যিলকদ-১৪৩২   ||   অক্টোবর-২০১১

২৮ হাজার কোটিপতি : দু’টি সহজ-সরল কথা

মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ

 

আলকাউসার জুলাই ২০১১ সংখ্যায় বাজেট পর্যালোচনার একপর্যায়ে দেশে মাথাপিছু গড় আয় নিয়ে কিছু কথা পেশ করা হয়েছিল। ঐ  লেখা প্রকাশের কয়েকদিন আগে (জুনের শেষ দিকে) দেশে মাথাপিছু ও পরিবারপ্রতি গড় আয়ের নতুন তথ্য প্রকাশ করেছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো। যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু গড় বার্ষিক আয় ৩০৬৩৬/-টাকা এবং পরিবারপ্রতি মাসিক গড় আয় ১০৬৪১/- টাকা।

ঐ তথ্য প্রকাশের দু-এক দিন পর (২৪ জুন ২০১১) আরেকটি খবর প্রকাশিত হয় খবরের কাগজগুলোতে। মোটা অক্ষরে ছাপা ঐ খবরের শিরোনাম ছিল বাংলাদেশে কোটিপতির সংখ্যা ২৮ হাজার। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের বরাতে ঐ খবরটি ছাপে পত্রিকাগুলো। খবরে বলা হয়েছে, কোটিপতির সংখ্যা মূলত আরো অনেক বেশি। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংক শুধু ব্যাংকে আমানতকারীদের তালিকা থেকে এ হিসাব বের করেছে। যে সকল কোটিপতি তাদের টাকা দেশীয় ব্যাংকে রাখে না অথবা অংশ বিশেষ রাখে এবং যারা বিভিন্ন নামে একাধিক একাউন্টে ভাগ করে করে টাকা জমা রাখে তাদের হিসাব ঐ ২৮ হাজারের বাইরে।  

এছাড়া এখানে শুধু ক্যাশ টাকার হিসাবে কোটিপতির সংখ্যা বের করা হয়েছে। দামী দামী জমি ও বহু বাড়ি-ফ্ল্যাটের মালিক, শত শত ভরি স্বর্ণালংকার ও ডায়মন্ডের ক্রেতা কোটিপতিদের হিসাব এ ২৮ হাজারের অন্তর্ভুক্ত নয়। বোঝা যাচ্ছে যে, সার্বিক বিবেচনায় প্রকৃত তথ্য বের হয়ে এলে দেখা যাবে, দেশে কোটিপতির সংখ্যা হয়ত এক লক্ষ ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে এ-ও বলা হয়েছে যে, ঐ ২৮ হাজার কোটিপতি হচ্ছে ব্যাংকের মোট আমানতকারীদের ০.৬% অথচ তাদের একাউন্টে জমা টাকার পরিমাণ হল মোট জমা টাকার এক তৃতীয়াংশ।  

উপরোক্ত দুটি তথ্য থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, আমাদের দেশে আসলে সম্পদ খুব একটা কম নেই। বরং পুরো ১৬ কোটি জনগোষ্ঠি মোটামুটি খেয়ে-পরে চলার মতো সম্পদ এই দেশেই বিদ্যমান। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঐ সম্পদের সিংহভাগই আবদ্ধ হয়ে আছে মাত্র ৫-৬% লোকের হাতে।

এর পাশাপাশি আরেকটি খবর হচ্ছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০% এরও বেশি লোক এখনো চরম দারিদ্রে্যর মধ্যে জীবন যাপন করছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান উচ্চমূল্য হত দরিদ্র জনসংখ্যার হারকে বাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আর মধ্যবিত্ত (তাদের ভাষায়) শ্রেণী তো এখন দিশেহারা লাগামহীন মূল্যস্ফীতি মোকাবেলা করতে গিয়ে। প্রতিদিনই তাদের অবস্থান মধ্য থেকে নিম্নমুখী হচ্ছে বর্ধিত বাজারমূল্য, বাড়িভাড়া ও যাতায়াত খরচের জোগান দিতে ব্যর্থ হওয়ার মাধ্যমে।

ধনী-গরীবের এ চরম বৈষম্য পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার ফসল এবং যতদিন বাজার ও অর্থনীতিতে পুঁজিবাদের রাজত্ব বহাল থাকবে ততদিন এ বৈষম্য বাড়তেই থাকবে। কারণ এ নীতির বাস্তবতাই হচ্ছে তেলা মাথায় তেল দেওয়া, ধনীকে আরো সম্পদশালী করা আর গরীবকে ফকীরে পরিণত করা।

ধনী-দরিদ্র তথা সম্পদের দিক থেকে মানুষের মাঝে তারতম্য সর্বযুগেই ছিল এবং একটি পর্যায় পর্যন্ত এটি স্বাভাবিকও বটে। কিন্তু একই সমাজের মুষ্টিমেয় কিছু লোকের পাহাড়সম সম্পদের অধিকারী হয়ে অত্যধিক বিলাসী জীবন যাপন করা এবং একই সমাজের সিংহভাগ লোকের ক্ষুধা-দারিদ্র ও অর্থনৈতিক কষ্ট-ক্লেশ নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করা একমাত্র পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থাতেই সম্ভব। কারণ এ ব্যবস্থায় একদিক থেকে সম্পদ আহরণে রয়েছে অবাধ স্বাধীনতা। অপরদিকে সে সম্পদ ব্যয়ের ক্ষেত্রেও নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ ও বাধ্যবাধকতা। সম্পদ অর্জনে যেমন কোনো নীতি-নৈতিকতা বা হালাল-হারাম দেখার প্রয়োজন হয় না; বরং সুদ, জুয়া, কৃত্রিম মূল্যবৃদ্ধি, মুনাফাখোরী এবং কাগজপত্রের কারসাজি বা কৌশলের মারপ্যাঁচে অন্যের সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার সব পথই খোলা থাকে, তেমনিভাবে সে টাকা-পয়সা ব্যয়ও করা যায় যে কোনো প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয়, বৈধ-অবৈধ এবং তথাকথিত (অশ্লীল) বিনোদনসহ যে কোনো খাতে। এছাড়া নীতি-নৈতিকতার বালাই না থাকায় আরেকটি বিশাল ধনাঢ্য শ্রেণী তৈরি হয় ঘুষ, প্রতারণা ও জুলুম-নির্যাতন ও ক্ষমতার দাপটে মানুষের কষ্টার্জিত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে।

অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষতি

বাহ্যিক দৃষ্টিতে কোনো দেশে কোটিপতি বা ধনীর সংখ্যা বাড়লে তা বরং সু-সংবাদই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চলমান পরিস্থিতিতে কেন তা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নেতিবাচক খবর। একটু চিন্তা করলেই এর কারণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। যেমন :

চাহিদা ও জোগানে ভারসাম্য নষ্ট হওয়া

অর্থনৈতিক বৈষম্যই অনেক ক্ষেত্রে বাজার উর্ধমুখী হওয়ার বড় কারণ হয়ে ওঠে। একশ্রেণীর লোকের কাছে বেহিসেবী অর্থ-কড়ি থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য যতই বাড়িয়ে দিক তারা সেগুলো স্বাচ্ছন্দেই খরিদ করে থাকে। এভাবে সরবরাহের তুলনায় কৃত্রিমভাবে অতিরিক্ত চাহিদার সৃষ্টি হয় এবং ব্যবসায়ীরা পণ্যমূল্য যতই বাড়িয়ে দিক তাতে কোনো দৃশ্যমান সমস্যা তৈরি হয় না। কিন্তু নিম্ন আয়ের লোকজন আটকে যায় সমস্যার জালে।

টাকা থাকলে সব কিছুই সম্ভব

সমাজে এ কথাটি ব্যাপকভাবে প্রচলিত যে, আমাদের দেশে টাকা থাকলে সব কিছুই করা যায়। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে ক্ষমতার উচ্চাসন থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, রাষ্ট্র-সমাজ সর্বত্র টাকাওয়ালাদের আধিপত্য। যে কোনো অসম্ভব বা বে-আইনী কাজকেই টাকার জোরে সম্ভব করে তুলতে পারে তারা। আর এ কারণেই কর্তাদের দাপটের কাছে জিম্মি হয়ে থাকে স্বল্প আয়ের লোকজন।

অপচয় ও বেহায়াপনার বিস্তার

টাকার দাপটে একশ্রেণীর লোকজন দেশের সম্পদের ব্যাপক অপচয় করে থাকে। অতীব প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ-পানি থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই এ ধারা চলছে। এছাড়া তাদের বিলাসসামগ্রি আমদানিতে ব্যয় হয়ে থাকে প্রবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রা। কখনো আবার সরকার বৈদেশিক ঋণ নিয়ে তার সুদ-আসলের বোঝা জানগণের উপর চাপিয়ে থাকে। অন্যদিকে নীতি-নৈতিকতার বালাই না থাকায় এ টাকার দাপটেই তারা দেশে ছড়িয়ে দিতে পারছে অপসংস্কৃতি ও বেহায়াপনার সয়লাব।

মিডিয়াজগত দখল

গত কয়েক বছর থেকে টাকাওয়ালারা ঝুঁকেছে মিডিয়ার দিকে। বড় বড় ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার মালিকানা নিয়ে রাষ্ট্রের তৃতীয় বিবেক (তাদের ভাষায়) সাংবাদিক ও সংবাদ জগতকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করছে একশ্রেণীর ধনকুবের গোষ্ঠি। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের ভবিষ্যত সম্পদ-তরুণ ও যুবক শ্রেণীর মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে অসুস্থ বিনোদনের ধারা।

ভালো টাকাওয়ালাও আছেন

এত সবের মধ্যেও দেশে এখনো কিছু নেককার ধনাঢ্য লোক অবশিষ্ট আছেন, যারা সম্পদ কামাইয়ের ক্ষেত্রে যেমন হালাল-হারাম বেছে অগ্রসর হন তেমনি সম্পদের অপচয় রোধেও সচেষ্ট থাকেন। তাদের দিক থেকে নিম্ন শ্রেণীর লোকজন শুধু নিরাপদেই থাকে না; বরং নিজেদের টাকার পুঙ্খানুঙ্খ যাকাত আদায় এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতার মাধ্যমে এ মুষ্টিমেয় কিছু মানুষই এখনো  গরীবদের জন্য কল্যাণবাহী হয়ে আছেন। মানুষের শিক্ষা, নৈতিকতা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উন্নয়ন ও প্রচার-প্রসারে এদের কষ্টার্জিত অর্থ অকাতরে ব্যয় হয়ে থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, প্রথমোক্ত শ্রেণীর ধনীদের দাপটে এদের হার দিন দিন নিম্নমুখি হচ্ছে।

কেন এ আলোচনা

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো কর্তৃক ঘোষিত মাথাপিছু গড় আয় ও দেশের কোটিপতির হিসাব নিয়ে মূলত দুটি কথা বলার জন্য আলকাউসারে আলোচনার প্রয়োজন অনুভব করা হয়েছে। প্রথম কথা হচ্ছে, মানুষসহ আল্লাহ রাববুল আলামীনের যত সৃষ্টি দুনিয়ায় আছে তাদের সকলের রিযিকের ব্যবস্থাও তিনি দুনিয়ায় রেখেছেন। কিন্তু বিশ্বব্যাপী সে রিযিকের বৃহদাংশ দখল হয়ে আছে মুষ্টিমেয় আধিপত্যবাদী বিলিয়নিয়ার ও কোটিপতিদের হাতে। শুধু ব্যাংকে জমা টাকার হিসাবেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কোটিপতি সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা মোট আমানতকারীর  ০.৬%। অথচ তাদের দখলে রয়েছে এক তৃতীয়াংশ টাকা। আর অবশিষ্ট ৯৯.৪% লোকের হাতে আছে অবশিষ্ট দুই তৃতীয়াংশ সম্পদ। শুধু তাই নয়; বরং অন্যদের জমা টাকাও এরাই ভোগ করছে ঋণ হিসেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৬৫% ভাগই কোটিপতিদের দখলে রয়েছে এবং একই সূত্র অনুযায়ী ঋণ খেলাপিও তারাই বেশি।

কয়েক বছর আগে জাতিসংঘের কোনো অঙ্গ সংস্থার প্রতিবেদনে পড়েছিলাম যে, বিশ্বের সমুদয় সম্পদের ৫০% নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র ১% মানুষ। এভাবেই আল্লাহর দেওয়া সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে যাচ্ছে মুষ্টিমেয় লোকের হাতে, আর বঞ্চিত হচ্ছে বৃহত্তর জনসমাজ এবং তারা জিম্মি হয়ে বসবাস করছে অর্থওয়ালাদের বহুমুখি দাপটের নিচে।

দ্বিতীয় কথা হচ্ছে উক্ত সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে ইসলামের ইনসাফভিত্তিক সুষম ও ভারসাম্যপূর্ণ অর্থ ব্যবস্থার বাস্তবায়ন করা। যেখানে ধনী-গরীবের মাঝে সম্পদে ব্যবধান থাকবে, কিন্তু বৈষম্য থাকবে না। ধনীদের সম্পদ থেকে গরীবরা যাকাত-উশরসহ অন্যান্য পাওনা গ্রহণ করবে অধিকার হিসেবে, করুণাস্বরূপ নয়।

আর সম্পদ অর্জনের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধিবিধান কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হলে বন্ধ হয়ে যাবে হারাম ও অনৈতিক পন্থায় অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার সকল পথ। সুদ, জুয়া, ফটকাবাজি এবং কৃত্রিম সম্পদ সৃষ্টির রাস্তাগুলো বন্ধ করলেই অর্থ-সম্পদের মালিকানা সম্প্রসারিত হবে এবং বিকেন্দ্রিত হবে বিশ্বব্যাপী অর্থের নিয়ন্ত্রণ। কমে আসবে কোটিপতিদের ক্ষমতার দাপট, তখন আর এ হিসাব শুনতে হবে না যে, ৩০০ সংসদ সদস্যের ১২৮ জনই হচ্ছে কোটিপতি (মোট সদস্যের ৪৪%)।

এছাড়া গণমানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধ ও শিক্ষা উন্নয়নের মাধ্যমে তাদেরকে নৈতিক বিষয়ে সচেতন করা গেলে কমে যাবে লাগামহীন দুর্নীতি। এতে ঘুষ-প্রতারণা ও জোরজুলুম করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার রাস্তাগুলো হয়ে যাবে সংকীর্ণ। তখন আর এ তথ্যও শুনতে হবে না যে, কোটিপতিদের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছে সামরিক-বেসামরিক আমলা।

মোটকথা হচ্ছে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বহুবিধ সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থ-ব্যবস্থার ছোবল থেকে বেরিয়ে এসে ইসলামের ইনসাফভিত্তিক অর্থনীতির বাস্তবায়ন। একই সঙ্গে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়ে মানুষের নৈতিকতার উন্নয়ন করার মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টি করে সৎ লোকদের ক্ষমতায়ন ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন করা।  

 

 

 

advertisement