বি প র্য য় : মানবিক সঙ্কটে ইউরোপ
শিশুর জন্য মায়ের কোলই শ্রেষ্ঠ আশ্রয়। ছোট্ট ছোট্ট শিশুর জন্য মায়ের কোলের কোনো বিকল্প থাকতে পারে না। মা-বাবার জীবদ্দশায় সাধারণত এর কোনো অন্যথা হয়ও না। ধনী-দরিদ্র এবং হতদরিদ্র পরিবারগুলোতেও এ চিত্র প্রায় একই রকম। হঠাৎ দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে অন্তত আমাদের চেনাজানা সমাজের কথা আমরা এভাবেই ব্যক্ত করতে পারি। কিন্তু এ বিষয়টি নিয়ে পার্থিব ক্ষেত্রে অতি উন্নত ইউরোপের দেশগুলোতে এখন ভয়াবহ বিপর্যয়ের ঘটনা ঘটে চলেছে। একটি দুটি নয়, শত শত। বিবিসি’র সূত্রে ১৪ জানুয়ারির ঢাকার একটি পত্রিকা এজাতীয় একটি খবর ছেপেছে। খবরের শুরুর কয়েকটি বাক্য এ রকম-‘ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কট মানবিক বিপর্যয়ের পথে যাচ্ছে। অন্তত গ্রিসের সাম্প্রতিক ঘটনা সেরকম পরিস্থিতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গ্রিসের রাজপথে এমন অনেক শিশুর দেখা মিলছে, যাদের বাবা মায়েরা তাদের ত্যাগ করে চলে গেছেন। সন্তানের ব্যয়ভার বহনে অক্ষম অভিভাবকরা ‘নিরুপায় হয়েই’ এই নিষ্ঠুরতার পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ হল ইউরোপের ঋণ সঙ্কটের সবচেয়ে মর্মান্তিক মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র।’
ওই খবরেরই এক জায়গায় আরও বলা হয়েছে-‘এথেন্সের যুবকেন্দ্র আর্ক অব দ্য ওয়ার্ল্ড জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে চারটি শিশুকে কে বা কারা তাদের সেন্টারের দরজায় ফেলে গেছে, যাদের মধ্যে একটি সদ্যজাত শিশুও রয়েছে। একদিন তো এক মা তার দুই বছর বয়সী শিশুকন্যা নাতাশাকে তাদের হাতে তুলে দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে গেছেন। অপরদিকে একজন শিক্ষক চার বছর বয়সী শিশু আন্নাকে রাস্তায় পেয়েছেন। শিশুটির হাতে একটি কাগজ ধরা ছিল, যাতে লেখা রয়েছে-‘আমি আজ আন্নাকে নিতে আসছি না। কারণ তাকে দেখাশুনা করার সামর্থ্য আমার নেই। দয়া করে তার দেখাশুনার ভারটা নিন। আমি দুঃখিত।’
বর্ণনাগুলো আসলেই কষ্টদায়ক ও হৃদয়স্পর্শী। কিন্তু হৃদয়স্পর্শী বর্ণনা সংবলিত এ খবরের মাঝে রয়েছে বেশ কিছু ভাবনীয় ও শিক্ষনীয় বিষয়। এক. গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোজোন বা গোটা ইউরোপের অর্থনৈতিক দুরবস্থা এ পর্যায়ে পৌঁছলে কীভাবে? উগ্রপুঁজিবাদ এবং দুর্বল রাষ্ট্র থেকে লুণ্ঠনের সাম্রাজ্যবাদী নীতিই তো এদের বড় সম্বল। কী পেল তারা এ ভুল সম্বল হাতে নিয়ে? অর্থব্যবস্থায় সুদমুক্ত ভারসাম্যময়তার বিকল্প যে আসলে কিছু হতে পারে না, ইউরোজোনের মুদ্রা ও আত্মার হাহাকার সে সত্যটিই আমাদের সামনে স্পষ্ট করে দিয়েছে।
দুই. আপন সন্তানকে-যে সন্তানের বয়স দু বছর/চার বছর-রাস্তায় ফেলে যাওয়ার পেছনে চূড়ান্ত কারণটি কি কেবল অর্থাভাব? আমাদের সমাজে হতদরিদ্র কিংবা ‘মিসকিন’ পরিবারের সন্তানদেরও কি রাস্তায় ফেলে যাওয়ার ঘটনা সহসাই ঘটতে আমরা দেখি? এ দেশে হঠাৎ হঠাৎ ‘অনাহুত’ সদ্যজাত শিশুকে কোথাও কোথাও ফেলে যাওয়ার খবর আসে। এটাও নির্মম, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আবার কোথাও কোথাও ‘অপারগ’ পিতা-মাতার সদ্যজাত শিশুকে দত্তক দেওয়ার খবরও আসে। সেখানেও কান্না, কাতরতা এবং শেষ পর্যায়ে সন্তানকে আঁকড়ে ধরার ঘটনা ঘটে। কিন্তু ঠান্ডা মাথায় নিজের দু বছর, চার-ছয় বছর বয়সী সন্তানকে ভরণ-পোষণের ‘অপারগতায়’ রাস্তায় ফেলে যাওয়ার বিষয়টির সঙ্গে আমরা অপরিচিত। এটা নিশ্চয়ই মানবিক বিচারে অসুস্থ একটি সমাজ এবং হৃদয়হীন একটি পরিবেশের সংবাদ। ওই সমাজ ও পরিবেশের যাবতীয় উপাদান-উপসর্গ এবং এজাতীয় পরিস্থিতি থেকে আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হেফাযত করুন।
তিন. একটি সমাজ অতি পার্থিবতাপ্রবণ, স্বাচ্ছন্দমুখী ও বিলাসপ্রিয় হয়ে পড়লে সেখানে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও দায়কে বোঝার মতো মনে হতে থাকাই স্বাভাবিক, যেগুলো ঝেড়ে ফেলার মধ্য দিয়েই মুক্তির স্বাদ খোঁজার চেষ্টা করা হয়। গ্রিসের বর্তমান জীবনযাত্রায়
সন্তানসহ সংসারের ব্যয়নির্বাহ দুরূহ হওয়ার কারণে কষ্ট দূর করতে সন্তানকেই ছেঁটে ফেলা হয়েছে। অর্থের পরিবর্তে হৃদয় কিংবা বিত্তের পরিবর্তে চিত্তের মূল্য বেশি দিলে ঘটনা হয়ত এরকম ঘটত না। খবরের শুরুতে যে মানবিক সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে, সেটা ছিল যথার্থ বর্ণনা। আল্লাহ তাআলা মানবিক সঙ্কট থেকে এবং সে সঙ্কটের পার্থিব ও পরকালীন উপকরণ ও উপলক্ষ থেকে পৃথিবীর সব জনপদকে রক্ষা করুন।