জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ.-এর আলখাসাইসুল কুবরা : একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক সীরাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘আলখাসাইস’। খাসাইস মানে বিশেষত্ব। আল্লাহ তাআলা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য এমন অনেক বিশেষত্ব দিয়েছেন, যা অন্য কাউকে দেননি। সীরাতের কোনো বড় গ্রন্থ ‘খাসাইসে’র আলোচনা ছাড়া নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘আলমুজিযাত’, যাকে দালাইলুন নবুওয়াহও বলে। অনেক সময় খাসাইসের মাঝে মুজিযাতও শামিল করা হয়।
খাসাইস ও মুজিযাত সম্পর্কে যেমন হাদীস ও সীরাতের কিতাবে আলাদা অধ্যায় থাকে তেমনি এ দুই বিষয়ে আলাদা গ্রন্থ রচনার ধারাও অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। তবে অনেক গ্রন্থই এখনো পান্ডুলিপি আকারে পৃথিবীর বিভিন্ন গ্রন্থাগারের শোভাবর্ধন করে চলেছে। এরপরও যত গ্রন্থ মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে তার সংখ্যাও মাশাআল্লাহ অনেক।
জালালুদ্দীন সুয়ূতী রাহ. (সিয়ূতী ভুল উচ্চারণ) তাঁর রচনা-‘আলখাসাইসুল কুবরা’য় খাসাইস ও মুজিযাত দু বিষয়েই রেওয়ায়েত সংকলন করেছেন। সুয়ূতী রাহ.-এর প্রবণতা এই যে, তিনি যখন কোনো বিষয়ে রেওয়ায়েত সংকলনের ইচ্ছা করেন তখন সব ধরনের রেওয়ায়েত সংকলন করেন। এ কারণে তাঁর এ ধরনের কিতাবে যয়ীফ, মুনকার, ওয়াহী রেওয়ায়েতও প্রচুর পরিমাণে এসে যায়। ‘আখাসাইসুল কুবরা’ কিতাবেও তাঁর এই প্রবণতা সক্রিয় ছিল। এ কারণে অনেক বে-আসল ও ভিত্তিহীন এবং মুনকার ও মওযূ রেওয়ায়েতও এ কিতাবে প্রবেশ করেছে। এ কিতাবের সকল বর্ণনা সহীহ মনে করা ঠিক নয়।
উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুম সুয়ূতী রাহ.-এর কিতাব ‘আলইতকান ফী উলূমিল কুরআন’ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে এ কিতাবের অনেকগুলো ভালো দিক উল্লেখ করার পর বলেন, ‘তবে ‘আলইতকান’ অধ্যয়নের সময় এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আল্লামা সুয়ূতী রাহ. তাঁর যেসব কিতাবে এক বিষয়ের সম্ভাব্য সকল তথ্য একত্র করার চেষ্টা করেছেন তাতে শুদ্ধ-অশুদ্ধ সব ধরনের বস্ত্তই একত্র হয়েছে। বিশেষত, বর্ণনার শুদ্ধাশুদ্ধির বিষয়ে পূর্ণ সতর্কতা এসব কিতাবে অনুপস্থিত। ফলে ‘আদ্দুররুল মানছূর’ ও ‘আলখাসাইসুল কুবরা’র মতো ‘আলইতকান’ কিতাবেও অনেক যয়ীফ; বরং মওযূ রেওয়ায়েতও বিদ্যমান রয়েছে। রেওয়ায়েতের ক্ষেত্রে এসব কিতাবের উপর পুরোপুরি নির্ভর করা যায় না।
‘এ কারণে এ সকল গ্রন্থের সঠিক ব্যবহারের জন্য ইলমে তাফসীর ও ইলমে হাদীসে পারদর্শিতা এবং এ সকল ইলম মাহির উস্তাযের নিকট থেকে হাসিল করা অতি জরুরি। নতুবা এই কিতাবের শুদ্ধ ও নির্ভরযোগ্য এবং অশুদ্ধ ও ভিত্তিহীন বর্ণনাসমূহের মাঝে পার্থক্য করা কঠিন হবে।’-তাবসেরে পৃ. ১৬
আলোচ্য কিতাবের বে-আসল ও ভিত্তিহীন এবং মুনকার ও মাওযূ রেওয়ায়েতসমূহের উপর একটি পর্যালোচনা প্রবন্ধ ইনশাআল্লাহ আগামী কোনো সংখ্যায় পেশ করব। আপাতত তালিবে ইলম ভাইদের বলব, তাঁরা এ বিষয়ে নিম্নোক্ত কিতাবসমূহ অধ্যয়ন করতে পারেন।
تهذيب الخصائص النبوية الكبرى
এটি শায়খ আবদুল্লাহ আততালীদীর কিতাব। এতে তিনি সুয়ূতী রাহ.-এর আলোচিত দুই খন্ডের কিতাব ‘আলখাসাইসুল কুবরা’ কে সংক্ষেপন করেছেন।
যয়ীফ, মুনকার ও মওযূ রেওয়ায়েত বাদ দিয়ে শুধু সহীহ-হাসান রেওয়ায়েত সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। এই কিতাবে সর্বমোট ৬৯৪টি হাদীস আছে। বৈরুতের দারুল বাশাইরিল ইসলামিয়্যাহ কিতাবটি প্রকাশ করেছে।
الآيات البينات في ذكر ما في أعضاء رسول الله صلى الله عليه وسلم من المعجزات
এটি মুহাদ্দিস আবুল খাত্তাব ইবনে দিহয়া (৬৩৩ হি.)-এর কিতাব। জামাল আযযূন-এর সম্পাদনায় ও তার টীকাসহ প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক : মাকতাবাতুল উমরাইন শারিক্বাহ
من معين الخصائص النبوية
শায়খ সালিহ আহমদ শামীর কিতাব, যিনি ইলম ও তাহকীকের ক্ষেত্রে মাশাআল্লাহ অত্যন্ত রুচিশীল ব্যক্তি। কিতাবটির প্রকাশক দামেশকের আলমাকতাবুল ইসলামী।
أعلام النبوة
ইমাম আবুল হাসান আলমাওয়ারদী রাহ. (৪৫০ হি.)-এর কিতাব। এর কয়েকটি এডিশন বৈরুত ও অন্যান্য জায়গা থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
এ বিষয়ে আরো অনেক কিতাব আছে। এখানে চারটি কিতাবের নাম লিখলাম।
আমার এ ধরনের নিবন্ধগুলো পড়ে সাধারণ শিক্ষিত বন্ধুরা বলেন, এগুলো তো আলিম-তালিবে ইলমদের বলা হল। আমরা কী বই পড়ব, তা তো বলেননি।
আমি তাদেরকে কীভাবে বোঝাই, বাংলা ভাষায় দ্বীনী কিতাবের পরিমাণ অনেক হলেও সূক্ষ্ম ও প্রয়োজনীয় ইলমী বিষয়ে নির্ভরযোগ্য রচনা খুবই কম। এই সংকটের কারণ কী জিজ্ঞাসা করা হলে সাধারণ উত্তর তো এই যে, মৌলভীরা আমাদের জন্য কিছুই লেখেনি। কিন্তু এর দায় যে সাধারণ দ্বীনদার ভাইদের উপরও কিছু না কিছু বর্তায় এবং তাদেরও যে কিছু করণীয় থাকতে পারে সে সম্পর্কে চিন্তা করার মতো মানুষের সংখ্যা খুব বেশি নয়।
কয়েক বছর আগের কথা। এক বুযুর্গ একজন আহলে খায়েরের (ধনী দ্বীনদার) সাথে একজন নওজোয়ান আলিমের পরিচয় করালেন। তার কিছু রচনার কথাও বললেন। তখন ঐ ব্যক্তি আক্ষেপ করে বলেছিলেন, বাংলায় কোনো কিতাব নেই? আসলে এ জাতির ভাগ্যই খারাপ ...!
তিনি ঐ বুযুর্গের মাদরাসার মাতবাখে (লিল্লাহ বোর্ডিংয়ে) প্রতি মাসে ষাট হাজার টাকা দিতেন। এখনকার অবস্থা আমার জানা নেই। তিনি বেঁচে আছেন, কি তাঁর ইন্তেকাল হয়ে গেছে তা-ও জানি না। যে অবস্থাতেই থাকুন, আল্লাহ তাঁকে ভালো রাখুন, সকল অনিষ্ট থেকে তাঁকে ও তাঁর সন্তানদের রক্ষা করুন। তো তিনি যখন আক্ষেপ করে উপরের কথাটা বলছিলেন তখন মনে মনে আমিও তাকে সম্বোধন করছিলাম, ‘জনাব! আপনি কি আপনার বুযুর্গের কাছে কখনো এই আবেদন করেছেন যে, আপনার মাদরাসায় ‘রচনা ও গবেষণা’র বিভাগ খুলুন যেন বাংলা ভাষায় কিছু খিদমত হয়। আর এক্ষেত্রে আমাদের কিছু করণীয় থাকলে বলুন, আমরা আদেশ পালনে প্রস্ত্তত!’
মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়ার প্রধান তিনটি বিভাগের দ্বিতীয়টি হচ্ছে রচনা বিভাগ। এ বিভাগের প্রায় বিশটি শাখার একটি হচ্ছে ‘আসসীরাতুন নাবাবিয়্যাহ’। শুধু বাংলাভাষী পাঠকদের জন্যই নয়, আরবদের জন্য এবং উলামা-তলাবার জন্যও এ বিষয়ে অনেক কাজ করার আছে। কিন্তু এ ধরনের গবেষণামূলক কাজের জন্য বাতেনী উপকরণের সাথে কত জাহেরী উপকরণ যে লাগে তা তো অনেকে ধারণাও করতে পারেন না।
আমরা পাঠকবৃন্দের কাছে দুআ চাই, আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে কবুল ও মকবূল করুন এবং দ্বীনের কাজে ব্যবহার করুন। আমীন।
কেউ কেউ মনে করে, দ্বীনের কাজ তো এমনি এমনি হয়ে যায়, এর জন্য আবার উপায়-উপকরণ লাগে নাকি। আসলে মোটেও লাগে না। আল্লাহ তাআলা গায়ব থেকেই সরাসরি সব করতে পারেন। কিন্তু এ তো তাঁর অনুগ্রহ যে, বান্দাকে দ্বীনের কাজে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছেন, যাতে সে আখিরাতের পাথেয় প্রস্ত্তত করতে পারে। নতুবা কর্তা তো একমাত্র আল্লাহ।
যারা দ্বীনের কাজে নুসরত করছেন তাদের এই অনুভূতি থাকতে হবে যে, আল্লাহ আমাকে কাজে লাগিয়েছেন। সুতরাং আমার শোকরগোযারি করা উচিত। অনুগ্রহ ফলানো, সিদ্ধান্ত চাপানো ও গর্ব-অহংকারের তো প্রশ্নই আসে না।
যাইহোক, আহলে খায়ের বন্ধুদের কর্তব্য, নিজেকে পেশ করা আর আহলে ইলমের কর্তব্য, হযরত হাকীমুল উম্মত থানভী রাহ.-এর যওক ও রুচি গ্রহণ করা। (যদি না কোনো শরয়ী ওযর থাকে।)
হযরত রাহ.-এর মালফূযাত ‘আলইফাযাতুল ইয়াওমিয়্যাহ’ তে (জিলদ ১; কিসত : ৫, পৃষ্ঠা : ৫৪৫; ১২/১২/১৩৫০ হি.) একদিন নীচের ঘটনাটি নজরে পড়ল।
‘একজন বললেন, হযরতের সকল মাকতূব (চিঠিপত্র) যদি এক জায়গায় সংকলিত হত তাহলে খুব ভালো হত যদি তাতে মাসলাহাত-পরিপন্থী কিছু না থাকে।
‘হযরত বললেন, মাসলাহাত-বিরোধী কিছু নেই, কিন্তু এসব কাজের জন্য অর্থের প্রয়োজন। আর এ পরিমাণ অর্থ তো নেই। কারো কাছে চাইতেও আত্মসম্মানে বাধে। আমি তো আল্লাহর লাখ লাখ শোকর আদায় করি যে, এখানে যে পরিমাণ কাজ বিনা চাওয়ায় হচ্ছে অন্য জায়গায় তা চাওয়ার পরও হয় না। এটা তাঁরই মেহেরবানি।’
যাইহোক, প্রসঙ্গ এল তাই এ কথাগুলো আরজ করলাম। বোধ হয় কিছু দীর্ঘই হয়ে গেল। তবে সান্ত্বনা এই যে, সম্ভবত আমাদের চেতনা ও কর্মের সাথে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় এতে আছে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।