লি বি য়া : ঈমানের সঙ্গে অবিচলতাই কাম্য
লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট মুয়াম্মার গাদ্দাফী নিহত হয়েছেন গত ২০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার। তার সঙ্গে তার এক ছেলে মুতাসিমকেও হত্যা করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী তার কিছু অনুসারীও সে সময় নিহত হন। ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও পরের দিনের সংবাদপত্রগুলোতে গাদ্দাফী নিহত হওয়ার বিবরণ সবিস্তার প্রচারিত হয়। এর পর থেকে এ বিষয়ক সংবাদের খুটিনাটি ও বিশ্লেষণ চার-পাঁচ দিন ধরেই প্রচার হচ্ছে।
সংবাদমাধ্যমগুলোর বর্ণনায় জানা যায়, গাদ্দাফী হত্যার পেছনে গাদ্দাফীবিরোধী জোটের সৈনিক এবং ন্যাটো সৈনিকদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। গাদ্দাফীবিরোধী লড়াই ও অনুসন্ধানের চূড়ান্ত মুহূর্তে ধরা পড়ার পর কোনো রকম অভিযোগ ও বিচার ছাড়াই তাকে হত্যা করার বিষয়টি নিয়ে এখন নানা দিক থেকে প্রশ্ন উঠছে। প্রথম দিকে তাকে কে কিভাবে হত্যা করেছে তার কৃতিত্ব নিতে এবং সেটা প্রচারে কে কতটা পারঙ্গমতা দেখিয়েছে সেটা জানাতে তৎপরতা দেখা গেলেও তিন-চার দিনের মাথায় এ বিষয়ে নতুন করে বিভ্রান্তি তৈরি করা হচ্ছে। একবার বলা হচ্ছে, বিদ্রোহী জোটের সৈনিকরাই তাকে হত্যা করেছে। আরেকবার বলা হচ্ছে, ন্যাটোর প্রশিক্ষিত সৈনিকরাই তাকে হত্যা করেছে। আবার বলা হচ্ছে, ন্যাটো সৈনিকরা ধরে তাকে হত্যার জন্য বিদ্রোহীদের হাতে ছেড়ে দিয়েছে; পরে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। এরই মধ্যে গাদ্দাফীবিরোধী অন্তবর্তী সরকারের প্রধান বলেছেন, গাদ্দাফীকে হত্যা করার কোনো ইচ্ছা তাদের ছিল না। মোটকথা, গাদ্দাফীকে হত্যার দায় এখন স্পষ্টভাবে কেউ নিতে চাচ্ছে না।
অভ্যুত্থান করে লিবিয়ার ক্ষমতায় আরোহণের পর দীর্ঘ চল্লিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন গাদ্দাফী। গত মাস আগে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কয়েকটি দেশের মতো লিবিয়াতেও সরকারবিরোধী বিক্ষোভ শুরু হয়। একপর্যায়ে গাদ্দাফী বিরোধীরা লড়াই ও প্রতিরোধে নেমে পড়ে। এর মধ্যেই বিরোধীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়,
বহিঃশক্তি ন্যাটো। ঘোষণা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়াসহ পশ্চিমা দেশগুলোর যুদ্ধজোট-ন্যাটো গাদ্দাফীবিরোধী অভ্যন্তরীণ লড়াইয়ে রসদ সরবরাহ করে। একপর্যায়ে নৌ-স্থল ও বিমান আক্রমণে তারা খোলাখুলি লিবিয়ার মাটিতে দখলদারের মতো নেমে পড়ে। ন্যাটোর আক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে রাজধানী ত্রিপোলি ছেড়ে গাদ্দাফী জন্মশহর সির্তে চলে যান। গত ২০ অক্টোবর সেখানেই তাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সির্তের অজ্ঞাত এক মরুভূমিতে জানাযা নামায শেষে তাকে দাফন করা হয়। এর আগে দাফন-সিদ্ধান্তের সমস্যায় ভঙ্গুর এক হিমাগারে রাখা গাদ্দাফীর লাশে পচন ধরেছিল। এখন বলা সম্ভব নয়। লিবিয়ার ক্ষমতায় কে কিভাবে আরোহন করে রাষ্ট্রটি চালাবে।
তবে পশ্চিমারা বিশ্ববাসীকে এটা ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছে যে, নিহত গাদ্দাফীর শবদেহের সঙ্গে যেমন চূড়ান্ত অবমাননাকর আচরণ করতে তারা কসুর করেনি, তেমনি তেলসম্পদে সমৃদ্ধ দেশ লিবিয়াকে লুটেপুটে খোকলা বানানোর উদ্যোগ নিতেও তারা কোনো লাজ-শরমের ধার ধারবে না। পৃথিবীর বড় দেশগুলোর বড় শাসকদের বড় মাপের বর্বরতার একটি চিত্র এখন লিবিয়ায় ফুটে ওঠেছে।
মুয়াম্মার গাদ্দাফীকে করুণভাবে হত্যা করা হয়েছে। তিনি তার শাসনামলে কেমন ছিলেন-আজ এ প্রশ্নটির উত্তর খুঁজলে দেখা যায়, অনেক সময়ই তিনি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ভূমিকা রেখেছেন। আবার ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর চেতনা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বহু বিতর্কিত পদক্ষেপও নিয়েছেন। তার সাহস ছিল, কিছু স্বেচ্ছাচারিতাও ছিল। তিনি মুসলিম ছিলেন, আবার বিভ্রান্তিও লালন করতেন। ক্ষমতার স্বাদ বিসর্জন দেওয়া নাকি পশ্চিমাদের কাছে দেশের সম্পদ নিয়ে আত্মসমর্পণ কোন বিষয়টা তাকে ক্ষমতা ত্যাগে বাঁধা দিয়েছে-এটি এ মুহূর্তে নিঃসংশয় হয়ে বলা মুশকিল। কিন্তু এ কথা বলতে কেউ দ্বিধা করবেন না যে, তার অনুপস্থিতিতে পশ্চিমারা এখন তেলসম্পদ লুট করতে শকূনের মতো লিবিয়ার আকাশ ছেয়ে ফেলছে। তাই তার জীবনকালের ভালোমন্দ, ভুল-ত্রুটির চেয়েও এখন বড় হয়ে ওঠেছে তাকে করুণভাবে হত্যা এবং লিবিয়ার ওপর পশ্চিমাদের লোভাতুর দৃষ্টির বিষয়টি।
পশ্চিমারা এ ধরনের বর্বরতা সব সময়ই করে থাকে। এ বর্বরতাই তাদের সম্পদ, ইমেজ ও বৈশিষ্ট্য। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে হলেও একই রকম কাজ তারা করেছে ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে,
পানামার নরিয়েগার সঙ্গে এবং এ্যাবোটাবাদে উসামা বিন লাদেনের সঙ্গে। নরিয়েগা অবশ্য এখনও বন্দিত্ব পার করছেন। পশ্চিমাদের আচরণই তাদের বর্বরতার শিকার প্রতিটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের প্রতি আমাদের সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য করে। স্বেচ্ছাচারিতা কিংবা সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতার লুকোচুরি নয়, এ পর্যায়ে আমরা আবারো স্মরণ করা ও স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার মনে করি যে, ঈমান-তাওয়াক্কুল ও জবাবদিহিতার সঙ্গে অবিচল থাকাই সব পর্যায়ের মুসলিম নেতাদের পথ।