শাওয়াল ১৪৪৬   ||   এপ্রিল ২০২৫

আমেরিকা-ইসরাইল-ফিলিস্তিন ॥
বিশ্লেষণধর্মী কয়েকটি নিবন্ধ

ওয়াসআতুল্লাহ খান

[ওয়াসআতুল্লাহ খান সিনিয়র সাংবাদিক এবং বিবিসি উর্দূ ও এক্সপ্রেস নিউজ নেটওয়ার্ক-এর নিয়মিত কলাম লেখক তূফানুল আকসা শুরুর পর তিনি ফিলিস্তিন-হামাস, ইসরাইল-আমেরিকা নিয়ে নিয়মিত লিখে চলেছেন তার প্রতিটি লেখাই বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যবহুল

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় তাঁর তিনটি লেখা মাসিক আলকাউসার-এর পাঠকদের খেদমতে পেশ করা হল লেখা তিনটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ফাহাদ]

 

আমেরিকার কোন্ ব্যক্তি ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত হতে পারে

এখন পর্যন্ত ২৩ জন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ইসরাইলে দায়িত্ব পালন করেছে ১৯৯৫ সালের আগে কোনো ইহুদী আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইসরাইলে নিয়োগ লাভ করেনি তবে যারাই ইসরাইলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে, তাদের অধিকাংশ পরোক্ষভাবে অবশ্যই জায়নবাদী অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে আজ পর্যন্ত আমেরিকার কোনো মুসলিম নাগরিককে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়নি; বরং ইসরাইলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার আগে তাদের অধিকাংশই হয়তো মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে অথবা এতদসংশ্লিষ্ট বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য আমেরিকার নীতিকে বহাল রাখতে নিজেদের আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক কার্যক্রম যথারীতি পালন করেছে উদাহরণস্বরূপ, ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার প্রথম রাষ্ট্রদূত জেমস গ্রোভার ম্যাকডোনাল্ড (James Grover McDonald) কোনো পেশাদার রাষ্ট্রদূত ছিল না তাকে বরং ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের বিষয়ে তার অসামান্য অবদানের জন্য মার্চ ১৯৪৯ সালে প্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়

জেমস ম্যাকডোনাল্ড ছিল ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৫ পর্যন্ত লীগ অব নেশনসের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার এ সুবাদে জার্মানিতে হিটলারের হাতে নির্যাতিত ইহুদীদের ফিলিস্তিনে স্থানান্তরের বিষয়ে দূতাবাসের সহযোগিতা লাভের জন্য সে সবরকম প্রচেষ্টা চালায় এ সময়ে জায়নবাদী নেতা খায়েম ব্যাজম্যানের (Chaim Azriel Weizmann) সাথে তার বন্ধুত্ব হয় ব্যাজম্যান পরে ইসরাইলের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয় জেমস ম্যাকডোনাল্ড রাষ্ট্রপতি রোজব্যাল্ট (Theodore Roosevelt)-এরও শরণার্থী বিষয়ক উপদেষ্টা ছিল

১৯৪৫ সালে গঠিত ফিলিস্তিন বিষয়ক অ্যাংলো-আমেরিকান ইনকোয়ারি কমিটিরও সে (Anglo-American Committee of Inquiry) সদস্য ছিল যে কমিটি ইউরোপে নির্যাতনের শিকার ১ লক্ষ ইহুদীকে ফিলিস্তিনে জরুরি পুনর্বাসনের সুপারিশ করেছিল ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দেড় মাস পরে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী হেরী ট্রুম্যান (Harry S. Truman) ১৯৪৮ সালের জুনে জেমস ম্যাকডোনাল্ডকে ইসরাইলের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করে আর ১৯৪৯ সালে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হয়

পৌনে দুই বছর দায়িত্ব পালনকালে জেমস ম্যাকডোনাল্ড নবগঠিত ইসরাইলের জন্য আমেরিকার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে প্রথমদিকে আমেরিকার প্রশাসন পশ্চিম জেরুজালেমে ইসরাইলের অধিগ্রহণকে স্বীকৃতি দেয়নি যার দরুন আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জেরুজালেমে ইসরাইলের পার্লামেন্টের উদ্বোধনী অধিবেশনে রাষ্ট্রদূত জেমস ম্যাকডোনাল্ডকে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিল কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড বিতর্কিত পশ্চিম জেরুজালেমে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড গোরিয়ানের (David Ben-Gurion) সাথে সাক্ষাৎ করে আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরোক্ষ নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখায়

ইহুদীদের উগ্রবাদী সশস্ত্র সংগঠন ইরগান (Irgun) -এর প্রধান মেনাখেম বেগিন (Menachem Begin)-এর আমেরিকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার ও ভিসা প্রদানের জন্য ম্যাকডোনাল্ড আপ্রাণ চেষ্টা করে এবং সফল হয় পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে মেনাখেম বেগিন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়

অবসর গ্রহণের পর জেমস ম্যকডোনাল্ড আমেরিকান জায়নবাদী সংগঠনগুলোর সাথে সক্রিয় থাকে তার ব্যক্তিগত ডায়েরিগুলো ওয়াশিংটনের জাতীয় হলোকাস্ট জাদুঘরের (United States Holocaust Memorial Museum) আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে মা জার্মান হওয়ার সুবাদে জার্মান ভাষা ছিল তার একরকম মাতৃভাষার মতোই

চার খণ্ডে প্রকাশিত তার ডায়েরিগুলো থেকে জানা যায়, ১৯৩০-এর দশকে লীগ অব ন্যাশনস-এর হাই কমিশনার হিসেবে নাৎসি শাসকদের সাথে কথাবার্তা থেকেই জেমস ম্যাকডোনাল্ড আঁচ করতে পেরেছিল, নাৎসিরা ইহুদীদের নির্মূল করার ছক আঁকছে কিন্তু আমেরিকাসহ লীগ অব নেশনস-এর কোনো সদস্য তার এ সতর্কতাকে পাত্তা দেয়নি ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে জেমস ম্যাকডোনাল্ড মৃত্যুবরণ করে ইসরাইলের নেতানিয়া শহরে তার নামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে

ওয়ালওয়ার্থ বারবার (Walworth Barbour) ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার পঞ্চম রাষ্ট্রদূত হলেও ১৯৬১ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত (বারো বছর) এই পদে দায়িত্ব পালন করে আর এ সময়ে সে আমেরিকার তিনজন রাষ্ট্রপতিকে ইসরাইল বিষয়ে পরামর্শ প্রদান করে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার (Golda Meir) একবার ওয়ালওয়ার্থ সম্পর্কে বলেছিল, যতদিন হোয়াইট হাউসে নিক্সন আর ইসরাইলে ওয়ালি (ওয়ালওয়ার্থ) থাকবে, ততদিন আর কোনো আমেরিকান-ইসরাইল ফ্রেন্ডশীপ সোসাইটির প্রয়োজন নেই

ওয়ালওয়ার্থ রাষ্ট্রদূত হওয়ার পরপরই ইসরাইলের গোপন পরমাণু কার্যক্রম শুরু হয় জুন ১৯৬৬ সালে ইসরাইল মিশরের সিনাই উপত্যকা ও জর্ডান থেকে পশ্চিম তীর ছিনিয়ে নেয় ১৯৮২ সালের জুলাইয়ে ওয়ালওয়ার্থ মৃত্যুবরণ করে তার নামে ইসরাইলের  ইয়াহুদ (Yehud) প্রদেশে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে আর তেলআবিবের একটি মহল্লাও তার নামে নামকরণ করা হয়েছে

অষ্টম মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্যামুয়েল লুইস (Samuel Winfield Lewis) ইসরাইলে আট বছর (১৯৭৭ থেকে ১৯৮৫) দায়িত্ব পালন করে এ সময়ে সে আমেরিকার দুজন রাষ্ট্রপতির [জিমি কার্টার (Jimmy Carter) ও রেগন (Ronald Wilson Reagan)] সমর্থন লাভ করে স্যামুয়েল ইসরাইল ও মিশরের মধ্যে ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি (Camp David Accords) আলোচনা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চুক্তি অনুযায়ী দেশদুটি একে অপরকে কূটনৈতিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে আর ইসরাইল সিনাই উপত্যকা মিশরকে ফিরিয়ে দেয় স্যামুয়েল ছিল দ্বি-জাতি-সমাধান তত্ত্বের পূর্ণ সমর্থক আর বুশ জুনিয়রের ইরাক নীতির কট্টর সমালোচক ২০১৪ সালের মার্চে তার মৃত্যু হয়

মার্টিন ইন্ডিক (Martin Sean Indyk) আমেরিকার ত্রয়োদশ ও ইহুদী বংশোদ্ভূত প্রথম রাষ্ট্রদূত ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ ও ২০০০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করে এরপর দীর্ঘ ১৭ বছর মার্টিন আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতির ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী এক নেতৃস্থানীয় ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশন (Brookings Institution) থিংক ট্যাংকের ভাইস চেয়ারম্যান ছিল

মার্টিন ছিল পোল্যান্ডের ইহুদী বংশোদ্ভূত তার পরিবার প্রথমে অস্ট্রেলিয়ায় দেশান্তরিত হয় এরপর ১৯৮২ সালে নিউইয়র্কে এসে থিতু হয় অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও মার্টিন ইসরাইলের হিব্রু ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করে অক্টোবর ১৯৭৩-এর আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মার্টিন একজন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করে এ সময়ে সে ইসরাইলের নাগরিকত্ব লাভেরও চিন্তাভাবনা করে

মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে মার্টিনের গভীর দৃষ্টি ছিল জন হপকিনস ইউনিভার্সিটি, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি ও তেলআবিবের মোশে দায়ান রিসার্চ সেন্টারে (Moshe Dayan Center) মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক বিভিন্ন কোর্স পরিচালনা করে ক্লিনটনের আমলে মার্টিন ছিল ক্লিনটনের বিশেষ সহকারী ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের নিয়ার ইস্ট এন্ড সাউথ এশিয়ান এফেয়ার্স-এর সিনিয়র ডিরেক্টর এ সুবাদে সে ইসরাইল-আরব সম্পর্ক, ইরাক ও উপসাগরীয় দেশগুলোর বিষয়ে নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর আমেরিকা-ইসরাইল সাইন্স ও টেকনোলজি কমিশনের সাথেও সম্পৃক্ত ছিল

এর আগে মার্টিন আমেরিকান ইসরাইল পাবলিক এফেয়ার্স কমিটি (ইপক) (American Israel Public Affairs ommittee (AIPAC)-এর রিসার্চ ডিরেক্টর ও নিউ ইসরাইল ফান্ড (New Israel Fund) নামের একটি আমেরিকান এনজিও-এর বোর্ড সদস্য ছিল এর সুবাদে সে ইসরাইলের বিভিন্ন গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানের জন্য ৩০০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল সংগ্রহ করে

জুলাই ২০১৩ থেকে জুন ২০১৪ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ইসরাইল ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের সাথে বোঝাপড়ার জন্য মার্টিন ইন্ডিককে বিশেষ দূত নিযুক্ত করে এছাড়াও সে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির ওপর প্রভাব সৃষ্টিকারী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ থিংক ট্যাঙ্ক ফরেইন রিলেশনস কাউন্সিল (Council on Foreign Relations)-এর সাথেও সম্পৃক্ত ছিল ২৫ জুলাই ২০২৪ মার্টিন ইন্ডিক মৃত্যুবরণ করে

মার্টিন ইন্ডিক ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার প্রথম ইহুদী রাষ্ট্রদূত হলেও অবসরপ্রাপ্ত অধিকাংশ সরকারি আমলার মতো ইসরাইলের নীতিমালাকে পক্ষপাতিত্বের চোখে দেখার পরিবর্তে সমালোচনার দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছে

২০১৪ সালে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব বিষয়ক আমেরিকার বিশেষ দূতের দায়িত্ব থেকে অবসর গ্রহণের পর মার্টিন ইন্ডিক ইসরাইলের সংবাদমাধ্যম ইহুদ আহারনূতকে ছদ্মনামে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকার প্রদান করে সংবাদপত্রটি ‘আমেরিকার একজন সিনিয়র রাষ্ট্রদূত’-এর বরাতে জানিয়েছে, তার মতে ‘‘ইহুদীদের সম্পর্কে একটি ধারণা হল, এরা খুব মেধাবী এবং ভবিষ্যৎকে নিজের মতো গড়ার সামর্থ্য আছে আর নিজেদের চালচলনে অন্যকে আকৃষ্ট করতেও বেশ পটু কিন্তু মনে হচ্ছে, ফিলিস্তিন বিষয়ে তারা পরিবর্তিত পারিপার্শ্বিক অবস্থা বুঝতে অক্ষম তাদের এখন উপলব্ধি করা দরকার, একবিংশ শতাব্দীর এই বিশ্ব দুনিয়ার কোনো অঞ্চলেই হস্তক্ষেপ বরদাশত করবে না উপরন্তু এই হস্তক্ষেপ ইসরাইলের দীর্ঘস্থায়িত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে ফিলিস্তিনীরা একসময় তাদের রাষ্ট্র পুনরুদ্ধারে সমর্থ হয়ে ওঠবে তা কঠোরতার মাধ্যমে হোক কিংবা বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের সহযোগিতায় ইসরাইলীদের ‘দেয়ালের লেখা’ও পড়া দরকার’’

মার্টিন ইন্ডিকের পরেও যাদেরকে ইসরাইলে রাষ্ট্রদূত হিসেবে পাঠানো হয়েছে তাদের অধিকাংশই ছিল ইহুদী বংশোদ্ভূত এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তারা ‘অব দ্যা রেকর্ড’ বলে থাকে, কোনো রাষ্ট্রদূতের ইহুদী হওয়া ইসরাইলী এস্টাবলিশমেন্ট ও সমাজ বোঝার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক হয়

কিন্তু প্রশ্ন হল, এই নীতি শুধু ইসরাইলের জন্যই কেন? আমেরিকার কোনো আরব নাগরিককে আজ পর্যন্ত কেন আরবের কোনো দেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিয়োগ দেওয়া হল না? তবে কি আরব সমাজ ও এর রুচি-প্রকৃতি বোঝা আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্ট-এর কোনো প্রয়োজন নেই? হয়তোবা নেই! 

  

ইসরাইলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হওয়ার মানদণ্ড

আমরা দেখেছি, ইসরাইলে নিয়োগ পাওয়া আমেরিকার কোনো রাষ্ট্রদূতের মধ্যে কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করা হয়, যা অন্য দেশে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হওয়ার মানদণ্ড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা ইসরাইলে নিয়োগ পাওয়া আমেরিকার প্রায় সকল রাষ্ট্রদূত ঐতিহাসিকভাবেই নিজ দেশের চেয়ে ইসরাইলের স্বার্থ ও তার জনগণের অনুভূতিকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছে

মার্টিন ইন্ডিক (Martin Sean Indyk) ১৯৯৫ সালে আমেরিকার প্রথম ইহুদী রাষ্ট্রদূত হিসেবে ইসরাইলে নিয়োগ লাভ করে আর গত ২৩ বছরে ইসরাইলে যে সকল রাষ্ট্রদূত নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছে তাদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ পেশাগত কর্মকাণ্ড থেকে বোঝা যায়, ইসরাইল ও আমেরিকা বাস্তব অর্থেই একে অপরের জন্য কতটা অপরিহার্য

ডেনিয়েল কার্টজার (Daniel Charles Kurtzer) আমেরিকার পররাষ্ট্র অধিদপ্তরে ২৯ বছর দায়িত্ব পালন করে ১৯৯৭ থেকে ২০০১ পর্যন্ত মিশরে আর মার্টিন ইন্ডিকের পর ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ইসরাইলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিল ডেনিয়েল কার্টজার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি (Princeton University ) থেকে মধ্যপ্রাচ্য পলিসি বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণের পর ডেনিয়েল প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক এন্ড ইন্টারন্যাশনাল এফেয়ার্স-এর মধ্যপ্রাচ্য পলিসি স্টাডিজ-এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে মিশর, ইসরাইল ও ইরাক সম্পর্ক বিষয়ে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ ও পরিকল্পনার ক্ষেত্রে বুশ সিনিয়র থেকে ওবামা পর্যন্ত সকল প্রশাসনের সহযোগিতা করে ডেনিয়েল ছিল ইসরাইল বেজবল লীগেরও (Israel Baseball League) কর্ণধার তার ছেলে ইহুদা কার্টজার (Yehuda Kurtzer) একজন প্রসিদ্ধ আমেরিকার জুইশ পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল (American Jewish public intellectual)

ডন শেপরো (Daniel Benjamin Dan Shapiro) ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিল এর আগে ২০০৭-এ ওয়াশিংটনের ইসরাইলপন্থি লবিং গ্রুপ টিমনজ এন্ড কোম্পানি (Timmons & Company)-এর সাথে যুক্ত থাকার সুবাদে ওবামা প্রশাসনকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইহুদী ভোট ব্যাংক সম্পর্কে পরামর্শ প্রদান করে ২০০৯-এর জানুয়ারিতে গঠিত আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল (United States National Security Council)-এর মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা বিষয়ক সিনিয়র ডিরেক্টর ছিল

ডন শেপরো ইসরাইলে ৬ বছর আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করে ২০১৭ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তেলআবিব ইউনিভার্সিটিতে ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিষয়ে অধ্যাপনা করে ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাকে ইরাক বিষয়ে ইসরাইলের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের দায়িত্ব অর্পণ করে বর্তমানে শেপরো ওয়েস্ট এক্সেক (WestExec Advisors LLC) নামের একটি লবিং ফার্মে দায়িত্বরত, যা ২০১৭ সালে এন্টনি ব্লিঙ্কেন (Antony John Blinken) ও ডেভিড কোহেন (David Samuel Cohen) মিলে প্রতিষ্ঠা করে জেরুজালেম পোস্ট-এর জরিপমতে যারা বিশ্বের প্রভাবশালী পঞ্চাশজন ইহুদীর তালিকাভুক্ত

ডন শেপরোর জন্ম এলিনয় (Illinois) রাষ্ট্রের এক রক্ষণশীল ইহুদী পরিবারে কিছু সময় সে ইসরাইলেও পড়াশোনা করে এরপর ১৯৯১ সালে ম্যাসাচুসেটস (Massachusetts) রাষ্ট্রের ব্র্যান্ডিজ ইউনিভার্সিটি (Brandeis University) থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইহুদীবাদ চর্চা (Near Eastern and Judaic Studies) বিষয়ে ব্যাচেলর ডিগ্রি এবং হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটি থেকে মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতি (Middle Eastern Politics) বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করে হিব্রু ও আরবী ভাষায়ও ডন শেপরো ছিল সমান পারদর্শী

ডেভিড ফ্রাইডম্যান (David Melech Friedman) ছিল মে ২০১৭ থেকে ২০২১ পর্যন্ত ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত সে জনৈক আমেরিকান ইহুদী মুরিস ফ্রাইডম্যান (Morris S. Friedman)-এর ছেলে পেশাগত জীবনে ডেভিড ফ্রাইডম্যান একজন উকিল তাকে আমেরিকার উদ্দীপ্ত ইসরাইলপন্থিদের একজন মনে করা হয় অধিগৃহীত পশ্চিম তীরের একটি ইহুদী ল ফার্ম ‘বাইত এল ইনস্টিটিউশনস’ (Bet El Institutions)-এর জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে ফ্রাইডম্যান দুই মিলিয়ন ডলার অনুদান সংগ্রহ করেছিল যে ফার্মটি ইসরাইল-ফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিরসনের দ্বি-জাতি সমাধান তত্ত্বের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই করে আসছিল কারণ সে ছিল ফিলিস্তিন বিষয়ে দ্বি-জাতি সমাধান তত্ত্বের ঘোর বিরোধী ডেভিড ফ্রাইডম্যান ট্রাম্পের (প্রথম মেয়াদে) রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আর নির্বাচনী ইশতিহারে আমেরিকার দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হবে এমন প্রতিশ্রুতিও অন্তর্ভুক্ত করিয়ে নেয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প তার এ প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নও করে এর মধ্য দিয়ে আমেরিকার ঐ পুরোনো নীতিও আনুষ্ঠানিক পূর্ণতা পেল, যার অধীনে ১৯৯৫ সালে কংগ্রেস জেরুজালেম অ্যাম্বেসি অ্যাক্ট পাশ হওয়ার পরও আমেরিকার প্রশাসন তা বাস্তবায়নে শুধু এ কারণে টালবাহানা করছিল যে, জেরুজালেমের ভবিষ্যৎ এখনো চূড়ান্ত হয়নি ট্রাম্পের এই পদপেক্ষের মধ্য দিয়ে আমেরিকা কার্যতভাবে জেরুজালেমকে ইসরাইলের অংশ বলেই স্বীকৃতি প্রদান করল

ট্রাম্প ইসরাইলের রাষ্ট্রদূত হিসেবে ফ্রাইডম্যান-এর নাম প্রস্তাব করার পর ফিলিস্তিনী অথরিটি ছাড়াও আমেরিকার সকল লিবারেল ইহুদী সংগঠন ও কংগ্রেসের উভয়  কক্ষে প্রস্তাবটির কড়া সমালোচনা হয় অবশেষে মাত্র দুই ভোটের ব্যবধানে সিনেট এই নামের মঞ্জুরি প্রদান করে তবে ইসরাইল এস্টাবলিশমেন্ট ও ইহুদী সংগঠনগুলো ডেভিডের নাম প্রস্তাবকে সাধুবাদ জানায়

সম্প্রতি প্রকাশিত ডেভিড ফ্রাইডম্যানের বিতর্কিত বই ‘সমস্যার সমাধান এক রাষ্ট্র’-এ লিখেছে, ‘ফিলিস্তিনীরা আরেকটি রাষ্ট্রের যোগ্য নয় তাদের আগে থেকেই একটি রাষ্ট্র আছে যার নাম জর্ডান বাইবেল অনুযায়ী পশ্চিম তীর ইহুদীদের আর এটি পরিপূর্ণভাবে ইসরাইলের অংশ হওয়াই কাম্য’ জেরুজালেম পোস্টের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের প্রভাবশালী পঞ্চাশজন ইহুদী ব্যক্তির তালিকায় ডেভিড ফ্রাইডম্যান ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আছে ডেভিড ফ্রাইডম্যান ও রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারকে (Jared Corey Kushner) ইসরাইল, বাহরাইন ও আমিরাতের মধ্যকার তথাকথিত ইবরাহীমী চুক্তি সম্পাদন করানোর বদৌলতে নোবেল শান্তি পুরস্কারের সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করা হয় ডেভিডের মেয়ে তালিয়া (Talia Friedman) ২০১৭ সালে ইসরাইলের একক নাগরিকত্ব গ্রহণ করে

থমাস নাইডজ (Thomas Richard Nides) নভেম্বর ২০২১ থেকে জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত ইসরাইলে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ লাভ করে অঙ্গরাষ্ট্র মিনেসোটার (Minnesota) এক ইহুদী আরনল্ড নাইডজ (Arnold Richard Nides) পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আরনল্ড ছিল একজন কট্টর সাম্রাজ্যবাদী এবং ট্যাম্পল ইসরাইল (Temple Israel) নামের একটি সংগঠনেরও প্রধান

থমাস নাইডজ আট বছর পর্যন্ত ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপ মরগন স্টেনলে (Morgan Stanley)-এর চীফ অপারেশনস অফিসার ছিল রাষ্ট্রপতি ওবামা তাকে ম্যানেজমেন্ট ও সম্পদ বিষয়ক (management and resources) মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারির দায়িত্ব প্রদান করে ২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনের পক্ষে প্রচারণা কাজে নাইডজ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে হিলারি ক্লিনটন নির্বাচনে জয়লাভ করলে নাইডজ হত হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফ জেরুজালেম পোস্টের জরিপে নাইডজের নামও ২০২২ সালের বিশ্বের প্রভাবশালী পঞ্চাশ ইহুদীর তালিকায় ছিল সে নিজেকে একজন উদার ও সংস্কারপন্থি ইহুদী দাবি করত তার স্ত্রী ভার্জিনিয়ার নিউজ চ্যানেল সিএনএন-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট

জেক লিউ (Jacob Joseph Lew) ২০২৩ থেকে ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার তেইশতম রাষ্ট্রদূত ইসরাইলে আজ পর্যন্ত যারাই আমেরিকার রাষ্ট্রদূত নির্বাচিত হয়েছে তাদের মধ্যে জেক লিউ একটু ভিন্ন কারণ সে ওবামার শাসন আমলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও হোয়াইট হাউসের চীফ অব স্টাফ-এর মতো নীতিনির্ধারণী পদে দায়িত্ব পালন করেছে জেক লিউ হার্ভার্ড কলেজ (Harvard College) ও জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটি (Georgetown University) থেকে শিক্ষা সমাপন করেছে তারও জন্ম একটি প্রাচীন রক্ষণশীল ইহুদী পরিবারে জেক লিউ সিটি গ্রুপ (সিটি ব্যাংক)-এর চীফ অপারেশনস অফিসার (COO) ও নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট (executive vice-president of operations) আমেরিকা-চীন ন্যাশনাল কনসালটেশন কমিটির প্রধান ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব ইসরাইল বোর্ডের ভাইস প্রেসিডেন্ট এছাড়াও ক্লিনটন ও ওবামা সরকারের আমলে ব্যবস্থাপনাগত বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করে

ইরানের সাথে পরমাণু চুক্তি সম্পাদনের ক্ষেত্রে জেক লিউ সচেষ্ট থাকলেও গাজায় ২০০৯ সালে ইসরাইলের চালানো হত্যাযজ্ঞকে জাতি নিধন আখ্যা দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ডস্টোন রিপোর্ট (Goldstone Report) প্রত্যাহারের জন্য ওবামা প্রশাসনে জেক সবচেয়ে বেশি তৎপরতা চালায়

ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য সময়-সময়ে যারা আমেরিকার বিশেষ দূত নিযুক্ত হয়েছিল, তাদের অধিকাংশের প্রেক্ষাপট ইহুদী যেমন, ক্লিনটনের আমলে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক আমেরিকার বিশেষ দূত ডেনিস রজ (Dennis B. Ross) সানফ্রান্সিসকোর একটি রক্ষণশীল ইহুদী পরিবারের সদস্য বুশ জুনিয়রের আমলে সে ছিল স্টেট ডিপার্টমেন্টের (State Department) পলিসি প্ল্যানিং ডিরেক্টর ((Director of Policy Planning  ) আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের উপসাগর ও দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়া বিষয়ক পরামর্শকও ছিল

বর্তমানে ডেনিস রজ ইসরাইলপন্থি থিংক ট্যাঙ্ক ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নেয়ার ইস্ট পলিসি (Washington Institute for Near East Policy) ছাড়াও জুইশ পিপল পলিসি ইনস্টিটিউটেরও (Jewish People Policy Institute) প্রধান ফিলিস্তিনের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী নাবিল শাআতের (Nabil Ali Muhammad Shaath) ভাষ্য অনুযায়ী ডেনিস রজ ইসরাইলীদের চেয়েও বেশি ইসরাইলপন্থি আমেরিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার ভাষ্য হল, ডেনিস একজন মধ্যস্থতাকারী হওয়া সত্ত্বেও সব বিষয়ে ইসরাইলকে অগ্রাধিকার দিতে অভ্যস্ত ছিল

প্রবন্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার ভয়ে আর নাম অন্তর্ভুক্ত করা হল না তবে গত প্রবন্ধ ও বর্তমান প্রবন্ধ থেকে সহজেই অনুমান হয় যে, আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য-নীতি কেমন নিরাপদ হাতে আছে

 

ইহুদী জনসংখ্যা ও আধিপত্য : একটি সমীক্ষা

এই তো কদিন আগে ইহুদীদের রোশ হাশানাহ (Rosh Hashanah) উদ্যাপন উপলক্ষ্যে তিন দিনব্যাপী ঐতিহাসিক তেহওয়ার পালিত হল এতে বিশ্বব্যাপী ইহুদীদের সর্বশেষ পরিসংখ্যানও তুলে ধরা হয় ইহুদীর পরিচয় হল, পিতামাতার অন্তত একজনের মূসা আ.-এর ধর্মানুসারী হওয়া (তাদের ধারণামতে)

রাষ্ট্রীয় পরিসংখ্যান অধিদপ্তর ও জেরুজালেমের হিব্রু ইউনিভার্সিটির জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে ইহুদীদের আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে ১ লক্ষ ইহুদীর বৃদ্ধি ঘটেছে আর সারা বিশ্বে ইহুদীর সংখ্যা সর্বমোট এক কোটি আটান্ন লক্ষ যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ০.২ শতাংশ যার মধ্যে ৭৩ লক্ষ ইহুদী ইসরাইলের অধিবাসী আর অবশিষ্ট ৮৫ লক্ষ গোটা বিশ্বে

ছড়িয়ে আছে

ইসরাইলের বাইরে ইহুদীদের সবচেয়ে বড় কমিউনিটি আমেরিকায় যেখানে ৬৩ লক্ষ ইহুদীর বসবাস ফ্রান্সে ইহুদী জনসংখ্যা ৪ লক্ষ ৩৮ হাজার কানাডায় ৪ লক্ষ ব্রিটেনে ৩ লক্ষ ১৩ হাজার আর্জেন্টিনায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার জার্মানিতে ১ লক্ষ ২৫  হাজার রাশিয়ায় ১ লক্ষ ২০ হাজার অস্ট্রেলিয়ায় ১ লক্ষ ১৭ হাজার ব্রাজিলে ৯০ হাজার ৩ শ দক্ষিণ আফ্রিকায় ৫০ হাজার হাঙ্গেরিতে ৪৫ হাজার মেক্সিকোতে ৪১ হাজার আর হল্যান্ডে আছে ৩৫ হাজার ইহুদীর বাস

অন্যদিকে সারা পৃথিবীতে ফিলিস্তিনী নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৪০ লক্ষ এর মধ্যে ফিলিস্তিন অথরিটির অধীনে বসবাসরত নাগরিকের সংখ্যা প্রায় ৫৫ লক্ষ যাদের ৩২ লক্ষ অধিগৃহীত পশ্চিম জর্ডান ও ২৩ লক্ষ গাজায় বসবাস করছে আর ২০ লক্ষ ফিলিস্তিনী ইসরাইলের নাগরিক যা ইসরাইলের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৫ শতাংশ এ হিসেবে ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে (ইসরাইল অধিগৃহীত পশ্চিম জর্ডান ও গাজাসহ) প্রায় ৭৫ লক্ষ ফিলিস্তিনী আরব বসবাস করছে

আর ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের বাইরে ৬৫ লক্ষ ফিলিস্তিনী নাগরিক রয়েছে যার শতকরা ৬০ ভাগেরই বাস যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে পরিচালিত ৫৮টি আশ্রয়শিবিরে জর্ডানে ফিলিস্তিনের মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৪ ভাগ লোক বসবাস করে আর অবশিষ্ট ফিলিস্তিনীরা সিরিয়া, মিশর, লেবানন, উপসাগরীয় বিভিন্ন দেশ, ইউরোপ এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাস করে

প্রভাব-আধিপত্য এবং উপায়-উপকরণ ও সরঞ্জমাদির সহজলভ্যতার বিচারে ইহুদী নাগরিকদের তুলনায় ফিলিস্তিনীরা কোনো গণনার মধ্যেই পড়ে না পৃথিবীর আধিপত্য যেসব রাষ্ট্রের হাতে, সেখানকার এস্টাবলিশমেন্টে ইহুদীর প্রভাব ও আধিপত্য তার জনসংখ্যার গড় থেকেও অনেক বেশি

যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকার জনসংখ্যায় ইহুদীদের গড় শতকরা দুই দশমিক চার ভাগ যার মধ্যে শতকরা ৯১ ভাগ ইহুদী আমেরিকার ২০টি অঙ্গরাজ্যে বসবাস করছে এর মধ্যে পাঁচটি রাজ্যে (নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ফ্লোরিডা, নিউজার্সি, পেনিসিলভিয়া) সবচেয়ে বেশি শতকরা ৬০ ভাগ ইহুদী বাস করে সংখ্যালঘু হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকার বর্তমান কংগ্রেসের নিম্ন কক্ষে শতকরা ৭ ভাগ ও উচ্চ কক্ষে (সিনেট) শতকরা ১০ ভাগ ইহুদী সদস্য রয়েছে আর আমেরিকার এস্টাবলিশমেন্ট-এর নীতিনির্ধারণী পদগুলোতে অধিষ্ঠিত ইহুদীদের গড় আরও বেশি

বাইডেন প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্টনি ব্লিঙ্কেনের (Antony John Blinken) নাম সবার ওপরে সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্টের জরিপ অনুযায়ী বিশ্বের ৫০ জন প্রভাবশালী ইহুদীর তালিকায় নেতানিয়াহু দ্বিতীয় আর এন্টনি ব্লিঙ্কেন তৃতীয় স্থানে রয়েছে এরপর আছে উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী ভেন্ডি শেরম্যান (Wendy Ruth Sherman) (যিনি জুলাইয়ে অবসরগ্রহণ করেছেন), ইসরাইল, ফিলিস্তিন ও উপসাগরীয় দেশ বিষয়ক ডেপুটি স্ট্যান্ড সেক্রেটারি অব স্টেট মায়েরা রিযঙ্ক, হলোকাস্ট বিষয়ক বিশেষ পরামর্শক স্টুয়ার্ট এইজানস্ট্যাট (Stuart Elliott Eizenstat), ইহুদী কমিউনিটি বিষয়ক হোয়াইট হাউসের যোগাযোগ কর্মকর্তা শেলী গ্রিনস্প্যান (Shelley Greenspan), [ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান (১৯৮৭ থেকে ২০০৬) এলন গ্রিনস্প্যান নয়] সিআইএ-এর ডেপুটি ডিরেক্টর ডেভিড কোহেন (David Samuel Cohen), ইসরাইলে নিযুক্ত আমেরিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইরান বিষয়ক উপ-প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডন শেপরো ((Daniel Benjamin Dan Shapiro) ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স-এর ডিরেক্টর এভরিল হাইনেস (Avril Danica Haines), সাইবার সিকিউরিটির ডেপুটি এডভাইজার এন নোবরগর, হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি এলিজান্দ্রো ম্যাইয়ুর্কাস (Alejandro Nicolas Mayorkas), এনার্জি রিসোর্সেস-এর পরামর্শক অ্যামোস হোশেসটিন (Amos J. Hochstein), ডেনমার্কে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এলান লিভিনথাল (Alan M. Leventhal), জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এমি গাটম্যান (Amy Gutmann), মাল্টায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত কোন্সটেন্স মিলস্টিন (Constance J. Milstein), কাজাখস্তানের রাষ্ট্রদূত ডেনিয়েল রোজেনব্লাম (Daniel N. Rosenblum), কানাডার রাষ্ট্রদূত ডেভিড কোহেন (David L. Cohen), হাঙ্গেরির রাষ্ট্রদূত ডেভিড প্রেসম্যান (David Pressman), ভারতের রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি (Eric Michael Garcetti), ইটালির রাষ্ট্রদূত জ্যাক মারকেল (Jack Alan Markell), সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত জোনাথন কাপলান (Jonathan Kaplan), নরওয়ের রাষ্ট্রদূত মার্ক নাথানসন (Marc B. Nathanson), প্যারাগুয়ের রাষ্ট্রদূত মার্ক ওস্টফিল্ড (Marc Ostfield ), আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মার্ক স্টেনলে (Marc Robert Stanley), ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মার্ক গিটেনস্টিন (Mark Henry Gitenstein), বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত মাইকেল এডলার (Michael M. Adler), জাপানের রাষ্ট্রদূত রাহম এমানুয়েল (Rahm Israel Emanuel), পর্তুগালের রাষ্ট্রদূত রেন্ডি লেভাইন (Randi Charno Levine), জর্ডানের রাষ্ট্রদূত ইয়াল লেমপার্ট (Yael Lempert), পররাষ্ট্র অধিদপ্তরের মুখপাত্র নিডপ্রাইস, আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক কেন্দ্রীয় কমিশনের প্রধান শীরুন ক্লিনবোম, বাইডেন প্রশাসনের চীফ অব স্টাফ (২০২১ থেকে ২০২৩) রোন ক্লিন, হোয়াইট হাউসের বিশেষ পরামর্শক এডওয়ার্ড স্কেল, এন্টি স্মাটাজম (ইহুদ-বিদ্বেষ) নির্মূল বিষয়ক রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা ডেবির আল্পাস্টাড, সীমান্ত নিরাপত্তার তত্ত্বাবধায়ক রবার্ট জ্যাকসন, আর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে আছে আমেরিকার প্রতিনিধি মাইকেল টেলর, এটর্নি জেনারেল মেয়র্ক গারল্যান্ড, স্ট্যান্ড এটর্নি জেনারেল জোনাথন কেন্টর, অর্থমন্ত্রী জিনিট ইয়ালন, অর্থনীতি বিষয়ক পরামর্শ কাউন্সিলের প্রধান জারেড ব্রান্সটিন, আন্ডার সেক্রেটারি কামরস জেড কোলকো, সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের প্রধান গেরি গেনজালার, সাইন্স ও টেকনোলজি বিষয়ক পরামর্শক ইয়র্ক লেনডার সকলেরই ইহুদী ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে

এমন নয় যে, বাইডেন প্রশাসনে মুসলিম পদাধিকারী নেই তবে তাদের অধিকাংশই নিম্নপদস্থ দায়িত্বে নিয়োজিত; যাদের সংখ্যা সবমিলিয়ে শ-এর মতো সর্বোচ্চ স্তরে শুধু রাশাদ হুসাইনের নাম চোখে পড়ে বর্তমানে যিনি আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ে প্রেসিডেন্টের এম্বেসেডর এট লার্জ (সাধারণ রাষ্ট্রদূত)-এর দায়িত্ব পালন করছেন রাশাদ হুসাইন বুশ প্রশাসনের সময় ইসলামী কনফারেন্স প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার খ্যাতিমান দূত ছিলেন কিন্তু আজ পর্যন্ত দুয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া আমেরিকার কোনো মুসলিম নাগরিক আমেরিকার রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ পায়নি অথচ জনসংখ্যার বিচারে আমেরিকায় মুসলমানদের গড় এক দশমিক দুই ভাগ (তিন দশমিক পাঁচ মিলিয়ন) খ্রিস্টান ও ইহুদীর পরই মুসলিম হল তৃতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় কমিউনিটি

পাকিস্তান বংশোদ্ভূত আমেরিকার নাগরিক আদীল মুঙ্গী একজন বিশিষ্ট আইনবিদ গত নভেম্বর বাইডেন প্রশাসন জাতীয় আদালতের জজ হিসেবে তার নাম প্রস্তাব করেছিল, কিন্তু সিনেটের বর্তমান আইন বিষয়ক কমিটি এখনো এর মঞ্জুরি দেয়নি উপরন্তু সিনেটের কেউ কেউ তাকে তীক্ষèভাবে তিরস্কারের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে

ডেমোক্রেট রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী কমলা হ্যারিসের উকিল স্বামী ডগলাস এমহোফ নিউইয়র্কে সোয়া শ বছর ধরে বসবাসরত পোল্যান্ড বংশোদ্ভূত এক ইহুদী পরিবারের সদস্য কমলা হ্যারিস রাষ্ট্রপতি পদে জয়লাভ করলে ডগলাস এমহোফ হত আমেরিকার প্রথম ফার্স্টম্যান বর্তমানে সে ইহুদী-বিদ্বেষ নির্মূল বিষয়ক হোয়াইট হাউসের একটি দলের সদস্য ইসরাইলের সমালোচনাও তার ইহুদীবিদ্বেষ বলেই মনে হয়

রাষ্ট্রপতি জো বাইডেনের দুই পুত্রবধুর বংশগত পরিচয়ও ইহুদী বড় ছেলে বিও বাইডেনের স্ত্রী হেলী ইউলিভার পেশায় একজন উকিল আর ছোট ছেলে হান্টার বাইডেনের স্ত্রী মিলিয়িসা কোহন একজন ফিল্ম মেকার

বাইডেন পরিবারের ঠিক উল্টো ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার জামাতা জ্যারেড কুশনার সে একজন ধনাঢ্য ইহুদী ব্যবসায়ী পরিবারের সদস্য ও শ্বশুরের সিনিয়র এডভাইজার ইসরাইল ও উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর মাঝে তথাকথিত ইবরাহীমী চুক্তি সম্পাদনের পেছনেও সে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী কুশনারকে সৌদী বাদশাহ মুহাম্মাদ বিন সালমানের একজন অন্যতম ঘনিষ্ঠ বন্ধু মনে করা হয়

আগামীতে আমরা সবচেয়ে প্রভাবশালী লবিং গোষ্ঠী আমেরিকা-ইসরাইল পাবলিক এফেয়ার্স কমিটি (ইপক) সম্পর্কে আলোচনা করব কোনো কোনো বিবেচনায় যা আমেরিকার কংগ্রেস থেকেও বেশি প্রভাবশালী আর তার এতই প্রভাব যে, ইপককে রাষ্ট্রের ভেতর আরেকটি রাষ্ট্রও বলা যায় 

 

 

advertisement