সা ম্প্র দা য়ি ক তা : ইসলাম বিরোধী সাম্প্রদায়িকতার চেনা-অচেনা মুখ
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র কয়েক বছর পর ইসলাম এবং নবীয়ে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর প্রথম প্রকাশ্য আক্রমণের ঘটনা ঘটে দাউদ হায়দার নামের এক কবির কবিতায়। এরপর আশির দশকে আরেকটি আক্রমণ হয় আলাউদ্দিন নামের এক হতভাগার মাধ্যমে। তারও পর দৃশ্যে আসে আহমদ শরীফ নামের এক পন্ডিত (?) এবং তসলিমা নসরীন নামের এক বিকৃত চরিত্রের লেখিকার নাম। এর সবকটি চরিত্রই ছিল নামধারী মুসলিম এবং মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া। এমনকি উচ্চ আদালতের বেঞ্চে বসে ফতোয়া ‘নিষিদ্ধ’ ঘোষণাকারী বিচারপতি দু’জনের জন্মও হয়েছে মুসলিম পরিবারে। এদের সবার বিরুদ্ধেই বিক্ষোভ হয়েছে। আন্দোলন হয়েছে। বিক্ষোভ ও জনরোষের মুখে এদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু সেসব আন্দোলন ও বিক্ষোভের সময় ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের কেউ অন্য ধর্মের অনুসারী কারো নাম মুখে আনেননি। সবাই অনুভব করতেন যে, এরা হচ্ছে শরীয়তের দৃষ্টিতে মুসলিম পরিবারে জন্ম নিয়ে ধর্মত্যাগ করা মুরতাদ। এখানে অন্য ধর্মাবলম্বী কারো কোনো প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততা নেই। যদিও এদের কারো কারো ক্ষেত্রে অন্য ধর্মাবলম্বী দেশ, গোষ্ঠী ও ব্যক্তিদের পিঠচাপড়ানো ও উস্কানির আলামত ছিল, কিন্তু সেদিকে কেউ চোখ দিতে চাননি। অথচ অতি সাম্প্রতিককালে ঘটে চলছে সম্পূর্ণ উল্টো ও পিলে চমকানো সব ঘটনা। ইদানীং ইসলাম এবং ইসলামের নবীর ওপর নোংরা আক্রমণের খোলা তরবারি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে দেশের প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায়েরই কিছু লোক। সবাইকে অবাক করে দিয়ে এবং সারা দেশকে জানান দিয়ে তারা একের পর এক ঘটনা ঘটিয়েই চলেছে চরম বে-পরোয়া ভঙ্গিতে। ১০ আগস্টের পত্রিকার পাতা থেকে সেসব ঘটনার দু’একটি নমুনা এখানে দেখা যাক।
* ২০১১ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর বিশ্বাস দশম শ্রেণীর ক্লাসে দাড়ি রাখা নিয়ে সমালোচনাকালে নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর অবমাননা করে। এতে ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে পুরো এলাকায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে শঙ্কর বিশ্বাস টুঙ্গিপাড়া থেকে পালিয়ে যায়।
* ২০১১ সালের ২৬ জুলাই ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মদন মোহন দাস মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং পবিত্র হজ নিয়ে কটুক্তি করে। সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে এক সভায় সে মন্তব্য করে, ‘এক লোক সুন্দরী মহিলা দেখলেই বিয়ে করে। এভাবে বিয়ে করতে করতে ১৫/১৬টি বিয়ে করে। মুহাম্মদও ১৫/১৬টি বিয়ে করেছে। তাহলে মুসলমানদের মুহাম্মদের হজ করা স্থান মক্কায় গিয়ে হজ না করে ওই ১৫/১৬টি বিয়ে করা লোকের বাড়িতে গিয়ে হজ করলেই তো হয়।’ (নাউযুবিল্লাহ)
এরপর তাকে প্রথমে পঞ্চগড়ের একটি স্কুলে বদলি করা হয়। পরে আবার অব্যহতি দেওয়া হয়। কিন্তু লক্ষ্য করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, এ দু’জনের কাউকেই গ্রেফতার করা হয়নি। যতদূর জানা গেছে, এরা আত্মগোপন করেও নেই। বুক ফুলিয়েই ঘুরাফেরা করছে এবং স্বসম্প্রদায়ের লোকজনের কাছ থেকে ‘সাহসী’ কাজের জন্য যথেষ্ট বাহবাও পাচ্ছে।
* ঠিক বছর খানেক আগের আরেকটি ঘটনার দিকেও সবার মনোযোগ যেতে পারে। সেটি হচ্ছে, ২০১০ সালের ১ আগস্ট বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট পরিচয়দানকারী জনৈক দেবনারায়ণ মহেশ্বর পবিত্র কুরআন শরীফের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে। রিট আবেদনে সে দাবি করে, হযরত ইবরাহীম (আ.) তার বড় ছেলে ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন বলে যে আয়াত কুরআন শরীফে রয়েছে, তা সঠিক নয়। সে দাবি করে, হযরত ইবরাহীম তার ছোট ছেলে হযরত ইসহাক (আ.)কে কুরবানি করতে নিয়ে যান। এ বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা ও কুরআনের আয়াত শুদ্ধ করার জন্য দেবনারায়ণ মহেশ্বর আদালতের কাছে প্রার্থনা করে। আদালত রিট খারিজ করে দেওয়ার পর দেবনারায়ণের এই চরম হঠকারী ও উস্কানিমূলক কর্মকান্ডে আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পুলিশ দেবনারায়ণ মহেশ্বরকে কর্ডন সহকারে এজলাস থেকে বের করে তাদের ভ্যানে প্রটেকশন দিয়ে আদালত এলাকার বাইরে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রেও গ্রেফতার করার কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এ ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটিরই খবর মিডিয়াতে প্রচার হয়েছে। দেশবাসীর মাঝে ক্ষোভ ও উত্তেজনা ছড়িয়েছে। কিন্তু দৃশ্যপট থেকে এদের সরিয়ে নিয়ে পিঠ বাঁচানো ছাড়া এদের ব্যাপারে আর কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এতেই প্রশ্ন সৃষ্টি হয় যে, এসব অপকর্মের পেছনে তাহলে কি ক্ষমতাধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ও দেশি-বিদেশি উপর মহলের কোনো সূক্ষ্ম পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে? এ প্রশ্নের এজমালি উত্তরটি জানা থাকলেও সুস্পষ্ট কোনো জবাব আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে এ প্রশ্নও এখন সৃষ্টি হচ্ছে যে, তাহলে কি নজীরবিহীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ-বাংলাদেশে এবার উপর মহলের পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলাম বিরোধী বিপরীত সাম্প্রদায়িকতার কোনো নতুন পর্ব শুরু হল? কেউ কেউ অবশ্য এ প্রশ্নের জবাবে বলতে পারেন, এগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একজন-দু’জনের ঘটনা। এটাকে এভাবে সামগ্রিকীকরণ ঠিক নয়। কিন্তু সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ, আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস এবং ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের বৈধতা-অবৈধতা বিষয়ে বছর খানেক ধরে আইন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান সরকার দলীয় মুখচেনা সংখ্যালঘু নেতার মুখভেংচানো বক্তব্য ও বিষোদগারের প্রতিটি বাক্যের সঙ্গে এসব ধৃষ্টতাকে মিলিয়ে দেখলে এগুলোকে কতটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মনে করা সম্ভব-ভেবে দেখা উচিত।
ইসলামবিরোধী ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িকতার জোয়ার কে কিভাবে কোন দিক থেকে প্রবাহিত করছে-এ বিষয়টা আরেকটু গভীরভাবে অনুধাবনের জন্য আমরা ভিকারুন নিসা নুন স্কুলের পরিমল ছত্রধর এবং আরও কয়েকজন সংখ্যালঘু শিক্ষকের নির্ভীক ও নির্বিকার চিত্তে দিনের পর দিন মুসলিম ছাত্রী নির্যাতন ও ধর্ষণের তোলপড়া করা ঘটনার দিকে চোখ ফেরাতে পারি। কতোটা ‘সাহস’ এবং কতোটা দুর্বৃত্তপনা বুকের মধ্যে লালন করতে পারলে একপাল সংখ্যালঘু শিক্ষক এক গুচ্ছ কোমল ফুলের মতো মুসলিম ছাত্রীর উপর বর্বরতা চালিয়ে যাওয়ার মতো জিঘাংসা প্রকাশ করতে পারে-সবার ভেবে দেখা দরকার। কাছাকাছি সময়ে ধামরাইয়ের এক মুসলিম কিশোরীকে সংখ্যালঘু তরুণ কর্তৃক গুম করে দেওয়া এবং মেয়েটির মাথায় সিঁদুর লাগিয়ে সে ছবি তার বাবার কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার খবরও পত্রিকার পাতায় ছাপা হয়েছে। এর সবগুলোই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা? কতগুলো এবং কত ধরনের ঘটনা ঘটলে পরে সেটাকে সামগ্রিক রূপদান করা সমীচীন হবে?
পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, ইসলামবিরোধী উগ্র সাম্প্রদায়িকতার যে পর্বটি হঠাৎ করে শুরু হয়েছে, তার শেকড় বহু গভীরে প্রোথিত। আর এর প্রকাশ ক্ষেত্রও হতে পারে বিচিত্র। ধর্মবিশ্বাস থেকে নিয়ে নারীর সম্ভ্রম লুট এবং আর্থিক নৈরাজ্য থেকে নিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি সব দিকেই এ সাম্প্রদায়িকতার দাঁতালো মুখ দৃশ্যমান হয়ে উঠতে পারে। তাই দলবাজি, স্বার্থ ও উদাসীনতার ঘুম ভেঙ্গে কমন কিছু বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ সতর্কতা গ্রহণ করা সবার জন্যই খুব জরুরি।