শাবান-রমজান ১৪৩০   ||   আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ২০০৯

বাইতুল্লাহর মুসাফির - ২৪

মাওলানা আবু তাহের মেসবাহ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) ফেরার পথে মুহসিনকে বললাম, ‘আমাদের শায়খ একটা বড় দায়িত্ব আপনার কাঁধে অর্পণ করতে চান!’ তিনি কিছুটা পেরেশান দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার কাঁধ তো এত মজবূত নয় যে, শায়খের দেয়া দায়িত্ব বহন করতে পারে, তবে সৌভাগ্য চেষ্টা অবশ্যই করবো।’ আমি বললাম, জাযাকাল্লাহ। আমার কাছে প্রেসিডেন্টের নামে শায়খের একটি ব্যক্তিগত পত্র রয়েছে। তিনি চান, এটি আমি নিজে প্রেসিডেন্টের হাতে পৌঁছে দেই। আপনি ব্যবস'া করতে পারলে শায়খ খুশী হবেন এবং আপনার জন্য দু‘আ করবেন। আমার কথা শেষ হলো না, মুহসিন বলে উঠলেন, আমি চেষ্টা করবো এবং মনে হয়, অসম্ভব হবে না। প্রেসিডেন্টের দুই পুত্র আদী ও কুসাঈ-এর গৃহশিক্ষক আমার বিশেষ বন্ধু। তার মাধ্যমে পারিবারিকভাবে দেখা হতে পারে, যদি প্রেসিডেন্ট আজই বাগদাদ ত্যাগ না করে থাকেন। আল্লাহর শোকর বিষয়টি এত আসান হবে, ভাবতে পারিনি। যা হয় তা সহজেই হয়, যা হয় না, প্রাণপণ করেও হয় না। আসলে সবকিছু পর্দার আড়াল থেকেই হয়, আমরা ফাঁদে পড়ে যাই কল্পিত যোগ্যতার। কিছুটা আশ্বস- হলাম যে, যদি কোনভাবে হযরতের চিঠি প্রেসিডেন্টের হাতে পৌঁছানো যায় তাহলে তিনি অন-ত এ সান-্বনা পাবেন যে, শেষ কর্তব্যটুকু করতে পেরেছেন। হঠাৎ মুহসিন আমাকে জিজ্ঞাসা করে বসলেন, আজকের আলোচনার ফল কী? আমি কিছুটা অপ্রস'ত। বুঝতে পারছি, এ প্রশ্নের কারণ, যুদ্ধবন্ধের বিষয়ে তার অন-রের ব্যাকুলতা। এটা শুধু তার নয়, ইরাকের বহু মানুষেরই কামনা; বিশেষ করে ইরাকের প্রবীণ শ্রেণীর। ক’দিনের সফরে অন-ত এটুকু বুঝতে পেরেছি যে, যুদ্ধ সাধারণ ইরাকীদের কাম্য নয়। আজ যদি যুদ্ধবন্ধের ঘোষণা আসে, ইরাকে উৎসবের আনন্দ হবে। আমি ইরান সফরে ছিলাম না, কিন' আমার সাধারণ বোধ বলে, সেখানেও একই অবস'া হবে। কোন দেশের সাধারণ মানুষ কখনো যুদ্ধ চায় না; বিশেষত যুদ্ধ যদি হয় এমন দীর্ঘস'ায়ী ও রক্তক্ষয়ী। মুহসিনকে কী উত্তর দেবো? কিছুক্ষণ চিন-া করে বললাম, দেখুন মুহসিন, আমি আপনার অনুভূতি বুঝতে পারি এবং এ প্রশ্ন আপনি করেছেন বন্ধুত্বের ভিত্তিতে, কিন' হযরতের অনুমতি ছাড়া তো আমি কিছু বলতেপারি না। মুহসিন বিচক্ষণ ব্যক্তি। সঙ্গে সঙ্গে বললেন, অবশ্যই! তোমাদের শায়খের তারবিয়াত এমনই হওয়ার কথা। হোটেলে ফিরে হযরতকে জানালাম, প্রেসিডেন্ট পর্যন- পৌঁছার একটা সম্ভাবনা পাওয়া গেছে মুহসিনের মাধ্যমে। হযরত মুহসিনকে কাছে ডেকে তার কপালে চুমু খেলেন এবং তার জন্য দু‘আ করলেন। মুহসিনের মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। বেচারা হয়ত এতটা আশা করেননি। আমি অবাক হয়ে দেখলাম এবং দৃশ্যটি এখনো আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে, মুহসিন হোটেলের লিফ্টের দিকে যাচ্ছেন, আর কপালে আলতো করে হাত বুলাচ্ছেন। লিফট পর্যন- পৌঁছে দিয়ে আমি কামরায় ফিরে এলাম। যারা বুঝতে পারে তাদের কাছে একটি চুম্বনের এত মূল্য, আর ...। মাগরিবের পরপর মুহসিনের ফোন পেলাম। তার কণ্ঠের উচ্ছ্বাস থেকেই বুঝলাম, খবর ইতিবাচক। ‘এক্ষুণি আসছি’ বলেই তিনি ফোন রেখে দিলেন। হযরতের দু‘আ নিয়ে আমরা বের হলাম। মুহসিন বললেন, আমরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাচ্ছি। আদী ও কুছাঈ-এর গৃহশিক্ষক সেখানে আছেন। তিনি আপনার জন্য পাঁচ মিনিট সময় নিয়েছেন। আমরা প্রেসিডেন্টের বাসভবনে পৌঁছলাম। অবাক হওয়ার বিষয়, এখানে আমাদেরকে সকালের মত কোন রকম নিরাপত্তা-পর্যবেক্ষণের সম্মুখীন হতে হলো না। আমাদের বসতে দেয়া হলো যে কামরায় আদী ও কুছাঈ গৃহশিক্ষকের কাছে পড়ছিলো। তাদের ছবি দেখেছি গত বছর ইরাকী পত্রিকা ‘আলিফ-বা’-এর একটি সংখ্যায়। আজ সরাসরি দেখলাম। আলিফ-বায় প্রেসিডেন্টের ছেলেমেয়েদের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিলো। তাতে পিতার প্রতি সন-ানদের অভিযোগ ছিলো যে, বাবাকে তারা অনেক সময় চোখের দেখাও দেখতে পায় না। সেদিক থেকে ঐ ইরাকী শিশুরা তাদের চেয়ে ভাগ্যবান যারা সবসময় বাবার সান্নিধ্য লাভ করে এবং যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়াতে পারে। আমি তাদেরকে সাক্ষাৎকারটির কথা স্মরণ করালাম। তারা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে শুধু মৃদু হাসলো; কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মনে হলো। কতই বা বয়স, কাছাকাছি দশবারো। কিন' মনে হলো, এখন থেকেই সুনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তিত্ব নিয়ে গড়ে ওঠছে। কথা, হাসি সবকিছু পরিমিত। গৃহশিক্ষকের সঙ্গে আচরণ সম্ভ্রমপূর্ণ। আমার ভালো লাগলো। আজ সাতাশ বছর পর যখন এ সফরনামা লিখছি তখন আমার স্মৃতিপটে বারবার ভেসে ওঠছে আদী ও কুছাঈ নামের সেই বালক দু’টির ছবি, যারা মৃদু হেসে আমাকে বলেছিলো, বাংলাদেশ ইরাকের বন্ধুদেশ। আমি বলেছিলাম, শুধু বন্ধুদেশ নয়, ভ্রাতৃদেশও। আমরা সকলে ‘আল-উখুওয়াতুল ইসলামিয়্যা’-এর বন্ধনে আবদ্ধ। তখন তারা লাজুক হেসে বলেছিলো, অবশ্যই। সেদিন আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাদের বালক বয়সের ব্যক্তিত্বে এবং সাহসিকতার অভিব্যক্তিতে। তারপর দজলা-ফোরাতের বুক দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। আদী ও কুছাঈ ধীরে ধীরে বড় হয়েছে। পিতার হাত ধরে ইরাকের শাসনক্ষমতায় জড়িয়েছে। পিতার মত তাদেরও হয়ত ভুলবিচ্যুতি ছিলো, তারাও হয়ত বুঝতে পারেনি, ক্ষমতার প্রাসাদে কত ফাঁক-ফোকর ছিলো; মার্কিন গোয়েন্দচক্রের জাল কত গভীরে বিছানো ছিলো। শেষ মুহূর্তে যখন ‘পিতা ও পুত্রদ্বয়’ রিপাবলিকান গার্ডের মাধ্যমে চূড়ান- হামলার স্বপ্নে বিভোর, তখনো তারা বুঝতে পারেনি, যুদ্ধের সবক’টি মাথা আগেই কেনা হয়ে গেছে। সময় পার হওয়ার পর হয়ত তারা বুঝতে পেরেছিলো, ইরানের ‘মোল্লারা’ কত বিচক্ষণ ছিলেন। মার্কিনীদের ক্রীতদাস, অথচ ইরানের সম্পদ বলে কথিত জেনারেলদের একসাথে ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে ‘মোল্লারা’ কত বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছিলেন। শিয়াদের ইমাম আয়াতুল্লাহ খোমেইনী তখন আশ্চর্য একটি কথা বলেছিলেন, ‘লোকেরা বলে, মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলতে নেই, কিন' আমার বিশ্বাস, অনেক সময় মাথা কেটে ফেললে ধড় বেঁচে যায়।’ ইরানের মোল্লা যা বুঝেছিলেন বিশ শতকে, ইরাকের ‘মিস্টার’ তা বুঝতে পেরেছিলেন একুশ শতকে। প্রাণ রক্ষার জন্য যখন পিতা ও পুত্রদ্বয়কে আত্মগোপন করতে হলো তখন তাদের এত সাধের, এত স্বপ্নের ইরাকে তাদেরকে আশ্রয় দেয়ার কেউ ছিলো না। একসময় পুত্রদের বিচ্ছিন্ন হতে হলো পিতা থেকে। তখন তিনি শুধুই পিতা ছিলেন; একজন অসহায় পিতা! পুত্রদের বুকে জড়িয়ে ধরে তিনি কেঁদেছিলেন, নিজের জন্য নয়, সন-ানদের নিরাপত্তার চিন-ায়। তখনো তিনি পুত্রদের একটি উপদেশ দিতে ভুলেন নি, ‘ধরা যদি পড়ো, শৃগালের মত পড়ো না, সিংহের মত পড়ো।’ দুই পুত্র পিতার নির্বুদ্ধিতা যেমন পেয়েছিলো তেমনি পেয়েছিলো পিতার শৌর্য ও সাহস। আদীর বার বছরের বালক মুস-ফা যেন বাবা, চাচা ও দাদাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিলো বীরত্বে ও সাহসিকতায়। বিশ্বাস করা যায়, আত্মগোপনে থাকা অসহায় তিনজন (একজন বালক) মানুষকে ধরার জন্য বাড়ীটি ঘেরাও করেছিলো তিনহাজার মার্কিন সেনা! বাবা ও চাচার সঙ্গে বার বছরের বালকও সেদিন লড়াই করেছিলো বন্দুকের শেষ গুলিটি পর্যন-। তিন হাজার মার্কিন সেনা স-ব্ধ হয়ে গিয়েছিলো দুই শার্দুল ও একটি শাবকের গর্জনে। হায়েনার দল জীবিত পাকড়াও করতে পারেনি তাদের। বুশ সিনিয়র হয়ত সেদিন আক্ষেপ করেছেন তার সন-ানদের সম্পর্কে। তবে তিনি নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন, হায়েনার ঔরস থেকে হায়েনাই জন্মলাভ করে, শার্দুল নয়। কত বড় বুকের পাটা নিয়ে আত্মগোপন করে থাকা পিতা সাদ্দাম দুই পুত্রের ও বালক পৌত্রের শাহাদাতের সংবাদ গ্রহণ করেছিলেন! ভীরুতার লেশমাত্র আছে যার মধ্যে তার পক্ষে কি আদৌ তা সম্ভব! মার্কিন হায়েনাদের হাতে শাহাদাত বরণকারী আদী ও কুছাঈ-এর দোষত্রুটি ও অপরাধ কতটুকু ছিলো আমি জানি না। দুই বোনের স্বামীদের কৌশলে ধরে এনে কেন হত্যা করা হয়েছিলো তাও আমার জানা নেই। তবে আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করা সেই বালকদু’টির ব্যক্তিত্বে আমি মুগ্ধ ছিলাম। আল্লাহ তাদের সব অপরাধ ক্ষমা করুন এবং তাদের শহীদের মর্যাদা দান করুন, আমীন। সাদ্দামের পুত্রদ্বয়কে তো আমি দেখেছি, তার নাতি শহীদ মুস-ফাকে দেখিনি; দেখার প্রশ্নও আসে না। বার বছরের বালক তো বলা যায় নিষ্পাপই ছিলো। তাকে দেখিনি, কিন' তার একটি ছবি আছে আমার বুকে, আমার কল্পনায়। বেলকনীর সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো সে বুক ফুলিয়ে। গুলি তার বুকে লেগেছিলো, পিঠে নয়। শুধু এই একটি কারণে, জীবনে আবার কখনো যদি ইরাক যেতে পারি, আর আমাকে শুধু একটিমাত্র কবর যিয়ারতের অনুমতি দেয়া হয়, আমি বলবো না, আমাকে আব্দুল কাদীর জিলানীর মাযারে নিয়ে চলো; আমি বলবো, আমাকে শহীদ মুস-ফার কবরে নিয়ে চলো; আমি শুধু তার কবর যিয়ারাত করবো। আমার চোখে তখন যদি পানি আসে, চোখের পানিতে ওর কবরের মাটি ভেজাবো। প্রিয় পাঠক, দেখো না, আবেগের তোড়ে কোত্থেকে কোথায় ভেসে গিয়েছি! অক্ষম মানুষের আসলে আবেগ ছাড়া আর থাকেই বা কী! ফিরে যাই প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাসভবনে। যথাসময়ে ডাক এলো। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের সামনে। এটা তার নিজস্ব পড়াশোনার কামরা। বিরাট কামরা। তাকে তাকে অসংখ্য বই। প্রথম দর্শনেই আমি অভিভূত হলাম। প্রেসিডেন্ট কিছু পড়ছিলেন। তিনি চেয়ার থেকে উঠে এসে মুছাফাহা করলেন। আমি প্রেসিডেন্ট বলে সম্বোধন করে কথা শুরু করতেই, তিনি আন-রিক হাসির সঙ্গে বললেন, তুমি এখন ইরাকের রাষ্ট্রীয় মেহমান নও, সাদ্দাম হোসায়নের ঘরের মেহমান। সকালের বৈঠকে সামরিক পোশাকে প্রেসিডেন্টের গর্বিত আসনেও তাকে মার্জিতরুচি ও সুশীল ব্যক্তি মনে হয়েছিলো, এখন ঘরোয়া পরিবেশে তাকে আরো খোলামনের, আরো আন-রিক মনে হলো। হায়, এ মানুষটি যদি অতীতের দিল্লীর শাসকদের মত কোন শায়খের ছোহবত লাভ করতেন, যদি সঠিক পথের সন্ধান পেতেন, তাহলে আরব ও মুসলিম জাহানের দুর্ভোগের কারণ না হয়ে হতে পারতেন গর্ব ও গৌরবের সম্পদ। তিনি যে আরব আভিজাত্যের অধিকারী সেটি প্রমাণ করতেই যেন এই সামান্য সময়ের ফাঁকেও আমার সামনে পরিবেশিত হলো তাজা খেজুর ও ধূমায়িত কফি। আমি হযরতের পত্র অর্পণ করলাম। তিনি তখনই খুলে পড়লেন। তারপর বললেন, ‘শায়খকে আমার সালাম বলো, আর বলো, তাঁর ইখলাছ ও আন-রিকতাকে আমি শ্রদ্ধা করি। আজকের ঘটনার জন্য আমি আন-রিক দুঃখিত। তাঁর উপদেশ আমি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করছি। যুদ্ধবন্ধের বিষয়ে শায়খের যে কোন উদ্যোগের প্রতি আমার যুক্তিসঙ্গত সহযোগিতা থাকবে, ‘যুক্তিসঙ্গত’ শব্দটি আমি পুনরুক্ত করছি।’ বিদায়ের সময় প্রেসিডেন্ট আমার হাত ধরে, সেই কামরা পর্যন- এলেন যেখানে আদী ও কুছাঈ পড়ছিলো এবং মুহসিন আমার অপেক্ষায় ছিলেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে তার পুত্রদ্বয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি হাসির ছলে তাদের সাক্ষাৎকারের কথা বললাম। প্রেসিডেন্ট অবাক হয়ে বললেন, আচ্ছা, আমি জানি না তো! আদি, অথবা কুছাঈ, এখন মনে নেই; আমাকে ওর হাতের কলমটি উপহার দিয়েছিলো। শিস কলম, মাথায় ইলেক্ট্রনিক ঘড়ি ছিলো। আমি অবাক হলাম, প্রেসিডেন্ট তার পুত্রের পিঠ চাপড়ে বললেন, শোকরান! অর্থাৎ মেহমানের ইকরাম করায় তিনি খুশী হয়েছেন। আরব পিতার তারবিয়াত দেখার এটা ছিলো এক দুর্লভ সুযোগ। পরবর্তীতে অবশ্য এসুযোগ আরো অনেক হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাসভবন থেকে বের হওয়ার আগে একটা কথা আমি বলতে চাই। সারা বিশ্বের আলোচিত সমালোচিত এবং এখন পশ্চিমা- বিশ্বের কাছে ধিকৃত প্রেসিডেন্ট সাদ্দামের বাসভবনে আসবাবপত্রের কোন বাহুল্য দেখিনি। তাঁর ধার্মিকতা প্রচার করার জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস'ায় অনেক পোস্টার ও বুকলেট প্রকাশ করা হলেও আমি তা দ্বারা প্রভাবিত হইনি, কিন' আমাকে কেউ বলে না দিলেও স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, রাষ্ট্রীয় সম্পদে তার সামান্যতম হস-ক্ষেপও ছিলো না। পরবর্তীতে তো তা দিবালোকের মত পরিষ্কার হয়ে গেছে। কারণ সারা ইরাক চষে ফেলেও মার্কিনীরা দু’টি জিনিস পায়নি। গণবিধ্বংসী অস্ত্র এবং সাদ্দামের আর্থিক দুর্নীতি। অস্ত্রের ‘অ’ এবং দুর্নীতির ‘দ’ও যদি তারা পেতো, বিশ্বমিডিয়া তোলপাড় করে ছাড়তো। আসলে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধই সাদ্দামকে ফাঁসির রজ্জুর কাছে নিয়ে গিয়েছিলো। নইলে আমরা সাদ্দামের যেসব বিষয়ের সমালোচনা করি, আমেরিকার চোখে সেগুলো তো সাদ্দামের গুণ। একথা হয়ত পৃথিবী কোনদিন জানতে পারবে না যে, বন্দী সাদ্দামকে কতভাবে প্রলু্ব্ধ করা হয়েছিলো এই বলে যে, এখনো তুমি ইরাকের তেল আমাদের হাতে তুলে দাও, ইরাকের ক্ষমতা আমরা তোমার হাতে তুলে দেবো। তখন তোমার চেয়ে পছন্দের মানুষ আমাদের কাছে আর কেউ হবে না। কিন' সাদ্দাম মুসলমান যতটুকুই ছিলেন, আরব ছিলেন পুরো মাত্রায়, আর ইরাকী ছিলেন আরো বেশী মাত্রায় এবং সেটাই হয়েছে তার জন্য কাল। মুহসিন আমাকে হোটেলে ফিরিয়ে দিয়ে ‘শুভরাত্রি’ জানিয়ে চলে গেলেন। হযরতকে আমি পুরো বিষয় অবহিত করলাম। তিনি নীরবে শুনলেন এবং গভীরভাবে ‘জাযাকাল্লাহ’ বললেন। মনে হলো, তার অন-র থেকে কোন চাপ সরে গেলো। *** হযরতের সফরসঙ্গীরা কিছুক্ষণ পর ফিরে এলেন। ক্লান- হলেও তাদের বেশ আনন্দিত মনে হলো। আখতার ফারূক সাহেব তার কামরা-কাঁপানো হাসিসহযোগে বললেন, আজকের প্রোগ্রাম মিস করে তুমি ভালো করোনি। ইরাকের সবচে’ দর্শনীয় বস'টি তোমার হাতছাড়া হয়েছে। আমি মৃদু হেসে বললাম, আমার এবং হযরতের হাতছাড়া হয়েছে। আর দর্শনীয় বস' ‘চোখছাড়া’ হতে পারে, হাতছাড়া হয় কীভাবে! গুণী মানুষের সঙ্গে এই একটি সুবিধা, তারা কথার রসটুকু গ্রহণ করেন, অন্যকিছু এড়িয়ে যান। তিনিও তাই করলেন। ব্যক্তিজীবনে তিনি বড় দিলখোলা মানুষ ছিলেন। রাজনীতিতে যেহেতু দিলটা খোলা রাখার কোন সুযোগ নেই সেহেতু সেখানে তিনি ছিলেন অন্য অনেকের মত, আলাদা কিছু নন। তাকে বললাম, ঘ্রাণে অর্ধভোজন বলে কথা আছে, যদিও আমার অভিজ্ঞতা অন্য রকম, তো শ্রবণে কি অর্ধ অবলোকন হতে পারে না! তিনি হাসতে হাসতে ‘আলবৎ হতে পারে’ বলে শোনালেন। তার বিবরণ থেকে মোটামুটি যা বুঝলাম তা এই যে, ইরাক সরকার মাদায়েনে ঐতিহাসিক কাদেসিয়া যুদ্ধের দৃশ্যাবলী বিশাল এক সাততলা ভবনের দেয়ালে, ছাদে ও মেঝেতে চিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছে এবং তা এমন বিস্ময়কর শিল্পচাতুর্যের মাধ্যমে যে, মনে হবে সবকিছু জীবন-। দর্শক ভাববে, যেন সে রণাঙ্গনে উপসি'ত থেকে বাস-ব যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করছে। সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে উঁচু এক মিনারে গিয়ে উঠতে হয়। সেখানে গম্বুজের আকৃতির একটি বিরাট কক্ষ। মনে হবে যেন সুউচ্চ কোন দুর্গের উপর তুমি দাঁড়িয়ে আছো। সামনে দৃষ্টিসীমা পর্যন- রয়েছে একটি প্রান-র। তার শেষ মাথায় একটি প্রাচীন দুর্গ বা দুর্গের ভগ্নাবশেষ। এর নাম কাদীকা দুর্গ। এ দুর্গের ছাদে বসেই অসুস' ও চলৎশক্তিরহিত কাদেসিয়ার সেনাপতি হযরত সা‘আদ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রা) যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। পরপর তিনদিন তিনরাত্রির ভয়াবহ যুদ্ধের যাবতীয় দৃশ্য পর্যায়ক্রমে দেয়ালচিত্রের সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গম্বুজ কক্ষের দেয়াল থেকে ছাদ পর্যন- তিন স-রে চিত্র তৈরী করা হয়েছে। রণাঙ্গনের ভূমি যেন প্রকৃত ভূমি এবং আকাশ যেন প্রকৃত আকাশ। চিত্রগুলোতে রঙের প্রয়োগ এমনই কুশলী যে, দৃশ্যাবলীর দূরত্বকে মনে হবে একেবারে বাস-ব! এখানে পারসিকদের হসি-বাহিনীর আক্রমণ যেমন দেখানো হয়েছে তেমনি দেখানো হয়েছে সে আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য মুসলিম বাহিনীর সাহসী সৈনিকদের ছুটে গিয়ে হাতির সুঁড় ধরে ঝুলে পড়ার এবং সুঁড় কেটে ফেলার যেন জীবন- দৃশ্য। আখতার ফারূক সাহেবের ভাষায়, ‘শব্দের বর্ণনা দিয়ে প্যানারোমার সৌন্দর্য বোঝানোর উপায় নেই। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর একটা কথা আছে, কিন' এখানে শব্দের বর্ণনা ঘোলের চেয়েও কম। এটা শুধু দেখার জিনিস, বলার বা শোনার জিনিস নয়। এধরনের প্যানারোমা পৃথিবীতে মাত্র তিনটি রয়েছে। একটি আমেরিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর, দ্বিতীয়টি জাপানে জাপান- যুদ্ধের উপর, আর তৃতীয়টি এখানে কাদেসিয়া-যুদ্ধের উপর। ইরাক সরকারের এত বিপুল অর্থ ব্যয় করে এত গুরুত্বের সাথে প্যানারোমা তৈরী করার রহস্য এই যে, কাদেসিয়া যুদ্ধকে তারা মনে করে পারসিকদের বিরুদ্ধে আরবদের জয়। অর্থাৎ এটা হলো তাদের আরবজাতীয়তাবাদের চেতনা সৃষ্টির প্রচেষ্টা। সুতরাং মহৎ প্রচেষ্ট! আমাদের চার বছর পর ইরাক সফরে মাওলানা তাকী উছমানী এই প্যানারোমা পরিদর্শন করে মন-ব্য করেছেন, ‘এটা যারা তৈরী করেছে অজ্ঞানে, কিংবা সজ্ঞানে একথা ভুলে গিয়েছিলো যে, কাদেসিয়াযুদ্ধের সিপাহসালার ছিলেন জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশছাহাবীর অন্যতম হযরত সা‘আদ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রা), তদুপরি এ যুদ্ধের অধিকাংশ মুজাহিদ ছিলেন ছাহাবী। সুতরাং তাদের কাল্পনিক চিত্র অংকন করা যেমন শরী‘আতবিরোধী তেমনি তা ছাহাবা কেরামের শান ও মর্যাদার জন্যও হানিকর।’ *** রাত্রে ইরাকের বহুলপ্রচারিত ইংরেজী দৈনিক বাগদাদ ডেইলী এবং আরবী দৈনিক আছ-ছাওরাহ-এর সাংবাদিক -বৃন্দ হোটেলে এলেন হযরতের সাক্ষাৎকার নিতে। এসব বিষয়ে তাঁর কোন আগ্রহ ছিলো না। তিনি বলে দিলেন, তোমরা যা ভালো বোঝো, করো। সকলে যা ভালো বুঝলেন তা এই যে, তারা জনাব আব্দুল মান্নানকে আচ্ছারকম হাজামত করলেন। আমি সবিনয়ে নিবেদন করেছিলাম যে, এ নোংরা বিষয় আলোচনায় না আনাই ভালো। এতে আমাদেরই ক্ষুদ্রতা প্রকাশ পাবে। তদুপরি বিভিন্ন বাস-ব কারণে এসব কথা পত্রিকায় আসবে না, কিন' তা ইরাক সরকারের সর্বোচ্চ স-র পর্যন- পৌঁছবে। পরদিন হযরতের সফরসঙ্গিগণ ক্ষুব্ধ বিস্ময়ে দেখলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে’ পত্রিকার পৃষ্ঠা ছিলো ‘খালি!’ আর সেটাই ছিলো স্বাভাবিক। হযরতের শান ও মান সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা থাকতে পারে, কিন' নিজেদের প্রেসিডেন্টের মর্যাদা সম্পর্কে ইরাকীরা অসচেতন হবে কেন? *** আর একটি মাত্র দিন আমাদের হাতে ছিলো এবং কুফা, নজফ ও কারবালা যিয়ারত করা বাকি ছিলো। খুব ভোরে যাত্রা শুরু হলো। বাগদাদ থেকে কুফার দূরত্ব প্রায় দেড়শ কিলোমিটার। খুব কাছেই নজফ শহর। মানববসতির ক্রমসমপ্রসারণের স্বাভাবিক ধারা এই যে, দুটি জনপদ প্রথমে আলাদা থাকে। তারপর উভয় জনপদ সমপ্রসারিত হতে হতে অভিন্ন জনপদে রূপানি-রত হয়। যেমন মক্কা ও মিনা ক্রমসম্প্রসারিত হয়ে এখন অভিন্ন জনপদে পরিণত হয়েছে। কিন' কুফা ও নজফ ব্যতিক্রম। এখন উভয় জনপদ আলাদা; মাঝখানে কয়েক কিলোমিটার একেবারে অনাবাদ। কিন' অতীতে কুফার জনপদ নজফ পর্যন- বিস-ৃত ছিলো এবং বলা চলে, নজফ কুফারই অন-র্ভুক্ত ছিলো। এজন্য নজফকে বলা হতো ‘যাহরুল কূফাহ’ বা কুফার পৃষ্ঠদেশ। এখন নজফে শিয়াসমপ্রদায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাকেন্দ্র অবসি'ত। আজকের খোমেইনী একসময় তার দীর্ঘ নির্বাসিত জীবনের বিরাট একটা অংশ এই নজফেই অতিবাহিত করেছিলেন ইরাকের রাষ্ট্রীয় মেহমানের মর্যাদায়। নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, একসময়ের মেহমান এখন জানি দুশমন! নাজাফ থেকে কারবালার দূরত্ব যথেষ্ট। হোসায়নি শাহাদাতের মর্মানি-ক ঘটনাকালের কারবালা ছিলো জনমানবহীন এক মরুভূমি। সেই কারবালা এখন এক সমৃদ্ধ জনপদ। এ কারবালায় দাঁড়িয়ে কল্পনাও করা যায় না সেই কারবালার রুক্ষ-কঠিন মরুদৃশ্য! বাগদাদ থেকে কুফা পর্যন- যে সুদীর্ঘ ও সুপ্রশস- সড়কপথ, তার দু’দিকে শুধু খেজুরবাগান। বলা যায়, পথের দু’দিকে খেজুরবাগান নয়, বরং খেজুরবাগানের মধ্য দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা পথ। খেজুরের ছায়া-ঢাকা সেই বাগদাদ-কুফা মহাসড়কের এখন কী অবস'া! এখন তো নিশ্চয় হানাদার বাহিনীর সাজোয়াবহর সেই সড়কপথে চলাচল করে, আর ইরাকীদের গাড়ী পথের বিভিন্ন চেকপোস্টে থামিয়ে রাখা হয়! কুফার কাছাকাছি এসে ইরাকের ঐতিহাসিক শহর হিল্লা, আর সামান্য দূরত্বে কালদানীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র এবং পৃথিবীর প্রাচীনতম বাবেল নগরি। কালদানীয়রা আদজাতির উত্তরপুরুষ। তারাই পূর্ব থেকে বিদ্যমান শহরটির নাম রেখেছে ‘বাবেল’- বৃহস্পতি গ্রহ। বাবেল এখনো আবাদ শহর। এখানেই ছিলো পৃথিবীবিখ্যাত ব্যাবিলনের শূন্যোদ্যান, যা আজ প্রায় ধ্বংসস'পে পরিণত। কোরআনে বাবেল-এর নাম এসেছে। জাদুবিদ্যার জন্য এ শহরের খ্যাতি ছিলো হযরত সোলায়মান (আ)-এর যুগে। বাবেলীদের পরীক্ষার জন্য হযরত হারূত ও মারূত নামে দুই ফিরেশতাকে পাঠানো হয়েছিলো মানুষের বেশে। দূর থেকেই শুধু দেখা হলো বাবেল শহর এবং তার শূন্যোদ্যানের ধ্বংসাবশেষ। আমাদের মেযবান ঐ স'ানটিকে ‘পরিদর্শনের’ অন-র্ভুক্ত করেননি হয়ত একথা ভেবে যে, নিছক ঐতিহাসিক স'ানের প্রতি আমাদের আগ্রহ থাকবে না। কুফা ও নাজাফ অতিক্রম করে গাড়ী এগিয়ে চললো, কারবালার উদ্দেশ্যে। উন্নত সড়কপথ, কিন-ু এখানে খেজুরগাছের ছায়া নেই। যত দূর দৃষ্টি যায়, শুধু বালুর সাগর, আর প্রস-রময় মরুভূমি। আমার জিজ্ঞাসার জবাবে মুহসিন বললেন, মদীনা থেকে কারবালার দূরত্ব প্রায় দু’হাজার কিলোমিটার। আজকের মানুষের পক্ষে কি কল্পনা করা সম্ভব, নবীজীর প্রিয় দৌহিত্র, মা ফাতেমার কলিজার টুকরা ইমাম হোসায়ন (রা) পরিবার-পরিজনের কাফেলা নিয়ে উটের পিঠে সওয়ার হয়ে কীভাবে এ দীর্ঘ কঠিন পথ পাড়ি দিয়েছিলেন! কী ভীষণ ধৈর্যের বিষয় ছিলো তা! কেন তিনি বেছে নিয়েছিলেন এমন মোজাহাদা ও কোরবানির পথ?! কারবালার কাছাকাছি পৌঁছে আমরা ছোট্ট একটি উটের কাফেলা দেখতে পেলাম। ইরাকে এখানেই উটের সঙ্গে প্রথম ও শেষ মুলাকাত! মরুভূমির বালুসাগর পাড়ি দিয়ে উটের কাফেলা চলেছে কারবালারই দিকে। আমি জানি না, কারা ছিলো উটের সেই কাফেলায়। কিন' দূর থেকে তাদের পথচলা দেখে আমার হৃদয়ে জাগলো আবেগের উত্তাল তরঙ্গ; চোখের পাতা হলো অশ্রুসিক্ত। আজকের উটের কাফেলায় আমি যেন দেখতে পেলাম সেই নূরানী কাফেলার দৃশ্য। নানাজানের রওযা শরীফের সান্নিধ্য ত্যাগ করে ইমাম হোসায়ন (রা) কেন এসেছিলেন মদীনা থেকে এই কারবালায়? এসেছিলেন যালিম শাসকের কবল থেকে উম্মাহকে উদ্ধার করার জন্য; নানাজানের প্রিয় দ্বীনের হিফাযতের জন্য। আর তিনি তো নিজে আসেননি; এসেছিলেন কুফা থেকে হাজার চিঠির আকুল আবেদনে সাড়া দিয়ে! কুফাবাসীর প্রতিশ্রুতি ছিলো যালিম শাসকের বিরুদ্ধে ইমামের হাতে বাই‘আত গ্রহণের, যা কবুল না করা ইমামের দৃষ্টিতে ছিলো জিহাদ থেকে পলায়নের শামিল, আর তা কীভাবে সম্ভব শেরে খোদা হযরত আলী (রা)-এর পুত্রের পক্ষে! পরিণাম পরিণতি থেকে বেপরোয়া হয়ে এবং শুভাকাঙ্ক্ষীদের পরার্মশ উপেক্ষা করে তাই তিনি প্রিয় মদীনা থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন সুদূর কুফার উদ্দেশ্যে। কীভাবে তিনি কল্পনা করবেন, কুফার লোকেরা তাঁর সাথে গাদ্দারি করতে পারে! তারা তো প্রিয় নানাজানের প্রিয় উম্মত! কিন' তাঁর কল্পনায় যা ছিলো না তাই ঘটে গেলো! পথেই পাওয়া গেলো কুফার বিশ্বাসভঙ্গের খবর, কিন' জিহাদের পথ থেকে ফিরে যাওয়া তো ইমামের পক্ষে সম্ভব নয়! তবে অন্যদের তিনি বললেন, যার ইচ্ছা, ফিরে যেতে পারে। অনেকেই ফিরে গেলো। একসময় রয়ে গেলো শুধু পরিবারের আপনজনেরা। শিশু-নারী-পুরুষ মিলিয়ে সত্তরজন। নিরস্ত্র অসহায় উটের কাফেলা এসে পৌঁছলো ফোরাত নদীর তীরে, এই কারবালার মাঠে। কিছুটা দূরে সরে গেলেও সেই ফোরাত আজো আছে। এখনো ফোরাত বয়ে যায় কুল কুল রবে কান্নার সুর তুলে। এ কান্না মহাকালের কান্না। যুগ যুগ ধরে ইমাম হোসায়নের শোকে উম্মাহর চোখ থেকে যত অশ্রু ঝরেছে সব তো এসে মিশেছে এই ফোরাতের পানিতে! কারবালার প্রান-রে আমি যেন দেখতে পেলাম হোসায়নী কাফেলার অসহায়ত্বের মর্মবিদারক দৃশ্য! যিয়াদের প্রেরিত বাহিনী ঘিরে ফেলেছে ক্লান--শ্রান- ও নিরস্ত্র ইমামের কাফেলাকে, আর ঘিরে রাখা হয়েছে ফোরাত নদী। কেন? কারবালার মরুভূমিতে ইমাম ও তাঁর পরিবার যেন পিপাসায় কাতর হয়ে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন। হায়, এ যমীন, এ আসমান আর কখনো কি দেখেছে এমন নির্মম নিষ্ঠুর দৃশ্য! প্রিয় নবীর প্রিয় দৌহিত্র, মা-ফাতেমার কলিজার টুকরা, জান্নাতের যুবকদলের সরদার ইমাম হোসায়ন পিপাসায় কাতর! পিপাসায় কাতর শিশু আছগর! পিপাসায় কাতর বিবি সাকীনা! ইমাম নিজের জন্য নয়, শিশু আছগরের জন্য এককাতরা পানির আবেদন জানালেন। কিন-ু এই উম্মতেরই একদল নরাধম দিলো না ইমামকে ফোরাত নদীর এককাতরা পানি! আগে তলোয়ার ছাড়ো, নিজেকে সোপর্দ করো, তারপর পানি। পিপাসায় ছাতি ফেটে যায়, তাই বলে এমন যিল্লতির পানি মুখে দেবেন ইমাম হোসায়ন ও তাঁর পরিবার! না, তিনি সিদ্ধান- নিলেন, যিল্লতির পানি নয়, তারা পান করবেন শাহাদাতের শারাবান তাহূরা! কাকে জিজ্ঞাসা করবো? পশুর অধম সেই মানুষগুলো তো এখন নেই দুনিয়াতে! আছে ফোরাত নদী; ইচ্ছে হলো তাকেই জিজ্ঞাসা করি, কেমন লেগেছিলো তখন তার! ইচ্ছে কি হয়েছিলো পশুগুলোকে ডুবিয়ে মারার? ইচ্ছে কি হয়েছিলো নিজে এগিয়ে গিয়ে ইমামকে আঁজলা ভরে পানি পেশ করার। কিন' ফোরাত নিজেও যে অসহায় ছিলো নরপশুদের উদ্ধত তলোয়ারের সামনে। তাই দুঃখে লজ্জায় ও বেদনায় হয়ত ফোরাতের পানি সেদিন শুকিয়ে গিয়েছিলো। এখন আমরা যা দেখি, তা ফোরাতের পানি নয়, ফোরাতের অশ্রু! ইমাম হোসায়ন তলোয়ার হাতে লড়াই করলেন, জখমী হলেন; তাঁর বুকের খুনে লাল হয়ে গেলো কারবালার তপ্ত বালু। লুটিয়ে পড়লেন জান্নাতের যুবকদলের সরদার। তাঁর শহীদী রূহ রওয়ানা হয়ে গেলো ফিরেশতাদের মিছিলে আল্লাহর আরশের উদ্দেশ্যে। ইমামের পবিত্র মস-ক .. নাহ, থাক! আগেও আমার মনে হয়েছে, এখনো মনে হলো। নবীর সারা জীবনে দুশমন যত যুলুম করেছে তাঁর উপর, তার চেয়ে বেশী যুলুম করেছে উম্মত নিজে একদিনে কারবালায় ফোরাত নদীর তীরে! উম্মতের একদল অপরাধ করেছে নবীর প্রিয় দৌহিত্রকে পিপাসায় কষ্ট দিয়ে হত্যা করে, আরেকদল অপরাধ করেছে তাঁকে পরিত্যাগ করে এবং নীরব দর্শক সেজে। আজ আমরা অপরাধ করছি ইমামের রক্তভেজা মাকছাদকে ভুলে গিয়ে। মরুকারবালা পার হচ্ছি, আর বিভিন্ন মর্মানি-ক দৃশ্য ভাসছে আমার অশ্রুঝাপসা দৃষ্টির সামনে। বেদনাহত হৃদয় বিভিন্ন ভাব ও ভাবনার তরঙ্গে আন্দোলিত হচ্ছে। এরই মধ্যে আমাদের গাড়ী প্রবেশ করলো আজকের কারবালা শহরে। হযরত প্রথমে হাযির হলেন সাইয়েদেনা ইমাম হোসায়ন (রা)-এর পবিত্র মাযারে। এখানে মহান ইমামের পাশে শুয়ে আছেন শিশু আছগরসহ অন্যান্য শহীদানে কারবালা। এখানে কারবালায় কাঁদতে হয় না, কান্না এসে যায়! এখানে ইমাম হোসায়নের মাযারে আপনা থেকেই অবিরল ধারায় অশ্রু ঝরে। কারবালার কান্না ও অশ্রু ঝরা তো আজকের নয়, যুগ যুগের। এখানে আকাশে বাতাসে সবসময় শোনা যায় কান্নার ধ্বনি এবং পাওয়া যায় নোনা অশ্রুর স্বাদ! আমরা কাঁদছিলাম, আর আমাদের হযরত কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন, তবে তাঁর কান্না এবং কান্নায় ভেঙ্গে পড়া সবই ছিলো আত্মিক সংযমে পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত। কান্নার অদম্য আবেগ এবং আত্মসংযমের অপূর্ব এক সঙ্গম যেন আমরা দেখতে পেলাম তাঁর মাঝে। তাঁর কান্না ও অশ্রুবর্ষণের মাঝে আমরা যেন দেখতে পেলাম এখানে ইমামের শোকে যুগে যুগে উম্মতের ‘বরগুযীদা’ মানুষের কান্না ও অশ্রুবর্ষণের দৃশ্য! ইমাম হোসায়ন (রা)-এর মাযারে বারবার আমার মনে পড়ছিলো হিন্দুস-ানের মর্দে মুমিন মাওলানা মুহম্মদ আলী জাওহার (রহ)-এর সেই অমর কবিতাপংক্তি- কাতলে হোসায়ন আছল মেঁ মুরগে ইয়াযীদ হায়/ ইসলাম যিন্দা হোতা হায় হার কারাবালা কে বা‘দ হোসায়নের শহীদী খুনে লেখা হয় ইয়াযীদী মওতের পরওয়ানা/ ইসলাম জীবন- হয় যত বার আসে কারবালা। হাঁ, ইসলামের জীবনে কারবালা একবার আসেনি এবং রক্তের স্রোত শুধু একবার প্রবাহিত হয়নি। যুগে যুগে বিভিন্ন ফোরাতের তীরে কারবালা বারবার এসেছে ফিরে। যখন যেখানে ডাক এসেছে নয়া কারবালার, তখনই যামানার হোসায়ন বুক পেতে দাঁড়িয়েছেন যামানার ইয়াযীদ-শিমারের খুনপিয়াসী খঞ্জরের সামনে। সেই রক্তের ফোয়ারায় স্নাত হয়ে ইসলাম আবার নবজীবন লাভ করেছে। হে কারবালা, হে অশ্রুর ফোয়ারা! হে কারবালা, হে হোসায়নি রক্তের স্রোতধারা! তোমার পুণ্যস্মৃতির পবিত্র স্পর্শ জীবনে আমার এই প্রথম, হয়ত জীবনে এই শেষ; কিন' আল্লাহর কাছে আমার এই মিনতি, কখনো যদি আসে নতুন কারবালার ডাক, আমি যেন হতে পারি মুসাফির হোসায়নি কাফেলার! আমি জানি, রক্ত আমার না-পাক; তবু হে মাওলা, আমার বুকের রক্ত তোমারই সৃষ্টি, সুতরাং তোমারই কাছে আমার মিনতি, আমার বুকের রক্তে ইসলাম যেন আবার নতুন জীবন লাভ করতে পারে। আমি চাই না ফোরাতের পানি, আমি চাই কাউছারের পেয়ালা। ফোরাত নদীর তীরে যখন দাঁড়ালাম, মনের তখনকার অবস'া ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। হাঁটু জলে নেমে নির্নিমেশ দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকলাম স্বচ্ছ পানির দিকে। চোখের পানি গিয়ে মিশলো ফোরাতের পানিতে। কোন কবি বলেছিলেন- সাদা চোখে ফোরাতের পানি হয়ত সাদা/ আছে যাদের দৃষ্টি জানে তারা কত লাল তা! আমার সাদা চোখে যদিও সাদা পানি ছাড়া আর কিছু দেখতে পাইনি, তবু মনে হয়েছে, এ পানিতে মিশে আছে হোসায়নের পবিত্র রক্ত এবং তার ঘ্রাণ। কারবালা থেকে বিদায়ের সময় হযরতের যে অবস'া হয়েছিলো, আজ এত বছর পরো তা স্পষ্ট মনে পড়ে। বাইরে সম্পূর্ণ শান- সি'র, ভিতরে যেন বইছে ঝড়; সেই কারবালার সেই মরুঝড়! বাইরে তার যা কিছু প্রকাশ তা হলো চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু, ফোঁটা ফোঁটা রক্ত! তিনি ফোরাত নদীর তীরে গেলেন, আমরাও গেলাম। তিনি হাঁটু পানিতে নামলেন, আমরাও নামলাম। বিশ্বাস করো পাঠক, আমি দেখেছি, এখনো দেখছি, ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু ফোঁটা ফোঁটা রক্ত হয়ে পড়ছে ফোরাতের পানিতে। আগে শুনেছি, কিন' বুঝিনি, আজ বুঝলাম নিজের চোখের অভিজ্ঞতা দিয়ে, কারবালায় এমনি এমনি অশ্রু ঝরে, ঝরতেই থাকে। যেন অশ্রু দিয়ে লেখা এ নাম- কারবালা! প্রতিটি হরফ থেকে যেন অশ্রু ঝরে, থামাতে চাইলে আরো বেশী ঝরে। রোধ করতে চাইলে ঝরঝর করে ঝরে। সেই ঝরঝর অশ্রু ঝরা চোখে বিদায় নিলাম কারবালা থেকে। তখন মনে হয়েছে, এখনো মনে হয়, কারবালা আমাকে বিদায় দেয়নি। কারবালা যেন আমাকে বারবার বলেছে, ‘বিদায় চেয়ো না, বিদায় নিয়ো না। থেকে যাও আমার বুকে ফোরাতের তীরে। অন-ত বুকে করে নিয়ে যাও আমার মরুভূমির ঝড়!’ সেই ঝড় এখনো যেন বইছে আমার বুকে! কারবালার স্মৃতি এখনো জ্বলজ্বল আমার হৃদয়ে! বাংলাদেশের বাতাসে, বৃক্ষের পত্রধ্বনিতে এখনো আমি শুনতে পাইও কারবালার কান্না! ভোরে সবুজ ঘাসের ডগায় যে শিশিরবিন্দু তাতে আমি দেখতে পাই কারবালার অশ্রু। এই যে আমাদের গ্রামের কোল ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী, আমার কাছে এ যেন ফোরাত নদীরই ছবি! কারবালা থেকে আমরা এসে পৌঁছলাম নাজাফে, শেরে খোদা হযরত আলী (রা)-এর মাযার-প্রাঙ্গনে। ভাব ও আবেগের তরঙ্গদোলায় হৃদয় এখানে এমনই উদ্বেলিত হলো যে, অতীত-বর্তমান যেন একাকার হয়ে গেলো! কোথায় নজফ, কোথায় ইরাক! আমার চোখের তারায় যে শুধু মক্কা, শুধু মদীনা! এখানে যিনি শুয়ে আছেন তিনি তো মক্কার সেই দশবছরের বালক, নির্জন পাহাড়ের পাদদেশে আল্লাহর নবীর সঙ্গে যিনি নামায পড়তেন! তিনি তো সেই বিশবছরের যুবক, হিজরতের রাতে আল্লাহর নবীর শয্যায় চাদরমুড়ি দিয়ে যিনি শুয়ে ছিলেন! তিনি তো মদীনার সেই বীর যোদ্ধা যার হাতে আল্লাহর নবী যুদ্ধের ঝাণ্ডা তুলে দিয়েছিলেন, আর খাইবার-দুর্গের দরজা ভেঙ্গে ঢাল বানিয়ে যিনি লড়াই করেছিলেন! মদীনা থেকে এত দূরে এই নাজাফে কেন তাঁর মাযার? কারণ বড় ফেতনার যুগে তাঁর কাঁধে এসেছিলো খেলাফাতের দায়িত্বভার। তিনি চাননি ফেতনার সায়লাব আসুক এবং বিনষ্ট করুক মদীনার পবিত্রতা। তাই তিনি নবীজীর বিচ্ছেদ বেদনা সহ্য করে মদীনা থেকে চলে এসেছেন কুফায়। আল্লাহর নবী যার হাতে তুলে দিয়েছিলেন আপন কলিজার টুকরা ফাতেমাকে, বড় কষ্ট দিয়েছে উম্মত তাঁকে, তাঁর জীবনের সায়াহ্নে। শাহাদাতের আগে এক স্বপ্নে আল্লাহর নবীর কাছে শেকায়াত করে তিনি বলেছেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনার উম্মত আমাকে বড় কষ্ট দিচ্ছে। তিনি শত্রুর আঘাত যেমন সয়েছেন, তেমনি সয়েছেন আপনজনদেরও আঘাত। তিনি বলতেন ডানে চলো, তারা চলতো বাঁয়ে। তিনি বলতেন, বাঁয়ে চলো সবাই চলতো ডানে। চরম কঠিন ও বিভীষিকাময় এক পরিসি'তির ভিতর দিয়ে একে একে ছয় বছর তিনি খেলাফতের দায়িত্ব পালন করেছেন। কীভাবে করেছেন তা আল্লাহ জানেন। তবে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে কীভাবে মুসলিম উম্মাহকে সিরাতুল মুসতাকীমের পথে পরিচালিত করতে হব, তার সর্বোত্তম আদর্শ পাওয়া যাবে একমাত্র তাঁরই পবিত্র জীবনে। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা তাকে চতুর্থ খলীফারূপে নির্বাচন করেছেন। ফজরের নামাযে যাওয়ার পথে গুপ্তঘাতকের হাতে তিনি শহীদ হয়েছেন। আশ্চর্য! ইসলামের চার খোলাফায়ে রাশেদীনের তিনজনই শাহাদাত বরণ করেছেন আততায়ীর হামলায়। এভাবে খেলাফাত ও শাহাদাত একাকার হয়ে গিয়েছিলো তাঁদের পবিত্র জীবনে। তাযকিয়া ও ইহসান এবং আত্মিক ও আধ্যাত্মিক সাধনার যে পুণ্যধারা চলে আসছে উম্মাহর মাঝে যুগ যুগ ধরে তার পুরোধা হলেন হযরত আলী (রা)। তাই যাদের দিল আছে তারা এখানে এসে লাভ করে থাকেন দিলের সুকূন ও সাকীনাহ এবং কলবের ফায়য ও ফায়যান। হযরত এখানে প্রাণভরে যিয়ারাত করলেন এবং দিলভরে দু‘আ করলেন। তারপর রওয়ানা হলেন হযরত আলী (রা)-এর দারুল খিলাফাত কুফার উদ্দেশ্যে। নাজাফ থেকে বিদায় নেয়ার সময় কলবের গভীরে তৃপ্তি ও প্রশানি-র অভূতপূর্ব এক অনুভূতি যেন দোলা দিলো। সেই পবিত্র অনুভূতির দোলায় আমি যখন মাতোয়ারা তখন হঠাৎ হযরত আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘মওলবী আবু তাহের, তোমার কলবে সাকীনা মাহসূস হইছে নি?’ আমি অবাক হলাম এবং রোমাঞ্চিত হলাম। আমার সর্বসত্তায় যেন অজানা অচেনা একটি কম্পন অনুভূত হলো, আমি আরয করলাম হযরত, কিছু একটা হয়েছে, সেটার নাম কি আমি জানি না। হযরত আলহামদুলিল্লাহ, বারাকাল্লাহ বলে...। প্রিয় পাঠক, এখানে এসে আবার মনে হলো কলম আমার সংযমের সীমা অতিক্রম করছে। এখানে আবার আমি অনুভব করলাম, বলার চেয়ে না বলার জন্য কত বেশী শক্তির প্রয়োজন। শুধু দু‘আ করি, আমার কলবকে এবং মুহাব্বাতের সঙ্গে যারা এ লেখা পড়ছে তাদের কলবকে আল্লাহ যেন তার মা‘রিফাত দ্বারা চিরআলোকিত করে দেন। আমীন। প্রিয় পাঠক, এতদিন ধরে আমরা একসঙ্গে আছি। আমি লিখছি, তুমি পড়ছো। হৃদয়ে হৃদয়ে একটা কিছু বন্ধন তো অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছে। সেই বন্ধনের দাবীতে বলছি, এসো আমরা একসঙ্গে বলি, আমীন। আমি তোমার জন্য দুআ করি, তুমিও আমার জন্য দুআ করো, আল্লাহ যেন আমাদের মাফ করে দেন, ঈমানের সঙ্গে, আসানির সঙ্গে আমাদের মওত নছীব করেন, আমাদের কবরকে যেন জান্নাতের টুকরো করে দেন, হাশরে যেন আরশের ছায়া দান করেন, কাউছরের তীরে, নবীর সান্নিধ্যে যেন একত্র করেন। আল্লাহ যেন আমাদের সকলকে বেলাহিসাব জান্নাত দান করেন। আমীন। এমন একটা সময় আসবে যখন আমি থাকবো না, তুমি থাকবে না। তখন যারা আসবে, তাদেরও জন্য এসো আমরা এ দু‘আ করে যাই; আশা করি, তারাও আমাদের জন্য দু‘আ করবে। কেন করবে না? আমরা তো মাটির উপরে তাদের বসবাস সুন্দর হওয়ার জন্য মাটির নীচে চলে যাচ্ছি! *** গাড়ীতে ওঠার সময় অবচেতন ভাবেই যেন ফিরে তাকালাম মাযারে হযরত আলী (রা)-এর দিকে, হয়ত জীবনে শেষ বারের জন্য। তখন তৃপ্তির তরঙ্গকে ছাপিয়ে উঠলো যেন অতৃপ্তি ও বেদনার ঢেউ। প্রশানি-র সোনালী মুহূর্তগুলোর স্বর্গীয় স্বাদ পূর্ণরূপে অনুভব করার আগেই যেন তা অতীতের গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে চায়। সময় কি ক্ষণিকের জন্যও সি'র হতে পারতো না এখানে এই পবিত্র মাযারপ্রাঙ্গনে! একটা কথা বলবো না ভেবেছিলাম। কিন' মনের কষ্টটা চেপে রাখা আর সম্ভব হলো না। নাজাফে হযরত আলী (রা)-এর মাযারের পার্শ্ববর্তী কামরায় একটি বেদনাদায়ক বিষয় দেখতে পেলাম। একটি ছবিতে হযরত ইমাম আলী এবং ইমাম হাসান-হোসায়নকে দেখানো হয়েছে। জানি না, এমন বে-আদবির ধৃষ্টতা কে করেছে! কীভাবে করেছে! গতকাল তো সাদ্দাম বলেছিলেন, তিনি ইরাকে ইসলাম কায়েম করছেন, আর সেটা হচ্ছে মাযারের ইসলাম, তখন ভাবতে পারিনি যে, সেটা এত বড় মন্দ ইসলাম! কুফা ও বছরা- এ দুই শহরের নাম শুনে আসছি সেই শৈশব থেকে। নাহবের কিতাবে সেই যে, পড়েছিলাম, ‘সিরতু মিনাল বাছরাতি ইলাল কুফাতি’, তারো বেশ আগে থেকে। পরবর্তীতে কুফার সঙ্গে গড়ে উঠেছে হৃদয়ের গভীর এক সম্পর্ক এবং মযবূত ইলমী বন্ধন। কারণ প্রথমত কুফা ছিলো হযরত আলী (রা)-এর দারুল খিলাফাহ এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা)সহ বহু ছাহাবীর অবস'ানকেন্দ্র। দ্বিতীয়ত এই কুফাতেই জন্মগ্রহণ করেছেন হযরত ইমাম আবু হানীফা (রহ) এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক (রহ)। জন্মগ্রহণ করেছেন জানা অজানা আরো অসংখ্য ইমাম, ফকীহ, মুহাদ্দিস ও ভাষাবিদ; ইলমের জগতে যারা ছিলেন একেকটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। সুতরাং ইলমের কেন্দ্রভূমি এই কুফা নগরীতে অন-ত কিছু সময়ের জন্য উপসি'ত হতে পারা একজন তালিবে ইলমের জন্য অবশ্যই সৌভাগ্যের বিষয়। তাই কুফা শহর দেখার এবং কুফার সেই জামে মসজিদে সামান্য সময় অতিবাহিত করার আকাঙ্ক্ষা আমার অন-রে ছিলো সবসময়। তাছাড়া আরেকটি বেদনাদায়ক ইতিহাস আমার হৃদয়ের এক কোমল অংশে ছিলো চিরজাগরূক সেজন্য ব্যাকুলতা ছিলো, অন-ত একবার হলেও ‘বিশ্বাসভঙ্গের’ এই শহরকে এবং শহরের মানুষগুলোকে দেখবো; দেখে শিক্ষা লাভ করবো। এ শহরেই নিঃসঙ্গ অবস'ায় শাহাদাত বরণ করেছেন হযরত আলী (রা)-এর ভাতিজা, ইমাম হোসায়নের উৎসর্গিতপ্রাণ অনুসারী হযরত মুসলিম বিন আকীল। ইতিহাসের কিতাবে আমি যতবার তাঁর শাহাদাতের করুণ কাহিনী পড়েছি শুধু চোখের পানিতে ভিজেছি, আর কুফার মাটি ও মানুষকে ধিক্কার দিয়েছি, তাদেরকে ছাড়া যাদের জন্ম কুফায় হলেও কুফার ‘কুফা’ থেকে ছিলেন মুক্ত। ইমাম হোসায়ন তাঁর এই উৎসর্গিত- প্রাণ ভাইকে অগ্রগামী সদস্যরূপে কুফায় পাঠিয়েছিলেন সরেজমিন অবস'া জানার জন্য। কুফার দুর্ভাগা সন-ানেরা প্রথমে তাঁকে সাদরে বরণ করেছিলো এবং এক বিরাট বাহিনী তাঁর হাতে জিহাদ ও শাহাদাতের বাইআত গ্রহণ করেছিলো। ফলে ইমাম হোসায়নকে তিনি লিখেছিলেন, ‘চলে আসুন, কুফার জানবায জোয়ানরা আপনার ইনতিযার করছে।’ হায়, দুর্ভাগা কুফা, কেন তুমি ডেকেছিলে! কেন তুমি ত্যাগ করেছিলে! কেন তুমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে! কেন তুমি বিশ্বাস ভঙ্গ করেছিলে! তুমি কি জানো, কাকে তুমি ডেকেছিলে! কাকে তুমি পরিত্যাগ করেছিলে! তুমি ডেকেছিলে তোমার মহাসৌভাগ্যকে; তুমি ত্যাগ করেছিলে তোমার মহাসৌভাগ্যকে! আমি ব্যাকুল ছিলাম প্রাচীন কুফার সেই গলিপথগুলো দেখার জন্য যেখানে নিঃসঙ্গ অসহায় মুসলিম বিন আকীল লক্ষ্যহীনভাবে হাঁটছিলেন আশ্রয় ও নিরাপত্তার আশায়। কত ঘরের দরজায় আওয়ায দিয়েছিলেন, দুয়ার খোলো, আমি তোমাদের ভাই! আমি নবীজীর নাতি ইমাম হোসায়নের প্রতিনিধি। খুলেনি কোন ঘরের দুয়ার। কারণ দুর্ভাগা কুফার কোন ঘর এত প্রশস- ছিলো না যেখানে ইমাম হোসায়নের প্রতিনিধি প্রবেশ করতে পারেন; যেখানে হযরত আলীর ভাতিজা আশ্রয় নিতে পারেন। একটি ঘরের দরজা খুলেছিলো, আশ্রয় দেয়ার জন্য নয়, যালিমের হাতে মাযলূমকে ধরিয়ে দেয়ার জন্য; দুনিয়ার কুকুর দুনিয়ার পুরস্কার পাওয়ার জন্য। মুসলিম বিন আকিল তখন কেঁদেছিলেন, হয়ত কালিমায় বিশ্বাসী মানুষের এই নীচতা দেখে, কিংবা এই অনুতাপে যে, ইমাম হোসায়নকে কোথায় কাদের কাছে আসতে তিনি খবর পাঠিয়েছেন! কিন' মৃত্যুর ভয়ে মোটেই নয়। হযরত আলীর ভাতিজা ভয় পাবেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে! ইমাম হোসায়নের ‘ভাই’ শাহাদাতের পেয়ালায় ঠোঁট লাগাতে! ছি! আমাদের গাড়ী যখন কুফা শহরে প্রবেশ করলো এবং বিভিন্ন শহর ও পথ অতিক্রম করতে লাগলো তখন ইতিহাসের উজানে সাঁতার কেটে আমি পৌঁছে গেলাম সেই সুদূর অতীতে। আমার ঝাপসা দৃষ্টির সামনে আমি যেন দেখতে পেলাম, হযরত মুসলিম বিন আকীল ঐ যে খোলা মাঠে নামায পড়ছেন! তখনো তার সঙ্গে রয়েছে কয়েকজন মানুষ, কিন' সালাম ফিরিয়ে দেখেন, কেউ নেই। লক্ষ মানুষের কুফা শহরে তিনি সম্পূর্ণ একা। আমি যেন দেখতে পেলাম, শিহরিত হয়ে আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম। ঐ যে এক নরাধম ধরিয়ে দিলো তাঁকে ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের হাতে! ঐ যে নিষ্ঠুর জল্লাদের খুনপিয়াসী তলোয়ার নেমে এলো তার গর্দানের উপর। মাথাটা .. উহ! আর পারি না! হায়, অন-ত একজন মানুষও যদি তাঁর সঙ্গে থাকতো এই দুর্ভাগা শহরের! তাহলে হযরত আলীর কুফা, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের কুফা এবং হযরত ইমাম আবু হানীফার কুফা বেঁচে যেতো ইতিহাসের বুকে লজ্জা ও কলঙ্ক থেকে। আমাদের গাড়ী এসে থামলো কুফার জামে মসজিদের সামনে। পৃথিবীর প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি। ১৯ হিজরীতে হযরত সা‘আদ বিন আবী ওয়াক্কাছ এটি নির্মাণ করেছেন। ক্রমসমপ্রসারিত এই মসজিদে আশি হাজার মুছল্লী একসাথে নামায পড়তে পারে। কিন' শহর ও তার জনসংখ্যা এখন এমনই ম্রিয়মাণ যে, জুমার দিনেও মুছল্লী পাঁচ হাজার হয় কি হয় না। অথচ একসময় এই মসজিদে ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিছীনের মজলিসে ইলম ও হালকায়ে দরস ছিলো জমজমাট। হাজার হাজার তালিবে ইলম দিন-রাত মশগুল থাকতো ইলমের মধু আহরণে। মসজিদের খোলা চত্বরে চারদিকে দুর্গের মত মজবুত দেয়াল এখন কালের থাবায় জীর্ণদশায় উপনীত। প্রাচীরসংলগ্ন শত শত কক্ষ এবং সেগুলোর দরজা মসজিদের আঙ্গিনামুখী। একসময় এখানে বাস করতো ইলমের পিপাসায় দূর দূরান- থেকে আগত মুসাফির তালিবানে ইলম। কল্পনার চোখে আমি তো দেখছি ইলমের ঐসব জমজমাট মজলিস এবং তালিবানে ইলমের নূরানী চেহারা, কিন' আমার সামনে ছিলো ছোট ছেলেদের খেলাধূলা ও ছোটাছুটির বাস-ব চিত্র! কোথায় গেলো হায়, ইলমের বাগানে ফুটে থাকা শত শত ফুলের সৌন্দর্য ও সুবাস! ঝরে যাওয়া ফুলের শুকনো পাপড়িগুলো, তাও বুঝি উড়ে গেছে যামানার ঝাপটায়! মসজিদের আঙ্গিনায় মাঝখানে ছোট ছোট কিছু মেহরাব; সেগুলোতে লেখা আছে, এখানে হযরত ইবরাহীম (আ) নামায পড়েছেন, এখানে হযরত নূহ (আ) নামায পড়েছেন। এভাবে আরো কয়েকটি নাম; অবশ্যই ভিত্তিহীন। কিন' যা কিছু ভিত্তিহীন তাতেই মানুষের উপচে পড়া ভক্তি, সবযুগে সবদেশে। তাই আগত পর্যটকরা ভক্তিগদগদ হয়ে ওখানে নামায পড়ে, দোয়া করে। কিন-ু দ্বীনের যা আসল বিষয় তাতে মানুষ আশ্চর্যরকম উদাসীন। কুফার জামে মসজিদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও দ্বীনী ফযীলতের জন্য এতটুকুই তো যথেষ্ট যে, তা ছাহাবা কেরামের স্মৃতিধন্য এক প্রাচীন মসজিদ। এখানে নামায পড়েছেন হযরত আলী (রা) ও হযরত সা‘আদ বিন আবী ওয়াক্কাছ (রা)। এখানে সিজদা করেছেন জান্নাতের যুবকদলের সরদার হযরত ইমাম হাসান ও হোসায়ন (রা)। এখানে কোরআন ও সুন্নাহর ইলম বিতরণ করেছেন হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রা), হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আবী আওফ (রা), হযরত মুগীরা বিন শো‘বা (রা) এবং আরো অসংখ্য ছাহাবা কেরাম। এখানে একসময় ইলমের ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়েছিলো ইমাম আবু হানীফা, ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহম্মদ (র)-এর মজলিসে। এখানে হাদীছ বয়ান হতো হযরত আব্দুল্লাহ ইবনুল মোবারক, হযরত সুফয়ান ছাওরী এবং নাম না জানা অসংখ্য মুহাদ্দিছীনের মজলিসে। আমাদের যারা গাইড তারা এসব জানবে কোত্থেকে! তাই ভিত্তিহীন কাহিনী ছাড়া তাদের আর কোন পুঁজি নেই! মসজিদ-প্রাঙ্গনে একটি গম্বুজের নীচে রয়েছে শহীদে কুফা হযরত মুসলিম বিন আকীলের মাযার। পাশের আরেকটি গম্বুজের নীচে রয়েছে হযরত হানী বিন ওরওয়ার মাযার, যিনি কিছু সময়ের জন্য মুসলিম বিন আকীলকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন। হযরতের সঙ্গে আমরা আযমত ও ভক্তি-মুহব্বতের সঙ্গে মসজিদের আঙ্গিনা থেকে ভিতরে প্রবেশ করলাম এবং হযরত আলী (রা)-এর মেহরাব অবলোকন করলাম, যেখানে দাঁড়িয়ে খলীফাতুল মুসলিমীন হিসাবে তিনি ইমামত ও খোতবা প্রদান করতেন। এই মেহরাবেই জীবনের শেষ ফজরে ইমামত করার জন্য তিনি ঘর থেকে রওয়ানা হয়েছিলেন, আর পথে ওত পেতে ছিলো অভিশপ্ত ঘাতক। রক্তাক্ত অবস'ায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হলো ঘরে। এই মেহরাবে তাঁর আর দাঁড়ানো হলো না। সেই ফজর তাঁর আর পড়ানো হলো না। হযরত আলী (রা)-এর মেহরাব এখন সংরক্ষিত, পাশে রয়েছে আলাদা মেহরাব। মসজিদের ভিতরে অত্যন- ভাবগম্ভীরতা ও নূরানিয়াত ছিলো। এ নূরানিয়াত ছাহাবা কেরামের নামায ও সিজদার এবং যিকির ও ইবাদাতের নূরানিয়াত। এ নূরানিয়াত খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত আলী (রা)-এর ন্যায় ও ইনছাফপূর্ণ শাসনের নূরানিয়াত। এ নূরানিয়াত হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদের ইলম ও ফিকাহর নূরানিয়াত। যুগ যুগের শত শত ইমাম, ফকীহ ও মুহাদ্দিছীনের ইলমী মাজালিসের নূরানিয়াত। মাগরিবের আযান হলো, যেমন বিশুদ্ধ তেমনি হৃদয়স্পর্শী। হবে না কেন! এ আযান তো এখানে একসময় ধ্বনিত হতো স্বয়ং খলীফাতুল মুসলিমীন আলী বিন আবু তালিবের উপসি'তিতে! এ আযানের ধ্বনি শুনেই তো জামাতে শামিল হতেন ছাহাবা কেরাম এবং পরবর্তী যুগের ইমাম, ফোকাহা ও মুহাদ্দিছীন। মাগরিবের নামায আদায় করলাম একশ’র কম মানুষের এক জামাতে। কিন' এই ক্ষুদ্র জামাতেও আমি যেন অনুভব করলাম সেই পুণ্যাত্মাদের উপসি'তি, যারা আল্লাহু আকবার বলতেন আল্লাহকে সর্বশক্তিমান মনে করে; যারা সিজদায় মাথা রাখতেন বন্দেগির বিনয়ে বিগলিত হয়ে; যারা সিজদা থেকে মাথা তুলতেন আল্লাহ ছাড়া মাথা নত না করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। মাগরিবের পর আমরা দেখলাম প্রাচীন কুফার প্রশাসনিক কার্যালয়ের জীর্ণভবন ও তার ভগ্নাবশেষ। মসজিদের দক্ষিণ দিকে কেবলার দেয়ালসংলগ্ন, দেখতে দুর্গের মত একটি ইমারতের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। প্রথম হিজরী শতকে এটাই ছিলো কুফার প্রশাসনিক কার্য পরিচালনার প্রধান কেন্দ্র। এই ধ্বংসাবশেষ সে যুগের বহু উত্থান-পতনের নীরব সাক্ষী। হাজার বছরের প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের নির্বাক ভাষা যদি বুঝতে পারো তাহলে এখানে তুমি শুনতে পাবে এই আর্তনাদ- ‘আমি ধ্বংস হয়েছি অনেক পরে; আমার বাসিন্দারা ধ্বংস হয়েছে অনেক আগে। আমি জানতাম একদিন আমি ধ্বংস হবো, কিন-ু আমার নির্বোধ বাসিন্দারা জানতো না, তারা ধ্বংস হবে এবং মাটির নীচে মাটির সাথে মিশে যাবে। তাই তারা কায়েম করেছিলো আনাচার-স্বেচ্ছাচারের রাজত্ব এবং গরম করেছিলো যুলুম ও ফেতনার বাজার। এখানে আমি দেখেছি জল্লাদের তলোয়ারের নীচে বহু মযলূমের গর্দান। এখানে আমি দেখেছি যিয়াদ ও ইবনে যিয়াদের গর্ব ও অহঙ্কার। এখানে আমি শুনেছি হাজ্জাজ বিন ইফসুফের সদম্ভ হুংকার। হাজ্জাজ নেই, সাঈদ বিন জোবায়র আছেন। ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ নেই, ইমাম হোসায়ন আছেন। শোনো হে বাংলাদেশের আজনবী মুসাফির! এত সহজে কলজে ফেটে আমার দেহ এমন চৌচির হতো না, যদি সেই মর্মন'দ দৃশ্য আমাকে দেখতে না হতো! একটু কাছে এসো হে মুসাফির! তাহলে এখনো আমার ভগ্নাবশেষেও তুমি অনুভব করবে সেই কম্পন! আমি থরথর করে কেঁপে উঠেছিলাম যেদিন আমার এখানে আনা হয়েছিলো তোমাদের পেয়ারা নবীর প্রিয় নাতির কর্তিত মস-ক। তা দেখে উল্লাসে ফেটে পড়েছিলো নরাধম ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদ ও তার অনুচরেরা। আমার সেদিন ইচ্ছে হয়েছিলো, এই নরপশুদেরসহ আমি মাটির নীচে ধ্বসে যাই। তারপর বেশী দিন যায়নি, ওবায়দুল্লাহ বিন যিয়াদের কাটা কল্লাও আমি এখানে মুখতার ছাকাফীর সামনে পরিবেশিত হতে দেখেছি। হে আজনবী মুসাফির! আমার বিধ্বস- বুকের কয়েকটি দীর্ঘশ্বাস তোমার কাছে আমানত রাখলাম। তোমার দেশের মানুষকে শুনিও তা। প্রশাসনিক ভবনের ভগ্নাংশের ডান দিকে একটি প্রাচীন জীর্ণ বাড়ী। প্রসিদ্ধ এই যে, এটি হযরত আলী (রা)-এর বাসগৃহ। খুব সাধারণ ঘর। উত্তর দিকের দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেই অপরিসর আঙ্গিনা। পূর্বদিকে দু’টি কামরা, ইমাম- ভ্রাতৃদ্বয়ের বলে কথিত। বাড়ীর পশ্চিম দিকে সুড়ঙের মত একটি সরু পথ, যার শেষ মাথায় একটি কামরা এবং তাতে একটি কূপ। বলা হয়, এ কূপের পানি হযরত আলী (রা) ব্যবহার করতেন। কামরার দক্ষিণ দিকের দরজা পার হয়ে অপেক্ষাকৃত বড় একটি কামরা। বলা হয়, এটি হযরত আলী (রা)-এর শয়নকক্ষ। ছাদ এত নীচু যে, প্রায় ছোঁয়া যায়। বাড়ীটি বারবার মেরামত করা হলেও এর আদল-আকৃতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে। এই হলো মুসলিম জাহানের চতুর্থ খলীফার ‘বালাখানা’, যিনি বিশ্বাস করতেন, দুনিয়া হলো আখেরাতের মুসাফিরখানা। এখানে বসে আমরা তৈরী করবো আখেরাতের আবাদুল আবাদ যিন্দেগির বালাখানা। কিনু- আমাদের অবস'া! ইয়া আলী, ইয়া আলী বলেই শেষ হয়ে যায় ভক্তি-ভালোবাসার উচ্ছ্বাস। ইয়া হাসান, ইয়া হোসায়ন বলেই আমরা সাঙ্গ করি কারবালার মাতম। কিন' তাঁদের জীবন ও জীবনযাত্রা! তাদের যিন্দেগি ও তরযে যিন্দেগি! যে কান্নায় আত্মনিবেদনের আকুতি নেই, যে অশ্রুফোঁটায় পথচলার মিনতি নেই সে কান্নায় হে মিথ্যা প্রেমিক, আমার কোন প্রয়োজন নেই। সে অশ্রুর ফোঁটায় আমার কোন আগ্রহ নেই। কারবালায় আমি কাঁদতে পারিনি, কিন' আমার হযরতের কান্না দেখেছি! ফোরাতের হাঁটুজলে দেখেছি তাঁর অশ্রুনিবেদন! নাজাফে হযরত আলীর মাযারে আমি তন্ময় হতে পারিনি, কিন-ু হযরতের ভাবতন্ময়তা দেখেছি। ছাহাব-তাবেয়ীন ও আইম্মামুজতাহিদীনের স্মৃতিধন্য কুফার জামে মসজিদে আমি সিজদায় লুটিয়ে পড়তে পারিনি, কিন' খুব নিকট থেকে দেখেছি হযরতের সিজদায় লুটিয়ে পড়া। এভাবে আজকের সারাটি দিন ছিলো শুধু দেখার সৌভাগ্য অর্জনের দিন। এ দেখা যেন আমার হৃদয়ের গভীরে রেখা হয়ে চিরঅম্লান থাকে, সেই কামনা করে হযরতের সঙ্গে রওয়ানা হলাম বাগদাদের পথে। *** বাগদাদ! মুসলিম উম্মাহর হাজার বছরের ইতিহাসে অনেক উত্থান-পতনের এবং অনেক আনন্দ-বেদনার নীরব সাক্ষী বাগদাদে আজ আমার শেষ রাত, এই সফরের, কিংবা সারা জীবনের। তাই অনেক রাত পর্যন- হোটেলে কামরার ছো্ট্ট বারান্দায় বসে প্রাণভরে আমি আমার প্রিয় বাগদাদকে দেখলাম। আমি বাগদাদের বাইরের সৌন্দর্য যেমন উপভোগ করলাম তেমনি চেষ্টা করলাম বাগদাদের ভিতরের সৌন্দর্য অনুভব করার। বাগদাদের যে সৌন্দর্য চোখের দৃষ্টিকে বিমুগ্ধ করে তা তৈরী করেছেন যুগে যুগে হারুন রশীদ ও তার উত্তরসূরীরা, আর তা ধ্বংস করেছে হালাকু খানেরা। আধুনিক বাগদাদের সৌন্দর্য, স্বীকার করতেই হবে সাদ্দাম হোসায়নের কীর্তি। বাগদাদ সুন্দর যেমন দিনের আলোতে সবুজের শামিয়ানার নীচে, তেমনি সুন্দর রাতের আলোতে তারকাখচিত আকাশের নীচে। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে বাগদাদের যে সৌন্দর্য আমি উপভোগ করেছিলাম তা ধ্বংস হয়ে গেছে নয়া যামানার হালাকু খানের হাতে। বাগদাদ আজ সারখার হয়ে গেছে মার্কিন হায়েনার বোমাবর্ষণ ও অগ্নিবৃষ্টিতে। আজ হয়ত আমার দেখে আসা বাগদাদকে আমি চিনতেই পারবো না। হয়ত আমাকে আর বাগদাদে যেতেই দেয়া হবে না! সেদিনের রূপসী বাগদাদ আজ শুধুই মৃত্যুর উপত্যকা। হয়ত বাগদাদ এখন ডুবে আছে রক্তের সাগরে। কিন-ু বাগদাদের ভিতরের সৌন্দর্য! যার স্রষ্টা ইমাম গায্যালী, শায়খ আব্দুল কাদির জীলানী ও তাঁদের উত্তরসূরীরা। সে সৌন্দর্য তো অমর অক্ষয়! সে সৌন্দর্য বিনাশ করতে পারে না যামানার কোন হালাকু খান। এমনকি আজো যদি যেতে পারি বাগদাদ নামের ভয়ঙ্কর মৃত্যু-উপত্যকায় এবং দাঁড়াতে পারি মারূফ কারখী, জোনায়দ বোগদাদী, শায়খ জিলানী ও ইমাম আবুহানীফা, আবু ইউসুফের মাযারে তাহলে হৃদয় ও আত্মায় এখনো আমি অনুভব করবো বাগদাদের অন-র্সৌন্দর্য। হয়ত সেখানে আমি শুনতে পাবো এই আশ্বাসবাণী- ‘হালাকু খান ধ্বংস হয়েছে, ধ্বংস হবে; বাগদাদ বেঁচে ছিলো, বেঁচে থাকবে। আ-সাঁ নেহী মিটানা নামো নিশান হামারা।’ রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বাগদাদের তারাভরা আকাশের দিকে বিদায়ের বিষণ্ন দৃষ্টি বুলিয়ে কিছুক্ষণের জন্য আমি শুয়ে পড়লাম হোটেলের সুসজ্জিত কামরায় পরিপাটি কোমল শয্যায়। বিদায়ের রাতে মেযবানের পক্ষ হতে কামরায় ফুলের তোড়া রেখে যাওয়া হয়েছে। কামরাটা এমন সুবাসিত ছিলো যে, বিষণ্নতার মাঝেও মনটা প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। মেযবানকে মনে মনে ধন্যবাদ জানিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। *** আজ আমাদের শেষ কর্মসূচী বাগদাদের জাদুঘর পরিদর্শন। হযরত থেকে গেলেন। আমার কেন যেন ইচ্ছে করছিলো না জাদুঘরের মৃত অতীতের অন্ধকারের মাঝে গিয়ে দাঁড়াতে। কিন' হযরত বললেন, ‘তুমি যাও। ইবরতের নযরে দেখলে ইবরতের বহু সামান পাবে সেখানে।’ এই ছিলেন আমাদের তাসবীহওয়ালা হযরত। যারা তাঁকে দেখেনি তারা ভাববে একরকম, যারা দেখেছে কিন' বুঝেনি তারা ভাববে অন্যরকম এবং অনেক রকম। যারা দেখেছে এবং কিছুটা বুঝেছে তাদের সংখ্যা কত কে জানে! কিন' পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তারা কেউ সংরক্ষণ করে রাখেননি তাঁর জীবন, চরিত্র, কর্ম, চিন-া ও বেদনার সঠিক চিত্র। এটা হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ক্ষেত্রে যেমন হয়েছে তেমনি হয়েছে হযরত ছদর ছাহেবের ক্ষেত্রে; তেমনি হয়েছে তাঁদের ক্ষেত্রে, অল্প ক’জন ক্ষণজন্মা পুরুষ, যারা এসেছিলেন এদেশে; দেশ ও জাতির প্রতি যাদের অবদান ছিলো অসামান্য। কিন' তাদেরকে ধারণ করা হয়েছে খুব সামান্য। বাগদাদের পথে বের হবো, আর সবুজের ছায়া পাবো না তা হতে পারে না; এবারও হলো না। সকালের সোনালী রোদ, আর সবুজ গাছের ছায়া; এর মাঝে সুপ্রশস- মসৃণ পথ। গাড়ী আছে, নিয়ন্ত্রিত গতি আছে; ধোঁয়া নেই এবং ভেঁপুর শব্দদূষণ নেই। এমন পথ যত দীর্ঘ হয় তত আনন্দ। আমাদের পথ অবশ্য দীর্ঘ হলো না। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেলাম। বিশাল জাদুঘর, বিশাল সংগ্রহ এবং আধুনিক তার সুবিন্যাস। বড় দু’টি ভাগ হলো ইসলামপূর্ব যুগ এবং ইসলামপরবর্তী যুগ। আমাদের হাতে সময় ছিলো না, আসলে প্রয়োজনও ছিলো না। শিক্ষা তো জাদুঘর থেকে হয় না, হয় জীবন থেকে। আর আমার জীবন সবসময় আমার সঙ্গে আছে এবং চারপাশে ছড়িয়ে আছে জীবনের উপাদান। প্রতি মুহূর্তে আমি শিখতে পারি জীবন থেকে এবং জীবনের উপাদান থেকে, যদি শিখতে চাই। খলীফা হারুন রশীদের মোহর দেখলাম। এই মোহরাংকিত পত্র তদানীন-ন পৃথিবীর যে কোন সম্রাট কম্পিত হাতে খুলতেন। কী আছে এই পত্রে! কোন দাবী! কোন অসন'ষ্টি! উত্তসূরীরা সেই মোহর তো সংরক্ষণ করতে পেরেছে, মোহরের সেই প্রভাব ও প্রতাপ! এ সফরনামা লেখার সময় শুনেছি, মার্কিন হায়েনাদের হাতে বাগদাদ জাদুঘর লুণ্ঠিত হয়েছে এবং মূল্যবান সব প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি হয়ে গেছে। চোর ও ডাকাত যখন ঢুকেছে চুরি ও লুণ্ঠন তো হবেই। হারুন রশীদের সেই মোহরও হয়ত চুরি হয়ে গেছে। তার অর্থ কি এই যে, আমাদের শেষ যোগ্যতাটুকুও বিলুপ্ত হয়ে গেছে! না, ঈমান যদি লুণ্ঠিত না হয়, জাদুঘর বা তেলের খনি লুণ্ঠিত হলেও কোন ভয় নেই। ঈমান আবার জাগবে এবং জাগবে মুসলিম উম্মাহ। এমনকি ঝড়ো হাওয়ায় ঈমানের উদ্যান তছনছও যদি হয়ে যায়, আবার তাতে বসন- আসবে। কবি ইকবাল তাই তো বলেছেন, বলতে পেরেছেন- ‘বহুবার পরীক্ষা নিয়েছে যামানা আমাদের।’ খলীফা আলমু‘তাছিমের তলোয়ার দেখলাম; যে তলোয়ার হাতে একদিন তিনি ছুটে গিয়েছিলেন দূর দারাযের অভিযানে শুধু এক মুসলিম নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য; কাফিরদের হাতে লাঞ্ছিত যে নারী ‘ওয়া মু‘তাছিমাহ’ (কোথায় তুমি হে মু‘তাছিম) বলে ফরিয়াদ করেছিলো, একই সঙ্গে দেখলাম খলীফা আল মু‘তাছিমের সেই দোররা যা একদিন ক্ষতবিক্ষত করেছিলো সত্যের প্রতি অবিচল ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের পবিত্র দেহ। উত্থান ও পতনের উভয় কার্যকারণের একত্র অবস'ান সত্যি আমাকে স-ম্ভিত করলো! হায় মু‘তাছিম, আজ তোমাকে ভালোবাসবো, না ঘৃণা করবো! যে তরবারি তুলে নিয়েছিলে অসহায় মুসলিম নারীর সম্ভ্রম রক্ষার জন্য, সে হাতেই কেন তুমি তুলে নিলে যুলুমের দোররা! আসলে এ দোররাই কি সেদিন ফায়ছালা করে দিয়েছিলো তোমার উত্তরসূরীদের ভাগ্য! এ দোররাই কি পরবর্তীকালে ডেকে এনেছিলো হালাকু খানের বরবাদি! আজ এ সফরনামা লেখার সময় এখানে এসে ভাবছি, সাদ্দাম নিজেই কি তার কর্মফলরূপে ডেকে এনেছিলেন বাগদাদের বরবাদি! কেন তিনি ইরানের উপর হামলা চালাতে গেলেন? কেন তিনি কুয়েতের উপর আগ্রাসন চালালেন? কেন তিনি মুসলিম বিশ্বের সমঝোতা প্রস-াবে সাড়া না দিয়ে আমেরিকা ও তার ‘কুকুরসংঘকে সুযোগ করে দিলেন তাকে টুটি চেপে ধরার? মানুষ নির্বোধ হয়, কিন' একজন রাষ্ট্রনায়ক এত নির্বোধও হয়! জাদুঘরে সবচে’ বেদনাদায়ক যা দেখলাম তা হলো, আব্বাসী খেলাফতের এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে যেন ভোগ-বিলাস ও নাচগান ছাড়া আর কোন শোগল ছিলো না তাদের। হারুন রশীদের বিনোদন মাইফেল দেখানো হয়েছে চিত্রকর্মে। অথচ এই হারুন রশীদ সম্পর্কে ইতিহাস বলে, একবছর তিনি যেতেন হজ্বের সফরে, একবছর বের হতেন জিহাদের অভিযানে! আরো দেখানো হয়েছে, ধর্মভিত্তিক পুরোনো সমাজব্যবস'া ভেঙ্গে কীভাবে গড়ে তোলা হয়েছে কল্যাণকর আধুনিক সমাজব্যবস'া। এসব দেখে ইরাকের তরুণসমাজ অবচেতনভাবেই ইসলাম থেকে দূরে সরে যাবে। তারা ভাবতে বাধ্য হবে, ধর্ম মানেই শোষণ, নিপীড়ন। ধর্ম মানেই অন্ধতা ও পশ্চাতপদতা। হায়, সাদ্দাম! তুমি ফিরে এসো এবং দেখে যাও তোমার সাধের ধর্মনিরপেক্ষ বাগদাদ! *** জাদুঘর থেকে মাওলানা মুহিউদ্দীন খান ছাহেবের সঙ্গে গেলাম তথ্যমন্ত্রণালয়ের ‘দাইরাতু ছাকাফাতিল আতফাল’ বিভাগে। আমার ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে খান ছাহেব সময়সংকীর্ণতার মধ্যেও ব্যবস'াটা করেছিলেন এবং আমাকে সঙ্গ দান করেছিলেন। হজ্বের সফর থেকে শুরু করে পুরোটা সময় তিনি আমার ইচ্ছা ও আগ্রহের প্রতি অনুগ্রহপূর্ণ দৃষ্টি রেখেছেন, যদিও এখন আমি আমার কর্মপরিসরে এমনভাবে আবদ্ধ যে, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয় না, তবু তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা জাগরূক রয়েছে আমার অন-রে। শিশুসংস্কৃতি বিভাগ থেকেই ইরাকের শিশু-কিশোরদের শিক্ষা-দীক্ষা ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের যাবতীয় বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এখান থেকে শিশু ও কিশোরদের জন্য দু’টি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা হয় যথাক্রমে মাজাল্লাতী ও আল-মিযমার নামে। আমার বিশেষ আগ্রহ দেখে বিভাগীয় প্রধান পত্রিকার অনেকগুলো সংরক্ষিত কপি এবং শিশু-কিশোরদের জন্য প্রকাশিত বেশ কিছু বই উপহার দিলেন। সেগুলো এখনো আছে আমার সংরক্ষণে। শুধু এই পত্রিকাগুলো দেখেও বোঝা যায় সাদ্দাম তার ইরাককে কোন পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, যে পথের পরিণতি এখন আমাদের চোখের সামনে। তখন একটি প্রশিক্ষণশিবির অনুষ্ঠিত হচ্ছিলো। আমাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সব দেখে শুনে মনে হলো, ইরাকের শিশু-কিশোরদের সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত সংস্কৃতির ছায়ায় গড়ে তোলার সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে এবং এর ‘সুফল’ও তারা পেতে শুরু করেছে। এদের ওপর আসবে আগামী দিনের ইরাকের দায়িত্বভার। সুতরাং বাগদাদের খোদা হাফেয! এর পর আমরা গেলাম ইরাকের এয়ার ওয়েযের দফতরে আমাদের বিমানযাত্রা নিশ্চিত করতে। সঙ্গে ছিলেন মুহসিন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানালেন, বিমানের ফ্লাইট এখন অনিশ্চিত এবং ঝুঁকিপূর্ণ; তদুপরি তিনচার দিন অপেক্ষা করতে হবে। অভাবনীয় এক অবস'ার সম্মুখীন হলাম। বিলম্ব করা হযরতের পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তিনি যত দ্রুত সম্ভব দেশে ফিরতে চাচ্ছেন এবং সেটাই স্বাভাবিক। তাই বিকল্প ব্যবস'ার কথা চিন-া করতেই হলো। তখন আমাদের জানানো হলো, সড়কপথে আমরা কুয়েত যেতে পারি; সেখান থেকে বিমানযোগে ঢাকা। আগামীকাল রাত দশটায় ফ্লাইট। জানতে চাইলাম সড়কপথে কুয়েত পৌঁছতে সময় লাগবে কত? বলা হলো, ছয় থেকে সাত ঘণ্টা। বাস ছাড়বে আজ বিকেলে। এত দীর্ঘ বাসযাত্রা হযরতের জন্য খুব কষ্টকর হবে, কিন' উপায়! মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সম্মতি দিলেন। কিন' একটি বিষয় বুঝতে পারলাম না; আমাদের মেযবান তো সরকারী বিশেষ গাড়ীর ব্যবস'া করতে পারতেন, যাতে আগামীকাল রওয়ানা হয়ে যথাসময়ে বিমানে ওঠা যায়! কুয়েতের বিমানবন্দরে কোন হোটেলে অপেক্ষা করার চেয়ে সেটাই তো ভালো! খান ছাহেব বললেন, ‘এখানে অপেক্ষা করা যা, কুয়েতেও তা। নিজেদের পক্ষ হতে ওদেরকে অন্য ব্যবস'ার কথা বলা ভালো দেখায় না।’ আমি আর দ্বিমত করলাম না। বিকেলে আছর পড়ে আমরা হোটেল ত্যাগ করলাম। মানুষের চরিত্র বড় বিচিত্র! মাত্র কয়েকটি দিন হোটেলের যে কক্ষে অবস'ান করলাম তা ছেড়ে যেতে মায়া হলো! এই মায়াটাই সব অনিষ্টের মূল। সম্পদের মায়া, সন-ানের মায়া, জীবনের মায়া- এই সব মায়াজাল আমাদের ছিন্ন করতে হবে। শুধু আখেরাতের মায়ায় আবদ্ধ থেকে আমাদেরকে দুনিয়ার জীবন অতিক্রম করে আখেরাতের সফর অব্যাহত রাখতে হবে। মুসাফিরকে পথের যাবতীয় মায়া থেকে মুক্ত থেকে স্বদেশের গন-ব্যে অবিচল থাকতে হবে। আর আখেরাত এবং জান্নাতই তো হলো মুমিনের স্বদেশ! গত রাতে যে কোমল শয্যায় শেষ শয়ন করেছিলাম তার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো ভাবলাম। যত সহজে ভাবলাম এবং এখন বললাম তত সহজ নয় হৃদয়ের গভীরে তা বদ্ধমূল করে নেয়া। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ ছোহবত ও মোজাহাদা। বাসের ‘মাওকিফে’ পৌঁছলাম। মুহসিন এই প্রথমবার নিজেকে হযরতের বুকে সঁপে দিলেন এবং বুক উজাড় করে কাঁদলেন, যেন তিনি তার সবচে’ আপনজনকে আজ হারাতে বসেছেন। সে দৃশ্য এখনো আমার মনে আছে, বহুদিন মনে থাকবে। দ্বীনের পথে তার অভিযাত্রা সফল হোক, সার্থক হোক। দুনিয়ার মায়াজাল যেন তাকে দ্বীনের পথ থেকে বিচ্যুত করতে না পারে। আমার সঙ্গেও কোলাকুলি হলো মুহসিনের। আমি কি ভেবেছিলাম বাগদাদের সফরে কারো সঙ্গে হৃদয়ের এমন সম্পর্ক হবে যে, বিদায়ের সময় তাতে টান পড়বে এবং ব্যথা জাগবে! আমি কি ভেবেছিলাম, বাগদাদ থেকে বিদায়-কালে দু’টি ছলছল চোখ আমাকে এই বলে মিনতি জানাবে, ‘বাগদাদে তোমার একটি ভাই আছে, কখনো ভুলে যেয়ো না’! গাড়ী ছাড়ার দুই তিন মিনিট আগে অভাবনীয় এক বিস্ময় ও আনন্দ আমাকে বিহ্বল করলো; ফুলের তোড়া হাতে মুহম্মদ এসে হাজির! বেচারা প্রথমে হোটেলে গিয়েছেন, সেখান থেকে এখানে ছুটে এসেছেন! তিনিও বিদায় জানালেন অশ্রুসিক্ত চোখে। মানবচরিত্র সত্যি বড় বিচিত্র! আমার ভালো লাগলো একথা ভেবে যে, মুহম্মদের ফুলের তোড়াটি ছিলো আমার জন্য, শুধু আমার জন্য। গাড়ী রওয়ানা হলো। বিদায় হে প্রিয় বাগদাদ! বিদায় হে মুহসিন! বিদায় হে মুহম্মদ! সঙ্গে থাকুক শুধু বাগদাদের স্মৃতি! সঙ্গে থাকুক শুধু তোমাদের হৃদয়ের ভালোবাসা, তোমাদের চোখের অশ্রু এবং তোমাদের বুকের স্পন্দন! *** জীবনে এই প্রথম এমন কঠিন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। এমনকি এখনো পর্যন- এটাই আমার জীবনের কঠিনতম অভিজ্ঞতা। সাত ঘণ্টার বাসের সফর দীর্ঘ হলো পঁচিশ ঘণ্টা! কীভাবে পার হলাম এ সুদীর্ঘ পথ। আমাদের কথা থাকুক, নব্বই বছরের বৃদ্ধ হযরত! তাঁর জন্য কেমন মহাকষ্টের ছিলো এ সফর! অথচ সারা পথে তিনি কষ্টের একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি; যা কিছু হায় আফসোস তা ছিলো আমাদের মুখে। বাগদাদ থেকে কুয়েত পর্যন- দীর্ঘ পথের সুদীর্ঘ সফরের সব কথা যদি লিখতে যাই, সেটাই হয়ে যাবে আলাদা এক সফরনামা এবং হয়ত তাতে শিক্ষার কিছু এবং আনন্দের প্রচুর উপকরণ থাকবে। কিন' প্রিয় পাঠক, আমিও যে ক্লান- হয়ে পড়েছি! আমিও যে তাড়াতাড়ি পৌঁছে যেতে চাই সফরনামার শেষ শব্দটির কাছে! নইলে লিখতে পারতাম, বাসের এই দীর্ঘ পথে হযরতের পাশের আসনে বসে তাঁকে কেমন দেখেছি! তিনি কী করেছেন, কী বলেছেন। সব মনে নেই, যা আছে তাও কম নয়। তিনি বলেছিলেন, মওলভী আবু তাহের, আমার ইচ্ছা হয়, তোমাকে খেলাফতের কাজে নিয়ে আসি, কিন-ু তা‘লীমের কাজ যে আরো আহাম কাজ! তুমি তা‘লীমের কাজে ‘হামাতন’ মশগুল থাকো। তুমি দোয়া করো, দেশে যাওয়ার পর নতুন কোন ফেতনা যেন খাড়া না হয়! আমার তো বড় আশংকা ‘হইতেছে’!’ তিনি বলেছিলেন, ‘সবাই মুহব্বতের লম্বাচওড়া দাবী করে। কিন-ু চাহাতের খেলাফ কিছু হইলে ছাড়িয়া চলিয়া যায়! সবাইকে একসঙ্গে রাখা খুবই কঠিন। তুমি কখনো নূরিয়া মাদ্রসা তরক করবা না।’ আমি বলেছিলাম, হযরত নূরিয়া যদি আমাকে তরক করে? হযরত কোন উত্তর না দিয়ে অনেক্ষণ আমার মাথায় তাঁর হাত রেখেছিলেন। এখন চিন-া করে দেখছি, সম্ভবত সেটাই ছিলো আমার মাথায় হযরতের শেষ হাত রাখা! এখানে আমি লিখতে পারতাম, ইরাক ও কুয়েত সীমানে- যে তিনঘণ্টা সময় আমরা কাটিয়েছি শুধু কথা বলে, আর আমাদের হযরত শুধু নামায পড়ে, সে সময়ের অনেক কথা। মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব সে সময় আমাকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিলেন। অনেক কথা বলেছিলেন, আমার কিছু কথা শুনেছিলেন। আমার তালিমের তারীকা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, এমনকি বর্তমান সফর সম্পর্কে আমার মতামত জানতে চেয়েছিলেন। আমি কিছু কথা বলেছিলাম দ্বিধা-সংকোচ ও দায়িত্ববোধের মধ্যবর্তী একটি অবস'ান থেকে। পুরো সফরে হযরতের ছায়ায় থেকে অন্যদিকে তাকাবার সুযোগ ছিলো না। এখানে এই তিনঘণ্টা সময় তাঁকে আমি খুব কাছে থেকে এবং গভীরভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম। তিনি নিজেই আমাকে কাছে ডেকে নিয়েছিলেন। আমি অবাক হয়েছিলাম, নুরীয়ায় তা‘লীমী শুগল সম্পর্কে তিনি এত বিস-ারিত জানেন দেখে। সেসব কথা যদি এখানে লেখা যেতো হয়ত অনেকের জন্য খুব শিক্ষণীয় হতো। সীমান- থেকে বিমানবন্দর পর্যন- বাসের জানালা থেকে ছবির মত কুয়েতকে যেমন দেখেছি এবং যে অনুভূতি অর্জন করেছি তাও যদি লিখতে যাই কম চিত্তাকর্ষক হবে বলে মনে হয় না। কিন' থাক সে কথা। কুয়েত বিমানবন্দরে পৌঁছার পর নতুন বিড়ম্বনা। হযরতের এবং মাওলানা আযীযুল হক ছাহেবের পাসপোর্ট পাওয়া গেলো না। যদিও এটা নিছক দুর্ঘটনা। কিন' এজন্য দায়ী আমরা নই। পাসপোর্ট নিয়ে এমন ছেলেখেলা কোন সভ্য দেশে কল্পনাও করা যায় না। আমার পাসপোর্ট থাকবে আমার কাছে, কিন' এখানে সে উপায় ছিলো না। সীমান- চেকপোস্টে সবার পাসপোর্ট নিয়ে গেলো বাসের চালক। ফেরত পাবো বিমানবন্দরে প্রবেশ করার পর। মানতেই হলো এ অদ্ভূত নিয়ম। বিমানবন্দরে এসে পাসপোর্ট নাম ডেকে হাতে দেয়া হলো না; একটা বাক্সে সতূপ করে ফেলে রাখা হলো, আর সবাই তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো। ঘাঁটাঘাঁটি হুড়াহুড়ি করে সবাই যার যার পাসপোর্ট নিলো। এই হলো ব্যবস'া, যার দুর্গতি এখন পোহাতে হবে আমাদের। কেন? জবাব নেই। দুর্গতির দীর্ঘ বিবরণ এখানে তুলে ধরে কী লাভ। তার চেয়ে দু‘আ করি। এই জাতিটাকে আল্লাহ অতীতের সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য এবং মেধা ও যোগ্যতা আবার ফিরিয়ে দেন। আল্লাহর মেহেরবানি, কুয়েতের রেফাঈ সাহেব ছিলেন হযরতের গুণমুগ্ধ। বাংলাদেশের সফরে তিনি নূরিয়া এসেছেন কয়েকবার। হযরতের মাকাম ও মর্তবা সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন। একসময় তিনি কুয়েতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। তিনি হযরতকে নিয়ে গেলেন। হযরত এক সপ্তাহের মত তার মেহমান ছিলেন। বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বিকল্প পাসপোর্টের ব্যবস'া হওয়ার পর হযরত এবং মাওলানা আযীযুল হক ছাহেব দেশে ফিরেছিলেন। অদ্ভূত এক পরিসি'তির মধ্যে সবকিছু আল্লাহর হাওয়ালা করে আমরা বিমানে আরোহণ করলাম। বিদায়ের সময় হযরত হাসি মুখে বললেন, ‘ফিকর মাত করনা, সবকুছ উনহী কি মারযী সে হো রাহা হায়।’ -চিন-া করো না, সবকিছু তাঁরই ইচ্ছায় হচ্ছে। সকাল ন’টায় বিমান ঢাকায় অবতরণ করলো। হযরতের ইসতিকবাল করতে যারা এসেছিলেন, ঘটনা শুনে তারা হতবিহ্বল হলেন। আমরা সান-্বনা দিয়ে বললাম, আল্লাহর রহমতে তিনি নিরাপদে আছেন। আব্বা এসেছিলেন বিমানবন্দরে। আব্বা আমাকে নিয়ে এলেন আম্মার কাছে; আম্মা আমাকে পাঠালেন আমার মেয়ের কাছে; আমার স্ত্রী আমার কোলে তুলে দিলেন চারমাসের তুলতুলে ছোট্ট মেয়েটিকে। আমার মনে হলো, তিনি আমার কোলে তুলে দিলেন ফুলের সুন্দর একটি তোড়া! পুলকিত চিত্তে আমি সে ফুলের কোমল স্পর্শ এবং স্নিগ্ধ সুবাস নিলাম। আমার লক্ষী মেয়েটিকে কোলে নেয়ার মাধ্যমেই আমার জীবনের প্রথম হজ্বের সফর সমাপ্ত হলো, যার আগমন আমার জীবনে যিয়ারাতে বাইতুল্লাহর মহাসৌভাগ্য বয়ে এনেছিলো। আমরা ভাবি, সময় থেমে থাকে। আসলে তা নয়। সময় থেমে থাকে না। সময় চলতে থাকে, সময় গলতে থাকে; সেই সঙ্গে আমাদের জীবনও বিন্দু বিন্দু করে গলে যায়। আমরা ধীরে ধীরে বড় হয়ে আবার ধীরে ধীরে ছোট হয়ে যাই। সেদিন আমি ছিলাম পঁচিশ বছরের যুবক, আজ অমি পঞ্চাশ-ঊর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। আমার দাড়ি এখন সাদা, আর আমার সেই লক্ষী মেয়ে এখন শুধু আমারই মা নয়, ছোট্ট একটি সন-ানেরও মা! বাবার জন্য আল্লাহর ঘর যিয়ারাতের সৌভাগ্য নিয়ে এসেছিলো যে মেয়ে, এই সেদিন সে নিজেও যিয়ারাত করে এসেছে আল্লাহর ঘর! কত মেহেরবান আমার আল্লাহ। *** আলহামদুলিল্লাহ, বা-বরকত সফরনামাটি সুসমাপ্ত হল। পরবর্তী হজ্বের সফরনামা আগামী মহররম ১৪৩১ হিজরী থেকে প্রকাশিত হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা সহজ করুন এবং কবূলিয়ত ও মকবূলিয়ত দান করুন।-সম্পাদক

 

advertisement