বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১৮
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আল্লাহর শোকর, আল্লাহ তাঁর গোনাহগার বান্দাকে
বা-সালামাত পৌঁছে দিয়েছেন হারামের কাছে, একেবারে কাছে। কয়েক কদম এগুলেই দেখা যাবে হারামের চত্বর এবং দেয়ালের অংশ। বুকটা কেমন যে দুরু দুরু করছে! কেমন বেদনা এ! কেমন যন্ত্রণা এ!! কষ্ট আছে এবং আছে আনন্দ!!
বুকটা যেন আজ নতুন এক অনুভূতির সন্ধান পেলো। কষ্টের আনন্দ এবং আনন্দের কষ্ট, আমার বুকের ভিতরে যেন এ দুইয়ের কেমন একটা মাখামাখি হলো।
তুমি যখন দূরে থাকো, তখন প্রিয়তমকে দেখতে না পাওয়ার কষ্ট একরকম! আর যখন সাগর-মরুভূমি পাড়ি দিয়ে প্রিয়তমের ঘরের দুয়ারে এসে দাঁড়াও তখনকার যে প্রতীক্ষা, তখনকার যে উৎকণ্ঠা সে একেবারে অন্যরকম!
রাত তখন এগারটা। বাস থেকে সামান নামছে, আমি দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ পিছন থেকে এলো অতি পরিচিত কণ্ঠে সালাম। আমার প্রিয় মনছূর ভাই। তিনি বলেন, ‘হযরত’, আমি বলি ‘ভাই’। কল্পনায়ও ছিলো না, মক্কা শরীফে প্রথম দেখা হবে তার সঙ্গে এবং তার সালাম হবে হারামের পথে আমার পাথেয়। কী মধুর সুরে, কী মিঠা আওয়াযে বললেন তিনি,
السلام عليكم
আপনার উপর বর্ষিত হোক শান্তি!
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
আকাশ থেকে যেন শান্তি, রহমত ও বরকতের বারি বর্ষিত হলো, আর আমরা উভয়ে তাতে সণাত হলাম।
কিছুক্ষণ পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম অভিভূত দৃষ্টিতে, তারপর যেন নিজেদের অজ্ঞাতেই আলিঙ্গনাবদ্ধ হলাম। বাইতুল্লাহর মুসাফিরকে আলিঙ্গন করে তিনি কী পেলেন, জানি না; বাইতুল্লাহর পড়শীকে আলিঙ্গন করে আমি অবর্ণনীয় এক কলবি রাহাত ও আত্মিক প্রশান্তি লাভ করলাম। মনে হলো, আমার মনে হলো, ঘরের মেযবান ঘরের পড়শীকে পাঠিয়েছেন মেহমানকে বরণ করার জন্য। আমি যেন সম্বর্ধিত হলাম! ভাবো না! যত গভীর করে ভাবতে পারো ভাবতে থাকো না! বাধা কোথায়!! তিনি বলেছেন, তুমি যেমন করে ভাববে তিনি তোমাকে তেমন করে গ্রহণ করবেন!!!
মনছূর ভাই বললেন, ঢাকায় আপনার বাসায় ফোন করে যদ্দুর জেনেছি তাতে তো গত রাতেই আপনার এসে পড়ার কথা। তাই আজ উম্মেহানিতে অনেক তালাশ করেছি, আর না পেয়ে পেরেশান হয়েছি। এখন ‘প্রফেসর হযরতের’ খোঁজখবর নিয়ে বাসায় ফিরছি; হঠাৎ দেখি আপনি বাস থেকে নামছেন!
আমি সংক্ষেপে পথের ঘটনা বললাম। সামান নিয়ে কিছু দূর হেঁটে আমাদের জন্য নির্ধারিত ঘরে উপস্থিত হলাম। ঢাকা হোটেলের বাম দিক দিয়ে বেশ কিছু দূর উপরে একটি ভবন, নাম দারুল আমান, তার পঞ্চম তলায় আমাদের থাকার ব্যবস্থা। আমীর ছাহেবের অনুমতি নিলাম হারাম শরীফে যাওয়ার জন্য। তিনি বললেন, যাও, তোমাকে তো এখন বেঁধেও রাখা যাবে না। তবে আমার জন্যও দু‘আ করো।
ব্যাগ খুলে দু’টো প্যাকেট নিলাম এবং মনছূর ভাইকে সঙ্গে করে বের হলাম। মনের আনন্দ, হৃদয়ের উচ্ছ্বাস, কলবের সুকূন এবং আত্মার প্রশান্তিতে আমি তখন এমনই বিহবল, যা প্রকাশ করার যথাশব্দ হয়ত মানুষের ভাষায় নেই, কিংবা আমার জানা নেই।
গলি পার হয়ে যখন মিসফালার বড় রাস্তায় উঠলাম ভিতরে তখন অদ্ভুত এক কম্পন অনুভব করলাম। জানি না, সে কম্পন পুলকের, না ভীতির, আনন্দের, না উৎকণ্ঠার!
আমি জানি, আমার সামনে এখন বাইতুল্লাহর হারাম। চোখ তুললেই পরম সৌভাগ্য আমাকে স্পর্শ করবে; আমি দেখতে পাবো হারামের জীবন্ত ছবি! কিন্তু ...
পাঁচ বছর আগে বিদায়কালে এখান থেকেই দেখেছিলাম হারামের ছবি! এই দীর্ঘ পাঁচ বছরে আমার চোখ কত না গোনাহ করেছে! চোখের দৃষ্টি পাপের কালিমায় কত না কলুষিত হয়েছে! কীভাবে এখন নযর ওঠাবো? কোন সাহসে চোখ তুলে তাকাবো আল্লাহর ঘরের হারামের দিকে? হে আল্লাহ, চোখের সব গোনাহ তুমি মুছে দাও! দৃষ্টির সব কলুষ-কালিমা তুমি দূর করে দাও!
অনেকক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে দ্বিধা-সঙ্কোচের পর্দা সরিয়ে অবনত দৃষ্টি তুলে তাকালাম এবং .. এবং দেখতে পেলাম আল্লাহর ঘরের হারাম, সামনের উন্মুক্ত চত্বর, শুভ্র চত্বরে ইহরামের সাদা লেবাসে হাজীদের আনাগোনা, তারপর হারামের মনোরম প্রাচীর, ভিতরে প্রবেশের পথ বাবে আব্দুল আযীয, উপরে সুউচ্চ আলোকিত মিনার! সবকিছু আগের মত, যেন চিরচেনা! স্বপ্ন তাহলে সত্য হলো! পাঁচ বছরের বিরহবেদনার পর মিলনের আনন্দ-লগ্ন তাহলে উপস্থিত হলো! আল্লাহর ঘরের হারাম সত্যি তাহলে আবার দেখা হলো! হারামের ভিতরে আবার তাহলে আমার প্রবেশ হবে! আবার তাহলে দেখা হবে আল্লাহর ঘর, কালো গিলাফে ঢাকা আমার আল্লাহর পবিত্র ঘর! তোমার হারাম হে আল্লাহ, চিরপবিত্র, চিরমহিয়ান; আমাদের ধন্য করো হে আল্লাহ তোমার হারামের কল্যাণ দ্বারা, তোমার হারামের নূর ও নূরানিয়াত দ্বারা।
***
প্যাকেট দু’টো মনছূর ভাইয়ের হাতে দিলাম। তার ছেলে-মেয়েদের জন্য কিছু মিষ্টান্ন আমার স্ত্রী তৈরী করে দিয়েছেন। আমি বললাম, আল্লাহর শোকর, আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো এবং আমানত বহনের দায় থেকে মুক্ত হওয়া গেলো।
মনছূর ভাই আরো কিছু সময় থাকতে চাইলেন। আমি একটু শক্ত করে বললাম, ভাই, এখন আমি একটু একা থাকতে চাই। অগত্যা তিনি আগামী রাত্রে উন্মেহানিতে দেখা করবেন বলে বিদায় নিলেন।
আমি এখন একা এবং এই একাকিত্ব আমার খুব ভালো লাগে। কারণ এসময় আমি গভীরভাবে অনুভব করি, আমি হারামের মেহমান, হারামের মালিক আমার মেযবান!
চারদিকে তাকালাম, হারাম ও তার শুভ্র চত্বরের কোন পরিবর্তন নেই। বাবে আব্দুল আযীয বরাবর স্তম্ভের চূড়ায় ঘড়িটি পঁচিশ বছর আগে ছিলো, এখনো আছে।
মিসফালার সড়কে সবুজ পোলটি পাঁচবছর আগে ছিলো, এখনো আছে। তবে বড় ধরনের একটা পরিবর্তন ঘটেছে। এটাকে বলা যায় ইতিহাসের একটি যুগের পরিবর্তন। হারামের সামনে মিসফালার রাস্তার ঠিক মাথায় যে পাহাড়টা ছিলো এবং তার উপর তুর্কীদের দুর্গ ছিলো তার কিছুই আর নেই। আস্ত একটা পাহাড় গায়েব! সেখানে প্রায় আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে দু’দুটি টাওয়ার! একটির নাম যমযম টাওয়ার।
পাহাড় মিসমার করার গুঞ্জন আগের সফরেই শুনা গিয়েছিলো, সেটা চোখের সামনে দেখে মনটা খুব বিষণ্ণ হলো, ওদিকে জাবালে ওমরও কাটা শুরু হয়ে গেছে। সেখানে ওঠবে বড় বড় টাওয়ার, আমাদের মত গরীব হাজীদের জন্য নয়, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিত্তশালীদের জন্য। তা না হয় উঠলো, কিন্তু অতীতের স্মৃতিগুলো?!
সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদবী রহ.-এর কথা মনে পড়ে, তিনি লিখেছেন, ‘এখানে এসে মানুষ যদি অতীতকে খুঁজে না পায় তাহলে তা হবে বড় বেদনাদায়ক। অতীতের কিছু না কিছু ছাপ ও চিহ্ন এখানে থাকা দরকার। কিন্তু হিজাযভূমি যদি হয়ে যায় ইউরোপের কোন শহরের ছবি এবং পাশ্চাত্যের বস্ত্তসভ্যতার প্রতিচ্ছবি ...’
***
হারামের চত্বরসংলগ্ন হাম্মামে প্রচন্ড ভিড় থাকে, দূরে সুড়ঙ্গ-পথের হাম্মাম থাকে ফাঁকা, যা আমার জন্য স্বস্তিদায়ক। কিন্তু সেই পরিচিত রাস্তাটা পেলাম না। একটু তালাশ করার পর অবশ্য নির্দেশক চিহ্ন পাওয়া গেলো।
অনেক দূর হেঁটে হাম্মামে গেলাম। মানুষজন বলতে গেলে নেই। প্রথমে ইহরামের উপরের চাদরটা ধুয়ে নিলাম। খুব শক্তিশালী পাখা লাগিয়ে ভিতরে বাতাসের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাদরটা দু’হাতে মেলে ধরতে পাঁচ মিনিটেই শুকিয়ে গেলো। এবার খুব আরাম করে গোসল করলাম। সারাদিনের সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো। নিজেকে খুব সতেজ ও সিণগ্ধ মনে হলো। সতেজ শরীর ও সিণগ্ধ অন্তর নিয়ে হাম্মাম থেকে বের হলাম। এবার আমি প্রবেশ করবো হারাম শরীফে। এবার আমি দাঁড়াবো আল্লাহর ঘরের সামনে। সারা অস্তিত্ব জুড়ে কী অপূর্ব এক শিহরণ!
প্রথমে হারামের চত্বরে প্রবেশ করলাম। আলোর বন্যায় ভেসে যাওয়া সাদা পাথরের শুভ্র চত্বর। এখানে সেখানে বসে আছেন বিভিন্ন দেশের, অভিন্ন লেবাসের হাজী ছাহেবান! দেখতে কী যে ভালো লাগে! আমিও যেন সাদা লেবাস ও শুভ্র হৃদয়ের নতুন এক মানুষ! নিজের কাছে নিজেকে এত শুভ্র-পবিত্র মনে হতে পারে, আগে কখনো ভাবিনি। জীবনে কখনো কোন পাপ যেন আমাকে স্পর্শ করেনি! মনে হলো, এখন যদি মৃত্যু হয়, সোজা জান্নাতে চলে যাবো ইনশাআল্লাহ!
কিছুক্ষণ বসে থাকলাম হারামের চত্বরে। ভাব ও
ভাবনার আকাশে সাদা-কালো কত মেঘের যে আনাগোনা হলো! কখনো বৃষ্টি হলো, কখনো মেঘের কোলে রোদ হেসে উঠলো, কখনো সাত রঙের রঙধনু দেখা দিলো এবং দেখা দিলো ...
আসলে তখনকার অনুভব-অনুভূতির কথা শব্দের অবয়বে প্রকাশ করা সম্ভবই নয়। হৃদয়ের ছবি যদি আঁকা যেতো তাহলে হয়ত তা সম্ভব হতো।
আমার হৃদয়ের স্পন্দন আমি নিজেই যেন শুনতে পাচ্ছি! সমগ্র অস্তিত্বব্যাপী কিসের যেন একটা কম্পন! জানি না ভয়ের, না আনন্দের! হে আল্লাহ, তুমি কত দয়াবান, কত মেহেরবান! কীভাবে কোন্ ভাষায় তোমার শোকর আদায় করবো হে আল্লাহ! যিন্দেগির পিছনের সব গোনাহ তুমি হে আল্লাহ, মুছে দাও এবং সামনের সমস্ত গোনাহ থেকে হিফাযত করো। তোমার ঘরের আদব যেন রক্ষা করতে পারি হে আল্লাহ! তোমার পেয়ারা হাবীব যেভাবে তোমার ঘর যিয়ারত করেছেন, ছাহাবা কেরাম যেভাবে তোমার ঘরের হক আদায় করেছেন, সামান্য হলেও তা অনুসরণ করার তাওফীক দাও হে আল্লাহ!
হে রাহমান! হে রাহীম! আমি এখন তোমার ঘরের যিয়ারতে রওয়ানা হবো। আমি তো কিছু জানি না, কিছু বুঝি না; তুমি হে আল্লাহ আমাকে সব বুঝিয়ে দাও, সব শিখিয়ে দাও, তুমি আমাকে সবকিছু করিয়ে দাও। আমার তাওয়াফ ও সা‘ঈ সব তুমি কবুল করে নাও।
বাবুল ফাতাহ দিয়ে হারামে প্রবেশ করা সুন্নত। বাবে আব্দুল আযীয হলো প্রথম দরজা, আর বাবুল ফাতাহ হলো (সম্ভবত) চৌচলিস্নশতম দরজা, ডান দিক দিয়ে ঘুরে বাবুল ফাতাহ-এর সামনে উপস্থিত হলাম এবং ভিতরে প্রবেশ করলাম। দৃষ্টি অবনত, মুখে ইস্তিগফার। বুকের ভিতরে কিসের যেন এক তরঙ্গপ্রবাহ! কিছুটা যেন আশা, আবার কিছুটা যেন আশঙ্কা! ভয় ও আনন্দের কেমন যেন এক মিশ্রণ! একবার মনে হয়, অপরাধী কীভাবে মাথা তুলে তাকাবে? আবার মনে হয়, তাঁর দয়া ও ক্ষমা তো সীমাহীন! তিনি তো তোমাকে ইহরামের লিবাস দান করেছেন। যিনি তোমাকে বাইরের শুভ্রতা দান করেছেন তিনিই তোমাকে ভিতরের শুভ্রতা দান করবেন। তুমি তো এখন তাঁর মেহমান। তিনি কি তোমার লাজ রক্ষা করবেন না! অন্তত তাঁর দয়া ও রহমতের লাজ!!
বান্দার দীনতা, আর মাওলার বদান্যতার কথা ভেবে চোখে পানি এসে গেলো। হায়, সারা জীবন এমন দয়ালু মাওলার শুধু নাফরমানিই করে গেলাম, তবু তাঁর দয়া ও করমের, করুণা ও রহমের সাগরে কখনো ভাটার টান ধরেনি, শুধু জোয়ার আর জোয়ার! অধম বান্দাকে আবার তিনি এনে দাঁড় করিয়েছেন তাঁর ঘরের দুয়ারে।
এখনো চোখ তুলিনি, তবু আমি দেখতে পাচ্ছি কালো গিলাফ, হাজরে আসওয়াদ, মুলতাযাম, যেমন দেখতে পেতাম বহু দূরে আমার জন্মভূমি থেকে। তখন ছিলো দূরত্বের পর্দা, এখন শুধু দৃষ্টির পর্দা।
হে আল্লাহ, এখন আমি চোখ তুলে তাকাবো, তুমি আমাকে অবলোকনের দৃষ্টি দান করো, সেই দৃষ্টি যা তুমি যুগে যুগে দান করেছো তোমার পেয়ারা বান্দাদের।
ধীরে ধীরে দুরু দুরু বুকে, লজ্জিত, কুণ্ঠিত ও পুলকিত হৃদয়ে এবং অশ্রুঝাপসা চোখে তাকালাম আমার আল্লাহর ঘরের দিকে। আহ, কী শান্তি, কী প্রশান্তি! কী তৃপ্তি ও পরিতৃপ্তি!! এ যে আমার কল্পনারও উর্ধ্বের প্রাপ্তি!!!
আমি দেখলাম কালো গিলাফে ঢাকা আমার আল্লাহর ঘর! দেখলাম ঘরের দুয়ার এবং মনে হলো খোলা দুয়ার!! আল্লাহর বান্দারা দাঁড়িয়ে আছে দু’হাত পেতে, কেউ বা দুয়ারের চৌকাঠ ধরে। আকাশ থেকে যেন ঝিরঝির বৃষ্টি ঝরছে, দয়া ও দানের বৃষ্টি!!
ঐ যে মুলতাযাম! সেখানেও উঁচু হয়ে আছে শত শত হাত, লেগে আছে শত শত বুক!! আল্লাহর ঘর যেন শুষে নিচ্ছে প্রতিটি বুকের তাপ ও উত্তাপ, প্রতিটি হৃদয়ের উষ্ণতা ও স্পন্দন!! আল্লাহর ঘর যেন তার দুয়ারে আগতদের জানাচ্ছে সিণগ্ধ অভিনন্দন!!!
কতবার দেখেছি, তবু মনে হয় এই প্রথম দেখা! এই প্রথম ভালো লাগা!! এই প্রথম ভালোবাসা!!!
ইচ্ছে হয় সারা জীবন দাঁড়িয়ে থাকি! সারা জীবন তাকিয়ে থাকি!! সময় যেন থেমে যায়! কালের গতি যেন স্থির হয়ে যায়!! শুধু যেন বইতে থাকে আলোর স্রোতধারা এবং নূরের ঝর্ণাধারা!!!
বাইতুল্লাহর প্রথম অবলোকনের সময় বলতে হয়-
اللهم زد بيكت ...
আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন, ছাহাবা কেরাম বলেছেন, যুগে যুগে আল্লাহর পেয়ারা বান্দারা বলেছেন; আজ এই গোনাহগার বান্দাও তা উচ্চারণ করলো। দু’টি শুকনো ঠোঁটের নিষ্প্রাণ উচ্চারণ, তবু তো যুক্ত হলো সেই পবিত্র উচ্চারণের আলোকিত ধারার সঙ্গে!
বাইতুল্লাহর প্রথম অবলোকনের সময় যে দু‘আ করা হয় আল্লাহ তা কবুল করেন, আসমানের এই খোশখবর ইয়াদ করে আমি দু‘আ করলাম, হে আল্লাহ, তোমার পেয়ারা হাবীব তাঁর পেয়ারা উম্মতের জন্য যা যা দু‘আ করেছেন, আমিও তো এক আদনা উম্মতি; আমাকেও তুমি সেই দু‘আর সামান্য ফায়য ও ফায়যান দান করো।
আমি দাঁড়িয়েছিলাম, আর আমার সামনে প্রবহমান ছিলো নিমগ্ন প্রেমিকদের তাওয়াফের আলোকিত তরঙ্গবৃত্ত। আমিও হাজরে আসওয়াদের অভিমুখী হলাম এবং দু’হাত তুলে বিসমিআল্লাহি আল্লাহু আকবার বলে শামিল হলাম বাইতুল্লাহর তাওয়াফে, আমিও দোল খেতে লাগলাম সেই আলোর তরঙ্গে। আল্লাহর রহমতে বহুবার হলো এ ঘরের তাওয়াফ, কিন্তু মনে হলো, জীবনের প্রথম তাওয়াফ। আল্লাহর ঘর শুধু প্রাচীন, আর সবকিছু যেন নতুন। হৃদয়ে নতুন অনুভব-অনুভূতি, নতুন শান্তি ও প্রশান্তি এবং নতুন প্রাপ্তির নতুন তৃপ্তি!
তাওয়াফের শেষ পর্যন্ত অন্তর জুড়ে একটা আশা আমাকে উদ্বেলিত করে রাখলো, এত দয়া যিনি করেছেন, আপন ঘরের তাওয়াফের সৌভাগ্য যিনি দান করেছেন, মৃত্যুর সময় ঈমানের সৌভাগ্য অবশ্যই তিনি দান করবেন; কবরে, হাশরে ঘরের মেহমানকে অবশ্যই তিনি দয়া করবেন। হে আল্লাহ, তোমার ঘরের তাওয়াফের সময় বান্দার অন্তরে এই যে আশা জেগেছে তা তো তোমারই দান, তাই তোমারই কাছে তা রেখে দিলাম আখেরাতের সঞ্চয়রূপে।
এক দুই করে তাওয়াফের সাত চক্কর শেষ হলো, কিন্তু পিপাসা দূর হলো না; পিপাসা যেন আরো তীব্র হলো, তৃপ্তির ব্যাকুলতা যেন আরো উদ্দীপ্ত হলো। বাইতুল্লাহর তাওয়াফের পিপাসা কখনো নিবারিত হয় না। এ এক অনন্ত পিপাসা। এখানে অতৃপ্তির মাঝেই পাবে তুমি তৃপ্তির স্বাদ ও শান্তি।
মুলতাযামের সামনে দাঁড়ালাম। কাছে যাওয়ার উপায় নেই। না থাক; যিনি দেবেন তিনি সবাইকে দেবেন। যে বুক লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে যেমন ‘সিঞ্চিত’ হবে, তেমনি বুকভরা ব্যাকুলতা নিয়ে দূর থেকে যে তাকিয়ে আছে সেও ‘বঞ্চিত’ হবে না। তাই দৃশ্যের অংশ হতে না পারলেও দৃশ্যের সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করলাম। কবি কত সুন্দর বলেছেন-
তোমার দুয়ার থেকে দূরে ছিলাম/ একবুক আশা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম/ ভিখারীদের ভিড় ছিলো/ আমার হাতে ভিক্ষার ঝুলি ছিলো/ আমি তোমার করুণার ছায়ায় ছিলাম।
না, তাঁর করুণার ছায়া থেকে কেউ দূরে থাকে না। যারা মুলতাযামে বুক লাগিয়েছে তারা যেমন তাঁর দানে ধন্য হবে, যারা দূর থেকে তাকিয়ে আছে এবং ভিক্ষার পাত্র এগিয়ে ধরেছে, তারাও তাঁর দানে ধনী হবে। মুলতাযাম থেকে সরে আসতে মন যেন কিছুতেই সরে না, তবু সরে আসতে হলো। ধীরে ধীরে মাকামে ইবরাহীমের দিকে সরে এলাম এবং অনেক পিছনে এসে তাওয়াফের দু’রাকাত আদায় করলাম। দু’হাত তুলে মুনাজাত করলাম। কতটুকু চাওয়া হলো, কতটুকু পাওয়া গেলো, কিছু জানি না; শুধু জানি, এখানে হাত উঠেছিলো আল্লাহর খলীলের, আল্লাহর হাবীবের; এখানে হাত উঠেছিলো ছাহাবা কেরামের। এখানে যার হাত ওঠে সে অন্তত সাদৃশ্যের সৌভাগ্য অর্জন করে।
***
যমযমের সিঁড়িটা তালাশ করতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। সিঁড়িটা নেই! হঠাৎ মনে পড়লো, আমার ছোট মেয়ে গতবার হজ্বের সফর থেকে ফিরে গিয়ে বলেছিলো, যমযমের ‘তহখানা’ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এখন সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ‘চাহে যমযমের’ কাছে দাঁড়িয়ে ‘শুরবে যমযমের’ সুযোগ নেই।
নবীর যামানা থেকে বর্তমান যামানা পর্যন্ত মানুষ যমযমের পারে যমযম পান করেছে, এখন চোখের দেখা দেখারও উপায় নেই!
এখন যমযম বরাবর মাতাফের প্রান্তে কিছু নল লাগিয়ে যমযম পানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাই যেমন ভিড় তেমনি....।
এটা কেন করা হয়েছে? সম্ভবত মাতাফ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু এর প্রয়োজন ছিলো বলে মনে হয় না। মাঝখান থেকে যমযমের কূপ চলে গেছে দৃষ্টিরও আড়ালে। এটা কত দূর ঠিক হলো কে জানে!
সে যাই হোক, বর্তমান ব্যবস্থাই তো মেনে নিতে হবে। নলগুলোর সামনে গেলাম। আহা, সবাই যেন যুগ যুগের পিপাসার্ত! শত শত নয়, হাজার হাজার! পিপাসার অস্থিরতা আছে, তবে গোলযোগ নেই। আগে পান করার প্রতিযোগিতা আছে, তবে কাউকে বঞ্চিত করার প্রবণতা নেই। অনেকে আবার অন্যকে গ্লাস ভরে দিচ্ছেন। দিতে দিতে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে তারপর নিজে পান করছেন। একজন বড় মধুর হেসে আমাকে একগ্লাস এগিয়ে দিলেন। কোন্ দেশের, কোন্ ভাষার, বুঝতে পারিনি। ইহরামের লিবাস থেকে শুধু বুঝতে পেরেছি, তিনি আর আমি অভিন্ন। তাওহীদ আমাদের বিশ্বাস, মিল্লাতে ইবরাহীম আমাদের পরিচয়, উম্মতে মুহম্মদী আমাদের জাতীয়তা।
তিনি নিজের আগে আমাকে যমযম পান করালেন, কারণ এতে তার ছাওয়াব হবে, তিনি আল্লাহর প্রিয় হবেন। এই মহৎ অনুভূতিটুকু যদি আমরা সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারি নিজ নিজ দেশে এবং তার ছায়াপাত ঘটাতে পারি জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাহলে সার্থক হয় আমাদের হজ্ব করা, আল্লাহর ঘর যিয়ারত করা এবং যমযম পান করা। যমযমের শীতলতা আমরা সবাই লাভ করি, কিন্তু যমযমের পবিত্রতা অর্জন করতে পারি ক’জন?!
কত দিন পর আবার এভাবে তৃপ্তিভরে যমযম পান করার সৌভাগ্য হলো! তিন, চার, পাঁচ, ছয়, যতটা সম্ভব হলো আকণ্ঠ পান করলাম। দেহের কোষে কোষে যেন পৌঁছে গেলো যমযমের শীতলতা! হে আল্লাহ, হৃদয় ও আত্মাও যেন লাভ করে যমযমের পবিত্রতা!
যখনই যমযমের পারে এসে দাঁড়াই, আমার পিপাসার্ত ঠোঁট যখনই যমযমের শীতল স্পর্শ লাভ করে, সবকিছু ছাড়িয়ে, সবকিছু ছাপিয়ে আমার মনে পড়ে শুধু একটি কথা, যমযম হলো ‘মাতৃসুধা’! মা হাজেরা তাঁর শিশুপুত্রকে শৈশবে শুধু বুকের দুধই দান করেননি, সারা জীবনের জন্য এবং চিরকালের জন্য পিপাসার পানিও দান করেছেন। তাতে দেহের পিপাসা যেমন বিদূরিত হয় তেমনি নিবারিত হয় আত্মারও পিপাসা।
মা হাজেরার এ দান শিশু ইসমাঈলের জন্য যেমন তেমনি সেযুগের, এযুগের এবং সর্বযুগের সকল শিশুর জন্য, সকল মায়ের পক্ষ হতে। সুতরাং কেউ যদি মাকে কষ্ট দেয়, মাতৃত্বকে অসম্মান করে, তার অধিকার নেই যমযমের পানিতে ঠোঁট ভেজাবার। যমযমের পানি হয়ত সে খাবে, কিন্তু মায়ের সন্তুষ্টি ছাড়া যমযমের পানি পান করে কেউ পাবে না ‘আবে যমযমের’ স্বাদ।
আজ থেকে উনিশ বছর আগে একজন আমাকে বলেছিলেন, সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে যমযমের পারে দাঁড়িয়ে যমযম পান করার সময় বলেছিলেন, যমযম একটু অন্যরকম, কিন্তু বিশেষ কোন স্বাদ তো নেই!
আমি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তার কথা শুনে। আগে বা পরে এমন কথা আমি আর কারো মুখে তো শুনিনি!
অনেক সময় পর নিজের অজান্তেই যেন বলে উঠলাম, ‘হয়ত মাকে কষ্ট দিয়েছেন; হয়ত আপনার মা আপনার প্রতি সন্তুষ্ট নন।’
এবার যেন তার স্তব্ধ হওয়ার পালা! অনেকক্ষণ শুধু তাকিয়ে থাকলেন, কিছু বললেন না।
তিন চারদিন পর তার সঙ্গে আবার দেখা হারাম শরীফে। তিনি আমার হাত ধরলেন, আর অশ্রু ছলছল চোখে বললেন, ‘এত দিন বলতাম, মাকে হজ্বে এনেছি, এখন বলি, আমি আমার মায়ের সঙ্গে হজ্বে এসেছি। আপনার সেদিনের কথা আমার চোখ খুলে দিয়েছে। সত্যি সারা জীবন মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। এখন যে তিনি বৃদ্ধা, এখনো কষ্ট দেই। সেদিন ঘরে গিয়ে মায়ের পায়ে পড়ে আমি মাফ চাইলাম, আর মা আমাকে মাফ করে দিলেন। মাফ করে দিলেন, আর আমাকে শিশুর মত আদর করলেন।
মায়ের ক্ষমা ও আদর সঙ্গে করে সেদিন যমযমের পারে এসে যমযম পান করলাম। আমি আটবার হজ্ব করেছি, তিনবার ওমরা করেছি, কিন্তু বিশ্বাস করুন, যমযমের স্বাদ এই প্রথম পেলাম।’
হাদীছ শরীফে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব বলেছেন-
ماء زمزم لما شرب له
আসলে যমযমের লয্যত ও ফযীলত নির্ভর করে পানকারীর হালাতের উপর। আল্লাহর কোন কোন বান্দা তো এমনও বলেছেন, ‘আমি যখন যমযম পান করি তখন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাআল্লামের পবিত্র থুথুর ঘ্রাণ ও স্বাদ অনুভব করি!’
আল্লাহ তাঁর পেয়ারা বান্দাদের সেই সব অনুভব-অনুভূতির কিছু হিস্সা আমাদেরও যেন দান করেন, আমীন।
***
যেহেতু মাঝখানে মাত্র একদিন সময় সেহেতু ইমাম ছাহেবের পরামর্শে আমরা সবাই হজ্বে ইফরাদের ইহরাম বেঁধেছি। তাই এখন তাওয়াফের পর আমাদের সাঈ নেই। তাওয়াফে যিয়ারাতের পর সাঈ করাই উত্তম। তবে এখন সাঈ করে নিলে তাওয়াফে যিয়ারাতের পর প্রচন্ড সমাগমের মধ্যে সাঈ করার প্রয়োজন হবে না। ইমাম ছাহেব কী জন্য যেন আমাকে বললেন, তুমি এখনই সাঈ করে নিও।
সাঈ-এর স্থান আমার জানা ছিলো, কিন্তু কী যে হলো, আমি যেন সব ভুলে গেলাম! সবকিছু যেন হারিয়ে গেলো। আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি আল্লাহর ঘর, যে ঘর শুধু আলো বিকিরণ করে, শুধু নূর ছড়ায়, শুধু সিণগ্ধতা দান করে। কাবাতল্লাহর সিণগ্ধতায় মানুষ এমনই আত্মসমাহিত হয়ে পড়ে যে, তার হৃদয় থেকে সকল স্মৃতি হারিয়ে যায়, তার দৃষ্টি থেকে সকল দিকচিহ্ন মুছে যায়। আমার অবস্থা কিছুটা যেন এমনই হলো। আমি যেন কোন দিক খুঁজে পাচ্ছি না! মাতাফে একটা সবুজ আলো ছিলো সাঈ-এর দিকনির্দেশ করার জন্য, সেটাও দেখতে পাচ্ছি না?!
একা এসেছি, সবকিছু জানা আছে এ ভরসায়। ধারণা ছিলো, কোন সমস্যা হবে না, কিন্তু সমস্যা হলো, সবকিছু একই রকম আছে, তবু সমস্যা হলো! আমি কি আল্লাহর উপর নির্ভরতার কথা ভুলে গিয়েছিলাম! আমি কি নিজের জানার উপর ভরসা করেছিলাম! হে আল্লাহ আমি তাওবা করছি। তুমি আমাকে পথ দেখিয়ে দাও। হে আল্লাহ, তোমার ঘরের সামনে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে আমার লজ্জা হয়, তুমিই আমাকে পথ দেখিয়ে দাও।
এবং আল্লাহ পথ দেখালেন। ধীরে ধীরে সবকিছু স্মৃতিতে ভেসে উঠলো। দৃষ্টিপথে সকল দিকচিহ্ন ফুটে উঠলো। বাইতুল্লাহর দরজার দিকে দাঁড়িয়ে হাতের ডান দিকে ঐ যে দেখা যাচ্ছে সবুজ বাতি! মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলাম ছাফা পর্বতের দিকে। মা হাজেরা প্রথমে ছাফা পাহাড়ে উঠেছিলেন পানির সন্ধানে! ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন নির্জন উপত্যকার চারদিকে; যদি কাফেলার কোন চিহ্ন পাওয়া যায়! যদি কলিজার টুকরো ইসমাঈলের জন্য এককাতরা পানি পাওয়া যায়!! কিন্তু না ছিলো কাফেলার চিহ্ন, না ছিলো পানির কাতরা! তখন আরো ব্যাকুল বে-কারার হয়ে তিনি নেমে এসেছিলেন ছাফা পাহাড় থেকে এবং ছুটে গিয়েছিলেন দূরের মারওয়া পাহাড়ের দিকে, কিন্তু কোথায় কাফেলার ঠিকানা! কোথায় পানির নিশানা!!
***
পাঁচ বছর বড় দীর্ঘ সময়। যে কোন সময় মৃত্যু এসে আমাকে নিয়ে যেতে পারতো সঙ্গে করে। এত দিনে শরীর স্বাস্থ্যের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। বয়সের দুয়ারে বার্ধক্য কিছুটা আগেই ‘লাঠি ভর করে’ এসে হাজির হয়েছে; অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে দুর্বলতার ছাপ পড়েছে। তবু এ পাঁচ বছর আমি বেঁচে আছি, কারণ এখনো হয়নি মৃত্যুর সময়। মৃত্যুর সময় হলে মউতের ফিরেশতা হাযির হয়ে যায়। ঠিক সময়ে, একমুহূর্ত আগেও না, পরেও না।
আমি বেঁচেছিলাম, দীর্ঘ পাঁচবছর পর আল্লাহ আবার আমাকে এনেছেন; তাঁর ঘরের তাওয়াফ করিয়েছেন। আবার আমি আল্লাহর ঘর দেখেছি, আবার যমযমের শীতল পানি পান করেছি। আবার আমি হাযির হয়েছি ছাফা-মারওয়ার এই পবিত্র স্থানে যেখানে মাতৃমমতার ব্যাকুলতা ও অস্থিরতার এবং .. এবং মায়ের বুকের মমতা যার দান তাঁর দয়া করুণার সিণগ্ধতম প্রকাশ ঘটেছিলো।
এখন এখানে উন্মুক্ত আকাশ নেই, তখন ছিলো। আকাশ দেখেছিলো সেই দৃশ্য। মায়ের অস্থির মমতা, গায়বের দয়া ও করুণার বর্ষণধারা এবং যমযমের উচ্ছ্বসিত ফোয়ারা দেখে আকাশ কত মুগ্ধ হয়েছিলো?! আকাশের সঙ্গে আমার যদি মিতালি হতো, আকাশের কাছে জানতে চাইতাম, কেমন ছিলো সে দৃশ্য এবং কেমন লেগেছিলো আকাশের?! এখন কি আকাশের কষ্ট হয় ছাদের আবরণে সেই পবিত্র স্থানটি তার দৃষ্টি থেকে ‘আড়াল’ পড়েছে বলে?!
আমি কি জানতাম, আবার আসবো আল্লাহর ঘরে?! আবার দেখবো কালো গিলাফের জান্নাতি জামাল?! আমার জীবনে আবার হবে ছাফা-মারওয়ার দৌড়?! জানতাম না, তবে আল্লাহ দয়া করেছেন; দয়া করে আল্লাহ আমাকে এনেছেন।
আমি জানি না আগামীকাল কী হবে। আমি কি হাজির হতে পারবো মিনার প্রান্তরে, আরাফার মরুভূমে, জাবালে রহমতের পাদদেশে? জানি না। মৃত্যু আমার থেকে কত দূরে আমি জানি না। শুধু জানি, আমার আল্লাহ বড় দয়াবান, বড় মেহেরবান। তাঁর ফায়ছালা আমার জন্য মঙ্গল ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না।
ধীরে ধীরে ছাফা পর্বতে আরোহণ করলাম। সেই ছাফা এখন আর নেই, আছে তার একটু উঁচু চিহ্ন। সেই সামান্য চিহ্নটুকু হৃদয়ে এখন আবেগের এমন তরঙ্গ সৃষ্টি করে! সেই তরঙ্গে দোল খেয়ে খেয়ে আমি যেন ভেসে যাই সুদূর অতীতে! নাই বা থাকুক ছাফা পাহাড় আমার চোখের সামনে; হৃদয় তো আছে! এবং আছে ভাবের তরঙ্গ ও আবেগের ঢেউ! আছে ইশকের মউজ ও প্রেমের জোয়ার!! আমি তো দেখতে পাই সুদূর অতীতের ছবি! মাতৃমমতার ব্যাকুলতার সেই পবিত্র দৃশ্য!! এখানে কোরায়শের সমাবেশে উচ্চারিত তাওহীদের যে আহবান, আমি তো শুনতে পাই তার প্রতিধ্বনি! এমনকি আবুলাহাবের উদ্ধত গর্জনও বাজে আমার কানে!!
চোখের দেখা যাদের কাছে বড় দেখা, আমি কেন তাদের দলে পড়ে থাকবো! হৃদয়ের দৃষ্টিতে যারা বর্তমানকে ছাপিয়ে অতীতকে দেখতে পায়, আমি কেন তাদের কাতারে শামিল হবো না! আমি কেন তাদের মত হওয়ার চেষ্টা করবো না!!
ছাফা পর্বতে আরোহণ করে বাইতুল্লাহর অভিমুখী হয়ে দাঁড়ালাম। চোখের তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে আল্লাহর ঘর দেখার চেষ্টা করলাম। এখানেও আড়াল! অতীত তো অতীত, বর্তমানও এখন চোখের আড়ালে থেকে যায়। বাইতুল্লাহর কালো গিলাফের কিছুটা আভাস শুধু দেখতে পেলাম। মাসনূন দোয়া পড়ে সমতলে নেমে এলাম। শুরু হয়ে গেলো ছাফা-মারওয়ার মাঝে আমার ছাঈ। না, আমি একা নই। লাখো আশিকানের বিপুল তরঙ্গ ছাফা থেকে গড়িয়ে নামছে, সমতল বেয়ে চলেছে, আবার মারওয়ায় গিয়ে উজানে উঠছে। আমি শুধু সেই স্রোতে নিজেকে বিলীন করে দিলাম। মহাকালের মহাস্রোতে ভেসে যাওয়ার সে কী আনন্দ! সাগর আমি দেখিনি এবং শুনিনি সাগরের আওয়ায, তবে এখানে এই সাগরের আওয়াযে আমার সর্বসত্তা যেন আচ্ছন্ন হয়ে থাকলো। সেই আচ্ছন্নতা থেকে আমি জেগে উঠলাম যখন মারওয়ায় এসে আমার সাঈ শেষ হলো। সেই তরঙ্গের কিন্তু শেষ নেই। ঢল গড়িয়ে নামছে, সমতল বেয়ে চলছে, উজান বেয়ে উঠছে, আবার গড়িয়ে নামছে। এধারা চলছে, চলবে এবং চলতেই থাকবে। ধন্য তুমি মা হাজেরা, ধন্য তোমার মাতৃমমতা! আমাদের এই নিষ্প্রাণ অনুকরণে তোমার ব্যাকুলতার কিছু ছাপ যেন পড়ে, আল্লাহ যেন কবুল করেন, আমীন।
ছাফার মত মারওয়া পাহাড়েরও সামান্য কিছু স্মৃতিমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। এটা অবশ্য করা হয়েছে এযুগের দুর্বল হাজীদের সুবিধার দিকে লক্ষ্য রেখে। সবকিছু যদি আগের মত থাকতো, আধুনিক আরাম আয়েশে অভ্যস্ত আমাদের মত হাজীদের হজ্ব করা তাহলে সত্যি অনেক কঠিন হতো। সুতরাং এসব বিষয় নিয়ে সমালোচনা যত কম করা যায় তত ভালো।
মারওয়ার উঁচুতে দাঁড়িয়ে কা‘বামুখী হয়ে অনেকক্ষণ দু‘আ করলাম। আল্লাহর পেয়ারা নবী সাঈ শেষ করে এখানে দাঁড়িয়ে দু‘আ করেছিলেন। তাঁর দু‘আ শুধু নিজের জন্য ছিলো না, ছিলো উম্মতের জন্য; কেয়ামত পর্যন্ত যত উম্মত আসবে সবার জন্য, নেককার ও বদকার সবার জন্য। তাহলে আহা কী শান্তি! কত বড় সান্ত্বনা! তিনি তো দু‘আ করেছেন আজ এখানে মারওয়ায় দাঁড়িয়ে থাকা গোনাহগার এই অধম উম্মতিরও জন্য!!
তাহাজ্জুদের তখন প্রায় শেষ সময়। মাতাফে ফিরে এসে আল্লাহর ঘরের সামনে কয়েক রাকাত নামায আদায় করলাম। আযান হয়ে গেলো। বাইতুল্লাহর আযান পাঁচ বছর পর আবার শোনার তাওফীক হলো। ‘পিপাসার্ত’ কানে আবার যেন মধু বর্ষিত হলো। আযান শেষ হলো, কিন্তু আযানের স্বাদ ও মিষ্টতা শেষ হলো না। কানের ‘জিহবায়’ যেন তা লেগেই থাকলো। এখন তো মদীনা শরীফে মসজিদে নববীতেও আযান হয়েছে। আবার সৌভাগ্য হবে তো এই গোনাহগার উম্মতির, নবীর শহরে নবীর মসজিদের আযান শোনার?!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)