আজ থেকে ১২ বছর আগে
স্বাধীনতার ৫৫ বছরে পা দিল দেশ। চার যুগেরও বেশি সময়ের পরিক্রমায় দেশ নানান চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে পার হয়েছে। শাসনের চেয়ে এদেশ শোষণের শিকার হয়েছে বেশি। বিপুল রক্তক্ষয়ের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীনতা জন্মলগ্ন থেকেই শকুনের শিকার হয়েছে। যাকে সামনে রেখে স্বাধীনতা অর্জন, তিনিই টুঁটি চেপে ধরেছিলেন স্বাধীনতার। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সহযোগিতার আবেগে ভারতের সাথে করে বসেন দাস চুক্তি। এরপর দেশে নির্বাচন হয়, ভোট কারচুপি হয়, দুর্ভিক্ষ হয়, একদলীয় শাসন কায়েম হয়। ১৫ আগস্টের ঘটনার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় নতুন যুগের।
মানুষ আশায় বুক বাঁধতে থাকে—মুসলিম দেশে ইসলামী শাসনের। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সবাই জনতার আকাক্সক্ষা ভুলে বসে, নিজের দেওয়া প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে চলে, কেবলা পশ্চিম থেকে সরিয়ে আরও পশ্চিমে সরিয়ে ফেলে। মুখে এক, কাজে-কর্মে আরেকের ফলে আবার দেশবিরোধী, ইসলামবিরোধী শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। নেতাদের দ্বারা প্রতারিত ও হতাশ জনতা সেই ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠীর ফাঁদে পড়ে। ইসলামবিরোধী শক্তিটি মাথায় টুপি ও হিজাব পরে অভিনয়ের মঞ্চে আসে। মানুষ ভুলে যায়; আবার ক্ষমতা দেয় তাদের নখরে। পরিণামে আবারও সেই স্বৈরশাসন, খুন, ত্রাস ও দমবন্ধ পরিবেশ। আবারও সংগ্রাম, আবারও নেতাদের প্রতিশ্রুতি, আবার কত শত মানুষের জান কুরবানী, আবার জালেমের পতন, আবার একদল মানুষের ক্ষমতায় আরোহণ, আবার জনতার আশায় বুক বাঁধা।
কিছুদিন যেতে না যেতে আবার জনতার স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা। এর পরও দেশ ও ইসলামের পক্ষে জনতার একতা। এর পরও বাংলার আকাশে কালো মেঘ ছেয়ে আসে। কারণ নেতৃত্বের আসনে যারা বসেছেন, তাঁরা না ইসলামকে চিনেছেন, না দেশকে ভালবাসতে পেরেছেন হৃদয়ের গভীর থেকে। ফলে তাঁরা ক্ষমতার জন্য জনতার দ্বারস্থ হলেও তারা চেয়ে থাকেন পশ্চিমের দিকে। তাদের হৃদয়ে বদ্ধমূল হয়ে থাকে, মসনদ টিকে থাকবে দিল্লির আশির্বাদে। আল্লাহর দেওয়া সময় ফুরিয়ে যায়। পশ্চিমা ও প্রতিবেশী দেশের প্রয়োজন পড়ে আরও অনুগত দাসের। ডানপন্থি নেতৃত্বের অযোগ্যতায় জেঁকে বসে দেশের ওপর পুরোনো শকুন। ২০০৯ সালে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে শুরু হয়ে ষোলো বছরের স্বৈরশাসন। এই শাসন এবং তাদের পূর্ববর্তী শাসন কোনো কালেই ইসলামবান্ধব ছিল না। তাদের শাসনামলে সব দিক থেকেই ইসলাম ও দেশ আক্রান্ত হতে থাকে। আল্লাহরও কী কুদরত, ডানপন্থিদের এই দুঃসময়ে তাদের সিংহপুরুষ নেতারাও ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে থাকেন। মুফতী ফজলুল হক আমিনী রাহ.-এর কথাই ধরা যাক। তাঁর ছেলে গুমের শিকার হলেন। তিনি গৃহবন্দি অবস্থায় ইহধাম ত্যাগ করলেন। তাকিয়ে দেখা ছাড়া কেউ কিছু বলতে পারল না।
গত ষোলো বছরে জালেম কীভাবে মজলুমের আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিল. সে অদ্ভুত কাহিনী অন্য কোনো দিনের জন্য তোলা থাকল। স্বৈরশাসক একের পর এক চাল দিয়ে যাচ্ছিল। আর আমজনতা সে চালের দিকে অসহায় তাকিয়ে ছিল।
এই সময়টাতে অনেক কিছু ঘটছিল। দেশে ইন্টারনেট ব্যাপক থেকে ব্যপকতর হচ্ছিল। মুষ্টিমেয় কিছু নিকৃষ্ট মনের মানুষ নেটের অপব্যবহার করে যাচ্ছিল। তারা অনলাইনে দিনের পর দিন আল্লাহ, তাঁর রাসূল, সাহাবায়ে কেরাম, উম্মাহাতুল মুমিনীন, ইসলামের বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে অশ্লীল, মিথ্যা, কুরুচিপূর্ণ কথা বলে যাচ্ছিল। প্রথম দিকে মিথ্যাকে নীরবতার মাধ্যমে পরাজিত করার নীতিতে সবাই এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু শাহবাগকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই ইতর শ্রেণির ইসলামবিদ্বেষীদের আস্ফালন দিন দিন বেড়েই চলছিল। ইসলামের বিরুদ্ধে তাদের এমন কুরুচিপূর্ণ অবস্থান সবাইকে আহত করছিল। আবশেষে হাটহাজারীতে অনুষ্ঠিত এক উলামা সম্মেলনে বর্ষিয়ান আলেমেদ্বীন আল্লামা আহমদ শফী রাহ. ১৩ দফা ঘোষণা করেন। সেই ১৩ দফা ছিল–
“১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কুরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
২. আল্লাহ্, রাসূল ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. শাহবাগ আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব ধরনের বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানীদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামায আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসীহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামী কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও ও খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব ধরনের অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসূলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-উলামা, মাদরাসা-ছাত্র, রাসূলপ্রেমিক জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ ও গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারা দেশের কওমী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষক, উলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতীবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-উলামা, মাদরাসা-ছাত্র ও রাসূলপ্রেমিক জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতিকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি প্রদান।”
এইসব দাবি আদায়ের লক্ষে ৬ এপ্রিল ঢাকা অভিমুখী লংমার্চ ঘোষিত হয়। সূচিত হয় শাহবাগের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের পুষে রাখা ক্ষোভ প্রকাশের সুযোগ। সারা দেশে বিপুল আয়োজনে শুরু হয় লংমার্চের প্রস্তুতি। অন্যদিকে লংমার্চ বানচাল করতে শুরু হয় নানা রকমের কূটকৌশল। এমনকি সরকারি ছুটির দিনে রাতের বেলা হরতাল ডেকে বসে বাম ঘরানার ২৭টি সংগঠন। সবধরনের গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়। ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়িও বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়। পথে পথে হামলা, মারধর, হয়রানী তো ছিলই। তবুও ৬ এপ্রিল পৃথিবীবাসী দেখল সফেদ শহর ঢাকা। দূরদূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে, জায়গায় জায়গায় গাড়ি বদল করে সাদা টুপি, সাদা কাপড়ের নবীপ্রেমিক জনতার ঢল। বাংলার ইতিহাসে এমন জনস্রোত বিরল। লংমার্চ-পরবর্তী সমাবেশের কেন্দ্র ছিল মতিঝিল শাপলা চত্বর। নির্ধারিত সময়ের আগেই সমাবেশস্থল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। যে দিকে চোখ যায় সেদিকেই নবীপ্রেমিক তাওহীদী জনতা। অসুস্থতা ও বয়সের ভারে ন্যুব্জ আল্লামা আহমদ শফী রাহ. বেলা তিনটার পর মঞ্চে উপস্থিত হন। ঘোষণা হয় হেফাজতের ১৩ দফা।
১২ বছর আগে ২০১৩ সালে ঘোষিত ১৩ দফার অনেক কিছু আজও প্রাসঙ্গিক। যদিও আওয়ামী লীগ পলাতক, শাহবাগের গণ জাগরণ মঞ্চ নেই, আল্লামা আহমদ শফীও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠিত হেফাজতও পরবর্তীতে আর নিজেদেরকে হেফাজত করতে পারেনি। বাংলার কোটি কোটি ধর্মপ্রাণ মানুষ এ জামাত এবং তার নেতাদের ওপর যে প্রবল আস্থা বুকে ধারণ করে জেগে উঠেছিল, কিছু জানা বা অজানা কারণে আর তা ধরে রাখা যায়নি। এক সময় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালও দম্ভের সাথে বলেছিলেন, ‘হেফাজত সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে।’ এভাবেই স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ অঞ্চলের মুসলিম উম্মাহর প্রবল আশা জাগানিয়া একটি স্বপ্ন দমে যায়। তবে এসব দেখে হতাশ হওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ ইতিহাস বরাবরই প্রমাণ করেছে, কোনো গোষ্ঠী যদি তাদের হক ও ন্যায়ের ঝান্ডা ধরে রাখতে না পারে, তাহলে একসময় আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হঠাৎ করেই অন্যদেরকে তাদের জায়গায় বসিয়ে দেন। অনেকেই বলেছেন, বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠা, ৬ এপ্রিল লংমার্চ, ৫ মে শাপলা ট্রাজেডি এবং এরপরের ইতিহাস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা হওয়া উচিত। একসময় হয়তো সেগুলো হবেও।
যাই হোক, উত্তাল সেই দিনের স্মৃতি ও আজকের পরিবর্তিত বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় পাঠকের সামনে ১৩ দফা তুলে ধরা হয়েছে। সেদিন আহমদ শফী সাহেবের পক্ষ থেকে লিখিত বক্তব্য পাঠ করা হয়। সেদিন অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেতা আল্লামা আহমদ শফী রাহ. তাঁর বক্তব্য শেষ করেছিলেন কুরআনে করীমের এ আয়াত দিয়ে–
نَصْرٌ مِّنَ اللهِ وَ فَتْحٌ قَرِیْبٌ.
[আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য ও আসন্ন বিজয়। –সূরা সাফ (৬১) : ১৩]
আল্লাহর সাহায্য ও আসন্ন বিজয়ের ঝলক আমরা ইতিমধ্যে অনেক প্রত্যক্ষ করেছি। শাহবাগীরা গর্তে লুকিয়েছে, শাহবাগীদের প্রধান পৃষ্ঠপোষকেরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। যারা গর্তে লুকিয়ে আছে কিংবা দেশে কোথাও ঘাপটি মেরে আছে, তারাও মাছের মতো খাবি খাচ্ছে। হেফাজতের ওপর চলা নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবি হেফাজতের বাইরে থেকে উঠছে। আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ে যতটুকু অসম্পূর্ণতা দেখা যায়, তা আমাদের গুনাহ ও অযোগ্যতার কারণে। যেদিন আমরা পরিপূর্ণ যোগ্য হয়ে উঠব, সূরা নূরে (২৪ : ৫৫) বর্ণিত ক্ষমতা ও পৃথিবীর মসনদে অধিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র দুটি শর্ত –ঈমান ও নেক আমল– পূর্ণ করতে পারব, সেদিনই আল্লাহর সাহায্য পূর্ণ হবে, বিজয় আসন্ন হবে।
শেষ বিকেলে মুনাজাতের মাধ্যমে লংমার্চ পরবর্তী সমাবেশের ইতি ঘটে। বাংলার ইতিহাসে ইসলামপন্থিদের নতুন প্রেসার গ্রুপ হেফাজত ইসলামের উত্থান ঘটে। লংমার্চে আসার পথে যেমন বাধা-বিপত্তির সৃষ্টি করা হয়েছিল, তেমনি ফেরার পথেও আওয়ামী লীগ ও বামপন্থিরা হামলা ও হয়রানী করতে থাকে। এই হামলা ও হয়রানী সেদিনই শেষ হয়নি। দিনের পর দিন বাড়তেই থাকে। নিত্য-নতুন ঘটনার পরিক্রমায় অনিবার্য হয়ে ওঠে ৫ই মে’র ঢাকা অবরোধ। সেই ঘটনাবহুল দিন নিয়ে হয়তো আগামীতে কথা হবে।