বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১৫
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বিমান থেকে যাত্রা শুরুর ঘোষণা এলো এবং তা আরবী ভাষায়। সউদিয়ার ত্রুটি অনেক, বিশেষ করে আমাদের মত ‘মিসকীন’ দেশের যাত্রিদের ক্ষেত্রে। তবু এই একটি কারণে সউদিয়া এখনো আমার প্রথম পছন্দ। সফরের শুরুতেই পাওয়া যায় বিশুদ্ধ আরবী ভাষার সজীব সিণগ্ধ পরশ, যদিও তা মাত্রই ‘একপশলা বৃষ্টি’। এর পর জিদ্দা পর্যন্ত আর ‘মেঘের’ দেখা নেই। বিমানের সেবক-সেবিকা, ওরা যে কোন দেশের, আল্লাহ মালুম!
এরপর প্রথমে পড়া হলো সওয়ারিতে আরোহণের দু‘আ-
سُبْحَانَ الَّذِيْ سَخَّرَ لَنَا هَذَا وَمَا كُنَّا لَهُ مُقْرِنِيْنَ وَإِنَّا إِلَى رَبِّنَا لَمُنْقَلِبُوْنَ.
সওয়ারিতে আরোহণের কত সুন্দর দু‘আ স্বয়ং আল্লাহ তাঁর পাক কালামে আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন!
‘সকল পবিত্রতা ঐ মহান সত্তার যিনি আমাদের জন্য বশীভূত করেছেন একে, অথচ আমরা সক্ষম ছিলাম না একে বশীভূত করতে, আর অবশ্যই আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট প্রত্যাবর্তন করবো।’
‘হাযা’ (একে) এমন একটি শব্দ যা সে যুগের উটের ক্ষেত্রে যেমন সত্য ছিলো, তেমনি সত্য আজকের জলযান ও আকাশযানের ক্ষেত্রে, তেমনি সত্য হবে আগামী যুগের অজানা যে কোন বাহানের জন্য!
বাহন সবযুগেই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। ঘোড়া বা উঠের পিঠ থেকে পড়ে গিয়ে তখনো প্রাণহানি ঘটত, আর আধুনিক যুগের যানবাহন কত ঝুঁকিপূর্ণ তা তো আমাদের কারো অজানা নয়। সে জন্য কত রকম নিরাপত্তা- ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, কিন্তু আল্লাহ অনুগ্রহ করে দু‘আর কত বড় একটা রক্ষাকবচ দান করেছেন, আমাদের! এই দু‘আ পড়ে ইনশাআল্লাহ আমরা যানবাহনের সর্বপ্রকার বিপদ ও দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকতে পারি, কিন্তু কত বড় গাফেল ও দুর্ভাগা আমরা! এ বিমানের প্রায় সকলে আমরা বাইতুল্লাহর মুসাফির। পরিচিত অপরিচিত কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম আরোহণের দু‘আ পড়েছেন কি না। দু’একজন বাদে কেউ পড়েননি। দু‘আটি জানেন না, এমনো পাওয়া গেলো কয়েকজন। আল্লাহ আমাদের অবস্থার সংশোধন করুন, আমীন।
তারপর পড়া হলো সফরের দু‘আ-
اللّهُمَّ إِنَّا نَسْأَلُكَ فِيْ سَفَرِنَا هَذَا الْبِرَّ وَالتَّقْوَى وَمِنَ الْعَمَلِ مَا تُحِبُّ وَتَرْضَى
হে আল্লাহ, আমরা আমাদের এই সফরে আপনার নিকট পুণ্য ও ধার্মিকতা প্রার্থনা করছি এবং (প্রার্থনা করছি) এমন আমল, যাতে আপনি সন্তুষ্ট হন
اللَّهُمَّ هَوِّنْ عَلَيْنَا سَفَرَنَا هَذَا وَاَطْوِ عَنَّا بُعْدَهُ
হে আল্লাহ, আপনি আমাদের জন্য এই সফরকে সহজ করে দিন এবং আমাদের থেকে এর দূরত্বকে গুটিয়ে দিন।
اللَّهُمَّ أَنْتَ الصَّاحِبُ فِي السَّفَرِ وَالْخَلِيْفَةُ فِي الْأَهْلِ.
হে আল্লাহ আপনিই সফরের সঙ্গী এবং পরিবার-পরিজনে স্থলবর্তী।
اللّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُِ بِكَ مِنْ وِعْثَاءِ السَّفَرِ وَكَآبَةِ الْمَنْظَرِ وَسُوْءِ الْمُنْقَلَبِ فِي الْماَلِ وَالأَهْلِ وَالْوَلَدِ.
হে আল্লাহ আমি আপনার নিকট আশ্রয় গ্রহণ করছি সফরের প্রতিকূলতা থেকে এবং দৃশ্যের বিষণ্ণতা থেকে এবং সম্পদে, পরিবারে ও সন্তানসন্ততির ক্ষেত্রে বিপর্যয় থেকে।
সফর যত আরামের হউক, মানুষ নিজেকে তখন বড় অসহায় ও নিঃসঙ্গ বোধ করে। কিন্তু মুমিন যখন সফরের শুরুতে এই দু‘আটি পড়ে, আর বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ আমার ‘সফরসঙ্গী’ এবং আল্লাহ আমার ঘরে আমার ‘স্থলবর্তী’ তখন মনে কত শক্তি অর্জিত হয়! কত নিশ্চিন্ততা লাভ হয়!
বস্ত্তত পূর্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে এই দু‘আ পড়ার পর কষ্টের সফরও আর কষ্টের থাকে না, কষ্টদায়ক কোন দৃশ্য ও পরিস্থিতিও আর সামনে আসে না। মুমিনের সফর হয়ে যায় শান্তির, সফলতার ও আনন্দের, ইনশাআল্লাহ, কিন্তু কোথায় সেই অনুভূতি! সেই বিশ্বাস!! সেই অন্তরঙ্গতা!!!
***
বিমানের যাত্রার প্রথম ‘দুলুনি’টুকু উপভোগ করার জন্য আমি ‘চৌকান্না’ হয়ে আছি। আমার মনে হয়, এটা যেন আল্লাহর ঘরের মেহমানের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে দোলনার আদরের ‘দুলুনি’! এটা আমি উপভোগ করি। আমার খুব ভালো লাগে, খুব শান্তি ও তৃপ্তির অনুভূতি হয়।
হাঁ, বিমান দুলে উঠলো। আমার সমগ্র অস্তিত্বে অপার্থিব একটি শিহরণ বয়ে গেলো। আমি আল্লাহর ঘরের মেহমান। আমি এখন আকাশের দোলনায় দোলবো এবং মেঘের রাজ্যের উপর দিয়ে উড়ে যাবো আমার স্বপ্নের দেশে, হিজাযের পুণ্যভূমিতে।
বিমান এখন জোর গতিতে দৌড়চ্ছে এবং সত্যি সত্যি দোলনার মত দুলছে। আমি আবার পড়লাম, ‘সুবহানাল্লাযী সাখ্খারা লানা হাযা...
দু‘আ পড়ছি, আর উপভোগ করছি স্বর্গীয় ‘দুলুনি’র স্বাদ। অবশেষে ‘আকাশের পাখী’ ডানা মেলে উড়াল দিলো নীল আকাশে। মাটির স্পর্শ ত্যাগ করে উঠে গেলো উপরে, আরো উপরে। ঘরবাড়ী সব প্রথমে ছোট হলো, তারপর হলো ক্ষুদ্র, তারপর অতি ক্ষুদ্র! যেন শিশুদের ‘খেলনাঘর’। আকাশ থেকে দেখলে চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠে এই পৃথিবী কত ক্ষুদ্র! কত তুচ্ছ! আল্লাহ যে বলেছেন ‘এই দুনিয়ার জীবন খেলাধূলা ছাড়া কিছু নয়’, তা কত সত্য! আমাদের কাছের দেখা কত ভুল, দূরের দেখা কত বাস্তব! পৃথিবীর জীবনকে যদি আমরা আরো দূর থেকে দেখতে পেতাম! কবর থেকে! হাশর থেকে! কেন দেখতে পাই না! আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তো দেখার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন কোরআনে, হাদীছে! দেখার চোখ যাদের আছে তারা অবশ্যই দেখতে পান; আমরাই শুধু অন্ধ হয়ে আছি দুনিয়ার ধাঁধায়।
***
দেখতে দেখতে বিমান চলে এলো মেঘের রাজ্যের উপরে। অনেক দিন পর আকাশ থেকে আবার উপভোগ করলাম বাংলার সৌন্দর্য। এ সৌন্দর্য উপভোগ করা ইবাদত। এ তো আল্লাহর সৃষ্টির সৌন্দর্য! আল্লাহর সৌন্দর্যকে অনুভব করার সৌন্দর্য!
ইমাম ছাহেবকে মনে হলো, খুব উৎকণ্ঠার মধ্যে সময়টুকু পার করেছেন। আমি যখন বললাম, ‘দেখো জাহাঙ্গীর, আমার দেশটা কত সুন্দর!’
তিনি বললেন, বিমানের সফর সবার কাছে মনে হয় আনন্দদায়ক। আমার কিন্তু কলজে কাঁপে; মনে হয়, এর চেয়ে বিপজ্জনক সফর আর কিছু হতে পারে না। আল্লাহ না করুন, দুর্ঘটনা হলে কারোই বাঁচার সম্ভাবনা থাকে না; এমনকি লাশগুলো পর্যন্ত চেনার উপায় থাকে না। অথচ কত নির্বিকারভাবে বসে আছি! এমন মুহূর্তে তো সবারই কর্তব্য আল্লাহর দিকে ‘মুতাওয়াজ্জিহ’ থাকা। আল্লাহর মদদ ও রহমত ছাড়া এ সফর নিরাপদে পার হওয়ার কি কোন উপায় আছে আমাদের?
***
মানচিত্রে বাংলাদেশটা যত ছোট, আকাশ পথে পাড়ি দিতে গিয়ে মনে হয় আরো ছোট। দেখতে দেখতে পিছনে চলে গেলো আমার প্রিয় মাতৃভূমি! পশ্চিম বাংলাও পার হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মধ্যে। সেটা বুঝতে পারলাম আকাশ থেকে বৃক্ষহীন মাটির রুক্ষতা দেখে। কোথায় আমার দেশের সবুজ, নদী, জল ও সজীবতা; আর কোথায় নদী-নালা ও বৃক্ষহীন এই পাহাড় ও মরুভূমি!
এক ঘণ্টার কিছু বেশী সময় পার হলো। তারপরই উদ্ভূত হলো এমন এক পরিস্থিতি যার অভিজ্ঞতা এবারই আমার প্রথম এবং এখানেও আমি পরম বিস্ময়ে, কৃতজ্ঞ চিত্তে অনুভব করলাম যে, আমাদের মাওলা তাঁর ঘরের মুসাফিরদের কত ভালোবাসেন! পথে পথে, এমনকি সাগরের দীর্ঘ পথের মত আকাশের সংক্ষিপ্ত পথেও কীভাবে তিনি তারবিয়াত করে করে তাদের নিয়ে যান তাঁর পবিত্র ঘরে! সুবহানাল্লাহ!
এই আসমানি তারবিয়াত যারা বুঝতে পারে তাদের হালাত হয় একরকম, যারা বুঝতে পারে না তাদের মুখ থেকে, মুখের অভিব্যক্তি থেকে ঝরে পড়ে শুধু বিরক্তি!
ঘটনা এই; বিমানের একজন মহিলাযাত্রী হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আমাদের ডানদিকের দু’কাতার পিছনেই ছিলেন তিনি। মনে হলো শ্বাস নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। বিমানসেবিকা ছুটে এলেন, প্রাথমিক শুশ্রুষা দিলেন। উপশম হলো না, বরং অবস্থা আরো অবনতির দিকে গেলো। বিমানসেবিকা বিচলিত হয়ে উপরে জানালেন। মাইকে ঘোষণা হলো, যাত্রীদের মধ্যে যদি কোন ডাক্তার থাকেন, তিনি যেন উঠে আসেন। বিভিন্ন গল্পে, ভ্রমণকাহিনীতে পড়েছি এধরনের পরিস্থিতির কথা। তখন ঘোষণা দিয়ে যাত্রীদের মধ্যে চিকিৎসক খোঁজা হয়। আজ সেটা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করলাম। বিষয়টা বড় অদ্ভুত! পাঁচশ যাত্রী নিয়ে যেখানে বিমান আকাশে উড়ছে সেখানে বিমানের পক্ষ হতে একজন চিকিৎসক এবং জরুরি চিকিৎসাব্যবস্থা থাকবে না?! যদি কোন চিকিৎসক না পাওয়া গেলো, কিংবা তার সঙ্গে প্রয়োজনীয় ঔষধ ও সরঞ্জাম না থাকলো তখন! যাত্রীসেবার এটা কী ধরনের নমুনা!
ঐ মহিলাযাত্রীর সৌভাগ্য, কিংবা দুর্ভাগ্য যে, একজন বাংলাদেশী চিকিৎসক বিমানে ছিলেন এবং তিনি এগিয়ে এলেন।
কোন পেশার ক্ষেত্রে সফলতার জন্য এটা খুবই জরুরি যে, প্রথম দর্শনেই তাকে মনে হবে, হাঁ, তিনি এ পেশারই মানুষ। একজন আদর্শ শিক্ষককে দেখেই বিশ্বাস হয়, তিনি শিক্ষক। এমনকি পেশাদার অপরাধীকেও দেখামাত্র বোঝা যায়, লোকটা খুনী বটে! একজন আদর্শ চিকিৎসকের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। পেশার সুস্পষ্ট একটা ছাপ থাকে মানুষের অবয়বে এবং অভিব্যক্তিতে। কিন্তু অসুস্থ মহিলাটির দিকে চিকিৎসক- পরিচয়ে যিনি এগিয়ে এলেন, আমার মন কিছুতেই সায় দিলো না তাকে চিকিৎসক বলে গ্রহণ করতে। তার ব্যাগ রাখা ছিলো আমাদের সামনে আলমারিতে। তিনি যখন ব্যাগ থেকে স্টেথস্কোপ বের করলেন তখন অবশ্য মানতেই হলো, তিনি চিকিৎসক। পরে এই চিকিৎসক ভদ্রলোকের নাম জেনেছি, তিনি বক্ষব্যাধি হাসপাতালের অধ্যাপক চিকিৎসক। সঙ্গত কারণেই এখানে তার নাম অনুক্ত রাখা হলো। প্রথমে ভেবেছিলাম, তিনি সউদি আরবে কর্মরত। ছুটি শেষে কর্মস্থলে যাচ্ছেন। কিন্তু মীকাতের ঘোষণার সময় যখন ইহরামের লিবাস ধারণ করলেন তখন বুঝলাম, তিনিও হজ্বের যাত্রী এবং বাইতুল্লাহর মুসাফির। তাতে আমার মন আরো ব্যথিত হলো। আল্লাহর ঘরের মুসাফিরের কাছে আরো ভালো কিছু আশা করে মানুষ।
মহিলার অবস্থা সত্যি গুরুতর হয়ে পড়েছিলো, কিন্তু অবাক হওয়ার মত বিষয় হলো, পুরুষ ডাক্তার তার মাথায় হাত রাখামাত্র তিনি চমকে উঠলেন এবং পড়ে যাওয়া ওড়না মাথায় দেয়ার চেষ্টা করলেন, আর তখন ডাক্তার ভদ্রলোকের প্রচন্ড এক ধমক খেলেন। তিনি বুঝতে চেষ্টা করলেন না যে, হয়ত ‘অশিক্ষিত’ এ মহিলা জীবনে এই প্রথম ঘর থেকে বের হয়েছেন, শুধু আল্লাহর ঘরের নিয়তে। তিনি কোথায় পাবেন আধুনিক জীবনের ‘আলো’! বেগানা পুরুষের সামনে, হোন তিনি চিকিৎসক, ‘খুলে মেলে’ বসার ‘আলোকিত’ সংস্কৃতির সঙ্গে কীভাবে তার পরিচয় হবে! কিন্তু তিনি যেহেতু আলোকপ্রাপ্ত সুশিক্ষিত চিকিৎসক সেহেতু তার কর্তব্য ছিলো অসুস্থ ও বিপন্ন মহিলাটির ধর্মবোধকে সম্মান করা, যেটা আমরা একটু পরেই দেখলাম অন্য একজন চিকিৎসকের মধ্যে।
স্টেথস্কোপধারী ভদ্রলোকটির সঙ্গে তার স্ত্রীও ছিলেন। তিনি তার স্ত্রীর সাহায্য নিতে পারতেন রুগিনীকে দেখা ও পরীক্ষা করার কাজে, যেটা করেছিলেন পরবর্তী চিকিৎসক। আসলে পড়াশোনা একবিষয়, জানাশোনা আরেক বিষয়, আর শিক্ষা, সে সম্পূর্ণ ভিন্ন একবিষয়। এ তিনটি বিষয়কে প্রায় আমরা গুলিয়ে ফেলি।
পরীক্ষা করে এবং লক্ষণ দেখে ডাক্তার সাহেব মনে করলেন ‘হার্ট এটাক’। ডাক্তারদের এই ‘মনে করা’ রোগীর জীবনে কত যে দুর্ভোগ ডেকে আনে তার ভুক্তভোগী আমি নিজেও, আমার বাবাকে নিয়ে একবার, আমার বোনকে নিয়ে একবার। থাক সে কথা।
তবে এখানে আমাদের দেশের স্বনামধন্য শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তালুকদার সাহেবের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করা অন্যায় হবে। আমার তখনকার ছয় সাত বছরের বোনটি প্রায় অবধারিত অপচিকিৎসার হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিলো প্রথমত আল্লাহর রহমতে, তারপর তাঁর হৃদয়ের মমতা এবং চিকিৎসা জীবনের অভিজ্ঞতার কল্যাণে।
বড় করুণ অবস্থা ছিলো। আমার বাবা তখন হাসপাতালে। সুতরাং তাঁকে কিছু জানানোর উপায় নেই। যা করতে হয় আমাকেই করতে হবে। সম্ভবত সেদিনই প্রথম বুঝেছিলাম, বড় ভাই হওয়ার দায়িত্ব কত কঠিন।
গলায় টনসিলের সমস্যা ভেবে স্থানীয় ডাক্তার ফাইজার-ই দিলেন, কিন্তু সন্ধ্যায় অবস্থা দেখে, তিনি পরামর্শ দিলেন, অবিলম্বে হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আববা যেখানে ছিলেন, জনসেবা হাসপাতাল, সেখানেই নিয়ে গেলাম। ‘বিশেষজ্ঞ’ ডাক্তার দেখলেন এবং বললেন, টনসিলের সমস্যা, ছোট্ট একটা অপারেশন দরকার। ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। হঠাৎ মনে পড়লো, ডাক্তার তালুকদার সাহেব তো কাছেই ইবনে সিনায় বসেন, তাকে একবার দেখাই না কেন! রাত এগারটায় তিনি দেখলেন, আর বললেন, ‘ক্লিয়ার ডিপথেরিয়া’।
তার তখন চলে যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছিলো, তবু বললেন, এই পরীক্ষাটা জরুরি ভিত্তিতে করিয়ে আনুন, আমি ততক্ষণ অপেক্ষা করবো। ইবনে সিনা থেকে পরীক্ষা করিয়ে আনা হলো এবং ফল হলো পজেটিভ, কিন্তু সেদিন দেখলাম একজন চিকিৎসকের চিকিৎসাপ্রতিভার আশ্চর্য উদ্ভাস! তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, ‘পরীক্ষা ভুল’। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, ফাইজার-ই খাওয়ানো হয়েছিলো? আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, জ্বি। তিনি বললেন, এ কারণেই রেজাল্ট রঙ এসেছে। আমি লিখে দিচ্ছি, এখনই বক্ষব্যাধি হাসপাতালে নিয়ে যান।
নিতে নিতে হলো রাত দেড়টা। জরুরি বিভাগে প্রথমে বললো, পরীক্ষা-নিরীক্ষার কথা, কিন্তু কর্তব্যরত চিকিৎসক ডক্তার তালুকদারের ‘কাগজ’ দেখে বললেন, তালুকদার স্যারের মন্তব্যের পর আর পরীক্ষার প্রয়োজন নেই। সঙ্গে সঙ্গে ভর্তি করে নেয়া হলো। পুরো সময়টা আমার মামা হাফেয খালেদ সাহেব সঙ্গে ছিলেন। বড় উপকার হয়েছিলো। তাঁর মাধ্যমে একটি চিরকুট পাঠালাম আমার স্ত্রীকে, ‘যে অবস্থায় আছ ভোরেই চলে এসো তোমার ভাইকে সঙ্গে করে।’
দেড় বছরের মেয়েটিকে তিনি তার মায়ের কাছে রেখে চলে এসেছিলেন সকাল সাতটায়। একটানা নয়দিন ছিলেন আমার বোনটির সঙ্গে হাসপাতালে। ছয় সাত বছরের অবুঝ মেয়ে হাসপাতালে থাকবে না কিছুতেই, এখনি বাসায় চলে যাবে আম্মার কাছে। ডাক্তার বিরক্ত হয়ে বলেন, নিয়ে যান বাসায়, চিকিৎসার দরকার নেই।
কী যে কঠিন অবস্থা!
শেষ পর্যন্ত নয়দিনের মাথায় সুস্থ হয়ে আমার বোন হালিমা বাসায় ফিরে আসে, আবক্ষাও তখন হাসপাতাল থেকে বাসায়।
আমি তালুকদার সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে দেখা করেছিলাম, তিনি খুশী হয়েছিলেন। এমন চিকিৎসক বাংলাদেশে এখন এমনই দুর্লভ পাখীর জগতে যেমন দুর্লভ, ‘আনকা’!
ডাক্তার তালুকদার বেঁচে আছেন; কোন সহৃদয় পাঠক যদি তাঁকে জানাতে
পারেন, এখনো আমি তাঁকে মনে রেখেছি, কৃতজ্ঞ হবো। তাঁর মত চিকিৎসক
এখনো যারা আছেন, আল্লাহ তাদের মঙ্গল করুন, আমীন।
***
ফিরে আসি আমাদের বর্তমান ডাক্তার মহোদয়ের কাছে। তিনি তার ব্যবস্থামত প্রাথমিক ঔষধ দিলেন, যা তার কাছে ছিল; সেই সঙ্গে অক্সিজেনও লাগানো হলো, আর আল্লাহর রহমতে ভদ্রমহিলা কিছুটা সুস্থ হলেন। আর তখনই তিনি লজ্জায় একেবারে জড়সড় হয়ে গেলেন এভাবে বেপর্দা অবস্থায় পড়ার কারণে।
ভদ্রমহিলার সঙ্গে মাহরাম ছিলেন তার মামা। তিনি গাঁও গেরামের আরো সরলসিধা বুড়ো মানুষ। সারা জীবন মাটি থেকে বিমানকে দেখেছেন আকাশে উড়তে; নিজে বিমানে করে আকাশে উড়েছেন এই প্রথম, তাও আল্লাহর ঘরের সফর বলে। ভদ্রমহিলার ‘পোলা’ ‘চারকি’ করে মক্কা শরীফে। বোঝাই যায়, কোন ধরনের ‘চারকি’। নানা হজ্বে আসছেন শুনে অনেক কষ্টে টাকা পাঠিয়েছে মাকে হজ্বে আনতে। এমন পুত্রের প্রতি না দেখেও শ্রদ্ধা জাগে।
বলতে ভুলে গিয়েছি, এত কিছু যে হলো, বিমান কিন্তু এতক্ষণ থেমে ছিলো না, চলন্ত অবস্থায় ছিলো।
বিমান উড়ছিলো আকাশে আপন গন্তব্যে নিজের গতিতে। আমরা যাত্রীরা বসেছিলাম নিজ নিজ আসনে। চিকিৎসা চলছিলো ভালোমন্দ মিশিয়ে। ভদ্রমহিলাও আল্লাহর রহমতে কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলেন এবং আশ্চর্য! পাড়াগাঁয়ের ‘অশিক্ষিত’ মহিলা তার দেশের ভাষা দিয়ে ডক্তারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। ইমাম ছাহেবকে বললাম, দেখো জাহাঙ্গির, এই ভদ্রমহিলার লেখাপড়া নেই, হয়ত বর্ণজ্ঞানও নেই, কিন্তু শিক্ষা আছে। এই শিক্ষা লেখাপড়া জানা অনেক ভদ্রমানুষেরও থাকে না।
এ পর্যন্ত চিকিৎসকের উপস্থিতি ভদ্রমহিলার জন্য ছিলো সৌভাগ্যেরই বিষয়। এরপর শুরু হলো দুর্ভাগ্যের পালা। ডাক্তার সাহেব আচমকা ঘোষণা করলেন, এ মহিলা বিমান সফরের অনুপযুক্ত। এখনই তার পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসার প্রয়োজন। সুতরাং বিমান থামাতে হবে এবং মহিলাকে নামাতে হবে।
তিনি ঘোষণা দিলেন, আর উপর থেকে আকাশটা যেন ভেঙ্গে পড়লো প্রথমে ভদ্রমহিলার উপর, তারপর আমাদের উপর।
ভদ্রমহিলা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার কান্নার কোন ভাষা ছিলো না, তবে কথার ভাষা ছিলো নোয়াখালীর। কিন্তু অশিক্ষিত রোগিণীর অনুনয় বিনয়ে কান দেবেন কেন এমন বিজ্ঞ চিকিৎসক! তিনি তো দেখবেন শুধু চিকিৎসার দাবী, খুবই সুসঙ্গত কথা।
বিমানের সেবক ও সেবিকা দু’জনকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলো যাত্রীদের পক্ষ হতে, এখন এই মহিলা ও তার মাহরামকে নামানোর অর্থ হবে হজ্ব থেকে বঞ্চিত করা। কারণ আজই জিদ্দায় প্রবেশের শেষ তারিখ। কিন্তু তারা যুক্তির কথাই বললেন, ‘ডাক্তারের মতামত পাওয়ার পর আমরা কোন ঝুঁকি নিতে পারি না।’ তারা ছুটে গেলেন পাইলটের উদ্দেশ্যে। একটু পরেই মাইকে ঘোষণা হলো, ‘একজন যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে জরুরি পরিস্থিতিতে বিমান অবতরণ করছে।’
দু’একজন উদ্যোগী যাত্রী বাংলাদেশী ডাক্তারকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন যে, মহিলাকে জোর করে নামানো হলে এমনিতেই বেচারী ‘হার্ট ফেল’ করে মারা যাবে। তখন সেটা মৃত্যু হবে না, সেটা হবে খুন করা। আল্লাহর ঘরের সফর, আল্লাহই হেফাযত করবেন। আপনি দয়া করে পাইলটকে বলুন, বিমান অবতরণের প্রয়োজন নেই।
ডাক্তার রাগত স্বরে বললেন, ‘চিকিৎসক কে, আপনারা, না আমি? আপনারা তার জীবনের নিরাপত্তা দিতে পারবেন? জীবনের দাম বেশী, না হজ্বের?’
কোনটা দামী তা কীভাবে বলি! দাম নির্ধারণের দৃষ্টিকোণও কি এক হয়? ভদ্রমহিলা তো বলছেন, মরলে মক্কাশরীফে মরবো, হাসপাতালে যাবো না। তিনি তো জীবনের চেয়ে হজ্বের দাম বেশী ভাবছেন, অবশ্য গ্রামের ‘অশিক্ষিত’ মহিলার ভাবনা!
শেষ পর্যন্ত মহিলার কান্নাকাটির মধ্যেই বিমান অবতরণ করলো। প্রথমে ঘোষণা ছিলো নিকটতম শহর হিসাবে বোম্বে বিমানবন্দরে অবতরণের, কিন্তু সেখান থেকে সবুজসঙ্কেত না পেয়ে নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণের সিদ্ধান্ত হলো এবং আমার মনে হয়, সেটা ছিলো ঐ অসহায় বান্দীর প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে গায়েবি মদদ।
বিমান আকাশে থাকতেই যোগাযোগ করা হয়েছিলো হাসপাতাল ও এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার জন্য, আর বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষও এমন তড়িৎ ব্যবস্থা নিলো যে, আমাদের দেশে কল্পনা করাও কঠিন। বিমান রানওয়ে’র মাটি স্পর্শ করার আগেই জানালাপথে দেখতে পেলাম একটি এম্বুলেন্স ও তার পিছনে একটি কার ছুটে আসছে।
বিমান তো অবতরণ করলো, কিন্তু ঐ মহিলা কিছুতেই ‘অবতরণ করিবে না’। তার এককথা, ‘অাঁরে মারি ফালান, কাডি ফালান, অাঁই নাইমতাম ন।’
বিমানবালা মহিলাকে তার আসন থেকে তুলতে চাচ্ছে বুঝিয়ে শুনিয়ে। তিনি আসনের হাতল ধরে আছেন, আর অসহায়ভাবে যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বলছেন, আপনারা আমাকে ফেলে চলে গেলে আল্লাহ কি তা সহ্য করবেন? দোহাই আল্লাহর, আমাকে ফেলে যাবেন না। আমি তো ঠিক হয়ে গেছি, মাথাটা শুধু একটু ‘ঘুরছিলো’।
আশ্চর্য হলেও সত্য, কিছু কিছু যাত্রী এবং তারা আল্লাহর পথের যাত্রী, মহিলার প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করছিলো যে, তার কারণে বিমান নামতে হলো, এখন আবার বিলম্ব হচ্ছে। হায়রে মানুষ এবং মানুষের অনুভূতি!
তবে অধিকাংশ যাত্রী মহিলার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলো। তারা মনে প্রাণে চাচ্ছিলো মহিলাকে নিয়েই যেন বিমান যাত্রা করে।
বাংলাদেশী ডাক্তার মহিলাকে প্রবোধ দিলেন এবং এবার তুমি করে সম্বোধন করলেন, ‘হাসপাতালে গেলে তুমি দু’দিনেই ঠিক হয়ে যাবে তখন সউদীয়া বিশেষ ব্যবস্থতায় তোমাকে মক্কা শরীফ নিয়ে যাবে।’
কিন্তু এটা ছিলো এক অবাস্তব সান্ত্বনা, যদিও বিমানের পাইলটও একই আশ্বাস শুনালেন।
অসুস্থ মহিলাযাত্রী নামতে চাচ্ছে না শুনে পাইলট আগেই ছুটে এসেছেন। তাকে বেশ পেরেশান মনে হলো।
জানালাপথে বাইরে দেখলাম, এম্বুলেন্সের সামনে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের লোকেরা অস্থিরভাবে বিমানের দরজার দিকে বারবার তাকাচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে না, ভিতরে কী হচ্ছে! মুমুর্ষূ রোগী, অথচ বিমানের দরজা খোলা হচ্ছে না!
যাত্রীরা প্রায় একজোট হয়ে গেলেন মহিলার পক্ষে। কিন্তু সউদীয়া তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। ‘একজন অসুস্থ যাত্রীর জীবনের ঝুঁকি নিতে আমরা পারি না। আকাশপথে এ যাত্রীর মৃত্যু হলে পুরো দায়দায়িত্ব আসবে আমাদের উপর। তখন আন্তর্জাতিকভাবে সউদীয়াকে জবাবদেহির সম্মুখীন হতে হবে।’
আধুনিক বিশ্বের এ আরেক অদ্ভুত চেহারা! এয়ার লাইন্সের অবহেলায় একজন রোগীর মৃত্যু হলে আন্তর্জাতিক জবাবদেহিতার ভয়, অথচ ইরাকে, আফগানিস্তানে, কাশ্মীরে, চেচেনিয়ায় লাখে লাখে মানুষ মরছে স্রেফ তপ্ত সীসার গুলি খেয়ে এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের নামে! সে জন্য কোন জবাবদেহিতা নেই!
***
বিমানের দরজা খোলা হলো। সিঁড়ি লাগানো হলো। দু‘জন পুলিশ ভিতরে প্রবেশ করলো এবং .. এবং আমাদের অবাক করে দিয়ে তারা বাংলায় কথা বললেন। দু’জনই পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী। তারা প্রায় একই সঙ্গে প্রশ্ন করলেন এবং সম্ভবত অবচেতনভাবেই; একজন বললেন, বাঙ্গালী? অন্যজন বললেন, বাংলাদেশী? পরে জানা গেলো, একজন হিন্দু, অন্যজন মুসলমান। তবে অল্প সময়ের মধ্যে দু’জনেই যাত্রীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেলেন। এ দৃশ্য আমি দেখলাম এবং অনেক কিছু অনুভব করলাম। কিন্তু আমাদের অনুভবে রাজনীতির খেলোয়াড়দের কী আসে যায়?
একজন যাত্রী সম্ভবত প্রকৌশলী, তাবলীগ জা‘মাতের সঙ্গে সম্পর্ক। পায়ে গুরুতর সমস্যা, ব্যান্ডেজ করা, ক্র্যাচে ভর দিয়ে হাঁটেন। এ অবস্থায় চলেছেন আল্লাহর ঘরে, হজ্বের সফরে। ভালো ইংরেজী বলেন, তিনি বিমানের পাইলটকে বুঝালেন, ডাক্তার পরিচয়দানকারী এ ভদ্রলোক আমাদেরই মত একজন যাত্রী। তার মন্তব্যের কতটুকু মূল্য আছে, আমি জানি না। তবে বিমানের বাইরে ইন্ডিয়ান যে ডাক্তার অপেক্ষা করছেন, আপনি তাকে ডাকুন। তিনি যদি রোগীকে ঝুকিমুক্ত বলে রায় দেন তখন তো আপনার কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
পাইলট দেখলেন, কথাটা যুক্তিসঙ্গত। তিনি সঙ্গে সঙ্গে মেনে নিলেন। কারণ পাইলট ছিলেন বৃটিশ। বাংলাদেশী ডাক্তারটির তখনকার চেহারা দেখে মনে হলো, নিজের দেশের লোকদের অনাস্থায় তিনি অত্যন্ত অপমানিত বোধ করছেন। কিন্তু উপায় কী! এটাই তো বাস্তবতা! শত শত রোগী প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে ইন্ডিয়া আসছে। চিকিৎসার মান কোথায় কী, সে প্রশ্ন আলাদা, তবে রোগীদের মন্তব্য হলো, বাংলাদেশে ডাক্তারের ব্যবহারে রোগী আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে, আর ইন্ডিয়ায় রোগী অর্ধেক সুস্থ হয়ে যায় ডাক্তারের সুন্দর ব্যবহারে, বাকি অর্ধেক ভালো হয় চিকিৎসায়।
আমাদের কাফেলার আমীর ছাহেব দেশের চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে তার ছোট ছেলেকে নিয়ে মাদরাজ গিয়েছিলেন। তিনি তার অভিজ্ঞতার যে বিবরণ দিলেন, এককথায় ‘অবিশ্বাস্য’। তার মন্তব্য হলো, আমাদের দেশে ডাক্তারের নযর থাকে রোগীর পকেটের দিকে, আর ইন্ডিয়ায় ডাক্তারের দৃষ্টি থাকে রোগীর মুখের দিকে।
ইন্ডিয়ার অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে এই কিছুদিন আগে আমি এবং আমার স্ত্রী চোখ দেখাতে গিয়েছিলাম হারুন আই ফাউন্ডেশনে মোটামুটি শীর্ষস্থানীয় একজন চক্ষুবিশেষজ্ঞের কাছে। যে আচরণ তিনি করলেন, বিশেষ করে আমার স্ত্রীর বোরকা ও পর্দা নিয়ে, তাতে দ্বিতীয়বার তার কাছে আর যাওয়া হয়নি। চোখের চিকিৎসাও আর করা হয়নি। থাক সে প্রসঙ্গ।
***
গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলিয়ে বিমানের দরজা দিয়ে যিনি প্রবেশ করলেন, তিনি যদি অমুসলিম না হতেন, বলতাম, একজন ফিরেশতা উদিত হলেন। ব্যক্তিত্বের দ্যুতি যেন ঠিকরে বেরুচ্ছে তার চেহারা থেকে। ছিলেনও উজ্জ্বল ফরসা, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ব্যক্তিত্বের দীপ্তি। সুতরাং মুসলিম হলে বলা যেতো ‘নূরুন আলা নূর’। এখানে বলা যায় ‘সোনায় সোহাগা’! তিনি রোগীর দিকে এগিয়ে এলেন ধীর পদক্ষেপে হাসি হাসি মুখে। বাংলাদেশী ডাক্তার অশোভনভাবে তার দিকে দৌড়ে এলেন, বললেন, রোগীর অবস্থা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। হালকা হার্টএটাক হয়েছিলো। আমি প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছি এখন সামলে উঠেছে, কিন্তু যে কোন সময় এটাক হতে পারে। তাই জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে নেয়া দরকার।
ইন্ডিয়ান ডাক্তার স্মিত মুখে মনোযোগের সঙ্গে তার কথা শুনলেন। তারপর রোগিণীর দিকে মনোযোগী হলেন। তিনি রোগিণীর মাথায় হাত রেখে তার জিহবা দেখতে যাবেন, কিন্তু রোগিনীর জড়সড় অবস্থা দেখেই থেমে গেলেন। বিমানবালাকে সাহায্য করতে বললেন। এ বিষয়টি আমরা যেমন লক্ষ্য করলাম, আশা করছি বাংলাদেশী ডাক্তারও লক্ষ্য করেছেন, শিক্ষা গ্রহণ করেছেন কি না সেটা অবশ্য ভিন্ন বিষয়।
ইন্ডিয়ান ডাক্তারকে বেশ চিন্তিত দেখালো। এম্বুলেন্স থেকে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ নার্সকে ডাকালেন এবং পরীক্ষা -নিরীক্ষা করলেন। মনে হলো, রোগনির্ণয়ের বিষয়ে তিনি বাংলাদেশী ডাক্তারের সঙ্গে একমত নন, তবে সতর্কতার খাতিরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ভালো মনে করছেন।
আল্লাহ তাওফীক দিলেন, আমি আসন থেকে উঠে গিয়ে হিন্দিতে (আসলে উর্দূতে) বললাম, ‘এই মহিলা হজ্বের যাত্রী। বহু কষ্টে খরচ যোগাড় করে হজ্বে রওয়ানা হয়েছেন। তিনি কিছুতেই হজ্ব থেকে বঞ্চিত হতে চান না।’
হজ্বের কথা শোনামাত্র তার মুখভাবে পরিবর্তন এসে গেলো। তিনি মৃদু হেসে বললেন, ‘ফের তো ভগওয়ান হী রক্সা করেঙ্গে।’ (তাহলে তো ভগবানই রক্ষা করবেন।)
পাইলটকে সম্বোধন করে বললেন, ‘মনে হয় তার বিমানযাত্রায় কোন সমস্যা নেই। তবে একঘণ্টার মত তাকে আমি পর্যবেক্ষণে রাখতে চাই।’
আমরা সবাই আলহামদু লিল্লাহ বলে উঠলাম। ভদ্রমাহিলাটির কথা কী আর বলবো, আনন্দে তার চোখে পানি এসে গেলো। বিরাট একটা পাথরের বোঝা যেন তার উপর থেকে সরে গেলো।
ভদ্রমহিলার দেহে বিভিন্ন যন্ত্র লাগানো হলো এবং পর্যবেক্ষণ শুরু হলো। বাংলাদেশী ডাক্তার সাহেব চলে গেলেন নিজের আসনে, কারণ এখানে তার কোন কাজ ছিলো না।
যাত্রীদের মধ্যে যারা ইংরেজী জানেন তাদের সঙ্গে ইন্ডিয়ান ডাক্তার বেশ হাসিমুখেই কথা বললেন। আমাকে হিন্দি বললেন বেশ উচ্ছ্বাসের সঙ্গে। তার আন্তরিক আচরণ আমাদের মুগ্ধ করলো।
আমরা চলেছি আল্লাহর ঘরে হজ্বের উদ্দেশ্যে। আসমানের গায়বি ইশারায় আমাদের নামতে হলো ভারতের ভূমিতে, নাগপুরে। সেখানে দু’জন চিকিৎসকের মাধ্যমে আমি বিচ্ছিন্নভাবে হলেও প্রত্যক্ষ করলাম দু’দেশের চিকিৎসা- ব্যবস্থার মৌলিক একটি পার্থক্য। একজন পরম নিশ্চিন্তে ভগবানের উপর ভরসা করলেন, অন্যজন হজ্বের যাত্রী হয়েও বলতে পারলেন না, আল্লাহ ভরসা, আল্লাহই রক্ষা করবেন। এখনো আমার কানে বাজে, ‘ফের তো ভগওয়ান হী রক্সা করেঙ্গে।’
***
বিমানের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তেপ্পান্ন বছর বয়সে কখনো আমার হিন্দুস্তান সফর করা হয়নি। আগ্রহ আছে, দীর্ঘ সময় নিয়ে হিন্দুস্তান সফর করার; লৌখনো, দিল্লী, আগ্রা, হায়দারাবাদ দেখার; দেওবন্দ, সাহারানপুর, নদওয়াতুল উলামা, আলীগড় যাওয়ার। আর একটি ব্যাকুল ইচ্ছা আছে ভূস্বর্গ বলে পরিচিত মুসলিম রক্তে রঞ্জিত কাশ্মীর নিজের চোখে দেখবার এবং ঝিলাম নদীর তীরে গিয়ে একবার দাঁড়াবার। জানি না আমার জীবনে কবে আসবে সেই দিন, আদৌ আসবে কি না! তবে আজ হঠাৎ যেন গায়ব থেকেই সুযোগ হয়ে গেলো, মুহূর্তের জন্য হলেও ভারত ভূমিকে দেখার। বিমানের সহকারী পাইলট আহমদ আল মুহাসিবী মিসরীয়। তিনি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাকে বললাম, আমি কিছুক্ষণের জন্য নীচে নামতে চাই, অবশ্য তোমার অনুমতি হলে।
তিনি হয়ত বাঙ্গালীর মুখে বিশুদ্ধ আরবী আশা করেননি; খুশী হলেন। কী করি, কোথায় লেখা-পড়া করেছি, এধরনের দু’ একটা প্রশ্ন করলেন। তারপর একটু ইতস্ততঃ করে স্মিত হেসে অনুমতি দিলেন।
অনুমতি পাবো, ধারণা ছিলো না। এসব বিষয়ে নিয়ম তো যথেষ্ট কঠোর। তাই খুশী হয়ে কৃতজ্ঞতা জানালাম; তারপর সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম। সেই পুলিশ দু’জন দৌড়ে এলেন, কী করছেন! কী করছেন!
বললাম, কখনো আমার হিন্দুস্তানে আসার সুযোগ হয়নি, কিছুক্ষণের জন্য হিন্দুস্তানের মাটিতে পা রাখতে চাই।
তারা একে অন্যের মুখের দিকে চেয়ে হেসে দিলেন, তারপর অন্যদিকে সরে গেলেন। বুঝলাম, তাদের পক্ষ হতে বাধা নেই, তবে হাসিটার অর্থ বুঝতে পারলাম না। যাকগে সেটা বুঝে আমার কাজও নেই।
সিঁড়ি থেকে নামলাম এবং জীবনে এই প্রথম ভারতের মাটিতে পা রাখলাম। দু’চার কদম হাঁটলাম। ভাবে আবেগে হৃদয় আমার উদ্বেলিত হয়ে উঠলো। এই বিশাল ভারত একসময় আমাদের ছিলো। হাজার বছরের মত এদেশ আমরা শাসন করেছি, যেমন শাসন করেছি স্পেন সাতশ বছর। কিন্তু এক সময় আমরা ভুলে গিয়েছিলাম আল্লাহর কিতাব ও নবীর সুন্নাহ; আমরা ডুবে গিয়েছিলাম মদের পেয়ালায়। তলোয়ারের ঝঙ্কার ভুলে আমরা হারিয়ে গিয়েছিলাম নাচ-গানে ও নূপুর-ঝুমুরে। ভোগ-বিলাস, আর স্বেচ্ছাচারই হয়ে ওঠেছিল তখন আমাদের পরিচয়। তাই একসময় আমরা স্পেন থেকে বিতাড়িত হলাম। আমাদের অস্তিত্বই বিলুপ্ত হয়ে গেলো স্পেনের মাটি থেকে। হিন্দুস্তানের শাসনক্ষমতাও হাতছাড়া হলো আমাদের, তবে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব মুছে ফেলতে পারেনি কেউ। মুসলিম শাসন নেই, কিন্তু ইসলাম আছে এবং আছে মুসলমান।
পরিণতির এ পার্থক্য কেন হলো স্পেনে এবং হিন্দুস্তানে? কারণ সম্ভবত এই যে, স্পেনে শাসকরা শুধু শাসন করেছে, আর আলিমরা করেছে ইলমচর্চা। মাটি ও মানুষের কথা ভাবেনি তারা। তাই স্পেনের মাটিতে বসেনি তাদের শেকড়, আর মানুষের অন্তরে হয়নি তাদের ঘর। কিন্তু হিন্দুস্তানে এসেছিলেন হাজার হাজার দরবেশ, কুতুব, আওলিয়া। বাদশাহ ও শাহী দরবারের সঙ্গে ছিলো না তাদের কোন সম্পর্ক। তাঁরা সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন মাটি ও মানুষের সঙ্গে। ধর্মের নিপীড়নে অতিষ্ঠ মানুষকে তারা ডেকেছিলেন ইসলামের সাম্য ও শান্তির পথে। তাঁরা নিজেরাই ছিলেন ইসলামের জীবন্ত নমুনা। মানুষের হৃদয় তারা জয় করেছিলেন, আর কোটি কোটি মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করেছিলো।
বিশাল ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে নিজেকে আমার মনে হলো বড় ভাগ্যবান। মনে হলো, আমি তো তাদেরই উত্তরসূরী যারা একদিন ভারতভূমি জয় করেছিলেন; ইসলামের জন্য এই ভূমিতে যাদের রক্ত ঝরেছে। মানচিত্র আমার জানা নেই; এখান থেকে দিল্লী কত দূর? কোথায় লৌখনো, হায়দারাবাদ? কিন্তু কল্পনার চোখে আমি দেখতে পেলাম, আবার ছুটে আসছেন মুহম্মদ বিন কাসেম, সুলতান মাহমূদ এবং আহমদ শাহ আবদালীর মুজাহিদীন ফৌজ! বিশাল ভারতের দিকে দিকে আবার উড়ছে ইসলামের হিলালি ঝান্ডা! মুসলিম খুনে রাঙা হয়ে লালকেল্লা আবার হয়েছে আমাদের লালকেল্লা!
পুলিশ দু’জন তাগাদা দিলেন। আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সিঁড়ি বেয়ে বিমানে উঠে এলাম। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হলো এজন্য যে, ভারতের মাটিতে ইসলামের জন্য যাদের রক্ত ঝরেছে আজ অপ্রত্যাশিত এক সুযোগে সেই মাটিতে দু’ফোটা চোখের পানি ফেলে তাদের কাতারে শামিল হতে পেরেছি।
বিমানের দোর গোড়ায় তখনো দাঁড়িয়ে ছিলেন কো-পাইলট আহমদ মুহাসিবী। তার মুখে আগের সেই হাসি হাসি ভাবটি নেই, বেশ গম্ভীর। আমি সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলাম, তিনি আমার হাত ধরে বললেন, আমি জানি তোমার চোখে পানি কেন! আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। তিনি বললেন-
إنك تبكي على أرض الهند الفقيدة، كما نبكي على أرض فلسطين المحتلة.
(তুমি হারানো ভারতভূমির জন্য কাঁদছ যেমন আমরা কাঁদছি ফিলিস্তিনের অধিকৃত ভূমির জন্য।)
তার কথায় আমার চোখে আবার পানি এসে গেলো। খুব বেদনার্ত স্বরে বললাম, ‘আমার ভাই, আজমের মুসলিম ভাইদের বুঝতে তোমরা ভুল করো। আমাদের কান্না যেমন ভারতের জন্য তেমনি স্পেনের জন্য, যেমন কাশ্মীরের জন্য তেমনি ফিলিস্তিনের জন্য।’
তিনি কয়েকবার ‘আফওয়ান’ বলে আমার হাত ঝাঁকিয়ে দিলেন।
***
ডাক্তার সাহেব লিখিতভাবে তার পর্যবেক্ষণ রিপোর্ট পেশ করলেন, যার খোলাছা ছিলো, ‘অসুস্থ যাত্রী এখন পূর্ণ সুস্থ এবং বিমান-ভ্রমণের জন্য সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত।
ব্রিটিশ পাইলট ভদ্রমহিলাকে ‘কংগ্রাচুল্যেশন’ বলে এমন একটি হাসি উপহার দিলেন যে, অভিভূত হওয়া ছাড়া উপায় ছিলো না! মনে হলো, তার অন্তরের ইচ্ছাটাই যেন পূর্ণ হয়েছে। কত ভালো হতো, বাংলাদেশী ডাক্তারও যদি উঠে এসে ভদ্রমহিলাকে মোবারকবাদ জানাতেন, আর বলতেন, আমি আমার চিকিৎসাজ্ঞান থেকে যা ভালো মনে করেছি তাই করেছি এবং তাই বলেছি। তবে পবিত্র ঘরের উদ্দেশ্যে আপনার যাত্রা অব্যাহত থাকলো বলে আমি খুশী।’
ইন্ডিয়ান ডাক্তার বিমানের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে হাসিমুখে যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘ভগওয়ান আপ সবোঁ কা তীর্থ য়াত্র শুভ কারে।’
একজন চিকিৎসক, যিনি জরুরি পরিস্থিতিতে বিমানে আরোহণ করেছিলেন একজন অসুস্থ যাত্রীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে, তার কি দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলো বিমানের যাত্রীদের শুভেচ্ছা জানানো? কেন তিনি এটা করলেন? এটা তার নিজস্ব সৌজন্যবোধ, কিংবা তার দেশপ্রেম। হয়ত তিনি চেয়েছেন বিদেশী বিমানযাত্রীদের সামনে তার দেশের উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তুলে ধরতে। আমাদের চরিত্রে এ দু’টো দিক থেকেই আমরা বঞ্চিত।
***
বিমানে আবার জ্বালানী নেয়া হচ্ছে। কারণ বিমানের অবতরণের সময় শূন্যে থাকা অবস্থায় জ্বালানী ফেলে দিতে হয়েছিলো। এটাই নাকি নিয়ম। নইলে আগুন ধরে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ইমাম ছাহেব বললেন, একজন সাধারণ অসুস্থ যাত্রীর জন্য একটি এয়ার লাইন্সের পক্ষ হতে এই যে বিরাট আয়োজন, জরুরি অবতরণ এবং এত বিপুল ক্ষতিবরণ, এই মানবিকতা সত্যি প্রশংসনীয়। এই শিক্ষাটুকু যদি আমরা আমাদের জীবনের সর্বত্র গ্রহণ করতে পারি তাহলে আমাদের গরীব দেশটা শান্তির নিবাস হয়ে যায়। অন্তত আমাদের মাদরাসাগুলোতে যেন আমরা এই মানসিকতা গ্রহণ করতে পারি। এটা তো ইসলামেরই শিক্ষা।
জ্বালানী গ্রহণ এবং বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সকল আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে দীর্ঘ সময় ব্যয় হলো। প্রায় পাঁচঘণ্টা পর বিমান আবার যাত্রা শুরু করলো। এই পুরো সময়টুকু সতর্কতার জন্য ডাক্তার ও এম্বুলেন্স সেখানেই অবস্থান করছিলো। বিমানের জানালাপথ থেকে দেখলাম, ডাক্তার, নার্স ও অন্যরা হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানাচ্ছেন। বাইরে থেকে হয়ত দেখা যাবে না, তবু প্রতি উত্তরে আমি হাত নাড়লাম। কিছুক্ষণ পর আকাশ থেকে দেখতে পেলাম, এম্বুলেন্স ফিরে যাচ্ছে। হিন্দুস্তানের মাটি থেকে উঠে এলেও হিন্দুস্তানের আসমানে আমরা থাকবো আরো কিছু সময়।
মহিলাযাত্রীটি তার আনন্দের উচ্ছ্বাস যেন চেপে রাখতে পারছেন না। বারবার তিনি সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন আর বলছেন, ‘আননেরা যুদ্দ করি অাঁরে দরি রাইকছেন, আল্লায় আননেগো হজ কবুল করুক।’
ইমাম ছাহেবকে বললাম, ঘর থেকে বের হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটলো এগুলো কিন্তু কাকতালীয় ঘটনা নয়। আমাদের জীবনে যা কিছু ঘটে সবই আল্লাহর হুকুমে গায়বি ইশারায় ঘটে এবং সবকিছুরই কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। বান্দা যদি সেই উদ্দেশ্যের সঙ্গে একাত্ম হতে পারে তাহলেই বান্দার লাভ। অন্যথায় ঘটনা একের পর এক ঘটে যায়, আর গাফলতের কারণে বান্দা ঘটনার সুফল থেকে মাহরূম থেকে যায়।
আল্লাহর ইলম ছাড়া এবং আল্লাহর হুকুম ছাড়া তো গাছের একটি পাতাও নড়ে না, তো এই যে ঘটনাগুলো ঘটলো, আমার বিশ্বাস, এর দ্বারা আমাদেরকে তাঁর ঘরের যিয়ারত লাভের এবং মকবূল হজ্ব আদায়ের যোগ্যতা দান করছেন; আমাদেরকে ছবর ও ধৈর্যের, সহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার এবং আল্লাহর কাযা ও ফায়ছালার সামনে আত্মসমর্পণের শিক্ষা দান করছেন। হজ্বের সফরের জন্য এটা হলো গায়বের তারবিয়াত। আল্লাহর শোকর, আল্লাহ আমাদের প্রতি বিরাট দয়া ও মেহেরবানি করছেন।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)