বাইতুল্লাহর ছায়ায়-১২
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমার একটি ‘অভিজাত’ রোগ আছে। রোগটিকে অভিজাত বলার দু’টি কারণ। প্রথমত গ্রীক সভ্যতার সূর্য যখন মধ্যগগনে তখনো এই রোগটির অস্তিত্ব ছিলো। কথিত আছে, গ্রীকরাই ছিলেন এ রোগের আবিষ্কারক ও চিকিৎসক।
গ্রীকদের জ্ঞানভান্ডার আরবীতে অনুবাদের পর মুসলিম চিকিৎসা- শাস্ত্রেও এ রোগটিকে সাদরে বরণ করা হয় এবং গ্রীক নামটিসহ।
মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে চিকিৎসাশাস্ত্রের মৌলিক উন্নতি হলেও কেন জানি এর নাম রয়ে গেলো, ‘ইউনানী’ চিকিৎসা। হয়ত মুসলিম সভ্যতা এভাবে তাদের পূর্বসভ্যতার প্রতি ঋণস্বীকার করতে চেয়েছে, যা পরবর্তী ইউরোপয়ী সভ্যতা কখনো করেনি। ইউরোপ তো মুসলিম বিজ্ঞানিদের নামটুকু পর্যন্ত অবিকৃত রাখার উদারতা দেখাতে পারেনি। তাই আমাদের ইবনে সীনা, যিনি আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের জনক, তাদের ভাষায় হয়ে যায় ‘এভিসিনা’। যদি বলি ‘দুষ্ট জাতি ও দুষ্ট সভ্যতা’ তাহলে হয়ত শ্রুতিকটু হবে; থাক।
অভিজাত বলার দ্বিতীয় কারণ, রোগটির বসবাস একসময় ছিলো শুধু বিত্তশালীসমাজে। অনেকে কিছুটা যেন আত্মতুষ্টির সঙ্গে বলতেন, ‘আমার আবার ডায়াবেটিস’!
আরবরা অবশ্য রোগটির প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে এর ডাক নাম রেখেছেন ‘মারাযুস্সুক্কার’ বা ‘চিনিরোগ’, সত্যি বড় মিষ্টি নাম! হয়ত একারণেই এ রোগের ভাগ্যে মিষ্টি নেই।
ডায়াবেটিস অবশ্য তার এই দ্বিতীয় আভিজাত্যটি অনেক আগেই বিসর্জন দিয়েছেন। এখন তিনি ধনী-গরীব সবার আত্মীয়। যারা ‘চারবেলা খায় এবং চার চাকায় হাঁটে তাদের যেমন ডায়াবেটিস হয়, যারা একবেলা খায় এবং দু’পায়ে দৌড়য় তাদেরও হয়। তাই তো আমার গরীবগৃহেও তার প্রবেশ। অবশ্য ‘গৃহপ্রবেশ’ না বলে ‘দেহপ্রবেশ’ বলাই অধিক সঙ্গত।
আমার ডায়াবেটিসের বয়স পনের বছর পার হয়েছে। অর্থাৎ কৈশোর পেরিয়ে তিনি এখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট। আর ডায়াবেটিস যত হৃষ্টপুষ্ট হয়, যে দেহে তিনি বাস করেন তা ততই জীর্ণশীর্ণ হয়। সুতরাং আমার দেহেরও এখন বড় জীর্ণদশা। তার উপর অনেকে যে ভুলটি করে আমিও তাই করেছি। অর্থাৎ শুরুতে রোগটিকে বড় বেশী অবহেলা করেছি, আর এখন দু’তিন বছর থেকে অতিমাত্রায় তোয়াজ করছি। দু’বেলা ইনসুলিন ও তিনবেলা কমেট এখন আমার ডায়াবেটিসের নিয়মিত ভোগ। তদুপরি উচ্চরক্তচাপের জন্য রয়েছে প্রসান। সুতরাং ঔষধপত্র ও আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম হচ্ছে এবার আমার সফরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পাথেয়। সেকারণে আমার স্ত্রী সেগুলো নিজের হাতে গুছিয়ে দিলেন এবং এত সুন্দর ও সুচারুরূপে যে, খুশী হয়ে বললাম, অন্তত এই সফরে আমার ডায়াবেটিসের ‘মন খারাপ’ করার হক নেই।
ঔষধপত্র সঙ্গে তো দেয়া হলো, কিন্তু মনে করিয়ে দেবে কে? ভুলে যাওয়ার বিষয়ে আমি যে রীতিমত অনন্য সাধারণ! কোন কারণে স্ত্রী যদি কাছে না থাকেন, ট্যাবলেটের পাতাটা পানের বাটার উপর রেখে দেন, যাতে পান খাওয়ার সময় মনে পড়ে। কিন্তু মনটা তো সবসময় কাছে থাকে না! তাই পান খেলেও ট্যাবলেটের পাতাটা চোখে পড়ে না। স্ত্রী ফিরে এসে জিজ্ঞাসা করেন, ঔষধ খেয়েছো? আমি সন্দেহে পড়ে যাই। আর তিনি ট্যাবলেটের খালি ঘরগুলো গুণে বলে দেন, খাওনি।
সেদিন হলো বড় মজার কান্ড! খাওয়া দাওয়া শেষে পানের বাটার দিকে হাত বাড়ালাম, স্ত্রী দেখলেন, কিন্তু কিছু বললেন না। অনেক যত্নে তৈরী করা খিলিটা যখন মুখে দেবো, তিনি বলে উঠলেন, রাখো, রাখো!
বুঝতে পারলাম না, কী হলো! তিনি পানের বাটা থেকে ট্যাবলেটের পাতাটা নিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, পানের কথা তো ভোলো না, ট্যাবলেটের কথা ভুলে যাও কেন? আমি যখন ‘থাকবো না’ তখন কী হবে বলো তো?
কঠিন প্রশ্ন! আমিও মনে মনে বললাম, ‘আমি যখন থাকবো না তখন তোমার কী হবে বলো তো?’
আসলে কিছুই হবে না; কিছুই হয় না। কারণ জীবনের গতি বড় নির্মম!
যাই হোক, ঔষধের কথা মনে করিয়ে দেয়ার দায়িত্বটি পুরো সফরে পরম যত্নের সঙ্গে পালন করেছে আমার বন্ধু জাহাঙ্গীর (ইমাম ছাহেব), এজন্য আমার স্ত্রী এখনো তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমার অবশ্য কৃতজ্ঞ হওয়ার দায় নেই। কারণ এটা তো বন্ধুত্বের পাওনা, যা দীর্ঘ চল্লিশ বছর আমরা পরস্পরের কাছে পেয়ে আসছি।
এ সফরেই মক্কা শরীফে আমাদের এক বৃদ্ধ সফরসঙ্গী বলেছিলেন, জীবনে অনেক বন্ধু ও বন্ধুত্ব দেখেছি, কিন্তু আপনাদের মত দেখিনি। এমন বন্ধুত্ব এত দীর্ঘকাল একভাবে টিকে আছে, এর রহস্যটা কী!
উত্তরে জাহাঙ্গীর যা বলেছিলো, তা সোনার হরফে লিখে রাখার মত। অবশ্য নতুন কোন কথা নয়। বন্ধুত্বের ইসলামী বুনিয়াদটাই সে তুলে ধরেছিলো, বলেছিলো, ‘আমরা আল্লাহর ওয়াস্তে মুহববত করেছি। পরস্পরের কাছে আমাদের কোন চাহিদা নেই, আর আমাদের একের ভুল অন্যের কাছে নিজেরই ভুল।’
কথাগুলো সত্য, বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে যেমন পারিবারিক সম্পর্কগুলোর ক্ষেত্রেও তেমন।
***
আমার স্ত্রী এবার একটি অকল্পনীয় কান্ড করলেন। তার খবরদারিতে বহু দিন থেকে আমার কপালে পান্তা জোটে না, অথচ সঙ্গে গোশত হোক, বা শুঁটকি, অথবা ডালের বড়া, আর কাঁচা মরিচ হোক, বা পোড়া মরিচ, পান্তা ছিলো শৈশব থেকে আমার প্রিয় খাবার। আজ তিনি দস্তরখান বিছিয়ে নিজের হাতে পান্তাভাত সাজিয়ে দিলেন এবং গরুর গোশত সহযোগে। বিদায়ের পূর্বে কী অপূর্ব আন্তরিক আয়োজন! কিন্তু মনটা খুশী হতে গিয়েও কেমন জানি করে উঠলো। কোথায় যেন পড়েছি; রোগীকে পছন্দের খাবার দেয়া অন্যরকম আলামত! আমার স্ত্রী এমন ভাবছেন না তো যে, আহা, মানুষটা যদি আর ফিরে না আসে!
যাহোক, বুকের কথা মুখে না এনে তৃপ্তির সঙ্গেই পান্তাভোগ সাঙ্গ করলাম, আর ‘পান্তাবুড়ী’কে ধন্যবাদ জানালাম। আহা, কত দিন পর এমন তৃপ্তির খাবার!
***
এবার নিয়ত করেছি, ঘরে ইহরামের লিবাস ধারণ করে আম্মার সামনে গিয়ে দাঁড়াবো এবং আম্মাকে তালবিয়া শোনাবো। কেন এ নিয়ত, জানি না। সব সময় মনের সব ইচ্ছার উপযুক্ত কারণ জানা থাকে না। তবে কিছু কিছু ইচ্ছা পূর্ণ হলে ভালো লাগে। আববা যখন দুনিয়াতে ছিলেন তখন যদি এ ইচ্ছাটা হতো, কত ভালো হতো! আববা কত খুশী হতেন!
গোসল করার সময় মনে অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। ইহরামের সাদা লিবাস যদি হয় কাফনের লিবাস, তাহলে এ গোসল তো মুরদারের গোসল; অন্তত এ গোসল তো সেই গোসলকে স্মরণ করিয়ে দেয়! আজকের গোসল তো আমি নিজে করছি; সেদিন তো নিজের গোসল নিজে করার শক্তি আমার থাকবে না! আমি কি জানতে পারবো যে, আমাকে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছে! আমাকে গোসল দেয়া হচ্ছে! কিংবা জানতে পারবো, কারা আমাকে গোসল দিচ্ছে! হায়, জীবিত অবস্থায় যদি তাদের দেখতে পেতাম! আল্লাহ তাদের ভালো করুন। সেদিন তারা যেন মুহববতের সঙ্গে, কোমলভাবে, সুন্নতমতে আমাকে গোসল দেয় এবং তারাও যেন পরবর্তীদের কাছে সুন্দর গোসল পায়।
কত ভালো হয়, যদি আজকের ইহরামের গোসল থেকেই নিজেকে মুরদার ভাবতে পারি! তবু আল্লাহর শোকর; এতটুকু অন্তত হলো যে, গোসলের পানিতে চোখের পানি মিশে গেলো এবং চোখের পানি দিয়ে ইহরামের গোসল হলো।
ভাব ও ভাবনা আল্লাহর দান এবং এটাই ইবাদতের প্রাণ। সুতরাং এসকল ভাব ও ভাবনা এবং অনুভব-অনুভূতির জন্য আল্লাহর শোকর আদায় করা কর্তব্য। আল্লাহুম্মা লাকাল হামদু ওয়া লাকাশ্শুক্র।
ঝরনার নীচে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ গোসল করলাম। বৃষ্টিতে ভেজার কোমল সিণগ্ধ একটি অনুভূতি হলো। তাই বাইরের শীতলতা ভিতরকে স্পর্শ করা পর্যন্ত ভিজতেই থাকলাম।
পুরোনো কাপড় ত্যাগ করে ইহরামের নতুন লেবাস ধারণ করার সময় মনে মনে কামনা করলাম; এভাবে যেন পিছনের অপরিচ্ছন্ন জীবনকে ত্যাগ করে আলোকিত এক নতুন জীবন গ্রহণ করতে পারি; নতুন জীবনের নবজন্ম লাভ করে যেন আল্লাহর ঘর থেকে ফিরে আসতে পারি।
আতরমাখা ইহরামের লেবাস হাতে নিয়ে যে খোশবু পেলাম সেটা যেন ছিলো আববাকে গোসল দেয়ার সময়ের খোশবু। সেদিন অনেকেই পেয়েছিলো ঐ খোশবু। আম্মাও পেয়েছিলেন। তখন ইহরামের এই টুকরোটি আববার গায়ে ছিলো। অন্য টুকরোটি তাঁর সঙ্গী হয়েছে কবরে। আববা বলেছিলেন, ‘তোমার ইহরামের একটা টুকরা আমার কাফনের মধ্যে দিয়ো।’
আমারও ইচ্ছা করে, ছেলেকে বলি, যদি সম্ভব হয় ইহরামের এই টুকরোটি আমার কাফনের সঙ্গে দিয়ো।
সবাই বলছিলো, এই শীতের মধ্যে নতুন তোয়ালে দু’টো পরে নাও।
তারা বুঝতে পারেনি, বুঝতে পারার কথাও নয়, পুরোনো ইহরামের এই টুকরোটির প্রতি কেন আমার...!
***
এত দিনের গোনাহগার নফস সহজে কি বশ মানতে চায়! কাফনের লিবাস ধারণ করেও কাফনধারী কি হতে চায়! তবু আল্লাহর নেক বান্দাগণ যা কিছু লিখেছেন, যুলহোলায়ফায় আমার ইহরামের লিবাস ঠিক করে দিতে দিতে হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ.) যা কিছু বলেছিলেন সেগুলো স্মরণ করে অবাধ্য নফসকে বশে আনতে চেষ্টা করলাম এবং একসময় জায়নামাযে দাঁড়ালাম। কোন দিকে মুখ করে? সেই ঘরের দিকে যে ঘরের মেহমান হওয়ার জন্য এই ইহরাম, এই শুভ্র লেবাস! যে ঘরের তাওয়াফ করার জন্য এই কাফেলা, এই দীর্ঘ সফর! ভাবতে খুব ভালো লাগলো, আজ ইহরামের নামায পড়ছি যে ঘরের গায়েবানা, ইনশাআল্লাহ আগামীকাল নামায পড়বো সেই ঘরের হাযেরানা! সেদিনের সেই নামাযের পবিত্রতা ও জ্যোতির্ময়তা এখনো যেন অন্তরের গভীরে কিছু আশা ও আশ্বাস জাগ্রত করে! কেন করবে না? দাতা তো নেককার-বদকার সবাইকে দিতে চান এবং দিতে ভালোবাসেন!
নামায শেষে হজ্বের ইহরামের নিয়ত করে মুহরিম হয়ে গেলাম।
اللهم إني أريد الحج، فيسره لي وتقبله مني
হে আল্লাহ, আমি তো হজ্বের নিয়ত করেছি, সুতরাং আপনি তা সহজ করে দিন এবং তা কবুল করে নিন।
এখন আমি মুহরিম। ইহরামের মাধ্যমে এখন আমার আগের জীবনের অবসান হলো এবং নতুন জীবনের উদ্বোধন হলো। সারা জীবন যত অশ্লীলতা ও পাপাচার হয়েছে, যত ঝগড়া-বিবাদ ঘটেছে, আমার আমলনামা থেকে তা যেন ইহরামের মাধ্যমে আজ মুছে গেলো। এখন থেকে আর কোন অশ্লীলতা ও পাপাচার নয়, নয় কোন ফাসাদ-বিবাদ। কারণ আমার ইহরাম আমাকে বলে-
فلا رفث ولا فسوق ولا جدال في الحج
করুণাময়ের করুণায় আমি এখন পুত-পবিত্র মানুষ, নাপাকি ও গান্দেগি থেকে পাকছাফ এক ইনসান। কারণ আমার ইহরাম আমাকে এ খোশখবর শোনায়-
من حج لله فلم يرفث ولم يفسق رجع كيوم ولدته أمه
আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যে হজ্ব করে, আর তাতে অশ্লীলতা করে না এবং পাপাচার করে না, সে ঐ দিনের মত নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসে যেদিন তার মা তাকে জন্মদান করেছে।
হে আল্লাহ হজ্বের ইহরামকে তুমি যেমন চাও তেমন শুভ্র-পবিত্র রাখার তাওফীক দাও। হজ্বের ইহরাম যেন হয় আমার জীবনের ইহরাম।
ভাবের তরঙ্গে আন্দোলিত হয়ে যখন ইহরামের প্রথম তালবিয়া উচ্চারণ করলাম-
لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك، إن الحمد والنعمة لك والملك، لا شريك لك
মনে হলো, সত্যি বুঝি আমি বাইতুল্লাহর দুয়ারে হাযির হয়ে গেছি! আমি যেন আল্লাহর ঘরের গিলাফ ধরে ফেলেছি! আল্লাহর ঘরের সুবাসে বান্দার ঘরও সুবাসিত হয়ে উঠেছে। শোকর আলহামদু লিল্লাহ।
স্ত্রী-পুত্র-কন্যা সবার থেকে বিদায় নিলাম। বিদায় তো আমরা গ্রহণ করি, কিন্তু তার তাৎপর্য কমই অনুধাবন করি। বিদায় মানে তো এই যে, আমি এখন আল্লাহর ঘরের মুসাফির। এখন কারো সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। পৃথিবীর সকল সম্পর্ক আমি ছিন্ন করেছি, এখন আমার সম্পর্ক শুধু আল্লাহর সঙ্গে।
এরকম একটি অনুভূতি এবারের ইহরাম থেকে অর্জনের চেষ্টা করলাম, কিন্তু হায়!
সবশেষে আম্মার সামনে হাযির হলাম; সালাম দিয়ে আম্মার পায়ের কাছে বসলাম এবং তালবিয়া শুনালাম, লাববাইক, আল্লাহুম্মা লাববাইক ...।
আম্মা নিজেকে যেন আর ধরে রাখতে পারলেন না। ভিতর থেকে কান্নার ঢেউ এসে আছড়ে পড়লো তার চোখে। আমি অস্থির হয়ে বললাম, কী হয়েছে আম্মা!
তিনি বললেন, এটা খুশির কান্না। আমার দুই ছেলে আল্লাহর ঘরের দাওয়াত পেয়েছে। আমার খুশির কি কোন ঠিকানা আছে! আমার চেয়ে ভাগ্যবতী আর কে আছে!
আম্মার পা ছুঁয়ে বললাম, ‘আম্মা, আমার জান্নাত তো এখানে আপনার পায়ের নীচে। আপনি সন্তুষ্ট হলেই আমার জন্য জান্নাতের দুয়ার খোলা। মায়ের সন্তুষ্টি ছাড়া তো হজ্বের কোন মূল্য নেই। সুতরাং সারা জীবন যত কষ্ট দিয়েছি সব মাফ করে দেন।’
দুনিয়াতে মায়ের মমতা হলো আল্লাহর করুণার ছায়া। সন্তান যত কষ্ট দিক, মাতৃমমতা কি তা ক্ষমা না করে পারে! এমন সময় সন্তানের এমন মিনতি কি মাতৃহৃদয়ে তরঙ্গ-জোয়ার সৃষ্টি না করে পারে!
আমার মায়ের হৃদয়েও এমন তরঙ্গজোয়ার সৃষ্টি হলো যে, চিরকালের শান্ত আমার মা অস্থির কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘এমন করে বলো কেন? আমার কষ্ট হয় না! দু‘আ করি, আল্লাহ তোমার সফর কবুল করুন।’
আম্মার পায়ের কাছে বসে আম্মার আদেশে মুনাজাত করলাম। একটি হাত শক্তিহীন, তাই মুনাজাতে আম্মা একটি হাত তুললেন। হোক না একটি হাত; মায়ের হাত তো! সন্তানের কল্যাণ কামনায় উত্তোলিত এ হাত কি রাহমান রাহীম আল্লাহ কখনো ফিরিয়ে দিতে পারেন!
আম্মার আম্মা, অর্থাৎ আমার নানীআম্মা, তিনিও মুনাজাতে শরীক ছিলেন। আমি ছিলাম, আমার মেয়ে ছিলো এবং ছিলো তার ছেলে। পাঁচটি প্রজন্মের একত্র মুনাজাত, ভাবতে সেদিন বড় ভালো লেগেছিলো। মুনাজাত শেষে আম্মার চোখের পানি ও দু‘আর পাথেয় সঙ্গে করে বিসমিল্লাহ বলে ঘর থেকে বের হলাম; পিছনে আর ফিরে তাকালাম না।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকা আমার ছোট মেয়ে সাফফানা আস্তে করে বললো, ‘আববু! দাদুর পায়ের কাছে তোমার বসে থাকার নূরানী দৃশ্য আমার অন্তরে অক্ষয় হয়ে থাকবে। দু‘আ করো, আমি যেন তা থেকে কিছু শিখতে পারি।’
এটা আসলে পৃথিবীর সব সন্তানের মনের কথা। আমাদের সন্তানেরা দেখতে চায় আমাদের আচরণ, আমরা তাদের শোনাই শুধু মুখের উচ্চারণ।
***
মাদরাসার খাদেম সাহেব বিমানবন্দর পর্যন্ত আমার সঙ্গী হলেন। গাড়ীতে উঠলাম। সফরের দু‘আ এবং সওয়ারির দু‘আ পড়ে নিলাম। গাড়ী রওয়ানা হলো। লাববাইক আল্লাহুম্মা লাববাইক, লাববাইকা লা-শারীকা লাকা লাববাইক ...।
রাস্তায় যারা দেখে অবাক চোখে তাকায়, এমনকি বস্তির পরিচিত এলাকা পার হওয়ার পরো। ট্রাফিক সিগন্যালে গাড়ী থামে, সেখানেও বহু চোখের অবাক চাহনি। এটাই স্বাভাবিক, কারণ এ তো সাধারণ লেবাস নয়, ইহরামের লেবাস, মেহমানে বাইতুল্লাহর লেবাস। মনে মনে প্রার্থনা জানালাম, হে আল্লাহ, যাদের হৃদয়ে স্বপ্ন আছে তোমার ঘর দেখার তাদের স্বপ্ন যেন পূর্ণ হয়; ইহরামের শুভ্র লেবাসে একদিন তারা যেন সজ্জিত হয়; তারাও যেন তোমার ঘরের মুসাফির হয়। আর এখনো যারা স্বপ্ন-বঞ্চিত তাদের হৃদয়ে হে আল্লাহ, স্বপ্ন দান করো, কালো গিলাফের এবং সবুজ গম্বুজের স্বপ্ন।
গাড়ী তখন যানজটে আটকা পড়ে ছিলো; হঠাৎ একজন রিক্শা থেকে নেমে দৌড়ে এলেন। সালাম-মুছাফাহা করে বললেন, ‘হাজীসাব, দু‘আ করবেন, আল্লাহ যেন আমারেও কবুল করে। নবীজীর রওযা শরীফে আমার সালাম দিয়েন।’
আমি অবাক হলাম, আল্লাহর কী শান! এ দু‘আই তো এখন আমি করছিলাম।
আমি খুব মুহববতের নযরে আমার অচেনা মুসলিম ভাইটির দিকে তাকালাম। কী নাম আপনার ভাই? শামসুল আলম।
মুখে দাড়ী নেই। চিবুকে হাত বুলিয়ে বললাম, দাড়ী হলো নবীর সুন্নত। ধীরে ধীরে দাড়ী রেখে দেয়ার নিয়ত করে ফেলেন।
আমি অবশ্যই আপনার পক্ষ হতে সালাম পেশ করবো এবং দু‘আ করবো। আপনি যেন নবীর সুন্নত মুখে নিয়ে নবীর রওযা শরীফে হাযির হতে পারেন।’
কত ভালো মানুষ তিনি! এই সামান্য কথাতেই চোখদু’টো তার ছলছল করে উঠলো!
***
কাফেলার আমীর মাওলানা ইয়াহয়া (জাহাঙ্গীর) জোর তাকিদ দিয়ে বলেছিলেন, দুপুর বারোটার আগে যেন মালিবাগ চৌধুরিপাড়া মসজিদে হাযির হয়ে যাই। সেখানে যোহর আদায় করে একসঙ্গে আমরা বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবো।
বারোটার কিছু পরে হলেও সবার আগে আমারই পৌঁছা হলো, এমনকি মসজিদের নিকটবর্তী বাড়ীর বাসিন্দা কাফেলার আমীর ছাহেবেরও আগে। মসজিদে প্রবেশ করে তাহিয়্যাতুল মসজিদ আদায় করলাম এবং কোরআন শরীফ নিয়ে তিলাওয়াতে মশগুল হলাম। আজকের নামায ও তিলাওয়াতের স্বাদই যেন অন্যরকম; সবকিছুরই স্বাদ যেন অন্যরকম!
কাফেলার অন্যান্য সদস্য একে একে আসছেন এবং ইহরাম ধারণ করছেন। আমীর ছাহেব প্রয়োজনীয় হিদায়াত দিয়ে তাদের সাহায্য করছেন। দেখা গেলো, দু’একজন ভেবে বসে আছেন যে, সেলাইবিহীন কাপড় পরেছেন তো ইহরাম হয়ে গেছে! আমীর ছাহেব তাদের ধরে ধরে বুঝিয়ে বুঝিয়ে ইহরাম ধারণ করালেন। আমীর ছাহেবের প্রতি তারা কোন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন না। আশ্চর্য আমরা এবং আশ্চর্য আমাদের চরিত্র!
***
আমার প্রিয় ছাত্র মাওলানা আবুল বাশার এবং তার বয়সের কয়েকজন আলিম একটি নতুন মাদরাসা করেছেন নতুন কিছু চিন্তা নিয়ে। পরিবেশ ও পরিস্থিতির বিচারে তাদের এ পদক্ষেপকে আমার খুব সাহসী মনে হয়েছে। তাই শুরু থেকেই তাদের প্রতি আমার সহমর্মিতা রয়েছে। সম্ভব হলে কার্যক্ষেত্রেও আমি তাদের সঙ্গ দিতাম। তবে নিজের জন্য যখন দু‘আ করি, তাদের কথাও স্মরণ করি। আমি তাদের ভালোবাসি, তারাও আমাকে ভালোবাসেন। বিশেষ করে আমার শিক্ষক জীবনের সূচনালগ্নের প্রিয় ছাত্র মাওলানা আবুল বাশার। সেদিন রাত্রে আমি পাসপোর্ট ও টিকেট নিতে আসবো শুনে সে দেখা করতে এসেছিলো। আমার পৌঁছতে অনেক বিলম্ব হওয়ায় আশাহত হয়ে ফিরে গিয়েছিলো। আজ আবার এসেছে। সঙ্গে এসেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ আলী ও মাওলানা যায়নুল আবেদীন। ইনি সম্ভাবনার অধিকারী লেখক। অনুবাদ করেন, আবার পত্রপত্রিকায় সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে লেখেন। যা লেখেন আস্থা ও আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লেখেন।
তাদের সঙ্গে অনেক কথা হলো, তা‘লীমের ময়দানে আমাদের করণীয় এবং সমাজের প্রতি আমাদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে, আরো কথা হলো ইলম ও আহলে ইলমের আত্মমর্যাদা রক্ষা করা এবং শুধু আল্লাহর উপর ভরসা রাখার অপরিহার্যতা সম্পর্কে। মনে হলো, আলোচনা দ্বারা উপস্থিত আমরা সবাই উপকৃত হলাম। অবশেষে আমাদের জন্য দু‘আ করে এবং দু‘আ চেয়ে তারা বিদায় নিলেন।
***
আল্লাহর ঘরের মেহমানদের প্রতি আল্লাহর বান্দাদের দিলে কত যে আযমত ও মুহববত তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ভিতরে ভিতরে লজ্জায় মরে যাই। আল্লাহ ক্ষমা করে ঢেকে রেখেছেন, তাই কেউ জানে না, আমার প্রকৃত অবস্থা, কেউ জানে না ইহরামের শুভ্রতার ভিতরে কত কদর্যতা! কিন্তু বাইতুল্লাহর নিসবতে মানুষ যখন ভক্তি করছে এবং সুধারণা পোষণ করছে, আমি অস্বীকার করবো কেন? কেউ পানি পড়া চাইলো, কেউ শিশুকে ঝাড়ফুঁক করাতে আনলো, দিলাম। পরম দাতা যদি ইচ্ছা করেন, অবশ্যই তাতে আছর পয়দা করতে পারেন।
***
আচমকাই খবরটা এলো এবং আমাদের চমকে দিলো; আজকের ফ্লাইট অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিলম্বিত ঘোষণা করা হয়েছে। একেই বলে বোধহয় বিনা মেঘে বজ্রপাত! বিভিন্ন কারণে এমনিতেই এবার অনেকের হজ্ব-বঞ্চিত হওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে; তার উপর আগামীকাল হচ্ছে জিদ্দায় প্রবেশের শেষ দিন। সউদী হুকুমত আর যাই করে, কোন অজুহাত শোনে না; শুধু ‘খালাছ’ বলে ফেরত পাঠিয়ে দেয়।
কী হলো তাহলে? কী হতে যাচ্ছে তাহলে? কী আছে আমাদের কপালে, আমার নছীবে? বাইরে শান্তভাব ধরে রাখার চেষ্টা করছি, কিন্তু ভিতরে অন্যদের মতই অস্থির। সে অস্থিরতা যে কেমন তা যদি শব্দের অবয়বে ফুটিয়ে তোলা যেতো! হঠাৎ মনে হলো, আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চারপাশে কেউ নেই, কোন কোলাহল নেই, সবকিছু কেমন অন্ধকার! আমি কি জ্ঞান হারিয়ে ফেলছি?
ধীরে ধীরে এ অবস্থাটা দূর হলো। আবার নিজের স্বাভাবিকতা ফিরে পেলাম। কয়েক মুহূর্তের জন্য ভিতরে যেন ঘোর আঁধারের একটা ঝড় এসেছিলো, যা সবকিছু তছনছ করে দিয়ে গেছে। সেই ঝড়টা এখন নেই, কিন্তু একটা ভয় ও উৎকণ্ঠা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। এমন যদি হয় যে, আমারই গোনাহের কারণে মাহরূমির ফায়ছালা হয়ে গেছে! হে আল্লাহ, আমি জানি, আমার মত গোনাহগার বান্দার কোন যোগ্যতা নেই আরদে মুকাদ্দাসায় কদম রাখার, তোমার ঘরের দুয়ারে হাযির হওয়ার। হে আলস্নাহ, তোমার দয়া হয়েছে বলেই না ইহরামের সাদা লেবাসে লাববাইক বলে ঘর থেকে বের হতে পেরেছি। হে আল্লাহ, পথ থেকে ফিরিয়ে দেয়া তো তোমার শানে করম নয়। তুমি তো সকল দয়ালুর সেরা দয়ালু! তুমি তো আরহামুর-রাহিমীন! দয়া করো এবং কবুল করো হে আল্লাহ! পথের সকল বাঁধা দূর করে দাও হে আল্লাহ! সফরের সকল কঠিনতা সহজ করে দাও হে আল্লাহ!
মুনাজাত করার পর মন কিছুটা শান্ত হলো এবং ভয় ও উৎকণ্ঠা কিছুটা দূর হলো, কিন্তু বুকের দুরু দুরু কম্পন আর থামে না। অজানা একটা আশঙ্কা থেকে থেকে ভিতরে দোলা দিয়ে যায়। কিসের যেন একটা কাঁটা খচখচ করে হৃদয়ে গভীরে বিঁধতেই থাকে। হঠাৎ হঠাৎ যেন কলজেটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি তো জানি না, আগামীকাল কী হবে! তাকদীরওয়ালা কী লিখে রেখেছেন আমার তাকদীরে! আমি কি দেখতে পাবো আল্লাহর ঘর? আমি কি পৌঁছতে পারবো মিনা-আরাফায়, মুযদালিফায়? আমি কি শামিল হতে পারবো জাবালে রহমতের পাদদেশে, হজ্বে আকবরের মহাসমাবেশে? আমি কি হাযির হতে পারবো সোনার মদীনায়, পেয়ারা নবীর পাক রাওযায়? জানি না, আমি কিছুই জানি না; জানেন শুধু আল্লাহ।
নিজেকে আমি তোমার হাতে সোপর্দ করলাম হে আল্লাহ! আমার গতকাল তোমার হাতে, আমার আজ ও আগামীকালও তোমার হাতে। তোমার যা কিছু ফায়ছালা তাতেই আমি রাযী-খুশী হে আল্লাহ! শুধু তুমি আমার প্রতি সন্তুষ্ট থেকো হে আল্লাহ!
***
আযান শুরু হলো। বড় করুণ মনে হলো আজকের আযানের সুর। আসলে হৃদয়ের করুণতায় সবকিছু করুণ হয়ে বাজে। কেন জানি মনে হলো, এ সুর মদীনার আযানের সুর! হঠাৎ দিলের পর্দায় মসজিদে নববীর তাসবীর এমন জীবন্ত হয়ে উঠলো যে, মুহূর্তের জন্য আমি স্থান-কাল ভুলে গেলাম। মনে হলো, আমি দাঁড়িয়ে আছি সবুজ গম্বুজের পাশে! এটা ছিলো ক্ষণিকের আচ্ছন্নতা। সম্বিত ফিরে পেয়ে শুনি, তখনো আযান চলছে, তেমনি করুণ সুরে, আর আমি পড়ে আছি সোনার মদীনা থেকে দূরে, বহু দূরে দুর্ভাগা বাংলার ভূমিতে। হিজাযের কাফেলায় আমার যাত্রা তখন অনিশ্চিত। চারদিকে চলছে হাজী ছাহেবানের শোরগোল ও হায়হুতাশ।
যোহরের জামাত শুরু হলো। নামাযে দাঁড়ালাম। ইহরামের সাদা লেবাসে প্রথম নামায! রুকু করলাম, সিজদায় গেলাম। ফোঁটা ফোঁটা চোখের জলে ভিজলো মসজিদের ফরাস। নামায শেষ হতে হতে অন্তরের গভীরে আশ্চর্য এক প্রশান্তির সুশীতল স্পর্শ অনুভব করলাম। তখন বিশ্বাস হলো, ইনশাআল্লাহ, গায়ব থেকে মদদ নেমে আসবে। পথের ধূলায় তিনি ফেলে রাখবেন না আমাদের। তাঁর ঘরের দুয়ারে তিনি পৌঁছাবেন আমাদের।
নামাযের পর কাফেলার আমীর সাহেব মশওয়ারায় বসলেন। বেচারা পড়েছেন কাফেলার সবার ক্ষোভের মুখে। সব দোষ যেন তাঁর একার! আশ্চর্য, এমন নাযুক অবস্থায়, এরকম সঙ্গীন হালতেও হারিয়ে যায় আমাদের মুখের সংযম!
সবার মতামত নিয়ে ইমাম ছাহেব আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী বলো?
সবাই মতামত দিলো অল্প, ক্ষোভ প্রকাশ করলো বিস্তার। ক্ষোভের বিষয়টা হলো, কেন তিনি এত শেষের তারিখ নিলেন?
আমি বললাম, ‘বিমানবন্দর পর্যন্ত যাওয়ার তাওফীক তো আমাদের আছে। আল্লাহর উপর ভরসা করে আমরা আমাদের সাধ্য পর্যন্ত তো অগ্রসর হতে পারি। তারপর আল্লাহর ইচ্ছা। তবে খুব মনে রাখতে হবে যে, আমরা এখন এক কঠিন ইমতিহানের মধ্যে আছি। শোরগোল করার সময় এটা নয় এবং নয় কারো প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করার সময়। এখন দিলের মধ্যে ভয় গ্রহণ করার সময় এবং ইসতিগফার করার সময়, যেন আল্লাহ সমস্ত গোনাখাতা মাফ করে দেন। আমাদের বদ আমলের কারণে যেন মাহরূমি নেমে না আসে।’
মনে হলো অধিকাংশের অন্তরে কথাগুলো কিছু না কিছু আছর করলো, অন্তত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশটা যথেষ্ট প্রশমিত হলো এবং সবাই ইসতিগফারে মনোযোগী হলো। আলহামদু লিল্লাহ।
আমীর ছাহেব বিমানবন্দরে রওয়ানা হওয়ার ফায়ছালা দিলেন। এখানে অপেক্ষা করার চেয়ে বিমানবন্দরে গিয়ে অপেক্ষা করাই ভালো।
কাফেলার এক যুবক ‘হামসফর’ বললেন, অনিশ্চয়তার মুখে বিমানবন্দরে গিয়ে কষ্ট করার কোন অর্থ হয় না। আপনারা যান, আমি বাসায় চলে যাবো এবং মোবাইলে ইমাম সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবো।
যদি জোর করার সুযোগ থাকতো, এই ভদ্রযুবকটিকে আমি জোর করে কাফেলার সঙ্গে রেখে দিতাম। কিন্তু এখন আপন-পর কারোই জোর করে ভালো করার উপায় নেই। নিজের ভালো সবাই এখন অনেক বেশী বোঝে।
কে তাকে বোঝাবে যে, হজ্বের সফরে এধরনের চিন্তা সঙ্গত নয়। এখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যত কষ্ট-পেরেশানি তা হাসিমুখে বরণ করাই কর্তব্য। কারণ এগুলো আসে গায়ব থেকে বান্দাকে তারবিয়াত করার জন্য; কলব ও রূহ এবং হৃদয় ও আত্মার দিক থেকে বান্দাকে তৈয়ার করার জন্য। আগের যুগে যেখানে মাস, ছয় মাস, এমনকি বছর লেগে যেতো হজ্বের সফরে, সেই সফরের নূর ও নূরানিয়াত এবং বরকত ও কবূলিয়াত কীভাবে হাছিল হতে পারে কয়েক ঘণ্টার আরামদায়ক সফরে, বিমানবালাদের পরিবেশিত খাবারে! একটি বর্ণনায় যে এসেছে, এমন যামানা আসবে, যখন হজ্ব হবে নিছক পর্যটন, তো এ যুগে হজ্বের সফর কি প্রায় পর্যটনের পর্যায়ে এসে পড়েনি!
বস্ত্তত আল্লাহ যখন এ যুগের নাদান হাজিদের প্রতি দয়া করতে চান তখন তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি কিছু কষ্ট-পেরেশানি দান করেন, যাতে তাদের হজ্ব আরাম আয়েশের অন্ধকার থেকে বের হয়ে মেহনত-মুজাহাদার আলোতে প্রবেশ করতে পারে এবং সামান্য হলেও পূর্ববর্তীদের হজ্বের নূর ও নূরানিয়াতের স্পর্শ লাভ করতে পারে। কিন্তু এটা তো তখনই হবে যখন আমরা ছবর-শোকরের পরিচয় দেবো এবং বাইতুল্লাহর সফরের সকল কষ্ট-পেরেশানিকে হাসিমুখে বরণ করে নেবো। কত না নির্বুদ্ধিতা হবে যদি আমরা আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে ‘যহমত’ মনে করি, আর অন্যকে দোষারোপ করতে লেগে যাই। হতে পারে, আমার কষ্ট-পেরেশানির কারণ কারো না কারো অবহেলা বা দায়িত্বহীনতা। সে জন্য হয়ত আখেরাতে তার পাকড়াও হবে, কিন্তু আমার জন্য তো এটা আল্লাহর পক্ষ হতে হজ্বের সফরের তারবিয়াত! আমার হজ্বের নূর ও নূরানিয়াত লাভের গায়বি ইনতিযাম! আমি কেন অধৈর্য হয়ে এত বড় নেয়ামত হাতছাড়া করি! আল্লাহ আমাদের ছহী বুঝ গ্রহণের তাওফীক দান করুন, আমীন।
***
ইহরামের সাদা লেবাসে একজনকেই মনে হয় বহুজন। কাফেলায় আমরা তেরজন, কিন্তু মনে হলো, সারা মসজিদ যেন ইহরামের সাদা লেবাসের শুভ্রতায় পরিপূর্ণ। সবাই ইহরামের নামায আদায় করছেন। নতুন যারা ইহরাম বাঁধতে পারেন না, ইমাম ছাহেব তাদের আন্তরিকভাবে সাহায্য করছেন। এ দৃশ্য আমার খুব ভালো লাগলো। পুরো সফরেই দেখেছি, সবার প্রতি তাঁর সযত্ন আচরণ। সবার হজ্ব যেন সুষ্ঠুভাবে আদায় হয়, এ জন্য তাঁর আশ্চর্য দরদ-ফিকির! আল্লাহ তাঁকে উত্তম থেকে উত্তম বিনিময় দান করুন, আমীন।
চৌধুরিপাড়া মসজিদপ্রাঙ্গনে ইজতিমাঈ দু‘আ হলো। শত শত মানুষ আমাদের সঙ্গে দু‘আয় শরীক হলেন। কাফেলার লোকদের যত না কান্না তার চেয়ে বেশী কাঁদলেন যারা আমাদের বিদায় জানাতে দু‘আয় শামিল হয়েছেন। রীতিমত কান্নার রোল পড়ে গেলো। কান্নার সৌন্দর্যে গভীরতায় আমি বিস্মিত হলাম, মুগ্ধ হলাম এবং অভিভূত হলাম। কে জানে, এখানে এমন কত বান্দা আছেন যাদের জিসিমে ইহরামের লেবাস নেই, কিন্তু তাদের কলব ও দিল ধারণ করে আছে ইহরামের নূরানি লেবাস। পক্ষান্তরে আমি তো জানি না, জিসিমে যাহিরি ইহরামের সঙ্গে আমার রূহ ও কলব কি পরেছে ইহরামের বাতেনি লেবাস! যাহির তো আসল নয়; যাহির তো বাতিনেরই প্রতিবিম্ব। এমন হওয়া তো বিচিত্র নয় যে, চোখের পানিতে বাইতুল্লাহর কাফেলাকে যারা বিদায় জানাচ্ছেন তারাই আল্লাহর বেশী প্রিয়! এমনকি এটাও তো হতে পারে যে, তাদের আহাযারির ওছিলায় আমাদের হজ্ব কবুল হয়ে যাবে! গায়বের খবর তো শুধু আল্লাহ জানেন।
মুনাজাতের পর কোলাকুলি ও মুছাফাহার আশ্চর্য মধুর এক দৃশ্যের অবতারণা হলো। দেখতে নিরীহ মধ্যবয়স্ক একজন ইমাম ছাহেবের হাত ধরে জারজার হয়ে কাঁদলেন, বললেন, ‘হুযূর! প্রতিবছর নিয়ত করি, চেষ্টা করি, কিন্তু আসমান থেকে আমার নাম আসে না। এবার আপনি খাছ করে দু‘আ করবেন যেন আগামী বছরই আল্লাহ আমাকে কবুল করেন। গায়ব থেকে যেন আমার সব ইনতিযাম হয়ে যায়।’
এক বুড়ো মানুষ, হাঁটতে বেশ কষ্ট হয়, ধীরে ধীরে আমার কাছে এলেন। মুছাফাহা করে বললেন, ইমাম সাহেবের কাছে আপনার পরিচয় পেলাম। আমি হাফেজ্জী হুযূর (রহ.)-এর মুরীদ। ঊনিশ শ বিরাশি সনে হজ্ব করেছি। আপনাকে হযরতের সঙ্গে দেখেছি। তখন তো আপনি বেশ জোয়ান ছিলেন। এখন আপনাকে চিনতেই পারিনি।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম আশি ছুঁই ছুঁই বুড়ো মানুষটির দিকে। নূরানি চেহারা। বলে দিতে হয় না যে, আল্লাহর কোন নেক বান্দার ছোহবত লাভ করেছেন। আর হযরত হাফেজ্জী হুযূরের ছোহবত লাভ করেছেন, এমন লোকদের তো আলাদা করেই চেনা যায়। আফসোস, হযরত হাফেজ্জী হুযূরকে যারা দু’চোখে দেখেছেন এবং ফয়য লাভ করেছেন, তাদের সংখ্যা প্রতিদিনই কমছে।
মনে পড়ে, হযরত হাফেজ্জী হুযূর (রহ.) বলতেন, একসময় মানুষ এমন কাউকে তালাশ করবে যে হযরত হাকীমুল উম্মত থানবী (রহ.) কে দেখেছে, কিন্তু পাবে না।
সে কথা প্রায় সত্য হতে চলেছে, আর এখন তো তার নিজের ক্ষেত্রেও সত্য হতে বড় বেশী বিলম্ব নেই।
মুরুবিবকে বললাম, ‘আলহামদু লিল্লাহ, আজ সফরের শুরুতে আপনার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। দু‘আ করবেন, আল্লাহ যেন সবকিছু আসান করে দেন এবং মকবূল হজ্ব নছীব করেন।’
তিনি আবারো বললেন, ‘আপনাকে দেখে আমি কিন্তু চিনতেই পারিনি। তখন তো আপনি বেশ জোয়ান ছিলেন।’ আমি মৃদু হেসে বললাম, জ্বি চিনতে না পারারই কথা। সময় তো আর বসে নেই। চুল-দাড়িতে সময়ের রঙ তো পড়েই চলেছে। আপনিও কি আর তখন এখনকার মত ছিলেন!
(চলবে ইনশাআল্লাহ)