বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১৭
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সংশ্লিষ্টদের আচরণেও ছিলো আমাদের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা। ভিতরের ক্ষোভ কারো কারো মুখেও এসে যায়। আসাটাই স্বাভাবিক। তবে ঐ যে বললাম, পরীক্ষা! দু’একজনকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ভাই! এরা হলেন সউদী আরবের মানুষ। তো আমরা কি এদের দেশে, এদের কাছে এসেছি? না; আমরা তো এসেছি হিজাযের ভূমিতে, আল্লাহর ঘরে, আল্লাহর নবীর দেশে। তো এটা কী শুধু আমাদের মুখের দাবী, না হৃদয়েরও আকুতি, আল্লাহ একটু পরীক্ষা করে দেখতে চান। শুরুতেই আমরা যেন ইশক ও মুহববতের পরীক্ষায় বে-কামিয়াব না হই; যে জন্য এসেছি এবং যার জন্য এসেছি আমরা যেন তাতেই নিবেদিত থাকি।
কথাগুলো দেখলাম, কারো কারো হৃদয়কে স্পর্শ করলো। বোঝার মানুষ কম, এটা যেমন সত্য, বোঝানোর মানুষ আরো কম, এটাও সত্য।
একটা বিষয়ে খুব ভয়ের মধ্যে ছিলাম। বিমানে থাকা অবস্থায় ইমাম ছাহেব তার পিছনের সফরের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন, পাসপোর্টে সিলছাপ্পড় নিয়ে একজন একজন করে বের হচ্ছে আর সউদী কর্মকর্তারা ধরে ধরে প্রতিষেধক ইনজেক্শন প্রয়োগ করছে। যতই বলা হচ্ছে এবং ছাড়পত্র দেখানো হচ্ছে যে, আমরা তো দেশ থেকেই প্রতিষেধক নিয়ে এসেছি, ভদ্রলোকেরা সেকথা কানেই তুলছে না। প্রায় বলপ্রয়োগ করেই নির্বিচারে প্রতিষেধক প্রয়োগ করছে। এটা তো মারাত্মক ব্যাপার ‘ওভারডোজ’-এর কারণে যদি গুরুতর কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়! ইমাম ছাহেব নাকি অনেক বুঝিয়ে ব্যক্তিগতভাবে রেহাই পেয়েছিলেন।
এবার অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি, আলহামদু লিল্লাহ! তবে সামান সংগ্রহ করতে গিয়ে নযীরবিহীন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হলো।
আমরা এসেছিলাম একেবারে শেষে। অন্যরা যার যার সামান নিয়ে বের হয়ে গেছে। ইমাম ছাহেবের সামান পাওয়া গেলো সহজেই। গোল বাঁধলো আমার বেলা। ব্রিফকেসটা ছিলো হাতে। অপেক্ষাকৃত বড় ব্যাগটা দেয়া হয়েছে সামানের সঙ্গে, সেটার কোন হদীস নেই। শীতের কাপড়চোপড় সবই ঐ ব্যাগে।
সিরিয়ার হাজী ছাহেবানের সামান আসা শুরু হয়ে গেছে। আমার ব্যাগ গেলো কোথায়?! কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এককর্মকর্তাকে পেয়ে সমস্যার কথা বললাম। ভদ্রলোক অজ্ঞতা এবং অপারগতা দু’টোই প্রকাশ করলেন নির্লিপ্তভাবে; যেন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, কয়টা বাজে, আর তিনি বলছেন, সঙ্গে ঘড়ি নেই!
শেষে জানতে চাইলাম, কোথায় যোগাযোগ করতে পারি। তখন তিনি কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে বললেন, তোমার সামান হয়ত বাইরে চলে গেছে অন্য সামানের সঙ্গে। বাইরে গিয়ে খোঁজ কর।
অদ্ভুত কথা! এটা তো দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার মত হলো! আমি ছাড়া আমার সামান বাইরে যাবে কেন এবং কীভাবে? ভদ্রলোক কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন।
এবার ল্যাগেজ চেক করার ব্যবস্থা ছিলো বেশ উন্নত। খোলার ঝামেলা নেই এবং সময়ের অপচয় নেই। স্বয়ংক্রিয়ভাবে চেক হয়। সন্দেহজনক কিছু দেখা গেলে শুধু সামান খুলতে বলা হয়। বিষয়টি বেশ স্বস্তিদায়ক, কিন্তু সামানই যদি হারিয়ে যায়, স্বস্তি আর থাকে কোথায়?!
আমি ধরে নিলাম, সামান আর পাওয়া যাচ্ছে না। মনটা মুষড়ে পড়লেও মানসিকভাবে প্রস্ত্তত হলাম পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য। আল্লাহর যা ইচ্ছা তাই তো হবে!
চিন্তিত ও পেরেশান অবস্থায় বের হয়ে এলাম আমি ও ইমাম ছাহেব। সামান হারানোর কথা শুনে সফরসঙ্গীরাও পেরেশান হলেন এবং সান্ত্বনার বিষয়, তাদের পেরেশানি ছিলো আমার চেয়ে বেশী। যতই না করলাম, তারা শুনলেন না; উঠেপড়ে লেগে গেলেন যাত্রীদের সামানের মধ্যে আমার হারানো সামান খুঁজতে। খুব খারাপ লাগছিলো যে, আমার কারণে সবাই কষ্টে পড়ে গেলেন, বিশেষ করে মহিলারা। সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, হয়ত এটাই আল্লাহর ইচ্ছা যে, বে-সামান অবস্থায় আমার সফর হবে। হয়ত এতেই রয়েছে আমার জন্য কল্যাণ। কিন্তু তাদের এককথা, শেষ পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করে দেখবো। কিন্তু কথা হলো চেষ্টা করা হবেটা কীভাবে এই জনসমুদ্রে এবং ‘সামান-সাগরে’! তাছাড়া আমার একটা বোকামিও আছে এখানে। সামানের গায়ে নাম-ঠিকানা কিছুই লেখা নেই। একজন কৌতুক করে বললেন, এটা তো বরং বুদ্ধির কাজ হয়েছে। আমাদের তালাশ করাটা এখন সহজ হবে; শুধু দেখবো কোন ব্যাগে নামঠিকানা লেখা নেই।
ভালো কথা। ‘সহজ’ কাজটা করা হলো, কিন্তু কাজ হলো না। আমি বললাম, হলো তো! এবার ক্ষান্ত দিন। শুধু শুধু কষ্ট করা হলো।
কিন্তু ভাই আব্দুল বাকী, আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন। সফর থেকে ফিরে আসার পর আমার সঙ্গে এখনো তিনি সেই দ্বীনী সম্পর্ক রক্ষা করে চলেছেন। তিনি বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, আমার মন বলছে, আপনার সামান হারাতে পারে না, আমি শেষবারের মত একটু দেখে আসি। তিনি দেখতে গেলেন এবং ... এবং আশ্চর্য, সামানসহ ফিরে এলেন! আনন্দ-উচ্ছ্বাসে আমার তখন চোখে পানি এসে পড়ার অবস্থা! যদি আদবের খেলাফ হয়, আল্লাহ মাফ করুন, আমার মনে পড়ে গেলো মরুভূমির সেই মুসাফিরের হারিয়ে যাওয়া উট ফিরে পাওয়ার কথা। হতাশার যখন চূড়ান্ত, তখন চোখ খুলে দেখে ...!
কীভাবে পাওয়া গেলো?! ভাই আব্দুল বাকী বললেন, একস্থানে দেখি, দশবারোজন মাঝখানে সামান রেখে গোল হয়ে বসে আছেন। আমার মন কেন জানি বললো, এখানে দেখা দরকার। কিন্তু তারা বিরক্তির স্বরে বললো, এখানে আপনার সামান আসবে কোত্থেকে? তাদের বিরক্তি অগ্রাহ্য করেই তালাশ শুরু করলাম। শুধু ‘চাকাওয়ালা’ ব্যাগ দেখছি, আর দেখছি নামঠিকানা আছে কি না? হঠাৎ দেখি, এটাতে নামঠিকানা নেই। জানতে চাইলাম, এটা কার? সবাই চুপ, অর্থাৎ কারো নয়? ট্যাগ নম্বর মিলিয়ে দেখি, মিলে যাচ্ছে! হাজি ছাহেবান তখন বললেন, ঠিক আছে, আপনার
হলে নিয়ে যান। আশ্চর্য, দুঃখ প্রকাশ করা দূরের কথা, সামান্য একটু অপ্রস্ত্তত হওয়ার অভিব্যক্তিটাও কারো মধ্যে প্রকাশ পেলো না!
সফরে সফরসঙ্গীরা যদি অন্তরঙ্গ হয়, এভাবেই আল্লাহর রহমত নাযিল হয়, এটা আমি বারবার দেখেছি। সেদিন আমি মনে মনে খুব লজ্জা পেয়েছিলাম একথা স্মরণ করে যে, ঊনিশ বছর আগে হজ্বের সফরে মরহূম শামসুল হক টিকেট, পাসপোর্ট ও টাকা হারিয়ে ফেলেছিলেন, কিন্তু আমি এরকম আন্তরিকতার পরিচয় দিতে পারিনি। হয়ত কিছুটা বিরক্তিও প্রকাশ পেয়েছিলো আমার আচরণে। আল্লাহ মাফ করুন এবং মরহূমের দরজা বুলন্দ করুন, আমীন।
দুঃখ প্রকাশ করার যে বিষয়টি ভাই আব্দুল বাকী বললেন, সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। প্রথমত এসব বিষয়ে আমাদের খুবই সতর্ক থাকা উচিত। আমি যেন কখনো কোনভাবে ঘরে এবং সফরে, বিশেষ করে হজ্বের মত মুবারক সফরে কারো পেরেশানির কারণ না হই। তবে মানুষমাত্রই ভুল হতে পারে, কিন্তু আমাদের উচিত ভুল প্রকাশ পাওয়ামাত্র আন্তরিকভাবে মাফ চেয়ে নেয়া, অন্তত দুঃখ প্রকাশ করা। ‘সরি’ শব্দটি ইংরেজ-জাতি এমনভাবে রপ্ত করেছে যে, এটি তাদের জীবন ও সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে। এটা খুব ভালো; এটা ইসলামের শিক্ষা। আমরা ফেলে দিয়েছি, তারা তুলে নিয়েছে। আমরা পিছিয়ে পড়েছি, তারা এগিয়ে গেছে।
‘হজ্বটার্মিনালে’ এখন আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে মক্কা-অভিমুখী বাসের জন্য। অপেক্ষা ও প্রতীক্ষার প্রহর সবসময় শুনে এসেছি বড় কষ্টের। অনেকে অনেকভাবে সেই কষ্টের কথা প্রকাশও করলেন। আমার কিন্তু আজ অন্যরকম অনুভূতি হলো। দীদারের স্বাদ ও লযযত তো আমার সামনে আছে ইনশাআল্লাহ। সেটা পেয়ে গেলে তো পাওয়া হয়েই গেলো। কিন্তু তখন তো আর দীদারের ইনতিযারের স্বাদ ও লযযত থাকবে না।
সুতরাং প্রতীক্ষার প্রহর যদি দীর্ঘ হয়েই যায়, ক্ষতি কী! দীদারের আনন্দ লাভের পূর্ব পর্যন্ত আমি তো দীদারের ইনতিযারের স্বাদ পেতে থাকবো! এবং সত্যি সত্যি আমার কাছে সেটা তখন মনে হলো অনাস্বাদিতপূর্ব!
চারদিকে লোকে লোকারণ্য। ইহরামের সাদা লেবাসের কারণে চারপাশে যেন শুধু শুভ্রতার তরঙ্গ!
মাঝে মধ্যে অন্য পোশাকের আনাগোনায়, অন্য মানুষের ছোটাছুটিতে কিছুটা ছন্দপতন ঘটে। তবে যারা ডুবে থাকে তাদের তাতে কিছু আসে যায় না।
আমরা বসে আছি তো বসেই আছি। কী এক ব্যবস্থাগত সমস্যার কারণে আমাদের গাড়ীর ইনতিযাম হয় না, ডাকও আসে না।
কাফেলার পর কাফেলা যাচ্ছে আমাদের সামনে দিয়ে;
হিন্দুস্তান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং কাহাঁ কাহাঁ মুলুকের কত কাফেলা! তাদের চলার মধ্যে কি অপূর্ব ছন্দ ও তরঙ্গ! ভাবে অভিব্যক্তিতে কী উদ্ভাস, কী উচ্ছ্বাস! আমি শুধু
দেখে যাচ্ছি অভিভূত হৃদয়ে এবং বিমুগ্ধ দৃষ্টিতে। সত্যি বাইতুল্লাহর মুসাফিরদের এই যে ব্যস্ততা ও চঞ্চলতা, কাফেলার পর কাফেলার এই যে গতি-তরঙ্গ তা দেখারও আলাদা একটা স্বাদ আছে, আনন্দ আছে!
কোন কোন মায়ের কোলে দুধের শিশু। ‘তিনি’ও এসেছেন নিজের অজান্তেএবং ‘আলহাজ’ হয়ে ফিরে যাবেন, তাও নিজের অজান্তে। কষ্ট যা হবার হবে মায়ের। তিনি তো থাকবেন মায়ের নিরাপদ কোলে, মায়ের বুকের স্পন্দনের একেবারে কাছে। তার কি কোনদিন সৌভাগ্য হবে বুড়ি মাকে পিঠে করে হজ্ব করাবার, আল্লাহর ঘর তাওয়াফ করাবার?! একসফরে অবশ্য এমন এক সৌভাগ্যবান সন্তানের দেখা পেয়েছিলাম, যিনি বলেছিলেন, পঞ্চাশ বছর আগে এই মা আমাকে কোলে করে হজ্ব করেছেন, এবার সেই মাকে আমি হাত ধরে ধরে হজ্ব করিয়েছি। মা অনেক খুশী হয়েছেন, অনেক দু‘আ দিয়েছেন।
আমি যখন কোন মাকে দেখি, রাজপ্রাসাদে, রাজপথে, ফুটপাতে, বস্তির কুঁড়েঘরে; বাংলাদেশে, মক্কায়, মদীনায়; যখন সন্তানকোলে
কোন মাকে দেখি, আমার হৃদয় কৃতজ্ঞতায় আপ্লুত হয়। আমি তখন শিশু হয়ে যাই এবং নিজেকে মায়ের কোলে অনুভব করি। কী পরিমাণ মমতা আল্লাহ দান করেছেন মায়ের বুকে, মাতৃহৃদয়ে! মায়ের কোলের এই শিশু কি কোনদিন কষ্ট দিতে পারে এমন মাকে! কোন কারণে, কোন যুক্তিতে!! অথচ এমনই হয়। এই পৃথিবী যেমন অবলোকন করেছে বহু দৃশ্য মাতৃমমতার তেমনি দেখেছে অনেক দৃশ্য মায়ের প্রতি সন্তানের নির্মমতার। তবু এখনো প্রতিটি সন্তানের জন্য আছে মায়ের কোল, আছে মায়ের বুক এবং সেই বুকে আছে দুধের ধারা।
কলিজার টুকরো সন্তানকে কোলে নিয়ে বাইতুল্লাহর সফরে আসা মা ততক্ষণে চলে গেছেন অনেক দূরে, আমাকেও মায়ের মমতায় সিক্ত করে, মায়ের প্রতি নিবেদিত হওয়ার শিক্ষা দিয়ে। দূর থেকেই মনে মনে উচ্চারণ করলাম, মা, তোমাকে সালাম। কোলের সন্তান যেন তোমার সুখের, শান্তির ও আনন্দেরই কারণ হয়, কখনো যেন তোমার দুঃখের, কষ্টের ও বেদনার কারণ না হয়।
দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি ছিলো, তবে অবসাদ ছিলো না এবং চোখে ঘুম ছিলো না। আমরা আল্লাহর ঘরের মেহমান। ইহরামের লেবাস পরিয়ে কত সম্মান করে আল্লাহ আমাদের তাঁর ঘরের পথে এ পর্যন্ত এনেছেন। এখন আল্লাহ আমাদের জন্য গাড়ী পাঠাবেন একেবারে তাঁর ঘরের দুয়ার পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার জন্য। মাওলার পক্ষ হতে কত সম্মান! কত মায়া, কত দয়া!! তারপর কি আর সাজে অসহিষ্ণু হওয়া!
ইমাম ছাহেবকে বলে একটু নিরালায় গিয়ে ক্লান্ত শরীরটা এলিয়ে দিলাম। একটুকরো আকাশ এবং একটি তারা দেখতে পেলাম। খুব ভালো লাগলো। হজ্বটার্মিনালের ভিতর থেকেও আকাশ দেখা যায়। এজন্য খুব ভালো লাগে। নকশাটা করা হয়েছে মরুভূমির তাঁবুর মত করে।
যেন সারি সারি তাঁবু। আধুনিক তাঁবু, তবে অতীতের অনুভব জাগ্রত করে। আকাশ থেকে দেখতে খুব সুন্দর লাগে, তবে ভিতর থেকে মাঝখানের ফাঁক দিয়ে একটু করে
আকাশ দেখা যায় বলে আরো সুন্দর লাগে। এটা ভাবতেও ভালো লাগে যে, এই টার্মিনাল ভবনের ডিজাইন ও নকশা করেছেন বাংলাদের কৃতি সন্তান মরহূম ফযলুর রহমান খান। (জানি না, এফ আর খান বলার কী প্রয়োজন!)
শুনেছি, আমেরিকার কোন এক গগনচুম্বী টাওয়ারের ডিজাইনও তারই করা, আর সেটা নাকি আধুনিক স্থাপত্যজগতের বিস্ময় এবং তার আন্তর্জাতিক
খ্যাতির কারণ। তিনি এখন পৃথিবীতে নেই; তবে তার নকশা করা তাঁবু আকারের হজ্বটার্মিনাল রয়েছে। শুনেছি এই জিদ্দাতেই বিমানের অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং
ইন্তিকাল করেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন, আমীন।
তাঁবু আকারের ছাদের গোল ফাঁক দিয়ে একফালি আকাশ এবং একটি তারা দেখতে পেলাম। হিজাযের আকাশে হিজাযের তারা এই প্রথম দেখা হলো, খুব ভালো লাগলো। আশা করি, আজ রাতে এই তারকার অস্ত যাওয়ার আগেই দীদারে বাইতুল্লাহ নছীব হবে। কেমন সুমধুর হবে আল্লাহর ঘরকে প্রথম দেখার শুভমুহূর্তটি! কেমন হবে তখন আমার হৃদয়ের অনুভূতি ও বুকের স্পন্দন!! আবেগে আনন্দে আমি কি আত্মহারা হয়ে যাবো?! নির্বাক হয়ে যাবো, দু‘আ পড়তেও ভুলে যাবো?!
হে আল্লাহ, আমার কলব ও রূহের, আমার হৃদয় ও আত্মার তো কোন প্রস্ত্ততি নেই তোমার ঘরের যিয়ারত-সৌভাগ্য অর্জনের! যতটুকু সময় এখনো আছে, হে আল্লাহ তুমি তাওফীক দাও প্রস্ত্তত হওয়ার, অর্জন করার এবং ধন্য হওয়ার।
ইমাম ছাহেব খবর দিলেন, গাড়ী এসে গেছে বাইতুল্লাহর অভিমুখে রওয়ানা হওয়ার! বাসের আসন- সংখ্যা পঞ্চাশ। আমরা মাত্র তেরজন। তাই আমাদের কাফেলা এবং শ্রীলঙ্কার একটি কাফেলার জন্য বরাদ্দ হলো একটি বাস।
দু’টি দেশের দুই ভাষার দু’টি কাফেলার সম্মিলিত তালবিয়া-ধ্বনির মধ্য দিয়ে বাসের যাত্রা শুরু হলো আল্লাহর ঘরের উদ্দেশ্যে।
এই সুযোগে অন্য দেশের অন্য ভাষার কয়েকজন মুমিন ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলো। পরিচয় মানে সালাম-বিনিময়, পরস্পরের জন্য শান্তিকামনা, আর একটু হাসি, যে হাসি সকল ভাষার সকল
মানুষের মুখে অভিন্ন। কারণ হাসি তো মুখের ভাষার অংশ নয়, হাসি হলো হৃদয়ের অনুভূতির অংশ, যা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় এবং হৃদয়ের জন্য নিবেদিত হয়। তাই মুখের ভাষায় কিছু বলা সম্ভব না হলেও মনে হলো একটুকরো হাসির মাধ্যমে অনেক কিছু বলা হলো এবং অনেক কিছু অনুভব করা হলো। আরো মনে হলো, আমরা অনেক কাছাকাছি হলাম, যতটুকু কাছে
বসে আছি তার চেয়ে বেশী কাছাকাছি। কেন নয়! আমরা তো আল্লাহর ঘরের যাত্রী, বাইতুল্লাহর মুসাফির। আমাদের সফরের শুরু ভিন্ন ভিন্ন, কিন্তু সফরের মন্যিল তো অভিন্ন, আল্লাহর ঘর, বাইতুল্লাহ! মানযিলের অভিন্নতা তো ইহরামের শুভ্রতা
থেকেই প্রকাশ পেয়েছে, এবার তা প্রকাশ পেলো সবার মুখের লববাইক উচ্চারণে।
পথ এমনই মসৃণ যে, বাসের চলায় কোন ‘দুলুনি’ নেই, কিন্তু মনে হলো সবারই হৃদয় আনন্দে উদ্বেলিত,
অপূর্ব একতরঙ্গে আন্দোলিত। তাই উচ্ছ্বাসভরা
কণ্ঠে আমাদের কাফেলার আমীর ছাহেব যখন উচ্চারণ করলেন হাযিরির ও বন্দেগির ইবরাহিমী তালবিয়া, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারীকা লাকা লাববাইক ... তখন ঈমানের একটি বিদ্যুৎ-তরঙ্গ যেন বয়ে গেলো আমাদের সবার অস্তিত্বকে উদ্দীপ্ত করে। ইমাম ছাহেবের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা উচ্চারণ করলাম, লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইক লা শারীকা লাকা লাববাইক ... অনেক সময় ধরে অব্যাহত থাকলো হাযিরির এই ঘোষণা এবং বন্দেগির তারানা।
বাসের ভিতরে আলো নিভিয়ে দেয়া হলো, কিন্তু আলো কি নিভলো? না নিভলো না, হৃদয়ের আলো যেন তাতে আরো উজ্জ্বল হলো,
কলবের নূর যেন আরো তাজাল্লি লাভ করলো। বাইরের অন্ধকারে ভিতরের জগত যেন আরো আলোকিত হলো। পথের দু’পাশের বিস্তৃত মরুভূমির সঙ্গে আমরা যেন একাকার হয়ে গেলাম। হিজাযভূমির সঙ্গে একাত্মতার এই যে পুলকানন্দ, সত্যি তা অপূর্ব!
মরুভূমির বিস্তার এবং দূরে পাহাড়ের ছায়া ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, তবু যেন কত কিছু দেখা যায়! আলোকিত মক্কা, নূরান্বিত হারাম, কালো গিলাফের বাইতুল্লাহ এবং ইহরামের শুভ্র লেবাসে আশিক-মজনুদের তাওয়াফ-তরঙ্গ!!!
আমি চলেছি, আল্লাহ আমাকে নিয়ে চলেছেন বাইতুল্লাহর দীদার লাভের জন্য, তাওয়াফের আশিকানা মউজে এবং প্রেমের তরঙ্গ-জোয়ারে শামিল হওয়ার জন্য।
বুকের ভিতরে এ কোন্ উথাল-পাতাল! হৃদয়ের স্পন্দনে শুনি কিসের ডাক! কার আহবান!!
পথ যত ফুরিয়ে আসছে,
দূরত্ব যত কমে আসছে, নৈকট্য যত নিবিড় হচ্ছে ভিতরের তোলপাড় যেন তত তীব্র হচ্ছে! আবেগের তরঙ্গ এবং
জযবার মউজ যেন তত জোরওয়ার হচ্ছে!! আমি যেন তত ডুবে যাচ্ছি, তলিয়ে যাচ্ছি! আমি যেন কোথায় কোন্ অতলে হারিয়ে যাচ্ছি!!
তাই যেন হয় হে আল্লাহ, তাই যেন হয়! তোমার ইশকের দরিয়ায়, তোমার প্রেমের সাগরে আমি যেন ডুবে যাই, তলিয়ে যাই!
এসে গেলো মক্কা শরীফের সেই সুপরিচিত প্রবেশ-দ্বার। একটি বিরাট রেহেল, তার উপর রক্ষিত কোরআন শরীফ, নীচে দিয়ে চলে গেছে সরল পথ! হয়ত বোঝানো
হয়েছে, নীচে তোমার কাবামুখী জীবনের পথ, আর সেই পথের একমাত্র পাথেয় হলো মাথার উপরে রক্ষিত কোরআন। কাজটা কতটা সুন্দর হয়েছে, কতটা সমুচিত হয়েছে সে অবশ্য ভিন্ন কথা। আসলে মনে হয়, আমাদের ভিতরের সবকিছু এখন বাইরে এসে যাচ্ছে, আর ভিতরটা হয়ে যাচ্ছে ...! কী হয়ে যাচ্ছে আল্লাহই ভালো জানেন।
আর মাত্র বিশমিনিটের পথ, কিন্তু প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতার জন্য এখানে অপেক্ষা করতে হবে কিছু সময়, কিংবা অনেক সময়। হোক না! ঘরের এত নিকটে এনে বান্দাকে তিনি যদি মিলনপূর্ব প্রতীক্ষার বেদনার স্বাদ ভোগ করাতে চান, দু’হাত পেতেই আমি নেবো তা! আমি তো শুধু চাই তাঁর পবিত্র সত্তায় চিরসমর্পিত হতে। হয়ত আমার মাওলার ইচ্ছা, বান্দা এখানে আমার ঘরের দীদার লাভের যোগ্যতা অর্জনের শেষ সুযোগটুকু গ্রহণ করুক।
একঘণ্টা পর আবার রওয়ানা; কিছুক্ষণ পর আলোঝলমল মক্কা শহর প্রথম দেখার আনন্দ, তারপর সেই আলোতে অবগাহন করে মক্কায় প্রবেশ করার অপূর্ব শিহরণ, সবই হলো যেন মধুর এক স্বপ্নের আবেশে। সেই মধুর স্বপ্ন থেকে যেন জেগে উঠলাম বাস যখন থামলো। আমরা এখন হারামের একেবারে কাছে, আল্লাহর ঘরের খুব নিকটে। ইচ্ছে হয় ছুটে যাই, ডানা মেলে এখনি উড়ে যাই! কিন্তু না; ভিতরের যত আকুলতা ও ব্যাকুলতা, সেটাকে ভিতরেই লালন করতে হবে সংযমের আবরণ দিয়ে। এটাই ইশকের আদব ও বন্দেগির তরীকা।
মিসফালার কবুতর-চত্বরে বাস থেকে নামা হলো। সমবেত কণ্ঠে আবার উচ্চারিত হলো লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক ধ্বনি! হাযির, হে আল্লাহ বান্দা হাযির, তোমার কোন শরীক নেই, তুমি লা-শারীক!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)