বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১৩
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাসা থেকে রওয়ানা হয়েছিলাম সি,এন,জি করে। সঙ্গে ছিলেন মাদরাসার খাদেম হানিফ। আমি তো জানতাম, সি,এন,জি করেই বিমানবন্দরে যাবো। গাড়ীর চালকও আমার পরিচিত এবং আন্তরিক। কিন্তু ‘ইনডিয়ান’ গাড়ীর সবচে’ বড় গুণ হলো যখন তখন অচল হওয়া। এখানেও তাই হলো, কোন রকম পূর্বঘোষণা ছাড়াই ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলো। তবে আমার জন্য তা কল্যাণকরই হলো। কারণ এমন একজন ভালো মানুষের গাড়ীতে করে বিমানবন্দরে যাওয়া হলো, পরবর্তীকালে যিনি আমার হজ্বের সফরসঙ্গী হয়েছিলেন, আর এখন তিনি আমার দ্বীনী কাজের একজন দরদী সঙ্গী। জীবনের চলার পথে বিভিন্ন বাঁকে এভাবে দূরের মানুষ কাছের হয়ে যায়, আবার কাছের মানুষ হয়ে যায় বহু দূরের।
যার কথা বলছি, তিনি আমার প্রিয় ভাই শাহজালাল। প্রায় প্রতিবছর বাইতুল্লাহর মুসাফিরের খিদমত মনে করে ইমাম ছাহেবকে তিনি গাড়ীতে করে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন। ইমাম ছাহেবের কথা হলো, মানুষ যদি খেদমত করে খুশী হয় এবং ছাওয়াবের ভাগী হতে চায় তো হোক না।
তিনি তাঁর নিয়তের ছাওয়াব পাবেন, তবে আমার এটা অত্যন্ত নীতিবিরুদ্ধ। কারণ আমার অভিজ্ঞতা বলে, মানুষ খেদমত করে যতটা খুশী হয়, খেদমত করতে না পারলে খুশী হয় অনেক বেশী।
কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই কার্যকর হয়, বান্দার ইচ্ছা নয়। নইলে আমার গাড়ীর চাকা না হয় একটি কম, কিন্তু হঠাৎ করে ইঞ্জিনটা বিগড়ে যাবে কেন? তাতেই না বাধ্য হয়ে ইমাম ছাহেবের সঙ্গে অন্যের গাড়ীতে গিয়ে বসতে হলো।
চালকের পাশে বসা মানুষটিকে পিছন থেকে দেখলাম। ইমাম ছাহেব বললে, ইনি শাহজালাল সাহেব। পরে তার সঙ্গে যত ওঠা বসা হলো, দেখলাম, তিনি ‘সাহেব’ নন, ‘ভাই’।
তাঁর কথা অনেক শুনেছি ইমাম ছাহেবের কাছে। আজ দেখলাম, প্রথমে শুধু পিছন থেকে, বিমানবন্দরে নেমে দেখলাম সম্মুখ থেকে। তারপর সেই যে কোলাকুলি হলো, তার উত্তাপ-উষ্ণতা এখনো আছে আমাদের বুকে।
***
যানজটমুক্ত পথে গাড়ী চলছে মসৃণ গতিতে। আমরা দু’জন মাঝে মাঝে বলছি-
লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারীকা লাকা লাববাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্-নি‘মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা-শারীকা লাক।
বড় অদ্ভুত এই লাববাইক ধ্বনি! সমগ্র অস্তিত্বে যেন এক তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করে; সুদূর অতীতের নূর ও নূরানিয়াতের সঙ্গে যেন একটা সম্পর্ক তৈরী করে; পৃথিবীতে প্রথম যিনি লাববাইক ধ্বনি উচ্চারণ করেছেন, কালের সুদীর্ঘ ব্যবধান সত্ত্বেও তাঁর সঙ্গে যেন একাত্মতার এক পবিত্র অনুভূতি এনে দেয়। আল্লাহর কত বড় দয়া যে, এ যুগের নাপাক যবানের লাববাইক আওয়াযের মধ্যেও খুব সামান্য হলেও তিনি চৌদ্দশ বছর আগের লাববাইক আওয়াযের খোশবু দান করেন। এমন নেক বান্দাও দুনিয়াতে আছেন যারা লাববাইক বলার সময় ঐ লাববাইকের খোশবু অনুভব করেন। হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ.) বলতেন, মিয়াঁ, খুব জাযবা, আর মুহববতের সঙ্গে লাববাইক বলো, যাতে মদীনার লাববাইকের খোশবু পাওয়া যায়। সেই খোশবু তিনি না পেলে কি আর এমন করে বলতেন!
***
গাড়ী বিমানবন্দর সড়কে উঠে এসে আরো দ্রুত গতিতে ছুটলো। এ সড়কে গাড়ী যখন দ্রুত গতিতে ছুটে চলে তখন আমার এমন অনুভূতি হয় যেন জিদ্দা থেকে মক্কার পথে চলেছি। উত্তরা যাওয়ার পথে বিমানবন্দর বরাবর এলেই মনে হয়, এই বুঝি গাড়ীটা পশ্চিম দিকে মোড় নেবে! কিন্তু নেয় না। সোজা উত্তরে চলে যায়। তখন আমার অনুভূতি হয়, চালক বুঝি পথ ভুল করলো। এ অনুভূতি কেন হয় জানি না, তবে হয়। ভিতরে তখন পুলক ও বিষণ্ণতার অপূর্ব এক মিশ্রস্বাদ অনুভব করি। হৃদয়ে বিচিত্র সব অনুভব-অনুভূতি কেন হয়, কীভাবে হয়, সে রহস্য এখনো মানুষের অজ্ঞাত। হয়ত চিরকাল অজ্ঞাতই থাকবে। স্থূল চক্ষুর দৃষ্টি যেদিন বন্ধ হবে এবং অন্তর্চক্ষুর দৃষ্টি উন্মিলিত হবে সেদিন হয়ত এ রহস্যের পর্দা উন্মোচিত হবে।
***
বিমানবন্দরের কাছাকাছি এসে ইমাম ছাহেবের ‘জাওয়াল’ বেজে উঠলো। আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালিকের ফোন। তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন হযরত পাহাড়পুরী হুযূরের কাছে সফরনামা লেখার অনুমতি চাওয়ার। আমার বিশ্বাস ছিলো, এবার তিনি অনুমতি দেবেন, তবু নিজেকে সরিয়ে রেখেছিলাম, যেন ফায়ছালা করার ক্ষেত্রে সেণহের বন্ধন কোনভাবেই তাঁকে পেরেশান না করে।
মাওলানা আব্দুল মালিক জানালেন, হযরত খুশিমনে ইজাযাত দিয়েছেন, শুধু তাই নয়, উৎসাহদান করে বলেছেন, ‘আমিও শাওকের সঙ্গে ইনতিযার করবো সফরনামা পড়ার জন্য।’
আমি আলহামদু লিল্লাহ বলে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম, আর মাওলানা আব্দুল মালিককে শুকরিয়া জানালাম ‘জাযাকাল্লাহু খায়রান’ বলে।
***
গাড়ী মূল সড়ক থেকে বিমানবন্দরে প্রবেশ করলো। আমি গভীরভাবে চিন্তা করে দেখলাম, বাইতুল্লাহর উদ্দেশ্যে জীবনের প্রথম সফরে বিমানবন্দরে প্রবেশ করার সময় হৃদয়ের যে আবেগ-অনুভূতি ছিলো তা আর কখনো হয়নি। হায়, সেই প্রথম আবেগ-অনুভূতি, সেই দুরু দুরু কম্পন আবার যদি ফিরে পেতাম, কিন্তু তা আর ফিরে আসে না। প্রতিবারই যেন একটু একটু করে কমছে। সবকিছু যেন কেমন স্বাভাবিকতায় আক্রান্ত হচ্ছে। প্রথম প্রেমের প্রথম আত্মনিবেদনের সেই শিহরণ, সেই কম্পন, সেই স্পন্দন কোথায় এখন।
***
গাড়ী থেকে নামলাম। বুকটা দুরু দুরু করছে। জানি না, আমাদের জন্য কী খবর অপেক্ষা করছে! অপেক্ষা করছিলো খবর নয়, নির্মম একটি নির্দেশ; ‘ভিতরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, এখানেই অপেক্ষা করুন।’
মনের তখন এমন পেরেশান
অবস্থা যে, কী বলবো! বিভিন্ন বুঝ দিয়ে মনকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। কিন্তু মন কখনো অশান্ত হয়ে ওঠে, কখনো আশঙ্কায় উৎকণ্ঠায় নির্জীব হয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে যেন অসুস্থ হয়ে পড়ছি। এ ভাবনা আরো বেশী পেরেশান করছে যে, এটা গোনাহের কারণে মাহরূমি নয় তো!
এর মধ্যে আরেক কা-! একভদ্রলোক, মুখে দাড়ি ছিলো, তিনি রাখেননি, রাখলে মনে হলো অনেক সুন্দর দেখাতো। বয়সে তরুণ। বড় বড় চোখ। উজ্জ্বল দৃষ্টি। উদ্ভাসিত মুখম-ল।
ধীরে ধীরে তিনি কাছে এলেন এবং কিছু বলার আগেই কেঁদে ফেললেন। কাঁদবো তো আমি, তুমি কেন কাঁদছো ভালো মানুষ!
অনেকক্ষণ পর অনেক কষ্টে কান্না সম্বরণ করে বললেন, আমি যাকে তালাশ করছি, মনে হয় আপনি সেই মানুষটি। আমার একটি আবেদন আছে।
আবেদন! আমার কাছে! আশ্চর্য! জীবনে অনেক দেখেছি, এমন তো দেখিনি! কিছু পয়সা চাইবে, তার জন্য এত ভনিতা কেন? মনে মনে ভাবলাম, সঙ্গে কিছু টাকা আছে, দিয়ে দেবো, যেন ভিতরে প্রবেশ করার জন্য সামনের দরজাটা আল্লাহ দয়া করে খুলে দেন। বললাম, কী বলবেন, বলুন!
আবার কান্না! এবার মনে হলো, যা ভাবছি তা নয়, অন্য কিছু। শেষে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, প্রিয় পাঠক! তুমি কি বুঝতে পারছো, কী তিনি বললেন? বললেন, আমার নাম আনোয়ারুল ইসলাম। আপনি দয়া করে নবীজীর দরবারে আমার সালাম পৌঁছে দেবেন। আমি দু‘আ করবো, আল্লাহ যেন আপনার হজ্ব কবুল করেন।
বলেই আবার অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। এবার আমারও চোখদু’টো ভিজে উঠলো। যার সামনে দুয়ার বন্ধ; অনিশ্চয়তার অন্ধকার, তার কাছে এমন মিনতিপূর্ণ আব্দার! তোমার রহস্যলীলা তুমি ছাড়া কে বোঝবে হে আল্লাহ!
অনেক কষ্টে অশ্রুসম্বরণ করে বললাম, ভাই আনওয়ার, আপনার কথা অবশ্যই আমার মনে থাকবো। ইনশাআল্লাহ আপনার সালাম আমি নিয়ে যাবো সোনার মদীনায় এবং নিবেদন করবো নবীজীর রওযায়। তবে আমারও একটি অনুরোধ আছে। তিনি সাগ্রহে জানতে চাইলেন, কী?!
আমি বললাম, দাড়ি হলো নবীজীর সুন্নত। দাড়ি না রাখলে ওয়াজিব তরকের গোনাহ হতে থাকে। আপনি চেষ্টা করবেন, ধীরে ধীরে দাড়িটা রেখে দিতে।
তিনি সলজ্জ কণ্ঠে বললেন, আমারও ইচ্ছা, কিন্তু শয়তানের ধোকায় পারি না।
আমি বললাম, প্রতিদিনের পরিবর্তে একদিন পর পর যদি কামান তাহলে তো অর্ধেক গোনাহ কমে যায়। তখন দেখবেন, আল্লাহ তা‘আলা তাওফীক দিয়ে দেবেন।
ভাই আনওয়ারুল ইসলাম তার ‘এগারো সংখ্যার’ ফোন নাম্বারটি দিয়ে বললেন, আমার সালাম পেশ করার পর দয়া করে মদীনা শরীফ থেকে জানাবেন। তাতে আমার ‘মনের আগুন’ শান্ত হবে।
বোঝা গেলো, তিনি বেশ প্রস্ত্ততি নিয়ে এসেছেন। পঞ্চাশ রিয়াল বের করে বললেন, এটা রাখুন ফোন করার জন্য।
অনেক বুঝিয়ে তাকে বিরত রাখলাম। তিনি মুছাফাহা করে বিদায় নিলেন। দেখে তখন মনে হলো, বুকের ভিতরে অনেক বড় প্রশান্তি নিয়ে তিনি যাচ্ছেন, অথচ হায়, আমার বুকের ভিতরে তখন ...!
ভাই আনওয়ারের সালাম আমি পেশ করেছিলাম পেয়ারা নবীর রওযা শরীফে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও ফোন করতে পারিনি। সফর থেকে ফিরে যখন ঘটনা বললাম, আমার ছেলে বলে, ‘কোড নাম্বার দিয়েছিলে?’
আমি তো তাজ্জব! ছেলে ফোন করে সঙ্গে সঙ্গে ভাই আনওয়ারকে পেয়ে গেলো। আমি তাকে খোশখবর জানালাম, আর কী কারণে মদীনা শরীফ থেকে জানাতে পারিনি, বললাম। তার পরের ঘটনা বড় কষ্টের। থাক সেটা।
***
একটা ঘণ্টা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে অতিক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় আদেশ জারি হলো, ‘সউদিয়ার বাসে উঠুন।’
বুঝুন এবার, ইহরামের লিবাস পরে বিমানবন্দরে এসে ওঠবো সউদীয়ার বিমানে নয়, বাসে! তার চেয়ে যদি বলা হতো, সবার সামনে কান ধরে দশবার ওঠ-বস করো, এত কষ্ট হতো না। একটা শোরগোল পড়ে গেলো। ক্ষোভ ও বিক্ষোভে সবাই যেন ফেটে পড়লো। কেউ কেউ সরাসরি কাফেলার আমীর সাহেবের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করলেন যে, কেন শেষের দিকে ফ্লাইট নিলেন। অনেকেই যে এ বিষয়ে একমত ছিলেন সেটা বেমালুম ভুলে গেলেন। শুধু ভুলে গেলেন না, কে কী আশঙ্কার কথা বলেছিলেন তাও সবিস্তারে বয়ান করতে লেগে গেলেন। লোকচরিত্র বড় আশ্চর্য!
বেচারা আমীর সাহেবের দোষটা যে কোথায় আমি খুঁজে পেলাম না। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কে বোঝে, আর কাকে বোঝায় যে, এ ক্ষোভ ও বিক্ষোভ অর্থহীন! এমনকি তা হজ্বের মূল প্রাণ ও তার অনুভব-অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গতিহীন! এখানে তো প্রতিমুহূর্তে উৎকণ্ঠা থাকবে যে, আমি সবচে’ বড় অপরাধী। আমার মত পাপী, গোনাহগার ও গান্দা ইনসানের কোন যোগ্যতা নেই পবিত্র ভূমিতে হাযির হওয়ার। আমি হজ্বের কাফেলায় শামিল হয়েছি বলেই এখন সবার এ দুর্গতি। আমার কারণেই এখন সবার যাত্রাবিঘ্নিত। হে আল্লাহ, আমাকে মাফ করে দাও এবং আমার ‘নহুসত’ থেকে আমাকে ও সবাইকে হেফাযত করো।
বিমানবন্দর পর্যন্ত এসেছিলাম এ আশায় যে, কাফেলা সামনে চলবে, চলতে থাকবে। আমরা পশ্চিমের উদ্দেশ্যে স্বপ্নের ডানা মেলে আকাশে ওড়বো এবং সাদা-কালো মেঘের রাজ্য পাড়ি দিয়ে হিজাযের ভূমিতে পৌঁছে যাবো, যেখানে আছে কালো গিলাফে ঢাকা আল্লাহর ঘর, সবুজ গম্বুজের ছায়ায় আছে নবীজীর কবর। কিন্তু যে কথা বরাবর শুনে এসেছি এবং বারবার বলে এসেছি, তা আজ আবার নতুন করে সত্য প্রমাণিত হলো। মানুষ শুধু স্বপ্ন দেখতে পারে, হৃদয়ের গভীরে শুধু স্বপ্ন লালন করতে পারে, কিন্তু স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতে পারে না। তুমি যদি স্বপ্ন দেখো তাহলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বহন করার জন্যও তোমাকে প্রস্ত্তত থাকতে হবে। তোমার স্বপ্ন দেখা এবং স্বপ্নভঙ্গের বেদনা সবই আল্লাহর পক্ষ হতে। তোমার তো দিন-রাতের, সকাল-সন্ধ্যার এবং সারা জীবনের একমাত্র ভাবনা হবে, আমার আল্লাহ আমার প্রতি সন্তুষ্ট কি না? আমার স্বপ্নভঙ্গের মধ্যেই যদি তাঁর সন্তুষ্টি থাকে হাজারো স্বপ্নের পূর্ণতাকে একটি স্বপ্নভঙ্গের বেদীতে উৎসর্গ করতে আমি প্রস্ত্তত।
সবাই গাড়ীতে উঠলাম, আর গাড়ী উল্টো দিকে চলতে শুরু করলো। এ অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম। যে পথে বিমানবন্দরে প্রবেশ করেছিলাম সে পথেই আবার বিমানবন্দর থেকে আমাদের বের করে নেয়া হলো। নিজের অজান্তেই দু’চোখ থেকে অশ্রুধারা প্রবাহিত হলো। সফরের দোরগোড়ায় এসে ফিরে যাওয়া, আর কখনো তো এমন হয়নি! এবারই প্রথম! তাহলে কি দয়ার পরিবর্তে দয়াময় এবার ইনছাফ করছেন?! আসামীকে পাকড়াও করে হাওয়ালাতে ফেরত পাঠাচ্ছেন?! আল্লাহ জানেন, কী আছে ভাগ্যের পর্দায়! তবে এখন আমাদের কাজ হলো ধরা পড়া আসামীর মত মাথা নীচু করে অপরাধ স্বীকার করে নেয়া এবং ইসতিগফার করতে থাকা। জাল ভিসা নিয়ে বিমানবন্দর পার হতে গিয়ে যারা ধরা পড়ে, জেলে যায়, আমরা তো তাদেরই মত। জাল প্রেমিক ও ভন্ড আশিক সেজে ঢুকে পড়েছিলাম হজ্বের কাফেলায়। এখন ধরা পড়েছি ঘরের মালিকের হাতে। তিনি তো এমন যে, তাঁর চোখে ফাঁকি দেয়া কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। পিছনে পাকড়াও করেননি; দেখেও দেখেননি। নির্বিঘ্নে পার হতে দিয়েছেন। এবার পাকড়াও করেছেন। তবে মাওলার দয়া ও করুণা তো অসীম! অনুতাপদগ্ধ হৃদয়ে যদি ক্ষমা চাওয়া যায় তাহলে ক্ষমা পেতে কতক্ষণ!
খাদিম হানিফ আমার সঙ্গে আসতে চাইলেন, যদি কোন প্রয়োজন হয়। দোষেগুণে এই মানুষটি আমার প্রতি আন্তরিক। প্রথম দিন থেকে এখন পর্যন্ত অনেক কিছু হয়েছে, তবে তার আন্তরিকতায় ভাটা পড়েনি। কোন কাজে কখনো না বলেনি। মানুষটি আরো ভালো হতে পারতো, কিন্তু আমরাও কি আরো ভালো বান্দা হতে পারতাম না?!
আমি বললাম, আপনি এসে আর কী হবে? হুকুম হলে তো আগে বাড়বো, আর হুকুম না হলে তো ফিরে যেতেই হবে। আপনি যান মাদরাসায় আপনার কাজে; তবে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।
গাড়ীতে শোরগোল হচ্ছে প্রচ-। সবাই বলছে, কেউ শুনছে না। এটা অবশ্য নতুন কিছু নয়, আমাদের চিরাচরিত জাতীয় চরিত্র। একবার মনে হলো জোরে জোরে লাববাইক বলি, কিন্তু মনে হলো গাড়ীর যাত্রাপথের সঙ্গে মিলবে না। জোরে জোরে ইসতিগফার পড়তে শুরু করলাম। শোরগোল কমে গেলো। দু’একটি কণ্ঠে ইস্তিগফারও ধ্বনিত হলো। ইমাম সাহেবকে বললাম, আমাদের কাওম আসলে ঠিক আছে, ত্রুটি হচ্ছে আমাদের পরিচালনায়। যদি বলতাম, শোরগোল না করে ইস্তিগফার করেন, বা আরো কঠিন কিছু বলতাম, কেউ শুনতো না, বরং বিরূপ প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা ছিলো।
গাড়ী গিয়ে থামলো উত্তরার শেষ মাথায় একটি হোটেলের সামনে। খুব সাধারণ হোটেল। কোন এয়ার লাইন্স তার যাত্রিদের সাধরণত এধরনের হোটেলে রাখে না। কিন্তু আমরা তো আল্লাহর ঘরের সম্মানিত মেহমান নই। আমরা তো আল্লাহর দরবারে ধরা পড়া আসামী। আসামীকে কোথায় রাখা হলো সেটা বড় কথা নয়, আসামীকে মাফ করা হলো কি না সেটাই বড় কথা। পথের ধূলায় ফেলে রাখো, হাসিমুখে পড়ে থাকবো, দয়া করে শুধু মাফ করে দিয়ো।
ব্যবস্থা যেমনই হোক, লেখা ছিলো ‘অভ্যর্থনা’। সেখানেই গাদাগাদি করে পঞ্চাশ ষাটজন আসামীকে বসানো হলো। ঘণ্টা পার হয়ে গেলো এ অবস্থায়। ইমাম ছাহেব বললেন, ক্ষুধা পেয়েছে। পেয়েছে তো আমারও। কিন্তু কয়েদির কি আরাম করে খাবার খাওয়া সাজে! তবু খাবার বের করলাম। রুটি, আর ভাজি। প্রত্যেক সফরের শুরুতে আমার মা তৈরী করে দিতেন। এখন তিনি অসুস্থতার কাছে অসহায়। এবার তৈরী করে দিয়েছেন আমার স্ত্রী, আমার সন্তানের মা। অসুস্থতার মধ্যেও আমার মা খোঁজ রেখেছেন সঙ্গে নাস্তা দেয়া হচ্ছে কি না। এ নাস্তা খাওয়ার কথা ছিলো বিমানে আরোহণ করে, আর বিমানের যাত্রা করার কথা ছিলো দুপুর আড়াইটায়।
আমরা দু’জন খেলাম, একজন বৃদ্ধ সফরসঙ্গীকেও শরীক করলাম। ক্ষুধার চাহিদা বড় আশ্চর্য! দুঃখের এবং কষ্টের মধ্যেও তৃপ্তির সঙ্গে খাওয়া হলো। ক্ষুধার সময় এভাবে যিনি খাদ্যের ব্যবস্থা করলেন, আশা করা যায়, তিনি নারায নন। আশা করা যায়, তিনি ডাকবেন, ইহরামের সাদা লেবাসের লাজ রক্ষা করবেন এবং ঘরের দুয়ারে হাযির হওয়ার তাওফীক দেবেন।
এককোণে অসুস্থ ও মা‘যূর একজন মানুষ বসে আছেন। দেখে বড় মায়া হলো। এমন মা‘যূর অবস্থায় হিম্মত করেছেন হজ্বের সফরের! আরো আশ্চর্য, ফোনে কথা বলছেন সতেজ যুবকের অটুট মনোবল নিয়ে। সম্ভবত ঘরের লোকদের অভয় দিচ্ছেন। হাসিমুখে বলছেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আমার কোন অসুবিধা হচ্ছে না। ঘরে নেয়ার জন্য যিনি ঘর থেকে বের করেছেন তিনিই আমার দেখাশোনা করবেন।
আমি মুগ্ধ হলাম আল্লাহর বান্দার কথা শুনে। আল্লাহর প্রতি এমন অবিচল আস্থা যার, সত্যি তো, তার আবার চিন্তা কিসের! তার হিফাযত তো করবেন স্বয়ং আল্লাহ! এমনকি তার সঙ্গে যারা যাবে তারাও থাকবে আল্লাহর হিফাযতে, তার ‘সঙ্গ’-এর বরকতে।
খুব ইচ্ছে হলো তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার এবং কথা বলার। যখন শুনলাম, তিনি আমাদেরই কাফেলার সঙ্গী তখন খুবই আনন্দ হলো, বড় সৌভাগ্যের অনুভূতি হলো।
মানুষটি এমনিতে নীরব, তবে সদালাপী। তাই আলাপ শুরু করতে অসুবিধা হলো না। আর আলাপ যখন শুরু হলো তখন বেশ উৎসাহের সঙ্গেই শুনালেন তার কাহিনী। পরিষ্কার বোঝা যায়, বলে আনন্দ পাচ্ছেন। আল্লাহর গায়বি মদদের কথা বলতে আনন্দ তো পাওয়ারই কথা! আল্লাহ নিজেই যখন বলেছেন, ‘আর আপন প্রতিপালকের নেয়ামতের কথা তুমি আলোচনা করো।’
শিকদার নামেই তিনি পরিচিত। সারা জীবন, ‘শিকদারি’ করেছেন, আর ব্যবসা-বাণিজ্যে ডুবে ছিলেন। তার ভাষায় ‘দু’হাতে নয়, চার হাতে’ অর্থ উপার্জন করেছেন। হজ্ব ফরয হয়েছিলো সেই যৌবন বয়সেই. কিন্তু হজ্বের কথা চিন্তা করারও অবসর ছিলো না। তাছাড়া তার ধারণা ছিলো, হজ্ব হলো বুড়ো বয়সের কাজ। বুড়ো বয়সটা আসুক তো, তারপর না হয় চিন্তা করা যাবে।
এদিকে বুড়ো বয়সটা পুরোপুরি আসার আগেই এসে গেলো অপ্রত্যাশিত এক বিপদ। অজ্ঞাত এক রোগে আক্রান্ত হলেন। পাদু’টো প্রায় অচল এবং হাতদু’টো প্রায় অবশ হয়ে তিনি, যাকে বলে, শয্যাগত হলেন। হাসপাতালে কাটলো দীর্ঘ দিন।
আমাদের দেশে ডাক্তাররা রোগ ধরতে না পারলেও বিজ্ঞের মত ভাব করেন। গম্ভীর মুখে লম্বা ব্যবস্থাপত্র ধরিয়ে দেন, আরো গম্ভীর মুখে কিছু উপদেশ ও পরামর্শ গছিয়ে দেন। বাকিটা আল্লাহর হাওয়ালা। শিকদার সাহেবের বেলায়ও তাই হলো। লম্বা লম্বা ব্যবস্থাপত্রের উপর চিকিৎসা হলো, দেশে ও বিদেশে। (আর আমাদের চিকিৎসার বিদেশ হলো ইন্ডিয়া।)
রোগের যখন সামান্য উপশম হলো তখন তাকে পেয়ে বসলো হজ্বের চিন্তা। সঙ্গত কারণেই পরিবারের লোকেরা রাজী নয়। এমন শারীরিক অবস্থায় রাজী হওয়ার কথাও নয়। তারা জোর দিলো হজ্বেবদলের জন্য। কিন্তু তিনি স্থিরপ্রতিজ্ঞ। ভুল যা হওয়ার হয়েছে। আল্লাহ যখন বাঁচিয়ে রেখেছেন, এখন যত কষ্টই হোক, নিজের হজ্ব নিজেই করার চেষ্টা করবেন।
কিন্তু কোন কাফেলা এমন মা‘যূর মানুষকে সঙ্গে নেয়ার কথা ভাবতেও রাজী নয়। শেষে হতাশই হয়ে পড়লেন। সময় যখন প্রায় শেষ তখন তিনি ইমাম ছাহেবের খোঁজ পেলেন এবং দেখা করে মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলেন।
শিকদার সাহেবের ভাষায়, ‘এ মানুষটিকে মনে হলো আসমানের ফিরেশতা! তিনি আমাকে আরো সাহস দিয়ে বললেন, কে বলে আপনি হজ্ব করতে পারবেন না? আরে, আল্লাহর মদদ না হলে তো সুস্থ-সবল মানুষও হজ্ব করতে পারে না। মক্কা শরীফে গিয়েও হাসপাতালে পড়ে থাকে। আর আল্লাহ যদি মদদ করেন তাহলে আরো মা‘যূর মানুষও সুস্থ-সবল মানুষের মত হজ্ব করে আসে। আপনি চলুন আমার সঙ্গে। আপনার ওছিলায় আমাদের হজ্বও আল্লাহ আসান করে দেবেন।’
এ পর্যন্ত বলে শিকদার সাহেব থামলেন। মনে হলো ভিতরে উথলে ওঠা আবেগ সংযত করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পারলেন না। চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বললেন, বিশ্বাস করেন ভাই, ইমাম সাহেবের কথা শুনে আমি কান্না সম্বরণ করতে পারিনি। মনে হলো স্বয়ং আল্লাহ আমার হাত ধরেছেন। কেউ যখন বোঝা মনে করে আমাকে সঙ্গে নিতে রাজী না তখন ইমাম সাহেব আমাকে সাগ্রহে এবং সসম্মানে সঙ্গে নিয়েছেন। এখন আমার পুরা একীন, আল্লাহ অবশ্যই আমাকে হজ্ব করাবেন এবং আসানির সঙ্গে করাবেন।
শিকদার বলছিলেন, আর আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। নিজেকে বড় ভাগ্যবান মনে হলো হজ্বের সফরে এমন মানুষের সঙ্গী হতে পেরে। পুরো সফরে ইমাম সাহেব তার অনেক খেদমত করেছেন এবং মাসআলার দিক থেকে যত আসান ছুরত হতে পারে তা নির্ধারণ করে হজ্ব আদায়ের সহজতম ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এজন্য ইমাম ছাহেবের প্রতি তিনি খুব কৃতজ্ঞ ছিলেন। হজ্ব থেকে ফিরে আসার কিছু দিনের মধ্যেই তিনি ইনতিকাল করেছেন। জীবনের ফরয হজ্বটুকু আদায় করার জন্যই যেন এত বড় অসুস্থতার মধ্যেও তিনি বেঁচে ছিলেন। মরহূম শিকদার সাহেবের হজ্ব করা না দেখলে বোঝা যাবে না, বান্দার উপর আল্লাহর মদদ ও সাহায্য কতভাবে হতে পারে!
আমি আশা করি, হাদীছ শরীফে যেমন এসেছে, তিনি জন্মদিনের মত মাসূম অবস্থায় হজ্ব থেকে ফিরে এসেছিলেন এবং মাসূম অবস্থায় দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। আল্লাহ তাকে বেলা হিসাব জান্নাতুল ফিরদাউস নছীব করুন, আমীন।
হোটেলে নামাযের কোন ব্যবস্থা ছিলো না; থাকার কথাও নয়। কয়েকজন করে আছরের জামাত করা হলো; মাগরিবও পড়া হলো একই ভাবে।
কিছু কিছু লোকের কামরার ব্যবস্থা হলো। তারা কামরায় চলে গেলেন। আমাদের তখনো ব্যবস্থা হয়নি। আমরা সেখানেই বসে থাকলাম। তবে একটু হালকা হওয়ার কারণে কিছুটা স্বস্তিবোধ হলো।
ইতিমধ্যে শিকদার সাহেবের বাসা থেকে লোক এসে গেলো। আমরাও অনুরোধ করলাম যে, আপনি মাযূর মানুষ। বাসায় গিয়ে বিশ্রাম করুন। নিজের গাড়ী আছে; খবর পাওয়ামাত্র বিমানবন্দরে চলে আসতে পারবেন।
কিন্তু তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের আওয়াযে বললেন, ঘর থেকে বের হয়েছি, ইনশাআল্লাহ ‘ঘর’ না দেখে ঘরে ফিরবো না। সুবহানাল্লাহ!
রাত আটটার দিকে আমাদের কামরার ব্যবস্থা হলো। দেহের ক্লান্তি ও অবসন্নতা তখন চরমে। দু’জনের কামরা চারজনের জন্য বরাদ্দ হলো; তবু তো হলো। বিছানায় যখন শরীরটা এলিয়ে দিলাম তখন অজান্তেই মুখ থেকে বের হলো আলহামদু লিল্লাহ! মনে মনে ভাবলাম, আসামী হই, আর কয়েদী হই, বিশ্রামের প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই। আর হে আল্লাহ, অবশেষে তুমি সে ব্যবস্থা করেছো। তোমার শোকর হে আল্লাহ তোমার শোকর!
আমাদের কামরা হলো চারতলায়। হোটেল কর্তৃপক্ষকে অনেক অনুরোধ করেও শিকদার সাহেবের জন্য নীচের তলায় ব্যবস্থা করা গেলো না। সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠতে তার যে কষ্ট হলো তা বলার মত নয়। যখন তাকে বললাম, অনেক চেষ্টা করেও কোন ব্যবস্থা করা গেলো না তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন, একবার, যখন আমি ‘শিকদার’ ছিলাম, কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। কামরা বুক করে গিয়েছিলাম। আমাকে অপেক্ষা করতে বললো, আর আমার রক্ত গরম হয়ে গেলো। সঙ্গে তো পাঁচ ছয়জন বডিগার্ড থাকতো। আর থাকবে না কেন, সেই বডিটা তো আর এখনকার মত ছিলো না। তো ওরা সঙ্গে সঙ্গে রিসেপশনের লোকটাকে ছাতু বানিয়ে ফেললো। আর পুরো হোটেল ম্যানেজমেন্ট হাতজোড় করে মাফ চাইতে লাগলো। এই হাত কি অবশ হয়েছে এমনি এমনি মনে করেন! তো আজকের কষ্টের ওছিলায় আল্লাহ যদি সেগুলো মাফ করে দেন তাহলে তো ভালোই।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম লোকটার প্রতি। ধর্মচিন্তা ও আল্লাহভীতি মানুষকে কোন্ নীচতা থেকে কত উচ্চতায় নিয়ে যায়!
যে ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে আমাদের সফরের ব্যবস্থা তার নাম হলো রফিক ট্রাভেলস। নতুন এবং অনভিজ্ঞ, তবে আন্তরিকতার অভাব ছিলো না। এজেন্সির চেয়ারম্যান নিজেও আমাদের সহযাত্রী এবং ইমাম ছাহেবের ছাত্র। বেচারা কী আর করতে পারেন? বারবার খোঁজ নিচ্ছেন, কষ্ট হচ্ছে বলে দুঃখ প্রকাশ করছেন। যে দেখে সেই জিজ্ঞাসা করে, কী খবর? কিন্তু বেচারার কাছে তো অনিশ্চয়তা ছাড়া কোন খবর নেই। তবু সবাইকে সাধ্যমত সান্তবনা দেয়ার চেষ্টা করছেন।
চারতলার করিডোরে এশার জামাত হলো। আশ্চর্য, জামাতে হাজী সাহেবদের হাযিরি হলো খুব কম, মাত্র দশপনেরজন। ইমাম সাহেব ইমামতি করলেন। নামাযের পর বড় মর্মস্পর্শী মুনাজাত করলেন। চোখ শুধু সিক্ত হলো না, বিধৌত হলো। অসহায় বান্দা আর কী করতে পারে কাকুতি-মিনতি ও অশ্রুপাত ছাড়া! আর এটাই তো মাওলার পছন্দ! যখন সময় হবে তখন দান তো করবেনই, কিন্তু তিনি চান, বান্দা তাঁর দরবারে রোনাযারি করুক; ভিক্ষুকের মত দু’হাত প্রসারিত করে চাইতে থাকুক। এতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি। এতেই বান্দার গৌরব।
মুনাজাতের পর ইমাম ছাহেব পূর্ণ বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে অত্যন্ত প্রশান্ত কণ্ঠে বললেন, আপনারা চিন্তা করবেন না। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের ব্যবস্থা করবেন। নিশ্চয় তিনি আমাদের আশা পূর্ণ করবেন। তার কথায় সবার সান্তবনা হলো, কিন্তু সবাই আবার হুহু করে কেঁদে উঠলো। সে বড় অদ্ভুত দৃশ্য! হজ্ব তো আগাগোড়া ইশক ও মুহবক্ষতের কারিশমা এবং প্রেম ও ভালোবাসার লীলা-খেলা! এখানে এই হাসি, এই কান্না! এই আনন্দ, এই বেদনা! এই আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠা, আবার এই আশ্বাস ও সান্তবনা! এখানে সবই সুন্দর, সবই মধুর, যদি দৃষ্টি থাকে অবলোকন করার এবং হৃদয় থাকে অনুভব করার।
হোটেল থেকে রাতের খাবার দেয়া হলো যেমন তাদের ইচ্ছে হলো। আমরা তা গ্রহণ করলাম নিজেদেরকে আল্লাহর মেহমান ভেবে এবং আল্লাহর পক্ষ হতে মেহমানদারি মনে করে। ফলে যে খাবার নিয়ে পাশের কামরায় শোরগোল হচ্ছে সে খাবারই আমাদের কাছে মনে হলো পরম সুস্বাদু। শিকদার সাহেব বড় শিক্ষার কথা বললেন, মাওলার পাঠানো খাবার যদি বান্দার মুখে না রোচে তাহলে সে কিসের বান্দা!
অনেক চিন্তা-ভাবনার পর ইমাম ছাহেবের মোবাইল থেকে বাসায় ফোন করলাম। মনে হলো, ঘরের মানুষ যদি দু‘আ করে তাহলে ‘ঘরওয়ালা’র দয়া হতে পারে। ফোন ধরলো বড় মেয়ে। আমার আওয়ায পেয়েই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো, আববু! আল্লাহর রহমতে মক্কা শরীফে পৌঁছে গেছো?
কী বলবো? কী বলা উচিত? এমন ভোলাভালা মেয়ের আনন্দের উচ্ছ্বাসটুকু নষ্ট করা কি ঠিক? শেষে বললাম, আম্মু! আল্লাহর রহমতে তোমার আববু এখনো পড়ে আছে ঢাকায়। দু‘আ করো, আল্লাহ যেন কবুল করেন। আল্লাহ যেন গায়ব থেকে ব্যবস্থা করে দেন।
একে একে সবার সঙ্গে কথা হলো। আমার ছোট মেয়েটি তার মত করেই বললো, চিন্তা করো না আববু! আমি দেখতে পাচ্ছি, তুমি আল্লাহর ঘরে পৌঁছে গিয়েছো!
এইটুকুন মেয়ে কীভাবে এমন বিশ্বাস ও প্রত্যয়ের সঙ্গে বলতে পারলো?! কী দেখতে পাচ্ছে সে?! কেমন দেখা সেটা?! সবসময় মনে হয় এমন করে বলা যায় না, আর যখন বলা যায় তখন তা সত্য না হয়ে যায় না!
রাত অনেক হয়েছে, শোয়া দরকার। শোয়া হলো, কিন্তু ঘুম কোথায়? বারবার মনে হচ্ছে, এই বুঝি খোশখবর এসে গেলো, চলো, চলো, জাহায তৈয়ার!
শেষে আমরা দু’জন বারান্দায় গিয়ে বসলাম। শীতের রাত। সারা শহর যেন ঘুমের চাদর মুড়ি দিয়ে আছে। মাঝে মধ্যে একটা দু’টো গাড়ী চলছে। এছাড়া কোথাও জীবনের কোন স্পন্দন নেই। নিজেদের তখন বড় অসহায় মনে হলো। ইমাম ছাহেবের তো কিসমত বড়। প্রতি বছরই তার হজ্ব নছীব হয়। কিন্তু আমার অবস্থা! উনিশ বছর আগে হজ্ব নছীব হয়েছিলো। আমি এবং ইমাম ছাহেব একসঙ্গে। সেটা ছিলো তার জীবনের প্রথম হজ্ব। দুই বন্ধু একসঙ্গে আল্লাহর ঘরের সফর করেছিলাম। বড় আনন্দের দিনগুলো ছিলো। উনিশ বছর পর আজ আবার হজ্বের ইহরাম ধারণ করেছি। কিন্তু ...! আশার দীপ জ্বলছে, তারপরো আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠার অাঁধারে ডুবে যাচ্ছি। দুই বন্ধুতে অনেক রাত পর্যন্ত উনিশ বছর আগের স্মৃতিচারণ করলাম। একসঙ্গে বাইতুল্লাহর তাওয়াফ করা, ছাফা-মারওয়ার মাঝে সাঈ করা, সুড়ঙ্গ পথে একসঙ্গে মক্কা-মিনায় হেঁটে আসা-যাওয়া করা, তের তারিখে প্রায় জনশূন্য মিনায় ঝড়বৃষ্টির কবলে পড়া। মদীনা শরীফের দিনগুলো ছিলো বড় আনন্দের, বড় সৌভাগ্যের। একসঙ্গে রওযা শরীফে সালাম পেশ করা, একসঙ্গে রিয়াযুল জান্নায় এবং ছুফফায় বসে থাকা। হে আল্লাহ, এই সফরের মাধ্যমে আবার ফিরিয়ে দাও আমাদের জীবনের সেই মধুর দিনগুলো।
বিষণ্ণ হৃদয়ে স্মৃতিচারণের বিষণ্ণতা যেন আরো গভীরভাবে আমাদের বেষ্টন করলো।
রাত বারোটা পার হলো, কিছু জানা গেলো না। না খবর, না খোশখবর। ইমাম ছাহেব উঠে কামরায় চলে গেলেন, একটু যদি ঘুম আসে! আমার ইচ্ছে হলো ছাদে যাওয়ার, একটু খোলা আকাশ দেখার। আমার দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা, বিষণ্ণ হৃদয় রাতের তারাভরা আকাশ থেকে সান্তবনা লাভ করে। তারকার ঝিলিমিলির আড়াল থেকে অন্য এক আলোর রশ্মি যেন তার হৃদয়ে নেমে আসে। পুরো ছয়তলা হোটেল তখন নীরব। সবাই ক্লান্ত ছিলো; সবাই ঘুমিয়ে আছে। কামরার ভিতরে হয়ত কেউ কেউ জেগে আছে এবং অস্থির চিত্তে প্রতীক্ষার প্রহর গুণছে।
ধীরে ধীরে ছাদে উঠে এলাম। আর কেউ নেই, আমি একা। নীরবতা ও নির্জনতা দু’টোই ভালো লাগলো। অন্তরে প্রশান্তির শীতল প্রলেপ অনুভূত হলো। রাতের তারাভরা আকাশের সৌন্দর্য সৃষ্টিজগতের মধ্যে সত্যি অতুলনীয়। আমার তোমার দৃষ্টি ঐ সৌন্দর্য পর্যন্তই শুধু পৌঁছতে পারে এবং তাতেই মুগ্ধ হয়। কিন্তু যাদের রয়েছে অন্তর্দৃষ্টি তারা ঐ সৌন্দর্য অতিক্রম করে পৌঁছে যায় সৌন্দর্যের আধার পর্যন্ত।
শীতের রাত। বেশ শীত লাগছে। কিন্তু আমার ভালো লাগছে। ছাদে চাদর বিছিয়ে দু’রাকাত নামায পড়লাম। মনটা অনেক শান্ত হলো। মসজিদুল হারামের ছাদে নামায পড়ার কথা মনে পড়লো। এতক্ষণ তো আমাদের পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিলো জিদ্দা পার হয়ে মক্কা শরীফে মসজিদুল হারামের শুভ্র চত্বরে। হয়ত এতক্ষণে শুরু হয়ে যেতো আমাদের তাওয়াফ-সাঈ। কিন্তু এটাই ছিলো আল্লাহর ইচ্ছা এবং আল্লাহর ইচ্ছাতেই কল্যাণ, বান্দা যদি আল্লাহর ইচ্ছাকে গ্রহণ করে নিতে এবং বরণ করে নিতে পারে।
নির্জন ছাদে আকাশের দিকে মুখ করে শুয়ে থাকলাম। ভালো লাগলো, অনেক ভালো লাগলো। সেই ভালো লাগা প্রথমে আকাশকে স্পর্শ করলো, তারপর আকাশের ঝলমলে তারাদের, তারপর.. তারপর আমি আর জানি না। শীতের রাতে আকাশের তারকারা আরো সুন্দর, আরো উজ্জ্বল হয়। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম।
মসজিদুল হারামের ছাদে ওঠা যায়, প্রথমে আমি জানতাম না। যেদিন জানলাম, খুব ইচ্ছে হলো ছাদে ওঠার। রাতের বেলা উঠেছিলাম। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম শতকোটি হৃদয়ের প্রেম ও ভক্তি-ভালোবাসার কেন্দ্র কালো গিলাফে ঢাকা বাইতুল্লাহকে। কী দেখেছিলাম সেদিন রাত্রে কীভাবে তা প্রকাশ করবো ভাষার সীমাবদ্ধতা দিয়ে। অনেক উঁচু থেকে দেখেছিলাম লক্ষ মানুষের তাওয়াফের স্রোত। আলোর একটা শুভ্র স্রোত যেন ঘুরছে কালো ঘরকে কেন্দ্র করে। আদব রক্ষা করে কিসের সঙ্গে উপমা দেয়া যায় এ সৌন্দর্যকে? অনেক ভেবেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমার সীমাবদ্ধতার কাছে পরাজয় মেনে মুক্ত কণ্ঠে স্বীকার করেছি, তোমার সৌন্দর্যের তুলনা তুমি নিজে।
সেদিন রাতে, তারপর অনেক রাতে মসজিদুল হারামের ছাদে শুয়ে থেকে রাতের আকাশ দেখেছি। ঠিক এই রকম আকাশ; এই রকম অন্ধকার; অন্ধকারে ফুটে থাকা অসংখ্য আলোকিত ফুল, তারার ফুল। দেখে মুগ্ধ হয়েছি, অভিভূত হয়েছি। আকাশকে অনেক আপন মনে হয়েছে, আর মনে হয়েছে, আকাশ থেকে যেন ঝিরঝির করে করুণা ঝরছে, আকাশের অধিপতির করুণা।
আজও তাই মনে হলো। আকাশকে অনেক সুন্দর, অনেক উজ্জ্বল এবং অনেক আপন মনে হলো; মসজিদুল হারামের ছাদ থেকে দেখা আকাশের মতই। আসলে আকাশ তো আকাশই, যেখান থেকেই তুমি দেখো। এখন যদি আমি মসজিদুল হারামের ছাদে শুয়ে থাকতাম তাহলে তো এ আকাশই দেখতাম। সেখানেও এই তারকারাই মিটিমিটি করতো। এখন এখানে এই সাধারণ একটি হোটেলের ছাদে শুয়ে শুয়ে আমি সেই আকাশ এবং সেই তারকাই দেখছি। এজন্যই তো কাছের পৃথিবী থেকে দূরের আকাশ মানুষের এত আপন।
মসজিদুল হারামে এখন তো রাত। কত রাত হবে? এখানে একটা, সেখানে হয়ত দশটা। এখন কি সেখানে মসজিদুল হারামের ছাদে কেউ শুয়ে আছে?! শুয়ে শুয়ে আকাশ দেখছে?! আকাশের তারা-ফুল দিয়ে মালা গাঁথছে, তাঁর দুয়ারে কৃতজ্ঞতা নিবেদন করতে?!
হে অদেখা বন্ধু! তুমি কোন দেশের জানি না, আরবের না আজমের, ইরাকের না ইরানের, হিজাযের না হিন্দুস্তানের; তবে তোমাকে আমি অনুভব করতে পারছি। কারণ তোমার এবং আমার হৃদয়ের অনুভূতি অভিন্ন। তুমি শুয়ে আছো মসজিদুল হারামের ছাদে, আলো-সিণগ্ধ পরিবেশে; আমি শুয়ে আছি সুদূর বাংলাদেশে, যেখান থেকে বিমান ওড়ে হিজাযের উদ্দেশ্যে তার কাছে একটি সাধারণ ভবনের অন্ধকার ও নির্জন ছাদে। তোমার চারপাশে আলো, আর আলো, যেন আলোর বন্যা; এখানে আমার চারপাশে শুধু অন্ধকার। তবু তুমি এবং আমি অভিন্ন। আমাদের হৃদয়ের অনুভূতি অভিন্ন। আমরা দু’জনেই আকাশ দেখছি; আসলে দেখতে চাচ্ছি অন্যকিছু। আমরা দু’জনেই ঝলমলে তারকাদের সৌন্দর্য উপভোগ করছি; আসলে অনুভব করতে চাচ্ছি অন্যকিছু।
আমিও এখন হতে পারতাম তোমার সঙ্গী। কিন্তু তোমার সৌভাগ্য তো তোমাকে পৌঁছে দিয়েছে হিজাযের পবিত্র ভূমিতে, মসজিদুল হারামে, আল্লাহর ঘরের কত কাছে! আর আমি পড়ে আছি...। তবে আমিও আসবো, অবশ্যই আসবো। তোমাকে যিনি পৌঁছিয়েছেন, আমাকেও পৌঁছাবেন তিনি। মসজিদুল হারাম থেকে আমাকেও দেখাবেন তিনি আকাশের সৌন্দর্য এবং তারকার শোভা।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)