নেয়ামতের কদরদানি
পৃথিবী পরিবর্তনশীল ও ধ্বংসশীল। পৃথিবীতে কোনো কিছুই স্থির নয় এবং চিরস্থায়ী নয়। তাই বিদ্যমান নেয়ামতের কদর করুন এবং আগামীর জন্য সংরক্ষণ করুন। সহজলভ্য নেয়ামতসমূহের অপচয় হতেও বিরত থাকুন যেমন পানি, বিদ্যুত, গ্যাস ইত্যাদি। এটা ইসলামের শিক্ষা। নদীর পানিতে অযু করার সময়ও কি পানির অপচয় নিষেধ নয়?
নানাজী তাঁর দীর্ঘ জীবনে প্রাচুর্যের শান্তি যেমন দেখেছেন তেমনি মানুষের অন্ন-বস্ত্রের নিদারুণ কষ্টও প্রত্যক্ষ করেছেন। এক জায়গায় লিখেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে এই কঠিন সময়ের মুখোমুখী করেছেন আমাদের শিক্ষা ও তরবিয়তের জন্য এবং জীবনের সকল প্রতিকূলতায় দৃঢ়পদ থাকার যোগ্যতা অর্জনের জন্য। শাম ছিল খায়র ও বরকতে পরিপূর্ণ ভূখন্ড, তার দীর্ঘ জীবনে কখনো অনাহার-পীড়িত হয়নি যেমনটি এখন হয়েছে। পথের পার্শ্বে ক্ষুধার্ত মানুষকে পড়ে থাকতে দেখেছি। খাবারের খোঁজে ঘুরে বেড়াতে এমনকি ডাস্টবিনে ময়লা ঘাটতেও দেখেছি। শামের এই দুরবস্থার কারণ ছিল দ্বিবিধ। একে তো তুর্কীরা এ অঞ্চলের গম তাদের জার্মান মিত্রদের জন্য নিয়ে গিয়েছিল এবং শামের অধিবাসীদের ক্ষুধা ও অনাহারে ফেলে রেখেছিল। যেমন তুর্কী সেনাবাহিনীকে লড়াইয়ের ময়দানে অনাহারে ফেলে রেখেছিল। এরপর যুক্ত হয়েছিল পঙ্গপালের অত্যাচার। পঙ্গপালের ঝাঁক যে দিক দিয়ে যেত সব তছনছ করে দিয়ে যেত।’
জীবনের এই অভিজ্ঞতা নানাজীর সামনে নেয়ামতের মূল্য পরিষ্কার করে দিয়েছিল। নেয়ামতের কদরদানি ছিল ঐসব বিষয়ের অন্যতম, যা তিনি আমাদের সবার আগে ও সর্বাধিক গুরুত্বের সাথে শিক্ষা দান করেছেন এবং প্রতিদিনের জীবনে আমাদেরকে এই বিষয়ে অভ্যস্ত করেছেন। খালি কক্ষে আমরা বাতি জ্বেলে রাখতাম না এবং ট্যাপ থেকে পানি নেওয়ার পর তা ভালোভাবে বন্ধ করতাম। টিস্যু বক্স থেকে প্রয়োজন মতো একটি বা দুটি টিস্যু নিতাম। অনেক টিস্যু একসাথে নিয়ে নষ্ট করতাম না।
একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, আমরা কখনো খাবার ফেলতাম না। এমনকি রুটির একটি টুকরাও না। নানাজীর কাছে এটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাবার নষ্ট করা ছিল তাঁর কাছে আল্লাহর আযাবের কারণ। তিনি বলতেন, এই অপরাধের কারণে আখেরাতের আযাবের আগে দুনিয়াতেই আল্লাহ খাদ্যের সংকটে ফেলতে পারেন। এজন্য আমরা কখনো এক লোকমা খাবারও উচ্ছিষ্ট রাখার সাহস পেতাম না; বরং ভালোভাবে বরতন মুছে খেতাম। ছোটবড় সবাই এই নিয়মে অভ্যস্থ ছিল।
আম্মা বলতেন, আমরা যেন বরতনে প্রয়োজনের বেশি খাবার না নেই। আগে থেকে পরিমাণ নির্ধারণ করা সম্ভব না হলে প্রথমে যেন অল্প করে নেই। শেষ হওয়ার পর প্রয়োজন থাকলে আবার নেই। তাহলে খাবার উচ্ছিষ্ট করার গুনাহ থেকে বাঁচতে পারব।
আম্মা আরো বলতেন, গত দিনের পুরনো খাবার খেতে আমরা যেন অনীহা বোধ না করি। তেমনি বিশেষ কোনো খাবারের প্রতিও যেন অনীহা প্রকাশ না করি। ঘরে যে বেলায় যা পাক হয় তা যেন আমরা সন্তুষ্ট মনে খাই এবং আল্লাহর শোকর আদায় করি। কারণ এটা আল্লাহর অনেক বড় নেয়ামত যে, তিনি মেহেরবানী করে এই খাবারটুকু আমাদের দান করেছেন।
***
কারো মনে হতে পারে, নানাজী বোধ হয় খুব কৃপণ ছিলেন কিংবা পরিবারের লোকদের ভালো খাওয়া-পরার বিষয়ে তার অনীহা ছিল। তা নয়। নানাজী ছিলেন খুবই দরাজ দিল এবং ঘরের প্রয়োজনে খরচও করতেন দরাজ হাতে।
কিন্তু তিনি আমাদের কল্যাণ চেয়েছেন। তাই খুব গুরুত্বের সাথে অপচয় থেকে বেঁচে থাকার শিক্ষা দিয়েছেন। কারণ ইসরাফ ও অপচয় শরীয়তে নিষিদ্ধ। সকল জিনিস পরিমাণ মতো ব্যবহার করা এবং আগামী দিনের প্রয়োজনের কথা ভেবে সতর্ক হওয়া বিচক্ষণতার পরিচয়। আজ আমাদের হাতে যা কিছু আছে তা তো চলেও যেতে পারে। তখন নেয়ামতের না-কদরির জন্য আফসোস করতে হবে। কিন্তু ঐসময়ের আফসোস কোনো কাজে আসবে না।
এই শিক্ষাই তো আজ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অনেক মানুষের; বরং অনেক সমাজ ও রাষ্ট্রের।