আমাদের সময় আমরা কী কাজে ব্যয় করছি
অনেক বোনকে দেখা যায়, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করছেন। সময় বয়ে চলেছে, অর্থহীন প্রলাপে আমলনামা ভরে উঠছে, অথচ তারা গল্প করছেন। এভাবে প্রতি মুহূর্তে জীবনের দৈর্ঘ্য কমে আসছে, অমোঘ মৃত্যু নিঃশব্দ পদে এগিয়ে আসছে। আর তারা গল্প করছেন ... গল্প ...। সাথে চলছে গীবত ও পরনিন্দার কলুষিত পাপচর্চা।
প্রিয় বোন! এই যে আপনি গল্প করছেন এর পরিণাম সম্পর্কে কি কখনো ভেবেছেন?
আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাদের মাগবূন ও ক্ষতিগ্রস্ত বলেছেন, আপনি তাদের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন না তো?
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো বলেছেন-অধিকাংশ লোকই দুটি নেয়ামতের (কদর না করে) ক্ষতিগ্রস্ত হয় : নেয়ামত দুটি হচ্ছে সুস্থতা ও অবসর।-সহীহ বুখারী, মিশকাত
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, তোমরা পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয় আসার পূর্বেই গুরুত্ব দাও এবং এর সদ্ব্যবহার কর। বার্ধক্যের পূর্বে যৌবনকে, অসুস্থতার পূর্বে সুস্থতাকে, দারিদ্রে্যর পূর্বে স্বচ্ছলতাকে, ব্যস্ততার পূর্বে অবসরকে এবং মরণের পূর্বে জীবনকে।-জামে তিরমিযী
এই হাদীসগুলোর আলোকে একবার ভেবে দেখুন তো! এই যে আপনি গল্প করছেন, জীবনের অবসর সময়কে কাজে না লাগিয়ে অবহেলায় নষ্ট করছেন সর্বজ্ঞ ও সর্বজ্ঞাত আল্লাহ পাকের কাছে কেয়ামতের মাঠে আপনি কী জবাব দিবেন?
খাঁটি মুমিনের একটি গুণ, সে অহেতুক কোনো কিছুতেই সময় ব্যয় করে না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, অর্থহীন কাজকর্ম ত্যাগ করার মাঝেই মুমিনের সৌন্দর্য নিহিত আছে।-সুনানে ইবনে মাজাহ, মিশকাত
প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হুমাইদী খুব সুন্দর বলেছেন-মানুষের সাথে মেলামেশার কী লাভ, কিছু প্রলাপ ও অর্থহীন তর্ক-বিতর্ক ছাড়া? অতএব জ্ঞানার্জন ও আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন ছাড়া লোকজনের সাথে দেখা-সাক্ষাত কমিয়ে দাও। -হেকায়েতে সাহাবা
যদি বলা হয়, মানুষের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস কী? তবে এর উত্তর হবে সময়। অন্য ভাষায় সময়ের সমষ্টির নামই জীবন। এই সময় অফুরন্ত নয়। প্রদীপের তেলের মতোই সময়রূপ তেল যখন ফুরিয়ে যাবে তখন জীবনরূপ প্রদীপও যাবে নিভে। আর শুরু হবে এক অন্তহীন জীবন। যার শুরু আছে কিন্তু শেষ নেই। দুনিয়ার জীবনের কৃতকর্মের উপর নির্ভর করছে সে জীবনের সফলতা ও ব্যর্থতা। এই সফলতা ও ব্যর্থতার মাপকাঠিও সেই অমোঘ জিজ্ঞাসা-আমি তোমাকে জীবন দিয়েছিলাম তা তুমি কোন কাজে ব্যয় করেছ? ভালো কাজে কি মন্দ কাজে?
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, এমন কোনোদিন যায় না যেদিন সূর্যোদয়ের সময় সে এ কথা ডেকে বলে না যে, হে বনী আদম! আমি শেষ দিন পর্যন্ত আর কখনো তোমার কাছে ফিরে আসব না। সুতরাং তোমরা আজকের মধ্যে যতটুকু সম্ভব ভালো কাজ করে নাও। (বায়হাকীর রেওয়ায়েতে, কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা)
সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. সূর্যাস্তের সময় এ বলে অনুতাপ করতেন যে, হায়! আমার জীবন থেকে একটি দিন কেটে গেল। কিন্তু আমার আমল তো বৃদ্ধি পেল না।
প্রসিদ্ধ তাবেয়ী হযরত আমের ইবনে আবদে কায়েস রাহ.-এর কাছে একবার এক লোক এসে খানিকক্ষণ তাঁর সাথে গল্প করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমি তোমার সাথে গল্প করব, কিন্তু ততক্ষণ সূর্যটাকে তোমার ধরে রাখতে হবে। (কীমাতুয যামান ইনদাল উলামা)
ইমাম দাউদ তায়ীকে কেউ রুটির পরিবর্তে ছাতু পানিতে মিশিয়ে খেতে দেখে কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, আমি হিসাব করে দেখেছি, রুটি খেতে যে অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয় সে সময়ে অন্তত পঞ্চাশটি আয়াত তেলাওয়াত করা যায়।
ইতিহাসে এ ধরনের আরো অনেক কাহিনী ও নমুনা ছড়িয়ে আছে। সব কথা ও কাহিনীর মূল বার্তা হল, সময়ের যথাযথ মূল্যায়ণ করা। অহেতুক কাজে বা কথায় সময় নষ্ট না করা।
অবসর সময়ে হাসি-তামাশায় মেতে না থেকে এই সময়টুকুকে আমরা অনেকভাবেই কাজে লাগাতে পারি। এই সময়টা আমরা যিকর-আযকার ও তাসবীহ-তাহলীলে কাটাতে পারি। জীবনে তো আমাদের কত ধরনের কত সংকটই লেগে আছে। যিকরের বরকতে আমাদের জীবনের সে সব সংকট অনেকটাই কেটে যাবে আর আখেরাতের প্রাপ্তি তো আছেই।
সবচেয়ে বড় কথা, যিকরকারী ব্যক্তি যিকরের মাধ্যমে যে আন্তরিক প্রশান্তি ও স্বস্তি লাভ করেন দুনিয়ার আর কোনো কিছুতেই তা পাওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-(তরজমা) নিশ্চয়ই আল্লাহর যিকর অন্তরকে প্রশান্তি দান করে।-সূরা রা’দ : ২৭
হিফযুল কুরআন এবং হিফযুল হাদীসের সংকল্প করতে পারি। দৈনিক পাঁচটি করে আয়াত অথবা একটি করে হাদীস মুখস্থ করলেও তো কম নয়। এমন করলে ছয়/সাত বছর পর হয়তো দেখা যাবে পুরো কুরআন অথবা হাদীসের বিশাল এক ভান্ডার মুখস্থ হয়ে গেছে।
এই সময়টুকুতে আমরা পড়াশোনার চেষ্টা করতে পারি। অনেক বোনকে দেখেছি, তারা বিয়ের পূর্বে যা একটু পড়াশোনা করতেন, বিয়ের পর তাও ছেড়ে দিয়েছেন। কারণ হিসেবে বলেন এখন আর পড়ালেখা করে কী হবে? কেন বোন! পড়ালেখার সাথে বিয়ের কী সম্পর্ক? পড়ার জন্য কি বয়সের কোনো নির্দিষ্ট সীমা টানা আছে? উম্মুল মুমিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রা. কিংবা উম্মে সালমা রা. তো নবীজীর সংসারে আসার পরই সব শিখেছেন।
কেউ কেউ শ্বশুর বাড়িতে স্বামীর অসহযোগিতা এবং অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের বিদ্রুপাত্মক মনোভাবের কথা বলে থাকেন। কিন্তু তারপরও আমি বলব, প্রিয় বোন! আপনার কাছে যদি এসব অহেতুক গল্প-কথার মজলিস ঘৃণিত হয়, আপনি যদি আপনার লক্ষ্যে অবিচল হন, আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ করেন এবং ইচ্ছা করেন পড়াশোনা করে জীবনের মূল্যবান সময়টাকে কাজে লাগাবেন এবং এতে যে বিদ্যাটা আপনার অর্জিত হবে তা কোনো কল্যাণ কাজে ব্যয় করবেন তবে আপনি অবশ্যই সফল হবেন। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-(তরজমা) যারা আমার পথে সাধনায় আত্মনিয়োগ করে তাদেরকে আমি অবশ্যই পথপ্রদর্শন করব। নিশ্চয়ই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের সঙ্গে আছেন।-সূরা আনকাবুত : ৫৯
আমাদের অনেকের পরিবারেই আর্থিক সংকট ও টানাটানি আছে। হালাল উপার্জনে টানাটানি থাকাটাই স্বাভাবিক। বর্তমানে দেশে অনেক ধরনের হস্ত ও কুটির শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটছে। বাজারেও এসবের চাহিদা যথেষ্ট। কোনো পুঁজি ছাড়াই এবং ঘরে বসে এসব কাজ করে বেশ লাভ করা যায়।
অবসর সময়ে এসব হস্তশিল্পের মধ্য থেকে যে কোনো একটা নির্বাচন করে এর পেছনে সময় ব্যয় করলে সময়টাও কাজে লাগবে এবং স্বামীকে সংসার ব্যয়ে কিছুটা হলেও সাহায্য করা হবে।
বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর স্ত্রী হযরত রায়েতা রা. হাতের কাজ করতেন এবং তার আয় সংসারের প্রয়োজনে ব্যয় করতেন। সংসারের প্রয়োজনের কারণে তিনি তার উপার্জিত অর্থ সদকা করতে পারতেন না। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে এসে একবার তিনি এ বিষয়ে অনুযোগ করলে এবং এই ব্যয়ে কোনো সওয়াব হবে কি না জানতে চাইলেন। উত্তরে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-এতে তোমার দুটি সওয়াব হবে। একটি আত্মীয়দেরকে দান করার এবং অপরটি সদকার।-মুসনাদে আহমদ
আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে সময়রূপ জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্পদকে উপলব্ধি করার এবং তার যথার্থ মূল্যায়ণ করার তাওফীক দান করুন। আমীন ইয়া রাববাল আলামীন।