নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের খেদমতে নারীর জিজ্ঞাসা ও নারীর বিষয়ে জিজ্ঞাসা
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
লাইলাতুল কদরে কী দুআ করব
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি যদি লাইলাতুল কদর পাই তখন কী দুআ করব? রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এই দুআ করবে-
اَللّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنَّا
(ইয়া আল্লাহ! নিশ্চয়ই তুমি অতি ক্ষমাশীল। সুতরাং আমাকে ক্ষমা করে দাও।)-মুসনাদে আহমদ ৬/১৭১, হাদীস : ২৫২৬০
অগ্রবর্তীর হক
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, (হজ্বের সময়) আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমরা কি মিনায় আপনার জন্য একটি ঘর বা ভবন নির্মাণ করব, যা আপনাকে রৌদ্রের তাপ থেকে রক্ষা করবে?’ জবাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না, মিনা হল যে আগে যাবে তার অবস্থানস্থল।’-সুনানে আবু দাউদ ১/২৭৬
অকস্মাৎ মৃত্যুর মূল্যায়ণ
উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আকস্মিক মৃত্যু সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম আল্লাহর নবী বললেন, ‘এটি ঈমানদারের জন্য স্বস্তি ও শান্তির কারণ। আর অক্ষম (পাপাচারীর) জন্য দুঃখ ও আফসোসের কারণ।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৪৯২৩
ফায়েদা : এই হাদীসের ‘আজিয’ বা অক্ষম শব্দের ব্যাখ্যা অন্য হাদীসে আছে। তাতে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘অক্ষম ঐ ব্যক্তি, যে নিজেকে প্রবৃত্তির অনুগামী করে আর আল্লাহ সম্পর্কে অলীক আশা পোষণ করে।’
মহামারীর হাকীকত
হযরত আয়েশা রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মহামারি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, ‘এটা হচ্ছে আযাব। আল্লাহ তাআলা তার যে বান্দাদের উপর ইচ্ছা তা প্রেরণ করেন। আর মুমিনদের জন্য আল্লাহ সেটিকে রহমত বানিয়ে দেন। যখন কোনো এলাকায় মহামারি দেখা দেয় আর মুমিন ব্যক্তি সবর ও সওয়াবের নিয়তে এই বিশ্বাস রেখে নিজ এলাকাতেই অবস্থান করে যে, আল্লাহ তার ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন তা ছাড়া কোনো কিছুই তাকে আক্রান্ত করতে পারবে না তাহলে সে শহীদের সওয়াব লাভ করবে।-সহীহ বুখারী ১/৪৯৪
ফায়েদা : উপরের দুটো হাদীসে এমন বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, যাকে সাধারণত অশুভ মনে করা হয়। জবাবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানিয়ে দিয়েছেন যে, একই বিষয় পাত্রভেদে শুভ হতে পারে, আবার অশুভও হতে পারে। এটা নির্ভর করে ব্যক্তির বিশ্বাস ও কর্মের উপর। কাফিরের জন্য যা আযাব ঈমানদারের জন্য, তার ঈমানের গুণে তা হয়ে যেতে পারে রহমত। এই হাদীস থেকে আরো শিক্ষা পাওয়া যায যে, কোনো মুমিন-মুসলমানকে বিপদগ্রস্ত হতে দেখলে তার সম্পর্কে কু-ধারণা পোষণ করা উচিত নয়।
সুসংবাদ, দুঃসংবাদ
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, (উম্মুল মুমিনীন) হযরত খাদীজা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ওয়ারাকাহ বিন নাউফাল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বলেছেন, ‘আমি তাকে স্বপ্নে সাদা কাপড় পরিহিত অবস্থায় দেখেছি। আমার ধারণা, সে যদি জাহান্নামী হত তবে তার পরনে সাদা কাপড় থাকত না।’-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৪২৪৮
কিয়ামতের দিন কেউ কাউকে স্মরণ করবে কি
হযরত আয়েশা রা. একবার জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদলেন। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কাঁদছ কেন?’
তিনি বললেন, ‘জাহান্নামের কথা স্মরণ করে কাঁদছি। আপনাদের কি কিয়ামতের দিন নিজেদের পরিবার-পরিজনের কথা মনে থাকবে?’
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনটি সময় এমন হবে, যখন কেউ কাউকে মনে করবে না। ১. আমল ওজনের সময়, যতক্ষণ না জানা যাবে, তার (নেক) আমলের পাল্লা ভারি হচ্ছে না হালকা হচ্ছে। ২. আমলনামা দেওয়ার সময়, যখন ঘোষণা করা হবে, এসো, আমলনামা পড়ে দেখ, যতক্ষণ না নিশ্চিত হবে যে, তার আমলনামা ডান হাতে আসছে, নাকি বাম হাতে, নাকি পিঠের পিছন দিকে! ৩. পুলসিরাতে। যখন তা জাহান্নামের সামনে বিছানো হবে।-সুনানে আবু দাউদ ২/৬৫৪
অবাধ্যচারীর সঙ্গ গ্রহণের পরিণাম
হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘একটি বাহিনী কাবা ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আসতে থাকবে। যখন তারা বাইদা নামক স্থানে পৌঁছবে তখন বাহিনীর প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি লোক মাটিতে ধ্বসে যাবে।’
উম্মুল মুমিনীন আরজ করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! তাদের মধ্যে তো এমন কিছু লোকও থাকবে, যারা শুধু পণ্য বিক্রির জন্য তাদের সাথে থাকবে। তেমনি আরো এমন লোকজন থাকবে, যারা ঐ বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত নয়? (অর্থাৎ যারা যোদ্ধা নয় এবং যাদের উদ্দেশ্য যুদ্ধ করা নয়) আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘প্রতিটি লোক মাটিতে ধ্বসে যাবে এরপর (কিয়ামতের দিন) প্রত্যেককে তার নিয়ত অনুযায়ী ওঠানো হবে।’-সহীহ বুখারী ১/২৮৪
নেয়ামতের শোকরগোযারী
হযরত আয়েশা রা. বলেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে এত দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে নামায পড়তেন যে, তার পা মুবারক ফুলে যেত। উম্মুল মুমিনীন আরজ করলেন, আল্লাহর রাসূল! আপনি কেন এমন করেন, আল্লাহ তাআলা তো আপনার আগের পরের সবকিছু মাফ করে দিয়েছেন।’
রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আমি কি আল্লাহর শোকর গোযার বান্দা হব না?’-সহীহ বুখারী ১/২৮৪
শয়তানের অনিষ্ট সম্পর্কে সতর্কতা
হযরত আয়েশা রা. বলেন, এক রাত্রে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নিকট থেকে বের হয়ে কোথাও (জান্নাতুল বাকী কবরস্থানে) গেলেন। এতে আমার মনে ক্ষোভ জাগল। (কারণ তাঁর মনে হয়েছিল, আল্লাহর রাসূল অন্য কোনো স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন) কিছুক্ষণ পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এসে যখন আমাকে এ অবস্থায় দেখতে পেলেন তখন বললেন, আয়েশা! তোমার কী হয়েছে? তোমার মনে কি ক্ষোভ জেগেছিল? (অন্য রেওয়ায়েতে আছে, উম্মুল মুমিনীন তাঁকে খুঁজতে খুঁজতে জান্নাতুল বাকীতে গেলেন। সেখানে তাঁকে দেখতে পেয়ে দ্রুত ঘরে ফিরে এলেন এবং হাঁপাতে লাগলেন। ইতিমধ্যে আল্লাহর রাসূল ঘরে ফিরলেন এবং তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে পেলেন।) আয়েশা রা. বললেন, আমার মতো (নারীর) কি আপনার মতো (স্বামীর) জন্য ক্ষোভ জাগা স্বাভাবিক নয়?
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমার শয়তানটি কি তোমাকে ধরে ফেলেছে?
আয়েশা রা. বললেন, আল্লাহর রাসূল! আমার সাথে কি শয়তান আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ।
আয়েশা রা. বললেন, প্রত্যেক মানুষের সাথেই কি শয়তান আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ।
আয়েশা রা. আবারো বললেন, আল্লাহর রাসূল! আপনার সাথেও কি আছে?
তিনি বললেন, হ্যাঁ। তবে আমার রব আমাকে সাহায্য করেছেন।-মুসনাদে আহমদ, হাদীস : ২৪৭২৬
ফায়েদা : স্ত্রীর মান-অভিমান, এমনকি ভুল ধারণাকেও সহজভাবে নেওয়ার এক আদর্শ উদাহরণ তেমনি ছোট ও অধীনের সরলতাপূর্ণ প্রশ্নের
শান্ত ও সঠিক উত্তর দেওয়ার এক অতুলনীয় দৃষ্টান্ত।
মাসনূন দুআর সূত্র
হযরত আয়েশা রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের পূর্বে এ দুআ বেশি বেশি পড়তেন-
سبحانك اللهم وبحمدك أستغفرك وأتوب إليك
উম্মুল মুমিনীন বলেন, আমি আরজ করলাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এখন আপনাকে এই কালিমাগুলো পড়তে দেখছি। (এর তাৎপর্য কী?)
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমার জন্য একটি লক্ষণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, যখন আমি তা উম্মতের মধ্যে দেখতে পাব তখন এই কালিমাগুলো পাঠ করব। এরপর তিনি সূরা নাসর শেষ পর্যন্ত তেলাওয়াত করলেন।-সহীহ মুসলিম ১/১৯২
পাক-পবিত্রতা
পবিত্রতা দ্বীনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ইসলামের অন্যতম প্রধান রুকন নামায পবিত্রতার উপর নির্ভরশীল। এ কারণে এ বিষয়ক বিধান জানা নারী-পুরুষ সকলের জন্য অতি জরুরি। সাহাবায়ে কেরাম অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এ বিষয়ক ইলম অর্জন করেছেন। কোনো দ্বিধা ও সংকোচ তাদের ইলম অর্জনের পথে বাধা হতে পারেনি। নারীরাও এ বিষয়ে পিছিয়ে ছিলেন না। অজ্ঞতায় নিমজ্জিত থাকার চেয়ে সংকোচ ত্যাগকেই তাঁরা শ্রেয় মনে করেছেন। এ ধরনের কিছু দৃষ্টান্ত এখানে দেখা যাবে।
ইসতিহাযাগ্রস্ত নারীর পবিত্রতা
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, উম্মে হাবীবা রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে ফতোয়া জানতে চাইলেন যে, আমার ঋতুকালের বাইরেও সর্বদা রক্ত আসে। (আমি কীভাবে পবিত্র হব এবং নামায আদায় করব?)
উত্তরে আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘এটি হল ইরক। অতএব তুমি গোসল করে নামায আদায় করবে।’
এরপর উম্মে হাবীবা রা. প্রত্যেক নামাযের সময় গোসল করতেন।-সহীহ মুসলিম ১/১৫১
কাপড়ের পবিত্রতা
হযরত আসমা রা. বলেন, এক নারী আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে জানতে চাইল, কাপড়ে হায়েযের রক্ত লাগলে তা কীভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
উত্তরে তিনি বললেন, প্রথমে হাত দ্বারা খুঁটে তুলে ফেলবে, তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলবে এরপর ঐ কাপড়ে নামায আদায় করতে পারবে।-সহীহ বুখারী ১/৪৫
মহিলাদের স্বপ্নদোষ হলে
উম্মুল মুমিনীন হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন, আবু তালহা রা.-এর স্ত্রী উম্মে সুলাইম রা. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট এসে আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আল্লাহ তাআলা সত্যের বিষয়ে নিঃসঙ্কোচ। (তো আমার জিজ্ঞাসা এই যে,) কোনো নারীর স্বপ্নদোষ হলে কি তার উপর গোসল ফরয হয়?’
উত্তরে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘হ্যাঁ। যদি সে পানি (ভেজা) দেখতে পায়।’-সহীহ বুখারী ১/৪২
নারীর জন্য ফরয গোসলে চুলের বেণী খোলার প্রয়োজন নেই
হযরত উম্মে সালামা রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি মাথার চুলে বেণী করে থাকি। ফরয গোসলের জন্য কি তা খুলতে হবে?’
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না। তুমি শুধু মাথায় তিনবার পানি ঢালবে তারপর পুরো শরীরে পানি ঢালবে এবং ভালোভাবে পবিত্র হবে। (অর্থাৎ বেনী খোলার প্রয়োজন নেই, চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছা ও গোটা শরীরে পানি প্রবাহিত করাই যথেষ্ট।)’-সহীহ মুসলিম ১/১৪৯
ইসতিহাযাগ্রস্ত নারীর নামায
হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত, ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ রা. রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করেছেন যে, ‘আমার ঋতুকালের বাইরেও স্রাব চালু থাকে। আমি কখনো পবিত্র হই না। এ অবস্থায় আমি কি নামায পড়া থেকে বিরত থাকব?’
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘না। এটা হল ইরক। ইতিপূর্বে তোমার যে কয়দিন স্রাব আসত ততদিন তুমি নামায পড়া বন্ধ রাখবে। তারপর গোসল করবে এবং নামায আদায় করবে।’-সহীহ বুখারী ১/৪৭
(চলবে ইনশাআল্লাহ)