত ময়দানের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করলাম। অপূর্ব! সত্যি অপূর্ব! কোথায় মরুভূমি, বালুর সাগর! যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ! যেন সবুজ সাগরে সবুজের ঢেউ! আমার দেশের সৌভাগ্য, বৃক্ষছায়াহীন আরাফার মরুভূমিকে সে এমন সবুজের শীতল ছায়া উপহার দিতে পেরেছে। পবিত্র ভূমির সঙ্গে আমার দেশের যেন একটি স্বর্গীয় সবুজবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে!

***

এখান থেকে ঐ যে কাছেই দেখা যায় জাবালে রহমত! আসার সময় যেমন দেখেছি তেমনি শুভ্রতায় আবৃত। এই পাহাড়ের পাদদেশে আল্লাহর নবী বিদায় হজ্বের সময় অবস্থান করেছেন। সোয়া লক্ষ নিবেদিতপ্রাণ ছাহাবী তাঁকে বেষ্টন করে সমবেত হয়েছিলেন। এই পাহাড়ের পাদদেশে উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে পেয়ারা নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিদায় হজ্বের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রদান করেছিলেন, আর বলেছিলেন,

ألا هل بلغت؟

তাহলে আল্লাহর আদেশে আজ যারা এখানে সমবেত হয়েছে, কী শিক্ষা নিয়ে তাদের ফিরে যেতে হবে নিজ নিজ দেশে। বিশেষ করে নবীর ওয়ারিছ বলে যাদের পরিচয়, আজ তাদের কী দায়িত্ব ও কর্তব্য?

فيبلغ الشاهد الغائب

উপস্থিত যেন পৌঁছে দেয় অনুপস্থিত-এর কাছে।

এখানে এই আরাফাভূমে প্রতিবছর বিশ্বের যত দেশের যত আলিম ও নায়েবে নবীর সমাবেশ ঘটে তারা যদি এ মহান বাণী ও আহবানে উদ্দীপ্ত হতে পারেন তাহলে মুসলিম জাহানের দেশে দেশে এখনো হতে পারে একটি

সুন্দর পরিবর্তনের সূচনা।

কিন্তু কবির ভাষায়

উদ্যানে বৃক্ষশাখে/ সবুজ পাতার হিল্লোলে/ শুনি কিসের ধ্বনি?/ কোথা বসন্ত, কোথা বুলবুলি?

সূর্য প্রতিদিন ওঠে এবং ডোবে। সূর্যের উদয়-অস্ত প্রতিদিনের স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু আজকের?

***

প্রতিদিন প্রতিপ্রভাতে সূর্যের উদয় ঘটে, কিন্তু আজ ছিলো আরাফার সূর্যোদয়। এ সূর্যের উদয় আমাদের জন্য এনেছিলো এক মহান আহবান, চলো, আরাফার পথে চলো, জাবালে রহমতের জন্য চলো।

আরাফার মধ্যগগনের সূর্য আজ প্রত্যক্ষ করেছে ইশক ও মুহববতের সেই মোহনীয় দৃশ্য যা প্রতিবছর একবার দেখা যায়! চৌদ্দশ বছর ধরে প্রতিবছর শুধু একবার!

আগের কিছু মানুষ আসে, কিছু মানুষ আর আসে না! তবে নতুন কিছু মানুষ শামিল হয়। তারা আগামী দিনের প্রতিনিধি। এভাবে মানুষের পরিবর্তন হয়, হতে থাকে; কিন্তু দৃশ্যের কোন পরিবর্তন নেই। সেই রোনা ও কান্না, সেই আহাযারি, সেই চোখের পানি।

ধীরে ধীরে দৃশ্যেরও পরিবর্তন হয়। কান্না আছে, উত্তাপ নেই। চোখের পানি আছে, উষ্ণতা নেই।

দৃশ্যের পরিবর্তন আছে, তবে সাদৃশ্যের পরিবর্তন নেই। আরাফার প্রথম সমাবেশের যে সৌন্দর্য মহিমা, যে মর্যাদা ও গরিমা, যে পবিত্রতা ও উজ্জ্বলতা এবং যে নূরানিয়াত ও কবুলিয়াত তার কিছু না কিছু অবশ্যই ধারণ করে প্রতিযুগে আরাফার মহাসমাবেশ শুধু এই সাদৃশ্যের গুণে।

এত শূন্যতা, এত নিঃস্বতার পরো নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হলো আরাফা-ময়দানে এই সাদৃশ্যের নূর ও নূরানিয়াতে শামিল হতে পেরে।

কী সুন্দর একটি সূর্যাস্ত আমার সামনে! আমি কি পাবো আগামী বছর এখানে এই সূর্যাস্ত!? আবার কি ফিরে আসা হবে এ মরুভূমিতে, নিম্ববৃক্ষের এই সবুজ উদ্যানে?!

আমি জানি না এবং জানে না আজকের সূর্যাস্ত; জানেন শুধু তিনি, আমার জীবন-মৃত্যুর এবং সূর্যের উদয়-অস্তের

নিয়ন্তা যিনি।

দূরত্ব কত দুস্তর! পথ কত দুর্গম! এবং জীবন কত ভঙ্গুর!! তবু .. তবু আমি আশা করি। কারণ তিনি দয়াময়, দয়া তাঁর অসীম। তিনি করুণাময়, করুণা তাঁর অপরিসীম।

সূর্যের অস্ত যাওয়ার দৃশ্যটি সবসময় বিষণ্ণ, কিন্তু আজকের সূর্যাস্তকে বিষণ্ণ মনে হলো না। এত কান্না, এত অশ্রুর মাঝে বিদায়গ্রহণে কি আর দুঃখ থাকে! কিন্তু অস্তগামী সূর্যের ক্লান্ত মুখের  দিকে তাকিয়ে আমার মন খুব বিষণ্ণ হলো। জাবালে রহমতের দিনটি যেন বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলো! কিছু সময়ের জন্য পৃথিবীর গতি যদি থেমে যেতো! সূর্যের অস্ত একটু যদি পিছিয়ে যেতো!

কিন্তু এমন করে ভাবছি কেন আমি?! পৃথিবী চলুক না তার নিজের গতিতে! সূর্যের অস্ত হোক না তার নিজের সময়ে! আমার তো প্রয়োজন শুধু দয়াময়ের দয়া ও করুণা! আর তিনি তো দিতে পারেন হিসাব না করে একমুহূর্তে!

হে আল্লাহ, আমি দিনের ক্ষুধার্ত, সন্ধ্যার ভিখারী। গ্রহণ করো আমার আজকের শেষ মিনতি। হে আল্লাহ, আমার দেশে আমি বৃষ্টি দেখেছি; ঝিরঝির বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি এবং অঝোরধারে বৃষ্টি।

সন্ধ্যার বিদায়ক্ষণে হে আল্লাহ, বর্ষণ করো তোমার করুণার বৃষ্টি; ঝিরঝির বৃষ্টি, রিমঝিম বৃষ্টি এবং অঝোরধারে বৃষ্টি।

বিশ্বাস করি হে আল্লাহ, তুমি বর্ষণ করেছো এবং আমরা সিক্ত ও সণাত হয়েছি।

***

খুশির দিনে বৃষ্টিতে ভিজে মানুষ যেভাবে বাড়ি ফেরে তেমনি বৃষ্টিভেজা মানুষ হয়ে আমি পাহাড় থেকে নেমে এলাম এবং আনন্দিত চিত্তে, চঞ্চল পদক্ষেপে তাঁবুতে ফিরে এলাম।

যখন তাঁবুর কাছাকাছি তখন আল্লাহর একবান্দা দৌড়ে এসে আমাকে কোল দিলেন এবং আবেগকম্পিত কণ্ঠে বললেন, মৌলবীজী, ইনশাআল্লাহ হজ্বে মাবরূর!

তার চোখে-মুখে স্বর্গীয় আনন্দের কী অপূর্ব ঝিলিক! সারা দুনিয়ার সম্পদ পেলেও  হয়ত এমন আনন্দ তার হতো না।

অশ্রুভেজা চোখে আসমানের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করলাম। হে আল্লাহ, হয়ত তুমি মানুষের বেশে ফিরেশতা পাঠিয়েছো বান্দাকে খুশী করতে, খোশখবর দিতে! তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!

তাঁবুতে প্রবেশ করে আমিও পরিচিত-অপরিচিত অনেককে কোল দিয়ে, হজ্বে মাবরূর বলে অভিনন্দন জানালাম। মনের খুশিরা যেন ডানা মেলে উড়ে আসতে চায়! ইচ্ছে করে; কোল নিয়ে, কোল দিয়ে উচ্ছল আনন্দ প্রকাশ করি। কিন্তু না, এখানেও সংযমের প্রয়োজন। কারণ অসংযম ও অসতর্কতার পথ ধরেই ঘটে বিদআতের অনুপ্রবেশ।

***

আজকের সূর্যোদয়ের সময় যারা ছিলো শুধু আব্দুল্লাহ, এখন সূর্যাস্তের সময় তারা হয়ে গেলো আলহাজ্ব আব্দুল্লাহ! এর চে আনন্দের, এর চেসৌভাগ্যের আর কী হতে পারে?! তবে একথাও সত্য যে, আমাদের হজ্ব যত না আনন্দের তার চে অনেক বেশী দায়িত্বের। কারণ একজন হাজীকে তো সারা জীবনের জন্য হতে হবে আরাফার শিক্ষা ও হজ্বের আদর্শের ধারক, বাহক ও প্রচারক। নিজের দেশে, নিজের সমাজে এবং নিজের পরিবারে তাকে হতে হবে মুহম্মদী হজ্বের এবং ইবরাহীমি লাববাইকের যিন্দা নমুনা। জীবনের সকল অঙ্গনে তাকে তো এমন আলো ছড়াতে হবে যেন সবাই বুঝতে পারে, হজ্ব মানুষের জীবনে কী আমূল পরিবর্তন আনতে পারে! মাথার উপর আসমান ভেঙ্গে পড়তে পারে, কিন্তু আলহাজ্ব আব্দুল্লাহর মুখে মিথ্যা কথা আসতে পারে না; তার হাতে অন্যের জানমাল, ইজ্জত-আবরু কখনো ক্ষুণ্ণ হতে পারে না; তার চিন্তায় কোন কলুষ আসতে পারে না, তার দ্বারা কখনো কারো কোন অকল্যাণ হতে পারে না; তার দ্বারা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘিত হতে পারে না। তার দেশে, তার সমাজে এবং তার পরিবারে তিনি হবেন এমনই আলোকিত একজন মানুষ।

আরাফার মরুভূমির প্রতিটি বালুকণার কাছে এ দায়বদ্ধতা স্বীকার করেই তো তিনি ফিরে যাবেন আজ!

সারা জীবন তাকে মনে রাখতে হবে, জাবালে রহমত যেন তার আচরণে শরমিন্দা না হয়; চৌদ্দশ বছরের এ নূরানি সিলসিলা তার দ্বারা যেন ক্ষুণ্ণ না হয়!

***

একদিনের তাঁবুর শহর দেখতে দেখতে গুটিয়ে গেলো। আমাদের এলাকার প্রায় সব তাঁবু খালি হয়ে গেলো। এই তাঁবুতে, এমনি আরো দুএকটি তাঁবুতে রয়ে গেছে কিছু মানুষ বাসের অপেক্ষায়। কোন তাঁবুতে আলো নেই। আরাফার তাঁবুতে আলোর ব্যবস্থা থাকবেই বা কেন?! আরাফা তো শুধু দিনের এবং একদিনের জনপদ! সকালে মানুষের জোয়ার আসে, সন্ধ্যায় নেমে যায়। উপমাটা হয়ত ঠিক হলো না, তবু মনে হলো, এ যেন প্রেমসাগরের জোয়ার-ভাটা!

রাস্তার আলোতে তাঁবুর অন্ধকার কিছুটা লঘু ছিলো, আর কারো কারো মুখে ছিলো লঘু কথা! কঙ্করের আঘাতে আগামীকাল যাকে জর্জরিত করা হবে সে তো ওত পেতেই থাকে, সুযোগ পেলেই হানা দেয় এবং এত সন্তর্পণে যে, কেউ টেরই পায় না; ইমাম ছাহেব টের পেলেন এবং সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বয়ান শুরু করলেন, আজকের দিনটি কেন এসেছিলো? কেন চলে গেলো? আমাদের কাছে কী রেখে গেলো? আমাদের থেকে কী নিয়ে গেলো? এসম্পর্কে তিনি তার নিজস্ব আন্দাযে কিছু কথা বললেন। মুযদালিফায় রাত্রিযাপন ও ছোবহে ছাদিকের ওকূফ সম্পর্কে এবং মিনায় তিন-চারদিনের করণীয় সম্পর্কে আলোচনা করলেন। এমনিতেও এসব আলোচনার প্রয়োজন ছিলো। কারণ পরে যখন তিনি প্রশ্নের সুযোগ দিলেন, দেখা গেলো অনেক কিছুই আমাদের হাজী ছাহেবানের জানা নেই। এমনকি এক কাফেলার আমীর ছাহেব তার দশবারোজন সঙ্গীসহ ইতিমধ্যেই মাগরিব আদায় করে ইতমিনানের সঙ্গে বসে আছেন! এমন পাকপাকিযা দিনে নামায কাযা করাটা তার পছন্দ ছিলো না। এতে অবশ্য একটা ভালো বিষয় বোঝা গেলো যে, সারা জীবন নামাযের প্রতি তিনি কত যত্নবান ছিলেন, তবে এটাও জানা গেলো যে, আল্লাহর বান্দারা কত সরল মনে, কত কম জেনে হজের মত কঠিন সফরে চলে আসেন!

অনেকবারের মত আবারও মনে হলো হজ্বের সফরে আসার আগে হজ্বের উপর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা কত জরুরি!

সরকারের ধর্মমন্ত্রণালয়ের কথা থাক। সেটা তো মন্ত্রণালয়! সেখানে তো মন্ত্রী ও সচীব মহোদয়ের নিবাস! তাছাড়া তাদের কাঁধের উপর রয়েছে বাড়ি ভাড়ার মত গুরুদায়িত্ব! কিন্তু দেশের সম্মানিত আলিমসমাজ! এত বড় একটি দ্বীনী দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়ার জন্য তারা কেন এগিয়ে আসছেন না?! প্রতিকূল থেকে প্রতিকূল পরিবেশে বিরাট থেকে বিরাট কোরবানির মাধ্যমে যারা হাজার হাজার মক্তব-মাদরাসা পরিচালনা করছেন তারা কি হজ্বের হাকীকত ও রূহকে যিন্দা করার জন্য এবং হজ্বের আহকাম ও মাসায়েলকে আমলে আনার জন্য মাদরাসাতুল হুজ্জাজ গড়ে তুলতে পারেন না, যেখানে সারা বছর থাকবে মাসব্যাপী, পক্ষকালব্যাপী হজ্বপ্রশিক্ষণের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা! তদুপরি থাকবে ডাকযোগে হজ্বশিক্ষার এবং টেলিফোনের মাধ্যমে হজ্বের আহকাম ও মাসায়েল জানার ব্যবস্থা! সর্বোপরি এ মাদরাসার তত্ত্বাবধানে হজ্বের আগের মাসগুলোতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পরিচালিত হতে পারে কয়েকদিনব্যাপী হজ্বপ্রশিক্ষণ- শিবির। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কাজ অবশ্যই হচ্ছে এবং তা কিছু না কিছু সুফলও দিচ্ছে, কিন্তু একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো অবশ্যই গড়ে ওঠা উচিত এবং সুচিন্তিত নিছাব ও পাঠ্যপুস্তকও তৈরী হওয়া উচিত।

দুআ করি, অন্তত আমার কোন প্রিয় ছাত্রকে আল্লাহ যেন এবিষয়ে হিম্মত ও তাওফীক দান করেন, আর এমহান কাজের গুরুত্ব অনুধাবনকারী বিত্তবানদের যেন সহযোগিতায় এগিয়ে আসার তাওফীক দান করেন, আমীন।

***

চলতে চলতে কলম কত দূরে চলে গেছে! অথচ আমি এখনো বসে আছি আরাফার ময়দানে আলোহীন তাঁবুতে। হাজী ছাহেবানের বিচিত্রসব প্রশ্নে ইমাম ছাহেব বেশ পেরেশান। আমি তাকে যথাসাধ্য সাহায্য করছি, আর মনে মনে প্রার্থনা করছি, হে আল্লাহ, আমরা যারা জানি এবং জানি না, মেহেরবানি করে আমাদের সবার হজ্ব তুমি কবুল করো। আমাদের না জানা ও না জানানোর অপরাধ ক্ষমা করো।

***

হতে হতে রাত নয়টা হলো। আগে হজ্ব ছিলো হাজী ছাহেবানের নিয়ন্ত্রণে। তাই তারা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নিতে পারতেন; এখন হজ্ব চলে গেছে এজেন্সির দখলে, তাই রাত বারটা বাজলেও হাজী ছাহেবানের করার কিছু নেই, বসে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া, আর গায়েবানা গালমন্দ করা ছাড়া। সেটাই তখন চলছিলো যার সাধ্যে যতটা কুলায়। এর মধ্যে আমাদের এজেন্সির পক্ষ হতে ঘোষণা করা হলো তাঁবু ত্যাগ করে রাস্তায় জড়ো হওয়ার জন্য। রাস্তায় এলাম, জড়ো হলাম এবং জড়তাগ্রস্ত হলাম। অর্থাৎ কখনো দুপায়ে, কখনো একপায়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।

বাস আছে, একটা নয়, দুটো নয়; অসংখ্য। কিছু আসছে, কিছু যাচ্ছে। কিন্তু ওগুলো আমাদের ওঠার জন্য নয়; দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখার জন্য, আর আফসোস করার জন্য। আমরা দেখতে থাকলাম এবং আফসোস করতে থাকলাম। কিন্তু মুশকিল হলো, কারো কারো আফসোস এবং আক্রোশ চলছিলো একসঙ্গে এবং যথেষ্টই গতির সঙ্গে। বড় করুণা হলো এজেন্সির লোকদের প্রতি। এত কটুকাটব্য সারা জীবনেও কি তাদের শুনতে হয়েছে! কিন্তু এ অবস্থায় বেচারাদের করণীয় যে কী তাও বুঝে আসে না! এখন তো কোন কিছু তাদেরও নিয়ন্ত্রণে নেই।

সেবাপ্রদানের দায়িত্ব যাদের তাদের পক্ষ হতে অবহেলা ও শিথিলতা অবশ্যই অন্যায়, তবে মনে রাখতে হবে, আচরণে বা উচ্চারণে আমাদের সামান্য অসংযম হতে পারে বিরাট বরবাদির কারণ।

***

পথের পাশে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে জানা গেলো, বাস আমাদের কাছে আসবে না, অনেক দূর হেঁটে আমাদেরই যেতে হবে বাসের কাছে। ট্রাভেল্স-এর চেয়ারম্যান ও সচীব দুজনই আমাদের সঙ্গে। গালমন্দের প্রতিটি সন্দেশ নির্বিবাদে হজম করে হাতজোড় হয়ে তারা বললেন, ভাই, মারেন- কাটেন, সামনে না গিয়ে  উপায় নাই।

চেয়ারম্যান সাহেবকে কানে কানে জিজ্ঞাসা করলাম, সামনে গিয়ে কি কোন উপায় হবে? তিনি হাল ছেড়ে দেয়ার আওয়াযে বললেন, হুযূর, উপায় এখন একমাত্র আল্লাহর হাতে।

মনে মনে বললাম, হাল ছেড়ে দেয়া ভালো। মানুষ যখন হাল ছাড়ে, গায়ব তখন হাল ধরে। আমাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো। অকল্পনীয়ভাবেই গায়ব থেকে সাহায্য নেমে এলো। কীভাবে? সেকথা বলার আগে একটি কষ্টের কথা বলি। 

পুরো সফরে ইমাম ছাহেবের কাফেলা ছিলো অনেক ভালো কাফেলা। সবাই যথেষ্ট আন্তরিক ও সহমর্মী। আমলে ইবাদতে খুব তৎপর। তবু বলতে হয়, একটি উত্তম হজ্বের জন্য আরো উত্তম হওয়া, আরো বিনয় ও নমনীয়তা এবং আরো আনুগত্য ও মান্যতা অর্জন করা দরকার। এগুলো ছাড়া পুনঃ পুনঃ নফল হজ্বে কী লাভ তা অবশ্যই ভেবে দেখার বিষয়।

বাস কেন আসবে না, কেন আমাদের যেতে হবে অত দূর হেঁটে, এই বলে অনেকে যেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছিলেন তা আমার কাছে খুব দুঃখজনক মনে হয়েছে। মজার বিষয় হলো হলো, হাঁটার কষ্টটা বেশী ছিলো স্বভাবতই মহিলাদের, কিন্তু ক্ষোভ বা বিরক্তির প্রকাশ তাদের মধ্যে ছিলো না, ছিলো আমাদের মধ্যে। মহিলারা বরং নিজ নিজ মাহরামকে সংযমে রাখার চেষ্টা করেছেন। একবার একজন তার মাহরামকে বললেন, রাগারাগি কইরা হজ্ব নষ্ট করনের দরকার কী?

জীবনের অনেক ক্ষেত্রের মত হজ্বের সফরেও এ মনোরম অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে যে, ধৈর্যে, সেণহে, মমতায়, কোমলতায় এবং আত্মত্যাগে আমাদের মায়েরা, মেয়েরা আমাদের চেয়ে ভালো। তারা কষ্ট করে অনেক, নষ্ট করে কম। আজ দুপুরের ঘটনা। পুরুষেরা খেয়ে দেয়ে জানতে পারলো, পর্দার ভিতরে মহিলাদের কাছে খাবার পাঠানো হয়নি, বাইরে পড়ে আছে। তখন খাবার পাঠানো হলো, কিন্তু কেউ অনুশোচনা প্রকাশ করলো না যে, কাজটা অন্যায় হয়েছে; ভিতর থেকেও অনুযোগ এলো না যে, কাজটা ভুল হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঐ কাফেলায় মা-বোন ও স্ত্রী-কন্যা সকলেই ছিলো। জ্বি হাঁ, আরাফার ময়দানে মুআল্লিমের দেয়া বিরিয়ানি খেতে বসে হাজী ছাহেব তার গর্ভধারণকারিণী মায়ের কথা ভুলে গিয়েছিলেন। কোন মা কি পারতেন সন্তানকে ভুলে লোকমা মুখে তুলতে?! কন্যা, ভগ্নী, এমনকি স্ত্রী?!

***

চলতে চলতে কলম চলে এসেছে অনেক দূর!

এবার শুনুন মাওলার গায়বি মদদের কথা! আমরা তো পেরেশান ছিলাম যে, হাঁটতে হবে অনেক দূর। কিন্তু সামান্য কিছু হাঁটার পর হঠাৎ দেখা গেলো, সামনে আমাদের ছিয়াশি নম্বরের বাস! রাস্তায় যেখানে গাড়ীরা সব জটপাকিয়ে আছে, সেখানে আমাদের বাস কীভাবে এতটা পথ এগিয়ে এলো? আসতে পারলো? ঘটনা এই যে, মিশরীয় চালক যখন বিসমিল্লাহ বলে চলতে শুরু করলেন তখন দেখতে পেলেন যে, তিনি একটু অগ্রসর হন, আর সামনে একটু একটু করে পথ খোলাসা হয়। কীভাবে হয় তা তিনিও বুঝতে পারেন না।

আমাদের কাফেলার লোকেরা এবং অন্যরা কী কী কসরতে বাসে উঠলো, মহিলাদের কী হেনস্থা হলো, তাতে আমাদের সাদা ইহরামে কত দাগ লাগলো সেকথা না হয় আলোচনার বাইরেই থাক।

***

বাস চলতে শুরু করলো, বরং বলা ভালো, হাঁটতে শুরু করলো। একবার, দুবার একটাদুটো দৌড় যে দেয়নি তা নয়, তবে বেশীর ভাগ পথ হেঁটে হেঁটে এবং থেমে থেমেই পার হলো। তারপরো শেষমাথা পর্যন্ত যাওয়া হলো না; মাঝপথেই নামতে হলো।

চালকের পীড়াপীড়ি তো ছিলো আরো আগে থেকেই। শেষে তিনি অজুহাত খাড়া করলেন যে, ইঞ্জিন গরম, আর চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আমরা দেখলাম, গাড়ীর ইঞ্জিন যত গরম, চালকের মাথা তার চেয়ে বেশী গরম। তাই বাধ্য হয়েই একটা পোলের উপর নামতে হলো। আমাদের কাফেলার একজন অবশ্য ঐ গাড়ীতে করেই শেষমাথা পর্যন্ত গিয়েছিলেন, তবে চালকের, বা আমাদের, এমনকি তার নিজেরও অজ্ঞাতসারে! আহা, বেচারা!

বাংলাদেশ তো বটেই, আরো দুএকটি দেশে বাসে চড়ার মওকা আমার হয়েছে। এমনকি দেশ থেকে দেশান্তরে দীর্ঘ সতের আঠারো ঘণ্টার বাস-সফরের অভিজ্ঞতাও আছে আমার ঝুলিতে, কিন্তু আরাফা থেকে মুযদালিফার পথে এই বাসিং-এর সত্যি কোন তুলনা নেই। আমার তো মনে হয়, এযুগের মানুষ যদি শুধু ছবরের সঙ্গে এইটুকুন কষ্ট গ্রহণ করে নেয়, তো ইনশাআল্লাহ তার হজ্ব কবুল।

দিক কয়টি ও কী কী তা সম্ভবত ড্রাইভার সাহেবের নলেজে ছিলো না। তিনি চতুর্দিকে গাড়ী চালিয়েছেন, আমাদের তাঁবুর দিকটি ছাড়া। এখন আমরা যাবো কোন্দিকে? পোলের উপর এত আলোর মাঝে নেমেও আমরা চতুর্দিক অন্ধকার দেখলাম এবং কিছু না বুঝেই একদিকে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে লাগলাম, কারণ না হেঁটে উপায় ছিলো না।

আচ্ছা বাবা, বাসওয়ালা তোমাকে নামিয়ে দিয়েছে তাতে এজেন্সিওয়ালার দোষটা কোথায়? না, সবদোষ ঐ নন্দঘোষ! রফিক ও বশির, এ দুই ভদ্রলোকের ধৈর্যের প্রশংসা না করে পারি না, অবশ্য আমাদের যেমন না হেঁটে উপায় নেই, তাদেরও ধৈর্য না ধরে উপায় কী!

রাস্তার মধ্যভাগ গাড়ীর দখলে, আর প্রান্তভাগ তাদের দখলে যারা মুযদালিফায় রাত্রিযাপনের সুন্নত আদায় করছেন। কেউ বসে, কেউ শুয়ে। অনেকে ছোট ছোট তাঁবু টানিয়ে দিব্যি সংসারপাতার আনন্দ উপভোগ করছেন। অবস্থা দেখে অন্তত তাই মনে হলো। এটা যে চলাচলের পথ সেকথা ভাবে কে?! ভাবলে কি আমাদের এমন দুর্গতি হয়!

এধরনের তাঁবু আগে দেখিনি; এবার দেখলাম। পঞ্চাশ রিয়াল নাকি দাম। যত সহজে পাতা যায় তার চেয়ে সহজে গোটানো যায়, আর বহন করা যায় আরো সহজে। তবু বহন করার কিছু না কিছু কষ্ট তো আছে! ঐ কষ্টটুকুও কেউ বড় একটা স্বীকার করতে চায় না। ওখানেই ফেলে রেখে যায়। এরকম ভাঙ্গা ছাতা ও ভাঙ্গা তাঁবুর শিক ঢুকে অনেকের পা যখম হতে দেখেছি; এখানে এবং আরাফা থেকে মুযদালিফায় হাঁটা পথে। দেখেছি আর ভেবেছি, হজ্ব করে হাজী হওয়া যত সহজ, মানুষ হওয়া যদি তত সহজ হতো! হজ্ব করা তো আসলে মানুষ হওয়ার জন্য, শুধু হাজী হওয়ার জন্য নয়।

একে তো হাঁটার জায়গা নেই, তার উপর ময়লা আবর্জনায় সব একাকার। দেশে পথে ঘাটে কলার খোসা পড়ে থাকতে দেখেছি, তাও আছে এখানে এবং প্রচুর পরিমাণে। সৌভাগ্যই বলতে হবে, কাউকে এপর্যন্ত কলার খোসায় পা দিয়ে পিছল খেয়ে পড়তে দেখিনি।

এই দেখো, ধড়াম সে একটা আওয়ায আমার এমন সুন্দর ভাবনায় কেমন ব্যঘাত ঘটালো! কী হলো, কী হলো! না, কলার খোসায় পা দিয়ে একজন পড়েছেন চিত হয়ে। যারা দেখলো তাদের অনেকে হাসল, তিনি নিজেও সলজ্জ হাসি হাসলেন। দুএকজন এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে উঠালো তিনি উঠলেন। আল্লাহর শোকর, তেমন আঘাত লাগেনি। কিন্তু কত বড় দুর্ঘটনা হতে পারতো!

যে সৌভাগ্যের কথা একটু আগে বললাম সেটা আর থাকলো না। কলার খোসায় আছাড় খেয়ে পড়ার দৃশ্যটা আমার দেশে খুবই পরিচিত দৃশ্য। এই পবিত্র সফরে শেষপর্যন্ত সেটাও দেখতে হলো। আল্লাহর বান্দারা, যত খুশি কলা খাও, তবে খোসাটা যেখানে খুশি, ফেলো না।

***

অনেক দূর হাঁটার পর ক্লান্তিতে শরীর যখন ভেঙ্গে আসছে তখন বোঝা গেলো, আমরা ভুল পথে হেঁটেছি; শুধু ভুল পথে নয়, একেবারে উল্টো পথে! সুতরাং যে পথে এসেছো সেপথেই আবার হাঁটো।

ইমাম ছাহেবের বুদ্ধির সত্যি তারিফ করতে হয়। হজ্বের সফরে কদমে কদমে কত ছাওয়াব সেটা রীতিমত বয়ান করে বুঝাতে লাগলেন। তাতে কাজ অবশ্য কিছুটা হলো। দুএকজন মুখ খুলতে গিয়েও খুললেন না। আসলে ছাওয়াবের লোভ বড় শক্ত লোভ, আর মানুষ বড় লোভী।

কাফেলায় একভদ্রলোক ছিলেন, নামটা জানা নেই, তবে সবাই জি, এম সাহেব বলতো। এটা তার কর্মক্ষেত্রের পদবি। প্রিয় কামরুল ইসলামের মাধ্যমে তিনি এ কাফেলায় শরীক হয়েছেন, তিনি এবং তার স্ত্রী। ভদ্রলোকের পায়ে ফোসকা পড়ে হাঁটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। স্যান্ডেল ছিলো প্লাস্টিকের। অবস্থাটা বুঝতে পেরে আমার স্পঞ্জের সঙ্গে তার স্যান্ডেল বিনিময় করলাম। তাতে তার কিছুটা আরাম হলো; আমার কী হলো তা তাকে বুঝতে দিলাম না। শুধু ভেবে অবাক হলাম, এমন পদস্থ ব্যক্তি এমন স্যান্ডেল পদস্থ করলেন কীভাবে! আর এমন বুদ্ধি নিয়ে তিনি এমন পদস্থ হলেন কেমন করে?!

ভদ্রলোকের প্রসঙ্গটা কেন উঠলো সেটা বলি। তার স্ত্রী ছিলেন খুবই অসুস্থ। এত অসুস্থ যে, হজ্বের সফর তো পরের কথা, ঘরেও হাঁটা-চলা কঠিন ছিলো। সেই তিনি এখন মুযদালিফার উদ্দেশ্যে হাঁটছেন ক্লান্তিহীনভাবে! আল্লাহ যে তার ঘরের মেহমানকে গায়ব থেকে সাহায্য করেন, আমার জন্য এ ভদ্রমহিলা হলেন তার চাক্ষুষ প্রমাণ।

সফরে রওয়ানা হওয়ার কয়েকদিন আগেও তিনি ছিলেন হাসপাতালের বিছানায়। চিকিৎসকরা যখন হতাশ হয়ে তাদের কথা বলে দিলেন, আর তাকে ঘরে নিয়ে আসা হলো তখন তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন, মরতেই যদি হয়, নিজের ঘরে নয়, আল্লাহর ঘরে গিয়ে মরবেন।

তিনি আল্লাহর ঘরে এসেছেন, হজ্ব করেছেন, মদীনা যিয়ারত করেছেন এবং প্রায় সুস্থ অবস্থায় দেশে ফিরেছেন। যদ্দুর জানি, এখনো তিনি সুস্থ আছেন। বলো বন্ধু! এটাকে তুমি কী বলবে? নিছক ঘটনা?! বলো, যদি তোমার ইচ্ছে হয়।

এধরনের ঘটনা লেখায় অনেক পড়েছি, নিজের চোখে কম দেখেছি। কিছু দিন আগে মিশরের এক অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। ক্যানসারে আক্রান্ত এই মহিলা জীবন থেকে নিরাশ হয়ে আল্লাহর ঘরে এসেছিলেন এবং তার ভাষায় জীবন ফিরে পেয়েছিলেন। দেশে ফিরে তিনি অভিনয়-পেশা ত্যাগ করে নতুন করে মুসলমান হয়েছিলেন।

তারও আগে ঊনিশশ সাতাশিতে হিন্দুস্তানের একভদ্রলোকের কাহিনী শুনেছিলাম তার নিজের যবানিতে। তিনিও হাসপাতাল থেকে মৃত্যুর ছাড়পত্র পেয়ে আল্লাহর ঘরে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, রোগের যে উপসর্গ প্রতিমুহূর্ত আমাকে অস্থির করে রেখেছিলো, সফরে রওয়ানা হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত একবারও তা দেখা দেয়নি।

আসল কথা হলো প্রেম, বিশ্বাস ও আত্মনিবেদন। আল্লাহকে যে ভালোবাসতে পারে, বিশ্বাস করতে পারে এবং পারে নিজেকে নিবেদন করতে, আল্লাহ তাকে নিরাশ করেন না।

অসাধারণ যারা তাদের আমি শ্রদ্ধা করি, কিন্তু নিজের করে ভাবতে পরি না। মুগ্ধ বিস্ময়ে তাদের জীবনের ঘটনা পড়ি, শুনি এবং দেখি, তবে নিজের ভিতরে তেমন করে আলোড়ন অনুভব করি না। কিন্তু যখন আমারই মত কোন সাধারণ মানুষের মধ্যে অসাধারণ কিছু দেখি তখন তার প্রতি শ্রদ্ধা নয়, জাগে হৃদয় শীতল করা ভালোবাসা। তখন আমি আলোড়িত হই এবং অনুপ্রাণিত হই। অসাধারণ যারা তাদের কথা শুনে নিজেকে প্রবোধ দেই, আমি কিভাবে হতে পারি তাদের মত?! আর সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন অসাধারণ কিছু দেখি, নিজেকে তখন তিরস্কার করি, তুমি কেন হতে পারো না তার মত?!

জি, এম সাহেবের স্ত্রী যথেষ্ট সাধারণ মানুষ, কিন্তু তিনি যে বলেছিলেন, মরতে যদি হয় তাহলে নিজের ঘরে নয়, আল্লাহর ঘরে, এটা অসাধারণ কথা। এমন করে যারা বলতে পারে তারা সাধারণ হয়েও অসাধারণ। পুরো হজ্বের সফরে কোন বিষয়ে তার মুখে কোন অভিযোগ শুনিনি। মুযদালিফার দীর্ঘ হাঁটা- পথে একবার শুধু বলেছিলেন, একটু বসতে পারলে ভালো হতো।

ইমাম ছাহেব পুরো কাফেলাকে বসতে বলেছিলেন, আর একজন দ্বীনদার হাজী ছাহেব বিলম্ব হচ্ছে বলে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন।

যাই হোক, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার শুরু হলো হাঁটা। এখন যদি বলি, ঐ ভদ্রমহিলার অনুরোধ রক্ষার কল্যাণেই আমরা পথ পেয়ে গেলাম, তাহলে তুমি অবাক হতে পারো, তবে সত্য বলছি, ঘটনাটা সত্য। একজন উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে উঠলেন, ঐ যে লালবাতি জ্বলছে!

আমাদের বাংলাভাষায় লালবাতি জ্বলাটা উচ্ছ্বাসের বিষয় নয়, দুশ্চিন্তার বিষয়। কিন্তু আমাদের জন্য এই লালবাতিটা ছিলো আশার আলো। আট তারিখের সন্ধ্যায় পাহাড়ের চূড়ার এই লালবাতিটিকেই ইমাম ছাহেব পথের নিশানরূপে দেখে রেখেছিলেন। ফলে এখন তাঁবুর অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হলো। আলহামদু লিল্লাহ!

সবাই ভাবলো, এই তো পাহাড়! এবং তার পাশেই আমাদের তাঁবু! কিন্তু এই তো মানে প্রায় দুই কিলোমিটার। যাক, তবু তো প্রায় শেষরাতে মুযদালিফার তাঁবুতে পৌঁছা গেলো। শোকর আলাহামদু লিল্লাহ! দয়া করে এবং ভালোবেসে আজ রাতে আল্লাহ যে এই কষ্টটুকু করিয়েছেন এই দয়া ও ভালোবাসা পাওয়ার কী যোগ্যতা ছিলো আমাদের? সামান্য কষ্ট দিয়ে হজ্বের বড় বড় ত্রুটি ও অসম্পূর্ণতা শোধরে দেয়া কি তাঁর দয়া ও অনুগ্রহ নয়? সুতরাং শোকর আলহামদু লিল্লাহ।

আমরা দুর্বল বান্দা। আমরা কষ্ট চাই না, আরাম চাই। তবে কষ্ট যদি এসেই যায়, ভাববো, এটা দয়াময়ের দয়া, আমাদের হজ্বের সংশোধনের জন্য। বান্দার হজ্ব তো গান্দেগি দ্বারা পদে পদে ক্ষতিগ্রস্ত হতেই থাকে।

***

সবার অবস্থা এমন কাহিল ছিলো যে, এই কাত এই ঘুম, মাঝখানে কোন ফাঁক নেই! আমার অবস্থাও ছিলো অভিন্ন, কিন্তু ভয় ছিলো, ঘুমিয়ে যদি উঠতে না পারি! তাই জেগে থাকতে না পারলেও চোখ দুটো খোলা রাখার কসরত করতে লাগলাম। অবশ্য নিদ্রিত তাঁবুর কতিপয় জাগ্রত নাক জেগে থাকতে আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করছিলো এবং আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করছিলাম।

মুযদালিফার এ তাঁবু আমাদের জন্য তো ছিলো মিনার তাঁবু। মুযদালিফায় তো তাঁবু থাকে না, থাকে খোলা আসমান এবং উন্মুক্ত আকাশ। পঁচিশবছর আগে এক বৃদ্ধ যুবকের সান্নিধ্যে মুযদালিফার মরুভূমিতে উন্মুক্ত আকাশের নীচে রাত যাপন করেছিলাম। সেই সুখের স্মৃতি কি এত সহজে ভোলা যায়! অতীতের সেই মধুর স্মৃতি যে আমাকে আরো দূর অতীতে নিয়ে যায়! সেই বৃদ্ধ যুবক যেন হাতছানি দিয়ে ডাকলেন! আমি সম্মোহিত হলাম এবং নিদ্রাবিভোর তাঁবু থেকে বের হয়ে এলাম। মেঘহীন কী সুন্দর আকাশ! দুধে ধোয়া কী সুন্দর জোসনা! এমন স্বচ্ছ আকাশ দেখে, এমন সিণগ্ধ জোসনা মেখে কার না ইচ্ছে জাগে ভালো মানুষ হতে! হে আকাশ, আমাকে তোমার মত উদার করো, হে জোসনা, আমাকে তোমার মত শুভ্র-সিণগ্ধ করো।

আকাশে চাঁদ ছিলো, জোসনা ছিলো, তারার মেলা ছিলো না, তবে দুচারটি তারা মুযদালিফার আলোর মেলার দিকে তাকিয়ে ছিলো। এই চাঁদ, এই জোসনা এবং তারাদের মিটি মিটি চাহনী আমার ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে অপূর্ব এক সজীবতা এনে দিলো। মনে হলো, আসমানের এ আয়োজন আজ মুযদালিফার পবিত্র রাতেরই জন্য। কত ভালো হতো, যদি এখন এখানে মাটির আলো না থাকতো! কিংবা যদি থাকতো দূর অতীতের সেই মশালের আলো! আকাশ তাহলে আরো কাছের হতো! চাঁদের জোসনা আরো আপন হতো! দূরের তারা এবং চোখের তারা একাকার হতো!

একটি জীবনের জন্য পঁচিশবছর যথেষ্ট দূরের অতীত, তবু মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা! আলোকিত মানুষটি এই মুযদালিফার বুকে দাঁড়িয়ে আলোকিত চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে কখনো দেখেছি চাঁদের আলো, কখনো তাঁর মুখের আলো। মুযদালিফার নিঝুম রাতে চাঁদের আলো এবং মুখের আলোর এই মাখামাখি শুধু কি আজকের!! শুধু বর্তমানের! শুধু নিকট অতীতের!!! দৃশ্য ও সাদৃশের সেই মধুরতা সেদিন আমাকে কী যে আনন্দ দিয়েছিলো! হে অতীত, আমার মিনতি শোনো, তুমি ফিরে এসো আমার কাছে, কিংবা আমাকে নিয়ে চলো তোমার কাছে!

পারস্যের কবি, নামটি মনে নেই, মনে নেই তার কবিতাটিও, তিনি বলেছেন, এই চাঁদ তোমাকে নিয়ে যাবে দূর অতীতের সেই প্রিয়তমের কাছে। তুমি যদি ভালোবাসতে চাও, এই চাঁদ তোমাকে শেখাবে তাকে ভালোবাসতে। তুমি যদি দূর অতীতের সিণগ্ধতা পেতে চাও, আজকের জোসনা তোমাকে নিয়ে যাবে তার কাছে। এ চাঁদ তো সেই চাঁদ! এ জোসনা তো সেই জোসনা!

***

ছোবহে ছাদিক হয়ে গেছে, মুযদালিফাও জেগে উঠেছে এবং সাজসাজ রব শুরু হয়েছে। আমিও তাঁবুতে ফিরে এলাম। এসে যা দেখলাম তাতে আমি তো আমি, পারস্যের কবিও কবিতা ভুলে যাবেন। বড় জোর লিখতে পারেন, একটি হাম্মামের জন্য দিতে রাজি অর্ধেক বোখারা!

বিশ থেকে পঁচিশজন দাঁড়িয়ে প্রতিটি লাইনে। সবার শেষে যে ব্যক্তিটি, কল্পনা করুন তার দুর্গতির কথা! আর আমাকে কিনা দাঁড়াতে হবে তারও পিছনে! হবেই তো! এতক্ষণ ভুলে ছিলাম কেন, আমিও উদরে গান্দেগি বহনকরা মানুষ!

বোধহয় এই প্রথম অনুভব করলাম যে, আল্লাহর সাহায্য শুধু দস্তরখানেই হয় না, হাম্মাম- খানায়ও হয়। চোখে যখন অন্ধকার দেখছি, আর ইস্তিগফার করছি তখন চিনি না, জানি না, এমন একজন নিজে পিছিয়ে এসে আমাকে উদ্ধার করলেন। সুবহানাল্লাহ, মানুষ যদি ইচ্ছে করে, কতভাবেই না মানুষের উপকার করতে পারে! আল্লাহ যেন তার ঐ নেক বান্দাকে উত্তম বিনিময় দান করেন।

অযু করে তাঁবুতে এসে দেখি ইমাম ছাহেব আমার জন্য ইন্তিযার করছেন। তার ইচ্ছে, আমাকে আজকের ফজরের ইমাম বানাবেন। আমিও সৌভাগ্য মনে করে ইমামের মুছল্লায় দাঁড়ালাম। সৌভাগ্যই তো! যদি ভুল চিন্তা হয়, আল্লাহ যেন মাফ করেন।

নামায পড়ালাম আমি, তিলাওয়াত করলাম আমি; আমার কান্না এলো না, আমার শুকনো চোখ ভিজলো না, অথচ পিছন থেকে কান্নার আওয়ায এলো!

কে কাঁদলো, কেন কাঁদলো, জানতে বড় ইচ্ছে হলো, আর ইচ্ছে হলো, তাকে বলি, রোযহাশরে ভুলে যেয়ো না তোমার অভাগা ইমামের কথা! নামাযের পর অকুফ হলো। কতজন কাঁদলো, কত আহাযারি, রোনাযারি হলো, আমার কিছুই হলো না। হাত তুলে শুধু বললাম, হে আল্লাহ, আমার মুরদা দিলে কান্না নেই, আমার শুকনো চোখে পানি নেই, তবে যারা তোমার দুয়ারে কাঁদছে, তোমার ভয়ে যাদের চোখে পানি ঝরছে, হাত তুলে আমিও তাদের দলে শামিল হয়েছি। আমাকেও তুমি কবুল করো হে আল্লাহ! আমাকেও তুমি দান করো, ধন্য করো হে আল্লাহ!

আশ্চর্য এক প্রশান্তিতে অন্তর যেন পরিপূর্ণ হয়ে গেলো। মনে হলো, না কেঁদেও আমি কেঁদেছি, চোখে পানি নেই, তবু আমার চোখ ভিজেছে। কারণ আমার মাওলা বলেছেন-

 

তারা এমন সৌভাগ্যবান যে, তাদের সঙ্গীরাও বঞ্চিত হয় না।

তাঁবুতে একজন দেখি, যারযার হয়ে কাঁদছে। আশ্চর্য, নিজের জন্য তার কোন চাওয়া নেই! তার কান্না ইরাকের জন্য, ফিলিস্তীন ও আফগানিস্তানের জন্য। এখনো আছে তাহলে এমন মুসলিম যার প্রাণ কাঁদে, যার বুক ফাটে দূর দেশের মুসলিম ভাইয়ের জন্য! মনে মনে লজ্জিত হলাম, আমার মুনাজাতে আমি তো উম্মতের কথা ভুলে গিয়েছিলাম!

***

ইমাম ছাহেব বললেন, কিছু নাস্তা করে তারপর ঘোমাও। নাস্তার ব্যবস্থা হতে তখনো কিছু দেরি, আর আমার জন্য তখন ঘুম ছিলো নাস্তার চেয়ে সুস্বাদু। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম। এমন স্বাদ ও শান্তির ঘুম

জীবনে কমই ঘুমিয়েছি। এ যেন

هم القوم لا يشقى جليسهم

ওয়ালা ঘুম! নইলে এমন স্বাদ! এমন শান্তি! জেগে উঠে দেহমনে এমন সজীবতা! তোমার শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর।

চোখ মেলে দেখি, ইমাম ছাহেব নাস্তা নিয়ে বসে আছেন। বললেন, তোমার

ঘুমন্ত মুখ দেখে মনে হলো বড় শান্তির ঘুম ঘুমুচ্ছো।

জাগলে কেন! আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকতে!

বললাম, জেগে ওঠার আগে বললে না কেন, আরো কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে থাকো!

নাস্তা তেমন আহামরি কিছু নয়। দুতিন টুকরো রুটি, একটি কলা, একটি আপেল, আর শীতল কোমল পানীয়। কিন্তু মনে হলো বেহেশতের মেওয়া, জান্নাতের শরবত! একজন বললেন, ক্ষুধার খাবার এমনই স্বাদের হয়।

হতে পারে, আবার

হতে পারে অন্যকিছু। আমরা কতটুকু জানি! কতটুকু বুঝি!!

দুনিয়ার ফল-পানি, আমি যদি ভাবি বেহেশতের মেওয়া, জান্নাতের শরবত, তোমার তাতে ক্ষতি কী?!

ভাবনার আনন্দটুকু তো আর মিথ্যে নয়! বরং তুমিও ভাবো না কেন? ভাবনার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হও কেন?

***

আজ দশ তারিখ, প্রথম জামারার দিন।

আজ শুধু বড় শয়তানকে পাথর মারা। যাদের ইফরাদ হজ্ব তারা  পাথর মেরে মাথা মুড়িয়ে নিলেই ইহরাম থেকে মুক্ত। অন্যদের জন্য মাথা মুড়ানোর হুকুম হলো পাথর মেরে কোরবানি করার পর।

ভাই কামরুল ইসলামসহ ছয়জন রওয়ানা হলাম জামারার উদ্দেশ্যে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

 

 

advertisement