রমযান-পরবর্তী জীবন ॥
অব্যাহত থাকুক রমযানের আমলের ধারা
মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ
মাহে রমযানের পবিত্র আঁচল আমাদের ছুঁয়ে গেল। আল্লাহর বিশেষ রহমত ও অবারিত মাগফিরাতের এই মাসে আমরা রোযা, তারাবী-তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াতে কুরআন, যিকির-ইস্তিগফার ইত্যাদির অপূর্ব সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু রমযানের বিদায় মানেই কি এসকল আমল-ইবাদতের বিদায়, নাকি একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা, যেখানে রমযানের শিক্ষা ও অর্জনকে জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ধারণ করতে হবে?
রমযান আমাদের কত কী দিয়েছে– এ নিয়ে ভাবনা এবং শাওয়াল থেকে শুরু করে বছরের বাকি দিনগুলোতে কীভাবে আমরা রমযানের অর্জন ও আমলের ধারা অব্যাহত রাখতে পারি– তা-ই এই প্রবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
এক.
তাকওয়া : রমযানের প্রধান অর্জন
আল্লাহ তাআলা বলেন–
یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا کُتِبَ عَلَیۡکُمُ الصِّیَامُ کَمَا کُتِبَ عَلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکُمۡ لَعَلَّکُمۡ تَتَّقُوۡنَ.
হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোযা ফরয করা হয়েছে, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রতি ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমাদের মধ্যে তাকওয়া সৃষ্টি হয়। –সূরা বাকারা (০২) : ১৮৩
রমযানের রোযা ও ইবাদতের মাধ্যমে অন্তরে তাকওয়ার যে বীজ রোপিত হয়েছে, তা যেন অঙ্কুরিত হয়ে, পত্র-পল্লবে বিকশিত হয়ে, শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ছায়াদান করে বছরব্যাপী।
তাকওয়া হল আল্লাহভীতির সাথে তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলার দৃঢ় প্রত্যয়। রমযানে আমরা দিনভর পানাহার ও প্রবৃত্তির চাহিদা থেকে বিরত থেকে এই গুণটির চর্চা করেছি। এখন চ্যালেঞ্জ হল, এই তাকওয়াকে শানিত করা ও জীবনব্যাপী ধারণ করা।
যেভাবে তাকওয়া স্থায়ী ও শানিত হয়
নিয়মিত মুহাসাবা করি। প্রতিদিন রাতের শেষ প্রহরে কিছুক্ষণ নিজের আমল-আচরণ পর্যালোচনা করি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَه، وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ.
বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে নিজের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২৪৫৯
খলীফাতুল মুসলিমীন হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর বিখ্যাত উক্তি স্মরণ রাখি। তিনি বলেন–
حَاسِبُوا أَنْفُسَكُمْ قَبْلَ أَنْ تُحَاسَبُوا.
তোমাদের হিসাব নেওয়ার পূর্বে তোমরা নিজেরাই নিজেদের হিসাব নাও। –জামে তিরমিযী, বর্ণনা ২৪৫৯
গোনাহ থেকে দূরে থাকি। রমযানে যেমন গোনাহ থেকে দূরে থাকতাম। রোযার ক্ষতি হয়– এমনকিছু থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতাম, তেমনি রমযানের পরেও সব ধরনের গোনাহের ব্যাপারে সতর্ক থাকি, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখি।
স্মরণ রাখি, রোযা অবস্থায় ওযু করতে গিয়ে কত সতর্ক থেকেছি; কোনোভাবেই যেন পানি গলার ভেতর যেতে না পারে। আবার ওযু শেষে বারবার থুথু ফেলেছি; যাতে কুলি করার কারণে পানির যে অংশ মুখে থেকে যায়, তা যেন ভেতরে চলে না যায়। (যদিও ওযুর পর এভাবে বারবার থুথু ফেলা জরুরি নয়; কিন্তু এটা আমাদের বাড়তি সতর্কতা।) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেও যদি আমরা আল্লাহর আদেশ-নিষেধের ব্যাপারে এমন সতর্ক থাকি, তাহলেই আমাদের রোযার অর্জন সার্থক হবে।
দুই.
তওবা-ইস্তিগফার ও গুনাহ থেকে দূরে থাকা
রমযানে আমরা ইফতারের আগের দুআয়, তারাবীর পর, তাহাজ্জুদে, ফরয নামাযের পর বারবার আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করেছি; চোখের পানি ফেলে গোনাহের জন্য ক্ষমা চেয়েছি, কৃত পাপ থেকে তওবা করেছি। রমযান-পরবর্তী জীবনেও আমরা তওবা-ইস্তিগফারের এই আমল জারি রাখতে পারি। সকাল-সন্ধ্যায় ইস্তিগফারের আমল করি। দৈনিক কমপক্ষে ১০০ বার ইস্তিগফার পাঠ করি এবং দিল থেকে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
يَا أَيُّهَا النَّاسُ، تُوبُوا إِلَى اللهِ، فَإِنِّي أَتُوبُ فِي اليَوْمِ إِلَيْهِ مِائَةَ مَرَّةٍ.
হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো। নিশ্চয়ই আমি প্রতিদিন তাঁর কাছে এক শ বার তওবা করি। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭০২
অনেকেই আছি, রমযানে ইবাদতে পূর্ণতা আনতে পারিনি বা গোনাহে জড়িয়ে পড়েছি, তাদের জন্য সুসংবাদ হল, আল্লাহর রহমতের দরজা সারা বছর খোলা।
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
إِنَّ اللهَ عز وجل يَبْسُطُ يَدَه بِاللَّيْلِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ النَّهَارِ، وَيَبْسُطُ يَدَه بِالنَّهَارِ لِيَتُوبَ مُسِيءُ اللَّيْلِ حَتَّى تَطْلُعَ الشَّمْسُ مِنْ مَغْرِبِهَا.
আল্লাহ তাআলা রাতে তাঁর (ক্ষমার) হাত প্রসারিত করেন, যাতে দিনের অপরাধী তওবা করতে পারে এবং দিনে তাঁর (ক্ষমার) হাত প্রসারিত করেন, যাতে রাতের অপরাধী তওবা করতে পারে। সূর্য পশ্চিম দিক থেকে উদিত হওয়া (কিয়ামতের আগ) পর্যন্ত এ সুযোগ অবারিত। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৭৫৯
গোনাহের পুনরাবৃত্তি রোধ করি। এমন যেন না হয়, রমযান শেষ, তো পুনরায় গোনাহে জড়ানো যাক। নাউযুবিল্লাহ।
তবে আমরা কেউই আত্মবিশ্বাস না হারাই; কোনো গোনাহ হয়ে গেলে সাথে সাথে তওবা করে নিই।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
ما مِنْ عَبدٍ يُذْنِبُ ذنباً فيُحسنُ الطهُورَ، ثم يقومُ فيصلي ركعتين، ثم يستغفِرُ الله إلا غفر الله له.
যে বান্দা কোনো গোনাহ করে, তারপর উত্তমরূপে ওযু করে এবং দুই রাকাত সালাত আদায় করে, এরপর আল্লাহ তাআলার নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা করে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ১৫২১
তিন.
আমল-ইবাদতের ধারাবাহিকতা
রমযানের রোযা, তারাবী, তাহাজ্জুদ ও কুরআন তিলাওয়াতের ধারা যেন শাওয়ালে থেমে না যায়। ফরয রোযার স্থলে নফল রোযা, তারাবীর স্থলে সাধারণ নফল নামায, তাহাজ্জুদ, তিলাওয়াত ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা রমযানের আমলের ধারা বজায় রাখতে পারি–
১. নফল রোযা
ক. শাওয়ালের ৬ রোযা
রমযানের পর প্রথমেই শাওয়ালের ৬ রোযা রেখে ফেলার চেষ্টা করি। এ রোযার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
مَنْ صَامَ رَمَضَانَ ثُمّ أَتْبَعَه سِتّا مِنْ شَوّالٍ، كَانَ كَصِيَامِ الدّهْرِ.
যে রমযানের রোযা রাখল এবং শাওয়ালে ছয় রোযা রাখল, সে যেন সারা বছর রোযা রাখল। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৪
খ. আশারায়ে যিলহজ্ব ও ইয়াওমে আরাফার রোযা
এরপরই শুরু হয় হজ্বের মাস। হজ্বের মাসের রোযাগুলোও রাখতে পারি। যেমন, যিলহজ্বের নয় দিনের রোযা, বিশেষত ইয়াওমে আরাফা বা নয় যিলহজ্বের রোযা।
যিলহজ্বের নয় দিনের রোযার বিষয়ে হাদীস শরীফে এসেছে–
كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَصُومُ تِسْعَ ذِي الْحِجّةِ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিলহজ্বের নয় দিন রোযা রাখতেন। –সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ২৪৩৭
ইয়াওমে আরাফার (নয় যিলহজ্বের) রোযার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
صِيَامُ يَوْمِ عَرَفَةَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَه، وَالسنَةَ الّتِي بَعْدَه.
আরাফার দিনের রোযার বিষয়ে আমি আল্লাহর কাছে প্রত্যাশা করি যে, (এর দ্বারা) বিগত বছরের এবং পরবর্তী বছরের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
গ. মুহাররম ও আশুরার রোযা
যিলহজ্বের পর শেষ হয় বছর। আসে নতুন বছর। সেই নতুন বছরের প্রথম মাস মুহাররম। এ মাসেও আমরা রোযা রাখতে পারি। রাখতে পারি আশুরার রোযা। আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.
রমযানের পর উত্তম রোযা হচ্ছে আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর উত্তম নামায হচ্ছে রাতের নামায। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩
আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে ইরশাদ হয়েছে–
صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السّنَةَ الّتِي قَبْلَهُ.
আশুরার রোযা সম্পর্কে আমি আল্লাহর কাছে আশাবাদী যে, এর দ্বারা তিনি বিগত বছরের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
ঘ. শাবান মাসের রোযা
এছাড়া শাবান মাসে বেশি বেশি রোযা রাখতে পারি। এ মাসে অধিক পরিমাণে রোযা রাখা উত্তম। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন–
لَمْ يَكُنْ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ فِي الشّهْرِ مِنَ السّنَةِ أَكْثَرَ صِيَامًا مِنْهُ فِي شَعْبَانَ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাস ব্যতীত বছরের অন্য কোনো মাসে এত অধিক (নফল) রোযা রাখতেন না। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭৮২
ঙ. আইয়ামে বীযের রোযা
এছাড়া প্রতি মাসে আইয়ামে বীযের রোযা রাখি। অর্থাৎ প্রত্যেক চান্দ্র মাসের ১৩, ১৪, ১৫ তারিখ রোযার ইহতিমাম করি। প্রতি মাসে এই তিন দিন রোযা রাখলে পুরো মাসের রোযা রাখার সওয়াব। হাদীসে এসেছে–
صَوْمُ ثَلَاثَةِ أَيّامٍ مِنَ الشّهْرِ، صَوْمُ الشّهْرِ كُلِّه.
মাসে তিন দিন রোযা রাখা পুরো মাস রোযা রাখার সমান। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৫৯
আরেক হাদীসে এসেছে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন–
ثَلَاثٌ مِنْ كُلِّ شَهْرٍ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، فَهَذَا صِيَامُ الدّهْرِ كُلِّه.
প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখা এবং রমযান মাসের রোযা সারা বছর রোযা রাখার সমতুল্য। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২
চ. সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা
নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি বৃহস্পতিবার ও সোমবার রোযা রাখতেন। তিনি বলেন–
تُعْرَضُ الأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالخَمِيسِ، فَأُحِبّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ.
حَدِيثُ أَبِي هُرَيْرَةَ فِي هَذَا البَابِ حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.
সোম ও বৃহস্পতিবার বান্দার আমলসমূহ আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি যে, আমি রোযা অবস্থায় আমার আমল পেশ হোক। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪৭
২. নফল নামায
যতদূর সম্ভব হয় নফল নামায আদায়ের ইহতিমাম করব। যেমন–
ক. তাহাজ্জুদ
শেষ রাতে উঠে তাহাজ্জুদের আমল করতে পারি। রাতের নীরবতা কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সাথে কথোপকথনের এই সুযোগ ছাড়ব না। তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও ফযীলত প্রসঙ্গে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
أَفْضَلُ الصّلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.
ফরয নামাযের পর সর্বোত্তম (নফল) নামায হল, রাতের নামায তথা তাহাজ্জুদ। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩
খ. ইশরাক ও চাশত
সূর্যোদয়ের পর থেকে সূর্য একেবারে মাথার ওপর আসার আগ পর্যন্ত এ সময়ে কোনো ফরয নামায না থাকলেও নফল নামায রয়েছে। তাই এ সময়েও চাইলে আমরা কিছু নফল নামায আদায় করতে পারি। যেমন, সূর্যোদয়ের পরপর দুই রাকাত এবং রৌদ্রতাপ কিছুটা বাড়লে চার রাকাত নামায আদায় করতে পারি।
নামাযের রাকাত-সংখ্যা নির্ধারিত নয়। কেউ যদি দুই রাকাত পড়ে, তাহলেও এই নফল নামাযটি আদায় হবে। আট রাকাত, চার রাকাত সব রকম বর্ণনাই রয়েছে। অতএব কমপক্ষে দুই রাকাত পড়ার চেষ্টা করি। চাইলে এর বেশিও পড়তে পারি। [দ্র. সহীহ ইবনে হিব্বান হাদীস ২৫৩১; সহীহ মুসলিম হাদীস ৭১৯]
হাদীস শরীফে চাশতের নামায তথা সালাতুদ দুহার অনেক ফযীলত এসেছে। যেমন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের প্রত্যেকের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জোড়া-গ্রন্থির ওপর সদকা রয়েছে। অতএব (এর জন্য) প্রত্যেক তাসবীহ সদকা হবে। প্রত্যেকটি তাহমীদ (আলহামদু লিল্লাহ বলা) সদকা হবে, প্রত্যেকটি তাহলীল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা) সদকা হবে, প্রত্যেকটি তাকবীর (আল্লাহু আকবার বলা) সদকা হবে, আমর বিল মারূফ সদকা হবে, নাহি আনিল মুনকার সদকা হবে। (অর্থাৎ এর প্রত্যেকটি দ্বারা ঐ সদকা আদায় করা যাবে।) আর এর প্রত্যেকটির জন্য চাশতের দুই রাকাত নামাযই যথেষ্ট হবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২০
অন্যত্র হাদীসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেছেন–
ابْنَ آدَمَ ارْكَعْ لِي أَرْبَعَ رَكَعَاتٍ مِنْ أَوّلِ النّهَارِ أَكْفِكَ آخِرَهُ.
قال الترمذي: هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.
হে আদম সন্তান! তুমি দিনের শুরুতে আমার জন্য চার রাকাত নামায আদায় কর, আমি পুরো দিন তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাব। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৭৫
গ. দিন-রাতের ১২ রাকাত সুন্নত
এছাড়া প্রতিদিনের ফরয নামাযের আগে ও পরে মোট ১২ রাকাত সুন্নতে মুআক্কাদাহ নামায অবশ্যই আদায় করব। এটা যেন আমার থেকে কখনোই না ছোটে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
مَنْ صَلّى اثْنَتَيْ عَشْرَةَ رَكْعَةً فِي يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ، بُنِيَ لَهُ بِهِنّ بَيْتٌ فِي الْجَنّةِ.
যে ব্যক্তি দিবারাত্রিতে ১২ রাকাত (সুন্নত) নামায আদায় করবে, বিনিময়ে তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর নির্মাণ করা হবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৭২৮
আসর নামাযের পূর্বেও চার রাকাত নামাযের কথা হাদীসে এসেছে। যদিও তা সুন্নতে মুআক্কাদার অন্তর্ভুক্ত নয়, তবুও সম্ভব হলে তা আদায় করার চেষ্টা করি। হাদীসে এ নামাযেরও বিভিন্ন ফযীলতের কথা এসেছে। [দ্র. জামে তিরমিযী, হাদীস ৪৩০]
ঘ. তাহিয়্যাতুল মাসজিদ
আমরা যখনই মসজিদে যাব, দুই রাকাত তাহিয়্যাতুল মাসজিদ আদায় করতে চেষ্টা করব।
হাদীস শরীফে এসেছে, তোমাদের কেউ মসজিদে প্রবেশ করলে সে যেন দুই রাকাত নামায পড়া ছাড়া না বসে। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৪৪
ঙ. তাহিয়্যাতুল ওযু
প্রতিবার ওযুর পর তাহিয়্যাতুল ওযুর নামায আদায় করা অনেক ফযীলতের আমল।
উকবা ইবনে আমের রা. থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন–
مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَتَوَضَّأُ فَيُحْسِنُ وُضُوءَه، ثُمَّ يَقُومُ فَيُصَلِّي رَكْعَتَيْنِ، مُقْبِلٌ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِه وَوَجْهِه، إِلّا وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ.
কোনো মুসলিম যখন উত্তমরূপে ওযু করে, অতঃপর দুই রাকাত নামায এমনভাবে আদায় করে যে, তার চেহারা ও অন্তুর তথা দেহ-মন পূর্ণ আল্লাহ-অভিমুখী থাকে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৩৪
চ. সাধারণ নফল নামায
সময়ে-সুযোগে সাধ্যমতো সাধারণ নফল নামায আদায় করতে চেষ্টা করব।
কিয়ামত দিবসে নফল নামায মুমিনের জন্য ভরপুর কল্যাণ বয়ে আনবে। নফলের মাধ্যমে ফরযের ঘাটতি পুরা করা হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন বান্দার প্রথম হিসাব হবে নামাযের। যদি তা যথাযথ পাওয়া যায়, তাহলে বান্দা সফল ও কৃতকার্য। আর যদি তা যথাযথ পাওয়া না যায়, তাহলে বান্দা অকৃতকার্য ও ব্যর্থ হবে।
ফরযের মাঝে যদি কোনো ঘাটতি থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘দেখো, আমার বান্দার কিছু নফল (নামায) আছে কি না?’ যদি থাকে, তাহলে ফরয নামাযের ঘাটতি নফল দ্বারা পূর্ণ করে দেওয়া হবে। তারপর অন্যান্য আমলের হিসাবও একই পদ্ধতিতে গ্রহণ করা হবে। (অর্থাৎ ফরযের ঘাটতি নফলের মাধ্যমে পুরা করা হবে।) –জামে তিরমিযী,
হাদীস ৪১৩
৩. তিলাওয়াতে কুরআন
কুরআন কারীমের তিলাওয়াত অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ ও মর্যাদাসম্বলিত একটি আমল। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন–
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللهِ فَلَه بِه حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الٓمّٓ حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ.
قال الترمذي : هذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ غَرِيبٌ مِنْ هذَا الوَجْهِ.
যে ব্যক্তি কুরআনের একটি হরফ পাঠ করল, তার বিনিময়ে সে একটি নেকী লাভ করল। উক্ত একটি নেকী দশ নেকীর সমতুল্য গণ্য করা হবে। আমি বলছি না যে, ‘আলিফ-লাম-মীম’ একটি হরফ। বরং ‘আলিফ’ একটি হরফ, ‘লাম’ একটি হরফ এবং ‘মীম’ একটি হরফ। –জামে তিরমিযী, হাদীস ২৯১০
তাই প্রতিদিন তিলাওয়াত করি। অল্প হলেও নিয়মিত পড়ি। কিয়ামতের দিন এই কুরআন আমার জন্য সুপারিশ করবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
اقْرَءُوا الْقُرْآنَ فَإِنّه يَأْتِي يَوْمَ الْقِيَامَةِ شَفِيعًا لِأَصْحَابِه.
তোমরা কুরআন পাঠ করো। কেননা তা কিয়ামতের দিন পাঠকারীদের জন্য সুপারিশ করবে। –সহীহ মুসলিম, হাদীস ৮০৪
সম্ভব হলে প্রতিদিন সহজবোধ্য নির্ভরযোগ্য কোনো তাফসীর অধ্যয়ন করি। রমযানে তারাবীর আগে-পরে এবং অন্য সময়ে উলামায়ে কেরামের মুখে শোনা তাফসীরের সেই ধারা রমযানের পরও জারি রাখি।
৪. যিকির ও দুআ
দুআ ও যিকিরের ইহতেমাম করি। সব সময় যেন আমার যবান যিকিরে সিক্ত থাকে।
আবদুল্লাহ ইবনে বুসর রা. থেকে বর্ণিত, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! শরীয়তের বিধান তো অনেক; আমাকে এমন একটি বিষয় বলুন, যা আমি দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে পারি (সহজে আমল করতে পারি)।
উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন–
لَا يَزَالُ لِسَانُكَ رَطْبًا مِنْ ذِكْرِ اللهِ.
তোমার জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকিরে সিক্ত থাকে। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৩৭৫
দুআ একটি স্বতন্ত্র ইবাদত; আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম। দুআর মাধ্যমে আল্লাহর সামনে আমাদের আবদিয়াত ও দাসত্বের প্রকাশ ঘটে। সুতরাং বেশি বেশি দুআ করার চেষ্টা করি।
দুআর ফযীলত বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
إِنَّ اللهَ حَيِيٌّ كَرِيمٌ يَسْتَحْيِي إِذَا رَفَعَ الرَّجُلُ إِلَيْهِ يَدَيْهِ أَنْ يَرُدَّهُمَا صِفْرًا خَائِبَتَيْنِ.
নিশ্চয়ই আল্লাহ পরম লজ্জাশীল ও মহানুভব। বান্দা যখন হাত তোলে, তখন তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দিতে লজ্জাবোধ করেন। –জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৫৫৬
এছাড়া আমরা সকাল-সন্ধ্যার তাসবীহাত আদায় করি। প্রতিটি কাজ সুন্নত মোতাবেক করি। প্রতিটি আমলের মাসনূন দুআগুলো পড়ার ইহতিমাম করি।
চার.
দান-সদকা
রমযানে রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দান অনেক বেশি বেড়ে যেত। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন–
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানুষের মাঝে শ্রেষ্ঠ বদান্যশীল ছিলেন। তাঁর এই বদান্যতার চূড়ান্ত প্রকাশ হত রমযানে; যখন জিবরীল আ. তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতেন। জিবরীল আ. রমযানের প্রতি রাতে আগমন করতেন এবং পরস্পর কুরআন শোনাতেন। আল্লাহর রাসূল তখন কল্যাণবাহী বায়ুর চেয়ে অধিক কল্যাণবর্ষী ছিলেন। –সহীহ বুখারী, হাদীস ৫
আমরা রমযানে দান-সদকা করেছি। কিন্তু এটি যেন কেবল রমযানেই সীমাবদ্ধ না থাকে। বরং সারা বছরই আমাদের দানশীলতার এই ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।
তাই আমরা নিয়মিত দান-সদকা করার চেষ্টা করব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন–
مَا مِنْ يَوْمٍ يُصْبِحُ الْعِبَادُ فِيهِ إِلّا مَلَكَانِ يَنْزِلَانِ فَيَقُولُ أَحَدُهُمَا: اللّهُمّ أَعْطِ مُنْفِقًا خَلَفًا وَيَقُولُ الْآخَر: اللّهُمّ أَعْطِ مُمْسِكًا تَلَفًا.
প্রতিদিন সকালে দুইজন ফেরেশতা দুআ করেন। একজন দুআয় বলে– হে আল্লাহ! দানকারীকে প্রতিদান দাও। অন্যজন বলে– হে আল্লাহ! কৃপণের সম্পদ ধ্বংস করো। –সহীহ বুখারী, হাদীস ১৪৪২
নিজের সাধ্যের মধ্যে সমাজসেবা জারি রাখি। এতীম, বিধবা ও অসহায়দের পাশে দাঁড়াই।
আল্লাহ আমাদের সকলকে রমযানের আমলের ধারা অব্যাহত রাখার তাওফীক দান করুন। ঈমান ও নেক আমলের যিন্দেগী নসীব করুন– আমীন।