বিলাপঃ বিকারগ্রস- ব্যক্তিদের তৎপরতায় সতর্কতা কাম্য
ঔদ্ধত্বেরও যে বিলাপ থাকে তা দেখা গেল গত ১৯ অক্টোবর সোমবারের একটি দৈনিক পত্রিকায়। তীব্র জনরোষের মুখে দেশত্যাগ করা এক লেখিকা গত জুন মাসে বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে তার দেশে ফেরার ব্যবস্থা করার জন্য আবেদন জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিটির উত্তরে প্রধানমন্ত্রী কিংবা বর্তমান প্রশাসন তার প্রতি কোনো সহানুভূতি প্রকাশ না করায় চিঠিটি ছাপিয়ে পাঠকদের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করেছে একটি দৈনিক। চটকদার গুজব ও মন-ব্য কলামে ভারাক্রান- সেই আট পৃষ্ঠার দৈনিকটিতে চিঠিটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা নাসরিনের আবেদন। ওই লেখিকার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি নির্দেশের জন্য তার দুই শব্দ বিশিষ্ট নামের প্রথমাংশটি মিডিয়ায় নিয়মিত উচ্চারিত হলেও ওই দৈনিকটিতে তার নামের শেষাংশটিকে শিরোনামে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর রহস্য খুঁজে জানা গেছে যে, তার নামের শেষাংশটি তার অতি ঘনিষ্ঠদের মুখে উচ্চারিত হয়ে থাকে বেশি। প্রশ্ন জাগতে পারে, বাংলাদেশের সব পর্যায়ের মানুষের ধিক্কার কুড়ানো ও উগ্র ধর্মবিদ্বেষী ওই লেখিকার প্রতি তবে কি ওই দৈনিকটিতে অতি সহানুভূতিশীল ও সক্রিয় কেউ রয়েছেন? হ্যাঁ, লেখিকার লেখা আরেক বিতর্কিত ও সতীর্থদের গোমর ফাঁক করা বই ‘ক’ পড়লে জানা যায়, ওই দৈনিকটির যিনি সম্পাদক, তিনি ওই লেখিকার ‘সাময়িক’ স্বামীদের দ্বিতীয়জন ছিলেন। লেখিকার পরিত্যক্ত এক সাবেক স্বামীর সম্পাদিত দৈনিকে তাই পাঠকের সহানুভূতি উদ্রেক করতে প্রধানমন্ত্রীকে লেখা নাসরিনের আবেদন চার লাইনের একটি পাদটিকাসহ ছাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। চিঠিটিকে একই সঙ্গে ঔদ্ধত্য, বিলাপ ও চাতুর্যের এক সংক্ষিপ্ত সমাহার বলা যায়।
লেখিকা এক জায়গায় লিখেছেন-আজ পনেরো বছর যাবৎ আমি নির্বাসন জীবন কাটাতে বাধ্য হচ্ছি। পৃথিবীর এক দেশ থেকে আরেক দেশে অনাথের মতো ঘুরছি। আমার নিজের দেশে আমাকে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি অনুমতি নেই বলে কোনও বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আমার পাসপোর্ট নবায়ন করা হয় না, আমার ইউরোপের পাসপোর্টে বাংলাদেশের নাগরিকদের যেরকম নো ভিসা রিকোয়ার্ড স্ট্যাম্প দেওয়া হয়, সেটিও দেওয়া হয় না। কী অন্যায় আমি করেছি যে, আমাকে আজ বিদেশ বিভুইয়ে আত্মীয়হীন, স্বজনহীন, বন্ধুহীন অবস্থায় দুঃসহ জীবন যাপন করতে হবে? নিজের দেশের মাটিতে আমার ঠাঁই হবে না, এর কি একটিই কারণ যে কিছু উগ্রপন্থী লোক আমার মতের সঙ্গে একমত নয়! কোনও সমাজে কি সবার সব মত বা বিশ্বাসের সঙ্গে এ যাবৎ সবাই একমত হয়েছে? ভিন্ন মত তো থাকেই এবং সেটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে, একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে, জঙ্গি মৌলবাদীদের মতের বিপক্ষে কোনও মত নিয়ে বাস করতে পারবো না, এ আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।
আরেক জায়গায় তিনি লিখেছেন-আমার নির্বাসন জীবন দিন দিন দুঃসহ হয়ে উঠছে। একজন বাঙালি লেখকের পক্ষে বিদেশ বাস সম্ভব নয়, বিশেষ করে যে লেখকের উপার্জনের উৎস লেখা। এই দীর্ঘ নির্বাসন আমার লেখার ক্ষতি শুধু করেনি, মানসিকভাবে আমি প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস-, অর্থনৈতিক পঙ্গুত্বের শিকার। আমার বাবার অঢেল ধন-সম্পত্তির সবকিছু ভাইদের করায়ত্ত, নারীর সমানাধিকারের পক্ষে দীর্ঘকাল সংগ্রাম করছি, আর আমার পরিবারেই দেশে আমার অনুপসি'তির কারণে, দেশের আইন লঙ্ঘন করে দুটো ভাই তাদের দুটো মাত্র বোনকে সম্পূর্ণরূপে বঞ্চিত করেছে প্রাপ্য উত্তরাধিকার থেকে। দূর থেকে এই অন্যায়গুলো শুধু দেখে যাওয়া ছাড়া আমার উপায়ই বা কী আছে। আমার নিজের যা কিছু ছিল তাও আজ হাতছাড়া। দখলদারদের কাছে আমার অনুপসি'তির অর্থ, আমি মৃত। কী দোষ আমি করেছি যে আমার নিজের দেশে আজ আমাকে মৃত হতে হয়।
প্রকাশ্যে পবিত্র কুরআন পরিবর্তনের দাবিদার, ধর্মীয় বিষয়ে বিদ্রোহাত্মক মনোভাবের উগ্র প্রকাশক ও জরায়ূর স্বাধীনতাকামী ওই লেখিকা তার চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিজের অপরাধের বিবরণ জানতে চেয়েছেন। বলেছেন-কী অন্যায় আমি করেছি এবং কী দোষ আমি করেছি। তার ‘নিষ্পাপত্ব’ তুলে ধরে বিলাপ করতে করতে সবশেষে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে তিনি মোক্ষম ভাষা ব্যবহার করে উসকে দিতে চেষ্টা করেছেন। লিখেছেন-মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে আপনি আপোসহীন লড়াই করছেন। দেশে প্রগতিশীল মানুষেরা আপনার পাশে দাঁড়িয়েছেন। এ সময় যদি দেশে ফেরা আমার সম্ভব না হয়, তবে আর হয়তো কখনও হবে না। আশা করছি, ভীষণভাবে আশা করছি, আপনি আমাকে দেশে ফিরতে দেবেন, প্রয়োজনে নিরাপত্তা দেবেন, আমাকে বাঁচতে দেবেন।
কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার প্রতি অনুচিত সহানুভূতি দেখাননি। তার পাসপোর্ট নবায়নের আবেদনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস সম্মতি জানায়নি। এটিকে এ সরকারের একটি যথোপযুক্ত সিদ্ধান- বলেই মনে করতে হবে। কিন' দুশ্চিন্তার বিষয় অন্য জায়গায়। ওই লেখিকার সঙ্গে সাবেক অপ্রকাশ্য সুসম্পর্ক রক্ষকারীর সংখ্যা এদেশের মিডিয়া পাড়ায় ও বুদ্ধিজীবী মহলে খুব একটা কম নয়। সটাক, পক্ককেশ ও আধাপ্রৌঢ় বহু সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীর ঝুলিতে তার অতি ঘনিষ্ঠতার স্মৃতি জমা হয়ে আছে। এসব নিখোঁজ চরিত্রের লোকেরা অতীতের সুখস্মৃতির দায়ে এক সঙ্গে সহানুভূতির কোরাস গাওয়া শুরু করে মিডিয়ায় কৃত্রিম ঝড় সৃষ্টি করলে সরকারের ভেতরের কোনো কোনো মহল বিভ্রান- হয়েও যেতে পারেন। ফলে এরকম একটি বিভ্রান- মানসিকতার ও বিপজ্জনক চরিত্রের নারীকে দেশে আমন্ত্রণ জানানোর কারণে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠার পরিবেশ রচিত হতে পারে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলা এবং এদেশের মানুষকে উগ্র হিসেবে চিহ্নিত করার মতো এক ঢিলে দুই পাখি শিকার করার জন্য যারা মুখিয়ে আছে, এতে তাদের টার্গেটই কেবল পূরণ হতে পারে। এতে সরকার ও দেশবাসীর কোনো কল্যাণ নেই। এজন্যই ওই উদ্ধত লেখিকার আজকের বিলাপ এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল বিকারগ্রস- ব্যক্তিদের তৎপরতার ক্ষেত্রেও সরকারের সতর্ক ও কঠোর মনোভাব কাম্য। তার মায়া কান্নার ফাঁদে পা না দেওয়াই দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।