প্রতিবেশীঃ প্রলাপই যখন কুটনীতি
ওয়ারিস রব্বানী
বাংলাদেশের অভ্যন-রীণ বিষয়ে কূটনীতিক মহলের নাক গলানো কিংবা অভিভাবক সুলভ মন-ব্য করার নজির একদম নতুন নয়। আবার বেশ পুরনোও নয়। শুরু থেকেই নিয়মিতভাবে এমনটি চলে এসেছে, এ কথা বলা যাবে না। তবে গত কয়েক বছর ধরে এ প্রবণতা একটু বেশি মাত্রায়ই দেখা যাচ্ছে। তারপরও এদেশের কোনো গুণী শ্রেণী কিংবা গোটা জাতিকে অসম্মান জানানোর মতো মন-ব্যের বিষয়টি কোনো কূটনীতিকের পক্ষ থেকে এ দেশে নতুনই বলা যায়। আগে এরকম দেখা যায়নি। বড় বড় দেশের কূটনীতিকদের বেলায়ও এ ধরনের ঘটনা তেমন ঘটেনি। কিন' আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটির রাষ্ট্রদূত জুলাইয়ের শুরুতে একবার বললেন, টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে বলে যেসব বিশেষজ্ঞরা কথা বলছেন, তারা আসলে তথাকথিত বিশেষজ্ঞ। তার এ বক্তব্যের সময় উপসি'ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাৎক্ষণিক কোনো জবাবী মন-ব্য না দেওয়ায় মিডিয়ায় এবং রাজনীতি বিশ্লেষকদের কাছে ব্যাপক সমালোচিত হন। এর কিছুদিন পর প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে ‘বহু ছাড় দিয়েও ঘনিষ্ঠতা রক্ষার দায়ে আবদ্ধ’ থাকা সত্ত্বেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলতে বাধ্য হয়েছেন, ওই কূটনীতিক তার কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষা করেননি।’ পরদিনই আরেক প্রভাবশালী মন্ত্রী অবশ্য ওই কূটনীতিককে বাঁচিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন প্রেসে। কূটনীতিক সাহেবের বক্তব্য কতটা অমার্জিত, অশোভন ও অমর্যাদাকর ছিল, সে তর্কের জের চলেছে বেশ ক’দিন।
এ জের কাটার আগেই ওই একই কূটনীতিক মশাই আবার গত ২০ জুলাই ব্যবসায়ীদের এক মিটিংয়ে কারো কোনো তোয়াক্কা না করে ছাফ বলে দিয়েছেন, এ দেশ থেকে তার দেশে যাওয়ার জন্য যারা ভিসা সংগ্রহে লাইন দিয়ে দাঁড়ায় তাদের ৮০ ভাগই হচ্ছে টাউট ও দালাল। ২৫ হাজার বাংলাদেশী প্রতিবছর তার দেশে বৈধ ভিসা নিয়ে যান। এরপর আর ফিরে আসেন না। এটি নাকি তার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।’
অতি উন্নত (আর্থিক বিবেচনায়) কোনো দেশের কূটনীতিক তিনি নন। তার দেশে দারিদ্র, সস-া শ্রম ও বিপুল প্রানি-ক জনগোষ্ঠীর দুঃখ-দুর্দশার কথা প্রায়ই মিডিয়ায় চলে আসে। অহং দেখানোর মতো তার দেশের তিনটি জিনিস ছাড়া কিছু নেই। সেই তিনটি জিনিস হচ্ছে, আয়তনের বিশালতা, বিপুল সংখ্যক সেনা ও সমরাস্ত্র এবং পরদেশে আগ্রাসী আচরণে নেতাদের নির্বিরোধ ঐক্য। এই অহং-এর উপর ভর করে এ দেশের উপর-নিচ সব মহলের মুণ্ডু চটকানোর মতো অভব্যতা তিনি দেখাচ্ছেন এবং বিনা প্রতিবাদে এদেশেই অবস'ান করছেন। প্রতিবাদ অবশ্য করছেন বিরোধী দলগুলো, সাধারণ মানুষ ও সুধী সমাজ। কিন' একটি দেশের কূটনীতিকের জিহ্বায় লাগাম টানার জন্য স্বাগতিক দেশের যে মহল বা স-র থেকে প্রতিবাদ উচ্চারিত হওয়ার নিয়ম রয়েছে সে জায়গাটায় বড় নীরবতা ও মুগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে আছে। এটাই দুঃখ।
যুদ্ধ করে স্বাধীন হওয়ায় গর্বিত, নিজস্ব সংস্কৃতি ও চেতনায় উজ্জীবিত একটি দেশের জন্য এ ধরনের কূটনৈতিক অভব্যতা বারবার সহ্য করে যাওয়া মারাত্মক লজ্জার বিষয়। সাধারণ-বিশেষ নির্বিশেষে স্বাগতিক দেশের সব পর্যায়ের মানুষকে অপমান করার ভাষা একজন কূটনীতিকের থাকার কথা নয়। কূটনীতিকদের নিজস্ব ও স্বতন্ত্র বচনভঙ্গি আছে। চরম দ্বিমতযোগ্য বিষয়েও তারা সাধারণত সংযত শব্দ প্রয়োগে অভ্যস- থাকেন। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রশিক্ষণও তাদের দেওয়া হয়ে থাকে বলে শোনা যায়। এরপরও একজন কূটনীতিকের ভাষার এই কদর্যতার বিষয়টিকে খাটো করে দেখার সুযোগ সম্ভবত খুবই কম। কোনো নির্দিষ্ট এজেণ্ডা ছাড়া এমন কাণ্ড কোনো কূটনীতিক করতে পারেন না। সেই এজেণ্ডাটি কী-এটা খুঁজে বের করার দায়িত্ব দায়িত্বশীল মহলের। তা না হলে দেশের এবং দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ-ক্ষতি ঠেকানো মুশকিল হয়ে যাবে।
কেউ কেউ উদার কণ্ঠে বলতে পারেন-একজন রূঢ় ও অভদ্রভাষী কূটনীতিকের একটি দু’টি অপমানজনক বাক্যের কারণে একটি দেশ ও জাতির হয়তো একটি পশমও ক্ষতিগ্রস- হয় না। প্রলাপ কিংবা অমার্জিত উক্তির হয়তো জবাব না দিলেও চলে যায়। ভদ্রতার নিজস্ব শক্তি ও জোরই হয়তো অভদ্রতার জবাব হয়ে যেতে পারে। কিন' একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন দেশ ও জাতির জন্য সমস্যাটা অন্য জায়গায়। এভাবে ‘পাগলদের’ সয়ে যেতে থাকলে একটি দিন তো এমনও চলে আসতে পারে যে, বহু সংযমী ও সংযতভাষী কূটনীতিকও সুনির্দিষ্ট দেশবিরোধী এজেণ্ডা নিয়ে ‘পাগল’ সেজে কথা বলতে থাকবেন। তখন পূর্ব থেকে প্রস'ত হয়ে থাকা ডুগডুগিওয়ালারা দেশের বারোটা বাজানো পর্যন- তাদের সঙ্গ দিয়ে যাবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এদেশে তো বুদ্ধি-ব্যাপারীদের মধ্যে ডুগডুগি বাজানোর লোকের অভাব নেই। তাই প্রথম পর্যায়েই প্রলাপবকা কূটনীতিকদের অকূটনৈতিক আচরণে বাধা দেওয়া উচিত। পারলে থামানো উচিত, না পারলে গাট্টি-বোচকা গোল করে স্বদেশে যাওয়ার ব্যবস'া নেওয়া উচিত। ক্ষতি কী? দেশটাতো কাছেই। শিফটিংয়ের কষ্ট বেশি হওয়ার কথা নয়।