ঈদুল আযহা : আমাদের ঈদ, ওদের ...
ঈদ মুসলমানের জাতীয় উৎসব। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন-
إن لكل قوم عيدا، وهذا عيدنا
‘অর্থাৎ সকল জাতির নিজস্ব উৎসব আছে, ঈদ হল আমাদের উৎসব।’ হাদীসের এই বাণী গভীর ব্যঞ্জনাপূর্ণ। এখানে যে আদর্শিক স্বাতন্ত্র্যবোধের শিক্ষা আছে তা ছাড়া মুসলিম উম্মাহর মর্যাদাপূর্ণ অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।
বর্তমান মুসলিম-সমাজে একদিকে আছে আদর্শের প্রশ্নে ব্যাপক শৈথিল্য ও আপোষকামিতা, অন্যদিকে জাহেলী বিভেদ-বিভাজনের জন্য চরম হিংস্রতা ও অসহিষ্ণুতা। এ কারণে মুসলিম উম্মাহ আজ শতধা বিভক্ত। ভাষা ও অঞ্চলের বিভাজন, বর্ণ ও শ্রেণীর বিভাজন, এমনকি রাজনৈতিক দল ও মতের বিভাজনও মুসলিম-সমাজে এত প্রকট যে, এসব কারণে অন্যের সম্পদ ও সম্মান লুণ্ঠন এবং রক্তপাত ও প্রাণহানী খুবই সাধারণ ব্যাপার। এই শ্রেণী-পরিচয়ই এখন ন্যায়-অন্যায় এবং শত্রুতা-মিত্রতার প্রধান মাপকাঠি। অথচ ইসলাম একে চিহ্নিত করেছে জাহেলিয়াত ও অন্ধকার বলে।
পক্ষান্তরে দ্বীন ও ঈমান এবং বিশ্বাস ও আদর্শের ক্ষেত্রে এরাই এত ‘উদার’ যে, তা বিসর্জন দিতেও তাদের কোথাও কোনো টান পড়ে না। আর এখন তো মুসলিমসমাজে এমন একটি শ্রেণীও তৈরি হয়ে গেছে, যারা পৌত্তলিকতার অন্ধকারকেই আলো বলে গ্রহণ করতে এবং পৌত্তলিক সম্প্রদায়কেই প্রকৃত মিত্র বলে ভাবতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে। (নাউযুবিল্লাহ।) বলাবাহুল্য, এই ধর্মহীনতার সুযোগ অন্তত ইসলামে নেই।
ইসলাম সাম্য ও শান্তির ধর্ম। সকল অন্যায় বিভাজন ও দলবাজির চেতনাকে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছে। কুরআন বলে, মানুষের ভাষা ও বর্ণের যে বৈচিত্র এবং শ্রেণী ও পেশার যে ভিন্নতা তা আল্লাহরই সৃষ্টি। এটা আল্লাহর সৃজনক্ষমতার জীবন্ত নিদর্শন এবং তাঁর শক্তি ও প্রজ্ঞার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর শৃঙ্খলা ও জীবনের চাকাকে সচল রাখার জন্যই মানুষকে বহু শ্রেণী ও পেশায় বিভক্ত করা হয়েছে। এটা কোনো অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িকতার উপাদান নয়, ন্যায়-অন্যায়ের মাপকাঠি তো নয়ই।
আল্লাহর কাছে মানবের মর্যাদা তার এই সকল বৈশিষ্ট্যের কারণে নয়। মানবের মর্যাদা আল্লাহর কাছে তার কর্মের ভিত্তিতে। ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই আল্লাহর কাছে সবচেয়ে মর্যাদাবান, যে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে মুত্তাকী।’
‘আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘোষণা করেছেন-
إن الله قد أذهب عنكم عبية الجاهلية وفخرها بالأباء : مومن تقي وفاجر شقي، أنتم بنو آدم وآدم من تراب.
আল্লাহ তাআলা নির্মূল করে দিয়েছেন তোমাদের মধ্যকার মূর্খতার অভিমান ও বংশের গৌরব। (এখন মানুষ শুধু দুই ভাগে বিভক্ত :) মুত্তাকি ঈমানদার ও দুর্ভাগা বদকার। তোমরা সকলেই আদমের সন্তান আর আদম সৃজিত মাটি থেকে।’
তো মানুষের মূল পরিচয় দুটি : ঈমানদার ও বে-ঈমান। মানবসম্প্রদায়ও দুই জাতিতে বিভক্ত : মুসলিম ও কাফির। কোনো মুসলিম যেমন ভাষা ও বর্ণ এবং পেশা ও রাজনীতির ভিন্নতার কারণে কোনো মুসলিমের পর হতে পারে না তেমনি কোনো কাফির শুধু ভাষা ও বর্ণ কিংবা অঞ্চলগত অভিন্নতার কারণে মুসলমানের স্বজাতি হতে পারে না।
মানবজাতির এটিই হচ্ছে মূল পার্থক্য, যা চিরন্তন ও চিরস্থায়ী। প্রকৃতির বিধান ও জীবন যাপনের নীতি দুক্ষেত্রেই তা অটল ও অলঙ্ঘনীয়। প্রকৃতি ও মানবের স্রষ্টা আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেন-
وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ ! إِلَّا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الْجِنَّةِ وَالنَّاسِ أَجْمَعِينَ
‘তোমার প্রতিপালক ইচ্ছা করলে সকল মানুষকে এক জাতি করতে পারতেন, কিন্তু তারা মতভেদ করতেই থাকবে। তবে তারা নয়, যাদেরকে তোমার প্রতিপালক দয়া করেছেন। আর তিনি এজন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। ‘আমি জিন্ন ও মানুষ উভয়ের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করবই।’ তোমার প্রতিপালকের এই কথা পূর্ণ হবেই।-সূরা হুদ (১১) : ১১৮-১১৯
এ হচ্ছে প্রকৃতির বিধান, প্রকৃতির স্রষ্টার অমোঘ ঘোষণা।
অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
لا اِكْرَاهَ فِىْ الدِّيْنِ، قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيْءِ، فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوْتِ ...
‘দ্বীনের বিষয়ে জবরদস্তি নেই। সুপথ ও ভ্রান্তি সুস্পষ্টরূপে পৃথক হয়ে গিয়েছে। এখন যে তাগুতকে অস্বীকার করছে ও আল্লাহর প্রতি ঈমান রাখছে সে তো ধারণ করেছে এমন এক মজবুত হাতল, যা ভেঙ্গে যাওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। আল্লাহ সব শোনেন, সব জানেন।
‘যারা ঈমান আনে আল্লাহ তাদের অভিভাবক। তিনি তাদেরকে বের করে আনেন অন্ধকার থেকে আলোতে। আর যারা কুফর করে তাগুত তাদের অভিভাবক। যারা তাদেরকে নিয়ে যায় আলো থেকে অন্ধকারে। এরাই হচ্ছে আগুনের অধিবাসী, এরাই সেখানে চিরকাল থাকবে।’-সূরা বাকারা (২) : ২৫৬-২৫৭
এ হচ্ছে শরীয়তের বিধান। সুতরাং জবরদস্তি করে কাউকে মুমিন বানানোর অবকাশ নেই।
সুতরাং ইসলাম ও কুফরের এই পার্থক্য চিরন্তন। মানুষের সাধ্য নেই এই পার্থক্য নির্মূল করার এবং অবকাশও নেই।
মুমিনের অভিভাবক স্বয়ং আল্লাহ। আর মুমিনের স্বজন ও স্বজাতি আল্লাহর রাসূল, সাহাবা-তাবেয়ীন এবং সকল যুগের, সকল ভাষার মুমিন-মুসলমান। পক্ষান্তরে কাফিরের অভিভাবক তাগূত ও শয়তান। আর তার স্বজন ও স্বজাতি সকল যুগের কাফের-সর্দার, মুশরিক-মুলহিদ-মোনাফিক শ্রেণী। ইসলাম সকল অন্যায় ভেদাভেদকে বিলুপ্ত করেছে, কিন্তু এই আদশির্ক স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয় স্বকীয়তা রক্ষার সর্বোচ্চ আদেশ করেছে।
কুরআন মজীদের অনেক আয়াতে আল্লাহ তাআলা এই বিধান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় দান করেছেন, (তরজমা) ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়। যে এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (অনিষ্ট) থেকে আত্মরক্ষার জন্য যদি কোনো পন্থা অবলম্বন করা হয় সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তোমাদের নিজের সম্পর্কে সাবধান করছেন। আর তাঁরই দিকে (সকলকে) ফিরে যেতে হবে।
‘(হে রাসূল!) বলে দাও, তোমাদের অন্তরে যা কিছু আছে, তোমরা তা গোপন রাখ বা প্রকাশ কর, আল্লাহ তা অবগত আছেন। তিনি জানেন যা কিছু আকাশমন্ডলে ও যমীনে আছে। আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’-সূরা আলে ইমরান (৩) : ২৮-২৯
আরো দেখুন : সূরা নিসা (৪ : ১৩৯, ১৪৪); সূরা মায়েদা (৫ : ৫১, ৫৭, ৮১); সূরা তাওবা (৯ : ৩৩); সূরা মুজাদালা (৫৮ : ২২) ও সুরা মুমতাহিনা (৬০ : ১)
অন্তরঙ্গতার শক্তিশালী প্রকাশ সাদৃশ্যে। এ কারণে অমুসলিমের সাদৃশ্য গ্রহণ মুসলমানের জন্য পরিষ্কার ভাষায় নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এত অধিক হাদীসে তা নিষেধ করা হয়েছে যে, ঐ সকল হাদীস ও সুন্নাহ সংকলন করা হলে একটি আলাদা পুস্তিকা হবে।
মদীনায় মুসলমানদের প্রতিবেশী সম্প্রদায় ছিল ইয়াহুদ। তাদেরকে বলা হয়েছে ‘আহলে কিতাব’। কিন্তু আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রকার উদারতা ও কল্যাণকামিতা সত্ত্বেও সুন্নাহ ও সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন এবং অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে মুসলমানদেরকেও তা রক্ষা করার আদেশ দিয়েছেন। ইবাদত-বন্দেগী থেকে শুরু করে লেবাস-পোশাক, বেশ-ভূষা, পর্ব-উৎসব, আইন-বিচার, দাম্পত্য ও সামাজিকতা ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র্য রক্ষার বিশেষ বিধান দান করেছেন এবং তা প্রয়োগ করেছেন।
এক হাদীসে তো বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য গ্রহণ করে সে তাদেরই অন্তর্ভুক্ত।’
من تشبه بقوم فهو منهم، رواه أبو داود بسنده عن ابن عمر مرفوعا، وقال ابن تيمية : وهذا إسناد جيد.
তো ইসলামে ‘আপন’-‘পরে’র যে পরিষ্কার ধারণা এবং স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা রক্ষার যে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সেটিই হচ্ছে এ নিবন্ধের শুরুতে উল্লেখিত হাদীসের ভাব ও ব্যঞ্জনা। এ হাদীস যেমন নির্দেশ দেয় ইসলামের ঈদকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার সাথে গ্রহণ করার তেমনি আহবান জানায় অমুসলিমদের পর্ব-উৎসবকে সর্বোতভাবে বর্জন করার।
আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ জাহেলী যুগের পর্ব-উৎসবকে এমনভাবে বর্জন করেছিলেন যে, আজ মদীনা মুনাওয়ারায় সেসবের কোনো নাম-নিশানাও নেই। হযরত আনাস রা. বলেন, ‘আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনা এলেন তখন মদীনাবাসীর নিজস্ব দুটি উৎসবের দিবস ছিল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘আল্লাহ তাআলা তোমাদেরকে এই দুই দিনের পরিবর্তে উত্তম দুটি দিন দান করেছেন : ঈদুল ফিতরের দিন ও ঈদুল আযহার দিন।’
আজ মদীনাতুর রাসূরে শুধু ‘উত্তম দুই দিবসই’ আছে, জাহেলী দুই দিবসের কোথাও কোনো চিহ্ন নেই।
ইসলাম যেমন বিধর্মীদের প্রতি ক্ষমা ও সহিষ্ণুতা এবং উদারতা ও কল্যাণকামিতার সর্বোচ্চ উদাহরণ তেমনি স্বকীয়তা ও মূল্যবোধ এবং ন্যায় ও আদর্শের ক্ষেত্রে আপোষহীনতারও ইস্পাতকঠিন দৃষ্টান্ত। তাই চারপাশে উচ্চারিত উদারতার ফাঁকা বুলিতে একজন মুসলিম কখনো প্রতারিত হতে পারে না। প্রকৃতপক্ষে এসব আহবান উদারতার নয় আদর্শত্যাগের আহবান।
একথাও একজন মুসলিমের স্মরণ রাখা দরকার যে, আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণা ও ক্রোধের বিষয় হচ্ছে মুসলিমসমাজে জাহেলিয়াতের প্রচার। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-
أبغض الناس إلى الله تعالى ثلاثة : ملحد في الحرم، مبتغ في الإسلام سنة الجاهلية، ومطل دم امرئ بغير حق ليريق دمه
অর্থাৎ তিন ব্যক্তি আল্লাহর কাছে সর্বাধিক ঘৃণিত : হরমের সিমানায় পাপাচার সংঘটনকারী, ইসলামে জাহেলী প্রথার প্রসার দানকারী ও অন্যায় রক্তপাতকারী।-সহীহ মুসলিম
তো আল্লাহ যাকে ঈমানের দৌলত দান করেছেন এবং মুসলিমসমাজের একজন গর্বিত সদস্য হওয়ার সৌভাগ্য দান করেছেন তার পক্ষে তো কোনোভাবেই সম্ভব নয় আদর্শের বিষয়ে হীনম্মন্যতার শিকার হওয়া এবং পৌত্তলিক সমাজ ও সম্প্রদায়ের সাথে একাত্মতা পোষণ করা।
বর্তমান যুগের ‘ফিকরী ইরতিদাদ’ তথা চিন্তাগত ধর্মত্যাগের যে প্রবণতা ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করছে তা থেকে আত্মরক্ষার একমাত্র উপায় মজবুত ঈমান ও সহীহ ইলম। সাধারণ মুসলমানদের মাঝেও দ্বীনী ইলমের প্রচার ও ঈমানী দাওয়াতের মেহনত ছাড়া এই সর্বগ্রাসী ফিতনা মোকাবিলা করার আর কোনো উপায় নেই। আসুন এই ঈদের ইজতিমায় আমরা একমাত্র ইসলামকেই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার এবং ইলম ও দাওয়াতের পথে নিজেকে উৎসর্গ করার শপথ গ্রহণ করি। আল্লাহ রাববুল আলামীন আমাদেরকে তাওফীক দান করুন। আমীন।