ষড়যন্ত্র
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে একের পর এক সরকার বিরোধী সহিংস আনেদালন গড়ে উঠছে। ঘটছে সরকার প্রধানের পতন। কোনো কোনো পশ্চিমা সাংবাদিক একে বলছেন, আরব বসন্ত। কিন্তু আসলে এসব আনেদালনের পেছনে কলকাঠি নাড়ছে কে বা কারা এবং তাদের উদ্দেশ্য কী? এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ে গত ২৩ অক্টোবর ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ডেস্ক রিপোর্ট হুবহু এখানে পুন:মুদ্রিত হল।
নেপথ্যে নাটের গুরু সিআইএ
ডেস্ক রিপোর্ট
আরবজুড়ে সাম্প্রতিক সব জন-মহাজাগরণের নেপথ্যে নাটের গুরু সিআইএ। গণবিদ্রোহের কলকাঠি নাড়ছে তারাই। তিউনিসিয়া থেকে মিসর ক্ষমতার পালাবদলে মূল খেলোয়াড় হলো মার্কিন এই আলটিমেট গোয়েন্দা সংস্থা। বেন আলি, হোসনি মোবারকের লৌহ শৃঙ্খলিত শাসনের পতন জনবিস্ফোরণের মুখে ঘটলেও এ অভ্যুত্থান নাটকের চিত্রনাট্য ও দৃশ্যকাব্যগুলো সিআইএ’রই রচনা।
সর্বশেষ শিকার হলো আরব মরুসিংহ গাদ্দাফি। যিনি দৃশ্যত এক নায়ক হলেও তার সার্বিক চরিত্র অন্য আরব দখলদার রাজা-বাদশাদের সঙ্গে ঠিক মেলে না। এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন অনেকেই—আরব দুনিয়ায় হঠাৎ করে কী হলো! দীর্ঘ শতাব্দীব্যাপী আরব রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক জীবনাচরণে কেন এই নতুন ছন্দ!
যুগ যুগ ধরে যারা শাসকের গুণকীর্তন করেছে, সেই শাসকের বিরুদ্ধেই কেন অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ল আরব তরুণরা? কীভাবে এতটা সাহসী হলো এসব সাধারণ মানুষ। যৌবনের এই জোয়ার এতদিন কোথায় ছিল। এর পেছনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদত ছিল সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (সিআইএ)। তারাই অর্থ,অস্ত্র ও বুদ্ধি দিয়ে এসব দেশে বিক্ষোভের বহ্নিশিখা জ্বেলে দিয়েছে। আরব বিশ্বের এই বিক্ষোভ-প্রতিবাদ,সশস্ত্র হামলা মূলত সিআইএ’র অনুপ্রেরণায়। জর্দান,মরক্কো,আলজেরিয়া,ইয়েমেন,লেবানন, বাহরাইন ও সিরিয়াতেও বিক্ষোভের পেছনে সিআইএ। ১১ সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে হামলার পর অনেক মুসলিম দেশ সিআইএ’র গোপন হামলার টার্গেটে পরিণত হয়। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেন, মিসর,লিবিয়া, পাকিস্তান এবং আরও কয়েকটি পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশ ছিল অন্যতম। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ বারবারই বলেছেন,তিনি মুসলিমদের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন না;বরং সিআইএ’র গোপন কৌশল দিয়ে এসব দেশে মার্কিন নীতি বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছিলেন তিনি। সিআইএ’র এজেন্টরা এখন প্রায় সব ইসলামী দেশে বিচরণ করছে।
এসব দেশে তাদের গড়ে তোলা বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সিআইএ’র এজেন্টরা তৎপর। তারা মিথ্যা প্রপাগান্ডা,রাজনৈতিক ভিন্নমত, জাতিগত বিভক্তি,সহিংসতা,অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতাদের গুপ্তহত্যা এবং নিরীহ মানুষ হত্যা এই এজেন্সির বড় লক্ষ্য। ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলায় অভিযুক্ত রামজি ইউসুফ—যিনি সিআইএ ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এসব কাজ সম্পর্কে অবগত—১৯৯৭ সালে মার্কিন আদালতে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন,‘তোমরা কসাই,তোমরা মিথ্যাবাদী,তোমরা বিশ্বাসঘাতক। তোমরা গণমাধ্যমের সামনে সন্ত্রাস দমনের কথা বল,আর পেছনের দরজা দিয়ে সন্ত্রাসবাদে সহায়তা কর।’ ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে এমন গুজব সিআইএ-ই রটিয়েছিল,যা সত্য নয়।
দ্য গার্ডিয়ান বলছে,মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থন মিসর,তিউনিশিয়া ও লিবিয়ার গোপন হামলার কৌশলকে জনপ্রিয় বিক্ষোভের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। এমনকি দীর্ঘদিনের মিত্র দেশ সিরিয়া ও বাহরাইনের গণবিক্ষোভে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করছে। প্রতিবেদনে বলা হয়,আরব বিশ্বে মার্কিন পররাষ্ট্র নীতিতে প্রেসিডেন্ট ওবামা পরিবর্তন এনেছেন। আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে বলছেন।
গত ২ মার্চ ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট সালেহ সিআইও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের ভূমিকার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন,আরব বিশ্বকে অস্থিতিশীল করার জন্য হোয়াইট হাউস তেল আবিবে (ইসরাইলের রাজধানী) একটি অপারেশন রুম পরিচালনা করছে। এছাড়া সানায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিরোধীরা প্রতিনিয়ত যোগাযোগ করে চলেছে। উইকিলিকসের ফাঁস করা গোপন তারবার্তায় জানা যায়, সিরিয়া ও অন্য আরব দেশগুলোতে বিক্ষোভ সংগঠিত করছে সিআইএ। যা হোক,ওবামা প্রদর্শিত কৌশলে লিবিয়ার নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি,তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বেন আলি এবং মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারককে ক্ষমতা থেকে অপসারণে সিআইএ সফল হয়েছে। যদিও বহু বছর ধরে এসব একনায়কের গদি দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পেছনে শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
এছাড়া কিছু কিছু তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়,সোমালিয়া ও ইয়েমেনে অবস্থানরত আল কায়দাকে দমনের ভান করে ওবামা প্রশাসন হর্ন অব আফ্রিকা এবং আরব উপত্যকায় সিআইএ’র জন্য একটি গোপন ড্রোন ঘাঁটি গড়তে চাইছে।
তবে এ মুহূর্তে যে প্রশ্নটি সবার সামনে আসছে,তা হলো এ অস্থিরতা তৈরির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের লাভ কী? বলা হচ্ছে,ইসরাইলের স্বার্থরক্ষার জন্যই
যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে। আর বড় বিষয় হলো,তারা আরব বিশ্বের তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে চাইছে। যদিও এসব দেশের আন্দোলনের আগুনে সিআইএ’র ঘি ঢালার কারণে ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিশ্বে অসন্তোষও বাড়ছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর কায়রোতে ইসরাইলি দূতাবাসে হামলার ঘটনা এর বড় উদাহরণ হতে পারে।
সিআইএ মূলত খেলছে দুইরূপধারী গোপন খেলা। আরব একনায়কদের তারাই নানা শক্তি ও সাহস জুগিয়ে পরিণত করছে দানবে। আবার মার্কিন স্বার্থের টানাপড়েনে তাদেরই খড়গের শিকার হয়ে করুণ পরিণতি ঘটছে বেন আলি,হোসনি মোবারকদের। প্রশ্ন এবার,এর পরে কে! কোন দেশে সিআইএ’র পরবর্তী মিশন।