রবিউল আওয়াল-১৪৩৩   ||   ফেব্রুয়ারি-২০১২

উ দা হ র ণ : জিএমজি এবং সাম্প্রদায়িকতা!

আবু তাশরীফ

খবরটি গত ডিসেম্বরের। ওই মাসের ২৭ তারিখে ঢাকার একটি দৈনিকে ছাপা হয়েছে। এরপর থেকে এ লেখা তৈরি করা পর্যন্ত পার হয়ে গেছে প্রায় বিশ দিন। কোনো ব্যাখ্যা বা প্রতিবাদ ছেপে আসতে দেখা যায়নি। এতে ধরে নেওয়া সঙ্গত যে, এ খবরটি সঠিক ছিল এবং খবরের মূল বিষয়বস্ত্ত ও তথ্যের সত্যতা নিয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক আপত্তি নেই। খবরটি কী ছিল এবার দেখা যাক।

শিরোনাম হচ্ছে-ইনশাআল্লাহ বলায় জিএমজির এয়ারহোস্টেসকে ক্ষমা চাইতে হল। মোট ১২ প্যারাগ্রাফে ছাপা হওয়া খবরটির প্রথম দুটি প্যারা পড়লেই বিষয়টি পরিষ্কার হযে যাবে। বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা জিএমজি এয়ার লাইন্সে ইনশাআল্লাহ ও ভ্রমণের দুআ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ইনশাআল্লাহ বলায়

সিনিয়র এক এয়ারহোস্টেসের চাকরি যায় যায় অবস্থা। ওই এয়ারহোস্টেসকে এর জন্য শোকজ করা হয়েছে। লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে তিনি চাকরিচ্যুতি থেকে আপাতত রক্ষা পেয়েছেন। অন্যদেরও চিঠি দিয়ে এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছেন জিএমজির ভারতীয় কর্মকর্তা এওয়ার্ড একলেসটন। এদিকে ইনশাআল্লাহ ও ভ্রমণের দুআ নিষিদ্ধ হওয়ায় বাংলাদেশী যাত্রীদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

জিএমজি এয়ারলাইন্সের একটি সূত্র জানায়, নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে জিএমজির সব ফ্লাইটে ইনশাআল্লাহ এবং ভ্রমণের দুআ বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়া মুরসাহা ইন্না রাববী লা গাফূরুর রাহীম পাঠ নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে অন্যান্য এয়ারলাইন্সের মতো জিএমজির ফ্লাইট যাত্রা শুরু এবং ল্যান্ড করার আগে ভ্রমণের দুআ ও ইনশাআল্লাহ অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা যাত্রা শুরু করছি এসব ঘোষণা থাকত। কিন্তু একচেটিয়া ভারতীয় কর্মকর্তা নিয়োগের পর আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করার ঘোষণা নিষিদ্ধ করার মতো ধৃষ্টতা দেখালো জিএমজি। ফলে শুধু যাত্রীই নয়, তীব্র ক্ষোভ দেখা দিয়েছে জিএমজির বাংলাদেশী অফিসারদের মধ্যেও।

সংবিধানে সেক্যুলারিজম পুনর্ভুক্তির পর রাষ্ট্রীয় ও সরকারি কর্মকান্ডের চরিত্রে এক ধরনের ইসলামশূন্যকরণ-এর বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। মন্ত্রীরা মসজিদের অর্ধেক জায়গা হিন্দুদের পূজার জন্য ছেড়ে দেওয়ার কথাও বুক ফুলিয়ে বলছেন। কিন্তু জিএমজি তো এদেশের একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স। সরকারি পদ্ধতি ও সরকারি দলের বদ-আদর্শের চরিত্র মানার কোনো বাধ্যবাধকতা তো তাদের ওপর ছিল না। তার পরও তারা কেন এটা করতে গেল? এ ঘটনাটিকে আমরা কী বলব? এটা কি বেসরকারি পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠার একটি ঔদ্ধত্যমূলক উদাহরণ? হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। ভেতরের চিত্র যা-ই হোক, আমরা তো দেখতে পাচ্ছি নোটিশ দিয়ে ইনশাআল্লাহ বলতে নিষেধ করা এবং বলার পর লিখিতভাবে ক্ষমা চেয়ে চাকরি রক্ষা করতে বাধ্য হওয়ার মতো ডিজিটাল (?) পরিবেশ এখন বাংলাদেশে বিরাজ করছে। সেক্যুলারিজম তথা ইসলামশূন্যকরণ-এর দূষিত বাতাসে চারপাশ ভারি হয়ে ওঠছে বললে কি ভুল বলা হবে?

একটি গুরুতর প্রশ্ন এ ঘটনায় প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেছে। সেটি হচ্ছে, একটি বেসরকারি এয়ারলাইন্স কী এমন দায়ের মধ্যে পড়ল যে, তাকে ইনশাআল্লাহ বলা নিষিদ্ধ করতে হল? এতে তো তার ব্যবসার ক্ষতি হওয়ার কথা। দেশের ঐতিহ্য ও আমমানুষের চিন্তাবিশ্বাস বর্জন করে সে কেন ঝুঁকি নিতে গেল? তাহলে কি সেক্যুলারিজমের নামে সবক্ষেত্রে ইসলামশূন্যকরণ প্রকল্পের কোনো তাৎপর্যপূর্ণ পর্ব ভেতরে ভেতরে শুরু হয়ে গেছে? সরকারপন্থী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে তার সূচনা-

বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে?

কেউ কেউ বলছেন এবং রিপোর্টেও বলা হয়েছে, একচেটিয়া ভারতীয় কর্মকর্তা নিয়োগের পর আল্লাহর নামে যাত্রা শুরু করার ঘোষণা নিষিদ্ধ করার মতো ধৃষ্টতা দেখাল জিএমজি। যদি ঘটনা তা-ই হয় তাহলে এটা আরও ভয়ঙ্কর। সেক্যুলারিজমের নামে এখানে অত্যন্ত খোলামেলাভাবে সাম্প্রদায়িক বাসনা চরিতার্থ করা হয়েছে। এদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে তাহলে সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন প্রতিবেশী দেশের কর্মকর্তাদের ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া উচিত। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে কি ভারতীয়দের সাম্প্রদায়িক বাসনা বাস্তবায়নের জন্য? সাধারণ নাগরিকদের তো অবশ্যই, ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক প্রবীণ মুক্তিসংগ্রামীদেরও এ বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

এরই কাছাকাছি আরেকটি খবর ছাপা হয়েছে গত ২৯ ডিসেম্বরের পত্রিকায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, বোরকা পরে ক্লাসে আসার কারণে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৃতীয় বর্ষের তিন ছাত্রীকে ক্লাসরুম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সহকারী প্রক্টর শাইখুল ইসলাম মামুন জিয়াদ ওই তিন ছাত্রীকে শুধু ক্লাস থেকে বের করে দিয়েই ক্ষান্ত হননি, দম্ভোক্তি করে তিনি বলেছেন, যারা বোরকা পরে ক্লাসে আসবে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার দরকার নেই। তারা কত বড় আন্দোলন করতে পারে তা দেখা যাবে।

এ ঘটনার পর ২২ দিন পার হয়েছে। কিন্তু নাটোরের একটি কলেজে ছাত্রীদের বোরকা পরে আসতে বলায় হাইকোর্টের যে বিচারপতি সুয়োমুটো রুল জারি করে বলেছিলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রীদের বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না এবং কেউ বোরকা পরে এলে তাকে বিব্রত করা যাবে না তিনি এখনও কিছু বলেননি। বোরকার জন্য ছাত্রীদের ক্লাস থেকে বের করা নিয়ে তার তো রুল দেওয়ার কথা। তার আগের সুয়োমুটো রুল অনুযায়ীই এ প্রত্যাশা জেগেছে। আগেও তো তিনি পত্রিকা পড়েই রুল দিয়েছিলেন। এবারও তো পত্রিকায় খবরটি এসেছে। তাহলে কি এ কথাই সত্য যে, বোরকা খুলতে তিনি যতটা উৎসাহী, বোরকা পরার কারণে কোনো ছাত্রীকে যেন বিব্রত করা না হয়-সে বিষয়ে তিনি ততটা  উৎসাহী নন? ভেতরের ঘটনা এবং মনের কথা জানা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়, কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি তো সেরকম কথাই বলে। আর এটা তো বড়ই বেদনাদায়ক ও হতাশাজনক।

 

 

 

advertisement