এই নেয়ামতের কী শোকর আদায় করব : আমাদের জন্য হারামাইনে দুআ করা হচ্ছে
দুআ হল মুমিনের হাতিয়ার। তার দিন-রাতের অযীফা। আল্লাহর নেক বান্দারা নিজেদের দুআয় সকল মুমিন নারী-পুরুষকে শামিল করেন। মুসলিম উম্মাহর জন্য আলাদাভাবে দুআ করেন। কুরআন মজীদে হযরত ইবরাহীম আ.-এর দুআ উল্লেখ করা হয়েছে-
رَبِّ اجْعَلْنِي مُقِيمَ الصَّلَاةِ وَمِنْ ذُرِّيَّتِي رَبَّنَا وَتَقَبَّلْ دُعَاءِ * رَبَّنَا اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِلْمُؤْمِنِينَ يَوْمَ يَقُومُ الْحِسَابُ *
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে নামায কায়েমকারী বানিয়ে দিন এবং আমার আওলাদের মধ্যে হতেও (এমন লোক সৃষ্টি করুন, যারা নামায কায়েম করবে।) হে আমার প্রতিপালক! আমার দুআ কবুল করে নিন।
হে আমাদের প্রতিপালক! যেদিন হিসাব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতা ও সকল ঈমানদারকে ক্ষমা করুন।-সূরা ইবরাহীম (১৪) : ৪০-৪১
হযরত নূহ আ.-এর দুআও-
رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَنْ دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا تَبَارًا
হে আমার প্রতিপালক! আমাকে ক্ষমা করুন এবং আমার পিতামাতাকেও এবং তাকেও, যে ঈমানের সাথে আমার ঘরে প্রবেশ করেছে। আর সকল মুমিন পুরুষ ও নারীকে। আর যারা জালেম তাদের ধ্বংসই বৃদ্ধি করুন।-সূরা নূহ (৭১) : ২৮
আর ফেরেশতাদের এই দুআও-
رَبَّنَا وَسِعْتَ كُلَّ شَيْءٍ رَحْمَةً وَعِلْمًا فَاغْفِرْ لِلَّذِينَ تَابُوا وَاتَّبَعُوا سَبِيلَكَ وَقِهِمْ عَذَابَ الْجَحِيمِ * رَبَّنَا وَأَدْخِلْهُمْ جَنَّاتِ عَدْنٍ الَّتِي وَعَدْتَهُمْ وَمَنْ صَلَحَ مِنْ آَبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ إِنَّكَ أَنْتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ * وَقِهِمُ السَّيِّئَاتِ وَمَنْ تَقِ السَّيِّئَاتِ يَوْمَئِذٍ فَقَدْ رَحِمْتَهُ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ *
হে আমাদের প্রতিপালক! আপনার রহমত ও ইলম সমস্ত কিছু জুড়ে ব্যাপ্ত। সুতরাং যারা তাওবা করেছে ও আপনার পথের অনুসারী হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করে দিন এবং তাদেরকে জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করুন।
হে আমাদের প্রতিপালক! তাদেরকে দাখিল করুন স্থায়ী জান্নাতে, যার ওয়াদা আপনি তাদের সাথে করেছেন এবং তাদের পিতামাতা, স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে যারা নেক লোক তাদেরকেও, নিশ্চয়ই কেবল আপনারই সত্ত্বা পরিপূর্ণ ক্ষমতার মালিক, পরিপূর্ণ হেকমতেরও মালিক।
তাদেরকে সব রকম মন্দ বিষয় থেকে রক্ষা করুন। সেদিন আপনি যাকে অকল্যাণ থেকে রক্ষা করবেন তার প্রতি আপনি প্রভূত দয়া করলেন। আর
এটাই তো মহাসাফল্য। সূরা গাফির (৪০) : ৭-৯
আকাবিরে সাহাবার অনুসারীদের গুণাবলির মধ্যে বলা হয়েছে, তারা তাদের পূর্ববর্তী মুসলিম ভাইদের জন্য এই দুআ করতেন-
رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالْإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًّا لِلَّذِينَ آَمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَءُوفٌ رَحِيمٌ
হে আমাদের প্রতিপালক! ক্ষমা করুন আমাদেরকে এবং আমাদের সেই ভাইদেরকেও, যারা আমাদের আগে ঈমান এনেছে এবং আমাদের অন্তরে ঈমানদারদের প্রতি কোনো হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না। হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি অতি মমতাবান, পরম দয়ালু।-সূরা হাশর (৬৯) : ১০
প্রত্যেক নামাযে তাশাহহুদের মধ্যে আমরা বলি-
السلام علينا وعلى عباد الله الصالحين
আমাদের উপর এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক।
এভাবে মুসলমান ভাইদের জন্য দুআ করার মধ্যে এক তো ঈমানী ভাতৃত্বের হক আদায় হয়, দ্বিতীয়ত এর মাধ্যমে উম্মতের ঐক্য এবং মধ্যে ঈমান ও তাওহীদের ভিত্তিতে মুসলমানদের একতা থাকার শিক্ষা জীবন্ত হয়। তৃতীয়ত এর মাধ্যমে ফেরেশতাদের দুআ পাওয়া যায়। তাঁরা বলেন-
آمين، ولك مثل ذلك
আল্লাহর নেক বান্দারা আমাদেরকে তাদের নেক দুআর মধ্যে স্মরণ করেন। তাই আমাদের উপরও এই দায়িত্ব বর্তায় যে, আমরাও তাঁদের জন্য দুআ করব। উল্লেখিত দুআগুলোও আমরা নিজেদের আমল-অযীফার মধ্যে শামিল করে নিব। কখনো মনে চাইলে নিম্নোক্ত শব্দেও দুআ করতে পারি।
اللهم إني أسألك بحق السائلين، فإن للسائل عليك لحقا أيما عبد أو أمة من أهل البر والبحر تقبلت دعوتهم واستجبت دعاءهم أن تشركنا في صالح ما يدعونك وأن تشركهم في صالح ما تدعوك وأن تعافينا وإياهم وأن تقبل منا ومنهم وأن تجاوز عنا وعنهم فإن آمنا بما أنزلت واتبعنا الرسول فاكتبنا مع الشاهدين.
আমাদের দ্বিতীয় কর্তব্য, আমরা মুহাসাবার মাধ্যমে নিজেদের ইছলাহের চেষ্টা করতে থাকব। এমন যেন না হয় যে, আল্লাহর নেক বান্দারা আমাদের জন্য দুআ করবে আর আমরা গাফলতে ডুবে থাকব। অন্যরা তো আমাদের জন্য কল্যাণ প্রার্থনা করছেন আর আমাদের মানসিকতা এমন হবে যে, আল্লাহ তাআলার রহমত ও নেয়ামতের কোনো প্রয়োজন আমাদের নেই। নাউযুবিল্লাহ।
তৃতীয় ও বড় কর্তব্য হল, আমরা এমন কোনো গুনাহ করব না, যাতে তাদের দুআর ফল লাভ অনিশ্চিত হয়ে যায়। আল্লাহর বান্দারা দুআ করেন মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীর জন্য। আর অনেক গুনাহ এমন আছে, যেগুলোর কারণে যদিও মানুষ কাফের হয় না। কিন্তু মুমিন ও মুমিনার মতো সম্মানিত উপাধির যোগ্যতা হারিয়ে ফেলে। যেমন মিথ্যা বলা, প্রতারণা করা, সুদ খাওয়া, ঘুষ খাওয়া, নামায রোযা, যাকাত ও হজ্ব সম্পর্কে উদাসীনতা, অশ্লীল কাজে জড়িয়ে পড়া, কারো জান-মাল, ইজ্জত-আব্রুর উপর জুলুম করা ইত্যাদি। তাই তাদের দুআর ফল লাভের জন্য নিজের এতটুকু ইছলাহ তো আবশ্যক, যাতে মুমিন ও মুমিনা উপাধিতে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্যতা আমরা হারিয়ে না ফেলি।
আমার জীবনের মূলধন হল আমার মমতাময়ী আম্মা, শ্রদ্ধেয় আববা, বংশের অন্যান্য মুরববী, আমার আসাতিযায়ে কেরাম, বন্ধু-বান্ধব ও তালিবে ইলম ভাইদের দুআ। মারকাযুদ দাওয়াও বেঁচে আছে বুযুর্গদের ও বন্ধু-বান্ধবের দুআর কল্যাণে। আল্লাহর রহমতের জায়গা ও সময়গুলোতে জানি না কত ভাই আমাদের জন্য দুআ করেন। আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে যথাযোগ্য
বিনিময় দান করুন।
হজ্বের সময় আরাফা, মুযদালিফা, মিনা, মসজিদে হারামে ও হারামে নববীতেও আল্লাহর নেক বান্দারা অনুগ্রহ করে নিজেদের নেক দুআয় আমাদেরকে শামিল করতে থাকেন। কখনো আমাদেরকে জানান, কখনো জানান না। আল্লাহর যে বান্দা পৃথিবীর কোনো প্রান্তে আমাদের জন্য, উম্মতের কোনো ব্যক্তির জন্য, পুরো উম্মতের জন্য, আমাদের সন্তানদের জন্য, কোনো মুসলমানের সন্তানের জন্য, মারকাযুদ দাওয়াহর জন্য, যে কোনো দ্বীনী মারকায বা প্রতিষ্ঠানের জন্য, দ্বীনের খাদেমদের জন্য দুআ করছেন, আমি অন্তরের অন্তস্তল থেকে সবার শোকর আদায় করছি এবং প্রত্যেকের জন্য দুআ করছি, আল্লাহ তাআলা তাদের সবাইকে যথাযোগ্য
বিনিময় দান করুন, তাদেরকে সুস্থতার সথে দীর্ঘ হায়াতে তাইয়েবা নসীব করুন, দ্বীন-দুনিয়ার সকল প্রকার কল্যাণ দান করুন, সব রকম অকল্যাণ থেকে রক্ষা করুন, তাদের সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার দায়িত্ব আল্লাহ তাআলা নিজেই নিয়ে নিন। তাদের সকল উদ্দেশ্য কবুল করুন এবং সব ধরনের নেক হাজত পূরণ করে দিন। আমীন।
কিছুদিন আগে হযরত মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ দামাত বারাকাতুহুম সাধারণ নিয়মের বাইরে হারাম শরীফ থেকে ফোন করে বললেন, আমার এ সংবাদ পাঠকদের নিকট পৌঁছিয়ে দিন, আমি (অন্যান্য সময়ের দুআর সাথে সাথে) এই মুহূর্তে তাওয়াফের মধ্যে এবং তাওয়াফের পরে পুষ্প ও আলকাউসারের জন্য অনেক দুআ করেছি। উভয় পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য, সম্পাদক, লেখক, ব্যবস্থাপক, পাঠক, শুভানুধ্যায়ী ও সহযোগীদের প্রত্যেকের কবূলিয়ত ও মাকবূলিয়ত, জীবনের সুখ-শান্তি, হালাল রিযিকের প্রশস্ততা, মৃত্যুর সহজতা, কবরের শান্তি, আখেরাতের কামিয়াবির জন্য অনেক অনেক দুআ করেছি। পুষ্প ও আলকাউসার এবং এর সাথে সংশ্লিষ্টদেরকে শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, সুন্নতের যিন্দা ও আল্লাহর কালিমাকে সমুন্নত করার খেদমতের জন্য কবুল করুন।
আরো অনেক দুআ করছি। আমার আশা, আল্লাহ তাআলা সব দুআ কবুল করবেন; বরং কবুল করে নিয়েছেন।’
আমি জানি না, কোন ভাষায় আল্লাহ তাআলার নিকট এই নেয়ামতের শোকর করব। শুধু এতটুকুই বলতে পারি-
اللهم لا أحصي ثناء عليك أنت كما أثنيت على نفسك، اللهم لك الحمد كله ولك الشكر كله، اللهم لك الحمد حتى ترضى ولك الحمد بعد أن ترضى اللهم لك الحمد كما تحبه وترضاه
আর এই দুআ করছি, হে আল্লাহ! আপনিই তো আপনার নেক বান্দাদের অন্তরে এই কথা ঢেলে দিয়েছেন যে, তারা যেন আমাদের জন্য দুআ করেন। হে আল্লাহ! আপনিই আমাদেরকে এই দুআগুলোর মর্যাদা রক্ষা করার তাওফীক দান করুন। আমাদেরকে ইছলাহ করুন এবং আমাদেরকে কবুল করুন। আমীন।
পুষ্পের পাঠকদের জন্য আরেকটি বার্তা হল, বর্তমানে যদিও পুষ্পের প্রকাশনা সাময়িকভাবে স্থগিত তবে পুষ্পসমগ্র ও দ্বিতীয় প্রকাশনার বিশটি সংখ্যা থেকে উপকৃত হওয়া অব্যাহত রাখলে পুষ্প বন্ধ নয়, চালুই আছে।
দুআ তো তিনি প্রত্যেক দ্বীনী প্রতিষ্ঠান, প্রত্যেক দ্বীনী কাজ, প্রত্যেক মুসলিম নর-পুরষ ও মুসলিম নারীর জন্যই করেন। তবে আজকে বিশেষভাবে পুষ্প ও আলকাউসারের কথা উল্লেখ করেছেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এবং সকল মুসলিম নর-নারীকে ঈমান, আমানত ও আমন নসীব করুন এবং সকলকে দ্বীনের সাচ্চা খাদেমদের কাতারে শামিল করুন। আমীন ইয়া রাববাল আলামীন।
বান্দা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক
২ মুহাররম ১৪৩৩ হিজরী