সে চলে গেছে আপনজনের কাছে!
কত হয়েছিল ওর বয়েস? সাতাশ-আটাশ। যৌবন সবে শুরু হয়েছিল। নতুন সংসারে তার ছিল একটি পুত্র। কিন্তু কে জানত, যৌবনের সূচনায় ছিল তার জীবনের সমাপ্তি। তাই একমাত্র পুত্রকে এতিমের গৌরব দান করে সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিল।
ও ছিল সবচেয়ে সরল, কিন্তু সবার চেয়ে বুদ্ধিমান; সবচেয়ে অসুস্থ, কিন্তু সবার চেয়ে স্বাস্থ্যবান; সবচেয়ে অসুখী, কিন্তু সবার চেয়ে হাসিখুশি! জীবন থেকে সে বেশি কিছু পায়নি, তবে যা পেয়েছিল তাতেই বিভোর ছিল।
তার সুযোগ হয়নি দীর্ঘ পড়াশোনার; দরসে কুরআন, দরসে হাদীসের লযযত হাসিল করার; সে পায়নি উপার্জনের সফলতা ও প্রতিষ্ঠার গৌরব! সে তো ছিল পরিবারের সবার চেয়ে ‘অপ্রয়োজনীয়’। অথচ তারই বিদায়ে যেন সব শূন্য হয়ে গেল!
ও ছিল সবার চেয়ে আদরপ্রিয়; কটুকথার শত কষাঘাতেও ওর ব্যাকুল হৃদয় বিমুখ হত না। প্রিয়জনের জন্য ওর ছিল বুকভরা বিশ্বাস, মুখভরা হাসি। ও শুধু খুঁজে ফিরত একটু আদর, একটুখানি প্রশ্রয়!
শেষবার ও যখন আমার বাসায় এল, কী কারণে সেদিন যেন একটু ভালো খাবারের আয়োজন ছিল। আমি তার সামনে দস্তরখান বিছালাম, সামনে বসে খাওয়ালাম। ও খুব আনন্দিত হল। আহা! যদি জানতাম, বিনা দাওয়াতে ভাইটি আমার এসেছিল আমাকে মেহমানদারির সৌভাগ্য দিয়ে যেতে! আমি কীভাবে জানব, ও এসেছিল আমার সারা জীবনের সান্ত্বনার শুভ্র পুষ্প হাতে নিয়ে?!
মৃত্যুর আগের দিনও জায়নামাযে বসে দোয়া করেছে, সবার জন্য আল্লাহর দরবারে চোখের পানি ফেলেছে। ভাইটিকে আমি কিছুই দিতে পারিনি, ও সবাইকে আঁচল ভরে দিয়ে গেছে।
***
সেদিন সকাল থেকে ধীরে ধীরে ওর কষ্ট শুরু হল। খুব বোধ হয় পিপাসা হয়েছিল, বুক বোধ হয় শুকিয়ে উঠেছিল। ওর স্ত্রীকে আল্লাহ দুনিয়া-আখেরাতের সকল মঙ্গল দান করুন, সে বোরকা পরে স্বামীর জন্য ‘ঠান্ডা’ নিয়ে এসেছিল।
কষ্ট যখন বেড়ে গেল, আম্মা ছিলেন ওর পাশে। আমার ভাইটি শৈশব থেকেই সৌভাগ্যবান, তবে মৃত্যুর শয্যায় মায়ের সান্নিধ্য ছিল তার পরম সৌভাগ্য।
আববা বোঝেন নি, তবুও বলেছেন, ‘ইস্তিগফার কর’। আম্মা বুঝেছেন, তাই বলেছেন, ‘বাবা! কালেমা পড়।’ সাথে সাথে তার মুখে কালেমা জারি হল এবং ইস্তিগফার শুরু হল। এরপর কষ্ট ও কালেমা, কালেমা ও কষ্ট-এভাবেই তার শেষ মুহূর্তগুলো নিঃশেষ হয়ে এল এবং ... আলহামদুলিল্লাহ, সর্বশেষ মুহূর্তটিও তাওহীদের কালেমায় মহিমান্বিত হয়ে গেল! সে আল্লাহর কাছ থেকে এসেছিল, আবার আল্লাহর কাছেই ফিরে গেল!
সে তো আলিম ছিল না, তবে কিছু সময় তালিবে ইলম ছিল। তার তো সম্পদ ছিল না, তবে পিতা-মাতার স্নেহের ছায়া ছিল। তাহলে কি আল্লাহ মেহেরবানের এই ছিল ‘গোপন’ ইচ্ছা-বান্দাকে তিনি দুহাত ভরে দিবেন জীবনের শেষ মুহূর্তে? আর তাই বুঝি আল্লাহর নবী নিষেধ করেছেন শত কষ্টেও জীবন থেকে ‘বিমুখ’ হতে?
***
তাকে গোসল দেওয়া হল, কাফন পরানো হল, জীবনের শেষ দিনগুলোতে সে হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে ভালো, সবচেয়ে সুন্দর। সে কি পেয়েছিল স্বর্গের হাতছানি, তাই ব্যাকুল হয়েছিল বিদায় দিতে ও বিদায় নিতে? সে কি পেয়েছিল বেহেশতের সুবাস; তাই হয়েছিল এত প্রফুল্ল, এত প্রাণবন্ত?
ঐ তো মওতের খাটিয়ায় শুয়ে আছে আমার ভাই প্রশান্ত মুখে! আমার আগেই তার এসেছে আকাশের ডাক! তাই সাদা পোশাকে প্রস্ত্তত হয়েছে মেঘের রাজ্যে চলে যাবে বলে? এখন কেউ তাকে কষ্ট দিবে না, সরলতার সুযোগে প্রতারণা করবে না। এ জীবনের সকল যন্ত্রণা সে অতিক্রম করেছে! সে এসেছিল এই অচেনা সংসারে অতিথি হয়ে। এখন ফিরে চলেছে তার সবচেয়ে আপনজনের কাছে।
আমি দেখলাম, কেমন হয় সন্তান-হারানো মায়ের অশ্রু! আমি অনুভব করলাম, কেমন হয় পুত্র-হারানো বাবার বেদনা! আমি কখনো ভুলব না আমার বৃদ্ধ পিতার শুকনো মুখ, রক্তিম চোখ, আর তপ্ত অশ্রু। আমি ভুলতে পারব না আমার অসুস্থ মায়ের ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না আর আববাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ব্যাকুল চেষ্টা! আমি কীভাবে ভুলব, আমার আববার মুনাজাতের দৃশ্য, সন্তানের মাগফিরাতের জন্য তার আকুল মিনতি।
***
ইশার নামাযের পর সালাতুল জানাযা হল। মাদানী নগর মাদরাসার আসাতিযা ও তালিবানে ইলম তার সালাতুল জানাযা পড়লেন। সবার পরনে সাদা লেবাস, মাথায় সাদা টুপি, সকলেই যেন বেহেশতের মুসাফির! মঞ্জিলের পথে সবাই অপেক্ষারত! একজনের ডাক এসেছে, তাই সবাই তাকে বিদায়-সালাম জানালেন!
আমি বড় কৃতজ্ঞ তাঁদের প্রতি, যারা আমার ভাইকে নওশার সাজে সাজিয়ে দিয়েছেন, যাঁরা সালাতুল জানাযা পড়ে তার খাটিয়া বহন করেছেন, যাঁরা তার শেষ শয্যা প্রস্ত্তত করে তাকে যত্নের সাথে শায়িত করেছেন।
আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব তাঁদের প্রতি, যাঁরা আমার ভাইয়ের জন্য ফেলবেন দু’ ফোটা চোখের পানি এবং আল্লাহর দরবারে করবেন মাগফিরাতের দুআ। আল্লাহ মেহেরবান যেন সবাইকে দান করেন সুন্দর মৃত্যু, সবাইকে নসীব করেন মুমিনের দিলের দুআ।
ইয়া আল্লাহ! আমার ভাইটিকে তুমি মাফ করে দাও। তুমি তো সকল দাতার বড় দাতা, সকল দয়ালুর বড় দয়ালু, তোমার বান্দার প্রতি তুমি দয়া কর। দুনিয়াতে যেমন করেছ আখিরাতেও তাকে সৌভাগ্যবান কর। তুমিই তার সবচেয়ে আপনজন, সবচেয়ে বড় আশ্রয়! ষ
[টীকা : ওর নাম মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া আবদুল্লাহ। গত ২০ রজব ’৩২ হি. মোতাবেক ২৩ জুন ’১১ ঈ. রোজ বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩ টায় তার ইন্তেকাল হয়েছে। আল্লাহ তাকে জান্নাত নসীব করুন।]