টিপাইমুখ বাঁধ কত ক্ষতি নিয়ে আসছে
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে তোড়জোড় শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে পরিষ্কার কোনো সিদ্ধান্ত বা পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি তখন। উল্টো টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন পর্যায়ে যারা বিভিন্ন আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন ও প্রতিবাদ করেছেন ভারতের পক্ষ থেকে তাদের শুনতে হয়েছে বহু অপমানমূলক বক্তব্য।
ভারত এবং ভারতপন্থী এদেশীয় রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়ার পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর হয় এমন কিছু করে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণ করা হবে না। এমন কথাও বলা হয়েছে যে, টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে বাংলাদেশে যারা বিরুদ্ধাচরণ করছে তারা আসলে রাজনৈতিক কোনো ইস্যুর জন্যই এমন করছে। এর মধ্যে দেশপ্রেমের কিছু নেই। কিন্তু তাদের এসব সাফাইমূলক ও বন্দনামূলক বক্তব্য সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে ভারত টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে।
গত অক্টোবর মাসের ২২ তারিখ টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ভারতসরকার সে দেশের দুটি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিও সই করেছে। নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে এ খবর বাংলাদেশে রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পর থেকে সরকারী দল ছাড়া প্রধান বিরোধী দলসহ সব মহল ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। এরই মধ্যে ১ডিসেম্বর সিলেট বিভাগজুড়ে হরতালের ডাক দেওয়া হয়েছে। পত্রপত্রিকায় প্রতিদিনই বিভিন্ন প্রতিবেদন-কলাম ও প্রতিক্রিয়া ছাপা হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে।
সিলেটের জকিগঞ্জের অমলশীদ
সীমান্তের প্রায় ১০০ কিলোমিটার পূর্বে ভারতের মণিপুর রাজ্যের চুবাচাঁদপুর জেলার দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল টিপাইমুখ বরাক নদের ওপরই নির্মিত হতে যাচ্ছে ১৬২ দশমিক ৮০ মিটার উঁচু বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। ফলে ভাটিতে সুরমা-কুশিয়ারা ও প্রমত্তা মেঘনা নদী ও তীরবর্তী এলাকায় এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠবে। এই উদ্বেগ অস্বীকার করতে না পেরেই ২০০৯ সালে সাবেক পানিসম্পদমন্ত্রী ও সরকারদলীয় এমপি আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে এক সংসদীয় প্রতিনিধি দল টিপাইমুখ বাঁধ এলাকা পরিদর্শনে যায়। ওই সময় ভারতীয় মন্ত্রীসহ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের তথ্যাদি চাওয়া হলে প্রতিশ্রুতি দিয়েও তারা কিছু দেয়নি। সফর শেষে দেওয়া রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি, সংসদেও এ নিয়ে কোনো আলোচনা হতে দেখা যায়নি। তখন এক সংবাদ সম্মেলনে রাজ্জাক সাহেব জোরগলায় টিপাইমুখ বাঁধে বাংলাদেশের ক্ষতি হবে না বলে বলেছিলেন।
এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কিছু করা হবে না-মুখে এমন আশ্বাস দিয়েই সবার অগোচরে টিপাইমুখ নিয়ে চুক্তি করে ফেলেছেন। এমন কথার মায়াজাল সৃষ্টি করেই ফারাক্কা বাঁধ নির্মিত হয়েছিল। এখন ভারত সরকারের এক এক করে নেওয়া পদক্ষেপ থেকে প্রমাণ হয়, তারা একতরফাভাবে টিপাইমুখ বাঁধ নির্মাণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অথচ বাংলাদেশের সব পর্যায়ের পানি ও নদী বিশেষজ্ঞরাই বলছেন, টিপাইমুখ বাঁধের কারণে বাংলাদেশের ভয়াবহ ক্ষতি হবে।
বিশেষজ্ঞদের তথ্য-উপাত্ত ও বক্তব্য অনুসরণ করে গত ২৫ নভেম্বর একটি জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছে-‘টিপাইমুখ বাঁধ যে বাংলাদেশের জন্য ফারাক্কার চেয়েও ভয়ঙ্কর বিপদরূপে আবির্ভুত হতে যাচ্ছে তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। এই বাঁধ নির্মিত হলে বাংলাদেশের নদীপ্রবাহে গুরুতর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়া ছাড়াও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওরগুলো বিপণ্ণ হয়ে পড়বে। এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে কৃষি উৎপাদনে, মৎস্যসম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় এই বিশাল বাঁধটি নির্মিত হলে কোনো কারণে প্রচন্ড ভূমিকম্পে বাঁধটি ভেঙে গেলে বাংলাদেশের বিরাট এলাকা দেখতে না দেখতে গভীর পানিতে তলিয়ে যাবে। তখন এদেশের প্রায় কোটি খানেক মানুষকে নূহের প্লাবনের মতো হাবুডুবু খেতে হবে। তাদের শেষ পরিণতি কী হতে পারে, তার একটা নমুনা আমরা জাপানে আঘাত হানা সর্বশেষ সুনামির সময় দেখেছি।’
টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে দেশব্যাপী উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়লেও আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে কোনো
সন্তোষজনক বক্তব্য আসছে না। সরকারের কোনো মন্ত্রীই এ বাঁধ প্রকল্পে এ দেশের জন্য ক্ষতিকর কিছুর আশঙ্কা করছেন না। উল্টো প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলকে দায়ী করে বলেছেন, তাদের সময়ে তারা এ বাঁধের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এটা ভারতের নিজস্ব ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে আমাদের কিছু বলার নেই।’ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিব ‘ভারতের পক্ষ থেকে এখনও কিছু জানানো হয়নি’ বলে দায়সারা বক্তব্য দিয়েছেন। অবশ্য পানিসম্পদমন্ত্রী গত ২৬ নভেম্বর সাংবাদিকদের চাপাচাপিতে বলে ফেলেছেন, ‘দরকার হলে আমরা আন্তর্জাতিক আদালতে যাব।’
এদিকে প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে টিপাইমুখ বাঁধ বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে পাঠানো চিঠির জবাব এসেছে বলে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। প্রধান বিরোধী দলের নেত্রী সরকারকে বলেছেন, ‘আপনারা এ বাঁধের বিরুদ্ধে আবস্থান গ্রহণ করুন। আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকব।’ সরকারের তরফে বিরোধীদলের এ আহবানকে ‘ইন্টারেস্টিং’ বলে আখ্যা দিলেও এ বিষয়ে ইতিবাচক কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না তা জানানো হয়নি।
ভারত সরকারের উদ্যোগে করা হচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার মুখ বুঁজে তা মেনে নিচ্ছে বলেই দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রধান বিরোধী দলসহ ছোট বড় দল ও মহলগুলো এ বাঁধের বিরোধিতা করছে। এর ফল কী হতে পারে? দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতা এখানে বড় হয়ে ওঠছে শুধু নয়; বরং দেশের স্বার্থেও ভিন দেশের কাছে নতজানু থাকা আর জরুরি ইস্যুতে বিভাজন অতিক্রম করতে না পারার এক ন্যাক্কারজনক উদাহরণ হয়ে যাচ্ছে টিপাইমুখ বাঁধ প্রকল্প। তবে এ আশা করা যেতে পারে যে, আল্লাহর নামে ভরসা করে সর্বস্তরের দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠি আগ্রাসী শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেমে এলে অবশ্যই এ বাঁধের পরিকল্পনা নস্যাত করা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।