এখনো আছে একটি প্রদীপ
বড় শান্তির একটি স্বপ্ন দেখেছি। আর তখন মনটা অশান্ত হয়ে উঠলো হুযূরের সঙ্গে দেখা করার জন্য; আমার প্রাণপ্রিয় হযরতুল উস্তায পাহাড়পুরী (দামাত বারাকতুহুম)। আল্লাহ তাঁকে দীর্ঘ উত্তম জীবন দান করুন। আগে নূরিয়ার জীবনে ইচ্ছে হলেই তাঁকে দেখতে পেতাম। অনেক সময় ইচ্ছেরও প্রয়োজন হতো না; তিনি ডাকতেন; আমি হাযির হতাম। তিনি বলতেন, আমি শুনতাম। কত রকম কথা হতো! শিক্ষার কথা, দীক্ষার কথা, অতীতের কথা, ভবিষ্যতের কথা। প্রতিটি কথা হৃদয়কে সবুজ করে, ভবিষ্যতের স্বপ্নকে সজীব করে এবং চলার পথকে আলোকিত করে। এমন কথা হতো যা উস্তায ও ছাত্রের মধ্যে হয়; এমন কথা হতো যা পিতা-পুত্রের মধ্যে হয়। (এখন যে শব্দটি বলবো তা যেন কাউকে বিভ্রান্ত না করে) এমন কথাও হতো যা বন্ধুর সঙ্গে হয়!
উস্তায যখন ‘বন্ধু’ হয়ে কথা বলেন তখন তা হৃদয়ে যে বিপুল শক্তির উদ্বোধন ঘটায়, যে সর্বজয়ী সাহসের সঞ্চার করে তা সেই শুধু বুঝতে পারে, যার এ সৌভাগ্য হয়েছে।
আগে এটা অনেক ছিলো; ধীরে ধীরে কমে এসেছে; আর এখন...।
কখনো এমন হতো যে, কোন কথা হতো না; শুধু একটি প্রশান্ত নীরবতা বিরাজ করতো। মনে হতো, নীরবতা যেন একখন্ড আকাশ, আর তা থেকে ঝরছে প্রশান্তির শিশির। কোথায় এখন সেই নীরবতা! কোথায় সেই নীরবতার উপলব্ধি!
আল্লাহর রহমতে এখনো তিনি আছেন আমার জীবনে, কিন্তু জীবনের সেই রাঙা প্রভাত, সেই আবিরমাখা সন্ধ্যা, সেই আলোকিত দিন ও জোসনা ধোয়া রাত কোথায় যেন হারিয়ে গেছে! মনে হয়, তিনি আজ কত দূরে! এমনও আশঙ্কা জাগে যে, ‘দূরের নৈকট্য’ বলে যে সান্ত্বনা, সেটা সত্যি, না আত্মপ্রতারণা!
তিনি অবশ্য সান্ত্বনার কথা বলেন। মন তাতে আশ্বস্ত হয়, আবার হয় না। সান্ত্বনা পেয়েও অতীতের জীবনে ফিরে যাওয়ার ব্যাকুলতা শান্ত হয় না।
ঐ জীবনটা ছিলো মরুদ্যানের মত ছায়াময়, স্নিগ্ধ শীতল; এখন যেন ধূধূ এক মরুভূমি! জীবনের আগুনঝরা রোদ থেকে এখন ইচ্ছে করলেই ‘ছায়া’র আশ্রয় নিতে পারি না। এখন অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হয়। তবু সান্ত্বনা, অনেক দূরে ছায়াটা এখনো আছে। জীবনের অজানা ভবিষ্যতে কী আছে কে জানে!
***
হুযূরের কাছে যাওয়ার জন্য এবং স্বপ্নটি তাঁকে বলার জন্য কয়েকদিন থেকে মনটা অস্থির। কিন্তু জীবনের বাস্তবতা এমন যে, ইচ্ছে থাকলেও উপায় থাকে না; অস্থিরতা ও ব্যাকুলতার মধ্যেই সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ সেদিন মনে হলো, যেতে হলে এর মধ্যেই যেতে হবে। তখন পুত্র মুহম্মদকে বললাম, ‘চলো বাবা, কাল ভোরে হুযূরের কাছে যাই।’
***
কিছু দিন থেকে চেষ্টা করি, ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার। আমাদের জীবনে চলার পথে এত কাঁটা ছিলো না, এত কাদা ছিলো না। কাফেলা ছিলো, রাহবার ছিলো; এত রাহযান ছিলো না। এখন যাদের পথচলা শুরু তাদের তো সারা পথেই কাঁটা, সারা পথেই কাদা। কাফেলা নেই, রাহবার নেই, অথচ পথের এখানে সেখানে ওত পেতে আছে হিংস্র লুটেরা। তাহলে জীবনের পথ কীভাবে তারা নিরাপদে পার হবে?! তাই ছেলেকেও সঙ্গে করে নিয়ে যাই। এই প্রদীপ থেকে একটু যেন আলো পায়; ভবিষ্যতের চলার পথ একটু যেন আলোকিত হয়।
***
ঢাকা শুধু দেশের রাজধানী নয়, অনেক কিছুরই রাজধানী; রাজনীতির, দুর্নীতির, খুনখারাবির এবং যানজটের। যানজট মানে কালো ধোঁয়ার রাজ্যে দম আটকে পড়ে থাকা। রাজধানীর দুর্ভাগা বাসিন্দা হিসাবে সেটা অবশ্য অসহনীয় কিছু নয়, যদি কিছু সময়ের জন্য হয়। কিন্তু রাজধানীর যানজট সময় ও স্থান মেনে চলে না। যখন যেখানে ইচ্ছা ‘নাযিল’ হতে পারে এবং যতক্ষণ ইচ্ছা...।
আমাকে বুদ্ধিমান বলা যেতে পারে এজন্য যে, ঐ বস্ত্তটিকে এড়িয়ে চলার জন্য আমি আশ্চর্য একটি কৌশল উদ্ভাবন করেছি। বিস্তর গবেষণার পর দেখলাম, আমরা যেমন সারা দিনের কর্মব্যস্ততার পর রাতে ‘ঘুম পাড়ি’ যানজট নামের যন্ত্রণাটিও সারাদিন মানুষকে ভুগিয়ে গভীর রাতে গ্যারেজে গিয়ে ‘ঘুম পাড়ে’, আর যানজটকে যেহেতু নামায পড়তে হয় না, তাই একটু দেরীতেই ওঠে। তো কোন মানযিলের উদ্দেশ্যে যখন আমি বের হই, চেষ্টা করি সেখানে গিয়ে ফজর পড়তে। তখন না থাকে যান, না থাকে জট; গাড়ী চলে গাড়ীর গতিতে এবং...।
***
আজ ১৯ শে ফেব্রুয়ারী। বাংলা তারিখটা বাঙ্গালী ও বাংলাদেশী কারোই মনে থাকে না, এমনকি বাংলাভাষার মাসেও না; আমার অবশ্য মনে আছে, তবে জানা নেই। আরবী তারিখটা মনে আছে এবং জানাও আছে; তবু কেন ইংরেজি তারিখ ব্যবহার করলাম? কারণটা না হয় থাক এখন!
আগের যুগে আলিমদের নিজস্ব বাহন ছিলো; উট, ঘোড়া, কিংবা অন্তত একটা গাধা। আমাদের তো একটা সাইকেলও নেই! অথচ বাহন জীবনের অপরিহার্য প্রয়োজন, যার উপর যাকাত নেই। পাঁচহাজার টাকার সাইকেলেও না, কোটি টাকার গাড়ীতেও না।
কৈশোরে খুব ইচ্ছে ছিলো, আমার একটা সাইকেল থাকবে। ইচ্ছেটা পূর্ণ হয়নি। সাইকেল- চালনাটা শিখতে চেয়েছিলাম; তাও পারিনি।
আমার ছেলের ইচ্ছাটা অবশ্য পূর্ণ হয়েছিলো। সুন্দর একটা সাইকেল পেয়েছিলো, চালাতেও পারতো বেশ, কিন্তু সাইকেলটা রাখতে পারেনি।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও কথাগুলো এখন এখানে কেন লিখলাম? কারণ একটু আগে আমার এক ‘আধুনিক’ বন্ধু ফোন করে বললেন, এক মাওলানা কোথায় যেন সফরে যাবেন, একদিনের জন্য গাড়ীটা চাচ্ছেন। তিনি দিতে চান না। তাই জানতে চান, কীভাবে নিষেধ করলে গোনাহ হবে না।’
বলুন, কী সাঙ্ঘাতিক কান্ড ! কেন আমাদের নিজস্ব বাহন নেই? কেন মানুষের কাছে হাত পাতা?
এ বিষয়টি অবশ্য আমার হুযূরের অনুভূতিতে ছিলো। তাই আমাকে বাহনসংগ্রহের জোর তাকিদ দিতেন, আর বলতেন, আপনার হলেই আমার হলো।
এত দিন হুযূরের বাহন ছিলো না। কষ্ট হতো এবং কষ্ট করেই মিরপুর থেকে লালমাটিয়া বাসে ওঠতেন। সে যে কী কষ্ট! আলহামদু লিল্লাহ, এখন তাঁর বাহন হয়েছে। না হয়ে উপায়ও ছিলো না। এখন তো তাঁকে চলতে হয়...।
যদিও আমার নিজস্ব বাহন নেই, তবে এলাকার পরিচিত চালক, যখনই ডাকি, খুশিমনে হাযির হয়। সন্ধ্যারাতে বলে রেখেছিলাম; ভোর চারটায় সে গাড়ী নিয়ে হাযির। ছেলেকে জাগালাম। একডাকে তার ওঠা দেখে বোঝা গেলো, জাগবার জন্যই ঘুমিয়েছিলো! জাগবার নিয়তে ঘুমুলে সে ঘুম থেকে ওঠাটা এরকমই হয়। আমরা আসলে জাগবার নিয়ত করে ঘোমাই না; ঘুমটাকে উপভোগ করার জন্য ঘোমাই। ছেলে তার মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিলো। আমি আম্মার কাছ থেকে রাত্রেই বিদায় নিয়ে রেখেছিলাম। বিসমিল্লাহ বলে বের হলাম। ঘরের দরজা থেকেই ‘সুবহানাল্লাযী সাখ্খারা লানা’ বলে গাড়ীতে উঠলাম। একটা দু’টো পাখী তখন জেগে উঠেছে। পাখিদের সঙ্গে প্রথম দেখা হলো পোলটা পার হওয়ার পর। ওরা মনে হয় দূরে কোথাও যাবে রিযিকের সন্ধানে। তার আগে গাছের ডালে ওড়াউড়ি করে সম্ভবত প্রস্ত্ততিপর্বটা সেরে নিচ্ছে; কিংবা হয়ত এটাই ওদের ইবাদত, আর কিচিরমিচিরটা তেলাওয়াত!
রাজধানী ঢাকায় এমন নির্জন পথ, এমন মসৃণ পথচলা, কল্পনা করতেই ভিতরে কেমন একটা শিহরণ জাগে! মনে হয়, এ পথ শুধু আমার, এ পথের পথিক শুধু আমি!
বুঝতে পারছি না, ‘মুহম্মদ আমার পাশে’ বলবো, নাকি ‘আমি মুহম্মদের পাশে’! আমার জীবন তো আমাকে বিদায় জানাতে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে, আর তার জীবনটা প্রস্ত্ততি গ্রহণ করছে তাকে স্বাগত জানাতে। এ জীবনে আমার যা কিছু কল্পনা ও পরিকল্পনা ছিলো, যা কিছু হয়েছে এবং যা কিছু হয়নি সব তো আমি তারই কাঁধে অর্পণ করে বিদায় নিতে চাই। সুতরাং বলা ভালো, গাড়ীতে আমি তার পাশে বসলাম। গাড়ীর ভিতরের আলো-অাঁধারিতে শুভ্র পোশাকে তাকে বেশ লাগছিলো। এটা তার গোনাহের বয়স নয়, হয়ত একারণেই তার পোশাকের শুভ্রতা আরো বেশী উজ্জ্বল মনে হচ্ছিলো। প্রার্থনা করি, সামনের জীবনটা যেন পুণ্যের শুভ্রতায় সমুজ্জ্বল থাকে। যখন আমি থাকবো না, আর সে অনেক বড় হয়ে জীবনের অনেক জটিলতায় প্রবেশ করবে তখন এ লেখাটি হয়ত তাকে শুভ্রতার পথে চলতে কিছুটা হলেও অনুপ্রাণিত করবে। সে আশা করেই কথাগুলো লিখে রাখলাম। (মনে রেখো বাবা, একসময় আমি তোমার পাশে বসেছিলাম, তোমাকে দেখে তোমার পোশাকের শুভ্রতা থেকে তোমার ভিতরের শুভ্রতাটুকু অনুভব করেছিলাম।)
***
পথে পথে আলোকসজ্জা দেখে মনে পড়লো, দেশ এখন খেলার উৎসবে ডুবে আছে, কিংবা ভেসে আছে। শহরের শুধু এই উৎসব-সাজের খরচই নাকি পঞ্চাশ কোটি টাকা! নগর-পরিচ্ছন্নতা বিভাগের ঐ যে তিনটি মহিলা ও পুরুষ ঝাড়ু দিচ্ছে, এ উৎসবের সাজ তাদের জীবনে কি কোন পরিবর্তন আনবে! অহেতুক এ আলোঝলমলতায় তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়, কে জানে!
অবাক হলাম এবং ভালো লাগলো আমার ও ছেলের ভাবনা একই খাতে প্রবাহিত হচ্ছে দেখে। সে বললো, ‘আচ্ছা আববু! গরীবের অর্থের এমন অপচয়, কারো মনে কি একটুও অনুশোচনা হয় না?’
আমি বললাম, এটা ঠিক, তবে আমাদের কর্তব্য হলো আগে আত্মসমালোচনা করা। অপচয় আমাদের জীবনেও আছে, যা না থাকলে আমাদের চারপাশের অভাবগ্রস্ত মানুষের কিছুটা হলেও উপকার হতো।
ছেলেকে এভাবে বললাম, কারণ আমি চাই না, এখনই তার চিন্তা সমালোচনাপ্রবণ হয়ে উঠুক। আগে দরকার আত্মসমালোচনা। তারপর যদি সমালোচনা হয় তখন সেটা হয় গঠনমূলক সমালোচনা।
নির্জন পথ। যানজটের যন্ত্রণায় যা পাড়ি দিতে লেগে যায় তিন ঘণ্টা, ত্রিশ মিনিটে তা পাড়ি দিয়ে মীরপুর পৌঁছে গেলাম। প্রথমে গেলাম মারকাযুদ্-দাওয়ায়। আমার প্রিয় মাওলানা আব্দুল মালেক, রাতেই তাকে বলা হয়েছে, আমাদের অপেক্ষায় ছিলেন। সেণহের (মাওলানা) আবরার ফোনে বললো, ‘আববা এখন মোটামুটি ‘খোশ’ অবস্থায় আছেন।’
অল্পক্ষণেই হুযূরের দরজায় পৌঁছে গেলাম। আবরার দরজা খুলল, আমরা হুযূরের খিদমতে হাযির হলাম।
প্রত্যেকের জীবনে এমন একজন মানুষের উপস্থিতির অনিবার্য প্রয়োজন যাকে দেখলে চোখদু’টো জুড়িয়ে যায়, মনে প্রশান্তি আসে, জীবনের গ্লানি দূর হয়, এবং .. এবং মনে হয়, আমাকে দেখে তাঁরও মুখমন্ডল উদ্ভাসিত হয়।
হুযূর এখন এমনই অসুস্থ, বিষণ্ণ ও ক্লিষ্ট যে, দেখে মায়া হলো, কষ্ট হলো, তবু চোখদু’টো জুড়িয়ে গেলো। মনে প্রশান্তির পরশ অনুভূত হলো এবং .. এবং জীর্ণ ক্লিষ্ট চেহারাটাও যেন খুশিতে উদ্ভাসিত হলো। আমার সঙ্গে মুছাফাহা করলেন, আর মুহম্মদকে মুছাফাহার পর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তার লেখা-পড়ার খোঁজ নিলেন, অনেক দু‘আ করলেন। পুষ্পের সদ্য প্রকাশিত উনিশতম সংখ্যাটি মুহম্মদের হাতে ছিলো। সে হুযূরকে দিলো। হুযূর ‘পুষ্প বের হয়েছে!’ বলে প্রচ্ছদটা দেখলেন, তারপর বললেন, ‘চোখের আলো বলে একটা কথা শুনতাম, বুঝতাম না, এখন বুঝতে পারি চোখের আলো কী জিনিস! চোখের দৃষ্টি আল্লাহর কত বড় নেয়ামত!’
মনে মনে দু‘আ করলাম, ‘এ মহা নেয়ামত যেন তাঁর জীবনে এবং আমাদের জীবনে আল্লাহ ‘বরকারার’ রাখেন, আমীন।’
কথা বলতে কষ্ট হয়, গলা শুকিয়ে আসে, তবু অনেক কথা বললেন। ‘নেকফাল’ ও সুলক্ষণ হিসাবে আগেও বলেছেন, আজ আবার বললেন, ‘আল্লাহ তো জানেন, মারকায ও মাদরাসাতুল মদীনাহ কোথায় হবে, আপনারা দু’জন আমার ‘হযরত’, তাই আল্লাহ তা‘আলা আগেই ঐ স্থানের নাম ‘হযরতপুর’ রেখে দিয়েছেন!’ বড়রা যখন মায়া করেন, কত রকম ভাষায় দু‘আ করেন! কখনো তিরস্কারের শব্দে, কখনো প্রশংসার বাক্যে, কখনো ..। এই ‘আন্দাযে দু‘আ’ বুঝতে না পেরে অনেকে বিভ্রান্ত হয়!
মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস বিভিন্ন আঙ্গিকেই লেখা হয়েছে। উস্তায ও ছাত্রেরও রয়েছে ধারাবাহিক ইতিহাস। যার শুভসূচনা দারুল আরকাম থেকে, যার বিস্তার সুদীর্ঘ চৌদ্দ শতাব্দী এবং মহাকালের সঙ্গে এখনো যা প্রবহমান। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, সেই কল্যাণময় ইতিহাস স্বতন্ত্র- ভাবে আজো লেখা হয়নি। হয়ত আগের ‘ছাফদিল’ মানুষের জন্য তেমন প্রয়োজন ছিলো না, কিন্তু এখন বড় প্রয়োজন।
তো বলছিলাম, দু‘আর বিভিন্ন রূপের কথা। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব যে বলেছিলেন, ‘আবু বকরের মাল আমার যত উপকার করেছে, আর কারো মাল তা করেনি’, এটা কী ছিলো? দু‘আ!
আর ঐ যে তাবুকের ঘটনায় কথা বন্ধ রাখা, সেটাও ছিলো দু‘আ।
দু‘আর এই রূপবৈচিত্র্যের বহু উদাহরণ আছে প্রত্যেক যুগে। ইমাম বুখারী যে বলেছেন- ‘আমি তোমার দ্বারা যত উপকৃত হয়েছি তুমি আমার দ্বারা তত হওনি।’ এটাও ছিলো দু‘আ, আর ঐ যে বলেছেন, ‘যাও বের হয়ে যাও’ সেটাও ছিলো দু‘আ।
তো আল্লাহর শোকর, আমার হুযূর যখন যে ভাষায় দু‘আ করেন, বুঝতে পারি যে, সেটা দু‘আ।
অনেক কথা হুযূর বললেন। ভালো লাগছিলো এটা বুঝতে পেরে যে, আমাদের উপস্থিতি তাঁর আত্মিক প্রশান্তির কারণ হয়েছে। তাই যেন বললেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমি হযরতপুর যাবো।
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস হয় না। এমন স্বাস্থ্যগত অবস্থায় যা বলছেন তা কীভাবে সম্ভব?!
আমার বিস্ময়ের ঘোর তখনো কাটেনি, মাওলানা আব্দুল মালিক উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ‘আলহামদু লিল্লাহ। যখন হুযূরের তবিয়ত প্রফুলস্ন থাকবে, আবরার খবর দিলেই আমি এসে হুযূরকে নিয়ে যাবো।’
আমি আর কী বলবো, চুপ করে থাকলাম!
বিদায়ের সময় বললাম, ‘হুযূর, একটি শান্তির স্বপ্ন দেখেছি, বলতে চাই।’
অনুমতি পেয়ে বললাম, স্বপ্নে দেখি, নূরিয়াতে আপনার সেই কামরার সামনে আপনার কাছে বসে আছি, আর বলছি, হুযূর! সব কিছু ছেড়ে আপনার কাছে চলে এসেছি। বাকি জীবন আপনার কাছেই পড়ে থাকবো। প্রয়োজন পুরা করার জন্য আপনি প্রতিমাসে তিনশ টাকা দেবেন। তাহলে আম্মার কোন কষ্ট হবে না।
আপনি চারশ টাকা দিয়ে বললেন, নিন, একশ বাড়িয়ে দিলাম। প্রতিমাসে চারশ দেবো।
আমি খুশী হয়ে আল্লাহর শোকর আদায় করলাম, আর আপনাকে ‘জাযাকাল্লাহু’ বললাম। এরপর ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো; তখন ফজরের আযান হচ্ছে।’
হুযূর বললেন, বহুত মোবারক খাব। তারপর এমন তা‘বীর বললেন যে, দিলটা খুশিতে আর চোখদু’টো অাঁসুতে ভরে গেলো। আলহামদু লিল্লাহ।
আমাদের তো উঠতে মন সরছিলো না, এমনকি অসুস্থতা সত্ত্বেও মনে হলো, তিনিও চাচ্ছেন, ‘সময় যেন থেমে থাকে, আর দাস্তানে মুহাববাত যেন চলতে থাকে!’
তবু বিদায় নিলাম। তিনি সব- সময়ের মত বললেন, ‘আল্লাহর হাওয়ালা’।
***
মারকাযের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। ত-বস্নকের মসজিদের কাছে এসেছি, এমন সময় মাওলানা আব্দুল মালিকের ফোন বেজে উঠলো। হুযূর ফিরে যেতে বলেছেন, জরুরি কথা আছে।
গাড়ী ঘোরানো হলো। অবাক হয়ে ভাবছি, এমন তো কখনো হয়নি! কী হতে পারে! আল্লাহ খায়ের করুন।
দূর থেকে দেখে আমি তো স্তব্ধ! হুযূর রাস্তায় আমাদের জন্য দঁড়িয়ে আছেন আবরারের কাঁধে ভর দিয়ে! বোঝাই যাচ্ছে, কেমন কষ্ট হচ্ছে। ঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে থাকা! আল্লাহ জানেন, কী ঘটনা!
তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে হুযূরের কাছে গেলাম। তারপর যা ঘটলো, অনেক ভেবেছি তা লিখবো কী না! হে প্রিয় পাঠক, আল্লাহ সাক্ষী, তোমার ভালো ভেবে লিখছি, দু‘আ করো আল্লাহ যেন আমারও ভালো করেন।
হুযূর বললেন, ‘আপনি যে স্বপ্নটি দেখেছেন তার উপর আমল করার জন্য ডেকে আনলাম। আমার কাছে এখন তিনশ আছে। এটা গ্রহণ করেন।’
হুযূর যদি বলতেন, ‘আমার কাছে একটুকরো চাঁদ আছে, এটা গ্রহণ করেন’, তাহলে এর চেয়ে বেশী আনন্দ হতো না।
গ্রহণ করে ধন্য হলাম। আমার বিশ্বাস, হুযূরের হাত দিয়ে আমার জন্য এটি ছিলো আকাশেরই দান!
আমি বেলা ইখতিয়ার হুযূরের বুকে আশ্রয় নিলাম। চোখের অশ্রু রোধ করা অসম্ভব হলো। দু’ফোটা চোখের জল ছাড়া আর তো কিছু ছিলো না দেয়ার জন্য!
আচ্ছা, বর্তমানকে নিষ্ফলা ভেবে আমরা যে অতীতের কান্না কাঁদি, কেন?! এমন বর্তমানকে নিয়ে কি গর্ব করা যায় না?! অতীতের মত এখনো কি আকাশের দান আমাদের কাছে নেমে আসে না! অতীত না হোক, অতীতের ছায়া তো আছে তাতে! দুঃখ শুধু এই যে, যতটুকু আছে তাও আমরা গ্রহণ করতে জানি না।
মারকাযের পথে আবার যখন রওয়ান হলাম, কেমন ছিলো তখন আমার ভিতরের আনন্দ, আমার হৃদয়ের আবেগ-তরঙ্গ তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। প্রয়োজনও নেই। যাদের অনুভব আছে, হৃদয়ের ভাব তারা তো হৃদয় থেকেই ধারণ করে!
ঠিক একথাটাই বললো, আমার ছেলে মুহম্মদ, ‘যা দেখলাম তাতে আমার মনে যে কী হচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। তোমার উস্তাযের সঙ্গে এমন একটি জান্নাতি দৃশ্য যে দেখার সৌভাগ্য হলো সে জন্য আল্লাহর শোকর। (‘জান্নাতি দৃশ্য’ শব্দটি তার নিজের।)
আমারও আনন্দ হলো যে, ছেলে তা দেখতে পেয়েছে। এমন কিছু দেখার জন্য তো হাযার মাইল সফর করাও সামান্য। শোকর হে আল্লাহ, তোমার শোকর!
মাওলানা আব্দুল মালেক আমাকে বিদায় দিলেন দুপুরে। কোথায়, কীভাবে বিদায় দিলেন? কেমন ছিলো মাঝখানের সময়টুকু? কী দেখলাম, কী শুনলাম এবং কী শিখলাম, যদি লিখতে চাই, লেখার মত অনেক কিছু আছে। কিন্তু থাক। কবির ভাষায়-
‘রাত ভোর হলো/ মোম গলে গলে শেষ হলো/ তবু কি ফুরোবে না তোমার গল্প!/এখনো আছে অনেক, বলেছি তো অল্প! কিন্তু তার দস্তরখানে যে ‘ভরপুর’ নাস্তাটা হলো তা যদি স্মরণ না করি এবং শোকর না করি তাহলে অন্যায় হবে তাঁর প্রতি এবং ...।
***
একুশে ফেব্রুয়ারীর নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে, তারা সেটা তাদের মত করেই পালন করে। ভাষার জন্য যারা প্রাণ দিয়েছে, তাতে তাদের আত্মার কতটা শান্তি এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের তাতে কতটা কল্যাণ, সে হিসাব যেদিন হবে সেদিন বোঝা যাবে আমাদের কী করার ছিলো, আমরা কী করেছি? তবে আমার জন্য এবারের একুশে ফেব্রুয়ারীটা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
ঠিক এগারটা বিশ মিনিটে মাওলানা আব্দুল মালিকের ফোন। তার ফোন আমার জন্য সবসময় কল্যাণের, আনন্দের। তাই যখন তার ফোন আসে, কল্যাণ-আনন্দের অনুভূতি নিয়েই ধরি। কিন্তু এতটা যে আমার কল্পনায়ও ছিলো না!
তিনি বললেন, ‘হযরতপুরের উদ্দেশ্যে হুযূর রওয়ানা হয়েছেন, আমি সঙ্গে আছি!’
ভাবলাম, ‘সঙ্গে তো থাকবেই! সময় তো এখন তোমার! তবে আমাকে মনে রেখেছো, সেজন্য কৃতজ্ঞ।’
তিনি তো আমার অবস্থা জানেন, তাই বললেন, আপনি আসতে না পারলে চিন্তার কারণ নেই। আমি হুযূরকে মাদরাসাতুল মাদীনাহর জমিতে নিয়ে যাবো।’
আব্দুল মালেক! আসলে তুমি অনেক ভালো! আমি যদি হতে পারতাম তোমার মত! আমার ছেলেরা যদি...! আমার ছেলেটি যদি...!
শারীরিক অবস্থা তখন ঘর থেকে বের হওয়ার মত ছিলো না। এদিকে আমার হজ্বের সফরসঙ্গী পরম মুহববতের মানুষ তাওফীকে ইলাহী তার এক ভাইকে নিয়ে মাদরাসায় আসবেন, আগেই কথা ছিলো এবং হয়ত রওয়ান হয়ে গেছেন। তার একার বিষয় হলে চিন্তা ছিলো না, কিন্তু সঙ্গে নতুন মেহমান! কী করি?!
তবে দ্বিধামুক্ত হতে সময় লাগলো না। আল্লাহর নাম নিয়ে ফোন করলাম। তাওফীক ফোন ধরেই বললেন, এই মাত্র ফোন করবো ভাবছি, আর আপনার ফোন এসে গেলো। হুযূর, আমি খুব দুঃখিত যে, ...
কথার মাঝখানেই বললাম, কিন্তু আমি খুব ‘সুখিত’ যে, ...।
সব শুনে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, আমিও।
এরপর থাকলো ভাই শাহজালাল। তারও আসার কথা এবং সম্ভবত...। ফোন করে শুনি, তিনি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একুশে ফেব্রুয়ারীতে পড়েছেন।
আমি পাহাড়পুরী হুযূরের কথা বলে বললাম, ‘আপনি সোজা বছিলা বরাবর বেড়ীবাঁধে অপেক্ষা করুন।’
ছেলেকে সঙ্গে নেয়ার খুব ইচ্ছে ছিলো, কিন্তু তার মায়ের তাকে প্রয়োজন ছিলো। যদিও বলছিলো, নিয়ে যাও; আমার সমস্যা হবে না, তবু ভাবলাম, থাক, মায়ের খিদমতে থাক।
ভেবেছিলাম রিকশায় যেতে হবে, কিন্তু না, আল্লাহ একটা সিএনজি পাঠালেন, আর আমি বিশ মিনিটে নির্ধারিত স্থানে পৌঁছে গেলাম। দেখি, ভাই শাহজালাল গাড়ীতে অপেক্ষা করছেন।
ভালো লাগলো তার হাতে পুষ্প ও আলকাউছার দেখে। বললেন, গাড়ীর সময়টুকু পড়ার কাজে ব্যয় করার চেষ্টা করি, যাতে সময়টা নষ্টই না হয়।
বললাম, মুমিনের সময় কখনো নষ্ট হতে পারে না। কারণ হয় সে পড়বে, না হয় লিখবে, না হয় যিকির-তিলাওয়াত করবে, না হয় চিন্তা-ফিকির করবে, আর না হয়, নিয়ত করে ঘোমুবে।
পাহাড়পুরী হুযূরকে তিনি দেখেছেন কয়েক বছর আগে বাইতুল্লাহর সফরে। তারপর আর দেখা হয়নি, যদিও খুব ইচ্ছে ছিলো। এভাবেই আল্লাহ বান্দার ইচ্ছা পূর্ণ করেন। সবকিছু হয় পর্দার আড়ালে বিভিন্ন কারণের আবরণে। বান্দা তাই বুঝতে পারে না এবং শোকর করে না।
***
বুড়িগঙ্গা তৃতীয় সেতু পার হয়ে কিছু দূর গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিতে হয়। প্রায় পানিশূন্য একটা খালের উপর একটা জীর্ণ পোল। সামান্য একটু এগিয়ে চৌমাথা। এই পথটুকু হলো যানজটের স্থায়ী ‘বাসস্থান’। ডানে হেমায়েতপুরের রাস্তাটা ধরে যেতে হয় প্রায় আট কিলোমিটার পথ। বেশ সুন্দর। গাছের ছায়া আছে। দু’টি তিনটি পোল আছে, নীচে পানি নেই। এখন পানি থাকে না। পথের পাশে কয়েকটি মসজিদ আছে; ছোট, তবে সুন্দর। অবশ্য মুছল্লী না থাকলেও যদি ‘সুন্দর’ শব্দটির ব্যবহার করা যায়।
একবার হযরতপুরে বড় রাস্তাটির পাশে মাগরিবের সময় একটি মসজিদে তো দেখা গেলো, ইমাম-মুছল্লী কেউ নেই! মাওলানা আব্দুল মালিক তখনই নিয়ত করলেন মসজিদটি আবাদ করার। আল্লাহ তাকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।
***
মারকাযের ‘ইহাতা’ ও প্রাঙ্গণ রাস্তা থেকে একটু দূরে, তাই গাড়ী থেকে নেমে জমির আইল ধরে কিছু দূর হাঁটতে হয়। অবশ্য দক্ষিণ দিক দিয়ে মারকায পর্যন্ত প্রায় তেরশ গজ লম্বা রাস্তা হয়েছে। ওদিক দিয়ে মারকাযের প্রাঙ্গণ পর্যন্ত গাড়ী যায়।
মরিচ খেতের আইল বরাবর বড় বড় ফাঁকের জাল টানানো আছে ফসল রক্ষার জন্য। বে-খেয়ালে জালে পা জড়িয়ে পড়লাম তো পড়লাম, একেবারে উপুড় হয়ে। অবচেতনে দু’হাত সামনে বাড়িয়ে পতন ঠেকাতে গেলাম। ঠেকলো তো না-ই। উলটো হাতে-হাঁটুতে ব্যথা পেলাম। ভাই শাহজালালও চেষ্টা করলেন পতন থেকে আমাকে রক্ষা করতে। কাউকে পতন থেকে রক্ষা করা, কাজটা আসলে তত সহজ নয়। তবে চেষ্টার আন্তরিকতাটুকু অবশ্যই শোকরের বিষয়।
ভাগ্য ভালো, দৃশ্যটি তিনি ছাড়া আর কেউ দেখেনি। শৈশব থেকে জানি, কেউ না দেখলে ব্যথা পাওয়া যায় না। শাহজালাল ব্যথার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। কষ্ট করে বললাম, না, ব্যথা পাইনি। একটু পরে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, বললাম, একটু পেয়েছি। তৃতীয় বার বললাম, বেশ ভালোই পেয়েছি মনে হয়। একসঙ্গে সবটুকু স্বীকার করতে সংকোচ হলো, তাই ভাগে ভাগে স্বীকার করলাম।
হযরতপুরে হোঁচট খাওয়া এবং পড়ে যাওয়া, সেই প্রথম দিন থেকে। আজও ফেরার পথে হোঁচট খেলাম। মাওলানা আব্দুল মালিক যা বলেছেন তা যেন সত্য হয়। তার ধারণা, প্রতি হোঁচটে মাদরাসাতুল মাদীনাহর জমির পরিমাণ বাড়বে। ইয়া আল্লাহ, বুড়ো বয়সে হোঁচট খাওয়া ছাড়াই তুমি দিয়ে দাও। মারকায তো হোঁচট না খেয়েই পেয়েছে!
***
দূর থেকে দেখতে পেলাম, হুযুর মারকাযের সদ্য তৈরী লম্বা টিনশেড ভবনটি হেঁটে হেঁটে দেখছেন। হাঁটা মানে দু’জনের কাঁধে ভর দিয়ে। সামনে এসে সালাম করলাম; মুছাফাহার জন্য হাত বাড়ালাম। হুযূর এমনই খুশি প্রকাশ করলেন যে, ...।
বললেন, ‘মনে মনে ভাবছিলাম, মাওলানা যদি এসে যেতেন! পরে শুনলাম, আপনি রওয়ানা হয়েছেন। খুব ভালো হলো। হযরতপুরে দুই ‘হযরত’কে একত্রে পেয়ে গেলাম।’
পিছনে পিছনে হাঁটছি, হুযূর একটু পর পর বলছেন, আদীব ছাহেব কোথায়? শেষে একেবারে পাশে থেকে হাঁটতে লাগলাম। হুযূর আস্তে করে বললেন, ‘এবার ঠিক হয়েছে।’
দক্ষিণ দিকের রাস্তায় কাজ চলছে, তাই মারকাযের প্রাঙ্গণ পর্যন্ত গাড়ী আসেনি। হুযূর হেঁটে এসেছেন। কীভাবে, তা শুধু আল্লাহ জানেন!
সবকিছু দেখে হুযূর বললেন, অল্প সময়ে মাশাআল্লাহ অনেক হয়েছে।
***
মসজিদে যোহরের নামায হলো। নামাযের পর তালিবানে ইলমের উদ্দেশ্যে মুখতাছার বয়ান হলো। শুরুতে হুযূর এই আয়াতাংশটি তিলাওয়াত করলেন-
وذروا ظاهر الاثم وباطنه
আর ছেড়ে দাও তোমরা যাহেরি গোনাহ এবং বাতেনি গোনাহ। অর্থৎ যে সকল গোনাহ বাহ্যিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারা হয়, হাত-পায়ের গোনাহ, জিহবার গোনাহ, চোখ-কানের গোনাহ, এগুলো ছেড়ে দাও। সেই সঙ্গে বাতেনি গোনাহও ছাড়তে হবে, অর্থাৎ যে সমস্ত গোনাহের সম্পর্ক দিলের সঙ্গে, দেমাগের সঙ্গে; যেমন হাসাদ ও হিংসা-বিদ্বেষ, অহঙ্কার ও কিব্র, ‘উজুব’ ও আত্মতুষ্টি, বুখল ও কৃপণতা এবং খারাপ চিন্তা-খেয়াল।
এরপর বললেন-
‘এটা হলো তালিবে ইলমের মাজমা। এখানে দু’টি ফারীক ও শ্রেণী রয়েছে। মুআল্লিমীনের ফারীক এবং মুতা‘আল্লিমীনের ফারীক। যারা শিক্ষক তারা পুরোনো তালিবে ইলম, যারা শিক্ষার্থী তারা নতুন তালিবে ইলম, কিন্তু সবাই তালিবে ইলম। তালিবে ইলম যদি ইলমের দৌলত হাছিল করতে চায় তাহলে তার প্রথম কর্তব্য হলো সর্বপ্রকার গোনাহ ছেড়ে দেয়া। কারণ গোনাহের কালো কালো দাগ দ্বারা কলব যখন দাগদার হয়ে যায় তখন ঐ কলবে ইলমের নূর কিছুতেই আসতে পারে না।’ এ প্রসঙ্গে হুযূর ইমাম শাফেয়ী রহ-এর কবিতাপংক্তি-
شكوت إلى وكيع سوء حفظي + فأرشدني إلى ترك المعاصي
তাঁর দরদভরা কণ্ঠে আবৃত্তি করলেন, তারপর এভাবে তরজমা করলেন, আমি আমার উস্তায ওয়াকী’ এর কাছে আমার হিফযশক্তির দুর্বলতার অনুযোগ করলাম। কিতাব পড়ি, হাদীছ শুনি, কিন্তু মনে থাকে না; যা পড়ি ভুলে যাই।
তখন আমার সেণহশীল উস্তায আমাকে গোনাহ ছেড়ে দেয়ার নছীহত করলেন। কারণ ইলম হচ্ছে আল্লাহর বিশেষ নূর, আর আল্লাহর কোন গোনাহগারকে দান করা হয় না।’
কথা বলতে প্রথমে তো খুব কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু আল্লাহর নেক বান্দাদের ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়, এখানেও তাই হলো। রূহের শক্তি যেন জিসমের দুর্বলতার উপর ধীরে ধীরে জয়ী হলো। যতক্ষণ বয়ান করলেন পুরা জোশের সঙ্গে করলেন। নতুন কিছু বলেননি। তাঁর যবানেই অনেকবার শুনেছি, তবে আজকের ‘কায়ফ ও সুরূর’ এবং ভাব ও আনন্দ ছিলো অন্যরকম। প্রতিটি শব্দ যেন কলবের গভীর থেকে বের হয়ে আসছে এবং কলবের গভীরে গিয়ে প্রবেশ করছে। দিলের মধ্যে এখনো যেন তার আছর তাজা আছে।
শেষে বললেন, ‘সৃষ্টির সময় থেকে এই যমিনের প্রতিটি যাররা ও কণায় লেখা ছিলো, এখানে মারকাযুদ্-দাওয়া হবে, ঐখানে মাদরাসাতুল মাদীনাহ হবে। আমাদের তো কল্পনায়ও ছিলো না। আল্লাহ তা‘আলা নিজের কুদরতে সব করেছেন। আল্লাহ যেন তা-কিয়ামত কবুল করেন।’
এরপর হুযূর বললেন, ‘এখন আমি মাদরাসাতুল মাদীনাহর জমি দেখতে যাবো।’
আমার তো খুশী হওয়ার কথা, কিন্তু হুযূরের কষ্টের কথা ভেবে অস্থির হলাম। মাওলানা আব্দুল মালিককে বললাম, হুযূরকে বলি, কষ্ট না করে এখান থেকেই দু‘আ করে দিন।
তিনি বললেন, ‘না যেতে পারলে তো হুযূরের আরো কষ্ট হবে।’
আর কী বলবো! আল্লাহর হাওয়ালা করে দিলাম।
বয়ানের একেবারে শেষে হুযূর এমন একটি কথা বললেন যে, মনে হলো, যমিনটা যদি ফাঁক হয়ে যেতো! আশ্চর্য, এত দিন কিছু বলেননি, আজ বললেন এবং ভরা মজমায় স্পষ্ট ভাষায়! বললেন, ‘আদীব ছাহেব আমাকে না জানিয়েই জমি খরিদ করেছেন, তবে আমি খুশী হয়েছি; আল্লাহ তা‘আলা মাদরাসাতুল মাদীনাহর জন্য জমির ব্যবস্থা করেছেন।’
ঘটনা এই যে, সুস্থ অবস্থায় হুযূর নিজেই মাদরাসাতুল মাদীনাহর জায়গা সন্ধানে বহু স্থানে গিয়েছেন। কখনো কখনো সারা দিন ঘুরেছেন। মারকায যখন যাত্রাবাড়ী ছিলো, হুযূর রূপনগর গিয়েছিলেন মাদরাসার জায়গা তালাশ করতে। প্রায় সারাদিন ছিলেন। তারপর ডেমরা হয়ে যাত্রাবাড়ী এসে মারকাযে আছর পড়েছেন এবং বিশ্রাম করেছেন। হুযূরের আদেশেই রূপনগরে এবং নবীনগরে কিছু জায়গা নেয়া হয়েছিলো, বিভিন্ন প্রতিকূলতায় যা স্থায়ী হয়নি, তবে হুযূরের দু‘আর বরকতে টাকাটা নষ্ট হয়নি।
ব্যতিক্রম হলো শুধু হযরতপুরে। লম্বা ঘটনা। গত রামাযানে আল্লাহর ঘর থেকে আসার দু’দিন পর মাওলানা আব্দুল মালিক ফোন করে বললেন, জায়গা দেখে রেখেছি, কাল আসুন। আল্লাহর এক বান্দা সঙ্গে থাকবেন। পরদিন সকালে উভয়ে মাদরাসাতুল মাদীনায় এসে আমাকে হযরতপুর নিয়ে গেলেন। জায়গা দেখে বললাম, ‘পছন্দ হয়েছে’। বলতে যা দেরী; আল্লাহর ঐ বান্দা জমির মালিককে ধরে এনে তক্ষুণি লেখাপড়া করে ফেললেন। মাওলানা আব্দুল মালিকের ওছিলায় কীভাবে যেন হযরত মাওলানা মুমিনুল্লাহ ছাহেবও মিলে গেলেন। সাক্ষী হিসাবে তিনি দস্তখত করলেন। মুফতি আব্দুল্লাহ, তার আন্তরিকতার বিনিময় আল্লাহর কাছে, নিজের পক্ষ হতে দশহাজার টাকা মুখবায়না দিয়ে যাকে বলে কথা পাকা করে ফেললেন। চলমান ছায়াছবির মত সবকিছু ঘটে গেলো। আমি যেন একটা আচ্ছন্নতার মধ্যে ছিলাম। বলারও সুযোগ পেলাম না যে, আগে পাহাড়পুরী হুযূরের অনুমতি নিতে হবে।
দুদিন পর হুযূরের খিদমতে হাযির হলাম। সব শুনে খুশী হলেন, দু‘আ দিলেন, আর বললেন, ‘কোন সন্দেহ নাই যে, গায়ব থেকে সাহায্য হয়েছে।’
আজ বুঝলাম, ঐ ত্রুটির কথা হুযূরের যেহেনে আছে। এখন তো আমাদের ছাত্ররা মাশাআল্লাহ ঘর ভাড়া নিয়ে ‘জামিয়া’ তৈয়ার করে ফেলে, খবরও পাই না। তারবিয়াতের নিয়তেও কিছু বলার হিম্মত হয় না। আশঙ্কা হয় যে, ‘বুরা মান জায়েগা’।
আল্লাহর শোকর, শিক্ষকতার শুরু থেকে এখন পর্যন্ত আমার প্রতি আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাযের তারবিয়াতের নযর অব্যাহত রয়েছে। ‘আল্লাহ কি আপনাকে পাল্কীতে করে নেবেন’ এ ঘটনা তো বিভিন্ন উপলক্ষে অনেকবার বলেছি। নূরিয়ার শুরুর জীবনে একবার একজনের সঙ্গে মন্দ আচরণ হলো। হুযূর কঠোর ভাষায় তিরস্কার করলেন। তারপর বললেন, আমার কথা খারাপ লাগছে? আমি আরয করলাম, ‘হুযূর, এ তো আমার সৌভাগ্য। নিজের সৌভাগ্য কি খারাপ লাগে!’
আশা করি, অধম ছাত্রের প্রতি হুযূরের তারবিয়াতি নযর তা-হায়াত অব্যাহত থাকবে। আমি তো হুযূরের কাছ থেকে সে ওয়াদা নিয়ে রেখেছি এবং একবার নয়, অনেক বার। এমনকি আমার ছাত্রদেরও বলে রেখেছি, ‘আমার কোন ত্রুটি নযরে পড়লে তোমরা আমানতদারির সঙ্গে হুযূরের কাছে পৌঁছে দিয়ো। ইনশাআল্লাহ তিনি মুনাসিব মত আমার ইছলাহ করবেন। কারণ আমার সঙ্গে হুযূরের ওয়াদা রয়েছে যে, তিনি আমার ইছলাহ করবেন। আমি যদি গ্রহণ না করি, তিনি দায়মুক্ত, কিন্তু যদি সতর্ক না করেন তাহলে আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবেন।’
এটা অনেক আগের কথা। সেই নূরিয়ার আমলের কথা, যখন খুব সাহস ছিলো, অনেক কথা বলতাম, বলতে পারতাম। এখন খুব ভয় করে, যদি বে-আদবি হয়!
তো আল্লাহর শোকর, হুযূর আমাকে তামবীহ করেছেন! আল্লাহর কসম, ছাত্রের জন্য এর চেয়ে সৌভাগ্যের আর কিছু নেই।
বয়ানের পর দস্তরখান বিছানো হলো। হুযূর এক দু’লোকমা খেলেন। এখন তাঁর খাবার ঐ রকমই। যেন অষুধ খেতে হবে বলে খাবার গ্রহণ করা।
চা তৈরী হলো, দুধ চা এবং সেকারিনের কড়া মিষ্টি। যখন ডায়াবেটিস ছিলো না, তখন চিনি ছিলো কয়েক চামচ। এদিকে আমার চা হলো শুধু চা।
হুযূর অর্ধেক পান করে বাকিটা আমাকে দিলেন। প্রাপ্য ছাড়াই এটা আমার সবসময়ের প্রাপ্তি। এটা যে কত বড় সৌভাগ্যের, এখন সে অনুভূতিও নেই। আমাকে চায়ের কথা বলা হলো; না করলাম। ইচ্ছে হলো না, তাবাররুকের স্বাদ নষ্ট করার।
দশমিনিট বিশ্রাম করে হুযূর রওয়ানা হলেন। দীর্ঘ পথ হেঁটে গাড়ীতে উঠলেন। আমাকে সঙ্গে বসার জন্য ডাকলেন। ভাই শাহজালালের কথা ভাবলাম। তার সঙ্গে এসেছি, তার সঙ্গ ত্যাগ করাটা কেমন হবে? এ দ্বিধা মুহূর্তের জন্য। উঠে হুযূরের পাশে বসলাম। তাকে বললাম পিছনে পিছনে আসতে, আর বললাম, ‘হুযূরের সঙ্গ ও ছোহবতের বরকত ইনশাআল্লাহ আপনিও পাবেন।’
বড় রাস্তাটা মারকায থেকে উত্তরে। সেই রাস্তা ধরে পশ্চিমে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে মাদরাসাতুল মাদীনাহর জমি। প্রায় পুরোটা পথই কাঁচা। আশা করা যায়, পাকা হবে। জমির সামনে গিয়ে হুযূর গাড়ী থেকে নামলেন। খুঁটির সীমা দেয়া আছে। জমির অবস্থান দেখে খুব, খুব খুশী হলেন। মুনাজাত করলেন। সে মুনাজাত আমার অন্তরে সুখের কী যে কম্পন সৃষ্টি করলো! নিজেকে মনে হলো পৃথিবীর সবচে’ সুখী, সবচে’ নিরাপদ মানুষ। মুনাজাতে আমার হুযূর আল্লাহকে বললেন, ‘হে আল্লাহ! আবু তাহের মিছবাহ সেই বাচ্চা বয়স থেকে আমার সঙ্গে আছে। আপনে তাকে ‘দেইখা শুইনা’ রাখেন। তার মাদরাসাকে কবুল করেন। এই জায়গার মধ্যে বরকত দান করেন। আরো যে পরিমাণ জায়গা দরকার, আপনি গায়ব থেকে তার ইন্তিযাম করেন। আপনি তার সমস্ত জরুরত পুরা করে দেন। ...’
হঠাৎ কী হলো! আমি যেন আমার আববার ছায়া দেখতে পেলাম! আমি যেন তাঁর কণ্ঠের ‘আমীন’ শুনতে পেলাম!
হুযূর তাঁর এমন শারীরিক ‘কষ্ট’ সত্ত্বেও মাদরাসাতুল মাদীনাহর জমিতে তাশরীফ এনেছেন, এটা যে আমার জন্য কত বড় শক্তি ও সান্তনা! কত বড় সাহস ও প্রেরণা!
আমার প্রতি মাওলানা আব্দুল মালিকের ইহসান দিন দিন বেড়েই চলেছে। মূলত তার উছিলাতেই আজ এত বড় প্রাপ্তি।
মাদরাসার জমিতে যে ভাই ধনেপাতা চাষ করেছেন, ঘটনা- ক্রমে তিনি সেখানে ছিলেন। আমার চিন্তায়ও আসেনি, মাওলানা আব্দুল মালিক হুযুরের জন্য কিছু ধনেপাতা তুলে আনার ব্যবস্থা করলেন। ধনেপাতার সুন্দর ঘ্রাণ ছিলো। হুযূর খুব খুশী হলেন। মাওলানা আব্দুল মালিক, তাঁর মা-বাবা, সন্তান ও ভাইবেরাদর সবাইকে আল্লাহ আপন শান মোতাবেক আজর দান করুন, আমীন।
একটু দূরে একঝাঁক সাদা বক বা কবুতর একসঙ্গে উড়াল দিচ্ছে, আবার একসঙ্গে জমিতে নেমে আসছে। আকাশের সাদা মেঘগুলো যেন কবুতর হয়ে ডানা মেলে নীচে নেমে এসেছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। কে জানে, আকাশ থেকে নেমে আসা এই শুভ্র বলাকা আকাশের কোন বার্তা কি না!
গাড়ী ফিরতি পথে রওয়ানা হলো। পথের পাশে একটি জমিতে যেন ফুল বিছিয়ে রাখা হয়েছে! হুযূর জিজ্ঞাসা করলেন, এগুলো কিসের ফুল! বলা হলো ধনেপাতার ফুল। আমারও জানা ছিলো না। আমি জানতাম, ধনেপাতা মানে শুধু ধনেপাতা। তাতে যে ফুল আসে, দানা হয়, আর সেই দানাই যে সুপরিচিত ধনে মশলা, সেটা ধারণায় ছিলো না। গ্রামবাংলার সঙ্গে আমাদের অপরিচয় কী বেদনাদায়ক পর্যায়ের!
***
মারকায বরাবর বড় রাস্তায় এসে গাড়ী থামলো। হুযূর এখন তার প্রিয় প্রতিষ্ঠান মারকাযে ইলমীতে যাবেন। গাড়ীতে এক ঘণ্টার কম সময়ের পথ। মাওলানা আব্দুল মালিক বললেন, তিনি হুযুরের সঙ্গে যাবেন। আমার নিয়ত ছিলো না, জানাও ছিলো না। দ্বিধায় পড়ে গেলাম। কী করা কর্তব্য! ভাই শাহ জালালকে একা ছেড়ে দেয়া কেমন হয়! আবার এমন সৌভাগ্য থেকে বঞ্চিত হওয়া, তাও কি উচিত!
হুযূর বললেন, আপনারা আর কষ্ট করবেন কেন? নিজ নিজ কাজে যান। মাওলানা আব্দুল মালেক অবিচল কণ্ঠে বললেন, আপনার সঙ্গে থাকাই এখন আমার কাজ।’
মানুষটা কত ভালো! তার কণ্ঠের অবিচলতায় আমি দ্বিধামুক্ত হলাম। ভাই শাহ জালালকে বললাম, অসুবিধা না হলে সঙ্গে চলুন, নচেৎ...। তিনি আমার কথা ভেবে দ্বিধান্বিত হলেন। মাওলানা আব্দুল মালিক বুঝতে পেরে বললেন, হুযূরকে মাদরাসায় পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব আমার। তিনি আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলেন। আমিও নির্ভার হলাম।
গাড়ী রওয়ানা হলো। ইটাভাড়া পোলের গোড়ায় এসে হুযূরের গাড়ী হেমায়েতপুরের দিকে মোড় নিলো, ভাই শাহজালাল বছিলার দিকে চলে গেলেন।
কত বড় ভুল হতো যদি এখানে আমার পথ আলাদা হয়ে যেতো! এখানেও মাওলানা আব্দুল মালিকের প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তা আমার সহায় হলো। এজন্য বারবার তাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম।
***
পথের পাশে ফসলের জমিগুলো বড় সুন্দর ছিলো। ধনেপাতার ঘ্রাণ ছিলো মনকে প্রফুল্লকারী। মাঝে ইটের ভাটা, আর চিমনির ধোঁয়া পরিবেশের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। ফসল ও শস্য হলো জীবনের প্রয়োজন; তাই তার সৌন্দর্যে চোখ জুড়য়! ইটের ভাটা হলো নগরসভ্যতার প্রয়োজন তাই তার চিমনির ধোঁয়ায় পিরবেশ কলুষিত হয়। সিঙ্গাইরে ধলেশ্বরির উপরে যে পোলটি, হুযূর যখন মারকাযে ইলমির জন্য জমি খরিদ করেন, ছিলো না। নৌকায় ধলেশ্বরি পার হয়ে যেতে হতো। হুযূর কীভাবে কত পানি-কাঁদা পার হয়ে যেতেন, আগেও বলেছেন, আজও বললেন। পোল পার হয়েই হাতের ডানে কাঁচা রাস্তা। আগে হুযূর তাঁর একটি স্বপ্নের কথা বলেছিলেন, আজ জায়গাটি দেখালেন। কাঁচা রাস্তায় নামার মুখে বামদিকের কোণের জমিতে মসজিদ দেখেছেন। স্বপ্নে সেই মসজিদে সারারাত ইবাদত করেছেন। হুযূর যখন জায়গাটা দেখিয়ে আবার স্বপ্নটা বললেন, তখন আমার মনের অবস্থা কী যে হলো! স্বপ্নের হাকীকত কী? স্বপ্নে যা দেখি, কেন দেখি? হুযূর এখানে স্বপ্নে মসজিদ দেখেছেন, বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি না। কেন? নেই, এজন্য; নাকি চোখে পর্দা আছে, এজন্য?! হুযূর এখন স্বপ্ন দেখছেন, সেই মসজিদটি এখানে তৈরী করবেন।
কাঁচা রাস্তাটি বেশ প্রশস্ত করে তৈরী হচ্ছে। হয়ত অচিরেই পাকা হয়ে যাবে। বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর পথের দু’দিকের জমিতে কী যেন গাছের বাগান। মাঝখান দিয়ে রাস্তাটি গেছে। বেশ সুন্দর। এখানে এসে হুযূর বললেন, এলাকাটির নাম ছিলো ফোর্টনগর, আমি নাম দিয়েছি, নূর নগর। প্রশাসনের লোকেরা নাকি মাদরাসার কাগজপত্রে নামটা দেখে চমৎকৃত হয়েছে এবং বেসরকারীভাবে হলেও তা গ্রহণ করেছে। আসলে আমরা অনেক কিছু করতে পারি, আল্লাহ আমাদের শক্তি দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহপ্রদত্ত সেই শক্তি সম্পর্কে আমরা বে-খবর। মাঝে মধ্যে জোশ আসে, মউজ আসে, তারপর থেমে যায়, সবকিছু আগের মত হয়ে যায়। এজন্যই যে ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়’ শহীদানের পাক লহু ঝরলো সেই পাক যমিনের ‘শহীদবাড়িয়া’ নামটি আমরা মানুষের মুখে, এমনকি নিজেদের মুখেও তুলে আনতে পারলাম না।
হুযূরের প্রতিষ্ঠানের নাম আলমারকাযুল ইলমী, যার বিভিন্ন লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের একটি হলো সমগ্র বাংলাদেশে কোরআনি মকতব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুসলিম সন্তানদের কোরআনী শিক্ষা দান করা। বড় হয়ে তারা শিক্ষা গ্রহণ করুক, বা না করুক, এবং যে শিক্ষাই গ্রহণ করুক, কোরআনের প্রাথমিক শিক্ষা হতে যেন কোন মুসলিম শিশু বঞ্চিত না থাকে। এ মহান উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য হাজার হাজার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মু‘আল্লিম দরকার। তো মারকাযে ইলমীর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের উপর গবেষণা করা এবং বাস্তব প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য এখানে দারুল কোরআন নামে মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, হিন্দুস্তানে লৌখনো শহরে যেমন নাদওয়াতুল উলামা-এর চিন্তাধারা বাস্তবায়নের জন্য দারুল উলুম প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
মাদরাসার কাছাকাছি এসে হুযূর সেই জায়গাটি দেখালেন যেখানে স্বপ্নযোগে হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.কে জাহাযে করে তাশরীফ আনতে দেখেছেন এবং জাহাযে অনেক যাত্রী ছিলো। আমরা মুগ্ধবিস্ময়ে অনেক বারের মত আবার শুনলাম সেই বরকতপূর্ণ খাবের বয়ান। পার্থক্য এই যে, আজ স্বপ্নের স্থানটিও দেখা হলো।
***
মাদরাসার সামনে গাড়ি থামলো। পাঁচ ছয় বছর আগে একবার এসেছিলাম। উপলক্ষ ছিলো শাভারে মাদরাসাতুল মাদীনার জন্য জায়গা দেখা। হুযূর শুনে খুশী হয়েছিলেন। আজ এসেছি হুযূরের সঙ্গে। সন্তানকে কাছে পেয়ে মায়ের আনন্দ যেমন, হুযূরের আনন্দে ছিলো যেন তারই ছায়া। সে আনন্দের প্রকাশ ছিলো দেখার এবং দেখে শেখার মত।
ছয় সাত বছরে মাশাআল্লাহ অনেক পরিবর্তন। এখনো বিদ্যুৎ আসেনি। এখনো এখানে মোমের আলো জ্বলে। কিন্তু কোরআনি শিক্ষার যে আলো, সবকিছুতে যেন তার উদ্ভাস। এমনকি যাদের দৃষ্টি স্থূল তারাও তা অনুভব করতে পারে।
একটি টিনের ঘর, এত সাধারণ যে, মনে হয়, এ যুগের নয়, পূর্বযুগের। পাকা যে মসজিদঘর, তাতেও যেন প্রাচীন যুগের ছাপ। সবকিছুতে যেন ঝলমল করছে প্রাচীনতার আলো। ছয়তলার বুনিয়াদ দিয়ে যে ভবনটি আংশিকভাবে তোলা হচ্ছে তার খুঁটিগুলো শুধু উঠেছে। সেখানে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম, মনে হলো, একটি আওয়ায কানে এলো, ‘আমাকে দেখো, দেখে বুঝতে চেষ্টা করো, তোমার প্রিয় উস্তায তিলে তিলে নিজেকে ক্ষয় করে কীভাবে আমাকে গড়ে তুলছেন! তুমি না বলো, তোমার হুযূরকে ভালোবাসো। কোথায় তোমার ভালোবাসা?! আমাকে তাহলে কেন ভালোবাসো না! তোমার কিছু ঘাম, কিছু শ্রম কেন আমি পাই না!
শোনো, সত্যি যদি তুমি তাঁর দু‘আ ও সন্তুষ্টি চাও তাহলে আমাকে গড়ে তোলার জন্য তাঁর পাশে দাঁড়াও।
***
আছরের আযান হলো। আশ্চর্য মসজিদ! আধুনিক যুগের ইট-সিমেন্ট-রড দিয়েই তৈরী, কিন্তু আধুনিকতার চিহ্নপর্যন্ত নেই! হুযূর বললেন, ‘মেহরাবটি আগে টিনের ছিলো, পরে পাকা হয়েছে। আমার অবশ্য দেখার সুযোগ হয়নি, আজই প্রথম দেখলাম।’
এযুগের মসজিদে সেযুগের প্রশান্তি অনুভব করার এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। তার উপর হুযূর আদেশ করলেন নামায পড়াতে। আমার জন্য এটা কি পরীক্ষা, না সৌভাগ্য! এখানেও আমি এক দুর্লভ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম। হুযূরের আদেশে যখনই ইমাম হয়েছি, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না এমন একটা ভীতি ও শঙ্কা অনুভব করেছি। হুযূরের আদেশ পালন করেছি, তবে ভয় ও শঙ্কার মধ্যে। আজ হলো ব্যতিক্রম এবং সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। অন্তরে আজ পূর্ণ প্রশান্তি ছিলো। মেহরাব থেকে একটি আলোক-ছটা যেন অন্তরে প্রবেশ করছে। ...
নামায শেষে ইচ্ছে হচ্ছিলো, আরো কিছু সময় ইমামের মুছল্লায় বসে থাকি। এমন সৌভাগ্য আর হয়, কি না হয়! কিন্তু সাহস হলো না। মুছল্লা থেকে সরে এলাম এবং মনে হলো ভালোই করলাম। হুযূর মুনাজাত করলেন। আমি শুধু সেই মুনাজাত দেখলাম, আর বললাম, হে আল্লাহ, বাইরে শান্ত, ভিতরে ঝড়, এমন মুনাজাতের সৌভাগ্য তুমি আমাকেও দিয়ো।
***
মাদরাসার শিক্ষক, যিনি সপরিবারে এখানে থাকেন এবং মোমের আলোতেই জীবন যাপন করেন। তিনি গাছের পেপে হাযির করলেন। এত সুন্দর করে কাটা হয়েছে, যেন একটি দিলের কতগুলো টুকরো। মাওলানা আব্দুল মালেক অনেক ক্ষেত্রে আমার চেয়ে এগিয়ে আছেন। এক্ষেত্রেও এগিয়ে থাকেন, আজও এগিয়েই থাকলেন। আমি খেলাম একটি টুকরোর কিছু অংশ, আর তিনি ...।
মাদরাসার তখন বিরতি। টিনের ঘরটি বন্ধ ছিলো। খোলার ব্যবস্থা ছিলো না। আশ্চর্য, হুযূর যেন পেরেশান হলেন, তার অধম শিষ্যদু’টিকে কোথায় বসাবেন! এত দিন ভাবতাম অধম শিষ্য, নিজেকে আজ মনে হলো অপদার্থ শিষ্য, যখন হুযূর বললেন, আপনি তো জানেন, শুরু থেকে সবকিছু আপনার নযরে আছে, কিভাবে ‘তিনশ তের’-এর চিন্তা আল্লাহ দান করলেন। তারপর কিভাবে কাতরা কাতরা করে পাত্র পূর্ণ করা হয়েছে। প্রতিটি কাতরা ছিলো আমার খুন পাসিনা...।
হুযূরের কথায় ‘পানি পানি’ হয়ে গেলাম। কারণ আমি জানি, সেই খুন-পাসিনায় আমার ‘কাতরা’ কত কম! তবু হুযূর বললেন এমনভাবে, যেন এই দুর্গম পথে আমি ছিলাম তাঁর হামসফর। হে আল্লাহ, অন্তত সামনের জীবনে তুমি তাওফীক দান করো।
ভিত্তির উপর শুধু খুঁটিগুলো উঠেছে যে ভবনটি, হুযূর সেখানে গেলেন। আমি সামান্য সময়ের জন্য আমার প্রয়োজনে গেলাম। এর মধ্যেই হুযূর তালাশ করলেন। ফিরে এসে দেখি, দুধের পেয়ালায় হুযূর আমার ‘নাছীব’ রেখে দিয়েছেন! হে আকাশ, তোমার নীলিমার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা!
বিদায়ের আগে হুযূর মুনাজাত করলেন! জারজার হয়ে কাঁদলেন, চোখ থেকে ঝরঝর করে অশ্রু ঝরলো। যা দেখতে পেলাম তা বললাম, যা দেখতে পাইনি তা কিছুটা অনুভব করলাম। সেই অনুভব শব্দে প্রকাশ করলে বলতে হয়, তা ছিলো অবুঝ শিশুর অবুঝ কান্না, আর শেষে ছিলো প্রাপ্তির হাসি-উদ্ভাস।
মুনাজাতে তিনি তাঁর রক্ত-বন্ধনের কথা বলেননি, বলেছেন আত্মার বন্ধনের কথা। তিনি বলেছেন, হে আল্লাহ! আমি আজ আদীব ছাহেবকে এবং মাওলানা আব্দুল মালেককে সঙ্গে এনেছি। আমার এখন খুশির সীমা নাই। হে আল্লাহ, তুমি তাদের অন্তরে এই মাদরাসার মুহববত ঢেলে দাও। আমার সমস্ত যিম্মাদারি তাদেরকে আদায় করার তাওফীক দাও। ...
আমি আমিন, আমীন বলেছি, আর ফিরে ফিরে তাকিয়েছি সেই খুঁটিগুলোর দিকে। একটু আগে এই ইটপাথর থেকেও আমি শুনেছি এ কান্না, এ আকুতি! আসলে তার হৃদয়ের কান্না ও আকুতি এখানে মিশে আছে প্রতিটি ইটপাথরের সঙ্গে।
মাদরাসার শিক্ষক তার চার মাসের শিশুপুত্রকে হুযূরের কাছে আনলেন। দু‘আ চাইতে গিয়ে যা বললেন তাতে আমি...। তিনি বললেন, ‘তিন তিনটি মেয়ের পর এই ছেলেটি হয়েছে।’
ছেলে হোক, মেয়ে হোক, এমন ছোট্ট মানবশিশু যখন দেখি, ভিতরটা কেঁদে ওঠে। পৃথিবী এখন এত নিষ্ঠুর যে, ফুলের মত শিশুদের জন্য তা আর বাস-উপযোগী নয়। জানি না, এই শিশুদের ভবিষ্যৎ কী? কীভাবে এরা বড় হবে, মানুষ হবে? কত নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতা, কত নগ্নতা ও অশ্লীলতা এদের দেখতে হবে কে জানে! এদের জীবনে, চরিত্রে সেগুলোর কী প্রভাব পড়বে? আমাকেও দু‘আর জন্য বলা হলো, আমি দু‘আ করলাম, আল্লাহ যেন এই শিশুটিকে এবং পৃথিবীর সব শিশুকে নিরাপত্তা ও সৌন্দর্য দান করেন, পাশবিকতা ও অশ্লীলতার ছায়া থেকেও যেন তারা দূরে থাকে।
***
হুযূর গাড়ীতে উঠলেন। সামনে চালকের পাশের আসনে বসলেন। চালক তাঁরই সুযোগ্য পুত্র, আমাদের স্নেহের ছাত্র মাওলানা আবরারুয্যামান। সুন্দর ও নিখুঁত তার গাড়ী চালনা। গাড়ী চালায় অনেকে, চালনা করে দু’একজন। যারা চালায় তারা যাত্রীদের কথা ভাবে না; ভাবে শুধু গন্তব্য। যারা গাড়ী চালনা করে, যাত্রী ও গন্তব্য দু’টোই থাকে তাদের চিন্তায়। এখানে অবশ্য যাত্রীর সঙ্গে চালকের রক্তের টান আছে। কিছুদিন আগে একচালককে দেখেছি। জান বাজি রেখে তিনি যাত্রিদের জান বাঁচিয়েছেন।
হুযূর নিজেও আবরারের গাড়ী চালনার প্রশংসা করলেন। বললেন, হাফেজ্জী হুযূর রহ. গাড়ীর চালককে রহস্য করে ‘প্রেসিডেন্ট’ বলতেন। ‘প্রেসিডেন্ট ইলেকশন’ উপলক্ষে যখন দেশব্যাপী সফর করেছেন তখন দস্তরখানে আগে চালকের খোঁজ নিতেন, আর বলতেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট কই? আগে তার খাওয়ার ইনতেযাম করো।
আসলেই তো! গাড়ীর চালক এবং দেশের চালকের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? অনেকেই দেশ চালায়, কিন্তু দেশকে চালনা করে ক’জন? যারা দেশ চালায় তারা শুধু গন্তব্যের চিন্তা করে, আর তাদের গন্তব্য হলো পরবর্তী নির্বাচন। যারা দেশ চালনা করে তারা চিন্তা করে শুধু এবং শুধু মানুষের ভাগ্য ও সৌভাগ্যের কথা। তারা নিজেদের কথা চিন্তা করে না, এমনকি চিন্তা করে না মানুষের ভালোবাসা ও ঘৃণারও কথা।
মাদরাসা থেকে বড় রাস্তা পর্যন্ত পথটা ছিলো কাঁচা ও উঁচু-নীচু। কিন্তু ‘প্রেসিডেন্ট’ সাহেব এমনভাবে চালনা করলেন যে, বলতে গেলে কোন কষ্টই হলো না। বড় রাস্তায় এসে অবশ্য গাড়ীকে তিনি সাবলীল গতি দান করলেন। কারণ সামনে মাগরিব!
হুযূরের খাদেমরা, পরামর্শ করে দেখলেন, বৈলারপুর গিয়ে মাগরিব পড়া যায়।
***
বৈলারপুর নামটি শুনে মনে পড়ে গেলো প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। তখন মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব ছিলেন এই মাদরাসার মুহতামিম। ছাত্রদের পরীক্ষা নিতে তাঁর অনুরোধে আসা হয়েছিলো। মাওলানা আব্দুল মালিক সাহেবকে অনুচ্চ কণ্ঠে বললাম সে কথা। তিনি রহস্য করে বললেন, ‘অনুরোধের সফর’ তাহলে তখনো করতেন? আমি বললাম, আসলে তখন শুধু এজন্য এসেছিলাম যে, তিনি যেন মনে না করেন, এখন তিনি নূরিয়ার যিম্মাদার নন বলে তার অনুরোধের...। তিনি যেন বুঝতে পারেন, আমার কাছে এখনো তিনি বড়।
আমি আরো বললাম, একারণেই এত কিছুর পরও নূরিয়ার যিম্মাদারদের ছেলেরা আমার কাছে পড়েছে, এখনো পড়ছে। এটা আমার জীবনের উছূল যে, প্রতিটি জিনিসকে নিজস্ব সীমায় রাখতে চেষ্টা করি।
আমার অনুচ্চ কণ্ঠের কথা যে হুযূর শুনেছেন তা বোঝা গেলো পরে।
আমাদের পৌঁছতে কিছুটা বিলম্ব হলো, কিন্তু মসজিদে হুযূরের ইনতিযার হচ্ছিলো। হুযূর খুব ক্লান্ত ছিলেন। নামায শেষে তিনি মাদরাসার দফতরে গেলেন।
মসজিদের সামনে দেখি একটি পাকা কবর। আগে ছিলো না। প্রতিদিন নতুন নতুন কত কবর তৈরী হয়! আমারও আছে একটি কবর। সেই কবর প্রতিদিন আমাকে ডাকে; সে ডাক আমি শুনতে পাই না। কারণ আমি ডুবে আছি জীবনের শোরগোলের মধ্যে।
পূর্বদিকে একটু খালি জায়গা। নির্জনতা ও আলো-অাঁধারি ছিলো। সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছি শাভার ও ঢাকার দিকে ছুটে চলা গাড়ীগুলো। হেড লাইটের আলো বেশ লাগছে। তীব্র আলো, কিন্তু দেখতে দেখতে হারিয়ে যায়। নতুন আলো আসে আবার চলে যায়। এ আলোর তীব্রতা আছে, স্থায়িত্ব নেই। অথচ ঐ যে দূরের বাড়ীঘরের আলো! তীব্রতা নেই, কিন্তু স্থির। এ আলোতে সবকিছু চেনা যায়, সব কিছু বোঝা যায়। তবু আমাদের মোহ চোখধাঁধানো আলোর প্রতি।
হঠাৎ দেখি, একটি দু’টি ছাত্র, ছোট্ট বয়সের, যেন অনেক সঙ্কোচ কাটিয়ে কাছে আসতে চায়। আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম। এতেই যেন ওরা কৃতার্থ। সালাম দিলো, মুছাফা করলো। কণ্ঠস্বরে নিষ্পাপতা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। কোমল হাতের স্পর্শের পবিত্রতা যেন অন্তরের গভীরে প্রবেশ করছে।
এরপর এমন হলো যে, ছোট ছোট অনেক ফুল যেন আমাকে বেষ্টন করলো। এরকম ক্ষেত্রে আমি বিব্রত হই, আজ কিন্তু মনে হলো, ‘এরা ছোট, এরা নিষ্পাপ। এদের সান্নিধ্যে পবিত্রতা আছে, এদের স্পর্শে সুবাস আছে। গ্রহণ করো এবং পবিত্র হও।’
একসময় আমিও ছিলাম এমন ছোট্ট শিশু। অবাক হয়ে দূর থেকে দেখতাম কোন বড় মানুষকে। ইচ্ছে হতো কাছে যাই। কখনো সুযোগ হতো, কখনো হতো না। কেউ যদি চিবুক ধরে একটু আদর দিতো, নিজেকে ধন্য মনে হতো। আসলে একটি শিশুর জীবনে এর অনেক মূল্য আছে। মনে পড়ে, আমার শৈশবে হযরত মাওলানা ক্কারী তৈয়ব ছাহেব রহ. এসেছিলেন লালবাগ মাদরাসায়। ইচ্ছে হচ্ছিলো, কাছে যাই, সালাম করি, হাতটা স্পর্শ করে দেখি। সুযোগ হয়নি। তখন খুব কান্না পেয়েছিলো।
সময়ের কারসাজিতে এখন আমরা ‘বড়’। আমাদের চারপাশে কত শিশু-ফুল! নিজের শৈশবের কথা মনে করে, কারো কারো চিবুক ধরে আদর দিলাম। নাম জিজ্ঞাসা করলাম। ওরা খুশী হলো যখন বুঝতে পারলো, মানুষটা তত বড় নয়, অনেকটা আমাদেরই মত।
মাদরাসার দফতরে এসে বসলাম। কিছুক্ষণ পর মাওলানা আব্দুল মালিক এলেন। তিনিও ছোট ছোট তালিবানে ইলমের বেষ্টনে ছিলেন। আমার কথা শুনে বললেন, ‘আমার নাপাকি তো বেশী তাই পাকছাফ হতে সময় বেশী লাগলো।’
যাকগে, এসব কথার কোন জবাব হয় না; তার চেয়ে নাস্তা করা ভালো।
বেশ তোড়জোড় করে দস্তরখান বিছানো হলো। অনেক কিছু আনা হলো। হুযূর গাড়ীর চালকের খোঁজ নিলেন এবং চালক শব্দটি ব্যবহার করেই। অর্থাৎ খোঁজ নেয়াটা সন্তান হিসাবে নয়, গাড়ীর চালক হিসাবে। আমার শিক্ষার জন্য বিষয়টি আবার চুপি চুপি আমাকে বললেনও। এগুলো এমন শিক্ষা যা কোন কিতাবে পাওয়া যায় না, কোন বয়ানেও পাওয়া যায় না; এগুলো পাওয়া যায় শুধু মানুষের মত মানুষের ছোহবত ও সংস্পর্শে।
***
শিক্ষকদের অনেকেই নূরিয়ার ছাত্র। হুযূর তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, মরহূম মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেব কোথায় বসতেন, তার বিশ্রামের কামরা কোনটি? তালিবানে ইলমের খোঁজখবরও নিলেন।
হঠাৎ হুযূর আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি যে মরহূম মাওলানা হামীদুল্লাহ ছাহেবের অনুরোধে এখানে এসেছিলেন, ভালো করেছিলেন। জাযাকাল্লাহু খায়রান।
হুযূর একটুকরো আপেল খেয়ে আমাকে দিলেন। আবার মনে পড়লো সেই কথা, ‘উস্তাযের হাত থেকে আমরা যে ফল গ্রহণ করি, কারো জন্য তা হয় শুধু গাছের ফল, কারো জন্য হয় জীবনের ফল।’ তেমন সৌভাগ্যই যেন আল্লাহ আমাদের দান করেন।
চা তৈরী হলো। হুযূর চায়ের পেয়ালা হাতে নিলেন। বিশ্বাস ছিলো, ঐ পেয়ালায় আছে আমার ‘নাছীব’, তাই অন্য পেয়ালা নিলাম না। তা-ই হলো; হুযূর জিজ্ঞাসা করলেন, ‘স্যাকারিনের চায়ে কষ্ট হবে?’
শোনো, আমার প্রাণপ্রিয় জানতে চান, জান্নাতের মধুতে আমার...! নির্বাক হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকলাম, আর তিনি মৃদু হেসে পবিত্র ঠোঁটের স্পর্শমাখা কাপটি আমার হাতে দিলেন। আলহামদু লিল্লাহ!
অসুস্থতার পর হুযূরকে যত বার দেখেছি, আজকের মত সতেজ ও প্রফুল্ল দেখিনি। ভিতরের আনন্দ বাইরের কষ্টকে কীভাবে ছাপিয়ে যায়, আজকের মত এমন করে আর বুঝিনি। আমরা যারা তাঁর ছাত্র এবং মুহববতের দাবিদার, আমাদের কর্তব্য দৈহিক শান্তির সঙ্গে তাঁর আত্মিক প্রশান্তির ব্যবস্থা করা, যা আমাদের দ্বারা বলতে গেলে কিছুই হয় না। কখনো কখনো মনে হয়, দুনিয়ার নামে হোক, বা দ্বীনের নামে, আমরা নিজেদের নিয়ে অনেক বেশী ব্যস্ত। আমাদের সঙ্গে যদি পরবর্তী প্রজন্মের একই আচরণ হয়?!
পরে হুযূরের বড় ছেলে, আমাদের প্রিয় ছাত্র (মাওলানা) আশরাফুয্যামানের কাছে শুনেছি, হুযূর বারবার বলেছেন, ‘সেদিন আমার এত ভালো লাগলো কী জন্য? অসুস্থতার মধ্যেও মনে হচ্ছিলো, সুস্থ সতেজ!
হুযূর এখানেও মুনাজাত করলেন। একদিনে তিনবার হুযূরের সঙ্গে হাত তুলে মুনাজাত, অলহামদু লিল্লাহ! একটি কথা মনে হয়; এখন তাঁর মুনাজাতে যেন হযরত হাফেজ্জী হুযূর রহ.-এর মুনাজাতের ছায়া পড়ে! সেই রকম কাকুতি-মিনতি, সেই রকম কান্না ও চোখের পানি এবং .. এবং সেই রকম আশ্বাস ও প্রশান্তি! বহুদিন আগের হারিয়ে যাওয়া সেই মুনাজাত আবার যেন আমরা ফিরে পেয়েছি। সেই মুনাজাতের সঙ্গে যখন হাত তুলতাম, অন্তরে এ আশ্বাস ও বিশ্বাস জন্ম নিতো যে, আমীন বলো, তোমার দু‘আ কবুল হবে। অন্তরের গভীরে সেই রকম আশ্বাস ও বিশ্বাস এখন এই মুনাজাতের সঙ্গেও অনুভূত হয়। মুনাজাতের কবুলিয়াতের জন্য এ অনুভূতির বড় প্রয়োজন।
***
হুযূর গাড়ীতে উঠলেন। সবার চেহারা বলছে, বিদায় দিতে কষ্ট হচ্ছে। হয়ত ভাবছে, আবার কবে দেখবো? দেখতে পাবো তো?!
গাড়ী রওয়ানা হলো মিরপুরের উদ্দেশ্যে। সামনে থেকে গাড়ী আসছে, পিছন থেকে কিছু গাড়ী অতিক্রম করছে। আমাদের চালকের দৃষ্টি পথের উপর স্থির। আলোর ঝলকানি চালকের দৃষ্টি ধাঁধিয়ে দিতে চায়, তবু তার দৃষ্টি স্থির! অন্ধকারের মধ্যে যেমন সতর্ক থাকতে হয়, তেমনি সতর্ক থাকতে হয় আলোর ঝলকানির মধ্যেও। যে আলো তোমার দৃষ্টিকে পথ চিনে নিতে সাহায্য করে সেটাই সত্যিকারের আলো, যে আলো তোমার দৃষ্টিকে ধাঁধিয়ে দেয় সেটা আলো নয়, আলেয়া। আলো ও আলেয়ার পার্থক্য বোঝার জন্য চাই অন্তর্জ্ঞানী মানুষের ছোহবত ও সংস্পর্শ।
সারা পথ হুযূর নীরব ছিলেন। সেই নীরবতা হৃদয় দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করেছি। অনুভব করতে পেরেছি, বলবো না; তবে এইটুকু বুঝতে পেরেছি যে, অন্তর যাদের জাগ্রত তাঁদের নীরবতার মধ্যে রয়েছে আশ্চর্য এক সজীবতা ও সিণগ্ধতা! নীরবতার এই সজীবতা ও সিণগ্ধতা অনেক আগে একবার অনুভব করেছিলাম কাকরাইল মসজিদের এক নূরানি মজলিসে। টঙ্গী ইজতেমার পরবর্তী সময়ের কথা। আছরের পর হযরতজী মাওলানা ইন‘আমুল হাসান রহ. খোলা চত্বরে একটি চেয়ারে বসে থাকতেন। আল্লাহর নেক বান্দাদের ভিতরের জগতটি অবলোকন করার যোগ্যতা আমাদের কোথায়! বাইরে থেকে দেখেছি প্রশান্ত নীরব। কিন্তু তার মধ্যে কী আশ্চর্য সজীবতা ও সিণগ্ধতা! হাজার হাজার মানুষ খোলা চত্বরে বসে নীরবে তাকিয়ে আছে তাঁর নূরানি চেহারার দিকে। শুধু তাকিয়ে থেকেই যেন মুরদা দিল যিন্দা হয়ে যায়; শুধু আলোর পরশেই ভিতরের অন্ধকার দূর হয়ে যায়। পরপর কয়েকদিন কাকরাইল মসজিদে গিয়েছিলাম শুধু ঐ নীরব মজলিসের নূরানিয়াত হাছিল করার জন্য। আজ পথের শোরগোলের মধ্যে, ছুটে চলা অসংখ্য গাড়ীর আওয়াযের মধ্যে আমার হুযূরের নীরব আত্মসমাহিত রূপটি অবলোকন করে মনে পড়লো সেই নীরব, কিন্তু সজীব ও আলোকিত মজলিসের কথা।
***
গাড়ী থামলো হুযূরের ঘরের দুয়ারে। তিনি নামলেন। তাকে ক্লান্ত মনে হলো না; তবে বিষণ্ণ মনে হলো। বিদায়ের সময় সংযম যেন ভেঙ্গে যায়। ইচ্ছে হলো, ঝাঁপিয়ে পড়ি ঐ বুকের মধ্যে, যার ভিতরে রয়েছে একটি সজীব হৃদয়, যে হৃদয় আমাকে ভালোবাসে, আমার কল্যাণ কামনা করে। কিন্তু হলো না, বুকটার দিকে শুধু তাকিয়ে থাকলাম, আর মুছাফাহা করে অপেক্ষায় থাকলাম ‘আল্লাহর হাওয়ালা’ শোনার জন্য, এবং শুনলাম।
আগের থেকে প্রস্ত্ততি ছিলো না, হঠাৎ কী যে হলো, ভিতর থেকে কে যেন উদ্বুদ্ধ করলো। আমি বললাম, হুযূর, এই সফরের ছোট্ট একটি সফরনামা লেখার ইচ্ছে করছে।
যা আশা ছিলো তাই হলো। বললেন, অবশ্যই লিখবেন। ইনশাআল্লাহ সবার ফায়দা হবে।
হুযূর জোর দিয়ে বললেন, আবরার আপনাদের মারকাযে পৌঁছে দিক। আবরারও উৎসাহের সঙ্গে প্রস্ত্তত। হুযূরের বলার মধ্যে যে মায়া ও মমতা ছিলো তার স্বাদ ও শান্তি অনুভব করে আমরা দু’জন বিগলিত হলাম, কিন্তু তাতে আমরা যে আর ‘আমরা’ থাকি না! তাই বললাম, হুযূর, তাতে তো আমাদের কষ্ট হবে!
তিনি মৃদু হাসলেন; যেন বললেন, আমার ইচ্ছেও সত্য, আপনাদের অনুভবও সত্য।
হুযূর ঘরে গেলেন, আমরা সেই দুয়ার থেকে রওয়ানা হলাম মারকাযের উদ্দেশ্যে।
***
রিকশা নেয়া যেতো, কিন্তু মাওলানা আব্দুল মালিক বললেন, হেঁটে যেতেই ভালো লাগবে। এবং অনেক ভালো লাগলো। এতক্ষণ যেন একটি স্বপ্নের মধ্যে ছিলাম। একটি সুন্দর স্বপ্ন।
এখন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেছি, কিন্তু স্বপ্নের মধুর আবেশ যেন রয়ে গেছে! স্বপ্নের চেয়ে স্বপ্নের আবেশ কম আনন্দের নয়।
দীর্ঘ পথ পার হয়ে কীভাবে মারকাযে এলাম জানি না। পায়ে হাঁটা এই পথটুকুর কথা যদি আলাদা করে বলি, অনেক কিছু বলার আছে। মারকায থেকে হুযূরের ঘর এবং
হুযূরের ঘর থেকে মারকায, এ পথ আমাদের জন্য নতুন নয়, কিন্তু আজ মনে হলো, এ পথ এবং পথের সবকিছু নতুন! কেন এমন মনে হলো?! কেন এমন মনে হয়?! হয়ত
এজন্য যে, আলোর পরশের চোখের দৃষ্টি এখন কিছুটা হলেও আলোকিত! নূরের ছোহবতে দিল সামান্য হলেও নূরান্বিত!
হাবীবুর রহমান, আমাদের প্রিয় হাবীব মারকাযে আমাদের স্বাগত জানালো এবং এশার নামাযের পর চা তৈরী করে খাওয়ালো। এমন স্বাদের চা
এবং এমন চায়ের স্বাদ বহু দিন পর পেলাম। স্বাদ যে কোথায় থাকে সে রহস্য মানুষ আজো উদ্ধার করতে পারেনি।
ইচ্ছে হচ্ছিলো এখানেই পড়ে থাকি, হুযূরের কাছ থেকে আর দূরে না যাই, সকালে আবার দেখা করি, আবার তাঁকে দেখি। ইচ্ছে ছিলো, উপায় ছিলো না। আমার স্ত্রী আগামীকাল ভোরে কুষ্টিয়া যাবেন বড় মেয়েকে
দেখতে। মুহম্মদ নিয়ে যাবে তার মাকে।
সুতরাং উঠতেই হলো। (মাওলানা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছি) প্রিয় আব্দুল মালিককে অনেক অনেক জাযাকাল্লাহ দিয়ে রওয়ানা হলাম মাদরাসাতুল মাদীনাহর উদ্দেশ্যে।
আশ্চর্য, ঢাকা শহরেরও যেন আজ নতুন রূপ! পথের নিত্যসঙ্গী যানজট নেই! যেন শান্তির পথ! শান্তির শহর! ষ