শি র শ্ ছে দ : শিক্ষা গ্রহণ ও সংযমের উপায় হোক
অক্টোবরের শুরুতে সৌদী আরবে একটি শিরশ্ছেদের ঘটনা বাংলাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। সৌদী আরবে একজন মিসরীয়কে হত্যার বিচার শেষে আট বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। জানা গেছে, ওই ঘটনায় দন্ডিত হওয়ায় দুই সৌদী নাগরিককেও শিরশ্ছেদ করা হয়েছে।
গণমাধ্যমগুলোর সূত্রে জানা গেছে, কয়েক বছর আগের এ ঘটনায় নিয়মতান্ত্রিক বিচার শেষে অপরাধীদের শিরশ্ছেদের রায় দেওয়া হয়। এরপর পুনঃশুনানির আবেদন, ক্ষমা প্রার্থনা ইত্যাদির পর্ব শেষ হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রাণদন্ডের বিধান অক্ষুণ্ণ রাখা হয়। এর পরপরই কিছু মানবাধিকারবাদী সুশীল মিডিয়া ও সংগঠনের পক্ষ থেকে এ ঘটনাকে ‘বর্বরতা’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা শুরু হয়। একই সঙ্গে প্রাণদন্ডের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের লোকদের
হা-হুতাশ ও দুঃখ-বেদনার চিত্রগুলোর ব্যাপক প্রচার দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে ‘বর্বর বিচার ও পদ্ধতি’ তে আট বাংলাদেশির করুণ মৃত্যু হয়েছে বলে প্রতিষ্ঠিত করার জোরদার চেষ্টা চালানো হয়। ক্ষোভে-দুঃখে ক্ষেপিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয় গোটা দেশের গণমতকে। কিন্তু চেষ্টা অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া হতে দেখা যায়নি। এ ধরনের পদক্ষেপ বেদনাবহ হলেও দৃষ্টান্তমূলক। বিষয়টি নিয়ে সীমাতিরিক্ত বিষোদগার ও সম্মতিবাচক প্রতিক্রিয়ার মিশ্র অবস্থায় বিবেচনার জন্য কিছু বিষয় পেশ করা হল।
এক. হত্যাকান্ডের কুরআনী বিচার-নীতি হল প্রাণদন্ড বা মৃত্যুদন্ড। অর্থাৎ প্রাণের বদলে প্রাণ। আরবিতে সমান প্রতিদানকেই ‘কিসাস’ বলা হয়। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে-‘এবং তোমাদের জন্য কিসাসের মধ্যে রয়েছে জীবন।’
অপরদিকে এসব দন্ড দৃষ্টান্তমূলকভাবে জনসমক্ষে সংগঠনেও কুরআনে কারীমের অপর আয়াতে উৎসাহিত করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাসেও এভাবে প্রকাশ্যে দন্ড কার্যকর করার নজির রয়েছে। সেজন্য সৌদী আরবে সংঘটিত শিরশ্ছেদের ঘটনাটিকে ঢালাওভাবে ‘বর্বরতা’ কিংবা তীব্রক্ষোভের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করার আগে একটু চিন্তা করা উচিত। কথার সময় ভেবে দেখা দরকার-কথাটি কার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, বিচারকের ভুল রায়ের, আইনের প্রায়োগিক ত্রুটির, নাকি পবিত্র কুরআনের প্রাণদন্ড বিষয়ক বিচার-নীতির?
শিরশ্ছেদের শিকার আট বাংলাদেশী কেবল বাংলাদেশের ও বাংলাভাষার মানুষ হওয়ার কারণেই কি এ প্রাণদন্ডে এত ক্ষোভ? তারা নিচ্ছিদ্র বিচারে এবং দীর্ঘ শুনানিতে অব্যর্থভাবে হত্যাকারী প্রমাণিত হওয়ার পরও কি এ দন্ড নিয়ে ক্ষুব্ধতা ও উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া সমীচীন? এতে মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে, এতে বর্বরতা হয়েছে-সুশীল মিডিয়াগুলোতে এ জাতীয় অব্যাহত চিৎকারের কারণ কী? এ ঘটনায় হঠাৎ করে বাংলাদেশের সব মানুষই যেন বিপণ্ণ হয়ে যাচ্ছে-এমন একটি উত্তেজনাদুষ্ট প্রতিক্রিয়া ফাঁপিয়ে তোলার পেছনে উদ্দেশ্য কী? উদাহরণের জন্য পেশ করা যেতে পারে, এর আগে ঢাকা, নাটোরসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রকাশ্যে টিভি মিডিয়ার সামনে সাপের মতো পিটিয়ে পিটিয়ে মানুষকে হত্যা করা হয়নি কি? রাজনৈতিক বর্বরতা এবং পাশবিক তারুণ্যের শিকার হয়ে কি গত কয়েক বছরে বহু তরুণ-তরুণীর জীবন বিপণ্ণ হয়নি এদেশে? তাহলে সৌদী আরবের হত্যাকান্ডে জড়িত লোকজনের প্রাণদন্ডে (হোক তা শিরশ্ছেদের মাধ্যমে) এত বেশি মুষড়ে পড়া ক্ষুব্ধতায় ডুবে যেতে চায় কেন একশ্রেণীর সুশীল ও মিডিয়া? এ প্রতিক্রিয়ায় সমতা ও ভারসাম্যের লেশমাত্র নেই। তাই বলা যেতেই পারে, এটি নিঃসন্দেহে মতলবী ও চরমভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
দুই. শিরশ্ছেদের শিকার ব্যক্তিদের (যারা আমাদের দেশীয় ভাই) মা-বাবা ও পরিবারের সদস্যদের দুঃখ-বেদনা ও হা-হুতাশ যৌক্তিক। যে কোনো কারণেই হোক আপনজ হারালে মানুষের অসহনীয় কষ্ট হয়। কিন্তু তাদের কষ্টটাকে পরিকল্পিতভাবে সামনে এনে একটি গোষ্ঠি সৌদী আরবের প্রাণদন্ডের বিধানকেই ‘অমানবিক ও বর্বর’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছে। অথচ এ গৌষ্ঠিটিই যখন মুজিব হত্যার দন্ডিত আসামীদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে তখন পরম উল্লাসে তৃপ্তি প্রকাশ করেছে। আনন্দ মিছিলও হয়েছে। সৌদী প্রাণদন্ড বিরোধী মিডিয়াগুলো তখন উল্লাসের সঙ্গে ‘সেই’ প্রাণদন্ডের খবর প্রচার করেছে। একচক্ষু মানুষ নিজেরটা ষোল আনা দেখে, অপরেরটায় অন্ধ থাকে। অপর একটি গোষ্ঠিকে দেখা গেছে, শিরশ্ছেদের ঘটনায় মানবাধিকার বিনাশ হয়ে গেছে বলে মাতম করেছে। সৌদী বিচারালয়ের রায়ে আটজনের শিরশ্ছেদে মানবাধিকার বিনাশ হওয়ার বিষয়টি যারা বুঝতে পারলেন,
তারা কিন্তু পাকিস্তান-
আফগানিস্তানে মার্কিন ড্রোন হামলায় গত কয়েক বছরে লক্ষাধিক নারী-শিশুর কাতরে কাতরে, ধুঁকরে ধুঁকরে নিহত হওয়ার ঘটনায় মানবাধিকার বিনাশের কোনো গন্ধ পাননি। অন্তত প্রকাশ্যে সেটা দেখা যায়নি।
তিন. কেউ কেউ এ ঘটনার পর বলার চেষ্টা করেছেন, আট বাংলাদেশীর শিরশ্ছেদ হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের কোনো অনুরোধ রাখা হয়নি। এতে তো ক্ষোভ তৈরি হতেই পারে। মিডিয়া ও সুশীল নাগরিকরা প্রতিবাদে ফেটে পড়তেই পারেন। দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসার একটি বিষয় তো আছে।’ এ জাতীয় বক্তব্য পড়ে দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসায় সুশীল বুদ্ধিজীবী ও মতলবী মিডিয়াগুলোর আচরণে ধন্ধে পড়ে যেতে হয়। কারণ ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের গুলি ও নৃশংসতার সাক্ষর হয়ে যেখানে আঘাতে প্রায়ই সীমান্তে ভারতীয়দের হাতে বাংলাদেশী ভাইয়েরা নিহত হয় তখন এরা ভালবাসার জায়গা খুঁজে পায় না। সব দরদ এদের তখনই উথলে উঠে যখন ঘটনাটি ঘটে সৌদী আরব, কাতার, পাকিস্তান কিংবা ইরানে। তখন এরা সেখানে অসভ্যতা, বর্বরতা খুঁজে পায় এবং বিচারের রায়টি যার উপর বাস্তবায়িত হয় সে বাংলাদেশী হলে তখন তারা সীমাহীন দেশপ্রেমিক হয়ে যায়।
চার. এটা ঠিক যে, সৌদী আরবের বর্তমান প্রজন্মের শাসক ও অধিবাসীদের অনেক অনৈতিকতা ও চারিত্রিক স্খলন। কিসাস বা প্রাণ সংহারের শাস্তি প্রাণদন্ড-এটি কুরআনের বিধান। বিচারিক পদ্ধতিতে নিশ্চিতভাবে হত্যাকারী চিহ্নিত হলে তাকে প্রাণদন্ড দেওয়া (এমনকি প্রকাশ্যে) ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ দন্ডবিধি। এমনকি এমনও শোনা যায় যে, এ ধরনের প্রাণ সংহারের ঘটনার পর হত্যাকারী সৌদী নাগরিক কিংবা ‘প্রভাবশালী’ কোনো রাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ায় আদালত তাকে প্রাণদন্ড দেয়নি কিংবা আদালত প্রাণদন্ড দেওয়ার পর রাজা-বাদশাহরা তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন তাহলে সেটি হবে তাদের স্খলন ও অবিমৃশ্যকারিতা। তবে এ জাতীয় অবিমৃশ্যকারিতার সঙ্গে ইসলামের বিচার ও দন্ডব্যবস্থার সাযুজ্য খোঁজা কিছুতেই উচিত হবে না। শোনা যায়, বাংলাদেশের মতো গরীব দেশের অভিবাসীরা অনেক সময়ই সৌদী নিয়োগকর্তা বা কফীলদের অন্যায়-নির্যাতনের শিকার হন। বহু নারীশ্রমিক সেখানে গিয়ে অবর্ণনীয় নিপীড়নের শিকার হন। কিন্তু তারা বিচার পান না কিংবা সহজে নিষ্কৃতি পান না। এটা কি সেখানকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের অসহযোগিতার কারণে ঘটে, নাকি বিচারব্যবস্থার ত্রুটির কারণে-এটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এ পরিস্থিতিটি যেভাবেই যে ছিদ্রের কারণেই সৃষ্টি হোক-সেটি চূড়ান্ত অন্যায়। এ অন্যায় যাদের কারণে হচ্ছে এবং যাদের কারণে টিকে আছে, ইসলামের দৃষ্টিতে তাদের অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য।
আর ইসলামের দন্ডবিধি আপন-পর সবার ক্ষেত্রেই সমান। বিচারব্যবস্থায় কিছুটা ইসলাম আছে-এমন একটি দেশে এ ধরনের পক্ষপাত বাইরের বিশ্বকে এসব ঘটনা ভুলবার্তাই দিতে পারে। কিন্তু তারপরও এ কথা তো সত্য যে, কোনো একটি ঘটনায় পুরোপুরি ইসলামী আইন মেনে নিশ্চিত হয়ে দন্ড দিলে এবং তা কার্যকর হলে সেটি ন্যায়ানুগ ইসলামী আদালতের রায় হিসেবেই গণ্য হবে। সে হিসেবে শিরশ্ছেদের ঘটনাটিকে বাঁকা চোখে না দেখে শিক্ষা গ্রহণ ও সংযমের উপায় হিসেবে গ্রহণ করা উচিত। কোনো প্রবাসীই ভিনদেশে গিয়ে যেন আইন হাতে তুলে নেওয়া এবং ডাকাতি ও হত্যাকান্ডে যুক্ত হওয়ার চিন্তাও না করে-সরকারী ব্যবস্থাপনা ও গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকায় সে বিষয়টিতেই জোর দেওয়া উচিত।