তাওহীদের তালবিয়া : বাক্য ও ব্যঞ্জনা
তালবিয়ার সাথে কে না পরিচিত? হজ্বের মাসে মসজিদে মসজিদে হজ্বের অনুশীলন হয় এবং ফাযাইল ও মাসাইলের আলোচনা হয়। তালবিয়ার প্রসঙ্গ তখন অপরিহার্যভাবে আসে এবং আলোচক-শ্রোতা সবার কণ্ঠে তালবিয়া ধ্বনিত হয়। এ কারণে মুসলিম সমাজের ছোট-বড় সকলেই তালবিয়ার সাথে পরিচিত। আর আল্লাহ যাদের দান করেছেন হজ্বের সৌভাগ্য তাদের কথা তো বলাই বাহুল্য। তালবিয়ায় তাদের ইহরামের সূচনা; তালবিয়া তাদের হজ্বের সঙ্গীত।
এ হজ্ব-সঙ্গীত অতি প্রাচীন, যুগে যুগে তা ধ্বনিত হয়েছে আল্লাহর ঘরের মুসাফিরদের কণ্ঠে ও হৃদয়ে। এ মুসাফির দলের অগ্রভাগে আছেন মানবজাতির সর্বোত্তম অংশ, আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা-নবী ও রাসূলগণ। মাঝে আছেন সাহাবা-হাওয়ারিয়ীন এবং শুহাদা-সালেহীনের মোবারক জামাত আর শেষে আছে পাপী তাপী নিঃস্ব ভিখারীর দল। সবাই এক আল্লাহর বান্দা, সকলের কণ্ঠেই ধ্বনিত তালবিয়া-সঙ্গীত-‘লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক’।
আমাদের পরম সৌভাগ্য, আমরা আখেরী নবী হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত। তাঁর অনুসরণের মাধ্যমে আমরা অনুসারী সকল নবী ও রাসূলের। তাঁরই স্বর্ণসূত্রে আমরা যুক্ত নবী-রাসূলের সোনালী ধারার সাথে। আজ আমরা যে তালবিয়া পাঠ করি-আল্লাহ আমাদের কলব ও যবানের সকল মলিনতা দূর করে দিন-হুবহু এই বাক্যগুলো উচ্চারিত হয়েছিল আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পাক যবানে। বড় বড় সাহাবী তা গ্রহণ করেছেন ও বর্ণনা করেছেন।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর মোবারক যবান থেকে তালবিয়া শিখেছি। তিনি বলতেন-
لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ لَبَّيْكَ، إِنَّ الْحَمْدَ وَالنِّعْمَةَ لَكَ وَالْمُلْكَ، لا شَرِيْكَ لَكَ
-সহীহ বুখারী, হাদীস : ১৫৪০, ১৫৪৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১১৮৪; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯১৮
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা., হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. ও হযরত আনাস রা.ও এই তালবিয়া বর্ণনা করেছেন। (দেখুন ১. মুসনাদে আহমদ ১/৪১০; মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা ৮/২১১; সুনানে নাসায়ী, হাদীস : ৩৭৩২২; ২. সহীহ ইবনে খুযাইমা, হাদীস : ২৬২৬; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস : ১৮১৩; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৯২৯; ৩. আবু ইয়ালা-মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদীস : ৫৩৬৪)
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নিজের সঙ্গীদেরকে এই তালবিয়া শেখাতেন। দেখুন : মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবা,আসওয়াদ রাহ.-এর সূত্রে, হাদীস : ১৩৬৪২
তো এ তালবিয়া আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর তালবিয়া, সাহাবায়ে কেরামের তালবিয়া, তাবেয়ীন ও তাবে তাবেয়ীনের তালবিয়া এবং সকল যুগের নেককার-সালেহীনের তালবিয়া। এ সোনালী ইতিহাস হৃদয়ে ধারণ করে আল্লাহর ঘরের মুসাফির যখন তালবিয়া পাঠ করবেন তখন তার অবস্থাই হবে ভিন্ন-তার হৃদয় হবে প্রশান্ত, মস্তিষ্ক হবে আলোকিত এবং প্রাণ ও আত্মা হবে পরিতৃপ্ত। এটি এ মোবারক তালবিয়ার প্রথম গুণ।
দ্বিতীয় গুণ, তার অতুলনীয় ভাব ও ব্যঞ্জনা। আরবী এখানে অপ্রতিদ্বন্দী, তবে তা শুধু তার গঠন-সৌন্দর্যের কারণেই নয়,. প্রাণ-সৌন্দর্যের কারণেও। এই জ্যোতির্ময় বাক্যমালা ধারণ করেছে আকাশের আলো। তাই এখানে আরবীর ব্যঞ্জনা আজমীতে তুলে আনা শুধু কঠিন নয়, সুকঠিন। সম্ভবত অসম্ভব!
আমাদের তো যোগ্যতা নেই এই জ্যোতির্ময় বাক্যমালার ভাব ও ব্যঞ্জণা হৃদয়ে ধারণ করার। তবু শুধু ভিখারীর ‘অধিকারে’ এই বাক্য-প্রাসাদের চারদিকে আনাগোনা করতে পারি-যদি প্রাসাদের মালিকের দয়া হয়! যদি দান করেন কিছু ভাব, কিছু অনুভূতি, কিছু শিক্ষা, কিছু উপলব্ধি!
তালবিয়ার শব্দ ও বাক্য
তালবিয়ায় ‘লাববাইক’ শব্দটি চারবার আছে। এটি একাধারে ভক্তি ও ভালবাসা এবং আনুগত্য ও সমর্পণের ভাব ধারণ করে।
‘লা-শারীকা লাক’ শব্দটি আছে দুইবার। এ হচ্ছে সকল প্রকার শিরক ও শরীককে বর্জনের ঘোষণা। শরণ ও প্রার্থনা এবং আনুগত্য ও উপাসনা কোনো বিষয়েই আল্লাহর কোনো শরীক নেই। তিনি লা-শরীক।
আর তৃতীয় বাক্যটি অর্থাৎ ‘ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক’ হচ্ছে তাওহীদের এ’লান, তাওহীদের দলিল এবং আল্লাহর হামদ ও শোকর।
ভাব ও বক্তব্য
‘লাববাইকাল্লাহুম্মা লাববাইক’।
আমি হাজির! ইয়া আল্লাহ আমি হাজির!
এ যেন সেই আসমানী আহবানের জবাব, যা ইবরাহীম আ.-এর মাধ্যমে রাববুল আলামীন জগৎবাসীকে করেছেন। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বর্ণনা করেন-
وَإِذْ بَوَّأْنَا لِإِبْرَاهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَنْ لَا تُشْرِكْ بِي شَيْئًا وَطَهِّرْ بَيْتِيَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ وَأَذِّنْ فِي النَّاسِ بِالْحَجِّ يَأْتُوكَ رِجَالًا وَعَلَى كُلِّ ضَامِرٍ يَأْتِينَ مِنْ كُلِّ فَجٍّ عَمِيقٍ لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ فِي أَيَّامٍ مَعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ فَكُلُوا مِنْهَا وَأَطْعِمُوا الْبَائِسَ الْفَقِيرَ
আর সে সময়ের কথা ওদের স্মরণ করিয়ে দিন যখন ইবরাহীমকে আমি বাইতুল্লাহর স্থান নির্দেশ করেছিলাম এবং (নির্দেশ দিয়েছিলাম) আমার সাথে কাউকে শরীক করো না এবং তাওয়াফকারীদের জন্য এবং যারা (নামাযে) দাঁড়ায় ও রুকু-সিজদা করে তাদের জন্য আমার ঘর পবিত্র রেখো।
আর মানুষের সভায় তুমি হজ্বের ঘোষণা দাও; তখন তারা পায়ে হেঁটে, উটে চড়ে তোমার কাছে এসে উপস্থিত হবে, যে উটগুলো সুদূর পথ অতিক্রম করে এসে পৌঁছবে, যেন তারা তাদের কল্যাণ প্রত্যক্ষ করতে পারে ...। সূরা হজ্ব : (২২) : ২৬-২৮
আল্লাহর খলীল আল্লাহর আদেশ পালন করেছিলেন এবং দূর দূরান্ত থেকে বাইতুল্লাহ অভিমুখে আল্লাহর বান্দাদের সফর শুরু হয়েছিল। এরপর কত কাল অতিবাহিত হল। আল্লাহর ঘরের দিকে এ সফর কখনো বন্ধ হয়নি। পরিশেষে এল আখেরী নবীর সোনালী যুগ। তখন উম্মতে মুহাম্মাদীকেও করা হল এই আলোর মিছিলে শামিল হওয়ার আদেশ। আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلًا وَمَنْ كَفَرَ فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنِ الْعَالَمِينَ
মানুষের উপর ফরয, আল্লাহর জন্য এ ঘরের হজ্ব করা, যারা সে পর্যন্ত পৌঁছার সামর্থ্য রাখে। আর যে অস্বীকার করে (তার মনে রাখা উচিত) আল্লাহ বিশ্ববাসীর মুখাপেক্ষী নন।-সূরা আলে ইমরান (৩) : ৯৭
বাইতুল্লাহর সফরে বান্দা নতুন করে লাভ করে তার আত্মপরিচয় এবং নবায়ণ করে রবের সাথে তার আবদিয়তের সম্পর্ক।
তো ‘লাববাইকাল্লাহুম্মা লাববাইক’ হচ্ছে আল্লাহর আনুগত্যের ঘোষণা এবং আল্লাহর সকল বিধানের প্রতি আনুগত্যের শপথ।
ইহরামের হালতে যে বান্দা আল্লাহর সাথে তার আনুগত্যের অঙ্গীকার নবায়ন করেছে তার পক্ষে কি সম্ভব স্বেচ্ছায়, স্বজ্ঞানে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করা?
সালাত ও যাকাতের বিষয়ে উদাসীন হওয়া?
অন্যের সম্পদ অবৈধ পন্থায় গ্রাস করা? সুদ-ঘুষ এবং জুয়া ও প্রতারণায় লিপ্ত হওয়া?
যিনি তার ‘লাববাইকা’য় সত্যবাদী তার পক্ষে কি সম্ভব বেপর্দা ও বেহায়াপনাকে প্রগতির উপায় এবং পর্দা ও পবিত্রতাকে উন্নতির অন্তরায় মনে করা?
লাববাইকায় সত্যবাদী হলে কখনো কি সম্ভব ব্যক্তিজীবনে ‘ধার্মিক’ ও সমাজজীবনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ হওয়া?
সত্যবাদিতা, আমানতদারী, দয়া ও সহনশীলতাকে দুর্বলের গুণ আর মিথ্যাচার, প্রতারণা, জুলুম ও অবিচারকে ক্ষমতার বৈশিষ্ট্য মনে করা? সম্ভব নয়, কস্মিনকালেও সম্ভব নয়।
তো লাববাইকার শিক্ষা হচ্ছে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর বিধানের শর্তহীন অনুগত্য এবং সকল অবস্থায় আল্লাহর ফয়সালায় পূর্ণ সমর্পণ। তালবিয়ার শিক্ষা, জীবন ও জীবিকার শত ব্যস্ততারও মাঝে আল্লাহকে স্মরণ রাখা এবং পার্থিব জীবনের
লাভ-লোকসানকে তুচ্ছ করে দাওয়াত, তালীম ও জিহাদের পথে নিজেকে উৎসর্গ করা।
এই আনুগত্য ও সমর্পণ মূর্ত হয়েছিল হজ্বের ঘোষক হযরত ইবরাহীম আ.-এর কথা ও কাজে এবং এই ত্যাগ ও নিবেদনেই উজ্জ্বল ছিল আল্লাহর খলীলের পবিত্র জীবন। কুরআন মজীদে আল্লাহ বলেন-
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ
যখন তার রব তাকে বললেন, ‘অনুগত হও’ তিনি বললেন, ‘আমি রাববুল আলামীনের অনুগত হলাম।’ আর এরই অসীয়ত করেছেন ইবরাহীম তাঁর সন্তানদেরকে এবং ইয়াকুব (তার
সন্তানদেরকে) যে, ‘আমার পুত্রগণ! আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীন মনোনীত করেছেন। সুতরাং কেবল মুসলিম অবস্থায় যেন তোমাদের মৃত্যু আসে।’-সূরা বাকারা (২) : ১৩১-১৩২
এই আনুগত্য ও সমর্পণই প্রার্থনা করেছিলেন হযরত ইবরাহীম আ. ও তাঁর পুত্র হযরত ইসমাইল আ. আল্লাহর ঘর নির্মাণ করার পর। তাঁরা তখন বলেছিলেন-
رَبَّنَا تَقَبَّلْ مِنَّا إِنَّكَ أَنْتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِنْ ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُسْلِمَةً لَكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ
হে আমাদের পালনকর্তা! আমাদের পক্ষ হতে কবুল করুন। নিশ্চয়ই আপনি এবং শুধু আপনি সব কিছু শোনেন ও সবকিছু জানেন।
হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদের দু’জনকে আপনার একান্ত অনুগত বানিয়ে নিন এবং আমাদের বংশধরদের মধ্যেও এমন উম্মত সৃষ্টি করুন, যারা হবে আপনার একান্ত অনুগত। এবং আমাদেরকে শিক্ষা দিন আমাদের ইবাদতের পদ্ধতি এবং কবুল করে নিন আমাদের তাওবা। নিশ্চয়ই আপনি এবং শুধুই আপনি অতি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।-সূরা বাকারা (২) : ১২৭-১২৮
তো আল্লাহর ঘরের মুসাফির যখন ইহরাম ধারণ করেন এবং ‘লাববাইকা’ উচ্চারণ করেন তখন এটা হয় তার আনুগত্যের শপথ এবং রবেবর সাথে তার সম্পর্কের নবায়ন।
‘লাববাইকা লা-শারীকা লাকা লাববাইক ...’
‘আমি হাজির! তোমার কোনো শরীক নেই; আমি হাজির!’ এ হচ্ছে সকল প্রকার শিরক ও শরীককে বর্জনের ঘোষণা। প্রার্থনা, উপাসনা ও নিরঙ্কুশ আনুগত্য কোনো ক্ষেত্রেই আল্লাহর কোনো শরীক নেই। বিশ্ব জগতের আদি থেকে অন্ত যত কিছুকে আল্লাহর সাথে শরীক করা হয়েছে বা হবে, যত ব্যক্তি বা সম্প্রদায় আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেছে বা করবে তাদের কারো সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। ইয়া আল্লাহ! আমি শুধু তোমার বান্দা-আমার উপাসনা ও আনুগত্য শুধু তোমার জন্য। আমার প্রার্থনা ও শরণ শুধু তোমারই কাছে। তুমি ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু।
মক্কার মুশরিকরাও আল্লাহকে বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা বলে স্বীকার করত। তবে প্রার্থনায়, উপাসনায় ও সৃষ্টিকুলের নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতায় অসংখ্য দেবদেবীকে তাঁর সাথে শরীক করত। (নাউযুবিল্লাহ) তারা মনে করত, এ সকল দেবদেবী হচ্ছে কিছু ছোট খোদা, যারা বড় খোদার তরফ থেকে নিয়োগ ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত। সুতরাং এদেরকে সন্তুষ্ট করা ছাড়া বড় খোদার সন্তুষ্টি অর্জন অসম্ভব। আল্লাহ তাআলা তাদের চিন্তার অসারতা ও তাদের মর্মন্তুদ পরিণতি ঘোষণা করেছেন-
تَنْزِيلُ الْكِتَابِ مِنَ اللَّهِ الْعَزِيزِ الْحَكِيمِ إِنَّا أَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ فَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصًا لَهُ الدِّينَ أَلَا لِلَّهِ الدِّينُ الْخَالِصُ وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى إِنَّ اللَّهَ يَحْكُمُ بَيْنَهُمْ فِي مَا هُمْ فِيهِ يَخْتَلِفُونَ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي مَنْ هُوَ كَاذِبٌ كَفَّارٌ
এই কিতাব অবতীর্ণ পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময় আল্লাহর নিকট থেকে। নিশ্চয়ই আমিই এই কিতাব তোমার প্রতি নাযিল করেছি সত্যসহ। সুতরাং তুমি আল্লাহর ইবাদত কর এভাবে যে, আনুগত্য হবে খালেস তারই জন্য। স্মরণ রেখ, খালেস আনুগত্য তাঁরই প্রাপ্য। যারা তাঁকে ছাড়া অন্যকে অভিভাবক বানিয়ে নিয়েছে (এই কথা বলে যে,) আমরা তাদের উপাসনা শুধু এজন্য করি যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে। আল্লাহ তাদের মধ্যে সেই বিষয়ে মীমাংসা করে দেবেন, যার মাঝে তারা মতবিরোধ করছে। নিশ্চিতভাবে জেনে রেখ, আল্লাহ এমন কোনো ব্যক্তিকে পথে আনেন না, যে চরম মিথ্যুক, কুফরের উপর অবিচলিত।-সূরা যুমার (৩৯) : ১-৩
মক্কার মুশরিকদের মাঝে মিল্লাতে ইবরাহীমীর ছিঁটেফোঁটা যা কিছু অবশিষ্ট ছিল তার অন্যতম ছিল হজ্বের তালবিয়া। তবে এতেও ঢুকিয়ে দিয়েছিল তারা শিরক ও পৌত্তলিকতা। মুসনাদে বাযযারে আছে, আনাস রা. বলেন, (হযরত) ইসমাইল আ.-এর পর লোকেরা ছিল ইসলামের অনুসারী। ইসলাম থেকে বিচ্যুত করার জন্য শয়তান তাদেরকে বিভিন্ন কথা বলত। একপর্যায়ে তাদের তালবিয়াতেও এ কথা যুক্ত করে দিল-
لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ، إِلَّا شَرِيَكًا هُوَ لَكَ
তো যারা ছিল মুসলিম, শয়তানের কুমন্ত্রণায় তারা শিরকে লিপ্ত হল।’-মাজমাউয যাওয়াইদ, হা: ৫৩৬২
সহীহ মুসলিমের হাদীসে আছে, হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আববাস রা. বলেন, ‘মুশরিকরা বাইতুল্লাহর চারপাশে প্রদক্ষিণকালে বলত-
لَبَّيْكَ اَللَّهُمَّ لَبَّيْكَ، لَبَّيْكَ لا شَرِيْكَ لَكَ، إِلَّا شَرِيَكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ
‘বান্দা হাজির! তোমার কোনো শরীক নেই। তবে শুধু ঐ শরীক, যার মালিক তুমি এবং যার সকল ক্ষমতা ও অধীনদেরও মালিক তুমি।
এরা ‘লাববাইকা লা-শারীকা লাক’ পর্যন্ত বললেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, থাম, থাম। তোমাদের মরণ হোক!!-সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৩৭৭
এই পৌত্তলিক সম্প্রদায়ের বুদ্ধি ও চিন্তার দৈন্য আল্লাহ তাআলা দৃষ্টান্ত দ্বারা বর্ণনা করেছেন। সূরা রূমের ২৮ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন-
ضَرَبَ لَكُمْ مَثَلًا مِنْ أَنْفُسِكُمْ هَلْ لَكُمْ مِنْ مَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ مِنْ شُرَكَاءَ فِي مَا رَزَقْنَاكُمْ فَأَنْتُمْ فِيهِ سَوَاءٌ تَخَافُونَهُمْ كَخِيفَتِكُمْ أَنْفُسَكُمْ كَذَلِكَ نُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
অর্থাৎ তোমরা নিজেদের স্বভাব ও প্রবণতা সম্পর্কেই চিন্তা কর। তোমরা কি কখনো মেনে নিতে পারবে যে, তোমরা স্বাধীন লোকেরা যেমন একে অপরের সাথে অংশীদারিত্বের কারবার কর এবং একে অন্যকে ভয় ও সমীহ করে থাক তোমাদের দাস-দাসীও তোমাদের অর্থ-সম্পদে এরূপ অংশীদার হবে এবং তাদেরকে তোমরা সেই রকম ভয় ও সমীহ করবে? যদি নিজেদের জন্য এটা মেনে নিতে না পার তাহলে আল্লাহর জন্য কীভাবে তা মেনে নিচ্ছ? তার সৃষ্টিকে কীভাবে তার অংশীদার সাব্যস্ত করছ?-তাফসীরে তাওযীহুল কুরআন ৩/২৭
তো আল্লাহ যাকে ইহরাম ধারণের ও তালবিয়া পাঠের সৌভাগ্য দান করেছেন তার পক্ষে কি সম্ভব কোনো ধরনের শিরকে লিপ্ত হওয়া? মাজার-দরগাহে সিজদা করা, তাওয়াফ করা? গায়রুল্লাহর নামে মান্নত করা, কোরবানী করা? গায়রুল্লাহর কাছে বিপদাপদ থেকে মুক্তি চাওয়া? সন্তান ও সম্পদ প্রার্থনা করা, কস্মিনকালেও সম্ভব নয়। এ সকল শিরকী কাজে লিপ্ত হওয়া তো দূরের কথা, মুসলিমসমাজে এগুলোর উপস্থিতি মেনে নেওয়াও তার পক্ষে সম্ভব নয়।
তেমনি কোনো পৌত্তলিক জাতির সাথে হৃদ্যতা স্থাপন করা, তাদের জাতীয় উৎসব ও পূজা-পার্বণে উপস্থিত হওয়া এবং তাদের বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে সমর্থন সম্ভব নয়।
শিরক ও মুশরিক সম্প্রদায়ের প্রতি আল্লাহর খলীল ইবরাহীম আ.-এর সেই বজ্রঘোষণা নতুন করে স্মরণ করুন। অথচ তিনি ছিলেন অতি সহনশীল ও কোমল-স্বভাব। শিরকের বিষয়ে তাঁর আপোষহীনতাকেই আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য উসওয়া ও আদর্শ ঘোষণা করেছেন-
قَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ
অবশ্যই তোমাদের জন্য রয়েছে উত্তম আদর্শ ইবরাহীম ও তাঁর সঙ্গীদের মাঝে, যখন তারা নিজেদের সম্প্রদায়কে বলল, তোমাদের সাথে ও তোমরা আল্লাহ ছাড়া যাদের উপাসনা কর তাদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। আমরা তোমাদেরকে অস্বীকার করি। আমাদের ও তোমাদের মাঝে সৃষ্টি হয়ে গেছে চিরবিদ্বেষ, যতক্ষণ না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আন ...।-সূরা মুমতাহিনা : ৪
শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তবে আদর্শের বিষয়ে আপোষ নয়
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিধর্মীর সাথে নির্ধারিত শর্তসাপেক্ষে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হতে পারে। তবে কোনো অবস্থাতেই বিশ্বাস ও আদর্শের আপোষ হতে পারে না। তাদের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তখনই হতে পারে যখন তারা আল্লাহর রাসূল, আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর দ্বীনের অবমাননা থেকে বিরত থাকে এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য ক্ষতিকর কর্মকান্ডে লিপ্ত না থাকে। অন্যথায় তারাই হবে শান্তি ভঙ্গকারী। যে অমুসলিম ইসলাম ও মুসলমানের মর্যাদা রক্ষা করে, তার জন্য ইসলামেরই বিধান, প্রতিবেশী হলে সদাচার করার, অতিথি হলে সমাদর করার এবং বিপদগ্রস্ত হলে সহায়তা করার। তবে কোনো অবস্থাতেই বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই তার শিরক ও পৌত্তলিকতা সমর্থন করার, তাদের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ কিংবা ধর্মীয় প্রতীক ধারণ করার। কুরআন মজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-
(তরজমা) ‘মুমিনগণ যেন মুমিনদেরকে ছেড়ে কাফিরদেরকে নিজেদের মিত্র ও সাহায্যকারী না বানায়। যে এরূপ করবে আল্লাহর সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে তাদের (অনিষ্ট) থেকে আত্মরক্ষার জন্য যদি কোনো পন্থা অবলম্বন করা হয় সেটা ভিন্ন কথা। আল্লাহ তাঁর নিজের সম্পর্কে তোমাদেরকে সাবধান করছেন। আর তাঁরই দিকে (সকলকে) ফিরে যেতে হবে।’-সূরা আলেইমরান (৩) : ২৮
আরো দেখুন : সূরা নিসা (৪ : ১৩৯, ১৪৪); সূরা মায়েদা (৫ : ৫১, ৫৭, ৮১); সূরা তাওবা (৯ : ৩৩); সূরা মুজাদালা (৫৮ : ২২) ও সুরা মুমতাহিনা (৬০ : ১)
হযরত ওমর ফারুক রা. বিধর্মীদের উৎসবে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকার আদেশ করে বলেন-
اجتنبوا أعداء الله في عيدهم
‘আল্লাহর দুশমনদের উৎসব থেকে তোমরা বিরত থাক।’-সুনানে বায়হাকী
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন-
من بنى ببلاد الأعاجم وصنع نيروزهم ومهرجانهم وتشبه بهم حتى يموت وهو كذلك، حشر معهم يوم القيامة.
যে ব্যক্তি (বিধর্মী) অনারবদের মাঝে বসবাস করে, তাদের নওরোজ ও মেহেরজান উদযাপন করে এবং তাদের অনুকরণ করে আর এ অবস্থায় তার মৃত্যু হয় কিয়ামতের দিন সে তাদেরই সাথে থাকবে।’-সুনানে বায়হাকী
তো যে মুসলিম তার তালবিয়ায় সত্যবাদী সে কি কখনো পৌত্তলিকতার সাথে একাত্ম হতে পারে? পারে না।
‘ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক’
সকল প্রশংসা তোমার, দান তোমার এবং রাজত্ব একমাত্র তোমার।
এ শুধু সৃষ্টিকর্তার স্ত্ততি ও প্রশংসাই নয়, এ হচ্ছে তাওহীদের ঘোষণা ও তাওহীদের দলীল।
তালবিয়ার এ অংশে তিনটি কথা আছে : এক. ‘সকল প্রশংসা তোমার’। কারণ একমাত্র তুমিই সর্বগুণের আধার। তোমার গুণাবলিই স্থায়ী ও স্বয়ম্ভূত। তুমিই জীবন ও প্রকৃতির স্রষ্টা; শক্তি ও সৌন্দর্যের সৃষ্টিকর্তা; বস্ত্তর গুণ, প্রাণের ধর্ম ও প্রকৃতির নিয়ম সবই তোমার সৃষ্টি। সুতরাং নিরঙ্কুশ প্রশংসা একমাত্র তোমারই প্রাপ্য। এবং জগতের সকল প্রশংসা তোমার দিকেই প্রত্যাবর্তিত।
দ্বিতীয় কথা, ‘দান তোমার।’ তুমিই সৃষ্টিকুলের পালনকর্তা। সৃষ্টির শক্তি ও সৌন্দর্য এবং প্রতিভা ও বৈশিষ্ট্য তোমারই দান। সৃষ্টিজগত তোমারই মুখাপেক্ষী। আর সৃষ্টির একের দ্বারা অপরের যে প্রয়োজন পূরণ সেও তোমারই ফয়সালা। সুতরাং দাতা একমাত্র তুমি, দান একমাত্র তোমার।
তৃতীয় কথা, ‘রাজত্ব একমাত্র তোমার।’ গোটা সৃষ্টিজগত তোমার আদেশের অধীন। তোমার আদেশেই সৃষ্টির সূচনা, তোমার আদেশেই বর্ধন, তোমার আদেশেই লয় ও সমাপ্তি। জগতের ক্ষুদ্র-বৃহৎ সকল বস্ত্তর ছোট-বড় সকল বিষয়ে তোমারই ইচ্ছা কার্যকর।
ألا لله ألا لله الخلق والأمر
আল্লাহই যখন বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা-পালনকর্তা; সৃষ্টিকুল যখন তাঁরই ইচ্ছা ও আদেশের অধীন তখন উপাসনা ও আনুগত্যও একমাত্র তাঁরই প্রাপ্য।
তিনি ছাড়া কোনো সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা নেই, সৃষ্টিকুলের জীবন-মৃত্যু, ভালো-মন্দে আর কারো অধিকার নেই। সুতরাং উপাসনা ও আনুগত্যেও তাঁর কোনো শরীক নেই।
ইহরামের হালতে তাওহীদের ঘোষণা যার কণ্ঠে উচ্চারিত হয় এবং আল্লাহর দয়ায় তাওহীদের প্রমাণ যার হৃদয়ে অবতীর্ণ হয় তার পক্ষে কি সম্ভব নিজের স্রষ্টাকে বিস্মৃত হওয়া? সে তো সৃষ্টির মাঝেই দেখতে পায় স্রষ্টার দান ও করুণা এবং ক্ষমতা ও প্রতাপ! তাই যারা সৃষ্টির মোহে স্রষ্টাকে ভুলে যায় তাদের জন্য তার অন্তরে জাগে বেদনা, যারা সৃষ্টির শক্তি ও সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে তারই উপাসনায় লিপ্ত হয় তাদের প্রতি তার অন্তরে করুণা জাগে, আর যারা ক্ষুদ্র মানবের সামান্য প্রতিভায় আত্মবিস্মৃত হয়ে নিজ স্রষ্টার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে তাদের প্রতি তার অন্তরে জাগে অপরিসীম ঘৃণা।
যে মুমিন তার তালবিয়ায় সত্যবাদী তার দৃষ্টিতে বস্ত্তর গুণ ও ধর্ম এবং প্রকৃতির নিয়ম ও শক্তি তার মহান সৃষ্টিকর্তার সৃজনক্ষমতার নিদর্শন। তাই সৃষ্টিজগত যতই তার সামনে উন্মোচিত হয় ততই সে স্রষ্টার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার পরিচয় লাভ করে, ততই সে ভক্তি ও শ্রদ্ধায় এবং সমর্পণ ও আনুগত্যে নতশীর হয়।
আর এটিই হচ্ছে আল্লাহর প্রাজ্ঞ ও অনুগত বান্দাদের বৈশিষ্ট্য, যার পুরোভাগে আছেন জলীলুল কদর নবী ও রাসূল।
হজ্বের ঘোষক ইবরাহীম আ. সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
وَكَذَلِكَ نُرِي إِبْرَاهِيمَ مَلَكُوتَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلِيَكُونَ مِنَ الْمُوقِنِينَ
এবং এভাবেই আমি ইবরাহীমকে দেখাই আসমান ও যমীনের মহারাজত্ব এবং যেন সে হয় দৃঢ়বিশ্বাসীদের একজন।-সূরা আনআম : ৭৫
সাইয়্যেদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-
لَقَدْ رَأَى مِنْ آَيَاتِ رَبِّهِ الْكُبْرَى
নিশ্চয়ই তিনি দেখেছেন আপন রবের বড় বড় নিদর্শন।-সূরা নাজম : ১৮
সব যমানার উলূল আলবাব ও প্রজ্ঞাবানদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন-
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لَآَيَاتٍ لِأُولِي الْأَلْبَابِ الَّذِينَ يَذْكُرُونَ اللَّهَ قِيَامًا وَقُعُودًا وَعَلَى جُنُوبِهِمْ وَيَتَفَكَّرُونَ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ رَبَّنَا مَا خَلَقْتَ هَذَا بَاطِلًا سُبْحَانَكَ فَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃজনে ও রাতদিনের পালাক্রমে আগমনে বহু নিদর্শন আছে বুদ্ধিমানদের জন্য; যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে (সর্বাবস্থায়) আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা করে (এবং তা লক্ষ্য করে বলে ওঠে)-হে আমাদের প্রতিপালক! আপনি এসব উদ্দেশ্যহীনভাবে সৃষ্টি করেননি। আপনি এমন (ফজুল) কাজ থেকে পবিত্র। সুতরাং আপনি আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন। ... সূরা আলেইমরান (৩) : ১৯০-১৯১
তো তালবিয়ার এই তৃতীয় কথাটি এ মহাসত্যের সাক্ষ্য যে, আয় আল্লাহ! আমার চারপাশে যা কিছু আছে সব তোমারই সৃষ্টি। এবং তোমার জ্ঞান ও প্রজ্ঞা, তোমার ক্ষমতা ও প্রতাপ এবং তোমার বড়ত্ব ও মহত্বের জীবন্ত নিদর্শন। আয় আল্লাহ! আমি বিশ্বাস ও উপলব্ধিতে এই মহাসত্যকে ধারণ করেছি এবং তোমারই সামনে সিজদাবনত হয়েছি।
সারকথা এই যে, তালবিয়ার এই জ্যোতির্ময় বাক্যগুলো তাওহীদ ও ইহসানের গভীর ব্যঞ্জনায় পরিপূর্ণ। এ কারণেই বিখ্যাত সাহাবী হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ রা. তালবিয়াকে অভিহিত করেছেন ‘তাওহীদ বলে। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ইহরামের বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন-
أهل بالتوحيد
অর্থাৎ আল্লাহর রাসূলের পাক যবানে ‘তাওহীদ’ ধ্বনিত হল।
তো এই তালবিয়া হচ্ছে তাওহীদের ঘোষণা এবং তাওহীদের ইমাম আমাদের মহান পূর্বসূরীদের সাথে আমাদের পবিত্র সেতুবন্ধন।
ইয়া আল্লাহ! দুনিয়াতেও তুমি আমাদের কলব ও যবান তালবিয়ার উচ্চারণে সজীব রাখ, আখিরাতেও তালবিয়া পড়তে পড়তে তোমার দরবারে হাজির হওয়ার সৌভাগ্য দান কর।