ই উ রো প : নরওয়ে থেকে লন্ডন : নিজেকে পোড়ানোর আগুন
নরওয়ের রাজধানী অসলোর প্রাণকেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কাছে স্থানীয় সময় বিকাল চারটায় ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। ঘটনাটি ঘটে গত ২২ জুলাই। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ৭ জন মারা যায়। আহত হয় কমপক্ষে আরও ১৫জন। এ ঘটনার প্রায় ঘণ্টাখানেক পর অসলো থেকে আশি কিলোমিটার দূরে অটোইয়া দ্বীপে বন্দুকের গুলিতে একজনমাত্র যুবক হত্যা করে ৮৫ জনকে। গণমাধ্যমের সূত্রে মুহূর্তের মধ্যেই ভয়ংকর ঘটনা দুটির খবর সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।
এরপরই শুরু হয় সেই বহুল চর্চিত উপাখ্যানের পুনরাবৃত্তি। এ ঘটনার পেছনে আলকায়েদা কিংবা উগ্রপন্থী মুসলমানদের হাত রয়েছে বলে সন্দেহ ব্যক্ত হতে থাকে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম থেকে নিয়ে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাব পর্যন্ত। গোয়েন্দাদের কাজ গল্পকারদের হাতে চলতে চলতে চবিবশ ঘণ্টা পেরোনোর আগেই আসল ঘটনা ও ঘটনার নায়ক সামনে চলে আসে। তখন প্রকাশ হয়ে যায় প্রচারণা-পারদর্শী ও বিদ্বেষ-বিশারদ ইউরোপের আত্মঘাতী এক কদাকার চেহারা।
নরওয়ে-হত্যাকান্ডে জড়িত যুবকের নাম অ্যান্ডারস বেহরিং ব্রেইভিক। ৩২ বছর বয়সের এই যুবক হচ্ছে একজন খ্রিস্টান-চরপন্থী। ইসলাম ও মুসলমানদের উগ্রবিদ্বেষী হিসেবে তার পরিচয় উঠে আসে রয়টার্স-বিবিসির বিবরণে। সে ইসলাম বিরোধী ব্লগে লেখালেখি করত। ইউরোপে মুসলিম এশিয়ানদের অভিবাসন বিরোধী একটি রাজনৈতিক দলের সদস্য সে। তাছাড়া ইউরোপে বহু সংস্কৃতিবাদেরও সে ছিল কট্টর সমালোচক। এজন্যই অভিবাসনের পক্ষের দলের তরুণ-তরুণীদের ওপর ঘৃণা ও আক্রোশে সে এই বর্বরোচিত হামলা চালায়। এ হামলায় বহু মানুষের মৃত্যুর পর নরওয়েতে শোকাকুল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। বের হয় শোক শোভাযাত্রা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, পশ্চিমা দেশগুলোতে গত এক দশকের মুসলিম বিরোধী উগ্র প্রচারণায় তৈরি অগ্নিকুন্ডের এটি একটি ভয়ঙ্কর স্ফুলিঙ্গ। এ আগুনের সব কটি শিখা জ্বলে উঠলে ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি অকল্পনীয় রকম ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। হায়!
পশ্চিমারা নিজেদের তৈরি করা দৈত্যের হাতে এখন নিজেরাই শেষ হতে চলেছে।
কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, ইউরোপজুড়ে কেবল আল কায়েদা আর তথাকথিত জঙ্গিবাদের ভূত খোঁজার এককেন্দ্রিক মনোযোগের কারণে অপর প্রান্তে গড়ে ওঠা বিষবৃক্ষ বর্তমানে মহীরুহে রূপ নিয়েছে। এ ঘটনায় হয়ত ইউরোপের দেশগুলো নিজেদের অভ্যন্তরীণ ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অন্তর্ঘাতমূলক উপলক্ষগুলোর দিকে নতুন করে মনোযোগ দেওয়ার কর্মপন্থা গ্রহণ করবে।’ পর্যবেক্ষকরা যাই মনে করুন, বাস্তবতা বলছে অন্য কথা। নরওয়ের ঘটনার পাঁচদিন পর ২৬ জুলাই বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম হেগ বিবিসিকে বলেছেন, সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি সমান মনোযোগ নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু ওই বক্তব্যেই তিনি আবার দাবি করেন, আলকায়েদাই তার দেশের জন্য বড় হুমকি। সত্যটাকে এক মুখে স্বীকার করলেও অন্য মুখে তা আড়াল করছেন। অর্থাৎ মন থেকে মুসলিম বিদ্বেষ দূর হয়নি। পাঁচদিন আগে নরওয়ের উগ্র মুসলিম বিদ্বেষী যুবকের ভূমিকা থেকে শিক্ষা গ্রহণের বহু সুযোগ থাকলেও বৃটেনের পক্ষে যথাযথভাবে তা গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। কাকতালীয়ভাবে নরওয়ের ঘটনার প্রায় দু সপ্তাহ পর ব্রিটেনের রাজধানী লন্ডনে শুরু হয় ব্যাপক সহিংসতা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের এক নারকীয় পর্ব। টানা চার দিন পর বিপুল সংখ্যক পুলিশ নামানোর কারণে লন্ডন কিছুটা শান্ত হলেও ব্রিটেনের অন্যান্য শহরে সহিংসতা চলেছে আরও কয়েকদিন। পুলিশের গুলিতে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক নিহত হওয়ার পর এ সহিংসতা শুরু হয়। এতে ব্রিটেনের আইন-শৃঙ্খলা ও সামাজিক অসহনশীলতার এক নগ্ন চিত্র প্রকাশ হয়ে যায়। ঘটনার সময় কোনো কোনো দেশের পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ব্যর্থরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণারও দাবি উঠে।
লন্ডনের সহিংসতা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ক্ষেত্রেও বীভৎস সে সত্যটি ধরা পড়ে। নিজেদের যে কোনো ক্ষয়-অবক্ষয়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে অপরের পেছনে বেশি লেগে থাকলে নিজের চুলার আগুনে নিজের ঘরই পুরে ছারখার হয়ে যায়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখে ‘আলকায়েদাই তার দেশের জন্য বড় হুমকি’ উচ্চারিত হওয়ার দশ-বার দিনের মাথায় লন্ডন সহিংসতা প্রমাণ করে দিল বড় হুমকি নিয়ে ব্রিটিশদের উপলব্ধিতে বড় রকম গলদ রয়েছে। অপরের ছিদ্র খুঁজতে খুঁজতে তারা নিজেরাই এখন ‘সভ্যতার চালুনি’ পরিণত হয়েছে। লন্ডনের বীভৎস সহিংসতার ওপর চোখরাখা বিশ্লেষকদের অনেকের দাবি, লন্ডনের ঘটনা ছিল যুগ যুগ যাবত চলা বর্ণবাদ ও বৈষম্যের একটি অনাকাঙ্খিত অথচ স্বাভাবিক ফল।
ব্রিটিশ সমাজে নিজেদের বর্ণবাদহীন উদার একটি চেহারা তুলে ধরার চেষ্টা চালু থাকলেও সত্য হচ্ছে, সাদা-কালোর বৈষম্য সেখানে প্রকটভাবে সক্রিয়।
মূলত কাছাকাছি সময়ে নরওয়ে ও লন্ডনের দুটি দুর্ঘটনাই বর্তমান সময়ে পশ্চিমা দেশগুলোর লালিত হিংসা ও বৈষম্যের চেহারাটা উলঙ্গ করে দিয়েছে। নিজেদের তৈরি করা দৈত্যের কামড়ে এখন তারা নিজেরাই ক্ষত-বিক্ষত হতে শুরু করেছে। চিন্তা, প্রচার, নীতি ও কর্মপন্থায় প্রকৃত সভ্যতা অবলম্বন না করলে তারা এখন নিজেরাই নিজেদের কামড়ে শেষ করতে থাকবে। অন্য জাতিকে মারতে সৈন্য পাঠিয়ে, অপর দেশ ধ্বংস করতে বোমা ফাটিয়ে তারা নিজেদের আর বাঁচাতে পারবে না। সত্যটা তারা বুঝুক। তারাও বাঁচুক, পৃথিবীও বাঁচুক।